সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

পাঠ প্রতিক্রিয়া * সব্যসাচী মজুমদার



নতুন বাংলা কবিতা

সব্যসাচী মজুমদার


বাংলা কবিতার ইতিবৃত্ত সবসময় নির্ভর করেছে তারুণ্যের ওপর এবং ভঙ্গিমার বদল ঐ তারুণ্যেই হয়,এ কথা বলা অত্যন্ত বাহুল্য হলেও উত্তর দু-হাজার কুড়ি, অর্থনৈতিক বিবর্তনটা যখন খুব দ্রুত ঘটছে,কতটা ঝাঁকুনি দিল বাংলা কবিতাকে,কি নতুন বিণ্যাস পাওয়া যাচ্ছে ---হদিশ পাওয়াটা খুব জরুরি বলে পূর্বোল্লিখিত কথা কটি আরেকবার মনে করা দরকার বৈকি যখন এই আলোচনা চার গুরুত্বপূর্ণ তরুণ কবির কবিতার শরীর পড়তে চলেছে।


             প্রাজ্ঞ,আপনি জানেন বাংলা কবিতায় একটা বহু চর্চিত ও অদরকারি তর্ক আছে, শহরের কবিতা আর মফসসলের কবিতা । কিছু কমন চিহ্নের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে মূলত তর্কটি ঘণীভূত হয়। কিন্তু বলুন তো মণীন্দ্র গুপ্ত বা নারায়ণ মুখোপাধ্যায়কে কিংবা রমেন্দ্র কুমার কোন শ্রেণিতে পড়বেন?কুর্চি পাহাড়ে বুনো কুল খাওয়ার প্রস্তাব তো মফসসল,শহর,সব ভেদ করে আবেদন জানায় আন্তর্জাতিক পাঠষ্ক্রিয়ার কাছে।আসলে কিছু কিছু মানবিক চিহ্ন রয়েছে যা ভূগোল ব্যতিরেকে অবিকল। সেই চিহ্নগুলিকে বাংলা ভাষার অনেকেই আত্মস্থ করেছেন, ইতিমধ্যেই।ফলে এ তর্ক যেমন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়,তেমনি জীবানু যুদ্ধকালীন সময়ে যখন আন্তর্জাতিকতা যখন মানুষের মুঠোয় পৃথিবীর মতন,সতর্ক হয়ে লক্ষ্য করতে হয় বৈকি, বাংলা কবিতার তরুণ প্রজন্ম কোথায় তার নির্ভরতা রাখছে,কাকে করে  তুলছে তার বৈদুর্য?


            যেমন প্রতাপ হালদারের নতুন ব‌ই 'ডোয়া'পড়তে গিয়ে যখন,"রোদ পরে আসে লালকচাগাছের পাতায়।" পঙক্তিটার সামনে দাঁড়াই , মনে পড়ে নব্ব‌ই দশকে ছেয়ে থাকা 'এন্টেনা'শব্দটা ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত।আর কিছু দিন পর গুগল করে জানতে হবে এন্টেনা কী, কিন্তু বৃক্ষ প্রেষণা যে আজ‌ও দৃশ্যের জন্ম দেয়,এই সময়ের তরুণ লেখেন,"মুলিবাঁশের ছায়ায় আহারের ওত"বিস্মিত হয়ে দেখি কী অনায়াসে ক্রিয়াপদ সরিয়ে দিয়ে 'ওত' শব্দটিকে জ্যান্ত করে দিলেন।এই পাঠকের চোখে ভেসে উঠলো গুগাবাবার প্রহরীরূপি নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের দুটো ধকধকে চোখ।

কৃত্তিবাসের থেকে একটু দূরে থাকেন তরুণ কবি প্রতাপ।তাঁর এক ফর্মার সবুজ রঙের পুস্তিকায় যেন লিখেছেন এক অনিঃশেষ জনপদাবলী।না ফুরনো আঁচ আর আহারের কথাবার্তাগুলো,


"হলদে পাখি ডেকে ওঠে পিলালো পিলালো

বীজ করবে বলে থাবাগাঁদা বেঁধে রাখে মা

কেমন উঠোন জুড়ে আলো "(ভিটে)


পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলা রাশিয়ার আক্রমণ, ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা, আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলের দর হ্রাস-বৃদ্ধি,আই পি এল ইত্যাদির মধ্যে ঐ 'থাবাগাঁদা'গুলোই জাদুর মতন ঘটে চলেছে নিশ্চিতভাবে,এমনকি বাংলা কবিতার রন্ধ্রে ঢুকে তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে,


"কাত করা বাড়ির থেকে

উনুনে বাঁশের গিঁট ফাটার আওয়াজ

কানে এলে ভাবি , এইমাত্র বাড়ি এল পলানি

মরে যাওয়া খিদেয় ভাত অল্প লাগে জানি,

এখানে বর্ষা এলে বাঁশপাতা কাঁদে"(বাড়ি)


আহারে বাংলা কবিতা!মুগ্ধ হয়ে থাকি।মরে যাওয়া খিদেটুকুর অনুবাদ নেই সম্পর্ক রয়েছে।


"একটা চালতাফুলের

ঝুঁকে পরা চাউনি দেখে

                        বিব্রত ময়ূর হয়ে পড়ি।"(ময়ূর)

'ঝুঁকে'আর 'বিব্রত'শব্দ দুটির নিপুণ ব্যবহার ঐ বিব্রত হয়ে পড়াটুকুকে পাঠকের শরীরে জীবন্ত করে দেয়।ছবির পর ছবি তৈরি করে গিয়েছেন প্রতাপ।তাঁর যাপনের,তাঁর শরীরের চারপাশে যা কিছু অতি নিশ্চিত ঘটে চলেছে তাদের কিছুটা রঙেই নির্মাণ করতে চেয়েছেন একটি বিকল্প-বাস্তব। অথচ যা অনায়াসেই ভেতর অবধি পৌঁছে যায় গৌড় সারঙের মতো,


"বাজারপাড়ার আলতো ধুলোর কাছে

গুডুরি পোশাকে শুয়ে থাকে চাষের জমি,"(এখানে)

       ঠিক একই প্রতিবেশে জারিত হতে হয় এর পরেই অভিমান্য পাল প্রণীত কাব্য পুস্তিকা 'জানালার মেঘ 'পড়তে গিয়ে। বস্তুত বাংলা কবিতা তার নিজস্ব বিনির্মাণের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বেছে নিয়েছে তার নিজস্ব ভূখণ্ডের স্বভাব।যাকে নির্ভর করে গড়ে গড়ে ওঠে অন্ন -সংহিতা।যে দেশ নিরপেক্ষ আততি মানুষের অপর বাস্তব তৈরি করে,তাকেই শ্রম পৃথিবীর প্রতিনিধি অভিমান্য নির্ভর করে লিখলেন,

"কোথায় লুকিয়ে আছে মেথিডাঙা বাঁধ

তার পারে হিজলের ঝোপ থেকে

অচেনা পাখির ডাক"(সম্পর্ক)


 লক্ষ্য করে দেখুন এই আন্তর্জাতিকতার চৌকাঠে ঢুকে পড়া সভ্যতায় দাঁড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বের তরুণ কিন্তু নির্ভর করছেন সেই সব ধারণাকে,যারা আবহমান ঘটে চলেছে প্রতিক্রিয়াগুলির অন্তরালে।আসলে এ থেকে বোঝা যায় অনায়াসেই যে শিকড়ের অন্তর্গত অনুভব‌ই কিছুটা জীবন্ত রেখেছে বাংলা কবিতার ইতিবৃত্তকে,

"কে যেন সকাল সকাল 

মিথ্যে আয়ু নিয়ে চলে যায় পিয়নের মতো"(পিয়ন)

        সেই বর্ষা হরকারাদের কথা মনে পড়ে যায়, মানুষের নিজস্ব অমল চিহ্ন হয়ে ওঠে কবির। জীবনের নিরপেক্ষ প্রেমের কাছে সত্যবদ্ধ পংক্তি তৈরি হয়,


"পুকুরের জল,কলমির শাক,হাঁস চ‌ই চ‌ই...

হরিতকির ডালে দোল খাচ্ছে

                                 বাতাসের বাহানা "


'বাহানা'শব্দটার ব্যবহার করার পরেই কবি লিখছেন,


"শঙ্খ বাজাও দূরাগত স্বরে...


আহ্বান যেন স্বতোৎসরিত সময়ের রব হয়ে ওঠে। সংক্ষিপ্ত এক পুস্তিকায় কবি যাপন করেন তাঁর নিজের বিনির্মাণ কিংবা অপর -বাস্তব। কিন্তু অনিবার্যভাবে আস্হা রাখেন আত্মনৈর্ব্যেক্তিকতায়,


"ভিতরে আবছায়া ছিল

সবুজ হরিণ বনে,

পৃথিবী ভেসে গেলো নীল কুয়াশায়..."(দূরবীন)


সমিধ গঙ্গোপাধ্যায় প্রণীত 'নিউক্লিয়াসের বিষ 'আবার আরেকটি অর্থের চিত্র নির্মাণ করছে এক‌ই সময়ে দাঁড়িয়ে।যে ক্ষয়িষ্ণুতা নিবিড় হয়ে একটা সঙষ্কৃতি রচনা করছে,সেই বাস্তবের রং মিশিয়ে নেন সমিধ তাঁর কাব্যে।দুই ফর্মার পুস্তিকায় সরাসরি কথা বলতে চেয়েছেন কবি,



"-তোমার জাত?

-জানি না, ইতিহাস পড়তে ভালো লাগে না

-তোমার ধর্ম?

-জন্মান্ধ সাপ ছাড়া সব‌ই সহ্য করতে পারি"(প্রার্থীতালিকা থেকে ৩০৪ নম্বর)


বাংলা এমন একটা ভাষা,তার লিরিক প্রবণতাকে কাটিয়ে প্রতিকবিতার দিকে যাওয়া ভীষণ দুরূহ। মণীন্দ্র গুপ্ত, তারাপদ রায়, সুবোধ সরকার এমত কতিপয় স্বর‌ই হয়ে উঠেছে প্রতিকবিতার বাঙালি প্রতিনিধি। কঠিন খুবই কঠিন সেই নির্মাণের ওপরেই নির্ভর করেছেন সমিধ।


"আমাদের মধ্যে ইবোলার খপ্পরে পড়া একটা নাদুসনুদুস

মহাদেশ ছিল

যার শুতে চাওয়ার যাবতীয় অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো কিভাবে 

শমিত করবো সেই নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠতাম "(এক দশকে মঞ্চ খসে যায়)

কিংবা

"শিল্পের কদরে যে অমাবস্যা থাকে,

তার কাছে হেঁটে গিয়ে দেখার অভ্যাস

তুমি ছাড়তে পারো না "(ধর্না মঞ্চে গ্রেফতার হ‌ওয়া প্রেমিকের স‌ওয়াল)


সমিধের কবিতায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে ফাক, শপিং,স্বপ্নদোষ, ইয়ার্কি,তোতলামি,চচ্চড়ি, বেঞ্চের তলা ইত্যাদি শব্দগুলো।একটা পরিচ্ছন্ন আত্মপীড়ার চিৎকার তৈরি করে।ক্ষ‌ইতে ক্ষ‌ইতে হঠাৎ খুনি হয়ে ওঠার মতো আত্মপীড়া চিৎকার করে বারবার।দেখায় সেইসব ছবি যা দেখার আগেই আমরা চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম,


"যুযুধান আত্মীয়স্বজন প্রাণপণে

সন্ধ্যের দিকে মাঠে ন্যাকড়ার পাশাপাশি শুয়ে থাকে "(অ্যাপোক্যালিপসের হপ্তাখানেক আগে)


বারবার নিজেকে আঘাত করতে করতে কাব্য গুঙিয়ে বলে উঠছে কিমাকার অংশের এবড়োখেবড়ো সব জীবনের চূড়াবিন্দুর কথা,


"লিঙ্গহীন যেসব ইতিহাস

খতিয়ে দ্যাখো সেইসব অর্ধপাচ্য অস্বস্তি ছুটকোছাটকা

সাক্ষীদের সালতারিখে মুড়ে পুরু জিভের নীচে রেখে

দেয়নি তো?"(চাবুক যে কথা জানে)


 ঠিক এই অবস্থান  থেকে কিছুটা সরে

"যুগ থেকে যুগান্তরের ভাত রান্না হয়ে চলে অবিমিশ্র

আবেগের আগুনে।"(আগুন)


লিখছেন শর্বরী চৌধুরী তাঁর 'মখমলের ইস্তেহার 'কাব্য পুস্তিকায়।ক্ষিদে আর কৃষকের আততি একাকার হয়ে একটা তীব্র জৈবিক মানুষের ইঙ্গিত দিয়ে শুরু হলো কাব্য। ঈষৎ নির্জনতায় বলে যান একজন গভীর আয়ুর তত্ত্বগূঢ়তা,

"বার্ধক্যের ঘুম বড় প্রতারক 

আলোগাছ কখন যে ধূলিসাৎ বোঝা দায় 

নির্জনতার কথা আস্তিক্যের কথা ফুরোয় নিমেষে।"(আলোগাছ)


শর্বরী চৌধুরী পৌঁছে গিয়েছেন এমন একটি পিনদ্ধতায় ,যেখান থেকে দেখতে পারছেন সম্পর্করহিত একটি উদাসীন জীবনকে।যে কেবল নৈর্ব্যক্তিকভাবে তার স্মৃতিজাত ধারণার কথা লিখে চলেছে।এর বেশি কোন‌ও সাপেক্ষ তার নেই। কিন্তু কী নির্মম এঁকে দিয়ে যান একটি ক্ষতের চিহ্ন,


"চোখে মুখে অবিরল ক্ষত

হাতের পুতুল পড়ে ঘাসের ওপর।"(ক্ষত)


এই আমাদের সময়ের চূড়াবিন্দুকে দেখে ফেলেন শর্বরী।একটি অপাপবিদ্ধ যাপনবৃত্তান্ত থেকে প্রায় শ্লোক যেন রচে ফেলেন তিনি।পঙক্তিগুলো হয়ে ওঠে এক একটা টীকা,


"প্রকৃত শোকের কাছে মাথা নত করি।

সে আমাকে শেখায় স্তব্ধতা"(উত্তরণ)

কিংবা

"তোমার চোখে বাসা বেঁধেছে মৃত্যুর জোনাকিরা

এক অকপট কলহ বড় প্রয়োজন এখন।"(অকপট)


যে সত্যের কথা আমরা সবাই জানি অথচ শর্বরীই কেবল জানেন,সেই জায়মান বাস্তব ঘিরে থাকে লেখাগুলোর ভেতরে।অস্হিরতার শেষে একটা নির্ভর আসে এই পাঠকের।বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে,


"লেহন করি চতুর্বর্গ আয়োজন

সব তাপ মুছে গিয়ে পুনর্বার জেগে ওঠে খিদে।"(খিদে)


কোন‌ও সতর্ক নির্মাণের কাজ করেননি কবি।নির্মোহ ভাষায় জানিয়ে যাওয়াটাই করে গেছেন, অন্ততঃ যে ভাষা তাঁর অধিত,


"অতিথি পাখির ডানা আহত করে;"(বীজ)


পিনদ্ধ শব্দ ব্যবহার শর্বরী চৌধুরীর স্বভাব। বিনীত বলিষ্ঠতায় বলে গেলেন সমস্ত সম্মোহন। একটি পরিক্রমা শেষে এটুকুই বলতে পারি,এই পাঠকের পাঠকষ্ক্রিয়া এটি একান্তভাবেই।চাই তর্ক হোক।বিরুদ্ধতা আমার পাঠকে পূর্ণ করুক।ব‌ইগুলি আপনার উইশলিস্টে থাকুক।


ডোয়া:প্রতাপ হালদার: একালের কবিকণ্ঠ: প্রচ্ছদ:সুমিত দাস: তিরিশ টাকা

জানলার মেঘ:অভিমান্য পাল:ধানদূর্বা:প্রচ্ছদ: কৌশিক দাস: তিরিশ টাকা

নিউক্লিয়াসের বিষ:সমিধ গঙ্গোপাধ্যায়:সৃ প্রকাশন: প্রচ্ছদ: চিরঞ্জিত সামন্ত: পঁয়ষট্টি টাকা

মখমলের ইস্তেহার:শর্বরী চৌধুরী:পাঠক:ষাট টাকা 


( ক্রমশ )


***************************************************************************



সব্যসাচী মজুমদার

 এ সময়ের অন্যতম শক্তিশালী তরুণ কবি। তাঁর কবিতার শব্দ ব্যবহারের চমৎকারিত্ব, ভাবনার গভীরতা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে তাঁর তিনটি  কাব্যগ্রন্থ : মেঘ আর ভাতের কবিতা , আজন্ম ধানের গন্ধে এবং তৃতীয় পৃথিবী ।


1 টি মন্তব্য:

  1. প্রতিটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া ভীষণ গবেষণামূলক বেশ ভালো লাগলো এই ভাবেই এগিয়ে চলুক বাংলা কবিতা।

    উত্তরমুছুন