ডিভোর্স / বিরথ চন্দ্র মণ্ডল
হ্যালো ;
ঐন্দ্রিলা, ক ' দিন ধরে একটা কথা তোকে বলবো বলবো করে ও বলা হয়নি ।
কথাটা ঋক বাবুকে নিয়ে। কিছু ভেবেছিস ইনাকে নিয়ে ? তোর মতামতের অপেক্ষায় আছি।
ফোনের ভেতর থেকে একটি মেয়েলি গলা ভেসে আসে - হ্যাঁ মা ; তুমি তো আগে ও বলেছিলে উনার কথা। আমি উনাকে দেখিনি যদিও। তোমার কাছে যতটুকু শুনেছি, -আমার তো মনে হয় -উনি খুব ভালো মানুষ। আমার এতে কোনো আপত্তি থাকবে না।
আর একটা কথা মা -তোমার প্রত্যেক সিদ্ধান্ত সময়ের সাথে সাথে একদমই খাঁটি হয়ে যায়। আমাদের খুব ভালো হয়ে যায়। একারণে , তোমার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস আর ভরসা আছে মা।
তাছাড়া, তোমার কাছে আমি আর ক' দিন বা থাকবো বলোতো ?
সমস্যা হবে হয়তো আমার বিয়ে নিয়ে। সেও না হয় হয়ে যাবে।
কিন্তু তুমি এমনিতেই অসুস্থ। তোমার একাকিত্ব থেকে রক্ষা পেতে ঋক বাবুর মতো একটি মানুষের প্রয়োজন তোমার। সেটা আমি বুঝি। তা না হলে......
কথা চলতে থাকে এইভাবে। প্রায় চল্লিশ - পঁয়তাল্লিশ মিনিট। মা মেয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন। ফোনে ফোনে।
সবে আঠারো পেরিয়েছে মেয়েটি। সংসারের চালচিত্তির , সম্পর্কের বাঁধন -ফাটল - একাকিত্ব... এসবের কতটুকু ই বা টের পেয়েছে মেয়েটি। অথচ ; তার বাচন - ভঙ্গিমা একদমই পরিণত মানুষের মতো।
এসব যত ই শোনে - তত ই স্তম্ভিত হয়ে যায় ঋক।
সৃজার সাথে পরিচয় মাস ছ'য়েকের। এর ই মধ্যে সৃজাকে বেশ বুঝেছে।
এক দৃঢ়চেতা স্বভাবি মানুষ। আদ্য-প্রান্ত সৎ , কাজ পাগল , সময়ের কাজ সময়ে করে নেবার তীব্র প্রবণতা ।
ঋক বুঝতে পারে - এই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য একটু বেশি তৎপর সৃজা। ওর সারাক্ষণ একা একা থাকার ভয়।
কারণ - রূপে সৃজা বেশ রূপসী। দুধে আলতো আলতা মেশানো গায়ের গড়ণ। মুখের সাধারণ কমনীয়তা য় সত্যিই যাদু আছে।
সে জায়গায় , ঋক একজন জ্ঞানী মানুষ। শ্রদ্ধার মানুষ।
কিন্তু সে ওতো আজ বিদ্ধস্ত। তার কষ্টগুলো বহু বছর , মনের এক নির্দিষ্ট জায়গায় মুহুর্মুহু দলা পাকায়। মোচড় দেয়। ঠিকরিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।
সব থেকে ও কিছু না থাকার যন্ত্রনায় ক্লীষ্ট দিনের পর দিন।
সেই কঠিন জায়গা থেকে বার বার বেরিয়ে আসতে চেয়ে ও পারেনি।
তার গাড়ি - বাড়ি - চাকরি , মান -সম্মান - যশ - প্রতিপত্তি.... সব থেকে ও আজ মনের বড্ড কাঙ্গাল।
বার বার চেষ্টা করে ও পুরোনো বাঁধন থেকে বেরোতে পারেনি।
কারণ -মান- সম্মান হারানোর ভয়।
সবে মণী - নীলরতন এক সন্তান। তার ভালবাসা, তার স্বপ্ন। সর্বপরি তার অসীম ধৈর্য।
সমস্ত ভুল সেই আবর্তককে ধৈর্যের শিকলে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে নিজেকে।
দিনের পর দিন।
তেমন করে ভালোবাসার মতো এমন কাউকে খুঁজে পায়নি হয়তো।
আর যাই হোক -সৃজা তাকে ভালোবাসে। অন্তর থেকে চায় তাকে।
সে চাওয়ার কোন খাদ্ নেই।
আবার বিয়ে করে নতুন সংসারী হতে চায় সৃজা।
এই প্রসঙ্গে কথায় কথায় ঋক বলেছিল -
----আর বিয়ে নয়। আমরা লিভ-টু-গেদারে থাকবো।
সেই কথায় সৃজা বিপক্ষে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বলেছিল -
-----না -না। একদমই নয়। লিভ-টু-গেদারে থাকার মতো হাইফাই সোসাইটি প্রয়োজন। অথচ, আমরা থাকবো একটি মিনি টাউনে। এখানে কোন লিভ-টু- গেদার নয়। সোজা বিয়ে।
তাছাড়া লিভ-টু-গেদার তোমার সমাজ, পাড়া - প্রতিবেশী -ভালো চোখে একদমই নেয় না।
আর একটা কথা -- বিয়ের বাঁধন এমন একটি সম্পর্ক... এমনিতেই খুব কাছের হোওয়া যায়। অন্য কিছু তে এমন হয় না। কোথায় যেন বাধো বাধো ঠেকে।
গড় - গড় করে বলে যাচ্ছিল সৃজা। বলছিল - আমি তোমাকে একদমই আপন করে পেতে চাই ।
সেই যখন একসাথে থাকবো - শুধু বিয়ে করে নিলে ক্ষতি কী বলো....?
সৃজাকে কোন ভাবে এ কথায় হারাতে পারেনি ঋক। সারাদিনে দু ' চার বার ফোন করে সৃজা।
মৌপিয়ার সামনেই কথা বলে ঋক। জড়তাহীন ভাবে কথা বলে। কোন রাখ -ঢাক থাকে না সে কথায়।
আজ পনেরো বছর মৌপিয়ার সাথে সম্পর্ক প্রায় তলানিতে।
যতটুকু টিকে আছে শুধু ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে।
মৌপিয়া চাকরি করে। বেশ ভালো আছে।
ভালো নেই ঋক। এক বন্ধুর প্রয়োজন তার। সৃজা তার তেমন এক বন্ধু। সৃজার সাথে হোয়াটসঅ্যাপ এ কথা বলে মৌপিয়ার সামনেই। কোন ভ্রুক্ষেপ করে না।
নিজেদের সম্পর্ককে সেই আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার জন্য বার বার মৌপিয়ার কাছে ছুটে গেছে। কোন বরফ গলে নি। বার বার সেধেছে। মনের কথা তো দূর -ফিরে ও তাকায়নি মৌপিয়া। স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে মৌপিয়ার চোখে মুখে সে সময়কার অস্বস্তিকর হাবভাব।
আজ সপ্তাহ খানিক হল, মৌপিয়া কারণে -অকারণে হুড করে রেগে যাচ্ছে। ছেলেটার সাথে পর্যন্ত ভালো করে কথা বলছে না। দেখে মনে হয়, কিছু একটা গভীর ভাবনায় মানষিক ভাবে জর্জরিত। বিপর্যস্ত।
কীইবা কারণ হতে পারে...? হোক.. এসব নিয়ে আর ভাবে না ঋক।
এই সব ভেবে ভেবে সে ওতো ক্লান্ত।
মৌপিয়া ভীষণ চাপা স্বভাবের। মন খুলে কিছু বলে ও না। সংসারের ভালো - মন্দ... কিচ্ছু না।
এ নিয়ে কী আর করা যায়...? সুতরাং, যেখানকার জল সেখানেই থাক। ঘেঁটে লাভ নেই।
সন্ধের সময় হঠাৎ গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল মৌপিয়া। ওর এমন ই স্বভাব। যখন - তখন চাইলেই ঘুমিয়ে যায়। ঋক পারে না এমনটা। হাজার চেষ্টা করে ও ঘুম আসে না তার।
সকালে হোয়াটসঅ্যাপ এ কথা হয়েছে সৃজার সাথে। আবার ফোন করল সৃজা।
---হ্যালো ঋক। ডিভোর্স টা কখন করছো বলো... !
সৃজার কথায় যেন অধিক আগ্ৰহ ফুটে উঠছে।
ঋক উত্তর দেয় -----সে হয়ে যাবে। এ নিয়ে তুমি উতলা হয়ো না।
সৃজা মুহুর্তে বলে -----না না। আমার সিগ্গির চাই। এসব নিয়ে ভাবতে আমার আর ভালো লাগছে না। আর ডিলে করোনা প্লীজ। কাল - পর্শুর মধ্যে ডিভোর্স টা নিয়ে নাও।
আর হ্যাঁ, বলে দাও মিউচুয়াল। কোনো দাবী - দাওয়া নয়! বুঝলে ! আমার পর্শু চাই ডিভোর্স পেপার। আমি ও এক্স এর সাথে কথা বলেছি। আগামী কাল হাতে পেয়ে যাবো। বুঝলে ---বুঝলে ---কোন কথা বলছো না কেন...?
ঋকের ফোনের সাউন্ড মৌপিয়া স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। ঋক জানে - ও এখনো ঘুমায়নি।
কী কারণে, কী জানি , ঘুম উবে গেছে ওর।
ফোন ধরা অবস্থায় কী উত্তর দেবে, বুঝতে পারছে না ঋক।
কোন রকম বলল --- আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখছি।
মৌপিয়াকে আগাম বলেছিল --ডিভোর্স টা দিয়ে দাও।
মিউচুয়াল। কোন দাবী থাকবে না আমার। তুমি তো জানো- আমাদের সম্পর্ক... শুধু কঙ্কালসার।
উত্তরে কিছুই বলেনি মৌ।
তাইকি এত ই ভাবনা ? ওতো বেশ ভালোই আছে।
ঋক দিনের পর দিন দগ্ধ হচ্ছে। স্থবির হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।
সে ও তো মানুষ। তার ওতো মন আছে। যে ভাবে ও বেঁচে আছে --- ওটা বেঁচে থাকা নয়।
এই ভাবে কেউ বাঁচে না। সুতরাং এই ভুল বোঝা -আর বুঝির জীবন থেকে মুক্তি পেতে ডিভোর্সই একমাত্র পথ।
কাজের মেয়ে এসে রান্না করে দিয়ে যায় ঋক দের। রাতের এবং সকাল, একসাথে।
এখন রাত প্রায় দশটা বাজে। খাওয়া সেরে বিছানা করতে এসে ঋক দেখলো- তার বিছানা মৌ করেছে।
ঋক দেখছে আর অবাক হচ্ছে। আশ্চর্য হচ্ছে।
অথচ ; আজ কয়েক বছর ওদের বিছানা আলাদা।
দু 'জনের সাথে কথা তেমন হয় না। তাহলে..?
ভেবে পাচ্ছে না ঋক।
কী এমন হল যে - ওর বিছানা মৌ করল......?
কিছু না বলে চুপচাপ যথারীতি বেড এ এলো। লাইট নিভালো। চোখ বন্ধ করল।
মৌপিয়া সবার শেষে বেডে আসে। আজ ও এল। তবে তার নিজের বেডে নয়... ঋকের বেডে।
ঋক অন্ধকারে এই সব দেখছে আর অবাক হচ্ছে।
বিছানায় এসে ঠায় বসে রইলো মৌপিয়া।
যেমনটি শুয়ে ছিল - সেই শোয়া অবস্থায় ঋক ভাবতে থাকলো -- এখন সে কী করবে ? উঠে পালাবে ?
নাকি...?
এই অন্ধকারে হাল্কা নাইট বাল্বের আলোয় দিব্বি বুঝতে পারছে, মৌপিয়ার চোখ থেকে ঠস্ ঠস্ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচল দিয়ে ভিজে যাওয়া নাক মুছে নিচ্ছে।
উঠে বসল ঋক। বলল - কী হয়েছে গো মৌ..?
এতক্ষণে নিজের আবেগকে অতি বল পূর্বক এক রকম জোর করে কন্ট্রোলে রেখেছিল মৌপিয়া।
ঋকের এমন দরদী কথায় তাকে আর আটকাতে পারলো না মৌ। মুহুর্তে ই হাউ হাউ করে কেঁদে ঋকের গলা জড়িয়ে ফেললো মৌপিয়া।
কাঁদতে কাঁদতে বললো --
আমি তো খুব খারাপ মেয়ে।
তোমার চোখে একদমই বাজে মেয়ে। ডিভোর্স চেয়েছিলে তো... ! কাল ই চলো --!
ঋক বুঝতে পারলো - এ ক' দিন এই সব ভেবে ভেবে , একদমই মনমরা হয়ে গেছিল।
'থ' মেরে গেছিল।
নিজের সাথে নিজের অহ রহ যুদ্ধ চালিয়ে গেছিল।
কোন রকম সম্বিত ফিরিয়ে এনে ঋক বললো -- কথাকি তোমার মন থেকে বললে, নাকি আমি চেয়েছিলাম বলে বললে....?
ঋককে আলিঙ্গনে আষ্টেপৃষ্ঠে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরে মৌপিয়া ।
অভিমানী সুরে বলল -- তুমি বুঝতে পারছো না - আমি কী বলতে চাইছি...!
সে বোঝার মানুষ..........
আর বেশি বলতে পারে না মৌপিয়া।
ডুকরিয়ে কেঁদে ফেলে.......
**********************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন