সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

গল্প * শতদল মিত্র



দুয়োভূমি 

শতদল মিত্র 


প্রকৃতি জাগরসম্ভব হয়, এ জাগতিকতায় সময় টুকুন স্থানু, যেন বা থমমারা, যদিও তা পলমাত্র, কেননা পরক্ষণেই প্রাকৃত চোখে আঁধার মুছে আলোর ঝিলিক, ফলে নিথর বাতাস আবার মৃদুমন্দে ঘাই তোলে, এ ছন্দে আকাশ বলে-- আলো হবে, সকল বৃক্ষপাতা চোখ মেলে বলে-- আলো হবে, ঘুমের ঘরের থেকে তাবৎ প্রাণীকুল আলিস্যি ঝেড়ে বলে-- আলো হবে। ব্রহ্ম জাগে। ভোর হয়। তখন আচরাচরে কুসুম-কুসুম মায়া।

     সে মায়ায় শঙ্কর অবচেতন থেকে চেতনে ফেরে, আবার ফেরেও না, যেহেতু তার চৈতন্যে তখনও বেদনারঙিন পুরাণ স্বপ্নের রেশ। স্বপ্নে নদীটি তিরতির বয়ে যায় পথের পাশটি দিয়ে। তার ছলাৎ ঢেউ হাসে-- কতদিন পর এলে! পথের ধুলো পায়ে লুটোয়-- এলে তবে! তার মাথায় বৃক্ষপাতার ছোঁয়া-- ভালো আছ তো! এ মায়াটানে কোকিলের হঠাৎ কুহুতান পঞ্চমে ভেসে এলে ভোরখানি অঘোর হয়। নদীটির ওপারে দিগন্তের দরজা সপাট খুলে একটি দোচালা ঘর বসত করে সহসা। যার উঠোনে একটি আমগাছের শীতল ছায়া, তুলসীতলার পাশে জবা ফুলের পবিত্রতা, যা গেরস্তের সুখছবিই যেন। সে ঘরখানি থেকে সদ্যযুবতী এক সদ্যস্নানের স্নিগ্ধতা মেখে, যেন বা নৃত্যপারা আলোতে বার হয়।

    --মা, আসি। আজ ফিরতে বেলা হবে। কলেজের পর টিউশুনি আছে।

      --দুগ্গা! দুগ্গা! এ অস্ফুট রবের সঙ্গে মমতাময়ী এক ফুটে ওঠে, যার বসনজুড়ে তেল-হলুদের বাস।

     --সাঁঝ লাগাস না যেন।

     এর উত্তরে চিলতে হাসি নাচে মেয়েটির মুখে, যার দোহারকিতে তার হাতের সাইকেল আওয়াজ তোলে-- ক্রিঙ!  ক্রিঙ!

     সে ধরতাইয়ে বাণী ভাসে-- সত্যি! বাবাটা যে কী! এত বেলা হল, এখনও মাঠ থেকে ফিরল না। আবার অসুখ বাধালে তখন? দাদাটা বিভুঁই থেকে কত আর সামলাবে?

     এ বাণীতে ছায়া থাকায় তা সজলতার পরশ আঁকে শঙ্করের চোখে, যে সজলতায় মাটিবাসের একজন মানুষ পরম মমতায় নিরানি দেয় মাঠজোড়া গাভীন সবুজে। এক কাঁচ-কাঁচ ব্যথা ঘনায় শঙ্করের বুকে, যা কুয়াশা নামায় আজমিনআশমানে। আর সে কুয়াশা ঠেলে কিশোর শঙ্কর বাবার হাত ধরে মুঠ আনতে মাঠে যায় আমনশরীর আউশের ঘ্রাণ মেখে। যদিও সে আনন্দ যাত্রায় হঠাৎই হোঁচট লেগেছিল, কেননা তার নজর টেনেছিল বোবা একজোড়া কাতর চোখ। ধানবোঝাই গাড়ি কাঁধে এক বলদ নিরুপায় বসে পড়েছিল কাদায়। এ নেকনে তার গায়ে পিঠে মালিকের সপাং সপাং পাঁচনবাড়ির বোল ওঠে, নামে... বার বার, বারংবার।

     --শালা, নামুনে খাবে শুধু! কাজের বেলায় ঢুঁ ঢুঁ! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। হারামজাদা, বোদো! নেতার মারি তোর বোদোমির।

     তখনও, এখনও-- এ দৃশ্য অসহায় বিষাদমগ্ন হওয়ায় সে, শঙ্কর, এক পাঁজর নিংড়ানো শ্বাস ছাড়ে। এ ঘাতে নদীটির জল ছলাৎ ঢেউ ভাঙলে সময় চিড় খায়। সে ফাটল বেয়ে ক্ষীণ ধ্বনি উথলে ওঠে, ঘূর্ণি তোলে।

     --শঙ্করা রে, তোর বাবার শরিলটো জুতের লয় বড়। প্যাটের বেদনাটো কমছে না রে।

    --দাদা, আমি বিয়ে করব না। কলেজে পড়ব।

     সে ধ্বনির ঘূর্ণি পাক খায়, ওপরবাগে ওঠে, যেন বা শঙ্করকে দুমড়ে-মুচড়ে। সে টানে শঙ্কর তরতরিয়ে ওপরে ওঠে, উঠতেই থাকে। রাম-দুই-তিন... বিশতলা-বাইশতলা। হুই উঁচু থেকে সমগ্র শহর ছোটোপারা, সকল মানুষ, বাড়ি, গাড়ি, এমন কি লৌহপুরুষের বিরাট ধাতবমূর্তিখানিও খাটো, ঝুলনের পুতুল যেন। এ উঁচাই-এ মেঘ পরশ দেয়। বিহ্বল শঙ্কর মেঘবিলাসী হয়। এ মেঘই কি তাদের গাঁয়ে যাবে? তার ঘর? ভাবে শঙ্কর। এ মেঘস্বপনে ঘর দোলা দেওয়ায় মেঘ একদিন ডেকে নেয় শঙ্করকে তার ডানায়। ঘরকাঙাল শঙ্কর ভাসতে ভাসতে উড়ে চলে তার গ্রামপানে। ভাসতেই থাকে, ভাসতেই থাকে। কিন্তু কোথাও পৌঁছায় না। এবং মাঝপথে হারিয়ে যায় সে। নিমনাগরিক শঙ্করদের হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়, যেহেতু সংবিধানে জীবনের অধিকার, সেহেতু শ্রম আইনে সুরক্ষা-নিরাপত্তামাখা কথাগুলো আবছা হলেও এখনও দেগে থাকে।

আবার নিয়তি এই যে হারিয়ে যাওয়া, বেঘর, ভাসমান শঙ্করদের শেষ স্বপ্নে আবহমানের ঘরই  ঘাই মারে, ফলে ঘর জিওল হয় তাদের আনজীবনে। আর সে ঘরটানে আমাদের শঙ্কর আপাতত ভেসে ওঠে তার গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট নদীটির পারে। এ মায়ায় একটি পাখি আনমনে ডেকে ওঠে-- চোখ গেল! অন্য একটি ডানার আলিস্যি ভেঙে জানান দেয়--ক্ব!  ওমনি ভোরেরআকাশ মুখ ধোয় নদীটির তির-তির জলে। নিশাচর ছায়াশরীরগুলো নদীতীর থেকে সরে গিয়ে সেঁধিয়ে যায় পুরাণ পাকুড়বৃক্ষের খোঁদলে। প্রাকৃত সে আঁধারে শেষতম বাদুড়টিও ঝুলে পড়ে ক্রমে। মাটি থেকে উদ্ভিন্ন বালখিল্য মুনি, ক্রাতব যে, ফুকরায়-- মায়া! মায়া! এই বলে তপঃক্লিষ্ট সে অমর মানব ফিরে যায় বাদুড় মায়ের বুকে, স্তন্যপানে মায়া-অবশ সাধনায়। এ অবসরে পুন্নাম মায়া জাগলে নদীটি উজিয়ে আমাদের শঙ্করের পা ভিজিয়ে দেয়। শঙ্কর ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তীর ছেড়ে জলে নামে। এক বাঁও, দু বাঁও... জল আহ্লাদে টেনে নেয় তাকে তার বুকের আদরে। আপাতত শঙ্কর বিন্দুবৎ, বা কয়েকটা বুদবুদ ঘূর্ণি, দূর স্রোতের। পেছনে পড়ে থাকে তার বাতিল ছায়াসমূহ-- যা ভোটার কার্ডের, আধার পত্রের বায়োমেট্রিক কুহকতার।

     এবং কুহক কথাটি মোহময়, তাই এই ক্ষণে নদীটির ওপরে দিগন্তের দরজা আবারও সপাট খুলে যায়। খোলা দিগন্তে ফুটে ওঠে একলা এক ভোরের স্বপ্ন, দুয়োভূমির এক মায়ের—শঙ্করা এলি!

     রাত চিরে জবাকুসুম আলো জাগে। যেমন জেগেছিল গতদিনে। যেমন জাগবে আগামীতেও। 



*****************************************************************************



শতদল মিত্র 

জন্ম: বৈশাখ 1368(ইং-1961)
আদি নিবাস: লাভপুর, বীরভূম। 
বর্তমানে কলকাতা নিবাসী।
পেশা: মুদ্রণ প্রযুক্তিবিদ
সম্পাদক: "কথক"
*প্রকাশিত বই:
কবিতা:
গড়িয়ে দিলাম কথা
লিখি নদীজল
মুনিবান 
পোড়া মৃত্তিকা হারানো জন্ম
রাত্রি লিখি রোদ্রের আখরে 
বিভাব কবিতাগুচ্ছ
গল্প: 
শালগাছ কিংবা অতিলৌকিক আখ্যানগুচ্ছ 
নরেন ভাণ্ডারীর জীবনবৃত্তান্ত 
উপন্যাস
মাটির দুর্গের সেনা 
খননডিহি
জিওলবট কিংবা নিমজীবন কথা


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন