বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

অণুগল্প * সুমিতা পয়ড়্যা



ণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----


সবলার অমৃতযোগ

সুমিতা পয়ড়্যা


শ্রাবণের অঝোরধারায় আকাশটা যেন ভেঙ্গে পড়েছে। ঘন জঙ্গলের বড়ো বড়ো গাছগুলোও আশ্রয় দিতে অপারগ। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তলপেটটা খামচে ধ'রে, ঝিমলি কোঁকাচ্ছে।

নিবিড় ভালোবাসার এই উপহার জংলী সমাজেও ব্রাত্য। অনেক বাধা, চোখরাঙানি অতিক্রম ক'রেও বুঝি শেষরক্ষা হ'লো না! কিংকর্তব্যবিমুঢ় ঝিমলিকে, চিরশান্তির আশ্রয় দিতে বুনো নদীটাই একমাত্র ভরসা! যত উত্তালই হোক-না-কেন, নদী তো আর উঠে আসবে না! তার আঁচলের তলায় তো, যেতেই হবে!

হঠাৎ, জল-কাদা-অন্ধকারেই এক আত্মঘোষণা...

"নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকাষর হে বিধাতা?"স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই প্রশ্ন বাণী মানসিকভাবে চিরস্বাধীন ঝিমলির  বজ্রকন্ঠে আকাশে বাতাসে নিনাদিত হয়ে উঠল। আপন অস্তিত্ব সাগৌরবে সকল বিরুদ্ধ শক্তিকে দলিত করে মাথা উঁচু করে যে দাঁড়াতে পারে সময়ের সাথে, পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সে প্রতিকূল পরিবেশেও আপন অস্তিত্ব স্বগৌরবে জানান দেয়।

ঝিমলি আজ অল্প বয়সী বিধবা। উত্তাল যৌবন, সুন্দরী, মোহময়ী ব্যক্তিত্ব সম্পন্না নারী। যে নিজের জীবন পিপাসাকে বিলিয়ে দিয়েছিল সুখের ঘরে--তার আদর্শ সৎ ভালো মানুষ বিমলদার হাতে।যে তার জীবনে এক ঝলক সতেজ বাতাস বয়ে এনে দিয়েছিলেন। দুজনে দুজনের প্রেমে পাগল ছিল আর তারই সন্তান ঝিলিকের গর্ভে ভালোবাসার উপহার স্বরূপ।

হঠাৎ এক দমকা ঝড় এসে সব কেড়ে নিয়ে গেল। সেদিন সকাল থেকে সে কি বৃষ্টি! যেন বৃষ্টির মহোৎসব! চারিদিকে বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। প্রলয় তান্ডবে মনে হচ্ছিল বিধাতা নিজ সৃষ্টির ওপরেই ভীষণ ক্ষুব্ধ। প্রকৃতি যেন ধ্বংসলীলায় মেতেছে। সম্পূর্ণ অচেনা পৃথিবী। প্রচন্ড আক্রোশে সব যেন তছনছ।

হঠাৎ এক আর্তস্বর!

বাতাসের আওয়াজে তা বারবার পরাজিত হচ্ছিল।

ক্ষীণ আকুল চিৎকারে মনে হচ্ছিল ছুটে যাই কিন্তু ঝিমলি ও নিরুপায়। সে এখন গর্ভবতী। এই অবস্থায় বাইরে বেরোনোটা ঠিক হবে না। অথচ সেই আর্তকন্ঠ শুনে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। অস্পষ্ট প্রকৃতির আলোর ঝিলিকে দেখলো তার বিমল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বাড়ির উঠোনে। পাশের বাড়ির মানুষের চিৎকার জানান দিল--বাজ পড়ছে। আর তার ফলে এমন ঘটনা।

চারিদিকে মানুষের কথাগুলোতে শিউরে উঠল ঝিমলি। সেদিন কার কতটুকু ক্ষতি হয়েছিল ঝিমলির জানা নেই তবে ঝিমলির সব রঙ অস্পষ্ট হতে হতে ভোরের পূব দিগন্তে পাড়ি দিয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তারপর হঠাৎ প্রকৃতি শান্ত হয়ে এলো।

ভোরের আলো ফুটেছে। মন্দিরে বাজছে কাঁসর ঘন্টা। শঙ্খ নিনাদে ঘোষিত হচ্ছে মঙ্গলময়ের মঙ্গল বারতা।

এদিকে ঝিমলি কোঁকাচ্ছে দেখে আশ্রয়দাত্রীমা ডাকছেন, কি হয়েছে মা? কোন কষ্ট হচ্ছে? তেমন হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ঝিমলি ওঠ।ওঠ মা। 

দেখ কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। ঝিমলি উঠলো; দেখল আকাশ পরিষ্কার; ঝলমলে রোদ্দুর।

প্রকৃতির শান্ত রূপ দেখে নিজেকে মনে হল পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ।

তাহলে আজ সবটাই কি স্বপ্ন দেখছিল! 

সেদিন তো---

তার ভালোবাসা ছিল বিমল;  কখনো তো তেমন খারাপ কিছু হয়নি! 

হাজারো প্রশ্নের মধ্যেও 

মনের ভেতর একটা আনন্দের অনুভূতি উপলব্ধি করল---স্বপ্নে বিধাতার কাছে রবি ঠাকুরের ভাষায় আত্ম ঘোষণা---যা এখন তার সম্পূর্ণ নিজের কথা। কারণ তার ভালোবাসাকে নিয়ে অনেক পথ চলতে হবে যে!











***********************************************************************************   



সুমিতা পয়ড়্যা (দে)

জন্ম এক সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারে। পিতা:  শান্তি পদ দে; মাতা: পারুল রানী দে। পিতা-মাতার আদর্শে আদর্শিত হয়ে এক বোন আর এক ভাইকে নিয়ে বড় হয়ে ওঠা।  রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এম-এ; বি-এড। ছোট্ট থেকে কবিতা বলার প্রতি এক অদম্য ঝোঁক ও ভালোবাসার "কাব্য নন্দন" আবৃত্তি শিক্ষা কেন্দ্র ছাড়াও  প্রথম গল্পগ্রন্থ "দৃষ্টিপাত"(২০২১) প্রথম কাব্যগ্রন্থ"অন্তরে বাহিরে"(২০১৯); "কবিতায় অভিযান"(২০২১)এবং "যে আঙ্গুল ছুঁয়েছিল তোমার হাত"(২০২৩)একক অনবদ্য সৃষ্টি যা পাঠকের কাছে সমাদৃত। এছাড়াও লেখকের গল্প গ্রন্থ 'সম্পূর্ণ বলয়'(২০২৩); 'অমৃতের দুনিয়া'(২০২৪)। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন