গুচ্ছ কবিতা * দীপংকর রায়
পাথুরে বোধনের কান্না শুনি কাশবনে
উৎসর্গ : দীপ্তিশিখা দাস
১১৫.
তোমার
এমন দুঃখ-সুখের গানে
গলা মেলাতে
বয়েই গেছে
জানা যখন হয়েই গেছে
সয়েই গেছে ব্যবধান!
ছবির মাদল ভাঙলো তবে
খানখান
কেন বলো তো ?
তার চেয়ে খেলাই যখন
সুখের ,
বেলায়-ই গাইবো গান
আপন সুখে ;
দুখে
আর বুকে
পাড়াই যতোই ঘুম
সেই তো রুখু পথেই ভিজি
একা ;
তোমার মেঘে ভাসবো কেন বলো
আমার আকাশ
সেই তো শুধুই দেখার ;
দেখি তো , খুঁজিও খানিক ,
তুমিও বেল্লিক
বোঝো না কিছুই
বেলা নেই, রাত্রি নেই
সকাল
বিকাল যে হলো
বোঝো না তাও !
তোমার ঋতু না হয় পাহাড় প্রমান
সমানে সমান
ভাবতে শেখ
খেলায়
মেলাও যদি
প্রাণ
তবেই বাজে
প্রলয় - মেঘের
গান !
বোঝো এবার
বোঝো
বাঁকা চাঁদের হাসি
কোলের উপর
যতোই শেখাও তাকে
সে রাখে তো ভালো ,
না হলে
এবার তুমি শুধুই কাঁদতে শেখো।
১১৬.
চাই নি তো জবাব
কুয়াশার এই ঘোরের কাছে
চাই নি ডাকের
বিভোরতাও ;
উন্মাদ হয়েছি
নিজের ভেতরে নিজেই
অজানা মূর্ছনায় ----
বিদ্যুতের তারগুলি
কুয়াশায় নিস্তেজ ঝুলে আছে ,
আমাদের আলো পৌঁছে দিতে ?
বাতাসের প্রয়োজন নেই। পাখা ঘোরে না ।
তাই , তার থাকা না থাকায়
চোখের আলোই যথেষ্ট ।
রাতে যদি বাথরুমের প্রয়োজন তখন সংযোগের কথাটি ;
এই রাতের বারান্দায়
প্রয়োজনীয়তা নেই ওই তারের ;
বারবার চমকে যাই
মনে হয় ফেলে আসা কালো কালো
হেরিকেনের মুখগুলি ;
বিদ্যুতের ঘাড়ে উঠে উন্মাদ নৃত্যে
মেতে উঠলো সে !
আমি পথ দেখতে না পেরে
গাছেদের দায়ী করলাম অনেক !
মনে মনে একটি রাত- প্যাচা বাদুড় হয়ে
লটকে গেলাম ।
হৃদয় কি ভেসে গেলো
অসহায় জোস্নায় ?
অন্ধকারের দিকে যেতে যেতে
নিঃসঙ্গ অবোধ মোহমূর্ছণায় বেঁচে উঠলাম
নাকি মরবার কথা
ভাবলাম আর একবার ?
১১৭.
কে কাকে সেই সত্যিটা বলে দেবে ,
কে কার ভেতরে বিড়বিড় করবে পথ ?
সেই মানুষটিকে
এই পৌষ
পথে পথে হারিয়ে যেতে দেখেছে ,
মানুষটির জন্যে
কোনো অনুকম্পা ছিল কি তোমার ?
আবর্জনার স্তুপের
ছায়াদের ঘুরতে দেখেছি অনেক ;
দেখেছি আবর্জনা সরিয়ে সে কেমন অমূল্য ইশারায় উন্মাদ হাসি
হাসতে হাসতে পথের মাঝে উলঙ্গ হয়ে গেলো ----
শ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে ,
পারে না কুকুর কুকুরীর সংযোগ ছিন্নতা নিয়ে কথা ;
কারণ, তারা কানেই নেয় না ,
আর নেয় না
যাকে তুমি উন্মাদ ঠাওরে নিলে ,
সেও কোনো দিকে না চেয়ে
মুখ ভেংচিয়ে চলে যায়...
সন্ধ্যার ইশারারা মাখছে গায় আকাশ !
বলো , কোন সত্য তোমার বিলাসী জীবনের জানলার
কাঁচ ভেঙে ছিল বলে মনে হলো ?
১১৮.
পাল্টে চলেছে চোখের উল্টো দিকে স্বপ্নরা
ধরতে পারছি না ।
পাকাল মাছের মতো পিছলে যাচ্ছে শরতের মোহমগ্ন
জলকথাদের ঢেউগুলি ......
কিছুক্ষন আগেও ছিলো বর্ণময় ;
দাঁড়াতে পারছি না
থরথর করে কেঁপে উঠছি ,
তার দু'বাহুর দিকে চেয়ে ;
তবে কি ফুরিয়ে আসছে
বেঁচে থাকার সব দৃষ্টিসুখের
এই যে জীবন পেয়েছিলাম যৌতুক ?
ভয় করছে
ফিরিয়ে দেও আমার প্রিয় ছবি
যে ছবিতে তুমি ছিলে বলেই
জীবন ছিলো
ছিল তোমাকে নিয়ে আমার সকল অপূর্ণতা ?
১১৯.
কে যেন কাশফুল হাওয়ায়
আরতি ভুলে যাচ্ছে দেবী মুখে----
জানি
আজ সে ছাতিম ফুলের সুবাস এড়িয়ে
হাতের রোমালের ভেতর সুগন্ধি ছড়িয়ে
ছড়ানো আকাশ ভরতি কেশবিন্যাসের প্রদর্শনীতে নাম লিখিয়েছে ----
তবু মোহবন্দী থেকে নিস্তার নেই আমাদের কারো ।
পথের এপাশ ঘুরে ওপাশে পিঁপড়েরা লাইন ভাঙছে ;
তুমি হেসো না,
এত হাসি ছড়িয়ে চলেছো বলেই ভয় হচ্ছে
বিষণ্ণ মুখখানির কথা ভেবে ;
তাহলে দিন রাত্রি সমান করে এত চিৎকার শুনতে হবে যে ,
আমরা কিছুতেই আর উৎসবের দিন গুনে
বেঁচে থাকতেই পারবো না -----
পাথর ঘুম চোখ খুলে ডাক দিয়ে গেল কাকে যেন !
আমি কি তার পাঁচ আঙুলের ভেতর
কিছুক্ষণ সুগন্ধি মেখে চেয়ে থাকবো ?
যেভাবে সে ছাতিম ফুলের সুবাস ছড়িয়ে উড়ে উঠলো
উৎসবমুখর দিনে---
১২০.
উৎসব এলো
আমি যেন কারো যাওয়ার দিকে
চেয়ে আছি অনন্তকাল -----
ঋতু আসে , চলেও যায়.......
গাছে গাছে শুকিয়ে যায়
যেভাবে একসময়ের কচি পাতারা ;
উৎসবের অংশিদার হতে গিয়েছিলাম বন্ধু সঙ্গতে ,
কেন জানি না কতবার
মনে হলো
শেষ কথা দিয়ে
কীভাবে ফুরিয়ে গেল উভয়ের দেওয়া নেওয়ার
চালাকির দিনগুলি ;
আজ বারবার উৎসবমুখর দিনে কেউ একজন ভিড় করলো।
আচ্ছা , আমি কি আবারও কারো অপেক্ষায় রয়েছি,
কখন সে আমায়
কিমা করাটা শেখাবে !
উৎসব আসে
চলেও যায়
আমি মনমরা হয়ে লক্ষ্য করি
কারো ছুরি চালানোর ধরণটা কেমন ছিল !
------তার মুখটি তো কোনোদিন দেখিনি !
যদিও তাকে ক'দিন না দেখতে পেলেই বলতাম ,
ভিডিও কল দেবো?
সময় পাল্টায় ।
একদিনও তাকে দেখিনি। যেভাবে দেখলে
জিভ বেয়ে নেমে আসে
সাপের ছোবোল ?
১২১.
গাছেরা চুল খুলে রোদ্দুরে শুখচ্ছে মাথা !
শীত ও সুষ্কতা এত প্রকৃতিতে ,
ঠিকঠাক বোঝার উপায় নেই
সময় কতো এখন ।
আচ্ছা
সে কি গত রাতে শিশিরে চাঁদে
লুকোচুরি খেলেছিল কুয়াশায় ?
চোখের ইশারারা যেন তেমন কিছুই
নানা কথার ছলে লুকিয়েছিল
অনেক অভিব্যক্তিতে ;
নাকি সেসব নিছকই
ডালেদের শিহরণে আটকে যাবার ভয় !
কোনটা যে...
ক্লান্ত ছিলাম খানিকটা যেন ,
টানা শ্বাস পাঠিয়েও থেমে গেলাম বুঝি !
সেও পর্যটন কথা বিলক্ষণ জানে যেন ;
দীর্ঘ লয়ে বুঁদ হয়ে যাওয়া তারপর .....?
যদিও আজ সে কথা যায়নি জানানো
যদিও সেসব বলা কওয়ার ভেতর
অনেক প্রতিপক্ষের ভিড় ----
তবু সে জানে ,
সবই যেন ক্ষমা কেবলই ;
অসহায়তা, পরাধীনতা
অনেক বাক্য আওড়ায় ;
মনে মনে বলি, এতই যদি রোদেদের খুনসুটি মাখো
এই দুপুরের ;
তবে কেন বিপরীতে পাঠাও না
প্রথম দিনের সুষমা খানিক !
ভেতর মহলে কী করে যে উঁকি দিয়ে
সেই দুর্বোধ্য সংলাপ মুখস্থ করি!
থরথর করে ধুলোয় বালিতে উড়ে যাই
দীর্ঘ কোনো পথে, কোথাও
যে রোদে আজ সে ফুটিয়ে তুললো
অনেক ঝুমকো জবাদের ;
কতকাল পাড়াগাঁর সে সব বাগানে
ঢুকিনি যেন , কতকাল !
১২২.
কবিতা নয়
কথোপকথনের অভিপ্রায় ,
অনন্ত অন্তরায় জুড়ে
ঘুরে ঘুরে
পাক খায় , তার কোলাহলে ?
কতরকম ভাবেই না সময়ের নিরীক্ষণ ;
অসীমের নিয়তি জোড়া !
হয়তো তবুতেই তার যাওয়া আসা
জুড়ে এই গান ,
এই সুর , এই মুর্ছনা !
কেন যে মনে হয়
কই , কথা হলো কই
দেখাই বা হলো কই ?
অদেখার মাঝেই
অনন্ত এই ,
অনন্ত কথপোকথন !
সকল ভাবনাই ভেসে গেল অনন্ত সে জলে ....
যে জলের অবস্থান
পথপাশের
একটি জলাশয়েই স্থির !
তোমারও থাকে কি ?
জানা হলো না তো সে কথাটি কোনোদিন !
১২৩.
ঘুরেফিরে হাত রাখি সেই গতিতেই ,
যা বস্তুতঃ গতিই না
ব্যবহৃত অভ্যাস...
অর্থাৎ যা কিছু গোপন,
সেটাই মান অপমানের?
কেনই বা অসহায়তা হতে যাবে
যাই আর না যাই
পাই তো তাতেই ভুল
এই ফুল কুড়াই
কোন অসীমের নিরিখে ?
যেদিকেই চাই
বাজে খালি খোল যেন
ফাঁপা, সবই ফাঁপা মাগো
তাই তো খেপারে লুকোই , কোটোরে ঢুকি ;
পেছনে পেছনে ছোটে অনন্তকাল
কে যেন তবু .......
১২৪.
মাঠে মাঠে চড়েছিলো অজানা বাসনারা
সে কথা রইলো সবই
অজানা !
সে শুধুই শস্য ফুলের ঝাঁঝালো মুগ্ধতার
নীলে নীলে
উড়ে বেড়ালো যেন ,
কোনো এক পাড়াগাঁর
খোড়ো চালের দিগন্তপ্রসারী ছবির ভেতর
একবার, দুইবার, হয়তো শতবার
তার নীল সে মাছিরা
হয়তো গভীর থেকে কোনো এক অসীমের প্রশান্তির ধার ছুঁয়ে ছুঁয়ে
ভেসে গেছিলো বহু দূর অবধি ----
হয়তো সে সব চেতনায় থেকেও নেই
হয়তো তন্দ্রায় জাগে
হয়তো তাইই নিরেট বরফকুচি হয়ে
উড়ে বেড়ায় কোথাও
তাতেও কি মুক্তি নেই তার !
হয়তো বলবে
না হলে নয়
না হয় যেওই ভুলে
শেষ সে উত্তর কারই বা জানা আছে কিছুই
উত্তরের অসাড় ব্যবহারিক সন্ধিক্ষণে
সকলেই বিষণ্ণ -----
জাগরণের ঘাড় ভাঙা
ছবি যেন সকলেই আজ ;
কেবলই ছবির মহড়া, আছে কি কিছুই!
*****************************************************************************************************



এক অন্তর্গত আত্মার বিষন্নতা ছেয়ে আছে কবিতাগুলিতে। নিজস্ব উপলব্ধি তীব্রতা বারবার অভিঘাত তুলেছে।
উত্তরমুছুন