প্রাচীন সাধুদের কথা
স্বামী গম্ভীরানন্দ (সংক্ষিপ্ত)
----- স্বামী চেতনানন্দ
১)
কোন মহান ব্যক্তির জীবনী লেখা বড়ই কঠিন। এসব মহান ব্যক্তি নিজের বিষয়ে কিছুই লেখেন না, বা বলতেও চান না। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা জিজ্ঞাসা করলে অধিকাংশ সময় মৌন থাকেন বা অন্য প্রসঙ্গ তুলে এড়িয়ে যান। অথচ এঁদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইতিহাস, এবং আধ্যাত্মজীবনের বহু গূঢ় রহস্য।
পূজনীয় গম্ভীরানন্দজী মহারাজের সঙ্গে আমার ত্রিশ বছরের পরিচয় এবং সাত বছর তাঁর সঙ্গে থেকেছি। আমি অদ্বৈত আশ্রম, ওয়েলিংটন লেনে প্রুফ-রিডার হিসেবে আসি ১৯৫৮সালের ১ ডিসেম্বর। তখন গম্ভীর মহারাজ অদ্বৈত আশ্রমের প্রেসিডেন্ট। আমি বই-এর প্রুফ দেখার কাজ করি। একদিন তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলেন, 'সাধু হতে গেলে ঝাঁপ দিতে হয়। Calculation করে সাধু হওয়া যায় না।' তিনি কর্মে ও ব্যবহারে খুবই গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। তবে আমার সঙ্গে খুবই স্নেহপূর্ণ এবং খোলাখুলি ব্যবহার করতেন। আমি তাঁকে মনে-প্রাণে শ্রদ্ধা করতাম এবং তাঁর অপূর্ব জীবন অনুসরণ করতে চেষ্টা করতাম।
ওয়েলিংটন লেনের বাড়ির চার তলায় তাঁর একটি ছোট ঘর ছিল; তার একপাশে সরিষার স্বামী নির্মোহানন্দজীর একখানা ছোট খাট ছিল। তিনি সপ্তাহে তিন দিন কলকাতায় থাকতেন। ক্যনভাসের একটা ইজিচেয়ারে জানালা পিছন করে বসে গম্ভীরানন্দজী লেখাপড়ার কাজ করতেন। আমি কখনও তাঁকে ছাদে গিয়ে পায়চারি করতে দেখিনি -পাছে প্রতিবেশীদের বাড়িতে নজর যায়। অপূর্ব সংযত জীবন! অদ্বৈত আশ্রমে তাঁর routine এরকম ছিল : সকাল ৪:৩০ উঠে ৫টায় জপ-ধ্যান করতেন। তারপর, ৬টায় চিঠিপত্রের উত্তর সেরে সকালের ক্লাসের জন্য শাস্ত্র পড়তেন। ৬:৩০টায় breakfast সেরে ৭টায় সাধু-ব্রহ্মচারীদের ক্লাস নিতেন। তাঁর কাছে আমি পাঁচ বছর গীতা, কেন-উপনিষদ, ছান্দোগ্য-উপনিষদ ও ব্রহ্মসূত্র পড়েছি। আধ-ঘন্টা ক্লাস। তারপর তিনি তাঁর কাজ শুরু করতেন। চোখ ভাল ছিল না। ঘন্টাখানেক কাজ করে চোখকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্য করিডোরে পায়চারি করতেন বা অফিসে নেমে ঘুরতেন। আবার কাজ করতেন প্রায় ১১টা পর্যন্ত। তারপর স্নান করে জপ করতেন এবং ১২টায় খাওয়ার পর একটু খবরের কাগজ দেখে শুয়ে পড়তেন। দুটো থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ এবং তার মধ্যে চারটায় এক কাপ চা খাওয়া। ৫টা থেকে ৬টা বেড়াতে যেতেন। তাঁর গতিবিধির সঙ্গে ঘড়ির সময় মেলানো যেত। রাত ৯টা পর্যন্ত জপ-ধ্যান। চোখের জন্য রাতে কাজ একদম বন্ধ ছিল। খাবার পর ৯:৩০টায় ক্লাস। অদ্বৈত আশ্রমে নিয়ম ছিল নতুন ব্রহ্মচারীকে পাঠক হতে হতো এবং যে বই নতুন বেরিয়েছে তা ১৫ মিনিট পাঠ করতে হতো। সবাই বসে শুনতেন। পাঠের সময় আমার যদি কোন উচ্চারণ ভুল হতো, গম্ভীর মহারাজ বলতেন, 'ওহে, ঐ শব্দটা একবার দেখ তো -Oxford Dictionary কী বলে।' ক্লাসের আগে আমি পড়ে যেতাম যাতে সবার সামনে না লজ্জায় পড়তে হয়।
২ )
আমাদের একজন ব্রহ্মচারী তখন অদ্বৈত আশ্রমের ভাণ্ডারি। সে দক্ষিণ ভারতীয় এক বহ্মচারীকে মজা করে ডিম দিয়ে ফ্রেঞ্চ-টোষ্ট খাইয়ে দিল। অথচ ঐ ব্রহ্মচারী কঠোর নিরামিষাশী। সে বুঝতে পারেনি। যখন সে জানতে পারল, সে অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং গম্ভীর মহারাজকে জানাল। মহারাজ তখন ভাণ্ডারি ব্রহ্মচারীকে ডেকে বললেন, 'এই প্রথম এবং শেষ। এরপর যদি তুমি এরূপ ব্যবহার কর, তোমাকে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বিদায় নিতে হবে। ঠাকুর কারো ভাব নষ্ট করতেন না, জেনে রেখো।' তিনি রেগে গেলে যে কী কঠোর হতে পারতেন -বলবার নয়। আরেকদিন সন্ধ্যায় এক ব্রহ্মচারী ও এক সাধু ক্যারাম খেলছিল। তিনি নিচ থেকে সোজা ওপরে উঠে এসে বললেন, 'এখন সন্ধ্যাবেলা। জপ-ধ্যান করতে যাও।' এমন দৃপ্তকন্ঠে বললেন যে, সবাই ভয় পেয়ে গেল। তার পরদিনই ক্যারাম বোর্ড চলে গেল সরিষা আশ্রমের ছেলেদের জন্য। আরেকদিন কয়েকজন সাধু মিলে একটা বিশেষ সিনেমা দেখতে যান। গম্ভীর মহারাজ ও আমি মাত্র আশ্রমে। রাতে খাওয়ার পর আমাকে বললেন, 'ওহে, তুমি যে গেলে না?' তারপর বললেন, 'দেখ, সাধুজীবনে ওসব দেখে বেড়ানো ভাল নয়। বহির্মুখী বৃত্তি এসে পড়ে।'
অদ্বৈত আশ্রমের প্রেসিডেন্টকে গরমের ছয়মাস মায়াবতী এবং শীতের ছয়মাস কলকাতায় থাকতে হয়। আমি একবার মায়াবতীতে গম্ভীর মহারাজের কাছে কাজের ব্যাপারে চিঠি দিই। তিনি ১৫/৫/১৯৬১ তারিখে উত্তরে লেখেন, 'দেখ, ছোটবেলায় 'পারিব না' বলে একটা কবিতা পড়েছিলাম, তা-ই তোমাকে লিখছি। এটাই তোমার চিঠির উত্তর :
পারিব না ও-কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব বার বার।
দশজনে পারে যাহা তুমিও পারিবে তাহা
পার কি না-পার কর যতন আবার,
পারিব না বলে মুখ করিও না ভার।
চিঠিখানা ছিল সংক্ষিপ্ত। কিন্তু চিরদিনের জন্য তা মনে গেঁথে গিয়েছে।
মায়াবতীতে তাঁর সঙ্গে থাকা আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কলকাতায় তাঁকে ঠাকুর-স্বামীজীর ও বেদান্তের গ্রন্থ প্রকাশনের ব্যাপারে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি। একবার পড়ে বা Edit না করে বই প্রেসে ছাপতে পাঠাতেন না। বই শেষ হয়ে আসছে, তা আগে থেকে তাঁকে জানাতে হতো। এর মধ্যে তিনি নিজের লেখা চালিয়ে যেতেন। ব্রহ্মসূত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করতে তাঁর পাঁচ বছর লেগে গিয়েছিল। তারপর নিজেই একটা portable typewriter-এর সাহায্যে টাইপ করতে শুরু করেন। ম্যানেজার মহারাজ একজন পেশাদার typist লাগিয়ে ঐ কাজ থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেন। স্বামীজীর জন্মশতবার্ষিকীর সময় মন্মথ ভট্টাচার্যকে লেখা স্বামীজীর একটা নতুন চিঠি পাওয়া যায়। তিনি সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে আমার মারফত মঠে স্বামী মাধবানন্দজীকে দেখাতে পাঠান। তিনি সেটা পেয়ে বলেন, 'গম্ভীরানন্দ অনুবাদ করেছে, আমাকে কেন আবার দেখতে হবে?' যাহোক, স্বামী মাধবানন্দজী সেটা দেখে গম্ভীর মহারাজকে ফেরত পাঠান। স্বামীজীর Complete Works-এ যাতে কোন ভুল না থাকে তার জন্য প্রাণ দিয়ে খাটতেন। মেরি লুইস বার্কের New Discoveries থেকে যেভাবে চয়ন করে স্বামীজীর Complete Works-এ তথ্য সংযোজন করেছেন সেটা তাঁর দারুন বিচক্ষণতার পরিচয়।
( আগামী সংখ্যায় )


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন