সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ,দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়-এর কলমে -----


সুখের লাগি

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়



মুসাফিরানার বেঞ্চে বসে আছে অপূর্ব ড্যামের জলের ঠান্ডা বাতাস গায়ে মেখে।মুকুটমণিপুর ওর কাছে বড়ো কষ্টের আশ্রয়। কাঁদে, তবুও আসে। জীবন হারিয়ে এখানেই জীবন যোগ হয় যেন ওর।ড্যামের জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ও। প্রবল বাতাসে জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বাঁধের ওপর পাথরের গায়ে।বুকের মধ্যেও আছড়ে পড়ছে ঢেউ এলোমেলো স্মৃতির ঝোড়ো হাওয়ায়।

      প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে অপূর্ব ও সুমনা সেবার বেড়াতে এসেছিল মুকুটমণিপুর। সবুজের বুকে আর এক সবুজ আনার স্বপ্ন ওদের তখন।সোনাঝুরি বনের ভেতর কটেজ। ঠিক যেন স্বর্গ ! শরীরের তানপুরায় বেজে চলেছে আনন্দভৈরবী ওদের।এতো সুখ থাকে শরীরে ! এতো ভালোলাগা থাকে ভালোবাসায় !মুকুটমণিপুর সত্যিই যেন সৌন্দর্যের এক অনিন্দ্য মুকুট ।

      সেদিন বিকেলে ওরা এসে বসে মুসাফিরানায়। পাহাড়ের মাথা কেটে একটা পার্ক ড্যামের ওপর।এক কথায় প্রকৃতির বুকে যেন এক অনাবিল আনন্দের ঠিকানা।লকগেট থেকে প্রায় দু কিলোমিটার।ওরা একটা ইঞ্জিন চালিত ভ্যানে  এসেছে।বেশ কিছু পর্যটক এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।কোন দিকে ওদের খেয়াল নেই যেন।হাতে হাত নীরব দর্শক ওরা হাওয়ায় নাচতে থাকা বাঁধের জলের। স্পর্শের মাদকতায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে।ওরা উঠে পড়ে নীচের রাস্তা থেকে একটা  ইঞ্জিন ভ্যানগাড়ি ধরে।দুপা ঝুলিয়ে গাড়ির কাঁপনে ওরা এগিয়ে চলে।গাড়ির কাঁপন যেন লেপ্টে থাকা দুই শরীরেও ছড়িয়ে পড়ছে আপন বন্যতায়।

        হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ করে পিছনের বাঁদিকের চাকা ফাটে।গাড়ি হুড়মুড়িয়ে গিয়ে ধাক্কা মারে বাঁধের বাঁধানো পাড়ে। প্রচন্ড জোড়ে ধাক্কায় ছিটকে পড়ে ওরা বাঁধের পাড় টপকে সাজানো পাথরের ওপর। প্রচন্ড একটা কষ্টে চোখ বুজে আসে অপূর্বর। একটা হইহই আওয়াজের মধ্যে জ্ঞান হারায় ও। একদিন পর জ্ঞান এলে জানতে পারে অ্যাক্সিডেন্টে সুমনা ও ভ্যানের ড্রাইভার মারা গেছে পাথরে মাথা থেতো হয়ে। সুমনা দূরে পাথরে ছিটকে পড়লে মাথা ফেটে ঘিলু বেড়িয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই সুমনা মারা যায়।ড্রাইভারেরও মাথায় চোট লাগে। প্রচুর রক্ত ক্ষরণের ফলে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই ও মারা যায়। অপূর্বর ডান পাটা কোমড়ের নীচে থেকে এমনভাবে থেঁতলে যায় যে পাটা বাদ না দিয়ে উপায় ছিল না। গ্যাংগ্রিনে অপূর্বও হয়তো মারা যেত তখন পা বাদ না দিলে। সুমনাকে দাহ করে ক্রাচ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল অপূর্ব সুমনার মা বাবার সাথে। সুমনার কথা মনে পড়লেই অভিরত অনুভবে অপূর্ব চলে আসে এখানে।মুসাফিরানায় বসে সুমনাকে খুঁজতে থাকে ড্যামের জলের বুকে।চোখ ভর্তি জল নিয়ে তখন ওর একাকী অস্তিত্ব খুঁজে ফেরে স্মৃতির বুকে সুমনার শরীরের স্পর্শ।

      হঠাৎ ড্রাইভার মনজয়ের ডাকে সম্বিৎ ফেরে:" সাব, অন্ধকার হয়ে গেছে। এবার উঠুন।"

হো হো করে হেসে ওঠে অপূর্ব।মনজয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে :" আমার জীবন জুড়েই এখন অন্ধকার। অন্ধকারে ভয় কি ভাই !"

মনজয় ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে আসতে থাকা    সাহেবের  জলভরা চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।


**********************************************************************



দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 


  রয়েল কমপ্লেক্স ,কাঠালবাগান ,উত্তর পাড়া, হুগলী থেকে লিখছেন পেশা: শিক্ষকতা ,নেশা : কলম চারিতা ,সাপলুডো খেলা শব্দ নিয়ে ,অণুগল্প ,ছোট গল্প ,কবিতা, প্রবন্ধে  সুখ-দুঃখ ,হর্ষ-বিষাদ, আড়ি ভাবের অনুভবে থাকা ,জীবনের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের আদর্শ মনন, যাপন ও শীলনে.. স্বপ্ন: পৃথিবীকে ভালবাসার যৌথ খামার বানানো..দিক চক্রবালে হিরণ্যগর্ভ আলোর খোঁজ ..পাখি ,গাছ আকাশের সাথে মন কি বাত.. সূর্যের নরম আলোয় সুখের আবিরে মানুষের সাথে হোলি খেলা..

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন