কুমিরের কান্না
দেবাংশু সরকার
রজত রায় একজন এম এল এ। রাজনীতিবিদ হলেও এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। তিনি একজন রাজনীতিবিদ হয়েও অনান্য রাজনীতিবিদদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একজন এম এল এ হলেও তার দলের অনান্য এম এল এ দের থেকে গুনগত, চরিত্রগত দিক দিয়ে যেন শত যোজন দূরে অবস্থান করেন। জীবনের সব ক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ চোখে পড়ে। রজত তেমনি এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ। সাধারনত রাজনীতিবিদরা নিজেদের একটা গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখেন। জনসাধারণের থেকে তারা যে আলাদা সেটা প্রচ্ছন্ন ভাবে বুঝিয়ে দেন। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ ভাবে সতর্ক থাকেন। কিন্তু রজত সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতার মানুষ। নিজেকে জনসাধারণের একজন বলেই মনে করেন তিনি। তার সঙ্গে না থাকে সরকারি নিরাপত্তা না থাকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা। মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ান কখনো একা, কখনো পার্টির নামমাত্র কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে। রোজ সকালে ব্যাগ হাতে বাজার করতে যান। বাড়িতে তিনটে গাড়ি থাকতেও অনেক সময়ে তাকে সাইকেল চালাতে দেখা যায়। সাধারন মানুষ শ্রদ্ধা মিশ্রিত অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে, আর ভাবে এতো বড় নেতা কিন্তু একেবারে মাটির মানুষ! বিন্দুমাত্র অহঙ্কার নেই!
সত্যি একেবারে মাটির মানুষ রজত। দিনের বেশির ভাগ সময় পায়ে হেঁটে এপাড়া ওপাড়া ঘুরে বেড়ান। এর ওর বাড়ি ঢুকে গল্প জুড়ে দেন। চা খাওয়ানোর আব্দার করেন। হাসি মস্করা করেন। এমনকি বাচ্চাদের সঙ্গে লুডো খেলতেও বসে যান। নিজের বিধানসভা এলাকার প্রতেককেই খুব ভালো ভাবে চেনেন। প্রত্যেকের সুখ দুঃখের খবর রাখেন। বিপদে আপদে, অসুখে বিসুখে সব সময়ে জনগণের পাশে থাকেন। কত রাত যে তার হাসপাতালে কেটেছে তিনি নিজেও মনে করতে পারেন না। আনন্দ উৎসবে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। পাড়ার পুজোয় চাঁদা তোলা থেকে বিসর্জন সবেতেই থাকেন সক্রিয়ভাবে । বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলতেও যান। কোনো জোর জুলুম নেই, গৃহস্থের দিকে চাঁদার বিল বাড়িয়ে তাদের অনুরোধ করেন টাকার অঙ্কটা লিখতে। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আবির মাখতে মাখতে ঠাকুর বিসর্জনে যান। কখনো ঢাক বাজান। কালীপুজোর পঙতি ভোজনে সপরিবারে অংশ নিতেও দেখা যায়। বলতে গেলে জনগণের সঙ্গে কোনো দুরত্বই নেই তার। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে কে নেতা, কে জনতা আলাদা করা যায় না। তাই তার পার্টি অফিস সবসময়েই রথের মেলার মত লোকারণ্য থাকে। সবার সঙ্গে তিনি ধৈর্য ধরে কথা বলেন।
দেখতে দেখতে ভোট এসে গেছে। রজতও ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। প্রত্যেক দিন বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ, মিছিল, বাড়ি বাড়ি প্রচার সব কিছুই শুরু হয়ে গেছে। নাওয়া খাওয়ার সময় নেই রজতের। সারা দিন দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। এবারের প্রচারে একটু অভিনবত্ব দেখা যাচ্ছে। এক কুখ্যাত দাগী আসামীকে রজত সঙ্গী করেছেন। যে কিনা কয়েক বছর আগে রজতের দলের বেশ কয়েকজন নেতা কর্মীকে খুণ করে জেল খেটে এসেছে। ভাষণ দিতে গিয়ে রজত সব জায়গায় সেই ব্যাপারেই বলছেন, "আমি বিশ্বাস করি পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়। তাই আমি কালুকে আমার দলে নিয়েছি। আমি আমার অহিংস আদর্শে চালিত করে অপরাধী কালু, পাপী কালুর মধ্যে থেকে মানুষ কালুকে বের করে এনেছি। আজ আপনারা যদি দশবার কালুকে আঘাত করেন ও একবারও প্রত্যাঘাত করবে না। কারন অহিংসা, মানবিকতা কি সেটা আজ ও মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছে। ওর জ্ঞান চক্ষু আমি খুলে দিয়েছি। আপনারা বিচার করে দেখুন গত কয়েক বছরে বিরোধী দলের কেউ খুণ হয় নি। হবে কি করে? আমাদের দলে আগে যেসব অপরাধীরা ছিল, তাদের সবাইয়ের চিত্তসুদ্ধি করেছি। তাদের অপরাধী সত্তাটাকে টেনে বের করে তাদের মানুষে পরিণত করেছি। আমরা রক্ত ঝরানো রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা অহিংস রাজনীতির লড়াইতে বিশ্বাস করি। খুণী কালু যখন বিরোধী দলে ছিলো, তখন আমাদের ছেলেরা খুণ হতো। আর আজ মানুষ কালু আমাদের দলে তাই বিরোধীরা নিরাপদে আছে। অথচ দেখুন আমাদের ছেলেরা খুণ হয়েই চলেছে। একজন কালু ওদের দল ছেড়েছে, ওরা সঙ্গে সঙ্গে দশটা কালু তৈরী করে ফেলেছে। আমি বিশ্বাস করি একজন মানুষকে খুণ করা যায়, কিন্তু একটা আদর্শকে খুণ করা যায় না। আর পৃথিবীতে এমন কোনো অস্ত্র নেই যা দিয়ে অহিংসা, মৈত্রী, প্রেমকে ধ্বংস করা যায়। এখন আপনারা ভেবে ঠিক করুন আপনারা কোন দিকে। হিংসা, খুণ, অত্যাচারের রাজনীতির দিকে নাকি অহিংসা, সহমর্মিতার দিকে।" রজতের ভাষণে জনগণ আবেগাপ্লুত হয়ে যায়। হাততালি দিতে দিতে, রজতের নামে জয়ধ্বনি করতে করতে বাড়ি ফেরে। ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটে।
আবার একদিন খবর আসে রজতের দলের আর একজন ছেলে খুণ হয়েছে। সমস্ত কাজ ফেলে ছুটলেন রজত। মৃতদেহ নিয়ে বিরাট শোক মিছিল করলেন। মৃতের বাবা, মা, আত্মীয়দের কাছে শোক জ্ঞাপন করলেন। বিরোধীদের প্ররোচনায় পা না দেওয়ার জন্য দলের ছেলেদের সতর্ক করলেন। সর্বোপরি অহিংস নীতিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে বললেন। মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সদলবলে শপথ নেন যে এই রক্তের বিনিময়েই তিনি শান্তি, অহিংসাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সন্ধ্যায় বের করলেন এক মোমবাতি মিছিল। রাস্তার দুধারে হাজার হাজার মানুষ ভারাক্রান্ত মনে মিছিল দেখলো।
শোক মিছিলে রজতের ঠিক পেছনে হাঁটতে হাঁটতে কালু ভাবতে থাকে তার অতীতের কথা। বেশ কম বয়সেই কালু তার বাবাকে হারায়। ঘরের সামান্য একটু অংশও তার কাকা জ্যাঠারা তাকে, তার মাকে দিতে রাজি নয়। নিজের ঘর থেকে বিতাড়িত হয় তারা। বাড়িতে জায়গা হারিয়ে মায়ের হাত ধরে তেরো বছরের কালীপদ ওরফে কালু এসে উঠলো তার মামার বাড়িতে এক অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে। বাড়ির ঝি চাকরের পুরো দায়িত্বটা তাদের মা ছেলেকে নিতে হলো। বিনিময়ে পেতো দুবেলা দুমুঠো। ক্লাস সেভেনে পড়তে পড়তে কাকা জ্যাঠাদের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়ে ছিলো কালু। লেখা পড়ার ওখানেই ইতি। মামার বাড়ি ফাই ফরমায়েস খাটতে খাটতে একদিন প্রমোশন হলো। মামার সুপারিশে পেলো রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে কাপ ধোয়ার চাকরি। সামান্য তিনশো টাকা মাইনে, সেটাও মামা কেড়ে নিতো!
চায়ের দোকানে কাজ করতে করতে বাইরের জগৎটাকে চিনতে থাকে কালু। চায়ের দোকানে চা খেতে, আড্ডা মারতে আসে বিভিন্ন ধরনের মানুষজন। তাদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পাড়ার এক রাজনৈতিক কর্মী স্বপন ও তার বন্ধুদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা কানে আসে কালুর। মাঝে মাঝে কালুও কিছু জানতে চায় স্বপনদের কাছে। ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। মিটিং মিছিলে ভিড় বাড়ানোর জন্য স্বপন কালুকে নিয়ে যায়। পার্টি অফিসেও যাতায়াত শুরু করলো কালু। বলতে গেলে স্বপন কালুর হাতে খড়ি দেয় রাজনীতিতে। ক্রমশ সে শাসক দল, বিরোধী দল, ছাপ্পা ভোট, প্রক্সি ভোট, বুথ দখল, বুথ জ্যাম, প্রভৃতি শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। চায়ের দোকানের কাজে যে কোনো ভবিষ্যত নেই সেটা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছে কালু। রিপ্লেসমেন্ট খুঁজছে। কিন্তু ক্লাস সেভেন অবধি পড়াশোনা করা ছেলেকে ভালো চাকরি কে দেবে? অগত্যা পার্টির নেতাদের ধরে যদি কিছু হয়। কিন্তু একটা অশিক্ষিত মূর্খ ছেলের পক্ষে তাত্ত্বিক নেতা হওয়াও সম্ভব নয়। অবশ্য রাজনীতির ময়দান থেকে পয়সা কামানোর আরো অনেক রাস্তা আছে। রাজনীতি করতে করতে ছোটোখাটো দোকান থেকে প্রোমোটারি, বিভিন্ন রকমের ব্যবসা করে অনেকেই দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু ব্যবসা শুরু করার মত শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা কোনো কিছুই কালুর নেই। আবার স্বপন রাস্তা দেখালো। নিয়ে গেলো গোপন ডেরায়। বোমা বাঁধা, চেম্বার চালানো শিখতে খুব বেশি সময় লাগলো না কালুর। ভোটের সময়ে বুথ দখল, এলাকা দখল, বুথ জ্যাম, ছাপ্পা মারা ক্রমশ কালুর বাঁ হাতের খেল হয়ে দাঁড়ালো। শার্ফ স্যুটার হিসেবে দলের মধ্যে তার বেশ সুনাম হয়েছে। ক্রমশ দলের মধ্যে তার গুরুত্ব বাড়তে লাগলো। দলের বড় মাপের নেতারাও তাকে সমঝে চলে।
ভোট এসে গেলো। নেতাদের অঙ্গুলি হেলনে কালুরা মাঠে নেমে পড়লো। প্রান ওষ্ঠাগত করে তুললো সাধারন মানুষের। সন্ধ্যা নামতেই বোমাবাজি, গুলির আওয়াজ, বারুদের গন্ধে আতঙ্কিত মানুষজন ঘরবন্দি। কিন্তু বিধিবাম। দূরদর্শী নেতারাও দেওয়াল লিখন পড়তে ব্যর্থ। ভোটের দিন ভোর হতেই ভোট কেন্দ্রে লম্বা লাইন। দুপুর বারোটার মধ্যেই সত্তর ভাগ ভোট পড়ে গেলো। কালুরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও খুব বেশি ছাপ্পা দিতে পারলো না। বোঝা গেলো রুলিং পার্টির ঔদ্ধত্য জনগণ মেনে নেয় নি। হয়ে গেলো পালা বদল। পাল্টে গেলো রং।
নেতারা মেনে নিলেও, কালুরা এই হার মানতে পারলো না। শুরু হলো ভোট পরবর্তী সংঘর্ষ। আবার শোনা যেতে লাগলো বোমা গুলির শব্দ। বাতাস ভরে উঠলো বারুদের গন্ধে। কিন্তু ভোটে হারা দলের ক্ষমতা সীমিত। একে একে গ্রেফতার হতে লাগলো কালুরা। শুরু হলো বন্দি জীবন। বিচারাধীন বন্দি। কোর্টে তারিখের পর তারিখ পড়ে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যায়, জামিন মঞ্জুর হয় না। চলতেই থাকে জেলের ঘানি টানা। অসহ্য এক বন্দি জীবন!
কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর বর্তমান রুলিং পার্টির নেতা রজত রায় জেলে কালুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। জেলারের সামনেই কালুকে বললেন, "তুই তোর ছেলেদের নিয়ে আমাদের দলে যোগ দে। তোদের জামিনের ব্যবস্থা করে দেবো। আর একটা কথা, আমাদের দল অন্যভাবে চলে। জেলার সাহেবের সামনেই বলছি, কোনো দিন তোকে বলবো না বিরোধী দলের কাউকে খুন করতে। এমনকি সামান্য আঘাত করতেও বলবো না।"
কালু এক কথায় রাজি। জেল বন্দি থেকে মুক্তি পাবে। তার ওপর আর কারও রক্ত ঝরাতে হবে না। কে আর চায় নিজের হাতে রক্ত মাখতে!
জেল থেকে বেরিয়ে কালুরা সদলবলে রজত রায়ের দলে যোগ দিলো। বিশেষ কোনও কাজ করতে হয় না। পার্টি অফিস খোলা, খাতাপত্র গুছিয়ে রাখা, রজতের সঙ্গে এখানে ওখানে যাওয়া, জনগণের সঙ্গে হেসে কথা বলা, বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো, সাহায্য করা। এসবের জন্য কালুরা অবশ্য ভালো মাসোহারা পায়।
ক্রমশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। কালুর মত দাগীরা রুলিং পার্টিতে থাকা স্বত্বেও বিরোধীরা নিশ্চিন্তে আছে। কেউ তাদের গায়ে হাত দেয় না। রক্ত ঝরায় না। অবশ্য ভোট এলে ছোটখাটো গোলমাল যে হয় না যে তা নয়। কিন্তু দেখা যায় রুলিং পার্টির দু একজন খুণ হয়। বোঝা যায় বিরোধী দল আবার গোপনে শক্তি সঞ্চয় করছে। শোকার্ত রজত তার সতীর্থদের ধৈর্য ধরতে বলেন। বলেন অহিংস নীতিতে আস্থা রাখতে।
এই ভাবেই কেটে যায় বছরের পর বছর। ভোট আসে ভোট যায়। প্রতিবারই রজতের দল পুরানো রেকর্ড ভেঙে আরো বড় ব্যবধানে জয়ী হয়। চার বারের নির্বাচিত এম এল এ রজত অবশ্য মন্ত্রীত্বের পথে পা বাড়ান নি। প্রস্তাব যে ছিল না তা নয়। কিন্তু রজত দলীয় সংগঠনকে মজবুত করা এবং জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
আবার ভোট আসছে। পার্টি অফিসগুলোতে আবার ভিড় বাড়ছে। ভোটের প্রচার, দেওয়াল লিখনের পরিকল্পনা চলছে। রজতও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যদিও কোনো দল এখনো প্রার্থী তালিকা প্রকাশ না করলেও, রজত ভোটে দাঁড়াবেন এবং আবার পুরানো রেকর্ড ভেঙে আরো বড় ব্যবধানে জয়ী হবেন সেটা পরিস্কার। এবারে তিনি কত ব্যবধানে জিতবেন তাই নিয়ে পার্টি অফিসে একটা সমীক্ষা চলছে। ভোটার লিস্টের প্রত্যেক ভোটারকে ধরে ধরে আলোচনা হচ্ছে । গত ইস্তাহার অনুযায়ী কতটা কাজ হয়েছে, কতটা বাকি আছে, তারও চুল চেরা বিশ্লেষন হচ্ছে।
এমনই একদিন অনেক রাতে পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে রজত বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে কেউ নেই। কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেছে সবাই। কিন্তু রজতের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় নি, ভোটের ব্যস্ততার জন্য। পার্টি অফিসেই রাতের খাওয়াটা সেরে নিয়েছেন। বাড়ি ফিরে বেশ অবাক হলেন। বাইরের দরজার তালাটা খোলা! এরকম ভুল তার সাধারনত হয় না। হয়তো ভোটের ব্যস্ততার জন্য তাড়াহুড়োয় তালা দিতে ভুলে গেছেন। ঘরে ঢুকলেন, আলো জ্বালালেন। একি! ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন রজত।
-কালু তুই এখানে?
-হ্যাঁ রজত দা। তোমার সঙ্গে একটা জরুরি ব্যাপারে পার্সোনালি আলোচনা করতে এলাম। তোমার দরজার তালাটা ভাঙার জন্য ক্ষমা করো। এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না। তোমার সঙ্গে একান্তে কথা বলার জন্য এটাই একমাত্র পথ। আজ তোমার বাড়ি বেশ ফাঁকা। সব কিছুর জন্যই বেশ অনুকূল পরিবেশ।
কোনো এক অজানা আতঙ্কে একটু যেন কেঁপে উঠলেন রজত। নরখাদক সিংহের সামনে অভিজ্ঞ রিং মাষ্টারের মত মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে স্বভাবসিদ্ধ দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠেন, "বল, কি তোর জরুরি ব্যাপার, যার জন্য মাঝরাতে এতো কান্ড ঘটালি।"
"এবার কে টিকিট পাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে এলাম। তুমিতো অনেক দিন রাজ করলে। এবার টিকিটটা আমাকে দাও।" কালুর কথায় আব্দার, হুমকি যেন মিলেমিশে আছে।
"সেকিরে! তুই দাঁড়ালেতো জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।" সশব্দে হেসে ওঠেন রজত। একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, "আগে পাবলিকের কাছে নিজের গ্রহণ যোগ্যতা প্রমান কর। তারপর ওসব ভাববি।"
- কেন পনেরো বছরে কি সেটা তৈরি হয়নি? আমি কি এরমধ্যে বিরোধী দলের একজনকেও আঘাত করেছি?
- সেতো আমার পলিশি। মানে আমাদের দলের পলিশির জন্য। না হলে কি যে ঘটিয়ে ফেলতিস কে জানে! ঠিক আছে মাথা ঠান্ডা কর। মন দিয়ে কাজ কর। কিছুদিন অপেক্ষা কর, তোকে একটা কাউন্সিলারের পোস্ট দেবো।
- সেতো দাদা তিন বছর পর! ততদিনে তুমি সব ভুলে যাবে।
- নারে, না। আমি কিছুই ভুলি না। জেলে দাঁড়িয়ে তোকে বলেছিলাম যে বিরোধীদের কাউকে খুণ করতে বলবো না। সেই কথা রেখেছি কিনা বল? আমার কথার একটা দাম আছে, সেটা মাথায় রাখিস।
- কিন্তু বিরোধী দলের না হলেও, প্রতিবার ভোট এলে নিজের দলের কাউকে না কাউকে আমাকে দিয়ে খুণ করিয়ে তুমি কুমিরের কান্না কেঁদেছো।
- ওরে, ভোট একটা পুজো। আর পাবলিক হচ্ছে দেবতা। দেবতার বর লাভ করতে হলে কিছু না কিছু উৎসর্গ করতে হয়। বলি দিতে হয়। আর বিরোধী দলের লোক মেরে লাভ কি? পাবলিকের সিমপ্যাথি অন্য দিকে চলে যেতে পারে। তাই ওদের পরোক্ষ ভাবে প্রোটেকশন দিতে হয়। বুঝলি রাজনীতিতে আমাদের সাফল্যের ইউ এস পি টা।
- খুব ভালো ভাবেই বুঝেছি। তাই তৈরি হয়ে এসেছি। এবার আমি কুমিরের কান্না কাঁদবো। আর তুমি হবে ভোটের বলি। তৈরি হও।
ঝলসে উঠলো সাইলেন্সার লাগানো আগ্নেয়াস্ত্র। ছলকে পড়লো রক্ত। আবার একটা বিশাল শোক মিছিল। রাস্তার দুধারে হাজার হাজার মানুষ চোখের জলে বিদায় জানালো তাদের প্রিয় নেতাকে।
শববাহী গাড়ির পেছনে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে, সজল নয়নে, কান্না ভেজা গলায়, স্লোগান দিতে দিতে চলেছেন কালীপদ বাবু - রজত রায় অমর রহে, রজত রায় অমর রহে।
************************************************************************
পেশা মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ। স্কুলের পত্রিকায় নিয়মিত লেখার অভ্যাস থাকলেও। তারপর দীর্ঘ বিরতি। লকডাউনের প্রথম বছরটা(2020) কেটে যায় টিভিতে রামায়ণ, মহাভারত দেখে। লকডাউনের দ্বিতীয় বছরের (2021) অখন্ড অবসরে লেখালেখির দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু ।
সাম্প্রতিক লেখা - প্রজাপতি সাহিত্য পত্রিকা/ সৃজন সাহিত্য পত্রিকা/ রংমিলন্তি প্রকাশন/ কারুলিপি অনুগল্প সংকলন/ অবেক্ষন/ ড্যাস সাহিত্য পত্রিকা/ লেখা ঘর সাহিত্য পত্রিকা/ মৌনমুখর সাহিত্য পত্রিকা/ তুলি কলম আকাশ/ ঘোড়সওয়ার/ স্নিগ্ধা প্রকাশন/ নীরব আলো প্রভৃতিতে প্রকাশিত হয়েছে ।


বেশ ভালো লাগল
উত্তরমুছুন