স্বপ্নদীপ রায় / তিনটি কবিতা
পরিচয়
আমি কে?
ঐ যে জ্বলন্ত সূর্য--কলঙ্কিণী ঢ্যামনা চাঁদ--
আকাশে মিটমিটে চপল সব তারা...
ওরা জানে...আমার পরিচয়।
অনতিদূরের বাঁশবনে বাতাসের ঝিরিঝিরি অনুপ্রাস
আতাগাছের ঝুনো ডালে ডুমো ডুমো লাজুক শৈশব...
পলেস্তারা খসা দেওয়াল থেকে অলস গায়ে
লুটিয়ে পড়া মায়া বিহারিনী মাধবীলতা
নির্মল পরিবেশ প্রকল্পে ঝলসে যাওয়া
মাঝ রাস্তার বেচারা ফ্যান-পাম অথবা
মাটির সঙ্গে দ্রব্যগুণ হয়ে মিশে যাওয়া হাড়গুড়ো
বা নিছক গোবর সার জানে..
...ওরাই আমি।
বিভিন্ন রূপে অভিন্ন তৈত্তিরীয় আমি।
কালো আকাশটা বিষে নীল হয়ে যায়
রাঙা মুখ গোটাতে গোটাতে বেসামাল গিলে ফেলে
শেষ টোপে দিগন্তের সব চুক্তি...সীমারেখা..শর্ত!
এই সব আমারই নিত্য...
ওদের খতিয়ে দেখ আরেকটিবার...
নিজের ভিতর নিজে অন্তরীণ...
জন্ম থেকে মৃত্যু পযর্ন্ত
পঞ্চভূতের ভিতরে ও বাইরে অপার আনন্দ
অথচ বহুরূপে বিশ্রুত ফাঁদিদুয়ার...
---একদম একা--অন্তর্গত!
কবির দৃষ্টিকোণ
রাত্রি ঘন হচ্ছে।
যেন অণ্ডকোষে ঘনীভূত শ্রাবণ বীর্য।
ছড়ানো পথ গুটিয়ে ফেলেছে দলিতের মনব্যথি...
এখন সবটাই চুপচাপ।আটোসাঁটো।নিখোঁজ।
ফ্লাইওভার থেকে নীচের শহরটাকে দেখে
একজোড়া পরিস্কার চোখ--
জোনাকী যেন সেখানে সহস্র আর
সহস্রগুণ বেগে ধাবিত রক্তপথে পিচ্ছিল বারুদের স্রোত।
আমি ভালো নেই।শুনতে পাচ্ছ তুমি?
...কে শুনবে?
শহর দেখাচ্ছে আজও বায়োস্কোপে ভেল্কি--
চাপা পড়ছে ঘুম ঘুম চোখে আণ্ডারপাসে...
মর্গের বস্তাচাপা দুর্গন্ধ ঠাণ্ডা শোক।
কবির ঘুম নেই।
কে কেড়েছে তার মনের আধমণ সুখ?
গ্রীণ টিতে পড়ছে ঘনঘন চুমুক
আর ছুটছে গাণ্ডিব কিংবা বিজয়ধনুষ অথবা
বাঁচিয়ে রাখার ঝাঁঝালো দোষ!
ওরা বলে আঁতেল।বলে ইঁচড়ে পাকা।
বলুক না।
শেষ কথা বলতে শেখেনি ওরা।
কথার ছায়ায় বেড়ে ওঠা অজাতশত্রুর সাথে
মিথোজীবিতা বাড়ায় সহিষ্ণু কবি...
কারণ সে জানে...সংগোপনে...
একমাত্র ঐ ঔরসই পৃথিবীর প্রদক্ষিণ রসদ!
মৌচাক
প্রিয়তমেষু,
অনেকক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে
নিরীক্ষণ করছি মাথার উপরের ঐ মৌচাক।
একটু একটু করে সুখ জমা হচ্ছে সেখানে।
প্রতিটি প্রকোষ্ঠে টৈটম্বুর যত্ন।
ভনভন করে চাকের চারিপাশে প্রদক্ষিণ করছে
কর্মি মৌমাছিদের দঙ্গল।
নিকোনো উঠান ঘর-দুয়ারে শিরিন স্বপ্নগুলো পাহারা দিতে হয় যে...
তুলসীতলায় বেজে ওঠে গৃহস্থের মঙ্গল-শঙ্খ।
ওদিকে মাটি ঘেঁষে জটলা করেছে কিছু বুদ্ধিজীবী।
কিছু হাতে কাপড় জড়ানো লাঠি...
কিছুতে কেরোসিন-সরকারী কন্ট্রোল!
সন্ধ্যা নামার অপেক্ষা।নৈঃশব্দ বড় ছোঁয়াচে।
নরম মাটির তলায় কবর কী আজ লাশ খোঁজে?
হঠাৎ জ্বলে উঠলো
সহস্র প্রদীপতুল্য তেজস্বী লেলিহান....
ইন্ধনের কেরোসিনে আসকারা মিলতেই
আঁকড়ে ধরল সে কাপড়ের সুডৌল শরীর..
--পুড়িয়ে মারার নেশাতুর সুখ!
"কেউ ব্যাটা পালাতে যেন না পারে
কেউ ব্যাটা পালাতে যেন না পারে.."
বলল নিছক লালাঝরা কিছু ম্যাস্টিভ-কুকুর।
এরপর চলল সেই ছবি--
ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ-একাত্তর-বাহাত্তর
-গৃহদাহ--গৃহদাহ--কিছু পলাতক কামড়ে ধরল কাঁটাতার--
কিছু ঝরে পড়ল মাটির ছায়ায়..
জৈব সারের অজুহাতে ঝলসানো
চাপ চাপ দুখ।
লাঠির তীব্র খোঁচায় ফিনকি দিয়ে
নির্গত হতে থাকলো দীর্ঘ পরিশ্রমের রক্ত...
ঘামের শরীর চুঁইয়ে জমা এফ.ডি--
সবটা ঝরে চলল কলকল ধারায় নিম্নগামী সমাজে,
--চাখা যাদের অতিমাত্রিক সুখ!
গর্ভে আটক গর্ভবতী
পুড়ে যায় নির্মমতার সহজ আঘাতে...
কেউ দেখে...দেখে না কেউ.... খানিকটা তফাতে।
ঐ কুঁড়িরাও যে বসন্ত শেষে পেল
সেই পিতৃহীন বৈশাখ...
পোড়া ঘাস...ডোবা সূর্য...আর
একদল ক্ষমতাভোগীর লাগামছাড়া আত্মোচ্ছ্বাস!
সব ধ্বংসই কি ভূমি পায়?
পায় খরস্রোতা রৌদ্রতাপে সঞ্জিবনী...রবিঠাকুর?
শিল্প ভেঙে নাবিক চেনায় সভ্যতার সীমারেখা..
রিক্ত ডাল অন্ধকারে শুধু কেঁদে মরে--
সেও তো মাটি হতে চেয়েছিল।
চেয়েছিল দু কাঁধ-জোড়া.... দায়িত্ব।
পৃথিবী গোগ্রাসে গিলেছে মিলনসুধা...
ছড়িয়েছে চোরাগলিতে যৌনত্বের আঁশটে গন্ধ;
মৃতেরা পোড়া ঘাসের শিকড়ে জ্বালায়
জোনাকীর স্বপ্ন...বাতাসে ভাসে দলা পাকানো
ধোঁয়ার অমিমাংসিত দীর্ঘ কুণ্ডলী...
জরায়ুতে মৃত ভ্রুণ মৃত পৃথিবীর প্রতিবিম্ব!
সভ্যতা গুটিপায়ে লাগায় অশরীরী দাবানল ..
ঐ পরচর্চাতেই চিরটাকাল সে
বড় অভ্যস্ত....বড়ই অভ্যস্ত!!
হতাশ হয়ো না প্রিয়তমেষু!
তুমি শরীর দাও--স্থির-প্রশান্ত একটা দাঁড়ি।
সুরক্ষিত অভিকেন্দ্র তোমাকে একদিন ফেরাবেই উৎসতাপ!
এটাই সৃষ্টির বীজমন্ত্র।।
***********************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন