সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

উপন্যাস * দীপংকর রায়

     



'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৫   

দীপংকর রায় 



কিন্তু কেন ---- তা তো জানা যায় না! 

যদিও এটা তো প্রথম পরীক্ষা ---- এর পরেরটা তো থাকলো মানুষের উপরে নাকি! নিরাপদদা তো সেটাই বলেছে। 

          যদিও আমি ভাবছি অন্য কথা ---- ভাবছি, এ তো বেশ মুশকিল বাধালাম! শেষে মানুষের উপরে প্রয়োগ করতে গিয়ে যদি সেই মানুষটা আমার পেছন না ছাড়ে, তখন কী হবে? সকলে জানাজানি হয়ে গেলে তো বিপদ আরো বাধলো।

          নিরাপদদা বলেছিল, দ্যাখপা , একেবারে পাগল হয়ে যাবেনে, কেবল তোমার পেছনে পেছনেই ঘোরবে। কাছ ছাড়া হবেনানে একেবারেই।

          আমার ভয় তো ওখানেই। বেশ ঝামেলা বাধিয়ে বসলাম। শেষে পরীক্ষে করতি যায়ে যদি এমন অবস্থা ডা বাধায়ে বসি, তাহলিই হইছে কাম; আরে বাবা, গুনিনেরও তো গুনিন রইছে ---- সব জানাজানি হয়ে গেলি, সব যদি প্রকাশ হয়ে যায়, গুনিনের গুনিন যদি আইসে কয়ে দেয় সব সত্যিডা, তহনে কী হবেনে ---- ? তহনে যাবানে কনে! তহনে তো আর ধরা না পড়ে উপায় থাকপেনানে! বলে যদি, এই কাণ্ডডা কিডা ঘটাইছে, তারে দেখতি এমনডা; ধরে আইনে দাও  তারে, বানধে ফেলাও ; তহনে! তহনে যাবানে কনে মুখলুকতি? সেই কথাডা ভাইবে ভাইবেই ঘাম ছাড়তিছে। বুকির ভেতরডা অমন ধড়াস ধড়াস করতিছে শুধু। 


          ধরা পড়া সেই অবস্থাটা যতই হোইহট্টোগোল বাধাক না কেন, তাও কিন্তু সেই মজাটার থেকেও মনটা সরতি চাচ্ছে না যে কিছুতেই !  কিন্তু কারে পাই, যার উপরি এই কাজডা করতে পারি? তাহলি কি তারে বলেকয়ে দেব ছিটোয়ে তার গায়ে মন্ত্রপূত সেই নবগঙ্গার জল?

           তাহলি তো আর ঝামেলা থাকতিছে না। আমি তো লুকোইনি কিছুই! বলে কয়েই তো করিছি সব কিছু! 


            শেষপর্যন্ত বশীকরণ মন্ত্র আমার আর মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়ে ওঠেনি  কোনোদিনও। কিন্তু মৌচাক ভাঙার মন্ত্রটা, সেটির কি করি? নিরাপদদাকে ধরলাম। বললাম, কি করি বলো দেহি একবার --- কিভাবেই বা বুঝতি পারি তাই কও তো একবার আমারে ; চাকের মাছি যে কামড়াবেনানে এই নিশ্চিন্তি পাবার উপায়ডা কও দেহিনি আমারে! আমি কিন্তু ইডারও পরিক্ষে না নিয়ে কারোরে গাছে তোলবোনানে, তা কয়ে রাখতিছি তুমারে ; তুমি ইবারে ইডার উপায়ডা কও তো দেহি দাদা ---- বুঝয়ে দেও একবার, আমি তালিই তারে নিশ্চিন্তিতে উঠোয়ে দি। কও, কও তো, বুঝোয়ে  কয়ে ফেল তো দেহি ভাই ---- শ্যাষে যদি তারে কামড়ায়, তাহলি সে তো ছাড়বেনানে আমারে ; তহন তুমি থাকপানে কনে তা কিডা কতি পারে! তুমি থাকতি থাকতিই  একদিন একখান চাক ভাইঙ্গে দ্যাখপানে, কী দাঁড়ায় সিডা দেখা যাক একবার। 

            আমার এত কথা শুনে সে একটুও বিরক্ত না হয়ে অত্যন্ত শান্ত হয়ে বলে, অতো কথা লাগবেনানে কতি, একখান হাতিশুরোর গাছ এক নিঃশ্বেসে টাইনে তুলে আইনে আমার সামনে দাঁড়াও দেহি। না হলি শেয়াল কাঁটার গাছ ; শেয়াল কাঁটা চিনিছো, না চেন নি? ---- ওই যে, তুমরা  যারে কও  শেয়াল মুতির গাছ গো ; তয় হাতিশুরোই ভালো, কাজডা চটজলদি করে বেশ। নিয়ে আসো দেহি একনিশ্বেসে একখান, তারপর সেই খেন কোমোড়ির খুঁটি গুঁজে নিয়ে নামে পড় গে দেহি ; ওই যে গো, তুমাগের সুষমা মাসির আম গাছে দেহ গে একখান চাক পড়িছে। দেও গে ওই গাছের গোড়ায় মনতোরডা পড়ে থাবা মাইরে। দেহ কি হয়। দ্যাখপানে বারি মারার সঙ্গে সঙ্গে চাকের ভিতরে কেমন ঢেউ খেলি যাচ্ছে ; তার মানে কি জানো, ঢেউ খেলতিছে মানে, চাক ঠিক আছে। তহনিই যাবা চাকের কাছে। জানবা চাক ভালো। কোনো চিন্তা নেই। ধুনো ধরায়ে নিয়ে উঠে যাও গাছের মাথায়, কিডা থামায় তোমারে আর ; তয় একটা কথা কয়ে দি, ভালো করে শুনে রাহ এই কথাটুক, ভুলেও কিন্তু কখনো চাকের মুচা ছাড়া, মাছিগের বাসা যাতি থায়ে সেহেনে পোচ লাগাবানা কলাম । চায়ের সঙ্গে এটটুখানি মুচাও  রাখপা কলাম। ওটুক মাছিগের জন্যি। তাগের বাচ্চাগের জন্যি। চাক মোচা ছাড়া করবা না একেবারে! তা না হলি  একবার ভাইবে  দ্যাহো দেহি, যাগের মুহির থে তুমি তাগের এটটু এটটু করে জোগাড় করা খাবার ছিনিয়ে নিয়ে আসলে, তাগের কেমন লাগার কথা! ভাইবে দ্যাহো, তারা কি খাইয়ে বাইচপেনে---- সিডা একবার ভাইবে দ্যাহো ;  কথাডা মনে রাইখো কিন্তু, বার বার যিডা কলাম মনে রাখপা ভালো ভাবে।


            কে আর নিরাপদর কথা শোনে! 

            সুভাষকে রাজি করালাম। নিজে তো গাছে ওঠার ক্ষমতা নেই, তাই, নানা ভাবে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করালাম। বললাম, আমি মন্তর শিখিছি, কোনো চিন্তা নেই, চল, সুষমা মাসিরে রাজি করাই। তারপরেই চাকখান ভাইঙ্গে ফেলি গে, চল, কোনো চিন্তা নেই, তোড়ে মাছিতি কামড়াবেনানে। 

            সে প্রথমটায় রাজি হয়নি। বলে, শেষে যদি কামড়ায়ে আমারে ছুলে দেয়, তহনে তুমি থাকপানে কনে, আমি তো উঠপানে গাছে ; কনতে কি শিখিছ তার নেই ঠিক, আমারে কচ্ছ গাছে উঠতি; আমি মরি আর কি, তুমি তো বাইচে যাবানে! ও নিরাপদ বাগদির কথা রাহ তো, ও ছাই জানে, যদি জাইনতোই তালি একদিনও তো ওরে দেখতাম একখানও চাক ভাঙতি ! এই যে, যে জানে, সে কি চুপ করে বসে থাকতি পারে, সিডা কও তো ; ওই সেবার তো দেখলাম, যেবার চাক ভাঙার লোকেরা আইসলো, ও দেহি তহনে মেচি বিড়ালের মতো লেজ গুটোয়ে বসে থাকলো! কোলো না তো কিছুই! বললো না তো, তুমাগের সঙ্গে আমিও যাই! 

            এরপর আরো একটা কথা বললো, ওঁ..... এই জন্যই তুমি ওর পিছন পিছন ঘোরাঘুরি করতিছিলে দেখতিছিলাম এত দিন...! 


             তাকে নানা ভাবে বোঝাই। বলি, শোন এই কাজডা যদি আমরা করতি পারি, তাহলি আমাগের  সকলে কোন চহি দেখপেনে তাই ক দেহি ভাই একবার?তোর কোনো ভয় নেই ---- আমি  দেহিছি, চাকে কোনো দোষ নেই, ঢেউ খেলতিসে, কোনো ভয় নেই তোর। কিছু যদি হয় তো দেহে নিস নাহলি আমারেই---- কোনো অসুবিধে নেই, চল লাইগে পড়ি গে.....।

            শেষ পর্যন্ত সুষমা মাসিকে রাজি করিয়ে একদিন খুব সকাল সকাল, বেলা ওঠার আগে ধামা কাচি নিয়ে খড়ের বোড়ে বানিয়ে, তাতে আগুন ধরিয়ে  সুভাষের গায়ে মাথায় বেশ খানিকটা হাত বুলিয়ে জয় মা কালী বলে তাকে গাছে উঠিয়ে দিলাম। 

            সুভাষ মৌমাছির চাকে পোচ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলতে লাগলো, নারে, একেবারেই কামড়াচ্ছে না রে  .....!

            ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। নিচেয় তখন পাড়ার অনেকেই প্রস্তুত এই বলে,  সুভাষরে যদি একটা মাছিও কামড়ায় তালি তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে কিন্তু কয়ে দিচ্ছি ; ছাড়বোনানে তোমারে আমরা কেউ ।


            এই ঘটনার সঙ্গে শরৎ বাবুর ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তের ঘটনার কি কোনো তুলনা করা চলে ? হয়তো যায়, হয়তো যায় না। তবে ইন্দ্রনাথের শাপ ধরা মন্ত্র শেখার অপেক্ষার সঙ্গে তো খানিকটা মেলে? কিন্তু আমি যেন মনে মনে কোথাও এমন একটা সূত্র খুঁজে পেলাম, বা শ্রীকান্ত পর্বের আরো পরে আরো নানা কাহিনীর সঙ্গে এমন একটা সাযুজ্য খুঁজে পেতে থাকলাম নানাভাবে, যাতে করে আমার সমস্ত ভাবনা চিন্তার নানা আলো অন্ধকারে মেলামেশা করে বেড়াতে লাগলো এমন কত বিচিত্র সব ভাবাবেগ, যাতে করে আজ মনে পড়ে গেল নিরাপদদাকে। মনে পড়ে গেল জোছনা রাতে বা অন্ধকার রাতে নৌকো নিয়ে মাছ ধরার কথা। 

             শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তও চলতে লাগলো আমার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দিন পর্যন্ত। কিন্তু রাজলক্ষ্মী? সে সূত্রের কথা কত রকমভাবেই না জীবনে কত বিচিত্র পথে এলো আর গেল তার কথা কি সবটা বলা যাবে কখনো, কোনোদিনও ?


              আমার সামান্য টাকা মাস মাহিনা পাওয়া মা সেদিন যে এক কথায় তার অফিসের সহকর্মীর মাধ্যমে মাসে মাসে ধার করে এই এক দুইটি করে খন্ড শরৎরচনাবলী এনে দিতে থাকলো, আর সেই গ্রন্থগুলি পেয়ে আমার ভেতরে যে কত কিছু ঘটে যেতে থাকলো তার সবটা কি লিখে প্রকাশ করা আদেও সম্ভব?


              আস্তে আস্তে এই বাড়িটার দুপুরবেলাগুলি বেশ মানুষজনে ভরে উঠতে লেগেছে। ও বাড়ির ফোচনের ঠাকুমা আর কাজের দিদির লুডুর কোট চলে বারান্দায়। আর আমরা ঘরের ভেতরে। সে আড্ডায় ফোচন আলোক শংকর প্রথম প্রথম নিয়মিত উপস্থিত হতো। পরে অবশ্য আরো অনেকে জুড়ে গেছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখন আমি ওদের সঙ্গে আড্ডার মধ্যে কথায় কথায় শরৎচন্দ্রের কথা চালান করে দি। শরৎচন্দ্র নিয়ে বেশ একটা পাণ্ডিত্য দেখাতে যাই। কিন্তু আমার সেই পাণ্ডিত্য খুব একটা জায়গা পায় না। সকলেই বলে ঐ সব তো শাদামাঠা গালগপ্প। শংকর বলে,  শুধু শরৎচন্দ্র পড়লেই হবে! বঙ্কিম পড়েছিস? রবীন্দ্রনাথ পড়। মধুসূদন কে দেখ। তারপর তো থাকলো আরো। এখানে ওখানে মিলে সব দেখ একবার, তারপরে তো ভালোমন্দ সব বলতে পারবি। বিদেশী সাহিত্যও পড়তে হবে। আর মাইকেলটা ভালো করে দেখলেই বুঝতে পারবি দম কাকে বলে! একসঙ্গে ওইরকম চারখানা মহাকাব্য লিখে দেখাক তো কেউ! তাহলে তো বুঝবো ক্ষমতা আছে ! এসবের খোঁজ কর আগে। পড়। তারপর না কথা। এত সোজা না। সাহিত্য করতে চাইছিস তো, বুঝতে পারবি কত দম দরকার। এরপর তো আরো কত আছে। চেষ্টা কর তাহলেই সকলের খোঁজ এসে যাবে। আর কত বই-ই বা  তুই এই রকমভাবে কিনেকেটে পড়ে পারবি? লাইব্রেরীতে যেতে হবে, লাইব্রেরীতে যা। 

              কোনো তর্কে যাই না। সাধ্য বা কোথায়! এরা কত জানে! মনেমনে এই কথাই ভাবি। আমি কি জানি। আমার তো এখনো শরীর থেকে বুনো গন্ধই যায় নি। আর এরা সব মিশনারী স্কুলে পড়াশোনা করা ছেলেপুলে। আমার থেকে কত সচ্ছল! কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করেছে! আর আমি কোথায় কি! তাই ঘাড় নেড়ে তাদের কথায় সমর্থন জানাই , বলি, না ভাই সত্যিই তো, এসব সব কিছুই জানতে হবে। কিছুই জানি না। আচ্ছা, কীভাবে পাই তাই ক দেহি। 

              শংকর বললো, লাইব্রেরীর মেম্বার হয়ে যা। আমার সঙ্গে একদিন নাগতলায় চ। বড় লাইব্রেরী আছে। কথা বলে দেখা যেতে পারে, ওদের নিয়মকানুন জানতে হবে তো আগে, তারপর তো মেম্বারসিপ। 

              বললাম, নাগতলায় কোথায় রে? 

              ও বললো, আমাদের স্কুলের গলিতেই ।একেবারে মুখটাতেই। দেখবি মস্ত বড় একটা মাঠ আছে, ওখানেই। শক্তিসঙ্ঘ লাইব্রেরী। 


              দিন শুরু হয় বাগান তৈরি করার পরিকল্পনা দিয়ে। সকালবেলাটা কাটে সেই বিষয়ে খুঁটিনাটি নাড়িয়ে-চাড়িয়ে । বর্ষাটা শেষ হয়ে শরৎ-এর আকাশ দেখা দিয়েছে। সকাল সন্ধ্যায় শিউলি ফুলের সুবাস ভেসে বেড়ায় বাতাসে। কিরকম একটা পুজো পুজো আয়োজন। 


             নতুন বন্ধুবান্ধবরা ইদানিং সকলে পুজোর জামাকাপড় কেনাকাটার কথা বলাবলি করে। কে কোথায় কি কিনছে। কে কার কাছ থেকে কি পাবে না পাবে তাও ; এবং আগে আগে সেগুলি দর্জির কাছে বানাতে না দিলে এর পরে আর অর্ডার নেবে না।


              এই রকম সব আলোচনা ইদানিং। কেউ বলছে আরো কি কি কেনাকাটার আছে, কি কি কিনবে আরো ; মা যদিও আমাকেও বলেছে পুজোর জামাকাপড়ের কথা একবার যেন!  অফিস থেকে ধারে একটা একটা করে প্যান্ট-জামার পিস এনেও রেখেছে, আজই বললো সে কথা, এবং দেখালোও । তাতে অবশ্য আমি বলেছিও, থাউক না মা, রাইখে দেও না আলমারিতিই ----পরে হবেনে ওসব, এহনে যা ভিড় শুনতিছি তাতি আমার ওগের মতোন কোনো অস্থিরতা নাই। থাউক গে, পরে দেখপানে, রাহো এহনে ---- 


           ক'দিন হলো মা আর একটা কথাও বলেছে, তুই না হয় এখানের স্কুলে ভর্তি হয়ে যা। ও দেশের পড়াশুনোর দাম নেই এখানে। এখানে পড়তে হলে দুই ক্লাস তো নামিয়ে দেবেই। তাছাড়া তুমি তো কাগজপত্র কিছুই আনো নি আবার! 

            বললাম, কাগজপত্তর, কই না তো! যা পড়াশুনা করিছি তা তো যেটুকুন অভ্যাসে রইছে ; কাগজ তো তুলে আনিনি! তাহলি তুমি যা কতি চাচ্ছ তাতে তো এই দাঁড়ায়, এহেনে ভর্তি হতি হলি আমারে ওই যেমন ঘাড় ভাইঙ্গে বাছুরির  দলে নাম লেখাতি হয় তেমনই আর কি, তাই তো কতি চাচ্ছ ? ওসব বাদ দেও মনে ; ওতি আমার আর তেমন টান নেই। 

             মা বলে, সে কি রে! সে তুই কি বলিস..? তাহলে তুই করবিডা কি, পারবি না..? 

              বললাম, এ নিয়ে তুমি ভাইবো না, আচ্ছা তুমি ব্রজদার কাছে শুনে দেহ দেহি, রবীন্দ্ররচনাবলীর দাম কতো পড়বেনে ! আস্তে আস্তে যদি উনি এই সঙ্গে নেয় ! তাছাড়াও তো আরো আছে, বঙ্কিম সমগ্র, মাইকেল মধুসূদন ; আচ্ছা সে সব নয় আরো ধিরে ধিরে দেখপানে ; আসলে কি জানো আমার মনে হচ্ছে কি জানো, সবগুলোন যদি এক সঙ্গে পাতাম না, তালি বড্ড ভালো লাগতো! তবু তুমি এটটু কথাবার্তা কয়ে রাহো দেহি কি হয়, ক' খণ্ড তা কে জা... নে....!

              এর পরেই নিজের মনে নিজেই বললাম, কে যে ভালো করে কয়ে দিতি পারবে আমায়, তেমন মানুষির যদি দেখা পাতাম তালি বড্ড ভালো হত। এরা সকলিই উপর উপর জানে ; কার কাছে যে যাইয়ে শুনি, তালি কি ব্রজদার কাছেই চলে যাবো একদিন সোজা? 


              কোনো ধারাবাহিকতাই বেশিদিন সয় না যে। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠি । তাহলে কি সব সময় সব কিছুতেই বৈচিত্র খুঁজে চলে অন্তরালের মন? না না, তাও তো না ! তাহলে একটা নিয়মকেও এড়িয়ে চলতে পারি না কেন! দেহ-মনও তো একটা নিয়মের ফাঁদেই বন্দী হয় কেবল দেখি। কোনো নিয়মের বাইরে গেলেও তো দেখি শরীরও বিদ্রোহ করে বসে! সে যে কোনো ভাবেই ভাবি না কেন । এই যে, কিভাবে না কিভাবে যেন প্রথার সঙ্গেই হাতমেলায় দেখি স্বভাবও ! তাহলে যা চেয়েছিলাম বা চাইনি হয় তো, কিন্তু সেভাবেই তো সব কিছুই হচ্ছে দেখি এ যাবৎকাল ! আস্তে আস্তে এক ভাবে না এক ভাবে জড়িয়ে পড়ছি দেখি সংসারের বেড়াজালে । মিনমিনে একটা চাহিদার কাছে লোভও তো চেয়ে থাকছে দেখছি হাঁ করে। 

              ইদানিং যারা আমাকে ঘিরে এখানে সময় কাটাচ্ছে , তারা সকলেই তো বেশ সচ্ছল পরিবারের প্রথাবদ্ধ গন্ডির মধ্যেই বেড়ে উঠেছে জানি ; এইসব ছেলেপেলেরা কেউই আমার মতো উদ্দেশ্যহীন মানুষিকতার নয় তো! হয়তো তাদের মধ্যে আমার মতো একটা তাল-কাটা ভাব আছে হয়তো, আর সেই জন্যেই এখানে আসে। হয়তো এখান থেকে বেরিয়ে যাবার পরেই, তাদের দেয়ালের যেসব রঙচঙ তারা দেখতে পায়, সেই রঙের সঙ্গে আমাদের ঘরের ভেতরের এরকম চুনখসা ভাবটা তো নেই! এই যে একখানা টালির চালের হাটখোলা ঘরে, চারদিক খোলা একটা বারান্দা, ঘরের ভেতরে টালির চাল দেখা যায়, সেই চালের কাঠের আড়ার উপর দিয়ে ইঁদুর দৌড়য় তেলাপোকা দৌড়য় । জানলা খুললে পেছন দিক থেকে শালিক চড়াই কাক এসে ঘরের ভেতরে দৌড়াত্ব চালায়। দেয়ালের চুন খসে পড়ে ঝুরঝুরিয়ে। যেন দাঁতমুখ খিচিয়ে ভেংচায় আমাকে। মেঝে দিয়ে পুয়ে শাপ কেঁচো উঠে আসে বর্ষায়। কোনরকমে মেঝেতে একটা রাফ ঢালাই দিয়ে নিয়েই মা উঠে এসেছিল খাসমহলের সেই ভাড়াবাড়ি থেকে, এই ভেবে, আর যাই হোক সেই ভাড়া ঘরের চাইতে তো এ ভালো হলো! নিজের মাটি তো! পরে না হয় ধিরে ধিরে একটু একটু করে এগোনো যাবে এসব নিয়ে। পরিকল্পনা তো কত কিছুই থাকে, তাই বলে কি সব ঠিক ঠাক হয়! তাই যা হয়, নানা ঝড়ঝাপটায় দায়দায়িত্বের তোড়ে সে দিকে আর সংকলন করে ওঠা হয়নি। প্রতি মাসে সে যা মাস মাহিনা পায়, তা দিয়ে লোকজন নিয়ে কোনোরকমে টেনেটুনে চলে যায়। 

              বাড়তি উপার্জনের জন্যে পলট্রিফার্ম করা হয়েছিল। তা তো লোকজনের অভাবে এবং মড়কছড়ক লেগে লাটে উঠেছে। এর বাইরেও আর একটা বিষয়, সেরকম বড় করে, অনেকগুলি ধাপে, অনেক জায়গা জমি ঘর না হলে এ ব্যবসায় এই ছোটো আকারের লাভের অংশ আর তেমন কিছুই থাকতো না নাকি। 

              এর মধ্যেই আবার গোরু। গোরু পোষার কথা মাথায় আসাতে লাফিয়ে পড়া। ভেবেছিল এর থেকে বাড়তি উপার্জন হলে অনেকটা সংকুলান হয়ে যাবে। তাছাড়াও আর একটা চিন্তা মাথায় এসেছিল। দিদিমার মনোযোগ আকর্ষণ করা। তাও হলো কই ? আমি চলে এলাম এ দেশে। ভাই চলে গেল ও দেশে। সে পেছন ধরলো কাইলে মামার বলা নেই কওয়া নেই।

              তাই সে কি ভাবলো আর কি ঘটলো! কোনোটাই জীবনে পরিকল্পনামাফিক হয় না। ভাবনা চলে এক পথে, আর ঘটনা চলে আরেক দিক দিয়ে তার নিজের ঢং-এ। কাউকেই কেউ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে না। সে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে থাকে।


( আগামী পর্বে )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন