সাধুসঙ্গে পুণ্যকথা
(শ্রীমৎ স্বামী বিশুদ্ধানন্দজী মহারাজের পুণ্যস্মৃতি)
প্রব্রাজিকা বিশ্বপ্রাণা
কাশীতে অন্যান্য দিনের কথা
অক্টোবর, ১৯৫৭
(১)
মহারাজ - সাধুর রাগ জলের দাগ। সবই ওপরে, তাঁদের ভেতরে কিছু থাকে না। একবার এই কাশীতেই চারুবাবুকে মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) কি একটা কারণে কী ভয়ানক বকলেন! Constant বকুনি, একেবারে যাচ্ছেতাই ভাবে। কিছুতেই আর থামেনই না। তখন মহারাজের সেই মূর্তির সামনে তো কিছু বলা চলে না! কয়েকদিন পরে মহারাজের mood যখন ভাল ছিল তখন তাঁকে বললাম, -'মহারাজ, সেদিন যেমন চারুবাবুকে বকলেন, আমি কোনদিন ঐরকম দোষ করলে আমাকেও তো ঐরকমই বকবেন? আর আপনাদের ঐ বকুনি তো আমাদের কাছে অভিশাপস্বরূপ, মহা অকল্যাণ তাতে। কি উপায় তাহলে আমাদের? মহারাজ তখনই জিব দেখিয়ে আর বুকে হাত দিয়ে মাথা নেড়ে আমাকে এই বুঝিয়ে দিলেন, -'আমরা যা বকাবকি করি তা শুধু আমাদের মুখেরই, অন্তর থেকে করি না। তাতে কোন ভয় নেই, কোনও অকল্যাণ হবে না।'
ছেলেবেলায় মহারাজের কাছে যখন থাকতাম, তখন দেখ কী সুন্দর ভাবটা আমার ছিল -সামান্য গামছাখানাও যে মহারাজ নিজে-হাতে টেনে নেবেন তাও আমার ভাল লাগত না। আমার তখন মনে হত -আমি তো কাছে রয়েছি, তবে কেন উনি নিজেই নেবেন গামছাখানা! ওঁর কখন কি দরকার হবে এই ভেবে ওঁকে ছেড়ে আমি একদন্ডও থাকতাম না, জপ-ধ্যানও করতাম না। মহারাজ জিজ্ঞেস করতেন, -'ধ্যানজপ করনা?' আমি বলতাম, -'না মহারাজ, ভাল লাগে না।' তার মানে আপনাকে ছেড়ে যেতে ভাল লাগে না -এই আর কি। মহারাজ তবু জোর করে জপ-ধ্যান করতে পাঠাতেন। ধ্যান করবার জন্য ভোরবেলা নিজেই উঠিয়ে দিতেন।
(২)
মহারাজ - একদিন আমি পুরোনো ঠাকুর-মন্দিরে বসে জপ করছি। এদিকে মহারাজের কাছে গেঁয়োখালির দেবেন ধাড়া নামে একজন ভক্তের ছেলে এসেছে। ওদের অনেক জমিজমা। মঠে প্রচুর ধান দিয়ে সাহায্য করত। ছেলেটি এসে ধরেছে -'মহারাজকে ওদের দেশে নিয়ে যাবে। তখন মহারাজ ওকে শিখিয়ে দিলেন -দেখ, ওপরে মন্দিরে বসে একটি সাধু জপ করছে, নিচে নামলেই তার পায়ের তলায় সাষ্টাঙ্গ হয়ে পড়বি আর বলবি, -'মহারাজ, দয়া করে আমাদের বাড়িতে আপনার পায়ের ধুলো দিতে হবে।'
আমি নিচে নামতেই তো ছেলেটি সাষ্টাঙ্গ হয়ে আমার পা জাপটে ধরেছে। কিছুতেই ছাড়বে না। মহারাজও তাকে support করছেন। আমি তখন মাছ খেতাম। মহারাজ বলছেন, -'জান, ওদের দেশে খুব ভাল কইমাছ পাওয়া যায়। এত করে ধরেছে যখন, যাও না ওর সঙ্গে।' আমি তখন বললাম, -'মহারাজ, আপনি যদি আদেশ করেন, তাহলেই যাব।' তারপর ওদের বাড়িতে কিছুদিন থেকে আমি ফিরে এসেছি।
গেঁয়োখালি যাওয়ার আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমি দক্ষিণ দেশীয় এক ভক্তকে একদিন দক্ষিণেশ্বর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি রামলালদাদার নাম শুনে রামলালদাদাকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। আমি তাতে বলেছিলাম, -'ভালই তো, আপনার দেওয়ার ইচ্ছা হয়েছে দিন।' এইকথা পরে মহারাজ শোনেন -আর শুনেই ওঁর ধারণা হল যে, আমিই রামলালদাদাকে টাকাটা পাইয়ে দিয়েছি। শুনে তো আমার ওপর উনি খুব রেগে গেলেন। ঠাকুরের সংসারে যাতে ভদ্রলোক টাকাকড়ি দেন, আমি সে চেষ্টা না করে রামলাল দাদাকে টাকাটা পাইয়ে দিলাম -এইজন্য রাগ। যাই হোক আমি তো গেঁয়োখালি থেকে ফিরেছি। ফিরে মহারাজকে গিয়ে প্রণাম করলাম। মহারাজ খুব গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। আমার সঙ্গে কোন কথাই বললেন না। শুধু বললেন, -'যাঁর নুন খাই, তাঁর গান গাই।' আমি আর তখন কি করি! শরৎ মহারাজ ছিলেন, তাঁর কাছে গেলাম। শরৎ মহারাজ বললেন, -'যাও মহারাজের জন্য একটু প্রসাদ নিয়ে তাঁর কাছে যাও।' আমি তাই করলাম।
(৩)
কাশীতে মহারাজের মুখে রাঁচির কথা:
মহারাজ - কুচবিহারের রানি, কেশব সেনের মেয়ে সুনীতি যখন রাঁচিতে ছিল তখন প্রায়ই আমার কাছে আসত। আমাকে ভালবাসত খুব। একদিন বললেন, -'তোমাকে আমাদের বাড়ি যেতে হবে।' আমি তো মহাবিপদে পড়লাম। একে বড়লোকের বাড়ি, তার ওপর আমি ওখানে গেলেই তো আমাকে ধরে ওর বিলেতের গল্প শোনাতে আরম্ভ করবে। আমি বললাম, -'আপনার বাড়িতে যাওয়ার আর কি দরকার! আপনি এখানে আসেন, দেখা হয়, এই তো বেশ।' কিছুতেই ছাড়বে না। অগত্যা একদিন যেতে হল। কিন্তু আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, কিছুতেই ওকে বিলেতের গল্প শোনাতে দেব না। সঙ্গে একখানা কথামৃত নিয়ে গেলাম। তারপর ঘরের মধ্যে বসে যেই বিলেতের গল্প আরম্ভ করেছে, আমি অমনি একটু পরে বললাম, -'দেখুন আমি একটা বই নিয়ে এসেছি, এর মধ্যে আপনার বাবার অনেক প্রসঙ্গ আছে। একটু পড়ে শোনাব কি?' তখন আর আপত্তি করে কি করে! বললে, -'হ্যাঁ, তা বেশ তো, শোনাও না।' তারপর আমি ঝাড়া চল্লিশ মিনিট ধরে কথামৃত পড়লাম। কেশব সেন যে স্টিমার-পার্টিতে ঠাকুরকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ঘটনা পড়লাম। সেখানে এক জায়গায় আছে, কেশব সেন ঠাকুরকে প্রনাম করে বিদায় নিচ্ছেন। এইটুকু শুনেই সুনীতি বলে উঠল, -'আচ্ছা, এই বই যিনি লিখেছেন তিনি কি বেঁচে আছেন? তাঁর ঠিকানা কি? আমি তো বাবাকে কোনদিন রামকৃষ্ণদেবকে প্রণাম করতে দেখিনি!' আমার কাছে কথামৃতের অন্যত্র এর প্রমাণ ছিল। কিন্তু তখন মনে এলনা বলে আর বলতে পারিনি, মষ্টারমশায়ের ঠিকানা দিলাম। পরে কলকাতায় গিয়ে প্রথমেই একেবারে মাষ্টারমশায়ের কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, -'সুনীতি দেবীর কি উত্তর দিয়েছেন?' মষ্টারমশাই বললেন, -'এ তো খুব সোজা। আমি লিখলাম: তুমি দেখনি বলে তো আর এটা মিথ্যে নয়।! আমি নিজের চোখে কতবার দেখেছি। আর শুধু আমি কেন, আরও কত লোক দেখেছে।'
********************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন