সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

পাঠ প্রতিক্রিয়া * তন্ময় রায়



 ' আলোপাখি ' : ভূমি থেকে ভূমাস্নাত পর্যটনলিপি

   তন্ময় রায় 



' আলোপাখি ' পড়া শেষ হল। সমস্ত মন জুড়ে এখন 'আলোপাখি'র ছায়া । আহা: কী শান্তি ,কবিতা পাঠের। কবির ভাবনায় স্পৃষ্ট হবার।

আপন মনেই ভাবছি , কে এই ' আলোপাখি ?' জীবনানন্দের ' দোয়েল-শ্যামা-ফিঙে '  সে নয় , হাজার হাজার মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দেওয়া বোদলেয়ারের আলবার্টসও নয় সে , তবে সে কোন পাখি , যার পাখায় ভর করে বারেবারে কবির ভূমি থেকে ভূমায় পর্যটন ...সমস্ত 'আলোপাখি' কবিতা গ্রন্থটি জুড়ে।


আমার মনে হয়েছে, আর কেউ না , ' আলোপাখি ' আসলে কবির অন্তরে লালিত এক অনন্ত অবিনাশী সত্তা। যার সঙ্গে কবির জন্ম-জন্মান্তরের সখ্যতা । কবির যত আবদার, যত অভিযোগ ,অনুযোগ ...সব 'আলোপাখি'র কাছে । তাই তিনি খুব সহজেই বলতে পারেন ---  " আলোপাখি ,/ আমি তো চিনি না পথ /শুধু যেন কানে আসে রাখালের সুর/ তুমি কি দেবে না বলে নিদ্রা থেকে জাগরন কত শত আলোকবর্ষ দূর.."

যেন মায়ের কাছে সন্তানের আবদার ' আলোপাখি,/ আমি তো চিনি না পথ ...' এবং এই আর্তি, এই ব্যাকুলতা প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই ঘুরে ফিরে এসেছে। কিন্তু আশ্চর্য , ক্লান্তি লাগেনি এতটুকু, বরং মন যেন প্রস্তুত হয়েই থেকেছে , শিশুর সারল্যে কবি কখন বলে উঠবেন----" আলোপাখি,/আলো দিয়ে বাঁধা সেতু ...ছায়া ছায়া ,/মধুপুর ...মধুপুর কত কত জনমের দূর!/ এভাবে নাচাবে যদি নূপুরের বেঁধে দিও/ ও -ওপারের সুর।'


কামনা-বাসনার ষড়রিপুর শেকলে তিনি বন্দি " আমি তো শেকলে বাঁধা দুই পায়ে বাসনার '' কবি জানেন ; তবু প্রগাঢ় প্রত্যয়ে তিনি বলে ওঠেন---" আলোপাখি,/ তুমি আছো আর কী-ইবা চাই !/সুখ- দুখ জোয়ার-ভাটার খেলা দেখে যাই হৃদয়গঙ্গায়..."


এইভাবে আলোপাখির আশ্চর্য আলোয় স্নাত হতে চেয়েছে কবি-প্রাণ, কখনো অনুপম রূপকে-চিত্রকল্পে, কখনোবা ছন্দে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, তাঁর ব্যবহৃত ছন্দ এতটাই সহজ স্বতস্ফূর্ত কবিতার ভাবের সঙ্গে ছন্দের দোলায় মন আপনিই নেচে ওঠে, আরোপিত মনে হয় না কখনো।


'আলোপাখি' সর্বমোট ষাটটি কবিতার সংকলন। স্বতন্ত্র কোন নামে কবিতাগুলিকে চিহ্নিত করেননি কবি। বিষয়ে ভাবে ব্যঞ্জনায় 'আলোপাখি' যেন ষাটটি ফুলে গাঁথা একটি অনুপম দীর্ঘ কবিতার মালা।


'আলোপাখির প্রাকভাষ' নিবন্ধে শ্রদ্ধেয়া পারমিতা ভৌমিক লিখেছেন, "....এসব কবিতা যেন মন্ত্রে পরিণত হতে চাইছে ...সেইটাই এর অভিমুখ।"এ যে কত বড় সত্য উপলব্ধি , প্রিয় পাঠক,কবিতাগুলি পাঠ না-করলে ,সম্যক উপলব্ধি করা যাবে না। কবির বোধ মনন এবং অবশ্যই কবিতাধ্যান যেখানে একক স্বরের স্থিতি পেয়েছে ,সেখানেই উচ্চারিত হয়েছে মন্ত্রের মতো সব পঙক্তি । কয়েকটি দৃষ্টান্ত ----


১) সারারাত এই বেহায়া শহরে পাগলা দাশুর মতো অনন্ত আঁধারে ভিজেছি...


২) আমার চেতনে চন্ডীদাস সিঁধকাটে, দূরের খেয়ার মতো ডাকে যেন কবীরের দোহা


৩) কপালে চাঁদের টিপ দুই চোখে নীলনদ গঙ্গা-যমুনার মতো অমল সকাল


৪) ভাবের ভিখারি আমি এ-পথে সে-পথে হেঁটে শেষমেশ মানুষের ছায়ায় দাঁড়াই


৫) আহা :, বাতাসে চন্দন-ঘ্রাণে আমি যেন অলীক সকাল।


৬) পাঁচ হাজার বছরের বৈদিক শিশির সারারাত আমাকে ভেজায় সামগান মন্ত্রের মতন...

 

এমনই আরো...



আলোপাখি/ পঙ্কজ মান্না 

প্রকাশক / কবিপত্র প্রকাশ


******************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন