কবি দীপঙ্কর রায়ের ' আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার প্রতিপক্ষ' কাব্যোপন্যাসটি পাঠ করলেন শ্রীদাম কুমার

ঠাসবুনোটের কাহিনী , প্লট, চরিত্রায়ন কিম্বা ঘটনার ঘনঘটা থেকে বহুদূরে ---সুলভ দেখনদারির বাইরেই এক স্বতন্ত্র গৌরবের অধিকারী "আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী, আমি-ই তোমার প্রতিপক্ষ" গ্রন্থখানি।
কবি-প্রানতার অপার মগ্নতায় লেখনি ডুবিয়েই কবি দীপঙ্কর রায় নিজস্বতার রঙে অনুপম শৈলীর আধারে কবিতা-উপন্যাসের আদলে মূলত গ্রন্থটি গড়ে তুলেছেন । সংবেদনশীলতা আর মানবিকতার দীপ্ত চৈতন্যের স্ফুরণে তাঁর লেখনি সর্বদাই বেগবান। প্রচার -বিমুখ আত্মমগ্ন এই মানুষটি তাঁর যাপন ও বিচরণের চারপাশের মানুষজন সমাজ রাজনৈতিক আবর্ত রাষ্ট্রীয় টানাপোড়েনের অভিঘাতের প্রান্তবিন্দুগুলিকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে অন্তর্বয়নে তুলে এনেছেন এই গ্রন্থের অক্ষরমালা আর স্বগতোক্তির মত অনন্য উচ্চারণ।
নামকরণ বা শিরোনামের কথা ভাবলেই আপাতভাবে মনের মধ্যে একটা বিরোধাভাস উদিত হয়।যে সাক্ষী সে-ই প্রতিপক্ষ ! কী করে হয়?সত্তার গভীরতর আলাপচারিতাতেই তা সম্ভব। তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে ক্ষীণভাবে হলেও স্মরণে আসে বিশ্ব সাহিত্যের কালজয়ী দৃষ্টান্তের কথা, 'জেকিল' 'হাইড'-এর'প্রসঙ্গ। রামপ্রসাদের প্রবৃত্তি- নিবৃত্তির কথা, বঙ্কিমচন্দ্রের কুমতি সুমতির কথা, কবি অজিত দত্তের একটি মেয়েরই হঠাৎ কখনো দস্যি আবার কখনো শান্ত হয়ে ওঠা--এমনি ধারা বহু কথা মনে ভেসে ওঠে।
যেন এক দীর্ঘ কবিতা পড়ছি। ধীরে শান্ত লয়ে এই কবিতার ছন্দপ্রবাহ বয়ে চলেছে। শান্ত নদীর প্রবাহ যেমন সহজে বোঝা যায় না, এর তীরে নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়ালেই তা টের পাওয়া যায়। তেমনি এই বইটির ছন্দ প্রবাহ। "এপারে থেকেও আমি ওপারের আনন্দ কুড়াই" --তবে শুধু আনন্দ কুড়ানোই নয়, হাসি কান্না সুখ দুঃখের অবিমিশ্র ধারা একাকার হয়ে আছে গ্রন্থটিতে। ভাগাভাগির স্বদেশ রাষ্ট্র কাঁটাতার--এসবের কতটুকু মূল্য আছে হৃদয়ের মানচিত্রে? চিরন্তন মানবের হৃদয়ভূমিকে তা কখনোই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। তাইতো রাষ্ট্রের বেড়াজালে বন্দী-মানুষ এপারে থেকেও মনের অতলে বয়ে বেড়ান ওপারের শৈশব স্মৃতি বাল্যের নদীর সাঁতার আনন্দ-বেদনার যাবতীয় অনুষঙ্গ মাতৃভূমির মনভূমির যাবতীয় স্পর্শকাতরতা আর পিছুটান। সেই টান রয়ে যায় আমৃত্যু। এই মানুষেরা তাই সব সম্পর্কেই খুঁজে ফেরেন মানবীয় রঙ। সেই রঙ যখন কালো হয়ে ঢেকে যায় বা ফিকে হয়ে আসে তখন এদের অন্তর যন্ত্রণায় মথিত হয়। তারই অনুরণন কবিতা-উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ছড়ানো।
সত্তার আলাপে আমাদের আত্মবোধকে দাঁড় করিয়ে দেন এক জিজ্ঞাসা চিহ্নের সম্মুখে--
"পাশাপাশিই তো ছিলে
থাকতে থাকতে কেউ আগে... কেউ বা পরের......
যাওয়া-আসা যখন নির্ধারিত--
যা তুমি জেনেও জানো না
যা তুমি না জানার বেমালুম ভুলে
অর্জন করেছ নিষ্ঠুর মুখের গড়ন
চোখের ঝাপসা বর্ণ;
কারো কান্না মানে, তোমার জীবন
কারো কান্না মানে, তোমার জাল বড় হওয়া
কারো সংসার ভাঙলে
ভাসলে সিঁদুর
তুমি মনে কর, তোমার গঙ্গাভ্রমণ? "
এ কাব্যভাষায় ভাসতে ভাসতে এক সময় মনে হয় "When many a voice is silent /There is one and only voice/ That raises its voice against injustice!" এরকমই একটি স্বর এখানে আমরা শুনতে পাই--
"পাঞ্জাবি ওড়ে
সাধারণতন্ত্রের মঞ্চ ছাড়ানো পতাকার চাইতেও উঁচু
সংলাপ হয় উচ্চারিত : " যে ঠিকানা জমির ছিল
খেতের
মাঠভরতি ফসলে যে তুমি, তুমি-ই—
না হলে তোমার স্বজন যারা
তাদের সকলের শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা
তোমার পায়ের তলার ঠিকানা চিনবে না
চিনবে শুধুই নদী।
যে তোমার অস্থিচর্ম খায় গিলে ! "
কবি প্রশ্ন তুলেছেন নদীর কাছেই কি-- " কুলের ঠিকানা খুঁজছো ?"
এই নিভৃত আলাপের পর কবিতার ভাষায় লেগেছে কাহিনীর রঙ, আলতো করে ছুঁয়ে ফেলেছে উপন্যাসের বৃত্ত--
"তার কাছে শোনো
যে অনেক কাহিনীর মূল জানে—
শ্যাওলা-সবুজ প্রান্তরের জল-কাদা দোলে যে হাওয়ায়
কত হোগলাবনে, কে কার মন দেওয়া নেওয়া কোরে
গেয়েছিল হৃদয়ের গান "
তবে শুধু হৃদয়ের গান গাওয়াই নয় আছে আরো অন্য কথা--
"কে কার জরায়ুর ভাঁজে দুই-ঠ্যাংদুলিয়ে আত্মকথা করেছিল মুখস্থ/কে কার সাথী বিশ্বাস, অনামিকা করণ/...ভাঁজে যেতে যেতে ছাড়িয়ে খেয়েছিল/আঁশফলের অনেক শাঁস? "
'ঝাঁপি খুলে' এই মগ্নকবির বুকের গভীরে লালিত স্বপ্নটি উঠে আসে--
" 'এ গঙ্গা সে গঙ্গা রইবে পাশে '
-- -- --
তোমার সন্তান বোঝাবে তোমায় আবাদি-ভাষা
আরো পরিষ্কার করে অন্য এক জীবনের সুর--
চলো সেই দেশের খোঁজে "
সেই দেশের খোঁজে এসে সন্তানের চোখে লাগে বাস্তবতার লঙ্কাগুঁড়ো। তাই কবিতার সংলাপে উচ্চারিত হয়--
" বহু হতাশার পথ ভাঙি
পথ ভেঙে পথকে করি সঙ্গ"
বাংলা কবিতা ধারায় কবি দীপংকর রায়ের জীবনানন্দ দাশ চর্চা ও প্রীতির বৈভব তাঁর কবিতার ভাষায় ও ভাববোধে কোথাও কোথাও এনেছে ঐতিহ্য চেতনার রঙ। এটিকে জীবনানন্দ দাশীয় প্রভাব না বলে 'শেকড় অভিলাষী' চৈতন্যের ঐতিহ্য বলা ভালো। 'দুই- ঠ্যাংদুলিয়ে'এরকম শব্দবন্ধের ব্যবহার সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। '১৯৪৬-৪৭ 'কবিতাটির রেশ যেন ক্ষণিকের জন্য হলেও বেজে উঠেছে--"কে অভিমন্যু মন্ডল, শেখ আখতার, কুদ্দুশ -ই-বা কে" যেমন খন্ডিত -স্বদেশ নয়, তেমনি খন্ডিত সত্তার অন্বেষণ নয় , তাঁর আর্তি সমগ্রতার অভিলাষী।
"তোমার মধ্যে মন বসত করে কয়জনা?"গানটির কথা মনে এলেও-- বইটিতে দুই মলাটে মূলত দ্বৈত সত্তার আবহেই গভীরতর ভাষ্য রচিত হয়েছে। যার অভিমুখটি রয়েছে চিরন্তনতার দিকে অনন্ত যাত্রায় সমগ্রতার খোঁজে--
"অপ্রয়োজনের অধিকারে যে জীবন যৌক্তিকতা ছাড়া
অযৌক্তিক সাহচর্যে অবিমিশ্র হারায়
তার দিকে কবে হবে সেই সমগ্রের মহাযাত্রা?"
বইটির প্রকাশক "এবং কথা" প্রকাশনী। প্রচ্ছদ শিল্প-শোভন। গাঢ় বাদামী রঙের মাঝে একটি নদীর আভাস। মনে হয় , এপার বাংলা ওপার বাংলাকেই দ্যোতিত করছে। প্রচ্ছদশিল্পীর অকুণ্ঠ প্রশংসা প্রাপ্য।নামাঙ্কন বর্ণবিন্যাস মুদ্রণ বোর্ডবাঁধাই সবকিছুই ধ্রুপদী মানের। "এবং কথা "প্রকাশনা গুণমানে বলিষ্ঠতার স্বাক্ষর বহনকারী। বইটির প্রকাশে বাংলা কাব্যসাহিত্য জগৎ সম্মৃদ্ধ হলো, এ আমার নিশ্চিত বিশ্বাস। সংগ্রহযোগ্য এই গ্রন্থটি নিবিষ্ট পাঠকের কাছে এক পরমপ্রাপ্তি।
*******************************************************************************************
জন্ম : ২৪ এপ্রিল ১৯৭৩ ভাড্ডি গ্রাম,গড়জয়পুর,পুরুলিয়া। একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম , বেড়ে ওঠা ।অন্তর্মুখীন স্বভাবের,প্রচারবিমুখ। কবিতার পাশাপাশি গদ্যেও সাবলীল । 'মাদৈল', অরন্ধন, রঙিন ক্যানভাস, 'কবিতা আশ্রম'-এর মত ওয়েব ম্যাগাজিনে মাঝে মধ্যেই কবিতা প্রকাশিত হয়ে থাকে।'এবং কথা'-র মত ধ্রুপদী মানের মুদ্রিত পত্রিকাতেও লেখা বের হয়েছে।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন