ধুলোর সিংহাসন
দেবাশিস সাহা
পর্ব * ৮
( পূর্বানুষঙ্গ : সপরিবারে পুরী বেড়াতে যায় অশোক। সঙ্গে যায় ভাগনা নিলু,বড় ভায়রা প্রদীপদা ও শ্যালিকা রিনাদি এবং তাদের একমাত্র ছেলে গোগোল ও প্রদীপদার বন্ধু কাশীদা। জীবনে এই প্রথম পুরীর সমুদ্র দেখল অশোক। আনন্দ ও উত্তেজনায় যারপরনাই বিহ্বল হয়ে পড়ে। অসম্ভব এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয় মন। পুরীর সমুদ্র তীরেই অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায়, একদা কলেজ বন্ধু বিজন ও তার পরিবারের সঙ্গে। এক অভূতপূর্ব নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয় । সব মিলিয়ে ছ'টা দিন যেন ছ'টা মুহূর্তের মতো কেটে যায়। বাড়ি ফেরার পর....)
পুরী থেকে ফিরে আসার পর অলির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ক'দিন ধরে জ্বর। সর্দি-কাশি। এমনিতেই ওর এলার্জির প্রবলেম। তার উপর মাইগ্রেনের ব্যথায় মাঝে মাঝে কাহিল হয়ে পড়ে। থাইরয়েডের সমস্যা পাকাপোক্তভাবে শরীরে বাসা বেঁধেছে। আগে চলত এলট্রক্সিন-৫০ । শেষবার থাইরয়েড টেস্ট করার পর ডাক্তার এলট্রক্সিন-৭৫ প্রেসক্রাইব করেছে। সেটাই চলছে নিয়মিত। রাতে শোবার আগে এলার্জির জন্য জুলোকাস্ট এলসি একটা আর সকালে ঘুম থেকে উঠে এলট্রক্সিন-৭৫ একটা । এই রুটিন চলছে বেশ কয়েক বছর। ক'দিনের অনিয়মে উপসর্গগুলো আরও বেড়েছে। জ্বর তো আছেই। চোখমুখ লাল। থেকে থেকে কাশি। আর নাগাড়ে হাঁচি চলছে সমানে।
অন্যদিন পাঁচটার আগেই উঠে পড়ে। উঠে আধা ঘন্টা যোগা করে। তারপর ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ উঠেছে অনেক আগেই। কাশির দমকে ভালো করে ঘুম হয়নি রাতে। ঘুমোতে পারেনি অশোকও। এমনিতে অশোক তাড়াতাড়িই ওঠে । কিন্তু বিছানা ছাড়ে না। অলি বেড-টি এনে পড়ানো আছে বলে ঠেলে গুঁতিয়ে তোলে।
উপমা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আজ ওর ক্লাস আছে। সকাল এগারোটা থেকে। বেরোবে দশটা নাগাদ। বিএ ফাইনালের পরপরই অশোক ওকে সরকারি চাকরির প্রিপারেশনের জন্য ভর্তি করিয়েছে একটা কোচিং-এ। বিএ-র রেজাল্ট বেরোতে বেরোতে পাঁচ-ছ মাস । বেকার বসে থেকে কী করবে। কিছু একটা শিখুক। চাকরি-বাকরির যা আকাল! এই উদ্দেশ্যেই ভর্তি করিয়েছে অশোক। কোচিংটা শিয়ালদার মৌলালিতে। দু'দিন ক্লাস থাকে। বৃহস্পতি আর রবি। তবে রবিবার টাইমটা বেশি। সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৫টা। বৃহস্পতিবার ১২ টা থেকে ৪ টে। অশোক নিজে গিয়ে ওই ইনস্টিটিউশন-এর সঙ্গে কথা বলে ভর্তি করিয়ে এসেছে। প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী । ফ্যাকাল্টিও ভালো। সব খোঁজখবর নিয়ে দেখে শুনে অশোকের মনে ধরেছে ইনস্টিটিউশনটা। ডিম্পু, উপমার এক মাসতুতো ভাই , এখান থেকে পড়েই ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। ডিম্পুর মা-ই অশোককে জোর করেছে-- ' অশোক, উপমাকে এখানেই ভর্তি করাও। টাকাটাও কম। আর এদের রেজাল্টও ভালো হয়। অন্য সব জায়গায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজারের কমে কোনও গল্প নেই।' ভেবেচিন্তে তাই এখানেই ভর্তি করিয়েছে অশোক। প্রথম প্রথম একটু ভয় পাচ্ছিল, উপমা একা একা এতদূর আসবে কী করে! বাবা মা ছাড়া শিয়ালদার এদিকটাতে ও খুব একটা আসেনি। ওর স্কুল ছিল গড়িয়া-সোনারপুর সাইডে। অশোক নিজে যে দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে, সেটাও সম্ভব নয়, কারণ রোববারে ওর বেশি পড়ানো থাকে। তাই কী ভাবে যেতে হবে ,দু'-একদিন সঙ্গে নিয়ে গিয়ে রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিয়ে এসেছে। অলি গাঁইগুঁই করছিল প্রথম প্রথম, ' না আমিই দিয়ে আসব নিয়ে আসব।'
' তাই হয় নাকি? এটা কখনো সম্ভব? ও কি এখনো নাইন-টেনে পড়ে? '
' তাহলেও...' কিন্তু কিন্তু করছিল অলি।
'দ্যাখো, চাকরি পেলেও কি তুমি মেয়েকে অফিস দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে, তাই কখনো হয়?'এইভাবে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অলিকে নিরস্ত করেছে অশোক।
আজ অলির শরীরে যে এতগুলো রোগ বাসা বেঁধেছে, সে ওর ক্রমাগত অনিয়মের ফল। উপমা যখন স্কুলে পড়ত, রোজ দিয়ে আসা নিয়ে আসা তো ছিলই, সেইসঙ্গে রেশন ধরা,বাজার করা, কেরোসিন তেল তোলা সব কাজ ও একা হাতে সামলাত। দু'পয়সা বাঁচাবে বলে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে,, দেড়-দু'কিলোমিটার হেঁটে বাড়িতে আসত, সঙ্গে রেশন কিংবা বাজারের ব্যাগ। অশোক কত বারণ করেছে, কেরোসিন তেল ধরাটা ছেড়ে দাও, দেড়-দু'ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। লাইন নিয়ে মারামারিও বেঁধে যায় কখনও কখনও। মাত্র তো তিনটে কার্ড। হাফ লিটার করে দেড় লিটার তেল পাও। তার জন্য এত খাটনি! তাছাড়া আমাদের তো কেরোসিনে রান্না হয় না, গ্যাসেই রান্না করো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অশোককে ধমকে চুপ করায় অলি ' তুমি থামো তো, কষ্ট তো আমি করি, তোমাকে তো বলি না।' অশোক চুপ করে যায়। জানে, এই দেড় লিটার তেল বাইরে বিক্রি করে অলি যে পয়সা পায়, তা জমিয়ে জমিয়ে মেয়েকে হয়তো একটা নাইটি কিংবা চুড়িদার কিনে দেয়।
উপমা যখন মাধ্যমিক পাশ করে এগারো ক্লাসে ভর্তি হল, তখন খাটনিটা গেল আরও বেড়ে। নিজে সময় দিতে পারবে না বলে মাধ্যমিক অব্দি সায়েন্স গ্রুপের জন্য বাড়িতে একটা টিচার রেখেছিল। কিন্তু এবার আর তা সম্ভব হল না। ইংলিশ জিওগ্রাফি সোশিয়লজি হিস্ট্রি সব সাবজেক্ট-এর জন্যই আলাদা আলাদা টিচার লাগবে, স্কুল জানিয়েছে। তা-ও যে কোনও টিচারে চলবে না। ওদের স্কুলের টিচারের কাছেই পড়তে হবে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এ এক চতুর খেলা। টিচারদের মাইনে জোগানোর জন্য নিজের কোচিংয়ে দিনরাত মুখ গুঁজে থাকত অশোক। আর অলি নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে মেয়ের লেজ হয়ে ছুটে বেড়াত সকালে সুদেষ্ণা ম্যাডাম, তো বিকেলে উজ্জয়িনী আন্টি কি সুদীপ স্যারের বাড়ি। অন্যান্য গার্জিয়ানদের সঙ্গে ঘন্টা দুয়েক বসে থেকে ছুটি হলে মেয়েকে মেয়ে ফিরত।
' কী কিগো ,তুমি আজ পড়াতে যাবে না?' কাশতে কাশতে বলল অলি।
' যাব। কাজগুলো সেরে নিই।'
' কী কাজ?'
' ঘর ঝাড় দিয়ে,বাসনগুলো মেজে,রাতের ছাড়া জামা কাপডগুলো কেচে,তারপর যাচ্ছি।'
' না, অতকাজ তোমার করতে হবে না। আমি আস্তে আস্তে সব করে নেব।'
' তুমি করে নেবে? আবার জল ঘাটবে? জ্বর কমেছে? দেখি, এগিয়ে এসে অলির কপালে হাত রাখে অশোক।
' গা তো বেশ গরম। ''
' ও ঠিক হয়ে যাবে। সর্দি-জ্বর তো। তুমি বরং চা-টা বসাও, চা খেয়ে পড়াতে যাও। আর পারলে ছাত্রদের কাউকে দিয়ে দুটো প্যারাসিটামল কিনে পাঠিয়ে দিয়ো ।’
'না, আর ডাক্তার না-দেখিয়ে উল্টোপাল্টা ওষুধ খেতে হবে না। চার -পাঁচদিন তো খেলে, কমল?'
' দেখি না আর একটা দিন। '
' না আর দেখতে হবে না। আমি কোচিং ছুটি দিয়ে আধ ঘন্টার মধ্যে আসছি। তুমি রেডি থাকো, ডাক্তার-খানা যাব।'
' কোন ডাক্তার-খানা?'
' কেন, অ্যাপোলো নার্সিংহোম, ওখানে ভালো ভালো ডাক্তার থাকে।'
অলি ঝপ করে বিছানা থেকে নামে। এমন ভাব দেখায় যেন কিছুই হয়নি, শরীর ওর পুরো ফিট। 'নামলে যে?'
' চা-টা বসাই, তুমি তো বকেই চলেছে।' মনে মনে ভাবে অলি ,অশোকের বাস্তববোধ বড় কম। উপমাকে ভর্তি করাতে এই সেদিন লাগল হাজার দশেক। পুরী ঘুরে এল,তাতেও খরচ হয়েছে লাগামছাড়া। এখন আবার নার্সিংহোম নিয়ে যেতে চাইছে। ওখানে ডাক্তারের ভিজিট পাঁচ-সাতশো টাকার কম না। আর শুধুই কি ভিজিট? গেলেই তো ডাক্তার খসখস করে গাদা গুচ্ছের টেস্ট লিখে দেবে। তার পয়সা জোগাড় করতে আবার ধার। হাত পাতো কারো কাছে। এসব অশোককে বুঝতে না-দিয়ে অলি বলল, ' ডাক্তারখানায় যাবে তো বলছ, আজ কী বার জানো?'
' কেন, রবিবার।'
' রবিবারে ভালো ডাক্তার থাকে না।' অশোক চুপ করে যায়। কথাটা মিথ্যে না। অশোক চুপ করে আছে দেখে অলি বলে, ' কাল শ্রীগুরুআশ্রম-এ দেখাব। তার মধ্যে আর যদি জ্বর না আসে, তাহলে তো আর ডাক্তারখানা যাওয়ার প্রশ্নই নেই। এতক্ষণে অশোকের মাথায় ঢোকে,অলি কেন অ্যাপোলো ছেড়ে শ্রীগুরুআশ্রম যেতে চাইছে। ওখানে মাত্র পঞ্চাশ টাকার টিকিট করলেই ডাক্তার দেখানো যায়। টেস্ট- ফেস্ট দিলেও টাকা লাগে অনেক কম।নার্সিংহোম টোম ওইসব বড়লোকী চাল আমাদের মানায় না, অলির সাফ কথা।
' আর দেরি করছ কেন, তাহলে এবার পড়াতে যাও।'
' যাচ্ছি।' অলির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অশোক কিছুক্ষণ। কত কী যেন ভেবে নেয় তার মধ্যে। কী আছে সেই তাকানোয়? কৃতজ্ঞতা? ভালোবাসা? যৌনকামনা? কেউ পড়তে না পারলেও, অশোকের এই দৃষ্টি পড়তে পারে অলি। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে, দু'পা পিছনে সরে যায়। হাতটা টেনে ধরে অশোক, ' দেখি এখন জ্বর আছে নাকি? ' কপালে হাত রাখে। তারপর এক ঝটকায় বুকে টেনে নেয়।
' ছাড়ো ছাড়ো, মেয়ে উঠে পড়বে।’
পড়াতে গিয়েও আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে এল অশোক, হাতে চারটে ক্যালপল।
' চলে এলে?'
' সেরকম কেউ আসেনি, শুধু ইলেভেনের শান্তনু আর অতনু ছাড়া।'
' কেন?'
' আরে, পরশু কালীপুজো না, মনে হয়, বাজি বন্দুক নিয়েই ব্যস্ত সবাই।'
' শান্তনু অতনুকেই পড়াতে।'
' ওরা পড়তে চাইল না, বলল, বাবার সঙ্গে যাবে।’
' কোথায়?'
'চাম্পাহাটি।'
'কেন?'
' বাজি কিনতে।'
' বলল, আর তুমি ছেড়ে দিলে? ওদের কথায় বিশ্বাস আছে?ফোন করে দেখতে, সত্যিই বাবা যেতে বলেছে কিনা।'
' পারতাম। কিন্তু দু'জনের জন্য ঘন্টা দুই বসে থাকতে আমারও ভালো লাগল না। ঘরে তোমার এই অবস্থা। উপমাও তো বেরবে।'
' তা তুমি এসে করবেটা কী? আমার জ্বর সর্দি-কাশি তোমার শরীরে নিতে পারবে?'
' তা না-পারলেও আলুসিদ্ধ-ভাতটা তো বসাতে পারব। উপমা কিছু খেয়ে যাবে না? ফিরতে ফিরতে তো সেই সন্ধে গড়াবে।'
'সে তো পারবে,কিন্তু দু'দিন বাদে যখন ওদের বাবা এসে বলবে, অশোক এই দিন পনেরো পুজোর ছুটি দিলে, স্কুল খুললেই তো অ্যানুয়াল। এত ঘনঘন ছুটি দিলে ওরা পাশ করবে কী ভাবে। তখন ভালো লাগবে শুনতে?
' সে তখন দেখা যাবে। উত্তর আমারও রেডি। পরীক্ষার সময় আমিও তো ওদেরকে ডেকে এক্সট্রা পড়িয়ে দিই ,না-কি। এমনি এমনি সব পাশ করে। ছাড়ো তো ওসব। তুমি এখনি একটা ওষুধ খেয়ে নাও।' বলতে না বলতেই একটা ট্যাবলেট ছিড়ে অলির হাতে দেয় অশোক, ' কিছু খেয়েছো তো?'
' একটু আগেই তো চা-বিস্কুট খেলাম।'
'তবু একটু কিছু খেয়ে খাও, অ্যালোপ্যাথ ওষুধ খালি পেটে খেতে নেই।
' সে খাচ্ছি, শোনো -----'
' কী?'
' আর যদি জ্বর না আসে, বিকেলে একটু বেরোব।'
'কোথায়? '
' কোথায় আবার, বাজারের দিকে।'
' কেন? '
' প্রেসার কুকারের সিটি দেওয়ার ভালবটা খারাপ হয়েছে, উপমা আজ ভাত বসিয়েছে গামলায়।'
' উপমা ভাত বসিয়েছে?'
' হ্যাঁ, ক্লাসে যাবে না! নিজেই আলুসিদ্ধ ভাত ফুটিয়ে নিয়েছে।'
' ও আচ্ছা। '
' আজই সারিয়ে আনতে হবে।কালীপুজো ভাইফোঁটার পরেই তো তোমার পড়ানোর চাপ বেড়ে যাবে। তখন আর বেরনো যাবে না। '
কথাটা ঠিক। নভেম্বরের মাঝামাঝি মাধ্যমিক ,উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্ট শুরু হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় স্কুলগুলোর অ্যানুয়াল। এই সময়টা দম ফেলার সময় থাকেনা অশোকের। এক্সট্রা ক্লাস নিতে হয়। গবেট ছাত্রগুলোকেও যে করে হোক পাশ করানোর ব্রত নেয় অশোক। না-হলে নতুন সেশানে ছাত্র সংখ্যা কমে যাবে। ছাত্র কমলে আয় কমবে। আয় কমলে কপালে ঢেউ খেলবে দুশ্চিন্তার শ্রাবণ মেঘ। একটু ভেবে নিয়ে অশোক বলে, ’ ঠিক আছে যাব। তবে আর যদি জ্বর না আসে।'
' আসবে না, এখন অনেকটা ভালো লাগছে।'
' না এলেই ---'
' আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ ড্রইং রুমের টেবিলে ফোনটা রেখে এসেছিল অশোক। একটানা বেজে চলেছে। কথাটা শেষ না করেই দৌড়ল ধরতে। ধরার আগেই লাইনটা কেটে গেল।
'এ রিংটোন আবার কবে লাগালে?'
' কাল ব্যালান্স ভরালাম না! ফোনের দোকানের ছেলেটা জোর করে দিয়ে দিল।'
'এই বয়সে আবার মনের মানুষ খুঁজছ? ' হালকা রসিকতা অলির।
'আস্তে বলো, মেয়ে ও ঘরে রেডি হচ্ছে, শুনতে পাবে।' ' শুনলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? তোমার মেয়ে কি কিছু বোঝে না?'
আবার বেজে উঠল ফোনটা ' আমি কোথায় পাব......' নিলু (ভাগনা ) স্ক্রিনে অশোক দেখে নিল নামটা।
' হ্যাঁ ,নিলু বল।' লাউড স্পিকারে দিয়েই কথা বলছে অশোক। খানিকটা যেন ' মনের মানুষের ' ব্যাপারে অলির সন্দেহ যাতে গাঢ় না হয়।
' মামা, একটা খুশির খবর আছে।'
' কী রে, বল। '
' আমি একটু আসব মামা? এসেই বলছি।' আনন্দ আর উত্তেজনা উপচে পড়ছে নিলুর কণ্ঠস্বরে।
' হ্যাঁ হ্যাঁ ,চলে আয়।'
' আমি জানি ' ও ঘর থেকে এসে উপমা বলল, ' নিলুদা আমাকেই আগে ফোন করেছিল।'
' তাই! কী বলল রে? '
' প্রথমে জিজ্ঞেস করল বাবাই বাড়িতে আছে কিনা তারপর বলল ও নেট কোয়ালিফাই করেছে,ৱ্যাঙ্ক হয়েছে ৯ '
' তাই! '
ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল অশোক, ' দারুণ খবর, দারুণ!'
' তবে দ্যাখ, নীলুদা কত কষ্ট করে পড়াশোনা করে এই জায়গায় পৌঁছল, দু'দিন বাদে প্রফেসর হয়ে যাবে আর তুই অনার্সটাই রাখতে পারলি না। ' উপমাকে ঠেস দিয়ে কথাটা বলে অলি।
'মা, অমনি শুরু করলে ' বলেই বাবার দিকে ফিরে মুখ গোমড়া করে বলল, ' বাবাই,আমি আসছি।''
'ক্লাস শেষ হলেই একটা ফোন করবি।' অলি যোগ করল, ' তাড়াতাড়ি আসবি, কিন্তু।'
' হ্যাঁ, ঠিক আছে।'
উপমা বেরোতেই সাইকেল নিয়ে ঢোকে নিলু। গেটের মুখে দেখা ' কনগ্রাচুলেশনস নিলুদা।'
' থ্যাংক ইউ।'
' যা উপরে যা, মা-বাবাই আছে।'
দরজা খুলেই দাঁড়িয়েছিল অলি। যতক্ষণ না উপমা দৃষ্টির আড়াল হয়, তাকিয়ে থাকে টা-টা করবে বলে। নিলুকে ঢুকতে দেখেই বলে, ' যা ঢুকে পড় নিলু,মামা আছে ভেতরে।’
অশোক নিলুর অপেক্ষাতেই ছিল। ' আয় আয়' নিলুকে ডেকে নিল ভিতরে।
' মামা তোমার ইচ্ছেটা পূর্ণ হল ' বলতে বলতে অশোককে প্রণাম করে নিলু।
' থাক থাক, আরও বড় হ, এত বড় যারা এতকাল তোকে দূর ছাই করেছে, তাদের যেন ঘাড় উঁচু করে তোকে দেখতে হয়।'
' হ্যাঁ মামা, তোমার জন্যই হচ্ছে সবকিছু ।'
অশোক চুপ করে থাকে। চোখে আনন্দাশ্রু গড়ায়। চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে বলে, ' আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে রে নিলু ' অস্ফুটে কথাটা বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় অশোক। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত স্মৃতি... নিলুর বাবা মারা গেল যক্ষায়....সদ্য বিধবা বোনটার বুকফাটা হাহাকার... কতই-বা বয়স তখন নিলুর... চার কি পাঁচ... ওইটুকু শিশু কোথায় যাবে, কী করবে...ভেবে দিশেহারা অশোক....ইতিমধ্যে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে লীনার শ্বশুর বাড়ির লোকজন...এদিককারও সব আত্মীয়-স্বজন। এমন সময়ে ত্রাতা হয়ে উঠল সেই বড়দি অপর্ণা। একদিন ফোনে ডাকল অশোককে, বলল, ' নিলুর পড়াশোনার খরচ আমি চালাব, অশোক ,তুমি শুধু নিলুকে তোমাদের সঙ্গে তিনবেলা একটু খেতে দিয়ো । ডাল ভাত ফ্যান ভাত, তোমরা যা খাও। জানি তোমার কষ্ট হবে, তবু দ্যাখো ওর তো আর কেউ থাকল না...' বলতে বলতে কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এসেছিল অপর্ণার।
জীবনে এমন একজন শ্রদ্ধা ভালোবাসার মানুষ থাকা প্রয়োজন, যাঁর কোনও কথা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা চলে না। শুধু নতজানু হও ,আদেশ মনে করে পালন করে যাও তাঁর প্রত্যেকটা কথা। অশোকের জীবনে সেই শ্রদ্ধা ভালোবাসার মানুষটি বড়দি, অপর্ণা। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সেই অপূর্ণ জায়গাটা অপর্ণাকেই দিয়ে এসেছে সে। এক্ষেত্রেও বড়দির কথাটা আদেশ মনে করে মাথা পেতে নিল অশোক,যদিও জানে, তারই তো তিনবেলা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।
' মামা ' নিলুর ডাকে বাস্তবের মাটিতে ফেরে অশোক। ' নিলু কী বলতে এসেছে শোনো।' ততক্ষণে অলি এসে দাঁড়িয়েছে ওদের কথার মাঝখানে। মামিকে প্রণাম করে নিলু বলতে থাকে, ' মামা-মামি ,মা বলেছে আজ রাতে তোমরা আমাদের ঘরে খাবে।'
' তাই! ' বিস্ময় আর খুশি অশোকের কথায়।
কী মেনু হবে রে নিলু?' অলির কৌতুহল।
' মাংস বিরিয়ানি '
' কে রান্না করবে?'
' পুচকাদা।'
' পুচকাদা কে রে ?'
নিলু বলে, 'পুচকাদা আমার এক বন্ধুর দাদা। হেব্বি বিরিয়ানি রান্না করে,বড় ক্যাটারিং আছে ওদের।'
' আর কাকে কাকে বলেছিস?'
' মেজ মামা, মেজ মামি ,বুড়া....মোটামুটি আমাদের আত্মীয় স্বজন সবাই আর আমার দু'-চারজন বন্ধু-বান্ধব।'
' আত্মীয়-স্বজনদের বলতে গেলি কেন, কেউ কোনওদিন দুটো টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে ?' ঝাঁজের সঙ্গে বলে অলি।
' তা না করুক, এটাই উত্তর ,এবার যদি নিজেদের বিবেক দংশন হয়।'
' ছাই হবে। বিবেক দংশন! সে বোধ ওদের আছে?' অলির কাঠখোট্টা জবাব।
' আরে নেই বলেই তো বোধের দরজায় ঘা মারতে হবে এবং এটাই সেরা উপায়, লজ্জা দেওয়া, কী বলিস নিলু ? '
'একদম মামা, আমি তো তোমার আদর্শেই বড়, আমিও তাই মনে করি। মা-ও বারণ করছিল,বলছিল শুধু ছোট মামা-মামি,উপমা আর তোর দু' চারজন বন্ধুদের বল। আমি মাকে বোঝালাম, না মা, তা হয় না,ওরা বুঝুক।'
প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে নিলু বলে , ' উপমা কখন ফিরবে মামি?'
' সন্ধে -সন্ধি। '
'বোনকে নিয়ে তোমরা তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু।'
নিলু চলে যেতেই গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করল অশোক, ' আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ... ।' 'রবীন্দ্রসঙ্গীত ছেড়ে হঠাৎ আধুনিক গান ধরলে?' বাঁকা প্রশ্ন অলির।
' আরে ,গানের কি আবার জাত বিচার আছে, মনের নানান সূক্ষাতিসূক্ষ চাওয়া-পাওয়ার কথা নিয়েই তো গীতিকাররা গান লেখেন। জানো অলি,আজ না আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। ভাবো, কী ভীষণ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে করে নিলু আজ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছল। আমার ইচ্ছে করছে দু'হাত তুলে নাচি আর গলা ছেড়ে গান গাই।'
' সে নাচো,গাও...কিন্তু আজ তো তাহলে প্রেসার কুকারের ভালবটা সারানো হল না।'
' আজ না হোক, কাল হবে,ভাবছ কেন? পড়ানো হয়ে গেলে সকালে আমি নিজে গিয়ে তোমাকে সারিয়ে এনে দেব।' ফুরফুরে মেজাজ অশোকের।
' তা দিয়ো , তবে তোমার নাচ-গান শেষ হলে একটু কাজের কাজ কিছু কোরো।'
' কাজের কাজ! কী গো? '
' ভুলে যাচ্ছ, চিরন্তন বলেছিল না, মাসখানেকের মধ্যে বইমেলা সংখ্যার জন্য লেখা পাঠাতে? পাঠিয়েছো? মাঝখানে তো ডিসেম্বর , তারপর জানুয়ারিতেই তো বইমেলা।'
' না পাঠাইনি, আচ্ছা অলি, ক'টা কবিতা যেন পাঠাতে বলেছিল?'
' দ্যাখো কান্ড! আমাকে কি বলেছিল, মনে তো হচ্ছে গুচ্ছ কবিতা পাঠানোর কথা বলেছিল।সেই জন্যই তো তুমি মাসখানেক সময় চাইলে, সেই পুরী যাওয়ার আগে।'
' ও ইয়েস, ইয়েস মনে পড়েছে। আজ নিলুদের বাড়ি থেকে ফিরে রাতেই বসব, দেখি কোন কবিতাগুলো পাঠানো যায়।'
নিলুদের বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরতে ফিরতে রাত্তির দশটা গড়াল। হাত মুখ ধুয়ে অশোক লেখার টেবিলে বসল। মন-প্রাণ খুশিতে ডগমগ। ডায়রিটা টেনে নিল। না,স্বরচিত কবিতার ডায়রি নয়। দিনলিপি লেখার ডায়রি। কবিতা বাছতে আজ আর ভালো লাগছে না। ডায়রি লিখতে ইচ্ছে করছে খুব। এটা অশোকের বরাবরের অভ্যাস। মন খুব আনন্দ বা বিষাদাক্রান্ত হলে ডায়রি লিখে হালকা হয়। তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে আজও লেখায় মনোনিবেশ করল ----
রবিবার
রাত ১০ টা ১৫
খুব একটা আনন্দের দিন গেল আজ। কী রকমের এই আনন্দ তা কী ভাবে ব্যক্ত করি। কতভাবেই তো আমরা আনন্দ পাই। সিনেমা দেখে, নতুন জামা কাপড় পরে , প্রিয় কোনও বই পড়ে, কখনও-বা ছবি এঁকে, কবিতা লিখে, শখের বাগান করে কিংবা দূর আকাশের রামধনু দেখে। কিন্তু আমার আজকের আনন্দটা ভিন্ন স্বাদের। এক বিরাট পাওয়ার। এক গভীর পরিতৃপ্তির। কী সেই আনন্দের উৎস, আগে সেটা বলি।
নিলু ইতিহাসে পিএইচডি করার সাথে সাথেই নেট কোয়ালিফাই করেছে।এবং একটা বড় স্কলারশিপ পেয়েছে। তাই আজ আমাদের ফ্যামিলির সক্কলকে নিলু মটন বিরিয়ানি উইথ চিকেন কষা খাওয়াচ্ছে। এটা ওর অনেক দিনের ইচ্ছে। আমি তাই 'না' করিনি। বড়দিও সম্মতি জানিয়েছে।
আমি যখন পুচকার রান্না করা বিরিয়ানি মুখে দিচ্ছি, মনের মধ্যে চলছে আনন্দের প্লাবন। তার ঢেউ এসে লাগছে খাবার টেবিলে। আনন্দে মাখামাখি হচ্ছে মাংস-বিরিয়ানি। তবে তা মাংস-বিরিয়ানির স্বাদের জন্য যতটা না, তার চেয়ে ঢের বেশি নিলুর একের পর এক জীবন যুদ্ধের কঠিন লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।
দাঁত দিয়ে মাংস ছিঁড়ছি আর মনের পর্দায় বার বার ভেসে উঠছিল নিলুর সেই শুকনো মুখটা। ওর না খেতে পাওয়ার যন্ত্রণাক্লিষ্ট দিনগুলো যেন পায়ে পায়ে হেঁটে আসছিল। চোখের সামনে ভাসছিল ওর মলিন বিবর্ণ বোতামবিহীন স্কুল শার্ট। বিরিয়ানির পাশাপাশি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল খিদের সময় ওর মুখের সামান্য ডালভাত ক'টা।
সেই নিলু আমাদের সকলকে খাওয়াচ্ছে, ডাল-ভাত নয়, মাংস-বিরিয়ানি ----এ আনন্দ এই ছোট্ট বুকে কোথায় রাখব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
আমাদের অনেক অপূর্ণ ইচ্ছা নিলু পূরণ করেছে। আরও করবে, এই আশা রাখি। তবে যেদিন নিলু কোনও কলেজের প্রফেসর হয়ে যাবে, সেদিন হবে আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ--- সেদিনটা যেন তাড়াতাড়ি আসে, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।
( আগামী পর্বে )