রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২

পাঠকের মতামত * স্বরবর্ণ * ৮


স্বরবর্ণ * আট সংখ্যাটি কেমন হল ? কী বলছেন সুধী পাঠকমন্ডলী ? এ বিষয়ে ব্লগে অনেকেই মতামত দিয়েছেন। আবার ব্লগে স্বচ্ছন্দ না হওয়ায়, অনেকে সম্পাদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মতামত জানিয়েছেন। ফোনেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, এ সংখ্যার কবি-লেখকেরা অনেকেই তাঁদের নিজস্ব ওয়ালে সংশ্লিষ্ট লেখাটি শেয়ার করেছেন। সেখানেও অনেকে মতামত দিয়েছেন। সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার জন্য সকল পাঠককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

পাঠকের মতামত শিরোধার্য করে আমরা ক্রমান্বয়ে সেগুলি প্রকাশ করব । আজ পাঠ প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্ব  -----

সুধাংশুরঞ্জন সাহা এ সংখ্যার সম্পাদকীয় পড়ে লিখছেন  একটি চমৎকার সম্পাদকীয়। কবিতা যেহেতু একটি শিল্প। শিল্পের সংজ্ঞা অনবরত বদলায়। কোনো সংজ্ঞাই সম্পূর্ণ নয়। কবিতার নির্মাণ কৌশল নতুন কাব্যভাষার জন্ম দেয়। কবিতা হয়ে ওঠে অনন্য এক শিল্প।

স্বপন নাগ ' প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * অরিত্র চ্যাটার্জী' সম্পর্কে লিখছেন  গানের শেষটা মনে পড়ছে না... এ কবিতার রেশও মুছে যাচ্ছে না, থেকেই যাচ্ছে। সুন্দর।

বৈশালী গাঙ্গুলী উদয় ভানু চক্রবর্তীর কবিতা পড়ে লিখেছেন   খুব সুন্দর গ্রীষ্মের খরতাপে অতিষ্ট জীবন, ধ্রুবতারা লেখা পড়লাম

সব্যসাচী মজুমদারের গ্রন্থ আলোচনা প্রসঙ্গে দেশিক হাজরা লিখছেন  প্রতিটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া ভীষণ গবেষণামূলক বেশ ভালো লাগলো । এই ভাবেই এগিয়ে চলুক বাংলা কবিতা

ঋতুপর্ণা খাটুয়ার কবিতা সম্পর্কে শাশ্বতী সরকার লিখছেন   ঋতুপর্ণার কবিতা ওঁর মতনই, সহজ, স্বাভাবিক, সুন্দর

পঙ্কজ মান্নার কবিতা সম্পর্কে ডাঃ স্বপ্নদীপ রায় লিখেছেন  প্রথম কবিতাটি অনেকবার পড়েছি।পূর্বেই। আমার মনের খুব কাছের।দ্বিতীয়টিতে এক নিস্তব্ধ সমর্পণ আছে। অনুভূতিময় কবিমানসে এ যেন ভাবের নিরন্তর দ‍্যোতনা!কবিকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম!

রাজীব দে রায় এর কবিতা পড়ে বিদিশা সরকার লিখছেন   অসাধারণ দুটি কবিতা। সমৃদ্ধ হলাম।

প্রদীপ ঘোষের কবিতা সম্পর্কে জবা ভট্টাচার্য  লিখছেন  দুটো কবিতাই অসামান্য। তিন বাঁও  মন টানলো।

গৌরীশঙ্কর দে-এর হাইকু পড়ে নাম জানাননি এমন একজন লিখছেন   কবি গৌরীশঙ্ককর দে-র কবিতার আমি মুগ্ধ পাঠক। তার ন'টি হাইকু মনের মধ্যে ন'টি দিগন্ত উন্মোচিত করলো যেন...।

পরান মণ্ডলের কবিতা সংক্রান্ত গদ্য সম্পর্কে শ্রীদাম কুমার লিখছেন  বেশ সমৃদ্ধ আলোচনা। শুভেচ্ছা নেবেন । 

চন্দ্রাণী গোস্বামীর কবিতা সম্পর্কে শরদিন্দু সাহা লিখেছেন  কল্পনাশক্তি বেশ ভালো, চিত্রকল্পগুলো ছুঁয়ে গেল। 

মৃন্ময় মাজীর কবিতার পড়ে বিদ্যুৎ পরামানিক লিখছেন  আগেও পড়েছি, আবারও পড়লাম । খুবই ভালো লাগা একটি উত্তর আধুনিক কবিতা । 

বিকাশ চন্দ-এর কবিতা সম্পর্কে মিন্টু চন্দ লিখছেন  খুব সুন্দর দুটো কবিতাই। 

শতদল মিত্রের গল্প পড়ে তন্ময় রায় লিখেছেন  আপনার গল্প " দুয়োভূমি"-র ভাষা এবং শঙ্কর চরিত্রটি অসাধারণ লেগেছে। 

দেবাংশু সরকার এর গল্প পড়ে শুভাশিস ঘোষ জানাচ্ছেন  বেশ ভালো লাগল। 

( আগামীদিন )

শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০২২

পাঠকের মতামত * স্বরবর্ণ * ৮



কবি-লেখকেরাই স্বরবর্ণের মূল চালিকা শক্তি। তাঁদের সৃষ্টিকাজ বুকে ধরে স্বরবর্ণের পথ চলা।কোনও সন্দেহ নেই,সেই সঙ্গে তার চলার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে পাঠকের সুচিন্তিত পাঠ-প্রতিক্রিয়া। প্রতি সংখ্যা মতো বর্তমান সংখ্যাটিরও বহু মতামত আমরা পেয়েছি। ক্রমান্বয়ে সেগুলি প্রকাশ করব। আজ, প্রথম পর্বে থাকছে, গৌরীশঙ্কর দে-র পাঠ-প্রতিক্রিয়া। তিনি প্রায় সম্পূর্ণ স্বরবর্ণ * ৮ সংখ্যাটি পাঠ করেছেন। এমন তন্ময় পাঠককে কুর্নিশ ।


গৌরীশঙ্কর দে-র পাঠ-প্রতিক্রিয়া

পঙ্কজ মান্নার কবিতা সম্পর্কে *  কবিদের কবি একজন। তাঁর কবিতা নিয়ে কিছু বলা আমার মতো তুচ্ছ একজন ভাষা শ্রমিকের কাছে, শৌখিন মজদুরির বেশি কিছু নয়। তাই সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই

উমা বন্দোপাধ্যায় *  উমাদির আকাশে কবিতা মেঘের মতো চড়ে। অত্যন্ত উচ্চাসনে বসিয়েছি তাঁকে। স্বরবর্ণ ওঁর ছোঁয়ায় নতুন বর্ণে বিচ্ছুরিত হলো।

শুভজিৎ গুপ্ত *  অন্যরকম লেখা। ভালো লাগলো খুব। 

গোবিন্দ মোদক * দ্বিতীয় তাল প্রধান কবিতাটিতে মনের ভিতর জলতরঙ্গ বেজে উঠল বুঝি।

মধুমিতা বসু সরকার * মুখপুস্তকের মাধ্যমে মধুমিতা বসু সরকারের কবিতার সঙ্গে আমরা অনেকেই এখন পরিচিত। অত্যন্ত ঋজু ঘনপিনদ্ধ চিত্রকল্পের মঘ্য দিয়ে কবি একটি অন্তর্জগত নির্মাণ করে কবিতার অন্তর্নিহিত বুনন সম্পূর্ণ করেন। স্বরবর্ণ-এ প্রকাশিত এই দুটি কবিতাই সেই অধরা মাধুরীর সন্ধানে আমাদের টেনে নিয়ে যায়। একজন কবির নিভৃতবিজ্ঞান স্বজ্ঞায় সঞ্চারিত হয়।

দেবার্ঘ সেন * দেবার্ঘ কবি। দেবার্ঘ ছবি আঁকে। দেবার্ঘে আমি দিগন্ত থেকে ছুটে আসা রেলপথ ররাবর দুটো ট্রেনের ছুটে আসা দেখি। "কৌশল" কবিতাটির 'A', প্রথম 'ভ্রামক' কবিতাটির 4G থেকে উঠে এলো বলে ভ্রম হয়। আর এই ভ্রম থেকে প্রতিধ্বনিত হয় কলমের বর্ণমালায় গাঁথা প্রতিকবিতা।

নিমাই জানা * "রাতের প্রতিটি আততায়ী তারার নিচে অযোগবাহ অক্ষরেরা শুয়ে থাকে গলিত মোমের মত শিরদাঁড়া নিয়ে" অথবা "শিশুরাই রাতের অন্ধকারে নিজেদের ছায়ার নিচে দাঁড়ানো আর এক ছায়াকে ভয় পায়," এই দুটি চিত্রকল্পের দৃশ্যগত ইন্দ্রিয়গম্য কাঠামোটি নিমাই জানা এক আপাত দুরূহ কিন্তু দুর্বোধ্য নয় (বুদ্ধদেব বসুর অসামান্য কবিতার নির্মাণ প্রসঙ্গে নিমাইকে দিয়ে সাম্প্রতিক কবিতার নতুন ধারা সৃষ্টি করিয়ে চলে অবিরত।

দেবদাস রজক *  চমৎকার লাগলো দুটি কবিতাই। অত্যন্ত অনায়াস ও আন্তরিক।

চন্দন রায় * কবিতাগুচ্ছ * চন্দন আশির কবি। আশির কবিতা হলো এককথায় লোহিত সরণের ক্রমশ গৈরিকীকরণের মেদুর অভিশাসন। সত্তরের মরচে ধরা বীজের জীবন। কবি চন্দন রায় তারই প্রতিভু। আশির দশকের সঙ্গবদ্ধ কোনো উচ্চারণ নেই। প্রত্যেক কবিই, চন্দন, অলোক বিশ্বাস, প্রজিত জানা, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (উত্তরপাড়ার), জহর সেন মজুমদার, বিজ্য সিংহ কতো প্রিয় নাম।

রূপায়ণ ঘোষ * অনুবাদ কবিতা *  অসাধারণ একটা কাজ। "শয়তানের সঙ্গে কথপোকথন" যে কী গভীর অর্থে আধুনিকতার বেড়া ভেঙেছে, ভাবা যায়না। প্রতিটি অনুদিত কবিতাই আদিম আইরিশ কবিতার পরিসরের বাইরে গিয়ে চিরায়ত হয়ে উঠেছে। অনুবাদকের প্রতি রইল অকুণ্ঠ অভিনন্দন

দেবাশিস সাহা-র উপন্যাস ধুলোর সিংহাসন (পর্ব-সাত)  অসাধারণ। দুকূল প্লাবনে ভেসে গেল, পুরীর সমুদ্রের ঢেউয়ে। অশোকের অন্তঃসত্ত্বা কবিমন, বিস্ময়, দুচোখের গভীর অবলোকন প্রদীপদা, কাশীদাকে রক্তমাংসের পুরুষ এবং রিনাদি, অলিদের মৃদু মানবী সঞ্চার পথের পাশে পায়েল শেঠ ও বিজন মুহূর্তে মোহানার দিকে খুলে দিল নারীর অন্য মুখ। হিউমার, গল্প বলার অনায়াস দক্ষতার উপর দিয়ে কবিমনের ঝাউপাতা, দার্শনিকতার শালপ্রাংশু মহাদ্রুমের সামনে নত হয়ে বসে পড়লাম। এত অকৃত্রিম উপন্যাসোপম এই রচনা হৃদয়ে প্রথম দেখা পুরীর গর্ভ মন্দিরের দিব্যত্রয়ীকে কষ্টিপাথর ছেনে লেখায় বসিয়ে দিয়েছে যেন চূড়ান্ত মানবতার বিমূর্ত মন্দির আর মন্দিরের চূড়ায় উঠে যাচ্ছে সন্ধ্যাবেলা ধ্বজ। একেবারে যাকে বলে মজে গেলাম সপ্তম পর্বে। পিঠে অদেখা বন্ধুর হাত রেখে বললাম। জয় হোক এই উপন্যাসের। জয় অশোকের মতো ঘোড়সওয়ার-এর জয়।

( আগামীদিন )

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি


 

স্বরবর্ণ * আট * ২০২২   

সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ  করব ২৫ জুনের পর থেকে । 


**********************

স্বরবর্ণ * নয়  * ২০২২  

দ্বিতীয় বর্ষ * তৃতীয় সংখ্যা 

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ আগস্ট ২০২ 


* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ জুলাই  ২০২- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর মাসের ১৫ তারিখ বেরো আগে থেকে লেখা পাঠানপরিকল্পনার সুবিধার জন্যলেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে 


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

 ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা  

স্বরবর্ণের অন্তরঙ্গ কিছু বই

 



স্বপন চক্রবর্তী বহু অবিস্মরণীয়  গ্রন্থের প্রণেতা |

 তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ ----


মিথ্যার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি * লৌকিক মাঘোৎসব * আত্মপ্রতিকৃতি * গীতবিতানের হাট 

যে কুসুম নিজের নাম না -জেনেই ফুটে আছে * স্মৃতি স্বপ্ন কান্না দরবারি *

হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্নের ডাক ইত্যাদি |




শুভঙ্কর দে  সম্পাদিত 

Health has a History Revisiting Bengal

বিজ্ঞানের ইতিহাস ভবিষ্যতের সন্ধান 

ভারতের সামাজিক ইতিহাস  









দীপংকর রায় 

কবিতার বই  *  

অন্তর অয়ন * আঁধার আলোকলতা *   অপ্রচলিত 

আর এক শরণার্থী দিন * মৎস্য কুমারীর জোছনা 



         



কবিতা উপন্যাস

অসমাপ্ত ছোঁয়া * ছায়ার খিদে *

গল্পগ্রন্থইচ্ছে পতঙ্গের  কান্না    আত্মজৈবনিক  উপন্যাস কোথাকার অতিথি আমি  

 





আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ



মাধুরী দাশগুপ্ত

বাতাসে কার কান্না


 

শুভজিৎ গুপ্ত  

পাখিদের আহিরভৈরব 


দেবাশিস সাহা 

    কবিতার বই 

তোমায় খুঁজে ফিরি


প্রাচীন সাধুদের কথা  

স্বামী গম্ভীরানন্দ (সংক্ষিপ্ত)

          ----- স্বামী চেতনানন্দ

১)

     

কোন মহান ব্যক্তির জীবনী লেখা বড়ই কঠিন। এসব মহান ব্যক্তি নিজের বিষয়ে কিছুই লেখেন না, বা বলতেও চান না। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা জিজ্ঞাসা করলে অধিকাংশ সময় মৌন থাকেন বা অন্য প্রসঙ্গ তুলে এড়িয়ে যান। অথচ এঁদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইতিহাস, এবং আধ্যাত্মজীবনের বহু গূঢ় রহস্য।

     ‎পূজনীয় গম্ভীরানন্দজী মহারাজের সঙ্গে আমার ত্রিশ বছরের পরিচয় এবং সাত বছর তাঁর সঙ্গে থেকেছি। আমি অদ্বৈত আশ্রম, ওয়েলিংটন লেনে প্রুফ-রিডার হিসেবে আসি ১৯৫৮সালের ১ ডিসেম্বর। তখন গম্ভীর মহারাজ অদ্বৈত আশ্রমের প্রেসিডেন্ট। আমি বই-এর প্রুফ দেখার কাজ করি। একদিন তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলেন, 'সাধু হতে গেলে ঝাঁপ দিতে হয়। Calculation করে সাধু হওয়া যায় না।' তিনি কর্মে ও ব্যবহারে খুবই গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। তবে আমার সঙ্গে খুবই স্নেহপূর্ণ এবং খোলাখুলি ব্যবহার করতেন। আমি তাঁকে মনে-প্রাণে শ্রদ্ধা করতাম এবং তাঁর অপূর্ব জীবন অনুসরণ করতে চেষ্টা করতাম।

     ‎ওয়েলিংটন লেনের বাড়ির চার তলায় তাঁর একটি ছোট ঘর ছিল; তার একপাশে সরিষার স্বামী নির্মোহানন্দজীর একখানা ছোট খাট ছিল। তিনি সপ্তাহে তিন দিন কলকাতায় থাকতেন। ক্যনভাসের একটা ইজিচেয়ারে জানালা পিছন করে বসে গম্ভীরানন্দজী লেখাপড়ার কাজ করতেন। আমি কখনও তাঁকে ছাদে গিয়ে পায়চারি করতে দেখিনি -পাছে প্রতিবেশীদের বাড়িতে নজর যায়। অপূর্ব সংযত জীবন! অদ্বৈত আশ্রমে তাঁর routine এরকম ছিল : সকাল ৪:৩০ উঠে ৫টায় জপ-ধ্যান করতেন। তারপর, ৬টায় চিঠিপত্রের উত্তর সেরে সকালের ক্লাসের জন্য শাস্ত্র পড়তেন। ৬:৩০টায় breakfast সেরে ৭টায় সাধু-ব্রহ্মচারীদের ক্লাস নিতেন। তাঁর কাছে আমি পাঁচ বছর গীতা, কেন-উপনিষদ, ছান্দোগ্য-উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্র পড়েছি। আধ-ঘন্টা ক্লাস। তারপর তিনি তাঁর কাজ শুরু করতেন। চোখ ভাল ছিল না। ঘন্টাখানেক কাজ করে চোখকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্য করিডোরে পায়চারি করতেন বা অফিসে নেমে ঘুরতেন। আবার কাজ করতেন প্রায় ১১টা পর্যন্ত। তারপর স্নান করে জপ করতেন এবং ১২টায় খাওয়ার পর একটু খবরের কাগজ দেখে শুয়ে পড়তেন। দুটো থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ এবং তার মধ্যে চারটায় এক কাপ চা খাওয়া। ৫টা থেকে ৬টা বেড়াতে যেতেন। তাঁর গতিবিধির সঙ্গে ঘড়ির সময় মেলানো যেত। রাত ৯টা পর্যন্ত জপ-ধ্যান। চোখের জন্য রাতে কাজ একদম বন্ধ ছিল। খাবার পর ৯:৩০টায় ক্লাস। অদ্বৈত আশ্রমে নিয়ম ছিল নতুন ব্রহ্মচারীকে পাঠক হতে হতো এবং যে বই নতুন বেরিয়েছে তা ১৫ মিনিট পাঠ করতে হতো। সবাই বসে শুনতেন। পাঠের সময় আমার যদি কোন উচ্চারণ ভুল হতো, গম্ভীর মহারাজ বলতেন, 'ওহে, ঐ শব্দটা একবার দেখ তো -Oxford Dictionary কী বলে।' ক্লাসের আগে আমি পড়ে যেতাম যাতে সবার সামনে না লজ্জায় পড়তে হয়।


     ২ )

     আমাদের একজন ব্রহ্মচারী তখন অদ্বৈত আশ্রমের ভাণ্ডারি। সে দক্ষিণ ভারতীয় এক বহ্মচারীকে মজা করে ডিম দিয়ে ফ্রেঞ্চ-টোষ্ট খাইয়ে দিল। অথচ ঐ ব্রহ্মচারী কঠোর নিরামিষাশী। সে বুঝতে পারেনি। যখন সে জানতে পারল, সে অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং গম্ভীর মহারাজকে জানাল। মহারাজ তখন ভাণ্ডারি ব্রহ্মচারীকে ডেকে বললেন, 'এই প্রথম এবং শেষ। এরপর যদি তুমি এরূপ ব্যবহার কর, তোমাকে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বিদায় নিতে হবে। ঠাকুর কারো ভাব নষ্ট করতেন না, জেনে রেখো।' তিনি রেগে গেলে যে কী কঠোর হতে পারতেন -বলবার নয়। আরেকদিন সন্ধ্যায় এক ব্রহ্মচারী ও এক সাধু ক্যারাম খেলছিল। তিনি নিচ থেকে সোজা ওপরে উঠে এসে বললেন, 'এখন সন্ধ্যাবেলা। জপ-ধ্যান করতে যাও।' এমন দৃপ্তকন্ঠে বললেন যে, সবাই ভয় পেয়ে গেল। তার পরদিনই ক্যারাম বোর্ড চলে গেল সরিষা আশ্রমের ছেলেদের জন্য। আরেকদিন কয়েকজন সাধু মিলে একটা বিশেষ সিনেমা দেখতে যান। গম্ভীর মহারাজ ও আমি মাত্র আশ্রমে। রাতে খাওয়ার পর আমাকে বললেন, 'ওহে, তুমি যে গেলে না?' তারপর বললেন, 'দেখ, সাধুজীবনে ওসব দেখে বেড়ানো ভাল নয়। বহির্মুখী বৃত্তি এসে পড়ে।'

     ‎অদ্বৈত আশ্রমের প্রেসিডেন্টকে গরমের ছয়মাস মায়াবতী এবং শীতের ছয়মাস কলকাতায় থাকতে হয়। আমি একবার মায়াবতীতে গম্ভীর মহারাজের কাছে কাজের ব্যাপারে চিঠি দিই। তিনি ১৫/৫/১৯৬১ তারিখে উত্তরে লেখেন, 'দেখ, ছোটবেলায় 'পারিব না' বলে একটা কবিতা পড়েছিলাম, তা-ই তোমাকে লিখছি। এটাই তোমার চিঠির উত্তর :

     পারিব না ও-কথাটি বলিও না আর

     কেন পারিবে না তাহা ভাব বার বার।

     দশজনে পারে যাহা তুমিও পারিবে তাহা

     পার কি না-পার কর যতন আবার,

     পারিব না বলে মুখ করিও না ভার।

     ‎চিঠিখানা ছিল সংক্ষিপ্ত। কিন্তু চিরদিনের জন্য তা মনে গেঁথে গিয়েছে।

     ‎মায়াবতীতে তাঁর সঙ্গে থাকা আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কলকাতায় তাঁকে ঠাকুর-স্বামীজীর ও বেদান্তের গ্রন্থ প্রকাশনের ব্যাপারে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি। একবার পড়ে বা Edit না করে বই প্রেসে ছাপতে পাঠাতেন না। বই শেষ হয়ে আসছে, তা আগে থেকে তাঁকে জানাতে হতো। এর মধ্যে তিনি নিজের লেখা চালিয়ে যেতেন। ব্রহ্মসূত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করতে তাঁর পাঁচ বছর লেগে গিয়েছিল। তারপর নিজেই একটা portable typewriter-এর সাহায্যে টাইপ করতে শুরু করেন। ম্যানেজার মহারাজ একজন পেশাদার typist লাগিয়ে ঐ কাজ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেন। স্বামীজীর জন্মশতবার্ষিকীর সময় মন্মথ ভট্টাচার্যকে লেখা স্বামীজীর একটা নতুন চিঠি পাওয়া যায়। তিনি সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে আমার মারফত মঠে স্বামী মাধবানন্দজীকে দেখাতে পাঠান। তিনি সেটা পেয়ে বলেন, 'গম্ভীরানন্দ অনুবাদ করেছে, আমাকে কেন আবার দেখতে হবে?' যাহোক, স্বামী মাধবানন্দজী সেটা দেখে গম্ভীর মহারাজকে ফেরত পাঠান। স্বামীজীর Complete Works-এ যাতে কোন ভুল না থাকে তার জন্য প্রাণ দিয়ে খাটতেন। মেরি লুইস বার্কের New Discoveries থেকে যেভাবে চয়ন করে স্বামীজীর Complete Works-এ তথ্য সংযোজন করেছেন সেটা তাঁর দারুন বিচক্ষণতার পরিচয়।


( আগামী সংখ্যায় )

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * অরিত্র চ্যাটার্জী

 



এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ /     সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন তরুণ কবি অরিত্র চ্যাটার্জী  




অরিত্র চ্যাটার্জী 



বিকেলের গান 


মনে কর একটা গান,

অথবা বিকেল জুড়ে একটা ফ্রেম

তার ভেতর কেবলই বৃষ্টি পড়ছে

খুব ধব্‌ধবে একটা টেবিল পাতা

অবিন্যস্ত কয়েকটি চেয়ার, 

ওরা উঠে গেছে একটু আগেই 

ফেলে রাখা গোলাপগুলো 

ঈষৎ কেঁপে উঠছে, বৃষ্টির তোড়ে   

ভেজা সামিয়ানা, শহরতলি পেরিয়ে  

মনে কর ওরা চলে যাচ্ছে, 

মনে কর, এমন একটা গান

যার শেষটা তোমার আজ 

আর মনে পড়ছে না কিছুতেই…










*************************************************************************

উপন্যাস * দেবাশিস সাহা




ধুলোর সিংহাসন  

দেবাশিস সাহা 

পর্ব * ৮ 


( পূর্বানুষঙ্গ : সপরিবারে পুরী বেড়াতে যায় অশোক। সঙ্গে যায় ভাগনা নিলু,বড় ভায়রা প্রদীপদা ও শ্যালিকা রিনাদি এবং তাদের একমাত্র ছেলে গোগোল ও প্রদীপদার বন্ধু কাশীদা। জীবনে এই প্রথম পুরীর সমুদ্র দেখল অশোক। আনন্দ ও উত্তেজনায় যারপরনাই বিহ্বল হয়ে পড়ে। অসম্ভব এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয় মন। পুরীর সমুদ্র তীরেই অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায়, একদা কলেজ বন্ধু বিজন ও তার পরিবারের সঙ্গে। এক অভূতপূর্ব  নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয় । সব মিলিয়ে ছ'টা দিন যেন ছ'টা মুহূর্তের মতো কেটে যায়। বাড়ি ফেরার পর....)



পুরী থেকে ফিরে আসার পর অলির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ক'দিন ধরে জ্বর। সর্দি-কাশি। এমনিতেই ওর এলার্জির প্রবলেম। তার উপর মাইগ্রেনের ব্যথায় মাঝে মাঝে কাহিল হয়ে পড়ে। থাইরয়েডের সমস্যা পাকাপোক্তভাবে শরীরে বাসা বেঁধেছে। আগে চলত এলট্রক্সিন-৫০ । শেষবার থাইরয়েড টেস্ট করার পর ডাক্তার এলট্রক্সিন-৭৫ প্রেসক্রাইব করেছে। সেটাই চলছে নিয়মিত। রাতে শোবার আগে এলার্জির জন্য  জুলোকাস্ট এলসি একটা আর সকালে ঘুম থেকে উঠে এলট্রক্সিন-৭৫ একটা । এই রুটিন চলছে বেশ কয়েক বছর। ক'দিনের অনিয়মে উপসর্গগুলো আরও বেড়েছে। জ্বর তো আছেই। চোখমুখ লাল। থেকে থেকে কাশি। আর নাগাড়ে হাঁচি চলছে সমানে।


      অন্যদিন পাঁচটার আগেই উঠে পড়ে। উঠে আধা ঘন্টা যোগা করে। তারপর ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ উঠেছে অনেক আগেই। কাশির দমকে ভালো করে ঘুম হয়নি রাতে। ঘুমোতে পারেনি অশোকও। এমনিতে অশোক তাড়াতাড়িই ওঠে । কিন্তু বিছানা ছাড়ে না। অলি বেড-টি এনে পড়ানো আছে বলে ঠেলে গুঁতিয়ে তোলে।


      উপমা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আজ ওর ক্লাস আছে। সকাল এগারোটা থেকে। বেরোবে দশটা নাগাদ। বিএ ফাইনালের পরপরই অশোক ওকে সরকারি চাকরির প্রিপারেশনের জন্য ভর্তি করিয়েছে একটা কোচিং-এ। বিএ-র রেজাল্ট বেরোতে বেরোতে পাঁচ-ছ মাস । বেকার বসে থেকে কী করবে। কিছু একটা শিখুক। চাকরি-বাকরির যা আকাল! এই উদ্দেশ্যেই ভর্তি করিয়েছে  অশোক। কোচিংটা শিয়ালদার  মৌলালিতে। দু'দিন ক্লাস থাকে। বৃহস্পতি আর রবি। তবে রবিবার টাইমটা বেশি। সকাল ১১ টা থেকে বিকেল ৫টা। বৃহস্পতিবার ১২ টা থেকে ৪ টে। অশোক নিজে গিয়ে ওই ইনস্টিটিউশন-এর সঙ্গে কথা বলে ভর্তি করিয়ে এসেছে। প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী । ফ্যাকাল্টিও ভালো। সব খোঁজখবর নিয়ে দেখে শুনে অশোকের মনে ধরেছে ইনস্টিটিউশনটা। ডিম্পু, উপমার এক মাসতুতো ভাই , এখান থেকে পড়েই ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। ডিম্পুর মা-ই অশোককে জোর করেছে-- ' অশোক, উপমাকে এখানেই ভর্তি করাও। টাকাটাও কম। আর এদের রেজাল্টও ভালো হয়। অন্য সব জায়গায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজারের কমে কোনও গল্প নেই।' ভেবেচিন্তে তাই এখানেই ভর্তি করিয়েছে অশোক। প্রথম প্রথম একটু ভয় পাচ্ছিল, উপমা একা একা এতদূর আসবে কী করে! বাবা মা ছাড়া শিয়ালদার এদিকটাতে ও খুব একটা আসেনি। ওর স্কুল ছিল গড়িয়া-সোনারপুর সাইডে। অশোক নিজে যে দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে, সেটাও সম্ভব নয়, কারণ রোববারে ওর বেশি পড়ানো  থাকে। তাই কী ভাবে যেতে হবে ,দু'-একদিন সঙ্গে নিয়ে গিয়ে রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিয়ে এসেছে। অলি গাঁইগুঁই করছিল প্রথম প্রথম, ' না আমিই দিয়ে আসব নিয়ে আসব।'

      ' তাই হয় নাকি? এটা কখনো সম্ভব? ও কি এখনো নাইন-টেনে পড়ে? '

     ' তাহলেও...' কিন্তু কিন্তু করছিল অলি।

     'দ্যাখো, চাকরি পেলেও কি তুমি মেয়েকে অফিস দিয়ে আসবে নিয়ে আসবে, তাই কখনো হয়?'এইভাবে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে  অলিকে নিরস্ত করেছে অশোক।


        আজ অলির শরীরে যে এতগুলো রোগ বাসা বেঁধেছে, সে ওর ক্রমাগত অনিয়মের ফল। উপমা যখন স্কুলে পড়ত, রোজ দিয়ে আসা নিয়ে আসা তো ছিলই, সেইসঙ্গে রেশন ধরা,বাজার করা, কেরোসিন তেল তোলা সব কাজ ও একা হাতে সামলাত। দু'পয়সা বাঁচাবে বলে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে,, দেড়-দু'কিলোমিটার হেঁটে বাড়িতে আসত, সঙ্গে রেশন কিংবা বাজারের ব্যাগ। অশোক কত বারণ করেছে, কেরোসিন তেল ধরাটা ছেড়ে দাও, দেড়-দু'ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। লাইন নিয়ে মারামারিও বেঁধে যায় কখনও কখনও। মাত্র তো তিনটে কার্ড। হাফ লিটার করে দেড় লিটার তেল পাও। তার জন্য এত খাটনি! তাছাড়া আমাদের তো কেরোসিনে রান্না হয় না, গ্যাসেই  রান্না করো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অশোককে ধমকে চুপ করায় অলি ' তুমি থামো তো, কষ্ট তো আমি করি, তোমাকে তো বলি না।' অশোক চুপ করে যায়। জানে, এই দেড় লিটার তেল বাইরে বিক্রি করে অলি যে পয়সা পায়, তা জমিয়ে জমিয়ে মেয়েকে হয়তো একটা নাইটি কিংবা চুড়িদার কিনে দেয়।


       উপমা যখন মাধ্যমিক পাশ করে এগারো ক্লাসে ভর্তি হল, তখন খাটনিটা গেল আরও বেড়ে। নিজে সময় দিতে পারবে না বলে মাধ্যমিক অব্দি সায়েন্স গ্রুপের জন্য বাড়িতে একটা টিচার রেখেছিল। কিন্তু এবার আর তা সম্ভব হল না। ইংলিশ জিওগ্রাফি সোশিয়লজি হিস্ট্রি সব সাবজেক্ট-এর জন্যই আলাদা আলাদা টিচার লাগবে, স্কুল জানিয়েছে। তা-ও যে কোনও টিচারে চলবে না। ওদের স্কুলের টিচারের কাছেই পড়তে হবে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এ এক  চতুর খেলা। টিচারদের মাইনে জোগানোর জন্য নিজের কোচিংয়ে  দিনরাত মুখ গুঁজে থাকত অশোক। আর অলি নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে মেয়ের লেজ হয়ে ছুটে বেড়াত সকালে সুদেষ্ণা ম্যাডাম, তো বিকেলে উজ্জয়িনী আন্টি কি সুদীপ স্যারের বাড়ি। অন্যান্য গার্জিয়ানদের সঙ্গে ঘন্টা দুয়েক বসে থেকে ছুটি হলে মেয়েকে মেয়ে ফিরত।


     ' কী কিগো ,তুমি আজ পড়াতে যাবে না?' কাশতে কাশতে বলল অলি।

     ' যাব। কাজগুলো সেরে নিই।'

     ' কী কাজ?'

     ' ঘর ঝাড় দিয়ে,বাসনগুলো মেজে,রাতের ছাড়া জামা কাপডগুলো কেচে,তারপর যাচ্ছি।'

     ' না, অতকাজ তোমার করতে হবে না। আমি আস্তে আস্তে সব করে নেব।'

      ' তুমি করে নেবে? আবার জল ঘাটবে? জ্বর কমেছে? দেখি, এগিয়ে এসে অলির কপালে হাত রাখে অশোক।

     ' গা তো বেশ গরম। ''

     ' ও ঠিক হয়ে যাবে। সর্দি-জ্বর তো। তুমি বরং চা-টা বসাও, চা খেয়ে পড়াতে যাও। আর পারলে ছাত্রদের কাউকে দিয়ে দুটো প্যারাসিটামল কিনে পাঠিয়ে দিয়ো ।’

    'না, আর ডাক্তার না-দেখিয়ে উল্টোপাল্টা ওষুধ খেতে হবে না। চার -পাঁচদিন তো খেলে, কমল?'

    ' দেখি না আর একটা দিন। '

     ' না আর দেখতে হবে না। আমি কোচিং ছুটি দিয়ে আধ ঘন্টার মধ্যে আসছি। তুমি রেডি থাকো, ডাক্তার-খানা যাব।'

    ' কোন ডাক্তার-খানা?'

    ' কেন, অ্যাপোলো  নার্সিংহোম, ওখানে ভালো ভালো ডাক্তার থাকে।'

      অলি ঝপ করে বিছানা থেকে নামে। এমন ভাব দেখায় যেন কিছুই হয়নি, শরীর ওর পুরো ফিট। 'নামলে যে?'

      ' চা-টা বসাই, তুমি তো বকেই চলেছে।' মনে মনে ভাবে অলি ,অশোকের বাস্তববোধ বড় কম। উপমাকে ভর্তি করাতে এই সেদিন লাগল হাজার দশেক। পুরী ঘুরে এল,তাতেও খরচ হয়েছে লাগামছাড়া। এখন আবার নার্সিংহোম নিয়ে যেতে চাইছে। ওখানে ডাক্তারের ভিজিট পাঁচ-সাতশো টাকার কম না। আর শুধুই কি ভিজিট? গেলেই তো ডাক্তার খসখস করে গাদা গুচ্ছের টেস্ট লিখে দেবে। তার পয়সা জোগাড় করতে আবার ধার। হাত পাতো কারো কাছে। এসব অশোককে বুঝতে না-দিয়ে অলি বলল, ' ডাক্তারখানায় যাবে তো বলছ, আজ কী বার জানো?'

    ' কেন, রবিবার।'

     ' রবিবারে ভালো ডাক্তার থাকে না।' অশোক চুপ করে যায়। কথাটা মিথ্যে না। অশোক চুপ করে আছে দেখে অলি বলে, ' কাল শ্রীগুরুআশ্রম-এ দেখাব। তার মধ্যে আর যদি জ্বর না আসে, তাহলে তো আর ডাক্তারখানা যাওয়ার প্রশ্নই নেই। এতক্ষণে অশোকের মাথায় ঢোকে,অলি কেন অ্যাপোলো ছেড়ে শ্রীগুরুআশ্রম যেতে চাইছে। ওখানে মাত্র পঞ্চাশ টাকার টিকিট করলেই ডাক্তার দেখানো যায়। টেস্ট- ফেস্ট দিলেও টাকা লাগে অনেক কম।নার্সিংহোম টোম ওইসব বড়লোকী চাল আমাদের মানায় না, অলির সাফ কথা।


    ' আর দেরি করছ কেন, তাহলে এবার পড়াতে যাও।'  

   ' যাচ্ছি।' অলির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অশোক কিছুক্ষণ। কত কী যেন ভেবে নেয় তার মধ্যে। কী আছে সেই তাকানোয়? কৃতজ্ঞতা? ভালোবাসা? যৌনকামনা? কেউ পড়তে না পারলেও, অশোকের এই দৃষ্টি পড়তে পারে অলি। কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে, দু'পা পিছনে সরে যায়। হাতটা টেনে ধরে অশোক, ' দেখি এখন জ্বর আছে নাকি? ' কপালে হাত রাখে। তারপর এক ঝটকায় বুকে টেনে নেয়।

    ' ছাড়ো ছাড়ো, মেয়ে উঠে পড়বে।’


       পড়াতে গিয়েও আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে এল অশোক, হাতে চারটে ক্যালপল।

      ' চলে এলে?'

     ' সেরকম কেউ আসেনি, শুধু ইলেভেনের শান্তনু আর অতনু ছাড়া।'

      ' কেন?'

       ' আরে, পরশু কালীপুজো না, মনে হয়, বাজি বন্দুক নিয়েই ব্যস্ত সবাই।'

      ' শান্তনু অতনুকেই পড়াতে।'

       ' ওরা পড়তে চাইল না, বলল, বাবার সঙ্গে যাবে।’

       ' কোথায়?'

       'চাম্পাহাটি।'

        'কেন?'

       ' বাজি কিনতে।'

       ' বলল, আর তুমি ছেড়ে দিলে? ওদের কথায় বিশ্বাস আছে?ফোন করে দেখতে, সত্যিই বাবা যেতে বলেছে কিনা।'

        ' পারতাম। কিন্তু দু'জনের জন্য ঘন্টা দুই বসে থাকতে আমারও ভালো লাগল না। ঘরে তোমার এই অবস্থা। উপমাও তো বেরবে।'

       ' তা তুমি এসে করবেটা কী? আমার জ্বর সর্দি-কাশি তোমার শরীরে নিতে পারবে?'

      ' তা না-পারলেও আলুসিদ্ধ-ভাতটা তো বসাতে পারব। উপমা কিছু খেয়ে যাবে না? ফিরতে ফিরতে তো সেই সন্ধে গড়াবে।'

     'সে তো পারবে,কিন্তু দু'দিন বাদে যখন ওদের বাবা এসে বলবে, অশোক এই দিন পনেরো পুজোর ছুটি দিলে, স্কুল খুললেই তো অ্যানুয়াল। এত ঘনঘন ছুটি দিলে ওরা পাশ করবে কী ভাবে। তখন ভালো লাগবে শুনতে?

       ' সে তখন দেখা যাবে। উত্তর আমারও রেডি। পরীক্ষার সময় আমিও তো ওদেরকে ডেকে এক্সট্রা পড়িয়ে দিই ,না-কি। এমনি এমনি সব পাশ করে। ছাড়ো তো ওসব। তুমি এখনি একটা ওষুধ খেয়ে নাও।' বলতে না বলতেই একটা ট্যাবলেট ছিড়ে অলির হাতে দেয় অশোক, ' কিছু খেয়েছো তো?'

      ' একটু আগেই তো চা-বিস্কুট খেলাম।'

       'তবু একটু কিছু খেয়ে খাও, অ্যালোপ্যাথ ওষুধ খালি পেটে খেতে নেই।

     ' সে খাচ্ছি, শোনো -----'

      ' কী?'

       ' আর যদি জ্বর না আসে, বিকেলে একটু বেরোব।' 

       'কোথায়? '

      ' কোথায় আবার, বাজারের দিকে।'

       ' কেন? '

       ' প্রেসার কুকারের সিটি দেওয়ার ভালবটা খারাপ হয়েছে, উপমা আজ ভাত বসিয়েছে গামলায়।'

       ' উপমা ভাত বসিয়েছে?'

       ' হ্যাঁ, ক্লাসে যাবে না! নিজেই আলুসিদ্ধ ভাত ফুটিয়ে নিয়েছে।'

       ' ও আচ্ছা। '

       ' আজই সারিয়ে আনতে হবে।কালীপুজো ভাইফোঁটার  পরেই তো তোমার পড়ানোর চাপ বেড়ে যাবে। তখন আর বেরনো যাবে না। '


         কথাটা ঠিক। নভেম্বরের মাঝামাঝি মাধ্যমিক ,উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্ট শুরু হয়। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হয় স্কুলগুলোর অ্যানুয়াল। এই সময়টা দম ফেলার সময় থাকেনা অশোকের। এক্সট্রা ক্লাস নিতে হয়। গবেট ছাত্রগুলোকেও যে করে হোক পাশ  করানোর ব্রত নেয় অশোক। না-হলে নতুন সেশানে ছাত্র সংখ্যা কমে যাবে। ছাত্র কমলে আয় কমবে। আয় কমলে কপালে ঢেউ খেলবে দুশ্চিন্তার শ্রাবণ মেঘ। একটু ভেবে নিয়ে অশোক বলে, ’ ঠিক আছে যাব। তবে আর যদি জ্বর না আসে।'

         ' আসবে না, এখন অনেকটা ভালো লাগছে।'

        ' না এলেই ---'


        ' আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ ড্রইং রুমের টেবিলে ফোনটা রেখে এসেছিল অশোক। একটানা বেজে চলেছে। কথাটা শেষ না করেই দৌড়ল ধরতে। ধরার আগেই লাইনটা কেটে গেল।


         'এ রিংটোন আবার কবে লাগালে?'


        ' কাল ব্যালান্স ভরালাম না! ফোনের দোকানের ছেলেটা জোর করে দিয়ে দিল।'

        'এই বয়সে আবার মনের মানুষ খুঁজছ? ' হালকা রসিকতা অলির।

       'আস্তে বলো, মেয়ে ও ঘরে রেডি হচ্ছে, শুনতে পাবে।' ' শুনলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? তোমার মেয়ে কি কিছু বোঝে না?'

          আবার বেজে উঠল ফোনটা ' আমি কোথায় পাব......' নিলু (ভাগনা ) স্ক্রিনে অশোক দেখে নিল নামটা।

        ' হ্যাঁ ,নিলু  বল।' লাউড স্পিকারে দিয়েই কথা বলছে অশোক। খানিকটা যেন ' মনের মানুষের ' ব্যাপারে অলির সন্দেহ যাতে গাঢ় না হয়।


        ' মামা, একটা খুশির খবর আছে।'

        ' কী রে, বল। '

      ' আমি একটু আসব মামা? এসেই বলছি।' আনন্দ আর উত্তেজনা উপচে পড়ছে  নিলুর কণ্ঠস্বরে।

       ' হ্যাঁ হ্যাঁ ,চলে আয়।'

        ' আমি জানি ' ও ঘর থেকে এসে উপমা বলল, '  নিলুদা আমাকেই আগে ফোন করেছিল।'

' তাই! কী বলল রে? '

        ' প্রথমে জিজ্ঞেস করল বাবাই বাড়িতে আছে কিনা তারপর বলল ও নেট কোয়ালিফাই করেছে,ৱ্যাঙ্ক  হয়েছে ৯ '

       ' তাই! '

ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল অশোক, ' দারুণ খবর, দারুণ!'

        ' তবে দ্যাখ, নীলুদা কত কষ্ট করে পড়াশোনা করে এই জায়গায় পৌঁছল, দু'দিন বাদে প্রফেসর হয়ে যাবে আর তুই অনার্সটাই রাখতে পারলি না। ' উপমাকে ঠেস দিয়ে কথাটা বলে অলি।

      'মা, অমনি শুরু করলে ' বলেই বাবার দিকে ফিরে মুখ গোমড়া করে বলল, ' বাবাই,আমি আসছি।''

     'ক্লাস শেষ হলেই একটা ফোন করবি।'   অলি যোগ করল, ' তাড়াতাড়ি আসবি, কিন্তু।'

     ' হ্যাঁ, ঠিক আছে।'

উপমা বেরোতেই সাইকেল নিয়ে ঢোকে নিলু। গেটের মুখে দেখা ' কনগ্রাচুলেশনস নিলুদা।'

' থ্যাংক ইউ।'

' যা উপরে যা, মা-বাবাই আছে।'

      দরজা খুলেই দাঁড়িয়েছিল অলি। যতক্ষণ না উপমা দৃষ্টির আড়াল হয়, তাকিয়ে থাকে টা-টা করবে বলে। নিলুকে ঢুকতে দেখেই বলে, ' যা ঢুকে পড় নিলু,মামা আছে ভেতরে।’


       অশোক নিলুর অপেক্ষাতেই ছিল। ' আয় আয়' নিলুকে ডেকে নিল ভিতরে।

       ' মামা তোমার ইচ্ছেটা পূর্ণ হল ' বলতে বলতে অশোককে প্রণাম করে নিলু।

       ' থাক থাক, আরও বড় হ, এত বড় যারা এতকাল তোকে দূর ছাই করেছে, তাদের যেন ঘাড় উঁচু করে তোকে দেখতে হয়।'

      ' হ্যাঁ মামা, তোমার জন্যই হচ্ছে সবকিছু ।'

        অশোক চুপ করে থাকে। চোখে আনন্দাশ্রু গড়ায়। চশমা খুলে চোখ মুছতে মুছতে বলে, ' আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে রে নিলু ' অস্ফুটে কথাটা বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় অশোক। চোখের  সামনে ভেসে ওঠে কত স্মৃতি... নিলুর বাবা মারা গেল যক্ষায়....সদ্য বিধবা বোনটার বুকফাটা হাহাকার... কতই-বা বয়স তখন নিলুর... চার কি পাঁচ... ওইটুকু শিশু কোথায় যাবে, কী করবে...ভেবে দিশেহারা অশোক....ইতিমধ্যে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে লীনার শ্বশুর বাড়ির লোকজন...এদিককারও সব আত্মীয়-স্বজন। এমন সময়ে ত্রাতা হয়ে উঠল সেই বড়দি অপর্ণা। একদিন ফোনে ডাকল অশোককে, বলল, ' নিলুর পড়াশোনার খরচ আমি চালাব, অশোক ,তুমি শুধু নিলুকে তোমাদের সঙ্গে তিনবেলা একটু খেতে দিয়ো । ডাল ভাত ফ্যান ভাত, তোমরা যা খাও। জানি তোমার কষ্ট হবে, তবু দ্যাখো ওর তো আর কেউ থাকল না...' বলতে বলতে কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এসেছিল অপর্ণার।


         জীবনে এমন একজন শ্রদ্ধা ভালোবাসার মানুষ থাকা প্রয়োজন, যাঁর কোনও কথা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা চলে না। শুধু নতজানু হও ,আদেশ মনে করে পালন করে যাও তাঁর প্রত্যেকটা কথা। অশোকের জীবনে সেই  শ্রদ্ধা ভালোবাসার মানুষটি বড়দি, অপর্ণা। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সেই অপূর্ণ জায়গাটা অপর্ণাকেই  দিয়ে এসেছে সে। এক্ষেত্রেও বড়দির কথাটা আদেশ মনে করে মাথা পেতে নিল অশোক,যদিও জানে, তারই তো তিনবেলা নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।


     ' মামা ' নিলুর ডাকে বাস্তবের মাটিতে ফেরে অশোক। ' নিলু কী বলতে এসেছে শোনো।' ততক্ষণে অলি এসে দাঁড়িয়েছে ওদের কথার মাঝখানে। মামিকে প্রণাম করে নিলু বলতে থাকে, ' মামা-মামি ,মা বলেছে আজ রাতে তোমরা আমাদের ঘরে খাবে।'

      ' তাই! ' বিস্ময় আর খুশি অশোকের কথায়।

      কী মেনু হবে রে নিলু?' অলির কৌতুহল।

    ' মাংস বিরিয়ানি '

    ' কে রান্না করবে?'

     ' পুচকাদা।'

     ' পুচকাদা কে রে ?'

 নিলু বলে, 'পুচকাদা আমার এক বন্ধুর দাদা। হেব্বি বিরিয়ানি রান্না করে,বড় ক্যাটারিং আছে ওদের।'

' আর কাকে কাকে বলেছিস?'


 ' মেজ মামা, মেজ মামি ,বুড়া....মোটামুটি আমাদের আত্মীয় স্বজন সবাই আর আমার দু'-চারজন বন্ধু-বান্ধব।'

' আত্মীয়-স্বজনদের বলতে গেলি কেন, কেউ কোনওদিন দুটো টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে ?' ঝাঁজের সঙ্গে বলে অলি।

' তা না করুক,  এটাই উত্তর ,এবার যদি  নিজেদের বিবেক দংশন হয়।'

 ' ছাই হবে। বিবেক দংশন! সে বোধ ওদের আছে?' অলির কাঠখোট্টা জবাব।

' আরে নেই বলেই তো বোধের দরজায় ঘা মারতে হবে এবং এটাই সেরা উপায়, লজ্জা দেওয়া, কী  বলিস  নিলু ? '

 'একদম মামা, আমি তো তোমার আদর্শেই বড়, আমিও তাই মনে করি। মা-ও বারণ করছিল,বলছিল শুধু ছোট মামা-মামি,উপমা আর তোর দু' চারজন বন্ধুদের বল। আমি মাকে বোঝালাম, না মা, তা হয় না,ওরা বুঝুক।'

প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে নিলু বলে , ' উপমা কখন ফিরবে মামি?'

' সন্ধে -সন্ধি। ' 

'বোনকে  নিয়ে তোমরা তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু।'


নিলু চলে যেতেই গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করল অশোক, ' আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ... ।' 'রবীন্দ্রসঙ্গীত ছেড়ে হঠাৎ আধুনিক গান ধরলে?' বাঁকা প্রশ্ন অলির।


 ' আরে ,গানের কি আবার জাত বিচার আছে, মনের নানান সূক্ষাতিসূক্ষ চাওয়া-পাওয়ার কথা নিয়েই তো গীতিকাররা গান লেখেন। জানো অলি,আজ না আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। ভাবো, কী  ভীষণ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে করে নিলু  আজ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছল। আমার ইচ্ছে করছে দু'হাত তুলে নাচি আর গলা ছেড়ে গান গাই।'

' সে নাচো,গাও...কিন্তু আজ তো তাহলে প্রেসার কুকারের ভালবটা সারানো হল না।'

' আজ না হোক, কাল হবে,ভাবছ কেন? পড়ানো হয়ে গেলে সকালে আমি নিজে গিয়ে তোমাকে সারিয়ে এনে দেব।' ফুরফুরে মেজাজ অশোকের।

' তা দিয়ো , তবে তোমার নাচ-গান শেষ হলে একটু কাজের কাজ কিছু কোরো।'

' কাজের কাজ! কী গো? '

' ভুলে যাচ্ছ, চিরন্তন বলেছিল না, মাসখানেকের মধ্যে বইমেলা সংখ্যার জন্য লেখা পাঠাতে? পাঠিয়েছো? মাঝখানে তো ডিসেম্বর , তারপর জানুয়ারিতেই তো বইমেলা।'

' না পাঠাইনি, আচ্ছা অলি, ক'টা কবিতা যেন পাঠাতে বলেছিল?'

 ' দ্যাখো কান্ড! আমাকে কি বলেছিল, মনে তো হচ্ছে গুচ্ছ কবিতা পাঠানোর কথা বলেছিল।সেই জন্যই তো তুমি মাসখানেক সময় চাইলে, সেই পুরী যাওয়ার আগে।'

' ও ইয়েস, ইয়েস  মনে পড়েছে। আজ নিলুদের বাড়ি থেকে ফিরে রাতেই বসব, দেখি কোন কবিতাগুলো পাঠানো যায়।'


নিলুদের বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরতে ফিরতে রাত্তির দশটা গড়াল। হাত মুখ ধুয়ে অশোক লেখার টেবিলে বসল। মন-প্রাণ খুশিতে ডগমগ। ডায়রিটা টেনে নিল। না,স্বরচিত কবিতার ডায়রি নয়। দিনলিপি লেখার ডায়রি। কবিতা বাছতে আজ আর ভালো লাগছে না। ডায়রি লিখতে ইচ্ছে করছে খুব। এটা অশোকের বরাবরের অভ্যাস। মন খুব আনন্দ বা বিষাদাক্রান্ত হলে ডায়রি লিখে হালকা হয়। তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে আজও লেখায় মনোনিবেশ করল ----


 রবিবার

 রাত ১০ টা ১৫ 


খুব একটা আনন্দের দিন গেল আজ। কী রকমের এই আনন্দ তা কী ভাবে ব্যক্ত করি। কতভাবেই তো আমরা আনন্দ পাই। সিনেমা দেখে, নতুন জামা কাপড় পরে , প্রিয় কোনও বই পড়ে, কখনও-বা ছবি এঁকে, কবিতা লিখে, শখের বাগান করে কিংবা দূর আকাশের রামধনু দেখে। কিন্তু আমার আজকের আনন্দটা ভিন্ন স্বাদের। এক বিরাট পাওয়ার। এক গভীর পরিতৃপ্তির। কী সেই আনন্দের উৎস, আগে সেটা বলি।

 নিলু ইতিহাসে পিএইচডি করার সাথে সাথেই নেট কোয়ালিফাই করেছে।এবং একটা বড় স্কলারশিপ পেয়েছে। তাই আজ আমাদের ফ্যামিলির সক্কলকে নিলু মটন বিরিয়ানি উইথ চিকেন কষা খাওয়াচ্ছে। এটা ওর অনেক দিনের ইচ্ছে। আমি তাই 'না' করিনি। বড়দিও সম্মতি জানিয়েছে।

আমি যখন পুচকার রান্না করা বিরিয়ানি মুখে দিচ্ছি, মনের মধ্যে চলছে আনন্দের প্লাবন। তার ঢেউ এসে লাগছে খাবার টেবিলে। আনন্দে মাখামাখি হচ্ছে মাংস-বিরিয়ানি। তবে তা মাংস-বিরিয়ানির স্বাদের জন্য যতটা না, তার চেয়ে ঢের বেশি  নিলুর একের পর এক জীবন যুদ্ধের কঠিন লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।

দাঁত দিয়ে মাংস ছিঁড়ছি আর মনের পর্দায় বার বার ভেসে উঠছিল  নিলুর সেই শুকনো মুখটা। ওর না খেতে পাওয়ার যন্ত্রণাক্লিষ্ট দিনগুলো যেন পায়ে পায়ে হেঁটে আসছিল। চোখের সামনে ভাসছিল ওর মলিন বিবর্ণ বোতামবিহীন স্কুল শার্ট। বিরিয়ানির পাশাপাশি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল খিদের সময় ওর মুখের সামান্য ডালভাত ক'টা।

সেই  নিলু আমাদের সকলকে খাওয়াচ্ছে, ডাল-ভাত নয়, মাংস-বিরিয়ানি ----এ আনন্দ এই ছোট্ট বুকে কোথায় রাখব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।

আমাদের অনেক অপূর্ণ ইচ্ছা  নিলু পূরণ করেছে। আরও করবে, এই আশা রাখি। তবে যেদিন নিলু কোনও কলেজের প্রফেসর হয়ে যাবে, সেদিন হবে আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ--- সেদিনটা যেন তাড়াতাড়ি আসে, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।


( আগামী পর্বে )

উপন্যাস * দীপংকর রায়

     



'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৫   

দীপংকর রায় 



কিন্তু কেন ---- তা তো জানা যায় না! 

যদিও এটা তো প্রথম পরীক্ষা ---- এর পরেরটা তো থাকলো মানুষের উপরে নাকি! নিরাপদদা তো সেটাই বলেছে। 

          যদিও আমি ভাবছি অন্য কথা ---- ভাবছি, এ তো বেশ মুশকিল বাধালাম! শেষে মানুষের উপরে প্রয়োগ করতে গিয়ে যদি সেই মানুষটা আমার পেছন না ছাড়ে, তখন কী হবে? সকলে জানাজানি হয়ে গেলে তো বিপদ আরো বাধলো।

          নিরাপদদা বলেছিল, দ্যাখপা , একেবারে পাগল হয়ে যাবেনে, কেবল তোমার পেছনে পেছনেই ঘোরবে। কাছ ছাড়া হবেনানে একেবারেই।

          আমার ভয় তো ওখানেই। বেশ ঝামেলা বাধিয়ে বসলাম। শেষে পরীক্ষে করতি যায়ে যদি এমন অবস্থা ডা বাধায়ে বসি, তাহলিই হইছে কাম; আরে বাবা, গুনিনেরও তো গুনিন রইছে ---- সব জানাজানি হয়ে গেলি, সব যদি প্রকাশ হয়ে যায়, গুনিনের গুনিন যদি আইসে কয়ে দেয় সব সত্যিডা, তহনে কী হবেনে ---- ? তহনে যাবানে কনে! তহনে তো আর ধরা না পড়ে উপায় থাকপেনানে! বলে যদি, এই কাণ্ডডা কিডা ঘটাইছে, তারে দেখতি এমনডা; ধরে আইনে দাও  তারে, বানধে ফেলাও ; তহনে! তহনে যাবানে কনে মুখলুকতি? সেই কথাডা ভাইবে ভাইবেই ঘাম ছাড়তিছে। বুকির ভেতরডা অমন ধড়াস ধড়াস করতিছে শুধু। 


          ধরা পড়া সেই অবস্থাটা যতই হোইহট্টোগোল বাধাক না কেন, তাও কিন্তু সেই মজাটার থেকেও মনটা সরতি চাচ্ছে না যে কিছুতেই !  কিন্তু কারে পাই, যার উপরি এই কাজডা করতে পারি? তাহলি কি তারে বলেকয়ে দেব ছিটোয়ে তার গায়ে মন্ত্রপূত সেই নবগঙ্গার জল?

           তাহলি তো আর ঝামেলা থাকতিছে না। আমি তো লুকোইনি কিছুই! বলে কয়েই তো করিছি সব কিছু! 


            শেষপর্যন্ত বশীকরণ মন্ত্র আমার আর মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়ে ওঠেনি  কোনোদিনও। কিন্তু মৌচাক ভাঙার মন্ত্রটা, সেটির কি করি? নিরাপদদাকে ধরলাম। বললাম, কি করি বলো দেহি একবার --- কিভাবেই বা বুঝতি পারি তাই কও তো একবার আমারে ; চাকের মাছি যে কামড়াবেনানে এই নিশ্চিন্তি পাবার উপায়ডা কও দেহিনি আমারে! আমি কিন্তু ইডারও পরিক্ষে না নিয়ে কারোরে গাছে তোলবোনানে, তা কয়ে রাখতিছি তুমারে ; তুমি ইবারে ইডার উপায়ডা কও তো দেহি দাদা ---- বুঝয়ে দেও একবার, আমি তালিই তারে নিশ্চিন্তিতে উঠোয়ে দি। কও, কও তো, বুঝোয়ে  কয়ে ফেল তো দেহি ভাই ---- শ্যাষে যদি তারে কামড়ায়, তাহলি সে তো ছাড়বেনানে আমারে ; তহন তুমি থাকপানে কনে তা কিডা কতি পারে! তুমি থাকতি থাকতিই  একদিন একখান চাক ভাইঙ্গে দ্যাখপানে, কী দাঁড়ায় সিডা দেখা যাক একবার। 

            আমার এত কথা শুনে সে একটুও বিরক্ত না হয়ে অত্যন্ত শান্ত হয়ে বলে, অতো কথা লাগবেনানে কতি, একখান হাতিশুরোর গাছ এক নিঃশ্বেসে টাইনে তুলে আইনে আমার সামনে দাঁড়াও দেহি। না হলি শেয়াল কাঁটার গাছ ; শেয়াল কাঁটা চিনিছো, না চেন নি? ---- ওই যে, তুমরা  যারে কও  শেয়াল মুতির গাছ গো ; তয় হাতিশুরোই ভালো, কাজডা চটজলদি করে বেশ। নিয়ে আসো দেহি একনিশ্বেসে একখান, তারপর সেই খেন কোমোড়ির খুঁটি গুঁজে নিয়ে নামে পড় গে দেহি ; ওই যে গো, তুমাগের সুষমা মাসির আম গাছে দেহ গে একখান চাক পড়িছে। দেও গে ওই গাছের গোড়ায় মনতোরডা পড়ে থাবা মাইরে। দেহ কি হয়। দ্যাখপানে বারি মারার সঙ্গে সঙ্গে চাকের ভিতরে কেমন ঢেউ খেলি যাচ্ছে ; তার মানে কি জানো, ঢেউ খেলতিছে মানে, চাক ঠিক আছে। তহনিই যাবা চাকের কাছে। জানবা চাক ভালো। কোনো চিন্তা নেই। ধুনো ধরায়ে নিয়ে উঠে যাও গাছের মাথায়, কিডা থামায় তোমারে আর ; তয় একটা কথা কয়ে দি, ভালো করে শুনে রাহ এই কথাটুক, ভুলেও কিন্তু কখনো চাকের মুচা ছাড়া, মাছিগের বাসা যাতি থায়ে সেহেনে পোচ লাগাবানা কলাম । চায়ের সঙ্গে এটটুখানি মুচাও  রাখপা কলাম। ওটুক মাছিগের জন্যি। তাগের বাচ্চাগের জন্যি। চাক মোচা ছাড়া করবা না একেবারে! তা না হলি  একবার ভাইবে  দ্যাহো দেহি, যাগের মুহির থে তুমি তাগের এটটু এটটু করে জোগাড় করা খাবার ছিনিয়ে নিয়ে আসলে, তাগের কেমন লাগার কথা! ভাইবে দ্যাহো, তারা কি খাইয়ে বাইচপেনে---- সিডা একবার ভাইবে দ্যাহো ;  কথাডা মনে রাইখো কিন্তু, বার বার যিডা কলাম মনে রাখপা ভালো ভাবে।


            কে আর নিরাপদর কথা শোনে! 

            সুভাষকে রাজি করালাম। নিজে তো গাছে ওঠার ক্ষমতা নেই, তাই, নানা ভাবে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করালাম। বললাম, আমি মন্তর শিখিছি, কোনো চিন্তা নেই, চল, সুষমা মাসিরে রাজি করাই। তারপরেই চাকখান ভাইঙ্গে ফেলি গে, চল, কোনো চিন্তা নেই, তোড়ে মাছিতি কামড়াবেনানে। 

            সে প্রথমটায় রাজি হয়নি। বলে, শেষে যদি কামড়ায়ে আমারে ছুলে দেয়, তহনে তুমি থাকপানে কনে, আমি তো উঠপানে গাছে ; কনতে কি শিখিছ তার নেই ঠিক, আমারে কচ্ছ গাছে উঠতি; আমি মরি আর কি, তুমি তো বাইচে যাবানে! ও নিরাপদ বাগদির কথা রাহ তো, ও ছাই জানে, যদি জাইনতোই তালি একদিনও তো ওরে দেখতাম একখানও চাক ভাঙতি ! এই যে, যে জানে, সে কি চুপ করে বসে থাকতি পারে, সিডা কও তো ; ওই সেবার তো দেখলাম, যেবার চাক ভাঙার লোকেরা আইসলো, ও দেহি তহনে মেচি বিড়ালের মতো লেজ গুটোয়ে বসে থাকলো! কোলো না তো কিছুই! বললো না তো, তুমাগের সঙ্গে আমিও যাই! 

            এরপর আরো একটা কথা বললো, ওঁ..... এই জন্যই তুমি ওর পিছন পিছন ঘোরাঘুরি করতিছিলে দেখতিছিলাম এত দিন...! 


             তাকে নানা ভাবে বোঝাই। বলি, শোন এই কাজডা যদি আমরা করতি পারি, তাহলি আমাগের  সকলে কোন চহি দেখপেনে তাই ক দেহি ভাই একবার?তোর কোনো ভয় নেই ---- আমি  দেহিছি, চাকে কোনো দোষ নেই, ঢেউ খেলতিসে, কোনো ভয় নেই তোর। কিছু যদি হয় তো দেহে নিস নাহলি আমারেই---- কোনো অসুবিধে নেই, চল লাইগে পড়ি গে.....।

            শেষ পর্যন্ত সুষমা মাসিকে রাজি করিয়ে একদিন খুব সকাল সকাল, বেলা ওঠার আগে ধামা কাচি নিয়ে খড়ের বোড়ে বানিয়ে, তাতে আগুন ধরিয়ে  সুভাষের গায়ে মাথায় বেশ খানিকটা হাত বুলিয়ে জয় মা কালী বলে তাকে গাছে উঠিয়ে দিলাম। 

            সুভাষ মৌমাছির চাকে পোচ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলতে লাগলো, নারে, একেবারেই কামড়াচ্ছে না রে  .....!

            ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। নিচেয় তখন পাড়ার অনেকেই প্রস্তুত এই বলে,  সুভাষরে যদি একটা মাছিও কামড়ায় তালি তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে কিন্তু কয়ে দিচ্ছি ; ছাড়বোনানে তোমারে আমরা কেউ ।


            এই ঘটনার সঙ্গে শরৎ বাবুর ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তের ঘটনার কি কোনো তুলনা করা চলে ? হয়তো যায়, হয়তো যায় না। তবে ইন্দ্রনাথের শাপ ধরা মন্ত্র শেখার অপেক্ষার সঙ্গে তো খানিকটা মেলে? কিন্তু আমি যেন মনে মনে কোথাও এমন একটা সূত্র খুঁজে পেলাম, বা শ্রীকান্ত পর্বের আরো পরে আরো নানা কাহিনীর সঙ্গে এমন একটা সাযুজ্য খুঁজে পেতে থাকলাম নানাভাবে, যাতে করে আমার সমস্ত ভাবনা চিন্তার নানা আলো অন্ধকারে মেলামেশা করে বেড়াতে লাগলো এমন কত বিচিত্র সব ভাবাবেগ, যাতে করে আজ মনে পড়ে গেল নিরাপদদাকে। মনে পড়ে গেল জোছনা রাতে বা অন্ধকার রাতে নৌকো নিয়ে মাছ ধরার কথা। 

             শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তও চলতে লাগলো আমার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দিন পর্যন্ত। কিন্তু রাজলক্ষ্মী? সে সূত্রের কথা কত রকমভাবেই না জীবনে কত বিচিত্র পথে এলো আর গেল তার কথা কি সবটা বলা যাবে কখনো, কোনোদিনও ?


              আমার সামান্য টাকা মাস মাহিনা পাওয়া মা সেদিন যে এক কথায় তার অফিসের সহকর্মীর মাধ্যমে মাসে মাসে ধার করে এই এক দুইটি করে খন্ড শরৎরচনাবলী এনে দিতে থাকলো, আর সেই গ্রন্থগুলি পেয়ে আমার ভেতরে যে কত কিছু ঘটে যেতে থাকলো তার সবটা কি লিখে প্রকাশ করা আদেও সম্ভব?


              আস্তে আস্তে এই বাড়িটার দুপুরবেলাগুলি বেশ মানুষজনে ভরে উঠতে লেগেছে। ও বাড়ির ফোচনের ঠাকুমা আর কাজের দিদির লুডুর কোট চলে বারান্দায়। আর আমরা ঘরের ভেতরে। সে আড্ডায় ফোচন আলোক শংকর প্রথম প্রথম নিয়মিত উপস্থিত হতো। পরে অবশ্য আরো অনেকে জুড়ে গেছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখন আমি ওদের সঙ্গে আড্ডার মধ্যে কথায় কথায় শরৎচন্দ্রের কথা চালান করে দি। শরৎচন্দ্র নিয়ে বেশ একটা পাণ্ডিত্য দেখাতে যাই। কিন্তু আমার সেই পাণ্ডিত্য খুব একটা জায়গা পায় না। সকলেই বলে ঐ সব তো শাদামাঠা গালগপ্প। শংকর বলে,  শুধু শরৎচন্দ্র পড়লেই হবে! বঙ্কিম পড়েছিস? রবীন্দ্রনাথ পড়। মধুসূদন কে দেখ। তারপর তো থাকলো আরো। এখানে ওখানে মিলে সব দেখ একবার, তারপরে তো ভালোমন্দ সব বলতে পারবি। বিদেশী সাহিত্যও পড়তে হবে। আর মাইকেলটা ভালো করে দেখলেই বুঝতে পারবি দম কাকে বলে! একসঙ্গে ওইরকম চারখানা মহাকাব্য লিখে দেখাক তো কেউ! তাহলে তো বুঝবো ক্ষমতা আছে ! এসবের খোঁজ কর আগে। পড়। তারপর না কথা। এত সোজা না। সাহিত্য করতে চাইছিস তো, বুঝতে পারবি কত দম দরকার। এরপর তো আরো কত আছে। চেষ্টা কর তাহলেই সকলের খোঁজ এসে যাবে। আর কত বই-ই বা  তুই এই রকমভাবে কিনেকেটে পড়ে পারবি? লাইব্রেরীতে যেতে হবে, লাইব্রেরীতে যা। 

              কোনো তর্কে যাই না। সাধ্য বা কোথায়! এরা কত জানে! মনেমনে এই কথাই ভাবি। আমি কি জানি। আমার তো এখনো শরীর থেকে বুনো গন্ধই যায় নি। আর এরা সব মিশনারী স্কুলে পড়াশোনা করা ছেলেপুলে। আমার থেকে কত সচ্ছল! কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করেছে! আর আমি কোথায় কি! তাই ঘাড় নেড়ে তাদের কথায় সমর্থন জানাই , বলি, না ভাই সত্যিই তো, এসব সব কিছুই জানতে হবে। কিছুই জানি না। আচ্ছা, কীভাবে পাই তাই ক দেহি। 

              শংকর বললো, লাইব্রেরীর মেম্বার হয়ে যা। আমার সঙ্গে একদিন নাগতলায় চ। বড় লাইব্রেরী আছে। কথা বলে দেখা যেতে পারে, ওদের নিয়মকানুন জানতে হবে তো আগে, তারপর তো মেম্বারসিপ। 

              বললাম, নাগতলায় কোথায় রে? 

              ও বললো, আমাদের স্কুলের গলিতেই ।একেবারে মুখটাতেই। দেখবি মস্ত বড় একটা মাঠ আছে, ওখানেই। শক্তিসঙ্ঘ লাইব্রেরী। 


              দিন শুরু হয় বাগান তৈরি করার পরিকল্পনা দিয়ে। সকালবেলাটা কাটে সেই বিষয়ে খুঁটিনাটি নাড়িয়ে-চাড়িয়ে । বর্ষাটা শেষ হয়ে শরৎ-এর আকাশ দেখা দিয়েছে। সকাল সন্ধ্যায় শিউলি ফুলের সুবাস ভেসে বেড়ায় বাতাসে। কিরকম একটা পুজো পুজো আয়োজন। 


             নতুন বন্ধুবান্ধবরা ইদানিং সকলে পুজোর জামাকাপড় কেনাকাটার কথা বলাবলি করে। কে কোথায় কি কিনছে। কে কার কাছ থেকে কি পাবে না পাবে তাও ; এবং আগে আগে সেগুলি দর্জির কাছে বানাতে না দিলে এর পরে আর অর্ডার নেবে না।


              এই রকম সব আলোচনা ইদানিং। কেউ বলছে আরো কি কি কেনাকাটার আছে, কি কি কিনবে আরো ; মা যদিও আমাকেও বলেছে পুজোর জামাকাপড়ের কথা একবার যেন!  অফিস থেকে ধারে একটা একটা করে প্যান্ট-জামার পিস এনেও রেখেছে, আজই বললো সে কথা, এবং দেখালোও । তাতে অবশ্য আমি বলেছিও, থাউক না মা, রাইখে দেও না আলমারিতিই ----পরে হবেনে ওসব, এহনে যা ভিড় শুনতিছি তাতি আমার ওগের মতোন কোনো অস্থিরতা নাই। থাউক গে, পরে দেখপানে, রাহো এহনে ---- 


           ক'দিন হলো মা আর একটা কথাও বলেছে, তুই না হয় এখানের স্কুলে ভর্তি হয়ে যা। ও দেশের পড়াশুনোর দাম নেই এখানে। এখানে পড়তে হলে দুই ক্লাস তো নামিয়ে দেবেই। তাছাড়া তুমি তো কাগজপত্র কিছুই আনো নি আবার! 

            বললাম, কাগজপত্তর, কই না তো! যা পড়াশুনা করিছি তা তো যেটুকুন অভ্যাসে রইছে ; কাগজ তো তুলে আনিনি! তাহলি তুমি যা কতি চাচ্ছ তাতে তো এই দাঁড়ায়, এহেনে ভর্তি হতি হলি আমারে ওই যেমন ঘাড় ভাইঙ্গে বাছুরির  দলে নাম লেখাতি হয় তেমনই আর কি, তাই তো কতি চাচ্ছ ? ওসব বাদ দেও মনে ; ওতি আমার আর তেমন টান নেই। 

             মা বলে, সে কি রে! সে তুই কি বলিস..? তাহলে তুই করবিডা কি, পারবি না..? 

              বললাম, এ নিয়ে তুমি ভাইবো না, আচ্ছা তুমি ব্রজদার কাছে শুনে দেহ দেহি, রবীন্দ্ররচনাবলীর দাম কতো পড়বেনে ! আস্তে আস্তে যদি উনি এই সঙ্গে নেয় ! তাছাড়াও তো আরো আছে, বঙ্কিম সমগ্র, মাইকেল মধুসূদন ; আচ্ছা সে সব নয় আরো ধিরে ধিরে দেখপানে ; আসলে কি জানো আমার মনে হচ্ছে কি জানো, সবগুলোন যদি এক সঙ্গে পাতাম না, তালি বড্ড ভালো লাগতো! তবু তুমি এটটু কথাবার্তা কয়ে রাহো দেহি কি হয়, ক' খণ্ড তা কে জা... নে....!

              এর পরেই নিজের মনে নিজেই বললাম, কে যে ভালো করে কয়ে দিতি পারবে আমায়, তেমন মানুষির যদি দেখা পাতাম তালি বড্ড ভালো হত। এরা সকলিই উপর উপর জানে ; কার কাছে যে যাইয়ে শুনি, তালি কি ব্রজদার কাছেই চলে যাবো একদিন সোজা? 


              কোনো ধারাবাহিকতাই বেশিদিন সয় না যে। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠি । তাহলে কি সব সময় সব কিছুতেই বৈচিত্র খুঁজে চলে অন্তরালের মন? না না, তাও তো না ! তাহলে একটা নিয়মকেও এড়িয়ে চলতে পারি না কেন! দেহ-মনও তো একটা নিয়মের ফাঁদেই বন্দী হয় কেবল দেখি। কোনো নিয়মের বাইরে গেলেও তো দেখি শরীরও বিদ্রোহ করে বসে! সে যে কোনো ভাবেই ভাবি না কেন । এই যে, কিভাবে না কিভাবে যেন প্রথার সঙ্গেই হাতমেলায় দেখি স্বভাবও ! তাহলে যা চেয়েছিলাম বা চাইনি হয় তো, কিন্তু সেভাবেই তো সব কিছুই হচ্ছে দেখি এ যাবৎকাল ! আস্তে আস্তে এক ভাবে না এক ভাবে জড়িয়ে পড়ছি দেখি সংসারের বেড়াজালে । মিনমিনে একটা চাহিদার কাছে লোভও তো চেয়ে থাকছে দেখছি হাঁ করে। 

              ইদানিং যারা আমাকে ঘিরে এখানে সময় কাটাচ্ছে , তারা সকলেই তো বেশ সচ্ছল পরিবারের প্রথাবদ্ধ গন্ডির মধ্যেই বেড়ে উঠেছে জানি ; এইসব ছেলেপেলেরা কেউই আমার মতো উদ্দেশ্যহীন মানুষিকতার নয় তো! হয়তো তাদের মধ্যে আমার মতো একটা তাল-কাটা ভাব আছে হয়তো, আর সেই জন্যেই এখানে আসে। হয়তো এখান থেকে বেরিয়ে যাবার পরেই, তাদের দেয়ালের যেসব রঙচঙ তারা দেখতে পায়, সেই রঙের সঙ্গে আমাদের ঘরের ভেতরের এরকম চুনখসা ভাবটা তো নেই! এই যে একখানা টালির চালের হাটখোলা ঘরে, চারদিক খোলা একটা বারান্দা, ঘরের ভেতরে টালির চাল দেখা যায়, সেই চালের কাঠের আড়ার উপর দিয়ে ইঁদুর দৌড়য় তেলাপোকা দৌড়য় । জানলা খুললে পেছন দিক থেকে শালিক চড়াই কাক এসে ঘরের ভেতরে দৌড়াত্ব চালায়। দেয়ালের চুন খসে পড়ে ঝুরঝুরিয়ে। যেন দাঁতমুখ খিচিয়ে ভেংচায় আমাকে। মেঝে দিয়ে পুয়ে শাপ কেঁচো উঠে আসে বর্ষায়। কোনরকমে মেঝেতে একটা রাফ ঢালাই দিয়ে নিয়েই মা উঠে এসেছিল খাসমহলের সেই ভাড়াবাড়ি থেকে, এই ভেবে, আর যাই হোক সেই ভাড়া ঘরের চাইতে তো এ ভালো হলো! নিজের মাটি তো! পরে না হয় ধিরে ধিরে একটু একটু করে এগোনো যাবে এসব নিয়ে। পরিকল্পনা তো কত কিছুই থাকে, তাই বলে কি সব ঠিক ঠাক হয়! তাই যা হয়, নানা ঝড়ঝাপটায় দায়দায়িত্বের তোড়ে সে দিকে আর সংকলন করে ওঠা হয়নি। প্রতি মাসে সে যা মাস মাহিনা পায়, তা দিয়ে লোকজন নিয়ে কোনোরকমে টেনেটুনে চলে যায়। 

              বাড়তি উপার্জনের জন্যে পলট্রিফার্ম করা হয়েছিল। তা তো লোকজনের অভাবে এবং মড়কছড়ক লেগে লাটে উঠেছে। এর বাইরেও আর একটা বিষয়, সেরকম বড় করে, অনেকগুলি ধাপে, অনেক জায়গা জমি ঘর না হলে এ ব্যবসায় এই ছোটো আকারের লাভের অংশ আর তেমন কিছুই থাকতো না নাকি। 

              এর মধ্যেই আবার গোরু। গোরু পোষার কথা মাথায় আসাতে লাফিয়ে পড়া। ভেবেছিল এর থেকে বাড়তি উপার্জন হলে অনেকটা সংকুলান হয়ে যাবে। তাছাড়াও আর একটা চিন্তা মাথায় এসেছিল। দিদিমার মনোযোগ আকর্ষণ করা। তাও হলো কই ? আমি চলে এলাম এ দেশে। ভাই চলে গেল ও দেশে। সে পেছন ধরলো কাইলে মামার বলা নেই কওয়া নেই।

              তাই সে কি ভাবলো আর কি ঘটলো! কোনোটাই জীবনে পরিকল্পনামাফিক হয় না। ভাবনা চলে এক পথে, আর ঘটনা চলে আরেক দিক দিয়ে তার নিজের ঢং-এ। কাউকেই কেউ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না। সে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে থাকে।


( আগামী পর্বে )

পাঠ প্রতিক্রিয়া * শ্রীদাম কুমার






কবি দীপঙ্কর রায়ের ' আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার প্রতিপক্ষ' কাব্যোপন্যাসটি পাঠ করলেন  শ্রীদাম কুমার  





বহু আগে কাব্য-উপন্যাস অভিধায় প্রকাশিত পত্রিকা -পৃষ্ঠার আঁচলছেড়ে, দুই মলাটবদ্ধ সুচারু গ্রন্থরূপ কবি দীপঙ্কর রায়ের--" আমি-ইতোমার একমাত্র সাক্ষী, আমি-ই তোমার প্রতিপক্ষ" সম্প্রতি পড়ে, যুগপৎ বিস্মিত ও অভিভূত হলাম ।

ঠাসবুনোটের কাহিনী , প্লট, চরিত্রায়ন কিম্বা ঘটনার ঘনঘটা থেকে বহুদূরে ---সুলভ  দেখনদারির বাইরেই এক স্বতন্ত্র গৌরবের অধিকারী "আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী, আমি-ই তোমার প্রতিপক্ষ" গ্রন্থখানি।

কবি-প্রানতার অপার মগ্নতায় লেখনি ডুবিয়েই কবি দীপঙ্কর রায় নিজস্বতার রঙে অনুপম শৈলীর আধারে কবিতা-উপন্যাসের আদলে মূলত গ্রন্থটি গড়ে তুলেছেন । সংবেদনশীলতা আর মানবিকতার দীপ্ত চৈতন্যের স্ফুরণে তাঁর লেখনি সর্বদাই বেগবান। প্রচার -বিমুখ আত্মমগ্ন এই মানুষটি তাঁর যাপন  ও বিচরণের চারপাশের মানুষজন সমাজ রাজনৈতিক আবর্ত রাষ্ট্রীয় টানাপোড়েনের অভিঘাতের প্রান্তবিন্দুগুলিকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে অন্তর্বয়নে তুলে এনেছেন এই গ্রন্থের অক্ষরমালা আর স্বগতোক্তির মত অনন্য উচ্চারণ।

নামকরণ বা শিরোনামের কথা ভাবলেই আপাতভাবে মনের মধ্যে একটা বিরোধাভাস উদিত হয়।যে সাক্ষী সে-ই প্রতিপক্ষ ! কী করে হয়?সত্তার গভীরতর আলাপচারিতাতেই তা সম্ভব। তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে ক্ষীণভাবে হলেও স্মরণে আসে বিশ্ব সাহিত্যের কালজয়ী দৃষ্টান্তের কথা, 'জেকিল' 'হাইড'-এর'প্রসঙ্গ। রামপ্রসাদের প্রবৃত্তি- নিবৃত্তির কথা, বঙ্কিমচন্দ্রের কুমতি সুমতির কথা, কবি অজিত দত্তের একটি মেয়েরই হঠাৎ কখনো দস্যি আবার কখনো শান্ত হয়ে ওঠা--এমনি ধারা বহু কথা মনে ভেসে ওঠে। 

যেন এক দীর্ঘ কবিতা পড়ছি। ধীরে শান্ত লয়ে এই কবিতার ছন্দপ্রবাহ বয়ে চলেছে। শান্ত নদীর প্রবাহ যেমন সহজে বোঝা যায় না, এর তীরে নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়ালেই তা টের পাওয়া যায়। তেমনি এই বইটির ছন্দ প্রবাহ। "এপারে থেকেও আমি ওপারের আনন্দ কুড়াই" --তবে শুধু আনন্দ কুড়ানোই নয়, হাসি কান্না সুখ দুঃখের অবিমিশ্র ধারা একাকার হয়ে আছে গ্রন্থটিতে। ভাগাভাগির স্বদেশ রাষ্ট্র কাঁটাতার--এসবের কতটুকু মূল্য আছে হৃদয়ের মানচিত্রে? চিরন্তন মানবের হৃদয়ভূমিকে তা কখনোই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। তাইতো রাষ্ট্রের বেড়াজালে বন্দী-মানুষ এপারে থেকেও মনের অতলে বয়ে বেড়ান ওপারের শৈশব স্মৃতি বাল্যের নদীর সাঁতার আনন্দ-বেদনার যাবতীয় অনুষঙ্গ মাতৃভূমির মনভূমির যাবতীয় স্পর্শকাতরতা আর পিছুটান। সেই টান রয়ে যায় আমৃত্যু। এই মানুষেরা তাই সব সম্পর্কেই খুঁজে ফেরেন মানবীয় রঙ। সেই রঙ যখন কালো হয়ে ঢেকে যায় বা ফিকে হয়ে আসে তখন এদের অন্তর যন্ত্রণায় মথিত হয়। তারই অনুরণন কবিতা-উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ছড়ানো।

সত্তার  আলাপে আমাদের আত্মবোধকে দাঁড় করিয়ে দেন এক জিজ্ঞাসা চিহ্নের সম্মুখে--

"পাশাপাশিই তো ছিলে

থাকতে থাকতে কেউ আগে... কেউ বা পরের......

যাওয়া-আসা যখন নির্ধারিত--

                 যা তুমি জেনেও জানো না

               যা তুমি না জানার বেমালুম ভুলে 

অর্জন করেছ নিষ্ঠুর মুখের গড়ন 

চোখের ঝাপসা বর্ণ;

কারো কান্না মানে, তোমার জীবন

কারো কান্না মানে, তোমার জাল বড় হওয়া

কারো সংসার ভাঙলে

                                              ভাসলে সিঁদুর 

তুমি মনে কর, তোমার গঙ্গাভ্রমণ? "


এ কাব্যভাষায় ভাসতে ভাসতে এক সময় মনে হয় "When many a voice is silent /There is one and only voice/ That raises its voice against injustice!" এরকমই একটি স্বর এখানে  আমরা শুনতে পাই--

"পাঞ্জাবি ওড়ে

 সাধারণতন্ত্রের মঞ্চ ছাড়ানো পতাকার চাইতেও উঁচু

 সংলাপ হয় উচ্চারিত :  "  যে ঠিকানা জমির ছিল

                                                       খেতের

মাঠভরতি ফসলে যে তুমি, তুমি-ই—

না হলে তোমার স্বজন যারা

তাদের সকলের শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা

তোমার পায়ের তলার ঠিকানা চিনবে না

চিনবে শুধুই নদী।

যে তোমার অস্থিচর্ম খায় গিলে ! "

কবি প্রশ্ন তুলেছেন নদীর কাছেই কি-- " কুলের   ঠিকানা খুঁজছো ?"

এই নিভৃত আলাপের পর কবিতার ভাষায় লেগেছে কাহিনীর রঙ, আলতো করে ছুঁয়ে ফেলেছে উপন্যাসের বৃত্ত--

"তার কাছে শোনো

যে অনেক কাহিনীর মূল জানে—

শ্যাওলা-সবুজ প্রান্তরের জল-কাদা দোলে যে হাওয়ায়

কত হোগলাবনে, কে কার মন দেওয়া নেওয়া কোরে

                               গেয়েছিল হৃদয়ের গান "

তবে শুধু হৃদয়ের গান গাওয়াই নয় আছে আরো অন্য কথা--

"কে কার জরায়ুর ভাঁজে দুই-ঠ্যাংদুলিয়ে আত্মকথা করেছিল মুখস্থ/কে কার সাথী বিশ্বাস, অনামিকা করণ/...ভাঁজে যেতে যেতে ছাড়িয়ে খেয়েছিল/আঁশফলের অনেক শাঁস? "

'ঝাঁপি খুলে' এই মগ্নকবির বুকের গভীরে লালিত স্বপ্নটি উঠে আসে--

" 'এ গঙ্গা সে গঙ্গা রইবে পাশে ' 

    --    --   --

তোমার সন্তান বোঝাবে তোমায় আবাদি-ভাষা

আরো পরিষ্কার করে অন্য এক জীবনের সুর-- 

চলো সেই দেশের খোঁজে "

 সেই দেশের খোঁজে এসে সন্তানের চোখে লাগে বাস্তবতার লঙ্কাগুঁড়ো। তাই কবিতার সংলাপে উচ্চারিত হয়--

                 "  বহু হতাশার পথ ভাঙি

                    পথ ভেঙে পথকে করি  সঙ্গ"

                    

বাংলা কবিতা  ধারায় কবি দীপংকর রায়ের জীবনানন্দ দাশ চর্চা ও প্রীতির বৈভব তাঁর কবিতার ভাষায় ও ভাববোধে কোথাও কোথাও এনেছে ঐতিহ্য চেতনার রঙ। এটিকে জীবনানন্দ দাশীয় প্রভাব না বলে 'শেকড় অভিলাষী' চৈতন্যের ঐতিহ্য বলা ভালো। 'দুই- ঠ্যাংদুলিয়ে'এরকম শব্দবন্ধের ব্যবহার সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। '১৯৪৬-৪৭ 'কবিতাটির রেশ যেন  ক্ষণিকের জন্য হলেও বেজে উঠেছে--"কে অভিমন্যু মন্ডল, শেখ আখতার, কুদ্দুশ -ই-বা কে" যেমন খন্ডিত -স্বদেশ নয়, তেমনি খন্ডিত সত্তার অন্বেষণ নয় , তাঁর আর্তি সমগ্রতার অভিলাষী।

 "তোমার মধ্যে মন বসত করে কয়জনা?"গানটির কথা মনে এলেও-- বইটিতে দুই মলাটে মূলত দ্বৈত সত্তার আবহেই গভীরতর  ভাষ্য রচিত হয়েছে। যার অভিমুখটি রয়েছে চিরন্তনতার দিকে অনন্ত যাত্রায় সমগ্রতার খোঁজে--

"অপ্রয়োজনের অধিকারে যে জীবন যৌক্তিকতা ছাড়া 

অযৌক্তিক সাহচর্যে অবিমিশ্র হারায়

তার দিকে কবে হবে সেই  সমগ্রের মহাযাত্রা?"

বইটির প্রকাশক "এবং কথা" প্রকাশনী। প্রচ্ছদ শিল্প-শোভন। গাঢ় বাদামী রঙের মাঝে একটি নদীর আভাস। মনে হয় , এপার বাংলা ওপার বাংলাকেই দ্যোতিত করছে।  প্রচ্ছদশিল্পীর অকুণ্ঠ প্রশংসা প্রাপ্য।নামাঙ্কন বর্ণবিন্যাস মুদ্রণ বোর্ডবাঁধাই সবকিছুই ধ্রুপদী মানের। "এবং কথা "প্রকাশনা গুণমানে বলিষ্ঠতার  স্বাক্ষর বহনকারী। বইটির প্রকাশে বাংলা  কাব্যসাহিত্য জগৎ সম্মৃদ্ধ হলো, এ আমার নিশ্চিত বিশ্বাস। সংগ্রহযোগ্য এই গ্রন্থটি নিবিষ্ট পাঠকের কাছে এক পরমপ্রাপ্তি।

 

*******************************************************************************************



শ্রীদাম কুমার  

জন্ম : ২৪ এপ্রিল ১৯৭৩  ভাড্ডি গ্রাম,গড়জয়পুর,পুরুলিয়া। একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম , বেড়ে ওঠা ।অন্তর্মুখীন স্বভাবের,প্রচারবিমুখ। কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও সাবলীল । 'মাদৈল', অরন্ধন, রঙিন ক্যানভাস, 'কবিতা আশ্রম'-এর মত ওয়েব ম্যাগাজিনে মাঝে মধ্যেই কবিতা প্রকাশিত হয়ে থাকে।'এবং কথা'-র মত ধ্রুপদী মানের মুদ্রিত পত্রিকাতেও লেখা বের হয়েছে।


পাঠ প্রতিক্রিয়া * তন্ময় রায়



 ' আলোপাখি ' : ভূমি থেকে ভূমাস্নাত পর্যটনলিপি

   তন্ময় রায় 



' আলোপাখি ' পড়া শেষ হল। সমস্ত মন জুড়ে এখন 'আলোপাখি'র ছায়া । আহা: কী শান্তি ,কবিতা পাঠের। কবির ভাবনায় স্পৃষ্ট হবার।

আপন মনেই ভাবছি , কে এই ' আলোপাখি ?' জীবনানন্দের ' দোয়েল-শ্যামা-ফিঙে '  সে নয় , হাজার হাজার মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়া বোদলেয়ারের আলবার্টসও নয় সে , তবে সে কোন পাখি , যার পাখায় ভর করে বারেবারে কবির ভূমি থেকে ভূমায় পর্যটন ...সমস্ত 'আলোপাখি' কবিতা গ্রন্থটি জুড়ে।


আমার মনে হয়েছে, আর কেউ না , ' আলোপাখি ' আসলে কবির অন্তরে লালিত এক অনন্ত অবিনাশী সত্তা। যার সঙ্গে কবির জন্ম-জন্মান্তরের সখ্যতা । কবির যত আবদার, যত অভিযোগ ,অনুযোগ ...সব 'আলোপাখি'র কাছে । তাই তিনি খুব সহজেই বলতে পারেন ---  " আলোপাখি ,/ আমি তো চিনি না পথ /শুধু যেন কানে আসে রাখালের সুর/ তুমি কি দেবে না বলে নিদ্রা থেকে জাগরন কত শত আলোকবর্ষ দূর.."

যেন মায়ের কাছে সন্তানের আবদার ' আলোপাখি,/ আমি তো চিনি না পথ ...' এবং এই আর্তি, এই ব্যাকুলতা প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই ঘুরে ফিরে এসেছে। কিন্তু আশ্চর্য , ক্লান্তি লাগেনি এতটুকু, বরং মন যেন প্রস্তুত হয়েই থেকেছে , শিশুর সারল্যে কবি কখন বলে উঠবেন----" আলোপাখি,/আলো দিয়ে বাঁধা সেতু ...ছায়া ছায়া ,/মধুপুর ...মধুপুর কত কত জনমের দূর!/ এভাবে নাচাবে যদি নূপুরের বেঁধে দিও/ ও -ওপারের সুর।'


কামনা-বাসনার ষড়রিপুর শেকলে তিনি বন্দি " আমি তো শেকলে বাঁধা দুই পায়ে বাসনার '' কবি জানেন ; তবু প্রগাঢ় প্রত্যয়ে তিনি বলে ওঠেন---" আলোপাখি,/ তুমি আছো আর কী-ইবা চাই !/সুখ- দুখ জোয়ার-ভাটার খেলা দেখে যাই হৃদয়গঙ্গায়..."


এইভাবে আলোপাখির আশ্চর্য আলোয় স্নাত হতে চেয়েছে কবি-প্রাণ, কখনো অনুপম রূপকে-চিত্রকল্পে, কখনোবা ছন্দে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, তাঁর ব্যবহৃত ছন্দ এতটাই সহজ স্বতস্ফূর্ত কবিতার ভাবের সঙ্গে ছন্দের দোলায় মন আপনিই নেচে ওঠে, আরোপিত মনে হয় না কখনো।


'আলোপাখি' সর্বমোট ষাটটি কবিতার সংকলন। স্বতন্ত্র কোন নামে কবিতাগুলিকে চিহ্নিত করেননি কবি। বিষয়ে ভাবে ব্যঞ্জনায় 'আলোপাখি' যেন ষাটটি ফুলে গাঁথা একটি অনুপম দীর্ঘ কবিতার মালা।


'আলোপাখির প্রাকভাষ' নিবন্ধে শ্রদ্ধেয়া পারমিতা ভৌমিক লিখেছেন, "....এসব কবিতা যেন মন্ত্রে পরিণত হতে চাইছে ...সেইটাই এর অভিমুখ।"এ যে কত বড় সত্য উপলব্ধি , প্রিয় পাঠক,কবিতাগুলি পাঠ না-করলে ,সম্যক উপলব্ধি করা যাবে না। কবির বোধ মনন এবং অবশ্যই কবিতাধ্যান যেখানে একক স্বরের স্থিতি পেয়েছে ,সেখানেই উচ্চারিত হয়েছে মন্ত্রের মতো সব পঙক্তি । কয়েকটি দৃষ্টান্ত ----


১) সারারাত এই বেহায়া শহরে পাগলা দাশুর মতো অনন্ত আঁধারে ভিজেছি...


২) আমার চেতনে চন্ডীদাস সিঁধকাটে, দূরের খেয়ার মতো ডাকে যেন কবীরের দোহা


৩) কপালে চাঁদের টিপ দুই চোখে নীলনদ গঙ্গা-যমুনার মতো অমল সকাল


৪) ভাবের ভিখারি আমি এ-পথে সে-পথে হেঁটে শেষমেশ মানুষের ছায়ায় দাঁড়াই


৫) আহা :, বাতাসে চন্দন-ঘ্রাণে আমি যেন অলীক সকাল।


৬) পাঁচ হাজার বছরের বৈদিক শিশির সারারাত আমাকে ভেজায় সামগান মন্ত্রের মতন...

 

এমনই আরো...



আলোপাখি/ পঙ্কজ মান্না 

প্রকাশক / কবিপত্র প্রকাশ


******************************************************************************

পাঠ প্রতিক্রিয়া * সব্যসাচী মজুমদার



নতুন বাংলা কবিতা

সব্যসাচী মজুমদার


বাংলা কবিতার ইতিবৃত্ত সবসময় নির্ভর করেছে তারুণ্যের ওপর এবং ভঙ্গিমার বদল ঐ তারুণ্যেই হয়,এ কথা বলা অত্যন্ত বাহুল্য হলেও উত্তর দু-হাজার কুড়ি, অর্থনৈতিক বিবর্তনটা যখন খুব দ্রুত ঘটছে,কতটা ঝাঁকুনি দিল বাংলা কবিতাকে,কি নতুন বিণ্যাস পাওয়া যাচ্ছে ---হদিশ পাওয়াটা খুব জরুরি বলে পূর্বোল্লিখিত কথা কটি আরেকবার মনে করা দরকার বৈকি যখন এই আলোচনা চার গুরুত্বপূর্ণ তরুণ কবির কবিতার শরীর পড়তে চলেছে।


             প্রাজ্ঞ,আপনি জানেন বাংলা কবিতায় একটা বহু চর্চিত ও অদরকারি তর্ক আছে, শহরের কবিতা আর মফসসলের কবিতা । কিছু কমন চিহ্নের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে মূলত তর্কটি ঘণীভূত হয়। কিন্তু বলুন তো মণীন্দ্র গুপ্ত বা নারায়ণ মুখোপাধ্যায়কে কিংবা রমেন্দ্র কুমার কোন শ্রেণিতে পড়বেন?কুর্চি পাহাড়ে বুনো কুল খাওয়ার প্রস্তাব তো মফসসল,শহর,সব ভেদ করে আবেদন জানায় আন্তর্জাতিক পাঠষ্ক্রিয়ার কাছে।আসলে কিছু কিছু মানবিক চিহ্ন রয়েছে যা ভূগোল ব্যতিরেকে অবিকল। সেই চিহ্নগুলিকে বাংলা ভাষার অনেকেই আত্মস্থ করেছেন, ইতিমধ্যেই।ফলে এ তর্ক যেমন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়,তেমনি জীবানু যুদ্ধকালীন সময়ে যখন আন্তর্জাতিকতা যখন মানুষের মুঠোয় পৃথিবীর মতন,সতর্ক হয়ে লক্ষ্য করতে হয় বৈকি, বাংলা কবিতার তরুণ প্রজন্ম কোথায় তার নির্ভরতা রাখছে,কাকে করে  তুলছে তার বৈদুর্য?


            যেমন প্রতাপ হালদারের নতুন ব‌ই 'ডোয়া'পড়তে গিয়ে যখন,"রোদ পরে আসে লালকচাগাছের পাতায়।" পঙক্তিটার সামনে দাঁড়াই , মনে পড়ে নব্ব‌ই দশকে ছেয়ে থাকা 'এন্টেনা'শব্দটা ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত।আর কিছু দিন পর গুগল করে জানতে হবে এন্টেনা কী, কিন্তু বৃক্ষ প্রেষণা যে আজ‌ও দৃশ্যের জন্ম দেয়,এই সময়ের তরুণ লেখেন,"মুলিবাঁশের ছায়ায় আহারের ওত"বিস্মিত হয়ে দেখি কী অনায়াসে ক্রিয়াপদ সরিয়ে দিয়ে 'ওত' শব্দটিকে জ্যান্ত করে দিলেন।এই পাঠকের চোখে ভেসে উঠলো গুগাবাবার প্রহরীরূপি নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের দুটো ধকধকে চোখ।

কৃত্তিবাসের থেকে একটু দূরে থাকেন তরুণ কবি প্রতাপ।তাঁর এক ফর্মার সবুজ রঙের পুস্তিকায় যেন লিখেছেন এক অনিঃশেষ জনপদাবলী।না ফুরনো আঁচ আর আহারের কথাবার্তাগুলো,


"হলদে পাখি ডেকে ওঠে পিলালো পিলালো

বীজ করবে বলে থাবাগাঁদা বেঁধে রাখে মা

কেমন উঠোন জুড়ে আলো "(ভিটে)


পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলা রাশিয়ার আক্রমণ, ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা, আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলের দর হ্রাস-বৃদ্ধি,আই পি এল ইত্যাদির মধ্যে ঐ 'থাবাগাঁদা'গুলোই জাদুর মতন ঘটে চলেছে নিশ্চিতভাবে,এমনকি বাংলা কবিতার রন্ধ্রে ঢুকে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে,


"কাত করা বাড়ির থেকে

উনুনে বাঁশের গিঁট ফাটার আওয়াজ

কানে এলে ভাবি , এইমাত্র বাড়ি এল পলানি

মরে যাওয়া খিদেয় ভাত অল্প লাগে জানি,

এখানে বর্ষা এলে বাঁশপাতা কাঁদে"(বাড়ি)


আহারে বাংলা কবিতা!মুগ্ধ হয়ে থাকি।মরে যাওয়া খিদেটুকুর অনুবাদ নেই সম্পর্ক রয়েছে।


"একটা চালতাফুলের

ঝুঁকে পরা চাউনি দেখে

                        বিব্রত ময়ূর হয়ে পড়ি।"(ময়ূর)

'ঝুঁকে'আর 'বিব্রত'শব্দ দুটির নিপুণ ব্যবহার ঐ বিব্রত হয়ে পড়াটুকুকে পাঠকের শরীরে জীবন্ত করে দেয়।ছবির পর ছবি তৈরি করে গিয়েছেন প্রতাপ।তাঁর যাপনের,তাঁর শরীরের চারপাশে যা কিছু অতি নিশ্চিত ঘটে চলেছে তাদের কিছুটা রঙেই নির্মাণ করতে চেয়েছেন একটি বিকল্প-বাস্তব। অথচ যা অনায়াসেই ভেতর অবধি পৌঁছে যায় গৌড় সারঙের মতো,


"বাজারপাড়ার আলতো ধুলোর কাছে

গুডুরি পোশাকে শুয়ে থাকে চাষের জমি,"(এখানে)

       ঠিক একই প্রতিবেশে জারিত হতে হয় এর পরেই অভিমান্য পাল প্রণীত কাব্য পুস্তিকা 'জানালার মেঘ 'পড়তে গিয়ে। বস্তুত বাংলা কবিতা তার নিজস্ব বিনির্মাণের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বেছে নিয়েছে তার নিজস্ব ভূখণ্ডের স্বভাব।যাকে নির্ভর করে গড়ে গড়ে ওঠে অন্ন -সংহিতা।যে দেশ নিরপেক্ষ আততি মানুষের অপর বাস্তব তৈরি করে,তাকেই শ্রম পৃথিবীর প্রতিনিধি অভিমান্য নির্ভর করে লিখলেন,

"কোথায় লুকিয়ে আছে মেথিডাঙা বাঁধ

তার পারে হিজলের ঝোপ থেকে

অচেনা পাখির ডাক"(সম্পর্ক)


 লক্ষ্য করে দেখুন এই আন্তর্জাতিকতার চৌকাঠে ঢুকে পড়া সভ্যতায় দাঁড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বের তরুণ কিন্তু নির্ভর করছেন সেই সব ধারণাকে,যারা আবহমান ঘটে চলেছে প্রতিক্রিয়াগুলির অন্তরালে।আসলে এ থেকে বোঝা যায় অনায়াসেই যে শিকড়ের অন্তর্গত অনুভব‌ই কিছুটা জীবন্ত রেখেছে বাংলা কবিতার ইতিবৃত্তকে,

"কে যেন সকাল সকাল 

মিথ্যে আয়ু নিয়ে চলে যায় পিয়নের মতো"(পিয়ন)

        সেই বর্ষা হরকারাদের কথা মনে পড়ে যায়, মানুষের নিজস্ব অমল চিহ্ন হয়ে ওঠে কবির। জীবনের নিরপেক্ষ প্রেমের কাছে সত্যবদ্ধ পংক্তি তৈরি হয়,


"পুকুরের জল,কলমির শাক,হাঁস চ‌ই চ‌ই...

হরিতকির ডালে দোল খাচ্ছে

                                 বাতাসের বাহানা "


'বাহানা'শব্দটার ব্যবহার করার পরেই কবি লিখছেন,


"শঙ্খ বাজাও দূরাগত স্বরে...


আহ্বান যেন স্বতোৎসরিত সময়ের রব হয়ে ওঠে। সংক্ষিপ্ত এক পুস্তিকায় কবি যাপন করেন তাঁর নিজের বিনির্মাণ কিংবা অপর -বাস্তব। কিন্তু অনিবার্যভাবে আস্হা রাখেন আত্মনৈর্ব্যেক্তিকতায়,


"ভিতরে আবছায়া ছিল

সবুজ হরিণ বনে,

পৃথিবী ভেসে গেলো নীল কুয়াশায়..."(দূরবীন)


সমিধ গঙ্গোপাধ্যায় প্রণীত 'নিউক্লিয়াসের বিষ 'আবার আরেকটি অর্থের চিত্র নির্মাণ করছে এক‌ই সময়ে দাঁড়িয়ে।যে ক্ষয়িষ্ণুতা নিবিড় হয়ে একটা সঙষ্কৃতি রচনা করছে,সেই বাস্তবের রং মিশিয়ে নেন সমিধ তাঁর কাব্যে।দুই ফর্মার পুস্তিকায় সরাসরি কথা বলতে চেয়েছেন কবি,



"-তোমার জাত?

-জানি না, ইতিহাস পড়তে ভালো লাগে না

-তোমার ধর্ম?

-জন্মান্ধ সাপ ছাড়া সব‌ই সহ্য করতে পারি"(প্রার্থীতালিকা থেকে ৩০৪ নম্বর)


বাংলা এমন একটা ভাষা,তার লিরিক প্রবণতাকে কাটিয়ে প্রতিকবিতার দিকে যাওয়া ভীষণ দুরূহ। মণীন্দ্র গুপ্ত, তারাপদ রায়, সুবোধ সরকার এমত কতিপয় স্বর‌ই হয়ে উঠেছে প্রতিকবিতার বাঙালি প্রতিনিধি। কঠিন খুবই কঠিন সেই নির্মাণের ওপরেই নির্ভর করেছেন সমিধ।


"আমাদের মধ্যে ইবোলার খপ্পরে পড়া একটা নাদুসনুদুস

মহাদেশ ছিল

যার শুতে চাওয়ার যাবতীয় অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো কিভাবে 

শমিত করবো সেই নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠতাম "(এক দশকে মঞ্চ খসে যায়)

কিংবা

"শিল্পের কদরে যে অমাবস্যা থাকে,

তার কাছে হেঁটে গিয়ে দেখার অভ্যাস

তুমি ছাড়তে পারো না "(ধর্না মঞ্চে গ্রেফতার হ‌ওয়া প্রেমিকের স‌ওয়াল)


সমিধের কবিতায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ফাক, শপিং,স্বপ্নদোষ, ইয়ার্কি,তোতলামি,চচ্চড়ি, বেঞ্চের তলা ইত্যাদি শব্দগুলো।একটা পরিচ্ছন্ন আত্মপীড়ার চিৎকার তৈরি করে।ক্ষ‌ইতে ক্ষ‌ইতে হঠাৎ খুনি হয়ে ওঠার মতো আত্মপীড়া চিৎকার করে বারবার।দেখায় সেইসব ছবি যা দেখার আগেই আমরা চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম,


"যুযুধান আত্মীয়স্বজন প্রাণপণে

সন্ধ্যের দিকে মাঠে ন্যাকড়ার পাশাপাশি শুয়ে থাকে "(অ্যাপোক্যালিপসের হপ্তাখানেক আগে)


বারবার নিজেকে আঘাত করতে করতে কাব্য গুঙিয়ে বলে উঠছে কিমাকার অংশের এবড়োখেবড়ো সব জীবনের চূড়াবিন্দুর কথা,


"লিঙ্গহীন যেসব ইতিহাস

খতিয়ে দ্যাখো সেইসব অর্ধপাচ্য অস্বস্তি ছুটকোছাটকা

সাক্ষীদের সালতারিখে মুড়ে পুরু জিভের নীচে রেখে

দেয়নি তো?"(চাবুক যে কথা জানে)


 ঠিক এই অবস্থান  থেকে কিছুটা সরে

"যুগ থেকে যুগান্তরের ভাত রান্না হয়ে চলে অবিমিশ্র

আবেগের আগুনে।"(আগুন)


লিখছেন শর্বরী চৌধুরী তাঁর 'মখমলের ইস্তেহার 'কাব্য পুস্তিকায়।ক্ষিদে আর কৃষকের আততি একাকার হয়ে একটা তীব্র জৈবিক মানুষের ইঙ্গিত দিয়ে শুরু হলো কাব্য। ঈষৎ নির্জনতায় বলে যান একজন গভীর আয়ুর তত্ত্বগূঢ়তা,

"বার্ধক্যের ঘুম বড় প্রতারক 

আলোগাছ কখন যে ধূলিসাৎ বোঝা দায় 

নির্জনতার কথা আস্তিক্যের কথা ফুরোয় নিমেষে।"(আলোগাছ)


শর্বরী চৌধুরী পৌঁছে গিয়েছেন এমন একটি পিনদ্ধতায় ,যেখান থেকে দেখতে পারছেন সম্পর্করহিত একটি উদাসীন জীবনকে।যে কেবল নৈর্ব্যক্তিকভাবে তার স্মৃতিজাত ধারণার কথা লিখে চলেছে।এর বেশি কোন‌ও সাপেক্ষ তার নেই। কিন্তু কী নির্মম এঁকে দিয়ে যান একটি ক্ষতের চিহ্ন,


"চোখে মুখে অবিরল ক্ষত

হাতের পুতুল পড়ে ঘাসের ওপর।"(ক্ষত)


এই আমাদের সময়ের চূড়াবিন্দুকে দেখে ফেলেন শর্বরী।একটি অপাপবিদ্ধ যাপনবৃত্তান্ত থেকে প্রায় শ্লোক যেন রচে ফেলেন তিনি।পঙক্তিগুলো হয়ে ওঠে এক একটা টীকা,


"প্রকৃত শোকের কাছে মাথা নত করি।

সে আমাকে শেখায় স্তব্ধতা"(উত্তরণ)

কিংবা

"তোমার চোখে বাসা বেঁধেছে মৃত্যুর জোনাকিরা

এক অকপট কলহ বড় প্রয়োজন এখন।"(অকপট)


যে সত্যের কথা আমরা সবাই জানি অথচ শর্বরীই কেবল জানেন,সেই জায়মান বাস্তব ঘিরে থাকে লেখাগুলোর ভেতরে।অস্হিরতার শেষে একটা নির্ভর আসে এই পাঠকের।বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে,


"লেহন করি চতুর্বর্গ আয়োজন

সব তাপ মুছে গিয়ে পুনর্বার জেগে ওঠে খিদে।"(খিদে)


কোন‌ও সতর্ক নির্মাণের কাজ করেননি কবি।নির্মোহ ভাষায় জানিয়ে যাওয়াটাই করে গেছেন, অন্ততঃ যে ভাষা তাঁর অধিত,


"অতিথি পাখির ডানা আহত করে;"(বীজ)


পিনদ্ধ শব্দ ব্যবহার শর্বরী চৌধুরীর স্বভাব। বিনীত বলিষ্ঠতায় বলে গেলেন সমস্ত সম্মোহন। একটি পরিক্রমা শেষে এটুকুই বলতে পারি,এই পাঠকের পাঠকষ্ক্রিয়া এটি একান্তভাবেই।চাই তর্ক হোক।বিরুদ্ধতা আমার পাঠকে পূর্ণ করুক।ব‌ইগুলি আপনার উইশলিস্টে থাকুক।


ডোয়া:প্রতাপ হালদার: একালের কবিকণ্ঠ: প্রচ্ছদ:সুমিত দাস: তিরিশ টাকা

জানলার মেঘ:অভিমান্য পাল:ধানদূর্বা:প্রচ্ছদ: কৌশিক দাস: তিরিশ টাকা

নিউক্লিয়াসের বিষ:সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়:সৃ প্রকাশন: প্রচ্ছদ: চিরঞ্জিত সামন্ত: পঁয়ষট্টি টাকা

মখমলের ইস্তেহার:শর্বরী চৌধুরী:পাঠক:ষাট টাকা 


( ক্রমশ )


***************************************************************************



সব্যসাচী মজুমদার

 এ সময়ের অন্যতম শক্তিশালী তরুণ কবি। তাঁর কবিতার শব্দ ব্যবহারের চমৎকারিত্ব, ভাবনার গভীরতা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে তাঁর তিনটি  কাব্যগ্রন্থ : মেঘ আর ভাতের কবিতা , আজন্ম ধানের গন্ধে এবং তৃতীয় পৃথিবী ।