বিষের ছোবল
মল্লিকা রায়
রাত প্রায় দুটো। ফাঁকা শুনশান রাস্তায় ছুটে চলেছে সাদা এম্বুলেন্স। ওপরে নীল আলোর স্তম্ভটা বনবন ঘুরে জানান দিচ্ছে এমার্জেন্সীর। ভেতরে কে অথবা কারা সঠিক বোঝার উপায় নেই। আপাতত একুশ দিনের লক ডাউনের প্রিয়ডে আতঙ্কিত শহরবাসী বুঝে নিয়েছে হয় ভ্রাম্যমান মেডিকেল গ্রুপ অথবা আক্রান্ত কোন রোগীকে কোয়ারেন্টাইন কিংবা আইশোলেসনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অতএব নিস্তব্ধ শহরের ঘরে আরও গভীর হয় মানুষের শরীর হৃদয় মন। এককালে চরম দুর্বিনীতও আজ বড় শান্ত বাঁচতে চায় সংসারের মায়া প্রাঙ্গনে। ভুল ভুল ভুল পরকীয়া ভুল " গভীর ভাবাবেগে আগলে ধরেছেন মধ্যবয়স্ক প্রৌঢ় তার স্ত্রীর সান্নিধ্য। যতদূর চোখ যায় রাস্তা বরাবর দীর্ঘ এক কালো সরীসৃপ যেন এঁকে বেঁকে সটান শুয়ে রয়েছে শহরের মাঝখানে। কাছ থেকে ঠিক এইরকমভাবে শহরের ভাবমূর্তি দেখবার সুযোগ হয়নি প্রিয়মের।পেশায় সাংবাদিক সর্বক্ষণ কেবল দুর্যোগ থেকে অসময় থেকে তুলে এনেছে হরেক পোজের ফোটোগ্রাফ। বহুদিন হয়ে গেল বন্ধ হয়েছে সেসব। আজ শুধু ঘুমের শহরে নিরিবিলি চলাফেরা। দূষিত পৃথিবীর পরে আজ পরিশ্রুতির সঙ্গম। তাই উলঙ্গ ধরিত্রী ঘুমে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন প্রাণীকূলকে। উত্তপ্ত পৃথিবীর কাছে তাই প্রেমাস্পদের আগমনে নীরব সৃষ্টিরহস্য।
একলা ছাতে এসে দু'হাত মেলে ধরে প্রিয়ম। ঠান্ডা হিমেল বাতাস দুষ্টামি করে এলো করে দেয় চুল। মুখে গালে আলতো ছুঁয়ে দেয় একজোড়া সরস ঠোট। ঠিক তন্বীর মতো। উহ্ কতদিন দেখা হয়না। ভিডিও কলে যদিবা দেখা হয় ছোঁওয়া যায় না, ইচ্ছে মত জাপটে ধরে করা যায় না অনেক, অনেককিছুই......
এত রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে ও। বিরক্ত করে লাভ নেই। টেবিলে অনেক রাত পর্যন্ত খবরের রেকর্ডগুলো সাজানো ওর অভ্যেস। লকডাউন প্রিয়ডে অনিমেষ দা রিপোর্টের কিছু অংশ কম্পিউটারের মেলে পাঠিয়ে দেন। সেগুলো এডিট করে ফেরত পাঠাতে বেশ অনেকটা রাত হয়ে যায় প্রিয়মের । মাঝে মধ্যে সময় দেওয়া হয় না তন্বীকেও। এই একটু অপেক্ষা কর প্লিজ লক্ষীটি আমিই কল দিচ্ছি......কত ঘন্টা মিনিট সেকেন্ড যে কেটে যায় একসময় ঘুমিয়ে পরে তন্বীও একরাশ অভিমান নিয়ে। আগেও রাতের ঘুমন্ত শহর দেখেছে প্রিয়ম তবে আজকে ঠিক এই সময়ের পৃথিবীটা অতি প্রাচীন এক সভ্যতার ভগ্নাবশেষ যেন সমস্ত তৎপরতা ও অভিপ্রায় সেরে কুপিয়ে খুন করে রাখা হয়েছে মনুষ্যত্ব। অবশিষ্টেরা নাকে মুখে কুলুপ এটে টু শব্দটি না করে সেঁদিয়ে রয়েছে গুপ্তকক্ষে। ভয় আর তরাসে গোটা পৃথিবী আজ শায়িত ঘাতকের উন্মত্ত আক্রমণে। মা বাবার আর ক্লাশ ফাইভে পড়া ভাই শ্রেয়মকে নিয়ে বালিগঞ্জ লেকের এই ফ্ল্যটে বছর ছয়েক হল এসেছে ওরা, থার্ড ফ্লোরের সেকেন্ড রো'য়ের তিনটি ফ্যামিলির মধ্যে ওরাই পুরোনো। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ কারুর সাথে কথা বলেন না খুব একটা। ফ্ল্যট কালচার বোধহয় একেই বলে।
এমনিতে খুব একটা মিলমিশ না হলেও এই সময় বিশেষত ফ্ল্যটের নীচে যখন নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর আনাজ,মাছ ফল ইত্যাদির ভ্যনগাড়ির বাঁশি বেজে ওঠে। মিসেস মিস্টারেরা ভীষণ তৎপর হয়ে ঘেষাঘেষি হতে দ্বিধা বোধ করেন না কেউ। কিংবা অমুক বৌদির অসাধারণ মিষ্টি মুখের ভাই" ডাক শুনে পেছন ফিরতেই ",ভাই আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না..... " ঠিক আছে চেনার দরকার নেই,আনাজ লাগবে তো মাছ ফল,বেশ সবই লাগবে জানি। এনে দিচ্ছি বৌদি একমিনিট.......ঠিক এভাবেই " !
বাহ্ আগে তো চোখ পরেনি। বেশ সুন্দরী। কি নাম কে জানে। হয়তো সবজিওলাই ভেবে নিয়েছে। নিক আপত্তি নেই। একটু ভদ্রতা বলে কিছু থাকে তো। দরজা সামান্য ফাঁক করে কোনমতে ব্যগটা টেনে নিয়ে দরজার বাইরে দুটো একশো টাকার নোট ফেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে বলেন,সরি মাফ্ করবেন ভাই, বুঝতেই তো পারছেন লক ডাউন "। যাঃ বাব্বা।
প্রিয়ম " কোন দরকার ছিল কি গাল্ বাড়িয়ে থাপ্পর খাবার ? যাক্ আজ নয় চিনলেন না একসময় ঠিকই চিনবেন। ঠেলায় পড়লে মানুষ আবর্জণাও খুঁটে খায়।
মাথার পরে কাস্তের মত অর্ধ চন্দ্রের ধূসর কমলা আলোয় নিজেকে ছায়ামূর্তির মত দেখাচ্ছে। চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই।পাশাপাশি ফ্ল্যটগুলো ঠাসাঠাসি করে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের নিয়ম অনিয়মকে তুড়ি মেরে সূর্য চন্দ্র গ্রহের জাগতিক ধারার উর্দ্ধমুখী প্রাণ সঞ্চারের তাড়ণায় প্রাণিত হতে।
সাইরেন বাজিয়ে হু হু করে ছুটে গেল আরও কয়েকটি এম্বুলেন্স। ওদের শহরে এখনও পর্যন্ত কোন সিম্পটম ধরা না পরলেও পাশের শহরে বেশ কয়েকজনের পজেটিভ ধরা পরায় ব্যরিকেডে ঘিরে দেওয়া হয়েছে শহরের প্রত্যন্ত জনবহুল অঞ্চলগুলি এছাড়া এলাকাটি রেড জোন হওয়ায় আগামী সাতদিনের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দোকান বাজার সব। দিনের শহরকে চোখ ভরে দেখতে অবাক লাগছে কিছুটা। ফ্ল্যটের ফার্স্ট ফ্লোরের ডঃ মিস্টার অর্নব নিযুক্ত আছেন দিনরাতের করোনা রোগীদের সেবায়। আপাতত তার বাড়িতে আসা বন্ধ। সেকেন্ড ফ্লোরের মিঃ চ্যটার্জীর স্ত্রী চব্বিশ ঘন্টার স্পেশ্যাল ডিউটিতে আছেন বেলেঘাটা হসপিট্যালে। সাত বছরের ছোট্ট তিন্নী বাবার কাছে জানতে চায় মাম্মাম কেন আসতে পারবে না বাড়িতে,কোন ব্যখ্যা খুঁজে পাননা অসহায় পিতা টিভি অন করে চালিয়ে দেন প্রিয় কার্টুন চ্যানেল। ফোর জি আই প্যাডে ইচ্ছেমত ডাউনলোড করতে বলেন চমকপ্রদ গেম। তবে এখন আর কোনকিছুই ভাল্লাগে না তিন্নীর।
**************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন