শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

লেখা আহ্বান

 



স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর

স্বরবর্ণ * ১৮ 

########################################

সংখ্যাটির জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ১৫ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত। কী ধরণের লেখা, লেখা পাঠানোর ঠিকানা এবং অন্যান্য জরুরি তথ্য পাওয়া যাবে উপরের লিংকে।পত্রিকার নিয়ম বহিৰ্ভূত কোনো লেখা গ্রহণ করা হবে না।মনোনয়ন সাপেক্ষে নির্বাচিত লেখক তালিকা ১৬ মার্চ সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। পত্রিকা প্রকাশিত হবে ১৫ এপ্রিল। 

########################################


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন -----

১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫মার্চ ০২৪ এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

তোমায় খুঁজে ফিরি * প্রব্রাজিকা বিশ্বপ্রাণা_




সাধুসঙ্গে পুণ‍্যকথা

(শ্রীমৎ স্বামী বিশুদ্ধানন্দজী মহারাজের পুণ‍্যস্মৃতি)

প্রব্রাজিকা বিশ্বপ্রাণা


কাশীতে অন‍্যান‍্য দিনের কথা

অক্টোবর, ১৯৫৭

(১)

     মহারাজ -  সাধুর রাগ জলের দাগ। সবই ওপরে, তাঁদের ভেতরে কিছু থাকে না। একবার এই কাশীতেই চারুবাবুকে মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) কি একটা কারণে কী ভয়ানক বকলেন! Constant বকুনি, একেবারে যাচ্ছেতাই ভাবে। কিছুতেই আর থামেনই না। তখন মহারাজের সেই মূর্তির সামনে তো কিছু বলা চলে না! কয়েকদিন পরে মহারাজের mood যখন ভাল ছিল তখন তাঁকে বললাম, -'মহারাজ, সেদিন যেমন চারুবাবুকে বকলেন, আমি কোনদিন ঐরকম দোষ করলে আমাকেও তো ঐরকমই বকবেন? আর আপনাদের ঐ বকুনি তো আমাদের কাছে অভিশাপস্বরূপ, মহা অকল‍্যাণ তাতে। কি উপায় তাহলে আমাদের? মহারাজ তখনই জিব দেখিয়ে আর বুকে হাত দিয়ে মাথা নেড়ে আমাকে এই বুঝিয়ে দিলেন, -'আমরা যা বকাবকি করি তা শুধু আমাদের মুখেরই, অন্তর থেকে করি না। তাতে কোন ভয় নেই, কোনও অকল‍্যাণ হবে না।'

     ‎ ছেলেবেলায় মহারাজের কাছে যখন থাকতাম, তখন দেখ কী সুন্দর ভাবটা আমার ছিল -সামান‍্য গামছাখানাও যে মহারাজ নিজে-হাতে টেনে নেবেন তাও আমার ভাল লাগত না। আমার তখন মনে হত -আমি তো কাছে রয়েছি, তবে কেন উনি নিজেই নেবেন গামছাখানা! ওঁর কখন কি দরকার হবে এই ভেবে ওঁকে ছেড়ে আমি একদন্ডও থাকতাম না, জপ-ধ‍্যানও করতাম না। মহারাজ জিজ্ঞেস করতেন, -'ধ‍্যানজপ করনা?' আমি বলতাম, -'না মহারাজ, ভাল লাগে না।' তার মানে আপনাকে ছেড়ে যেতে ভাল লাগে না -এই আর কি। মহারাজ তবু জোর করে জপ-ধ‍্যান করতে পাঠাতেন। ধ‍্যান করবার জন্য ভোরবেলা নিজেই উঠিয়ে দিতেন।


(২)

     মহারাজ - একদিন আমি পুরোনো ঠাকুর-মন্দিরে বসে জপ করছি। এদিকে মহারাজের কাছে গেঁয়োখালির দেবেন ধাড়া নামে একজন ভক্তের ছেলে এসেছে। ওদের অনেক জমিজমা। মঠে প্রচুর ধান দিয়ে সাহায্য করত। ছেলেটি এসে ধরেছে -'মহারাজকে ওদের দেশে নিয়ে যাবে। তখন মহারাজ ওকে শিখিয়ে দিলেন -দেখ, ওপরে মন্দিরে বসে একটি সাধু জপ করছে, নিচে নামলেই তার পায়ের তলায় সাষ্টাঙ্গ হয়ে পড়বি আর বলবি, -'মহারাজ, দয়া করে আমাদের বাড়িতে আপনার পায়ের ধুলো দিতে হবে।'

     ‎ আমি নিচে নামতেই তো ছেলেটি সাষ্টাঙ্গ হয়ে আমার পা জাপটে ধরেছে। কিছুতেই ছাড়বে না। মহারাজও তাকে support করছেন। আমি তখন মাছ খেতাম। মহারাজ বলছেন, -'জান, ওদের দেশে খুব ভাল কইমাছ পাওয়া যায়। এত করে ধরেছে যখন, যাও না ওর সঙ্গে।' আমি তখন বললাম, -'মহারাজ, আপনি যদি আদেশ করেন, তাহলেই যাব।' তারপর ওদের বাড়িতে কিছুদিন থেকে আমি ফিরে এসেছি। 

    গেঁয়োখালি যাওয়ার আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমি দক্ষিণ দেশীয় এক ভক্তকে একদিন দক্ষিণেশ্বর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি রামলালদাদার নাম শুনে রামলালদাদাকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। আমি তাতে বলেছিলাম, -'ভালই তো, আপনার দেওয়ার ইচ্ছা হয়েছে দিন।' এইকথা পরে মহারাজ শোনেন -আর শুনেই ওঁর ধারণা হল যে, আমিই রামলালদাদাকে টাকাটা পাইয়ে দিয়েছি। শুনে তো আমার ওপর উনি খুব রেগে গেলেন। ঠাকুরের সংসারে যাতে ভদ্রলোক টাকাকড়ি দেন, আমি সে চেষ্টা না করে রামলাল দাদাকে টাকাটা পাইয়ে দিলাম -এইজন‍্য রাগ। যাই হোক আমি তো গেঁয়োখালি থেকে ফিরেছি। ফিরে মহারাজকে গিয়ে প্রণাম করলাম। মহারাজ খুব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। আমার সঙ্গে কোন কথাই বললেন না। শুধু বললেন, -'যাঁর নুন খাই, তাঁর গান গাই।' আমি আর তখন কি করি! শরৎ মহারাজ ছিলেন, তাঁর কাছে গেলাম। শরৎ মহারাজ বললেন, -'যাও মহারাজের জন্য একটু প্রসাদ নিয়ে তাঁর কাছে যাও।' আমি তাই করলাম।


(৩)

কাশীতে মহারাজের মুখে রাঁচির কথা:

     মহারাজ -  কুচবিহারের রানি, কেশব সেনের মেয়ে সুনীতি যখন রাঁচিতে ছিল তখন প্রায়ই আমার কাছে আসত। আমাকে ভালবাসত খুব। একদিন বললেন, -'তোমাকে আমাদের বাড়ি যেতে হবে।' আমি তো মহাবিপদে পড়লাম। একে বড়লোকের বাড়ি, তার ওপর আমি ওখানে গেলেই তো আমাকে ধরে ওর বিলেতের গল্প শোনাতে আরম্ভ করবে। আমি বললাম, -'আপনার বাড়িতে যাওয়ার আর কি দরকার! আপনি এখানে আসেন, দেখা হয়, এই তো বেশ।' কিছুতেই ছাড়বে না। অগত‍্যা একদিন যেতে হল। কিন্তু আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, কিছুতেই ওকে বিলেতের গল্প শোনাতে দেব না। সঙ্গে একখানা কথামৃত নিয়ে গেলাম। তারপর ঘরের মধ্যে বসে যেই বিলেতের গল্প আরম্ভ করেছে, আমি অমনি একটু পরে বললাম, -'দেখুন আমি একটা বই নিয়ে এসেছি, এর মধ্যে আপনার বাবার অনেক প্রসঙ্গ আছে। একটু পড়ে শোনাব কি?' তখন আর আপত্তি করে কি করে! বললে, -'হ‍্যাঁ, তা বেশ তো, শোনাও না।' তারপর আমি ঝাড়া চল্লিশ মিনিট ধরে কথামৃত পড়লাম। কেশব সেন যে স্টিমার-পার্টিতে ঠাকুরকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ঘটনা পড়লাম। সেখানে এক জায়গায় আছে, কেশব সেন ঠাকুরকে প্রনাম করে বিদায় নিচ্ছেন। এইটুকু শুনেই সুনীতি বলে উঠল, -'আচ্ছা, এই বই যিনি লিখেছেন তিনি কি বেঁচে আছেন? তাঁর ঠিকানা কি? আমি তো বাবাকে কোনদিন রামকৃষ্ণদেবকে প্রণাম করতে দেখিনি!' আমার কাছে কথামৃতের অন‍্যত্র এর প্রমাণ ছিল। কিন্তু তখন মনে এলনা বলে আর বলতে পারিনি, মষ্টারমশায়ের ঠিকানা দিলাম। পরে কলকাতায় গিয়ে প্রথমেই একেবারে মাষ্টারমশায়ের কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, -'সুনীতি দেবীর কি উত্তর দিয়েছেন?' মষ্টারমশাই বললেন, -'এ তো খুব সোজা। আমি লিখলাম: তুমি দেখনি বলে তো আর এটা মিথ‍্যে নয়।! আমি নিজের চোখে কতবার দেখেছি। আর শুধু আমি কেন, আরও কত লোক দেখেছে।'













********************************************************

পাঠ প্রতিক্রিয়া * দেবাশিস সাহা


 


অক্ষরের ভাস্কর্যলিপি 

দেবাশিস সাহা 


১ .



 'এত কবি কেন' একটি সাক্ষাৎকারে, বহুল প্রচলিত একটি দৈনিকে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন। কবিদের সংখ্যাধিক্য তাঁকে বিচলিত করেছিল। সাক্ষাৎকারে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, কোনও তরুণ কবি কবিতা শোনাতে এলে, তিনি তাঁকে শেক্সপিয়ারের সনেট অনুবাদ করে শোনানোর পরামর্শ দেন। কবিতা লিখতে এসে ছন্দ শেখা কতটা জরুরী কিংবা শেক্সপিয়ারের সনেটই বা অনুবাদ করতে হবে কি না, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, কবিতা লিখতে এসে কবিকে অবশ্যই কবিতাচর্চার হোমওয়ার্কটি সেরে আসতে হয়। যথেষ্ট চর্চা বা অনুশীলন ছাড়া শুধু ভাব বা আবেগের বশে কিছু লিখলেই, তা আর যা-ই হোক কবিতা হয় না, তা, তাকে আমরা যতই আধুনিক বা উত্তরাধুনিক যে নামেই অভিহিত করি না কেন।

আশিস মাইতির 'চম্পক নগরে, ত্রাস' কবিতার বইটি পড়ে প্রথমেই এই কথাগুলি মনে হল। ছন্দের পরিশীলিত প্রয়োগ, নতুন নতুন চিত্রকল্প অনুপ্রাস উপমা অলংকারের সার্থক ব্যবহারে, সর্বোপরি অতীত ঐতিহ্যের অনুসরণ...বেদ -পুরাণ থেকে আহৃত শব্দের উত্তরণ ঘটিয়েছেন কবি বহুমাত্রিকতায়, যা দীর্ঘদিনের চর্চা ও অনুশীলনের ফসল, মনে না করার কোনো কারণ নেই, নিঃসন্দেহে বলা যায়।

একটি শব্দ আপাতভাবে জড়, নিরীহ। শক্তিশালী কবির হাতে শব্দের সেই জড়ত্বের মুক্তি ঘটে। শব্দ- ছন্দ- অর্থ পরম্পরায় আমরা অভিভূত হই, কবিতা পাঠের অপার্থিব আনন্দে। কবি আশিস মাইতিতে-ও যা অলক্ষ নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তাঁর তিনটি কবিতার কিয়দংশ উদ্ধৃত করে বিষয়টি পরিস্ফুট করা যাক ----

'বসন্তে আজ ভিজতে হবে, বৃষ্টি পড়ে বক্ষ -মাঝে!
সোপান শেষে আকাশ দেখা, উড়ন্ত সে ঊর্মিমালা--
চূর্ণ হয় পুলিন তটে, বৃষ্টি পড়ে সকাল-সাঁঝে।
সে অরণ্যের বসত জমি, তপ্ত হৃদে তীব্র জ্বালা!

কুশিক মুনি--- একতারা সুর, ফুল্ল নারী মৌন লাজে। বসন্তে আজ ভিজতে হবে, বৃষ্টি পড়ে বক্ষ -মাঝে।'

                                (বসন্তে আজ ভিজতে হবে ) 

কিংবা যখন পড়ি----

'আল্লাহরাখা আলাপে ক্রুন্দসী কাঁদে, হায়!
পুড়ে যায়, আবারো পুড়ে যায়, পুড়ে যায়---
আউল আকুল বাউলের তরী!'

                                             (বর্ষা এলেও)
অথবা

'রামের-ও আগের সে যুগের মতো হায় 
হাম্বীর জাগে সাদা সূর্যাস্ত অন্তিমে 
অন্তহীন বিন্দু ঝরোখার অনন্ত গরিমায়'

                                                    (স্রোত)

প্রিয় পাঠক, এই তিনটি কবিতায় ব্যবহৃত পুলিন, কুশিক মুনি, হাম্বীর ( 'আমি হাম্বীর আমি ছায়ানট' -- কাজী নজরুলের বিদ্রোহী মনে রেখেও ) ইত্যাদি শব্দের নির্মোক ছিঁড়ে যখন আমরা কবিতাটির অন্তরাত্মায় প্রবেশ করি, তখন আমরা কবি শেলির মতো উদ্বেলিত হয়ে বলতেই পারি, ' I have drunken deep of joy , And i will no other wine tonight.'
অবশ্য, এজন্য কবিতা তিনটির সম্পূর্ণ পাঠ আবশ্যক।

আবার, 'চম্পক নগরে, ত্রাস' কবিতায় কবি যখন লিখছেন 'অমৃত অক্ষর লিপি মৌন -পরিচয়,/
দিনে দিনে গর্ভে বাড়ে কবির সঞ্চয়!' তখন আমরা নিশ্চিত হতে পারি 'অক্ষর লিপি' যে 'অমৃত'স্বরূপ তা কবির অজানা নয়। তাই তাঁর বোধের জগত ঋদ্ধতায় ভরে ওঠে দিনে দিনে। কাব্য দেবীকে অক্ষরের অর্ঘ্য নিবেদনের প্রাণের প্রতীতি জাগে কবিমনে। তিনি যাঞ্জিক। আয়োজন সম্পূর্ণ। মৃদঙ্গের তালে ছন্দ বাজছে, কাব্যের অধরা 'মাধুরীর মায়া কেঁপে কেঁপে / আবেশ ছড়ায় যাঞ্জিক জনে সন্ধ্যার শীতল ছায়ায়।' কবি জানেন 'বিষাদ বাহিত আত্মার /সে দেবী, বিচ্ছেদ মৃত্যুর ব্যবধান শেষে /অমেয় অভ্যুদয় আনে অক্ষরে অক্ষরে।' তবু অধরা কাব্য মাধুরীর মায়ায় অতৃপ্ত কবি। তাই বিষাদ অনিবার্য ছায়া ফেলে 'যে বেদীতে এ অক্ষরের ভাস্কর্যবিলাস,/ অবিনশ্বর কিনা সন্দেহ তাতে অনুক্ষণ।'
                                            (প্রাণের প্রতীতি )

যে কোনো সৃষ্টিশীল প্রাণে এমন প্রশ্ন জাগা  অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এই নশ্বর- অবিনশ্বরতার প্রশ্নে আমরা স্মরণ করতে পারি কবি শম্ভু রক্ষিতের একটি উক্তিঃ আমরা সকলেই পরীক্ষা দিতে বসেছি, খাতা জমা রেখে যেতে হবে, মহাকাল কাকে কত নম্বর দেবে তার ওপরেই নির্ভর করছে কবি ও কবিতার ভবিষ্যত, খাতা জমা দিয়ে চলে যাবো, চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পর খাতাগুলো দেখা হবে, যদি কিছু সারবস্তু থাকে, পাশ করবেন, নাহলে গোল্লা!!"

অতএব, আমাদের কাব্যাকাশে 'অক্ষরে অক্ষরে কবির প্রবুদ্ধ অনুরাগ' ছড়িয়ে পড়বে, প্রত্যাশায় রইলাম। কারণ প্রকৃতার্থেই তিনি অক্ষরের ভাস্কর্যলিপিকর। 

পরিশেষে আর একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, বইটির প্রচ্ছদ ও বাঁধাই সুন্দর। তবে প্রুফ সংশোধনে আরো যত্নবান হলে ভালো হত। কবিতার বইয়ে বানান ভুল যথেষ্ট পীড়াদায়ক।


চম্পক নগরে, ত্রাস
আশিস মাইতি
প্রকাশকঃ বান্ধবনগর
প্রচ্ছদঃ সুষমা মাইতি























২ .


কবি দেবাশিস সরখেল -এর 'ঝুমুর গান হে' কবিতাগ্রন্থে রাঢ় অঞ্চলের মানুষের কঠিন কঠোর জীবন প্রবাহ, তাদের কৃষ্টি- সংস্কৃতি, আহার -বিহার, ভাব -ভালোবাসা, তাদের ক্ষোভ- সংক্ষোভ, সর্বোপরি জন্মভূমি গানভূম মানভূম -এর প্রতি অগাধ ভালোবাসার কথা আশ্চর্য বাণীরূপ লাভ করেছে। এই অঞ্চলের আকাশে বাতাসে ঢেউ খেলে ছৌ, ভাদু, ঝুমুরের সুর। ঋতুতে ঋতুতে অপরূপ সেজে ওঠে প্রকৃতি। শিমুল, পলাশ, পণশেটিয়া, পুটুস, শিরীষ, মহুয়া, ঘেঁটুবন, আকন্দের মোহময় ছায়া বিছানো প্রান্তর যেমন একদিকে আকর্ষণ করে মনকে, তেমনই 'বন করলা, বন কুঁদুরী ঝুলে' থাকে, থাকে 'ঘুগিতে চ্যাঙ, মাগুর তুড় / বৃক্ষের অমৃতপোশাকে ব্যাকরণহীন শ্রাবণ।' আর, এসব কিছু মিলে কবি উপলব্ধি করেন 'সুনির্মল ফিরোজা বাতাসে গাছেদের খুশি জাগে খুব।'

'ঝুমুর গান হে' কবিতার বইটির কবিতাগুলিকে কবি দুটি পর্বে সাজিয়েছেন। প্রথম পর্বে রয়েছে ৯৫ টি কবিতা। এই পর্বের প্রত্যেকটি কবিতার একটি  শিরোনাম রয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে 'ভাঙাচোরা হিরণ্য পাথর' নামে আলাদা একটি শিরোনাম। এখানে, কবির টুকরো টুকরো অনুভবমালা হীরক দ্যুতির মতো ঝলসে উঠেছে। উদাহরণে পরে আসছি। আগে ফিরি প্রথম পর্বের আলোচনায়।

প্রথম পর্বের অনেকগুলি কবিতা, যেমন রবীন্দ্রনাথ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ঠাকুর সাহেব, মন্ডলবাবু, শ্যামল সুন্দর, বরুণ বিশ্বাস, প্রফুল্ল, ছবিয়াল অমিয়কুমার, চরণদাস---ইত্যাদি কবিতাগুলিতে ব্যক্তি শিরোনামের আড়ালে কবিমনন স্পর্শ করতে চেয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মানুষটির অন্তর্নিহিত চরিত্রমাধুর্য এবং তা থেকে কবিতার অপার্থিব উত্তরণ।
'আমার চোখের জল যখন চোখে আটকে থাকে, গড়াতে চায় না কিছুতেই 
তখন তোমার গান শুনি ' 
'রবীন্দ্রনাথ' কবিতায় এভাবে রবিছায়ায় আশ্রয় খুঁজেছেন কবি। সামাজিক গাঢ় তমিস্রার ভেতর কবি দেখতে পান, রবীন্দ্র 'গানের ভেতর জেগে উঠে হিরণ্ময় আলো।' যে-আলোয় জীবনের 'শূন্য ঘট পূর্ণ হতে থাকে।' এবং কবি এক নিবিড় উপলব্ধির চরম সীমায় পৌঁছন 'সুবর্ণরেখার ভেতর আমি এক কণা বালি'। (শুভ রবীন্দ্রনাথ -- পৃ-১৩)

'সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়' কবিতায় কবি সুনীলের 'কেউ কথা রাখেনি' কবিতার আলোকে ঘাত-প্রতিঘাতময় নিজের জীবনের সমগ্র তোলপাড়টুকু ঘুরেফিরে দেখতে চেয়েছেন।
শৈশবে 'সুবর্ণকঙ্কণ-পরা ফর্সা রমণীদের দেখিনি তেমন' তা না দেখলেও, কবির 'কৈশোর মাখামাখি হয়ে আছে অর্চনায় করবীফুলে। / আমের মুকুলে জাম ডালে' দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কবি যেমন লিখছেন, তেমনই আবার, এই কবিতাতেই দেখতে পাচ্ছি,  বামপন্থায় বিশ্বাসী কবির রাজনৈতিক বিশ্বাসে চিড় ধরেছে 'আমাদের ধর্মের কল নড়ে গ্যাছে বামপন্থায়, বেভুল বাতাসে।' কিংবা, যখন তিনি লিখছেন 'বাংলার মাটিতে বিভেদের বীজে বামপন্থায় / মিলেমিশে ধীরে ধীরে গজিয়েছে চারা।' তখন এই ধারণা স্পষ্ট হয়। অথচ কত দিন গেছে আদর্শের জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য 'ক্ষিদের জ্বালায় বিড়ি টেনে ক্ষিদেটি পোড়ানো' কবি ভোলেননি সে কথাও।

এই পর্বেই আর এক ধরনের কবিতা রয়েছে, যে কবিতাগুলিতে রাষ্ট্রীয় শোষণ যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ-সহ কবির তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে।

'সবুজ সাইকেলে আমরা রোজ ফিরি/ দু'টাকা কেজি চাল এবং সব শ্রী, /আমরা ভিখিরী, বাঙালী ভিখিরী।'
'ক্লাবে তো টাকা উড়ে / উড়ছে সাইকেল / এই তো সেই খেল / খেলা যে মাদারীর' কবি জানেন 'এ বড় রঙ্গ ভোটরঙ্গ'। (বাঙালী ভিখিরী--পৃ-২০) বাস্তবিক, 'চাদ্দিকে শুধু হাহাকার / ছায়াপ্রেত, ধড় মুণ্ডহীন কীচক, প্রত্যহ লাফায়' (কীচক--- পৃ-২৩) অথচ, এসবের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই, বিদ্রোহ নেই। কবির ভাষায় 'আমি, তুমি আমরা সবাই / প্রভুর চরণদাস'(চরণদাস --পৃ-২৪) কারণ, তাঁর মতে, তারা শাসকের ছুঁড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্টে সন্তুষ্ট।

'বাঁকানো চাঁদের সাদা ফালিটি 
তুমি বুঝি খুব ভালবাসতে 
চাঁদের শতক আজ নহে তো 
এযুগের চাঁদ হলো কাস্তে' একদা কবি দিনেশ দাস লিখেছিলেন। এই অবিস্মরণীয় পঙক্তিগুলি মনে পড়ে যায়, যখন 'বাঙালী ভিখিরী' কবিতায় কবি বলেন, 'চাঁদের 'ফালিটি এবং হাতুড়ি /ভালো তো বাসতিস /তুই কি আসছিস ?' বর্তমান শাসকদলের বিভীষিকাময় শাসন ও শোষণের হাত থেকে পরিত্রাণের আশার আলো দেখছেন কবি।


জীবনে চলার পথে পথের খোঁজে কত না পথে যে পা পড়ে! কত সত্য-মিথ্যার মুখোমুখি হতে হয়। জন্ম নেয় নতুন বোধ। নতুন উপলব্ধি। 'কোনো কবিতা এমন চোখে জল আসে / সে কবির সমস্ত কবিতা গান বেজে উঠে, আমার আকাশে অহরহ।' মোহিনী গাঙ্গুলীর জলদগম্ভীর স্বরে কবির এমনটাই মনে হয়।
কবি ভুলতে পারেন না 'ছবিয়াল অমিয়কুমার'কেও। কারণ, তিনি 'সাত সমুদ্রের অন্তরমহলে যে জীবন, তাকে এনেছেন ছেনে / এনেছেন অমিয়প্রবাহ।'
'এই অনির্বাণ জেগে জেগে নিজেকে জাগানো' তিনিই পারেন 'মানভূমে সুনিবিড় ছবিয়াল অমিয়কুমার।'
(ছবিয়াল অমিকুমার-- পৃ-১৭) তেমনই, এক বিরাট বিস্ময়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করান কবি আমাদের এমন উচ্চারণে 'উড়ে যেতে যেতে / কতদূর উড়বে সে নিজেই জানে না' (চঙ--- পৃ-১৮)।

কিছু কবিতার দর্শনসঞ্জাত উচ্চারণ আমাদের মুগ্ধ করে। 'অনাদিকালের এই সৌধখানি প্রসন্নতা মেখে থাকে রোজ' (প্রফুল্ল --- পৃ-১৬) । এই কবিতাতেই প্রফুল্লর জন্য কিছু করতে না পারার আক্ষেপ শোনা যায় কবির গলায় 'তোমার জন্য কিছু করা হয়নি আমার / যেন বলি, ক্ষমো, ক্ষমো হে আমায়।' আবার 'ঝুমুর গান হে' গ্রন্থের নামে নামকবিতার একটি অবিস্মরণীয় পঙক্তি 'আমিই মৃদঙ্গভাঙা নদী, চৈত্রে শ্রীখোল।'


দ্বিতীয় পর্বে, অর্থাৎ 'ভাঙাচোরা হিরণ্য পাথর' পর্যায়ের কবিতাগুলি শিরোনামহীন, আগেই উল্লেখ করেছি। টুকরো টুকরো অনুভবমালা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ পেয়েছে (দু-একটি ছাড়া) যার অধিকাংশ অমৃতস্বাদ বহন করে। ৮০থেকে ৯৬ পৃষ্ঠার মধ্যে রয়েছে এই স্বর্ণউচ্চারণগুলি। দু-একটি নমুনা ---

১) 
আমার এই বাঁচা এই মরা 
করিম খাঁ সাহেবের তবলা লহরা

২) 
যে অমৃত তোমাকে বাড়াতে চাই আমি 
তাই পরিণত হয় বিষে 
তোমায় সন্তুষ্ট করি কীসে?

৩) 
একা হতে হতে তুমি অনেক হয়ে যাও 
যৌবনের তুমি, কৈশোরের তুমি, প্রৌঢ় তুমি
ঘরময় আত্মীয় 
কে কাকে আলিঙ্গন করবে ভেবে পায় না।

৪) 
একজন আছে 
সে বড় দূরে থাকে,
ডিহাং নদীর বাঁকে 
চলো মন নিজ নিকেতনে যাই 
নিজেকে হারাই

৫)
যে ক্ষেতে বর্ষণ হলে মাটি মহারসে ঘামে 
সে ক্ষেতে কর্ষণ হলে ফসলের সফলতা নেই 
তোমার বাড়ি তো ক্ষেতের পাশে নিবিড় নির্জনে জেনেছি, বুঝেছি আমি অতি সঙ্গোপনে।

এমনি আরো 'ভাঙাচোরা হিরণ্য পাথরে'র অমৃতস্বাদ পেতে হলে, প্রিয় পাঠক, আপনাকে 'ঝুমুর গান হে' কবিতাগ্রন্থটি পড়তেই হবে।


ঝুমুর গান হে 
দেবাশিস সরখেল

অণিমা প্রকাশনী 
১৪১ কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিট 
কলকাতা ৭০০০০৯
প্রচ্ছদ : শঙ্কর বসাক

**********************************************************************************************


উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল




[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * নয়

বিশ্বনাথ পাল

ভারতী সেনগুপ্তের বাড়িতে জরুরি সভা বসেছে। আমাদের আকাশ গ্রুপের সদস্যদের  নিয়ে।  ভারতীও আমাদের সদস্য। আমাদের আকাশ পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যা কীভাবে প্রকাশিত হবে বা আকাশ গ্রুপের সাংস্কৃতিক কাজকর্ম কীভাবে চলবে, সদস্যদের অবদান কী হবে সেইসব নিয়ে আলোচনা। সকাল থেকেই সল্টলেকে ভারতীদের বাড়িতে আমরা হাজির। দুপুরে ওদের বাড়িতে আমাদের খাওয়ার নেমতন্নও। ভারতীরা অবস্থাপন্ন পরিবার। ওর বাবার নিজস্ব ব্যবসা আছে। আমাদের গ্রুপের আট-দশ জন সদস্য ছাড়াও উপস্থিত আছেন একজন মধ্যবয়স্ক লেখক। অঙ্কুশ রায়। তিনি আমাদের গ্রুপের আপনজন, উপদেষ্টা। পত্রিকার চলার পথ সুগম করতে তাঁর পরামর্শ আমরা পেতাম। তিনিই আমাদের পত্রিকা ছাপানোর প্রেস ঠিক করে দিয়েছিলেন। তাঁর সুপারিশে আমাদের কাগজে অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক লেখা দিয়েছেন।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর অয়নের নেতৃত্বে আমাদের বন্ধুদের নিয়ে যে পত্রিকার সূচনা হয়েছিল, দেখতে দেখতে তার বয়স দশ পেরোল। ইতিমধ্যে আমাদেরও বয়স বেড়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে কর্মজীবনের দোরগোড়ায় আমরা। আমাদের মধ্যে ডাক্তারি পড়ছিল রজতাভ। সেও পড়া প্রায় শেষ করে ডিগ্রি পাওয়ার আগে একটি হাসপাতালে ইন্ট্রানশিপ করছে। 

অয়ন ছিল আমাদের মধ্যমণি। ওর বাবা কেমিস্ট্রির অধ্যাপক। ফলে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা ওর বাবার কাছে কেমিস্ট্রি পড়ার জন্য ভিড় করত।  ওর বাবা জয়েন্টের ক্লাসও  করাতেন। ফলে ছাত্রছাত্রীদের অনেকের সঙ্গেই অয়নের পরিচয় বন্ধুত্বে গড়াত। সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই অয়নের আকাশ গ্রুপ গঠনের পরিকল্পনা। আমার সঙ্গে অয়নের আলাপ অবশ্য ওর বাবার কাছে পড়তে গিয়ে নয়, বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনে পড়তে গিয়ে। সূর্যপুর থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছি আমি। সেখানে উচ্চমাধ্যমিক তখনও চালু হয়নি। ফলে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে ভর্তি হলাম বৈকুণ্ঠপুরে। নিজের ইচ্ছায় নয়, আমার ইচ্ছা ছিল নেতাজী কলোনি বিদ্যামন্দিরে পড়ার। কারণ আমার স্কুলের বন্ধুরা ওই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও তড়িৎস্যারের পরামর্শে বৈকুণ্ঠপুরে ভর্তি হলাম। স্যারের পরামর্শ আমার কাছে আদেশের সামিল। কারণ স্যারের কাছে আমার অশেষ ঋণ। 

ক্লাস টেনে পড়ি তখন। ইংরেজি বাদে আর কোনও বিষয়ের প্রাইভেট শিক্ষক ছিলেন না। টেস্টের পরে অবশ্য রামচন্দ্রবাবু বাড়িতে ডেকে আমাদের কয়েকজনকে বাংলা পড়িয়েছেন। তিনি কারও থেকেই বেতন নিতেন না। যাইহোক ইংরেজি কোচিঙের ফিস আমার সাধ্যের মধ্যেই ছিল, মাসে ষাট টাকা, দিতামও আমার টিউশনির প্রাপ্ত টাকা থেকে। মাধ্যমিক পরীক্ষার সাত মাস বাকি। অন্তত অঙ্ক ও ভৌতবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক হলে ভাল হয়। ক্লাস টেনে ওঠার পর আমার বাবা তার পরিচিতদের মধ্যে একজনকে পেয়েছিলেন যিনি একটি নামী স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। বাবার অনুরোধে তিনি আমাকে বিনা বেতনে অঙ্ক করাতে রাজি হয়েছিলেন। ফলে বাড়ি একদিন গিয়ে অঙ্কের ‘করণী’ অধ্যায়টা শুরুও করেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় দিনেই গিয়েই দেখা গেল কী কারণে তাঁর পা ভেঙেছে, তিনি শয্যাশায়ী। ফলে স্কুল বাদে অন্য কারও কাছে আমার অঙ্ক শেখার ইতি ঘটল। এদিকে স্কুলে সামনের বছর সম্ভাব্য প্রথম বিভাগের তালিকায় আমার নাম রেখেছেন শিক্ষকরা, বিশেষত তড়িৎস্যার।

এরই মধ্যে একদিন স্কুলের একবন্ধু রাজকুমার এল আমাদের বাড়িতে। নাম রাজকুমার হলেও ওরও বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। ও জানাল তড়িৎবাবুর কাছে ও বিনা বেতনে  পড়ে। তড়িৎবাবুকে আমি গিয়ে যদি আমার দুঃস্থতার কথা বলি তাহলে আমাকেও পড়াবেন। তড়িৎস্যার পড়াতেন অঙ্ক ও ভৌতবিজ্ঞান—দুটোই বিজ্ঞান বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  কিন্তু কারও কাছে গিয়ে নিজের দুঃস্থতার কথা বলা আমার কর্ম নয়। ফলে প্রস্তাবে রাজি হতে  পারলাম না।

দু-একদিন বাদে একদিন স্কুলে বসে ক্লাস করছি। হঠাৎ ক্লাসে তড়িৎস্যারের প্রবেশ। আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, “সোমনাথ, টিফিন পিরিয়ডে তুই আমার সঙ্গে দেখা করবি।” 

করলাম। তড়িৎবাবু বললেন, “আমি কী করে জানব যে তোর সায়েন্সের কোনও টিচার নেই!” 

আমি নির্বাক। দু-এক মুহূর্ত পরে স্যার আবার বললেন, “তুই আজই সন্ধেবেলায় বইখাতা নিয়ে আমার বাড়ি চলে আয়। আরে দশটা ছেলের সঙ্গে আরও একজনকে পড়াতে আমাকে কি অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হবে? হবে না তো। শুধু একটা খাতা বেশি দেখতে হবে। আমার বাড়ি চিনিস তো? না চিনলে সুদীপের সঙ্গে আসিস, ওরও পড়া আছে আজ।”  

বুঝলাম কয়েকদিন আগে রাজকুমার ও আমার কথা মা আড়াল থেকে শুনেছিল। তাই মা আজ সকালে এসে তড়িৎবাবুকে অনুরোধ করেন তার ছেলেটিকে যেন স্যার বিনা বেতনে পড়ান।


তো, এইভাবে মাধ্যমিকের আগের শেষ সাত মাস সুদীপদের ব্যাচে তড়িৎস্যারের কোচিঙে অঙ্ক ও ভৌতবিজ্ঞান পড়ি। একটা আক্ষেপ ছিল অঙ্কে লেটার পাইনি বলে। ৭৬ পেয়েছিলাম। অঙ্ক ছিল সবার শেষে। পরীক্ষা দেওয়ার পর স্যারকে প্রশ্ন দেখাতে গিয়েছি। অঙ্কে কোন কোন প্রশ্নের উত্তর করেছি মিলিয়ে দেখা গেল ৮০ নম্বরের উত্তরই করিনি, ফলে লেটার পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। স্যারের গলায় হতাশা ঝরে পড়ল। আসলে আমার আত্মবিশ্বাস বেশ কম ছিল— অঙ্কটা ধরে ধরে সময় নিয়ে করতাম যেন ভুল না হয়। ফলে তিন ঘণ্টায় ৭৬-এর বেশি উত্তর করতে পারিনি। পরিমিতির একটা অঙ্ক করতে গিয়ে সূত্রটা কিছুতেই মনে পড়ল না। নাহলে ৮০ হয়ে যেত। তবে রেজাল্টে বেরোলে দেখা গেল ৭৬-এ কোনও ভুল ছিল না।আমার প্রাপ্ত নম্বর ৭৬-ই।এমনকী জ্যামিতির উপপাদ্য লেখাও আমার এতটাই সঠিক ছিল এক নম্বরও কাটেননি পরীক্ষক। এটুকুই ছিল আমার সান্ত্বনা। এরপর হয়তো এক চোরা আত্মবিশ্বাস ছুঁয়েছিল আমায়— অঙ্কটা বোধহয় একটু আধটু পারি।

তো যে স্যার আমাকে বিনাবেতনে পড়ান, আমি অঙ্কে লেটার পাব না জেনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন, তাঁর পরামর্শ কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? মাধ্যমিকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের আগ্রহে আমাকে  ঐচ্ছিক বিষয় নিতে হয়েছিল অঙ্ক। নিয়ে তো পড়ি অথৈ জলে। ঘন জ্যামিতি আরও কী সব ছিল। কেসি নাগের বই। তখনও তড়িৎবাবুকে একদিন সমস্যার কথা জানাতে স্যার ছুটির পরে এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে ঘন জ্যামিতি ও কিছু অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়েছেন। ওই পেপারে ৬৬ পেয়ে মোটামুটি  মুখরক্ষা করি। ফলে তড়িৎবাবুর পরামর্শে স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনে আমার ভর্তি হওয়া এবং অয়ন ও রজতাভর সঙ্গে আলাপ। 

এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বলি। 

তড়িৎবাবুর পরামর্শে বৈকুণ্ঠপুরে ভর্তি তো হলাম। কিন্তু যাব কীভাবে? আমার বাড়ি থেকে স্কুলের যা দূরত্ব হেঁটে যেতে চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। প্রথম দু-একদিন হেঁটে যাতায়াত  করলাম। কিন্তু এতটা পথ প্রায় কান্না পাওয়ার মতো অবস্থা। বিকল্প রিক্সায় যাওয়া যায়, কিন্তু ভাড়া চল্লিশ টাকা। প্রতিদিন চল্লিশ চল্লিশ আশি টাকা খরচ করে স্কুল করা অসম্ভব। অথচ  বাড়িতে যদি একটা সাইকেল থাকত, তাহলে অনায়াসেই এই সমস্যার সমাধান হত। ক্লাস এইটে থাকতেই সাইকেল চালানো শিখেছি পাড়ার এক বন্ধুর সাইকেল ধার করে। তখন মনে হত সাইকেল চালানো ও সাঁতার—এই দুটো বিষয় পুরুষ মানুষের অবশ্যই জানা উচিত। যাইহোক, দুটোই শিখেছিলাম। 

তৃতীয় দিন আর স্কুলে না গিয়ে সাইকেলের বায়না ধরলাম বাড়িতে। বিশেষত বাবার কাছে। যে করেই হোক আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিতেই হবে। নাহলে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। এদিকে অভাবের সংসার। হুট বললেই সাইকেল কেনা যায় না। নতুন সাইকেল তখন প্রায় হাজার দুয়েক টাকার ধাক্কা। কিন্তু আমি নিরুপায়। দু-দিন না খেয়ে থাকলাম। দাবি আদায়ে অনশন বলা যেতে পারে। অনশনের তৃতীয় দিনে আমার জামাইবাবু মানে বড়দির বর, যার বিয়ে পাড়াতেই হয়েছিল অর্থাভাবে কালীঘাট মন্দিরে, আমাদের বাড়িতে এসে একটা পুরনো সাইকেলের হদিস দিল। আটশো টাকা দাম। রেসিং কার সাইকেল। 

এই প্রস্তাবে বাবাকে রাজি করানো গেল। লাল ও সাদা রঙের মিশেলে উচ্চতায় খানিক ছোট রেসিং কার সাইকেল, হোক না সেকেন্ড হ্যান্ড, তাও তো সাইকেল। আমার কাছে হয়ে উঠল পক্ষীরাজ ঘোড়া।

সেই পক্ষীরাজে চেপে প্রথম যেদিন বৈকুণ্ঠপুর স্কুলে গেলাম, যাওয়ার পথে ঘটল এক বিপত্তি। স্কুলের গেটের কিছু আগে রাস্তায় একটা রিক্সার চাকার নাটবল্টুতে আমার সাইকেলের চাকার রিং আটকে সাইকেলসহ আমি চিৎপাত। পথচলতি মানুষের কথা কানে গেল, “এমন পাগলের মতো কেউ সদাইকেল চালায়!” আসলে নিজের বাহন চালানোর আনন্দে ওটা যে পক্ষীরাজ ঘোড়া নয়, সাইকেল— ভুলে গিয়েছি। ফলে গতিবেগের বিষয়ে কোনও খেয়াল ছিল না। যাইহোক ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ হয়নি। নেভি ব্লু রঙের স্কুলের প্যান্টটা হাঁটুর কাছে ফুটো হ্য়, যা পরে রিফু করতে হয়েছিল। আর পায়ের খানিকটা অংশ ছড়ে গিয়েছিল। এরপর অবশ্য গতিবেগ সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলাম।  

এর দশ-এগারো বছর পরে অবশ্য তড়িৎস্যারর একটি পরামর্শ রাখতে পারিনি। সেই প্রসঙ্গে পরে আসব। 

আবার পূর্ব প্রসঙ্গে আসি। নতুন করে আকাশ পত্রিকা প্রকাশ করতে কে কী ভাবে সাহায্য করবে এই প্রশ্ন উঠল সভায়। আমি স্পষ্ট জানালাম যে আমি চাঁদা দেব, লেখা চাইলেও দেব, কিন্তু সময় দিতে পারব না।

আকাশ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য অনেক সময় দিতে হত। আমাদের পত্রিকা ছাপা হত উত্তর কলকাতার একটি প্রেস থেকে। ফলে পত্রিকা বেরনোর সময় ম্যাটার জমা দেওয়া, প্রুফ দেখা প্রভৃতি কাজে বহুবার প্রেসে ছুটতে হত। এসব ছাড়াও প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় আমরা নিজেদের লেখা পড়তাম অয়নের বাড়িতে জড়ো হয়ে। লেখা পড়ার পর শ্রোতাদের মতামত চাওয়া হত। আমি বেশির ভাগ সময় নিরুত্তর থাকতাম। কিন্তু অয়ন প্রত্যেকের লেখা শুনে খুব সুন্দর ব্যাখ্যাসহ সমালোচনা করত।  সেই সময় বাজারে মোবাইল ফোন এলেও স্মার্ট ফোন আসেনি। মোবাইল মারফৎ সমাজ মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা কল্পনাতীত। হয়তো অরকুট সবে পাখা মেলেছে।  লোকে কম্পিউটারে তার স্বাদ পেত। 

ফলে সপ্তাহে একদিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া, নিজেদের লেখা পড়া বেশ ভাল একটা ব্যাপার ছিল। প্রায় আট-দশ বছর এই আড্ডা ও সাহিত্যপাঠের নিয়মিত সদস্য ছিলাম। কিন্তু যে দিনের কথা বলছি তখন বুঝে গিয়েছি যে চাকরি-বাকরি না পেলে এই সাহিত্যানুরাগী বন্ধুদলেরও করুণার পাত্র হয়ে থাকতে হবে। কথাটা অয়নও আমাকে একাধিক বার বলেছে। ফলে স্থির করলাম, এবার ছড়ানো ছেটানো মনটাকে জড়ো করে সংহত করতে হবে। একটা সরকারি  চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা আমার সত্যিই আছে কিনা তাও পরখ করে দেখার জন্য প্রয়োজন  একাগ্র হয়ে পড়াশোনা করা। এর জন্য কিছুদিনের জন্য আকাশ গ্রুপ, পত্রিকা, সাহিত্যসভা সমস্ত কিছুর থেকে দূরত্ব রচনা করতে চাইলাম। এমনিতে শুধুমাত্র বই মুখে করে বসে থাকার সুযোগ বা বিলাসিতা আমার ছিল না। আমাকে টিউশনি করে খেতে হত। পাশাপাশি বাবা যখন যে  ঠাকুর বানাত, তার চোখ আঁকা ও অন্যান্য কাজেও বাবাকে সাহায্য করতাম। ফলে চব্বিশ ঘণ্টার  মধ্যে দিনে দু-তিন ঘণ্টার বেশি পড়ার সময় পেতাম না। এখন এই দু-তিন ঘণ্টাটাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে গেলে উপলক্ষ্যগুলোর গায়ে দূরত্বের পর্দা দেওয়া প্রয়োজন ছিল, যাতে দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যূত না হয়।  


****************************************************************

বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকঃ পরম্পরা প্রকাশন।

যোগাযোগঃ 9830747017



*****************************************************************


উপন্যাস * দীপংকর রায়

 




['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৩   

দীপংকর রায়


এই তো , এইটুকুন ছটফটানিই শুধু , ব্যস্ততা —-- পুজোর আগে ও পরে , তারপর তার রেশটা হয়তো থাকত প্রতিমা আড়ঙ্গে ( মেলা ) নিয়ে যাওয়া সময় পর্যন্ত । সে পর্যন্ত ও তার অস্থিরতা । না না , আর একটুও , সে হলো ইঁদুর মাটি চেলে দিয়ে প্রতিমা যখন রওনা করানো হোত , তখন পর্যন্তও তার উৎকন্ঠা । সে কাজটা হোয়ে গেলে এরপর যা যা ," তা যেমন হয় হোকগে— "  এরকমই একটা ভাব মুখে থাকলেও , ঠিক কথা সেটাও না । তারপরেও তো আরো কত কি ! এই যেমন নৌকা তৈরি করা — আগে আগে সে দায়িত্ব সামলেছে দেখতাম ভূবন কাকা , এখন তো সে আর পারে না — সেসব থেকে সে এখন অব্যাহতি নিয়েছে । এখন তার জায়গায় তার দুই ছেলে ও কাইলে মামা , কুমার দা , শিবু দা , প'রে মামা । এরাই সকলে মিলেঝুলে করে নেয় দেখি । পুরো আয়োজনটাই এখন তাদের । সে দুই নৌকোর জোড়ন বাঁধা থেকে শুরু করে চারপাশে বাঁশ বাঁধা , সামিয়ানা টাঙানো , সব কিছু— এরাই সকলে করে ফেলে । ভূবন কাকা যেন পরবর্তী এই জেনারেশনের হাতেই সে সবের অলিখিত একটা নির্দেশনামা ধরিয়ে দিয়েছে ;  বলেছে যেন , " আমি তো এতকাল করলাম , ইবারে তোমরাই সামলাও …..। " 


       পাঁচু ভাই মোনো মামার তল্লা বাঁশের ঝোড় থেকে বড় বড় চারখানি বাঁশের ডগা কেটে নিয়ে এসে কোন সময় রেখে দিত নৌকোর উপর । সে কথা কাউকে যেন বলতে হোত না !

     সেই চারখানি তল্লা বাঁশের আগার মাথায় সামান্য কিছুটা ডালপাতা থাকবে যদিও তাতে ; তার  চারকোনার চারটি মাথায় দড়ি দিয়ে সামিয়ানা বাঁধা হবে । এর পর দুই নৌকোয় বাঁশের মাচা বেঁধে জোড়ন তৈরি করা হোত । এই মাচার উপরেই দুই নৌকোর মাঝখানে প্রতিমা রাখা হবে । পরে যখন বিসর্জনের সময় হবে , এই দুই নৌকোর মাঝখানে  জোড়নের বাঁধন খুলে দিলেই একেবারে সোজা ভাবে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়ে যেত । 

       এই হচ্ছে জোড়নের সুবিধা ।

তাছাড়াও আর একটি সুবিধা হোল আরএকখানি নৌকো হোলে , ছেলেপেলে বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে সকলে বসবার একটু সুবিধা । 

        তাই দুই নৌকোর পাটাতনের উপরেই মাদুর পাতা হোত । তার মধ্যে একখানি তে খানিকটা জায়গা ফাঁকা রাখা হোত ঢাকি এবং ধুনুচি নাচের জন্যে । আর বাজি , বাজি বলতে তো ওই সেই কাঠি বাজি — যাতে একটি কাঠির মাথায় বারুদ লাগানো থাকতো । আর বোম , যা ছুঁড়ে ফাটাতে হোত । সে কাজটি করতে হোত নৌকোর গোলুইএর উপরেই । তাকেই সহ্য করতে হোত বুক পেতে সেই দিনটার সব আঘাত । সেও যেন বুক পেতে দিয়েই আনন্দ পেত ।

         আড়ঙে যাবার পথে ঘাটে ঘাটে মহিলারা সিঁদুর দিত মূর্তির পায়ে । মিষ্টিমুখ করাতো মাকে । কেউ নৌকোয় উঠে আসত , কেউ বা সিঁদুর মিষ্টির থালা এগিয়ে দিতো মায়ের পায়ে দিয়ে দেবার জন্যে —-- নৌকোয় যারা থাকত তাদের হাতে হাতে । 

         কোনোদিনই কোনো উল্লাসে সামিল হতে পারিনি ! চুপচাপ বসে থাকতাম নৌকায় উঠে‌।

কি এক বিষণ্ণতা আমার চোখেমুখে ঘিরে থাকত কেন যে ! তার হদিস  কোনোকালেই পাইনি । আড়ঙে যেতে যেতে মনে হোত কেবলই —- এই তো , কদিন ধরে কত আয়োজন, কত আয়োজন করেই না পুজোটা শুরু হয় ! আর এই তো , এই যে মানুষজনের এত হোইহল্লা , আড়ঙ ,  বাজির গন্ধ , পাঁপড় ভাজা গন্ধ ,  বাদামের গন্ধ , চানাচুর ভাজার গন্ধ —- সকলে গোল হোয়ে বসে নৌকোর উপর চেঁচামেচি , কথা বলাবলি , সন্ধ্যা হোলে ধুনুচি নাচের হোইহল্লা , মাইকের আওয়াজ , মেলা কমেটির নানা ঘোষণা , সব কিছু মিলে সে এক হোই হোই ব্যাপার…! অথচ আমি চুপটি করে বসে থাকতাম নৌকোর মাথার কাছটায় । 


        আমার বয়সি বা আমার থেকে ছোট বড় সকলেই মেলায় নেমে যেত এটা ওটা কিনতে ঘুরতে , কিম্বা কত কিছু করতে হয়তো ; আমি নামতাম না নিচেয় । মন্টু মামার বউ অভিযোগ করে বলত , এই যে মনি , তুমি যে নামতিছ না নিচেয় , এর জন্যি আমাগের ছেলেপেলেরাও নামতি চাচ্ছে না যে… ! তুমিই তো আমাগের ডায়েডুয়ে নিয়ে আসলে ! তার জন্যিই তো আমার ও আসা হোল । এহনে তুমি নিচেয় না নামতি চাইলে, ওরাও তো নামতি চাচ্ছে না ! চলো চলো , সগ্গলি যাচ্ছে যহনে তহনে তুমিও চলো যাই —- ।

        লজ্জায় পড়ে যেতাম । মনে মনে ভাবতাম , এমা , আমার জন্যি এতগুলি মানুষের আনন্দ করা নষ্ট হতি যাচ্ছে ! না , তাতো ঠিক না ! 

     অনিচ্ছা সত্ত্বেও লাফ দিয়ে সকলের সঙ্গে সঙ্গে নামতে হোত নিচেয় । সঞ্চয়কেও ইশারায় ডাকতাম —- সে তাতে বলতো , তুই যা বউদিগের সাথে , আমি ঘট বেসজ্জন দিয়ে আসি । ধুনুচিও ধরাতি হবে । সন্ধে যে লাগে এলো যে ! 

        কোনোরকমে এক চক্কর মেরেই মেলার ভেতর , ওদের যা কেনাকাটার আছে বলতাম কিনে নিতে । বলতাম , নেও তাড়াতাড়ি চলো তো এবারে ।

           কল্যানী তো ঠোঁট কাটা —- বলতো , খাওয়াবেন না কিছু ? 

            সমস্যায় পড়তাম । টাকা পয়সার জন্যে না । সে তো প্রত্যেক দিদিমা মামিমা দের মাসি দের পাব্বনীর টাকা তো পকেটেই আছে ।সে সব বরাদ্দ মত যা পাবার পেয়েছি তো , বাকি কিছু দিদিমাও দিয়ে দিত । তার সাবধানী মন টাকা পয়সার বিষয়ে অতি সচেতন । বাইরে কোথাও গেলে সব সময়ই একটাই কথা —- কখন কনে কি লাগে , তা কিডা কতি পারে ! টাকা সঙ্গে থাকলি একটা বল- ভরসা পাওয়া যায় । তবে দেখপা , বেহিসেবী হবা না যেন কখনো ! 

      তাই ওসব না , কেনাকাটার ঝক্কি কেন যেন আমি সামলাতে পারি না কিছুতেই । তাই মামিকে বলতাম , ও মামি , কী কেনবেন কিনে নেন । আমি পাঁপড় ভাজা কেনবার জন্যি এই কিছু টাকা আপনার হাতে দিচ্ছি।

       সে তা আনন্দের সঙ্গে নিয়ে একটা নতুন চালন কিনে তাতে এক চালন বোঝাই করে পাঁপড় ভাজা কিনে নিত নৌকোর সকলের জন্যে ।কল্যানীকেও মহা খুশিতে দেখতাম তাতে । বলতাম , নে চল দেখি এবার নৌকোয় —-- 


           বেবি টা একটু বড় হয়েছে, সে ইতিমধ্যেই তার কৈশোরীক চাঞ্চল্য প্রদর্শন করতে শুরু করে দিয়েছে । তাকে দেখে অনেক ছেলে ছোকরারা তার সঙ্গে বেশ ভাব জমাতে নানা সম্পর্কের ছুতো তৈরি করে ডাকাডাকি করতো তাকে । তাতে তাকেও দেখতাম  বেশ আনন্দই পেতে ! চোখ মুখ দেখেলেই সেটি বোঝা যেত । সে  মনে মনে বলছে ও যেন , দ্যাখো , আমার এখন কত কদর বেড়েছে ! দেখছ তো ,  কত জন আমার সঙ্গে কীরকম কথা বলার জন্যে এগিয়ে আসছে ? এটা ওটা কিনে দিতে চাইছে ! আহ্লাদ দেখাচ্ছে কিরকম ভাবে দেখ একবার… ! 

     আমার দিকে চেয়ে নিয়ে বলছে যেন , দ্যাখো তুমি তো কেমন সবসময় আড়ষ্ঠ হয়ে নৌকোর উপরে বসেছিলে এতক্ষণ ,আসতেই চাইছিলে না —  ভাগ্গিস , কাকিমারে দিয়ে তোমারে রাজি করালাম তাই —- তা না হলি এই এতটা মজা পাওয়া হত আড়ঙের ! নামাই তো হত না , ভীতুর ডিম একটা —- পারো শুধু রাঙাদির সঙ্গে চেঁচামেচি করতি ….।

      ও বরাবরই এরকমের । হোইহল্লা করে থাকতে ভালো বাসে । একবার বলা শুরু করলে আর বাঁধ মানতে চায় না । মুখে লাগাম নেই । আমাকেও ছাড়ে না  আহ্লাদ করে কিছু বলতে ।  

       যদিও খুব একটা ভালো লাগে যে আমার , তাও না — ওর এই ধরণের আদিখ্যেতা গুলোন …।  

      যা হোক , নানা ভালো লাগা খারাপ লাগা সব মিলিয়েই আড়ঙের মাঠের পর্ব মিটিয়ে , এবারে যখন নৌকোতে যেয়ে উঠতাম , তখন আবার আর এক পর্ব সেই সব পাঁপড় ভাজা বাদাম ভাজা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে । তখনো পর্যন্ত বেবির সেই দেখনদারী ভাবটার ঘোর কাটতে চাইছে না যেন । কল্যানী বলত , এই মানুষটা না একটা বেরসিক । একদম আনন্দ করতি জানে না …. !

     কথাটা সে আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়েই বললো কাউকে । বিশেষ একটা খেয়াল না করলেও — শুনতে তো পেয়েছি !


      নৌকোয় নৌকোয় সন্ধ্যারতি শুরু হয়ে যেত এবারে … । ধুনুচি নাচ আর ঢাকের মোহড়া…. মাইকে নানা রকমের গানবাজনার আওয়াজের মধ্যে আমাকে দেখিয়ে তার যে বলা কথাটি খুব একটা গুরুত্ব পেল তা একটুও মনে হলো না। কারণ , তখন কে কতটা ধুনুচি নাচ নাচতে পারবে , নানা কেরামতি দেখিয়ে ,  সেদিকেই সকলের নজর চলে গেছে…. । 


     এদিকে তখন , এক এক নৌকোর সঙ্গে এক এক‌ নৌকোর একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা লেগে গেছে …. । 

    ধুপ-ধুনোর ধোঁয়া , বাজির শব্দ , মাইকের ঘ্যারঘ্যারানি , সব মিলে সন্ধ্যাবেলার নবগঙ্গার তখন অন্য আর এক রূপ । সে যে কি এক আবহ…. ! 

    সে কথা আজ এই কলকাতায় বসে যখন সেই কথাগুলো ভাবছি, তখন কত কথাই না মনে পড়ছে আরো ..!

       এরপর আরো এক অন্য আবহ ছিল , যখন মেলা থেকে ফিরে চলেছি নৌকো নিয়ে — তখনকার অবস্থা ছিল আর একরকমের । 

         অল্প অল্প নিয়র পড়া শুরু হয়ে যেত কার্তিক মাস পড়তে না পড়তেই তখন ।  মিনমিনে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব । বিসর্জনের নৌকোয় ওঠার সময় দিদিমা সঙ্গে একটা চাদর নিয়ে যেতে বলে রাখত আগেই । আর সেই চাদর সামলাত কল্যানীই । সে সেটা সন্ধে লাগতে না লাগতে ফেরার সময় আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলতো , নেন্ — মাথাটার উপরে দিয়ে নেন , নিয়ের লাইগে যাবেনে কিন্তু ; তাহলি আর রক্ষে নেই আমার…, রাঙাদি কিন্তু আমারেই কবেনে ,"তুই কি একটু দেখতি পারিস নি —-- ওর কি এসবে কখনো কোনো হুঁদো আছে নাকি —- ও তো তালকানা….। "

      এই যে সকলে হোই হোই করে গেলাম , অথচ ফেরার সময় সকলেরই যেন সকলের সঙ্গে একটা চুপচাপ কথা বলাবলিই চলছে  নীরবে ! কেউ কাউকেই মুখে কিছু বলছে না যদিও ।

      ঘাটে নৌকা লাগলে সকলে নেমে যেত যেমন , তেমন আমাকেও নামতে হত । বিসর্জনের নৌকোয় থাকার মতো তখনো পর্যন্ত আমি যেন দিদিমার কাছে সেরকমের বড় হয়নি । আসলে সে আমাকে কখনো বড় হয়েছি বলে ভাবতেই পারত না । অথচ সঞ্চয় কিন্তু তখন থেকেই সকলের সঙ্গে বিসর্জন দিতে নৌকাতেই থাকত ! 

       যদিও এইসব নিয়ে আমার কোনো অভিযোগও থাকত না , তার কাছে কখনোই । কারণ কেউ তো জানে না , এর আসল সত্যটা কোথায় লুকোনো ! 

      আমিও যে এই বিসর্জন জিনিসটাই দেখতে পারি না । 

      সে যখন মেলার উদ্দেশ্যে রওনা হোত নৌকো , তখনই মনে হত মা কালীর মুখটা যেন কেমন ভার ভার লাগছে । কিরকম একটা অন্ধকারচ্ছন্ন ভাব লক্ষ্য করতাম প্রতিমার মুখটিতে যেন । পরক্ষণেই মনে হত , আচ্ছা এটা কি সত্যি সত্যিই দেখছি আমি ! নাকি আমার ভেতরে বিসর্জনের সুর বেজে উঠেছে  বলেই , ওরকমটা মনে হচ্ছে আমার !  

          সত্যি সত্যিই কি এই যাওয়া আসায় কোনো আনন্দ দুঃখ বেদনা কিছুই কি যায় আসে আমাদের মতন তাঁর ? তাও তো জানিনা স্পষ্ট করে কিছুই !


             আবার এক সময় সমাধানে আসতাম এই ভেবে , এই যে আমরা সকলে মিলে যে বিসর্জনের একটা আবহের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করেছি যে, এটারই একটা প্রভাব তাঁরও মুখের উপর পড়ে বলেই , আর সেটাও আমরা ভাবছি বলেই হয়তো ; না হলে পূজা আরতির সময়ে রাতের বেলায় আমি কেন তাঁর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে থেকে লক্ষ্য করে দেখেছি তো , তাঁর মুখটি যেন হাসিতে ভরে উঠেছে ….! সত্যি সত্যিই কি মা কালী হেসে ওঠেন তখন ? হয়তো ওঠেন , তা না হলে আমি কেন উপলব্ধি করি এমন ভাবে 

সেই জিনিসটি …!

          এই সব , এই সব কথাই ভাবতে থাকি আমার রাতের বেলার বসবার সেই মোড়াটির উপর বসে বসে … । 

        আজও ভাবছি সেই ফেলে আসা  কালীপুজোর রাতের কথা , আজকের এই এখানের কালীপুজোর রাতের বেলায় একাকী বসে বসে….। 

          সন্ধ্যা লাগতে লাগতেই চারদিক থেকে বাজির আওয়াজ… দুম দাম , হুস্ হাস্… , সি… সি …. করে কোথা থেকে উড়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে যেন… ! 

         ওগুলোর ভেতর কোনটা রকেট বাজি ? তাও জানি না ঠিক করে ।

           সামনের  মাসিমা দের বাড়ির দালান ঘরের পেছনের দিকে যে ঝাউ গাছের সারি , তারও উপর দিয়ে কত বাজির ফুলঝুরি ছড়িয়ে পড়ছে…., এক এক সময় এক একরকমের আওয়াজ নিয়ে সে সব….।  


           একাকীই চুপটি করে দেখছি সে সব । 

           কাজের দিদি আজ দুজনের জন্যে দুকাপ চা করেছে এখন । তার একটি  বসিয়ে দিয়ে গেল আমার পায়ের কাছটি তে নিঃশব্দে।

          তার নিজের চায়ের কাপটি নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল সে‌ । 

           বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে আজ । ওদেশে থাকতে এই সময় থেকেই রাতে শোবার সময় কাঁথা লাগত দেখেছি । পুজোর শেষে হোমের ফোঁটা নেবার সময় তো কাঁথার তলা থেকে উঠে যেয়ে ফোঁটা নিতেই ভীষণ আলস্য লাগত ! 

             এখানে যদিও সেরকম টা না লাগলেও , এখনি একটা কুয়াশা কুয়াশা ভাব যেন চারদিকে । মিনমিনে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবও রয়েছে । ইচ্ছে করলেই একটা হালকা চাদর গায়ে লাগালেও লাগানো যেতে পারে । নতুন ঠান্ডা বলে কথা ,  বলা যায় না লাগলেও লেগে যেতে পারে তো !


             বাড়িতে ঢুকবার প্রধান সদর দরজাটি যে বাঁশের চটার বেড়া দিয়ে তৈরি করা —- সেটি খুলে অলোক , ফোচন , মলি , এই তিনজনকে ঢুকতে দেখলাম । না ওরা তিনজনই নয় , একটু পেছনে কাবেরীও  আছে দেখলাম । ওঁরা সকলে মিলে একেবারে হই হই করে উঠলো এই বলে ;  বিশেষ করে কাবেরী তো একটু অভিযোগের শুরেই বলে উঠল , আচ্ছা , তুই কিরকম ঠিক বলতো ? আজ এমন একটা দিনে তুই এরকম চুপ করে বারান্দার কোণে বসে আছিস ! একা একা কী করছিলি তাই বল তো ?

          তারপরে একে একে অভিযোগের পরে অভিযোগ —- আবদার  — অনুশোচনা — তিরস্কার — কত কিছু যে ;  তার বর্ণনায় না যেয়ে ওদের বলতে চাইলাম তার পরিবর্তে একটি কথাই —- সেই সব দিনগুলোতেই  ঘুরতে কেন জানি মনেমনে ভালো লাগছিল ভীষণ আমার….. !

             কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না ! তবুও ভালোলাগছে এইটা ভেবেই —- কোথায় আমার মতো একটা বেরসিক চরিত্রের প্রতিবেশির ছেলে , আজকের দিনে একা একা বসে থাকবে কেন ! এই কথা ভেবে তাকে টেনে ঘরের বাইরে বের করা যায় কিভাবে , সেইটা ভেবে সকলে দলবেঁধে ছুটে এসেছে যে , এটা কি কম বড় কথা নাকি ! সকলে মিলে এই যে একজোট হয়ে ছুটে এসেছে এই বলেই হয়তো , '' চল তো , যাই ওকে বের করে নিয়ে আসি গে…., কোথায় সকলে মিলে একজোট হয়ে হইহল্লা করে কাটাবো , তা না চুপ করে বসে আছে বারান্দার এক কোণে ! চল দেখি — ও না এলে সকলে মিলে আজ ওর ওখানেই কাটাবো , চল , চল দেখি ……। "


         এই যে সম্পর্কের বাঁধন , যা আমি এখানে এসেই না শুধুমাত্র , সে  সেই ছেলেবেলা থেকে এ পর্যন্ত সকলের কাছ থেকেই যে কী গভীর ভালোবাসা স্নেহে আগলে রাখতে এগিয়ে আসতে দেখেছি সবসময় একে অন্য কে ; হয়তো ঝগড়াঝাঁটিও হয়েছে , তবু তা যেন চিরদিনের জন্যে নয় ! একসময় আবার সব ভুলে যেয়ে একে অন্যের খোঁজ খবর সবই রেখেছে সকলে । 

        সত্যিই সে সব কথা সবটা ভাবলে ভালো লাগে । তখন আমি কোনো শূন্যস্থান খুঁজে পাই না তো কোথাও !

       এরা যেন সব সময়ই ঘিরে ধরে থাকে । আমিই যেন কখনো কখনো এদের সঙ্গ কে মনে করি বড্ড একঘেয়ে । আর তখনই আবার পথে পথে একা একা হেঁটে বেড়াই । না হলে সিনেমা হল ফাঁকা পেলে একখানা টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি । কী ছবি , কী বই চলছে এসবের কোনো ধার ধারা নেই—-  ঢুকে পড়েছি একা একাই…. ।


            ইদানীং সিনেমা দেখায় পেয়ে বসেছে । এমনই একটা টান থেকে শংকর ফোচন আরো কে কে যেন ছিল সেই দলে ! এবং এক সময় তো লেকের পাশের হলটায় চলছিল যে সেই সময়ের সব চেয়ে 'এ ' মার্কা ছবি —- ' ববি ',.....বলতাম , চল তো দেখে আসি ….! 

       অলোক যেন কীভাবে ফোচনকে সঙ্গে নিয়ে কটা টিকিট জোগাড় করেছে লাইন দিয়ে — সকলে মিলে গোপনে বলেছি , ' চল তো , দেখে আসি —- কী আর এমন হাতি ঘোড়া আছে ওতে  ! ' 


          কিন্তু ববি তো দেখা হলো । হয়তো একটু গোপনীয়তা নিয়ে — কিন্তু কেন যে এই চুপিচুপি একটা ব্যাপার , তার তো কিছুই বুঝলাম না  এই ছবিটি দেখে ! 

            ফোচনের বড় সুভাষ , সুবীর , মানু , ও পাড়ার হুলো , সরকার বাড়ির ছেলেরা সকলে মিলে পরদিন সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার মাঠের কোণায় ডেকে নিয়ে সে কি জেরা করা শুরু করলো , মূলত আমাকেই — শংকর ফোচনও ছিল , ওদের ভেতর কেউ একজন বললো , '' কী রে , তোরা নাকি ' ববি ' দেখতে গেছিলি মেনকা হলে ? ''

         আমিই একটু এগিয়ে গিয়েই  বললাম , '' হ্যাঁ …. কেন , তাতে কি হইছে কি ? ''

         মানু বললো , '' ওঁ….. তোমরা বুঝি খুব বড় হয়ে গ্যাছো , নাকি ? মাসিমার কানে যদি যায় তাহলে কী হবে ? শংকরের বাড়িতে জানে তো ? '' 

          বললাম , '' কেন , জানলে কী হবেনে ? আমরা কী এমনের গরহীত অন্যায় কাজ করে ফেলেছি যার জন্যি এত ঘটা করে আমাগের জেরা করবার জন্যি তোমরা একেবারে দল বাঁধে চলে আইস সকলে ? একটা ছবি দেহিছি এই তো ! তাতে যেন একেবারে চন্ডী অশুদ্ধ হয়ে গ্যাছে …! ''

         সুবীর বললো , '' ওঁ….. তা তুমি বুঝতে পারছ না বুঝি ! ''

           সুভাষও একসঙ্গে বলে উঠলো একই কথা । যেন নাটকের সংলাপ চলছে । 

 

             অত্যন্ত স্থির হয়ে বললাম ,''আমার মা যদি কিছু বলে তা আমি বুঝে নিতি পারবানে । আমি কিন্তু মনে করতিছি না , সেরকম কোনোই অন্যায় করিসি আমরা ! তবে আর সকলের বিষয়টা আমি জানি না — আশাকরি তারাও বুঝে নিতি পারবেনে —- তবে শোনো তোমরা , আমি কিন্তু এই কাজটা কে কোনো দোষের বলে মনে করতিসি না । পারলি তোমরাও দেহে আসগে না —- কি হাতি ঘোড়া আছে সেই ছবি তি ! আমি মনে করি শিল্পের আবার স্লীল অস্লীল কী ! সেটা তো একটা ছবি মাত্র !  তাছাড়া আর তো কিছুই না  !  …এই তোরা যাবি নাকি ? চল , আমার কাজ আছে , ঠিক আছে যাই এহোনে —- পারলি তোরা সকলে মিলে দেখে আয়গে যা…. ''

         পেছন থেকে কে যেন শুনলাম বলে উঠলো —- ও বাবা , এ তো দেখছি যথেষ্ট ফোঁস করে ওঠে ! দেখে তো মনে হয় না এত ট্যাঁটন ….! আচ্ছা , এরে অন্য ভাবে দেখতে হবে।

           সে সব শুনেও পেছনে ফিরিনি আর । এরপরেও এদের আরো কিছু বলার আছে কিনা সেটাও মনে করি নি । তারপরেও কত ছবি দেখেছি , কিন্তু বুঝে উঠতে পারলাম না ওই ছবিটিকে সেই সময়ের সমাজ এতটা অচ্ছুৎ করে দেখেছিল ই বা কেন !  ছবি হিসেবে তো একেবারেই বাজারের আর পাঁচটা ছবির মতনই একটি ছবি —- তবুও তখনকার চেতনা দিয়ে যেমন ,  আজকের ভাবনা চিন্তা দিয়েও যদি তাকে ভাবি , তাহলে তো কিছুই দাঁড়ায় না ! 

         সে দিনের সেই ব্যাবহা—  সেই যে থোড়াই কেয়ার করি গোছের 

একটা চরিত্রের প্রকাশ ; সেটা এরা খুব ভালো চোখে নেয় নি । সেই চাপটা গুনগুনিয়ে চললো বেশ কিছুদিন । সকলের পরিবারের কাছেই পৌঁছে দেবার উপায় টা —  নানা কায়দায় কীভাবে সম্ভব , তার কৌশলটা এরা খুব ভালো করেই  আয়ত্ত করে নিয়ে জানিয়ে দেয়‌ , সকলের বাড়ি বাড়ি একে একে নানা কায়দায় ।

            ফোচনের ঠাকুমা একদিন কথায় কথায় বললো , কী রে ভাই সিনেমা দ্যাখতে গেছিলা নাকি ?

            বললাম , হ ,  ঠাকুমা ।

      —- তা ভালো করছো , অর বাবায় তো কইলো না তেমন কিছু , অর মায় বকা-ঝকা দিল । আমি কইলাম আগের মারে ," বউমা , হোই ছে ডা কি ? এই বয়সে পোলাপান দ্যাখছে না হয় একখান ছবি , তাইতে এতডা বকনঝকনের কি আছে আমি তো বুইঝ্ঝা পাই না ! এই বয়সে দেখপে না তো কি বুইড়া বয়সে দ্যাখপে নাকি ?..... ছাড়ো তো, পোলাপানেরে লইয়া এত প্যাচাল পারণ ভাল্লাগে না বাপু , অ্যাতে আরো বিগড়াইয়ে যায় পোলাপানে ।খারাপ কিছু দেখলে অগোরে বুঝাইয়া কয়ন লাগে— দ্যাহো , এইডা ভালো , এই ডা খারাপ , এইডা বুঝাই-য়া বিচার করণের ভার অগোরেই দিতি হয় ,  তাতে অরাই বুঝতে পারে , নিজের মধ্যে একটা বিচার করে নিয়ে — "

           ঠাকুমা যেটার এত সহজে সমাধান টানতে পারছে — এদের কাছে সেটা এত সহজে বুঝবার বিষয় নয় । তাছাড়া নাতি নাতনির প্রতি তার একটা পক্ষপাতিত্ব ছিলোই । 

            যাইহোক বিষয়টা মিটে গেলেও মিটলো না । 

            শংকর একদিন বললো , এই শোন ,  এদের একদম পাত্তা দিবি না তো । যতসব ভোজগারলের দল ! লেখাপড়ার দৌড় তো কত , তা আমি জানি ! ওরা যেন কিছুই দেখে না , করেও না কিছুই ; এই তো , দেখ না কদিন বাদেই সব গোপনে দলবেঁধে টিকিট কেটে দেখে আসবে ঠিক দেখতে পাবি — হুঁ হুঁ… শুনেছে না ,  কুচকুচানি আছে একটু ;  অথচ আমি তো তেমন কিছুই পেলাম না ! হলিউডের ছবিগুলিকে তাহলে এরা কী বলবে ! ওগুলোই কি সব নাকি ? আসলে তো বোঝে না কিছুই — বোঝে শুধু ওটাই — ! 


           তার উত্তরে এই কথাটাই বললাম ওকে ,  আমি ওসব সব বাদ দিলাম , আমি শুধু এই কথাটাই বলতি চাই , আমি কোথায় কী দেখবো , কী খাবো , সেটা তোমরা ঠিক করে দেবার কে ? এই নিয়ে এত চোখমুখ টানাটানির ই বা কি থাকতি পারে , সেইটাই তো আমি বুঝতি পারতিছি নে ভাই ! 

          শুধু এখানেই থামেনি সবটা । দিদির বন্ধুরাও জিজ্ঞাসা করেছে । টুকুন দি তো একদিন বেশ গম্ভীর হয়ে  জিজ্ঞাসা করলো একই টোনে , বললো , তোরা তো শুনছি অনেক বড় হয়ে গেছিস রে ….! 

             উত্তরে বললাম , তা যা কোইছেন টুকুন দি ! পারলি যান না দেখে আসেন গে —- খুব একটা খারাপ লাগবে নানে… ।

             তার পরের অভিব্যাক্তির অপেক্ষা না করে হন হন করে হাঁটা লাগালাম বাজারের দিকে । 

                মনে মনে একবার শুধু বললাম , টুকুনদিও ছাড়লো না তাহলে !

                 পাড়ার বেশ কিছু মানুষ সেই থেকে আমাদের দলটার একটা নামকরণ ও করে ফেললো , ডেপোর দল । বেয়াড়া । বলে বেড়াতে লাগলো , এই মনিন্দ্র কর্মকারের পোলাডা হলো গিয়ে বড়ো আঁতেল একটা…। 

               সুভাষ বললো , তার সঙ্গে জুটেছে আমাদের বোকাপাঠা টা —- ওরে ওরা চালনা করছে বুঝতে পারছিস ! ইদানীং দেখছি কতকগুলোন আরো বাইরের ছেলেপেলে জুটেছে এই দলে ।


             সে যাই বলুক , আমাদের আড্ডা নিয়ম করে আবার চলতে লাগলো । একরকম প্রতি রবিবার হলে ই নতুন একটা টিকিট কাটার লাইনে দাঁড়িয়ে যাই আমরা কজনে মিলে । সে যে ছবিই আসুক না কেন, প্রথমেই দেখতে হবে সেটা । দেখে এসে সেই নিয়ে এক দুদিন আলোচনাও চলে আমাদের মধ্যে ।  

        এই করতে করতে কিভাবে যেন আমি একেবারে উত্তম ভক্ত হয়ে গেলাম । চুলের ছাঁট ও পাল্টে গেল আমার । দিদিমার গোল ফ্রেমের রোলগোল্ডের চশমা টা  নাকের ডগায় ঝুলিয়ে পথের দাবীর সব্যসাচীর ডায়লক মুখস্থ করে আওড়াতে লাগলাম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে , '' মনে করো দেশ তোমার মা , তুমি তাঁর সন্তান —- তোমার চোখের সামনে তোমার মাকে বিবস্ত্র করে চাবুক মারা হচ্ছে …….'',

           আমার এই নকল করে অভিনয় করা দেখে একদিন শংকর বললো , বা …! বেশ বেশ ….! তুই তো দেখছি বেশ আয়ত্ব করেছিস —- এতো একেবারে যেন ছোট উত্তম কুমার ! তা হাইট টা যদি আর একটু ভালো হোত , তাহলে ঠিক হোত আরো …;

          পথের দাবীর সব্যসাচী এতটাই প্রভাবিত করলো যে গোটা উপন্যাস টি তিনদিন ধরে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে একরকম টানা পড়ে ফেললাম । আর ছবিটির কয়েকটি জায়গার দৃশ্য এতটাই মুগ্ধ করলো —-  যে কারণে বার কয়েক তো দেখেই ফেললাম ।

          যদিও এইসব ঘটনার কথা সিনেমার প্রসঙ্গ উঠলো বলেই সামনে এসে দাঁড়ালো । আসলে এ ঘটনা এদেশে আসবার বছর খানেক পরের ঘটনা তো হবেই ।

            কালীপুজোর পরপর ই মা ওদেশ থেকে ভাইকে নিয়ে ফিরে এসেছিল । দিদিমা সেই সঙ্গে আসতে পারেনি ভিসা না পাওয়ার জন্যেই — কথা হয়ে রয়েছে ভিসা পেলে সঞ্চয় কিম্বা কাইলে মামা তাকে বর্ডার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যাবে , আর আমরা তাকে সেখান থেকে এগিয়ে নিয়ে আসবো । 

          ভাই ওখানে এতদিন কী কী করে বেড়িয়েছে —- মোটামুটি তার-ই একটা বর্ণনা চলতে লাগলো কদিন ধরে । কথা প্রসঙ্গে প্রসঙ্গ উঠলেই সেই একই বিষয়ের অবতারণা চলছে  আজ কদিন ধরেই ।

            শুনালাম একথাও , মা নাকি দিদিমাকে পরিষ্কার ভাবে বলে এসেছে , যাই করো আর তাই করো , তোমার এদেশে আর একা একা এই ভাবে থাকা চলবে না । তোমার বড় নাতিও যখন ওদেশে ফিরে গ্যালো আর আমিও তোমার জন্যেই তো এই গোরুবাছুর পুষলাম , তাহলে এবারে আর এখানে পড়ে থাকা কেন ? এবার তোমাকে যেতেই হবে ওখানে ; না না , ওসব আর শুনছি নে , আচ্ছা ঠিক আছে , তুমি এখানে যেমন জায়গা জমি গোরু বাছুর নিয়ে থাকো , ওখানেও না হয় সেভাবেই থাকবে । সে ব্যাবস্থাই না হয় করে দেওয়া যাবে । আমি নিশি বিশ্বাসের মতো না হয় মাঠের দিকে চাষের জমি জমা কি ভাবে পাওয়া যায় সে সবের খোঁজ খবর করে দেখবো । চলো , এবারেই দেখবো — কত কি দাম দস্তুর এখন চলছে মাঠের দিকে‌ ; মোটমাট কথা হোল এভাবে তোমার আর এখানে থাকাটা চলবে না ।বয়স তো হচ্ছে , না কি কমছে ?

           সেখানে দিদিমাকে কীভাবে মা বলেছে — সেই কথাগুলি ই সে বলছিল ।

            আমি মায়ের কথার সূত্র ধরেই বললাম , তা তোমার কথা কি মেনে নিয়েছে দিদিভাই ? তা তো মনে হয় না ! 

              মা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো , মানবে না তো কি করবে ? যদিও এখানে একটা বিশেষ বিষয় রয়েছে , সেটা হলো গিয়ে তুমি , তুমিই পারো , তুমিই যদি তাকে ঠিকঠাক ভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে  পারো তো , তাহলেই হবে — তুমিই পারো যা বুঝতে পারলাম , তোমার কথাই সে মানতে পারে । তাছাড়া সে এখনো ভাবছে যদি তুমি আবার ঠেলা দেও ওদেশে ! তাহলে সে আর নড়বে না কোথাও । আমার সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে । তাই বলছিলাম কি , শোনো বাবা , এখানে সবটাই তোমার সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করছে এখন । সে এখনো ভাবছে , তুমি যদি ওদেশে ফিরে যাও ! আর সেটা গেলেই সে সব কিছু ঠিক করবে । বলছে , ''জমিজাতির এখন দাম নেই — টাকার বাটাও একেবারেই কম —- দরদাম বারুক তারপর ভাবা যাবে । তারে পাঠাও তো আগে একখান পাসপোর্ট করে , সে কি কয় ,তারপরে ভাবা যাবেনে ওসব সবকিছু । ''

         তার মানে বুঝতে পারছ ? তোমার দিদিমার মনের বাসনা টা কি  !

      আমি যেন এসবের ভেতরে বাইরে কোনো পথেই হাঁটলাম না । এমনই একটা ভাব করে অন্য কিছুর দিকে বিষয়টাকে ঘোরানোর জন্যেই বললাম , '' এবারে আর কোথাও গেছিলে নাকি বেড়াতে…. ? ''


***********************************************

আগামী পর্বে

***********************************************

ভ্রমণকাহিনি * মুর্শিদ এ এম





দূষণমুক্ত রোম, এক ভ্রমণাভিজ্ঞতা

মুর্শিদ এ এম  


বর্তমান পৃথিবীতে দূষণ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা ক্রমবর্ধমান। এই নিয়ে নানান সম্মেলন হচ্ছে বিশ্ব জুড়ে। তাবড় নেতারা সম্মেলনে যোগ দিয়ে এসে দেশের মানুষের কাছে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা ঝাড়ছেন। কিন্তু যদি বলা যায়, বিশ্বের দূষণ নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা শূন্য, তাহলে খুব একটা ভুল হবে না। দূষণ শুধু ধুলো-ধোঁয়াতে সীমাবদ্ধ থাকে না, মানুষের নৈতিক দূষণকেও এর সঙ্গে জুড়ে বিচার করা উচিত।  

এসব কথা মনে এল রোম-সফর সেরে আসবার পর। বস্তুত, ঘর ছেড়ে না বেরোলে ঘরের ফুটোফাটা নজরে ধরা দেয় না। অবশ্য, নিজের ফুটোফাটা দেখার মতো মনের অবস্থান চাই। নিজের সব ভালো--এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে না এলে তা ঘটে না। আবার, পরের ভালোর কাছে নিজের অবস্থানকে হেটা করার লক্ষ্যও যেন তাতে না থাকে। যাই হোক, কথা হচ্ছিল দূষণ নিয়ে। সাধারণ মানুষের দূষণ প্রতিরোধের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন এসে পড়ল। অন্তরের দূষণকেও জড়িয়ে নিতে হল।  

আমরা যতই নোংরা হই না কেন, আমাদের মনের মধ্যে কোথাও শুচিতার সুপ্ত একখণ্ড বরফ সঞ্চিত থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তা বেরিয়ে আসতে পারে বিগলিত হয়ে। আমরা পথেঘাটে যত্রতত্র গুটখার প্যাকেট, বিড়ির প্যাকেট, থুতু ইত্যাদি ফেলে নোংরা করে থাকি। কিন্তু কোনো কর্পোরেট অফিস বা ঝকঝকে শপিং মল-এ তা থেকে সংযত রাখি নিজেকে। এই দ্বৈতস্বভাবে বা সত্তায় বোঝা যায়, পরিবেশ আমাদের দিয়ে সুপ্ত অভ্যাসটিকে ঝালিয়ে নেয়। তাহলে এও বলা যায়, ইচ্ছে করলে আমরা সর্বদাই এমন পরিপাটি পরিচ্ছন্ন থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি। 

ইতালির রোম শহরে পা রাখার পর ঝটিতে এই সংবেদ আমাকে নাড়া দিল। ওখানকার অসাধারণ প্রকৃতি এমনিতেই পরিচ্ছন্ন। পাহাড়ের কোলে প্রাচীন এক শহর। অমন নির্মল নীল আকাশ বহুদিন চোখে দেখিনি। অবিরাম সবুজ গাছ-গাছালি। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, তাদের গায়ে কোনো ধুলোবালি নেই। পর্যাপ্ত খোলামেলা পার্ক, খেলার মাঠ, প্রশস্ত চত্বর। চত্বরকে বলে piazza। পিয়াযজার মধ্যিখানে কোথাও কোথাও ফোয়ারা। বিশাল বিশাল মার্বেল পাথরের সুদৃশ্য সুঠাম চেহারার মূর্তির শরীর থেকে নির্গত সে জল পান করা যায়। যে জল পাইপলাইন দিয়ে সরবরাহ করা হয় চব্বিশ ঘণ্টা, তা যেমন ঠান্ডা, তেমনই পরিশ্রুত ও পেয়। কিন্তু এ কি শুধুই প্রকৃতির দান, মানুষের কৃতিত্ব কি নেই! এই জায়গাতেই কিছু বলার হয়ে ওঠে। 

মনে হয় যেন ওখানকার নাগরিক মুক্ত আর পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী। যারা তাদের ভিটেমাটিকে কলুষ হতে দেয়নি বা দেবে না কিছুতেই। প্রথমত, শহরে এমন যানবাহন নেই, যা কালো কার্বনমিশ্রিত ধোঁয়া নির্গত করে। এমন কেউ পথেঘাটে রান্না বা উনুন জ্বালায় না, যার দরুন বাতাসে দূষণের মাত্র বাড়ে। অথচ অগুনতি রেস্তোরা রয়েছে শহরজুড়ে। প্রশস্ত চত্বরে খোলা ছাদের নীচে খানাপিনার আয়োজন নজরকাড়া। যান চলাচল পথের পাশে চওড়া ফুটপাথ। সেখানে সাইকেলের হ্যান্ডেলওলা খুব ছোটো ছোটো চাকা লাগানো ফুট তিনেক লম্বা আর ফুটখানেক চওড়া পাদানির এক ধরনের যান দাঁড় করানো  থাকে। নাম monopatino। নির্দিষ্ট অ্যাপে গিয়ে বুক করে অনলাইনে পয়সা দিয়ে ভাড়া নিয়ে যে কেউ চালিয়ে আবার মেয়াদ শেষে যে কোনো ফুটপাথে রেখে চলে যেতে পারে।  খুব ডিসিপ্লিনড না হলে এভাবে পরিবহন-সহায়তা কী সম্ভব হত! বিগত একমাসের সফরে কাউকে থুতু ফেলতে দেখিনি জনসমক্ষে। তামাক বা নেশার দ্রব্য বা খাবারের মোড়ক কোথাও পড়ে নেই। অথচ নেশা যে তারা করে না, তা তো না। 

অবশ্য সব ছাপিয়ে দৃশ্যমান তাদের ভালোবাসার নেশা। চেনাজানা মানুষ, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলে গাঢ় আলিঙ্গন আর চুম্বনে ভরিয়ে দেয় এরা। স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সর্বত্রই এক ছবি। আমাদের পাপী চোখে এগুলি বেশ করকরে ঠেকে কিন্তু ওরা কেউ ফিরেও তাকায় না। সত্যি বলতে, প্রেমের এ-হেন অনুভব উদযাপন করাই তো জীবনের ধর্ম, যৌবনের সার্থকতা! তাকে উপলব্ধি করতে পারলে আর তেমন বাধো বাধো, অস্বস্তিকর  লাগে না। ওদেশের উচ্ছল যৌবন-মুখরিত সাস্থ্যবান নারী-পুরুষকে দেখলে এটাকে স্বাভাবিক বলে মানতেই হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতা ওদের দেখে শিখতে হয়। দিনে-দুপুরে বড়ো রাস্তায় পার্কে-- আপনার পাশ দিয়ে দেখবেন কেউ না কেউ দৌড়ে যাচ্ছেন শরীর চর্চার নিমিত্ত। বয়েসে তাঁরা যে নবীন তা নয়। সত্তরোর্ধ্ব পুরুষ আখছারই সেই দৌড়ে সামিল। আমাদের বাসার পাশেই এক ক্রীড়াঙ্গণ ফোরাম-এ উঁকি মেরেছিলাম এক বিকালে। সেখানে গোটা চারেক টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল, ক্রিকেট এবং ফুটবল মাঠ একই চত্বরে। একের  পর এক নারী-পুরুষ গাড়ি নিয়ে আসছেন তারপর পোশাক বদলে নেমে পড়ছেন শরীরচর্চায়। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ষাটোর্ধ্ব। এঁদের সবলতা পথে ঘাটে আপনাকে অবাক করে দেবে! বলাই বাহুল্য, নর-নারীতে সেখানে প্রভেদ নেই, প্রভেদ দেখাও হয় না অন্যত্র। বড় বড় ট্রাক বা লাকসারি বাস চালকের আসনে মহিলাদের অনায়াস উপস্থিতি শিক্ষণীয় বিষয়। দর্শনীয় স্থানের টিকিট-পরীক্ষক বা পুলিশ কিংবা নিরাপত্তাকর্মী--তরুণীরা যেমন হাসিমুখ তেমনি পোশাক এবং অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। আমাদের বঙ্গের নিরাপত্তারক্ষী বা শান্তিরক্ষাকারীদের অবসাদগ্রস্ত মুখমণ্ডল, উদাস খৈনি ডলার বহর বা নোয়াপাতি ভুঁড়ি-জাত বৈকালিক ঢেকুর, এর পাশে কেমন লাগবে সহজেই অনুমান করা চলে।  

বলছিলাম দূষণমুক্ত এক শহরের কথা। কিছু থাক না থাক রাস্তার প্রতিটি মোড়ে পাঁচ-ছটা বিশাল সাইজের ওয়েস্ট ড্রাম বসানো রয়েছে। রাত গভীর হলে বড়ো বড়ো ট্রাক এসে তাদের অটোমেটিক যন্ত্রের সাহায্যে ঘাড়ে তুলে নিজের পেটে সমস্ত আবর্জনা ঢুকিয়ে নিয়ে চলে যায়। আর ডাস্টবিন তো রেল-স্টেশনে, মেট্রোতে ছড়াছড়ি। এমনকি চৌরাস্তার মোড়েও দু-তিন রঙয়ের আবর্জনা ফেলার বাস্কেট ঘন ঘন রাখা। কোথাও ব্যানার ফ্লেক্স পোস্টার চোখে পড়েনি এ কয়দিনে। দোকানগুলি শুধুমাত্রই সাইনবোর্ড সজ্জিত। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন দোকানের মধ্যই সীমাবদ্ধ। লটকায়িত প্লাস্টিকের স্লেটে ‘কাটা-190, গোটা-100’ লেখার মতো সৌন্দর্যবোধের অভাব চোখে পড়ল! কাঁচা বাজার আর অন্য প্রয়োজনীয় বাজার আলাদা জায়গায়। আমরা বাজার করতাম ভিত্তোরিয়ো বাজারে। মেট্রো চেপে ভিত্তোরিয়ো ইম্মানুয়েলে স্টেশনে নেমে যেতে হয়। এটা বড় একখানা সবজি- মাছ মাংসের প্রখ্যাত বাজার। সবজি ছাড়া মাছ মাংস ইত্যাদি প্যাকেটে মোড়া অবস্থায় বিক্রি হয়। বিক্রেতাদের প্রত্যেকের হাত দস্তানায় ঢাকা। এই বাজারের স্টলগুলোর অধিকাংশ মালিক বাংলাদেশী। ফলে কেনাকাটার সময়ে বাংলা যত খুশি প্রাণ খুলে বলে নেওয়া যেত। একেবারেই আমাদের এখানকার সমস্ত শাক-সবজি পাওয়া যায়। মাছও কলকাতার বাজারের মতো। চিকেন বিফ কাঁকড়া মাটন অক্টোপাশ আর পর্ক পাশাপাশি রেখে বিক্রির ‘অপরাধে’ কারও কখনও জ্যান্ত পুড়ে মরার ঘটনা ঘটেনি। 

ইতালির মানুষ পকেটে সর্বদাই টিসু পেপার নিয়ে ঘোরে। শারীরিক বর্জ্য তাতে মুছে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। ফলে জল ফেলে পথঘাট নোংরা করতে হয় না। শৌচালয়ের বাড়াবাড়ি নেই। আমরা ভালোভাবেই জানি আমাদের দেশে অধিক শৌচালয় থাকা সত্ত্বেও তার বাইরে কে কত নোংরা করতে পারি, তার প্রতিযোগিতায় সামিল হই। ওখানে স্টেশন, শপিং মল ইত্যাদি লোক সমাগমের স্থান ছাড়া পাবলিক টয়লেট আলাদা করে নেই। সেগুলি অধিকাংশই পয়সার বিনিময়ে। কোথাও এক ইউরো। কোথাও চার/পাঁচ। আর আছে রেস্তোঁরায়। বহুজাতিক এক রেস্টুরেন্টে খাবারের বিল দেখতে চাইছিল এক বাংলাদেশী কর্মী, নইলে টয়লেট সারা যাবে না!  

দূষণ তো যানবাহন থেকেও ছড়াতে পারে। আগেই কার্বন-ধোঁয়ার কথা বলেছি। গাড়ি চলাচলের সুষ্ঠু নিয়মও তো দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরি করায় সহায়তা দেয়। যেখান-সেখান দিয়ে রাস্তা পার হওয়া, অকারণে তাড়াহুড়ো করে কোনো গাড়িকে ওভারটেক করতে যাওয়া, অনর্থক হর্ন বাজানো, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্ক করা। সিগন্যাল ভায়োলেট করা ইত্যাদি সুস্থ নাগরিকের লক্ষণ নয়। প্রত্যক্ষভাবে যানব্যবস্থা সুচারু রাখার জন্যে এগুলোকে মান্য করা যেমন উচিত, তেমনই পরোক্ষভাবে নাগরিকের সুচেতনা  তৈরিতে মানসিক ভাবে এটি সাহায্য করে। একটি অবিন্যস্ত, উৎশৃংখল, নাজেহাল  পরিবেশে যাতায়াতকারী চালক বা যাত্রীর মানসিক গড়ন  আর শান্ত, সাবলীল পরিবেশের যাত্রী বা চালকের মানসিক গড়নের তুলনা করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে এর পার্থক্য। বলা যায় না, এই আপাতক্ষীণ পার্থক্যই হয়তো নির্ণায়ক হতে পারে একটি দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির। রোমের নাগরিকেরা এটি মানে, মানতে বাধ্য করে জানপ্রাণ দিয়ে। বাস, প্রচুর প্রাইভেট কার, বাইক একই পথে চলাচল করে সারিবদ্ধ ভাবে, একে অপরের পেছনে। কেউ কোনো ভাবেই কাউকে ওভারটেক করার প্রয়োজন মনে করে না। সিগন্যাল ব্যবস্থা অটোমেটিক, কোনো মোড়ে একটাও ট্র্যাফিক পুলিশের দেখা মিলবে না। হর্ন দেয়া একেবারেই নেই, নেই উদ্ধত ভঙ্গির কোনো চালক বা গাড়ির মধ্যকার কানফাটানো মিউজিক। মাইকের অত্যাচার কোত্থাও নেই। তবে গানবাজনা আছে। মেট্রোর চত্বরে, পার্কে, কোনো চার্চে বা মেলায়। কাছের জনের শোনবার জন্যে। সোলো গায়ক। আপনমনে গিটার বাজিয়ে গেয়ে চলেছেন। এটা যেমন মনোরঞ্জনের উপাদান তেমনই তা উপার্জনেরও অবলম্বন। সমস্ত দেশের মানুষজনকে ঘাড় ধরে শোনানোর মতো পবিত্র কর্তব্যকে হেলায় সরিয়ে রেখেছে। জেব্রা ক্রসিঙের যেখানে সিগন্যাল নেই, রাস্তা পারাপারের জন্যে কোনো পথচারী সাদা দাগে পা ফেললেই দ্রুতগামী গাড়িও থেমে যায়। তারা মনে করে, যে মানুষটা পায়ে হেঁটে চলেছে তার আগে যাওয়া উচিত, যার কাছে গাড়ি আছে তার নয়! এ-বিষয়ে তাদের সংস্কার হল—পথচারীরা হলেন প্রেসিডেন্টতুল্য (presidento) আর চালকেরা হলেন প্রজা! বাসগুলি নির্দিষ্ট স্টপে হলদে স্ট্যান্ডে লেখা নম্বর  অনুসারে টাইম টেবল ধরে আসে। এর জন্যে অ্যাপ সকলের মোবাইলে ভরা থাকে। দেখে নেয়া যায় ঠিক কোন সময় বাসটি আসছে। অনর্থক সময় নষ্ট হয় না তাতে। অটোমেটিক দরজা, টিকিট পাঞ্চ করার যন্ত্র, বাস থামানোর যাত্রী-নির্দেশ এবং কন্ডাকটরহীন এই বাসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক চালু থাকে সবসময়।  কোন স্টপ আসছে তা-ও জানান দেয় ভেতরের ডিসপ্লে বোর্ড এবং ঘোষক-কণ্ঠ। সন্ধে সাতটার মধ্যে শহর প্রায় যানমুক্ত হয়ে পড়ে। এত এত প্রাইভেট গাড়ির ব্যক্তিগত গ্যারাজের বন্দোবস্ত নেই। প্রশস্ত রাস্তার ধারে, সার দিয়ে দুরত্ব মেনে পার্ক করা থাকে রাতভর। তিন ধরনের পার্কিং লট আছে এখানে। বেশি পয়সায়, কম পয়সায় আর বিনামূল্যে।   

বাস-ট্রামে ভাড়া ফাঁকি দেয়া সর্বত্রই চালু অভ্যাস। ফাঁকি দিলে জরিমানা ধার্য করা হয় সকল দেশেই। কিন্তু সে জরিমানার পরিমাণ এত কম যে, অপরাধ করেও ছাড়া পেয়ে যাওয়া সহজ। রোমে কড়াকড়ি নিয়মে ফাঁকি দেয়া যাত্রীকে জরিমানা দিতে হয় স্পট ফাইন—৫০ ইউরো, আর দেরিতে দিলে লাগে ১০০ ইউরো। আমাদের টাকায় ৪৫০০ বা ৯০০০ টাকা! বোঝা যায়, বেশি পরিমাণে পেনাল্টি করার কারণে এখানে কেউ টিকিট না-কেটে যাতায়াত করতে সাহস পায় না। আমাদের এখানে যদি সেরকম ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে কি ফাঁকির প্রবণতা কমবে? (বাসের ক্ষেত্রে নয়, ট্র্যাফিক আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে) জবাব একটাই, সরকারি জরিমানা কেউ কি দেয়? পুলিশের সঙ্গে রফা করে ৫০০-র জায়গায় ৫০ টাকা দিয়ে কার্য সমাধা করে ফেলেন জনগণ! দাঁড়াল এই, সরকারি সদিচ্ছা থাকলেও ফাঁক বা ফাঁকি অন্যত্র। এবং সকলেই জানেন এই দূষণের টিকি কোথায় বাঁধা থাকে! এই দূষণ হল  দুর্নীতির সূতিকাগার, যা ছেয়ে রয়েছে আমাদের দেশ জুড়ে। ইউরোপের এই শহরের সভ্য নিয়ম-রক্ষকেরা এই রফা থেকে দূরে থাকেন। রাজনীতির লাম্পট্য বা লম্পট রাজনীতি এঁঁদের কলুষিত করতে সমর্থ হয়নি। 

ট্রেনে দুজন চেকারকে দেখেছিলাম, একজন তার মধ্যে মহিলা--দুজনেরই সরকারি পোশাক সুঠাম স্ব্যাস্থের অধিকারী, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী--চাহনিতে টের পাওয়া যায়, এবং কোমরে  দস্তুরমতো রিভলভার শোভা পাচ্ছে। অথচ টিকিট পরীক্ষা করার বেলা নেহাতই নরম কণ্ঠ, যেমনটা আমরা দেখে থাকি--কোনো প্রধানমন্ত্রীসুলভ ভাব নেই। নিজের প্রতি, নিজের কর্মের প্রতি এই সম্ভ্রমবোধ না থাকলে সুসভ্য হওয়ার অজস্র উপকরণ দিয়েও কিছু হয় না। এক ট্রেনচালক যখন সারাদিনের ব্যস্ত ডিউটি-শেষে, কেবিন থেকে বেরিয়ে  কোনো প্রশ্নকারী অনভিজ্ঞ যাত্রীকে গন্তব্যের খুঁটিনাটি বলতে থাকেন এনকোয়ারিতে না-পাঠিয়ে, তখন আমাদের কর্মচারীদের সদাব্যাজার মুখ মনে পড়াতে বাধ্য করে। দুষণের এই পরম্পরা দেখে আসছে আমাদের দেশ। রাজনীতির দোসরেরা এই পরম্পরার ধারক-বাহক, পৃষ্ঠপোষক। কর্মের পরিবেশ যেমন দূষণে আক্রান্ত, মানুষের চরিত্রও সেইভাবে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে এক অতলান্ত কালোর দিকে। এখন এখানে কেউ না-চাইলেও দিবারাত্র পাঁচ বার বা অষ্ট প্রহর তারস্বরে কানের কাছে মাইক বাজিয়ে যে শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার চলে, উত্সবের নামে লাগাম ছাড়া বাজি ডিজে ব্যবহার করা হ্য়, তা অসভ্যতাকেই চিহ্নিত করে। মনে হয়, কেউই  আমরা সুস্থ নই, সাবলীল বা সহজ নই। নিজেদের বদলানো ছাড়া অপরকে দোষ দিয়ে লাভ হবে না আর। এই আত্মদূষণের দায় থেকে আমাদের মুক্তি কে দেবে!











***********************************************

অণুগল্প * সুমিতা পয়ড়্যা



ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----


সবলার অমৃতযোগ

সুমিতা পয়ড়্যা


শ্রাবণের অঝোরধারায় আকাশটা যেন ভেঙ্গে পড়েছে। ঘন জঙ্গলের বড়ো বড়ো গাছগুলোও আশ্রয় দিতে অপারগ। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তলপেটটা খামচে ধ'রে, ঝিমলি কোঁকাচ্ছে।

নিবিড় ভালোবাসার এই উপহার জংলী সমাজেও ব্রাত্য। অনেক বাধা, চোখরাঙানি অতিক্রম ক'রেও বুঝি শেষরক্ষা হ'লো না! কিংকর্তব্যবিমুঢ় ঝিমলিকে, চিরশান্তির আশ্রয় দিতে বুনো নদীটাই একমাত্র ভরসা! যত উত্তালই হোক-না-কেন, নদী তো আর উঠে আসবে না! তার আঁচলের তলায় তো, যেতেই হবে!

হঠাৎ, জল-কাদা-অন্ধকারেই এক আত্মঘোষণা...

"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকাষর হে বিধাতা?"স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই প্রশ্ন বাণী মানসিকভাবে চিরস্বাধীন ঝিমলির  বজ্রকন্ঠে আকাশে বাতাসে নিনাদিত হয়ে উঠল। আপন অস্তিত্ব সাগৌরবে সকল বিরুদ্ধ শক্তিকে দলিত করে মাথা উঁচু করে যে দাঁড়াতে পারে সময়ের সাথে, পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সে প্রতিকূল পরিবেশেও আপন অস্তিত্ব স্বগৌরবে জানান দেয়।

ঝিমলি আজ অল্প বয়সী বিধবা। উত্তাল যৌবন, সুন্দরী, মোহময়ী ব্যক্তিত্ব সম্পন্না নারী। যে নিজের জীবন পিপাসাকে বিলিয়ে দিয়েছিল সুখের ঘরে--তার আদর্শ সৎ ভালো মানুষ বিমলদার হাতে।যে তার জীবনে এক ঝলক সতেজ বাতাস বয়ে এনে দিয়েছিলেন। দুজনে দুজনের প্রেমে পাগল ছিল আর তারই সন্তান ঝিলিকের গর্ভে ভালোবাসার উপহার স্বরূপ।

হঠাৎ এক দমকা ঝড় এসে সব কেড়ে নিয়ে গেল। সেদিন সকাল থেকে সে কি বৃষ্টি! যেন বৃষ্টির মহোৎসব! চারিদিকে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। প্রলয় তান্ডবে মনে হচ্ছিল বিধাতা নিজ সৃষ্টির ওপরেই ভীষণ ক্ষুব্ধ। প্রকৃতি যেন ধ্বংসলীলায় মেতেছে। সম্পূর্ণ অচেনা পৃথিবী। প্রচন্ড আক্রোশে সব যেন তছনছ।

হঠাৎ এক আর্তস্বর!

বাতাসের আওয়াজে তা বারবার পরাজিত হচ্ছিল।

ক্ষীণ আকুল চিৎকারে মনে হচ্ছিল ছুটে যাই কিন্তু ঝিমলি ও নিরুপায়। সে এখন গর্ভবতী। এই অবস্থায় বাইরে বেরোনোটা ঠিক হবে না। অথচ সেই আর্তকন্ঠ শুনে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। অস্পষ্ট প্রকৃতির আলোর ঝিলিকে দেখলো তার বিমল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বাড়ির উঠোনে। পাশের বাড়ির মানুষের চিৎকার জানান দিল--বাজ পড়ছে। আর তার ফলে এমন ঘটনা।

চারিদিকে মানুষের কথাগুলোতে শিউরে উঠল ঝিমলি। সেদিন কার কতটুকু ক্ষতি হয়েছিল ঝিমলির জানা নেই তবে ঝিমলির সব রঙ অস্পষ্ট হতে হতে ভোরের পূব দিগন্তে পাড়ি দিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তারপর হঠাৎ প্রকৃতি শান্ত হয়ে এলো।

ভোরের আলো ফুটেছে। মন্দিরে বাজছে কাঁসর ঘন্টা। শঙ্খ নিনাদে ঘোষিত হচ্ছে মঙ্গলময়ের মঙ্গল বারতা।

এদিকে ঝিমলি কোঁকাচ্ছে দেখে আশ্রয়দাত্রীমা ডাকছেন, কি হয়েছে মা? কোন কষ্ট হচ্ছে? তেমন হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ঝিমলি ওঠ।ওঠ মা। 

দেখ কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। ঝিমলি উঠলো; দেখল আকাশ পরিষ্কার; ঝলমলে রোদ্দুর।

প্রকৃতির শান্ত রূপ দেখে নিজেকে মনে হল পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ।

তাহলে আজ সবটাই কি স্বপ্ন দেখছিল! 

সেদিন তো---

তার ভালোবাসা ছিল বিমল;  কখনো তো তেমন খারাপ কিছু হয়নি! 

হাজারো প্রশ্নের মধ্যেও 

মনের ভেতর একটা আনন্দের অনুভূতি উপলব্ধি করল---স্বপ্নে বিধাতার কাছে রবি ঠাকুরের ভাষায় আত্ম ঘোষণা---যা এখন তার সম্পূর্ণ নিজের কথা। কারণ তার ভালোবাসাকে নিয়ে অনেক পথ চলতে হবে যে!











***********************************************************************************   



সুমিতা পয়ড়্যা (দে)

জন্ম এক সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারে। পিতা:  শান্তি পদ দে; মাতা: পারুল রানী দে। পিতা-মাতার আদর্শে আদর্শিত হয়ে এক বোন আর এক ভাইকে নিয়ে বড় হয়ে ওঠা।  রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম-এ; বি-এড। ছোট্ট থেকে কবিতা বলার প্রতি এক অদম্য ঝোঁক ও ভালোবাসার "কাব্য নন্দন" আবৃত্তি শিক্ষা কেন্দ্র ছাড়াও  প্রথম গল্পগ্রন্থ "দৃষ্টিপাত"(২০২১) প্রথম কাব্যগ্রন্থ"অন্তরে বাহিরে"(২০১৯); "কবিতায় অভিযান"(২০২১)এবং "যে আঙ্গুল ছুঁয়েছিল তোমার হাত"(২০২৩)একক অনবদ্য সৃষ্টি যা পাঠকের কাছে সমাদৃত। এছাড়াও লেখকের গল্প গ্রন্থ 'সম্পূর্ণ বলয়'(২০২৩); 'অমৃতের দুনিয়া'(২০২৪)। 

অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়





জাগ্ৰত বসন্তে

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


তোমার নাচের স্কুল ' নূপুর ' এ আজ বসন্ত বন্দনা চলছে। তুমি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বসন্ত বন্দনা বলতে, বসন্ত উৎসব নয়।
নাচ, গান, আবৃত্তি, কবিতা পাঠে জমজমাট। এলাকার মান্যগণ্য অতিথিরা উপস্থিত। ওদের আপ্যায়নে তোমারই স্কুলের ছেলেমেয়েরা। আমার এই দিনটা তুমিময় নির্জন বাস থাকে। তোমার পোঁতা পলাশ গাছটার নিচে বাগানের কোণের ছায়ায় চেয়ার পেতে বসে।দূর থেকে দেখে চলেছি তোমারই সংস্কৃতির ধারা বয়ে নিয়ে চলেছে তোমার ছেলেমেয়েরা। একটা ভালোলাগা ছুঁয়ে যায় বুকের নিভৃত কোণে।
আবীর মেখে বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে। দূরে মহিলারাও আনন্দ ভৈরবীতে। সবই ঠিকঠাক আছে। শুধু কোথায় যেন এক নীরব অভিমান! এতো কিসের তাড়া ছিল তোমার? সারা জীবন হাতে হাত বেঁধে বেঁধেই তো সব কাজ করেছিলাম। তবুও তুমি.....
একটা পলাশ ফুল টুক করে ঝরে পড়লো গায়। সাদা পাঞ্জাবিতে লাল রঙ আমাকে যেন রঙীন করে দিয়ে গেল। হয়তো এ তোমার বসন্ত উপহার। কান্না ভেজা চোখে ফুলটা আকাশের দিকে তুলে গেয়ে উঠলাম তোমারই প্রিয় গানটা:" রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও/ যাও গো এবার যাবার আগে।"

 

                

************************************************************************************************


দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 

 রয়েল কমপ্লেক্স ,কাঠালবাগান ,উত্তর পাড়া, হুগলী থেকে লিখছেন পেশা: শিক্ষকতা ,নেশা : কলম চারিতা ,সাপলুডো খেলা শব্দ নিয়ে ,অণুগল্প ,ছোট গল্প ,কবিতা, প্রবন্ধে  সুখ-দুঃখ ,হর্ষ-বিষাদ, আড়ি ভাবের অনুভবে থাকা ,জীবনের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের আদর্শ মনন, যাপন ও শীলনে.. স্বপ্ন: পৃথিবীকে ভালবাসার যৌথ খামার বানানো..দিক চক্রবালে হিরণ্যগর্ভ আলোর খোঁজ ..পাখি ,গাছ আকাশের সাথে মন কি বাত.. সূর্যের নরম আলোয় সুখের আবিরে মানুষের সাথে হোলি খেলা..