ধুলোর সিংহাসন
পর্ব * পাঁচ
দেবাশিস সাহা
(পূর্বানুষঙ্গ : বৈশাখী দুর্যোগ শেষ হলে অশোক কোচিং ছুটি দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ায়। মাথায় ঘুরতে থাকে দু'কিলো চাল আর একটা সরষের তেল নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। স্ত্রী অলি মেয়েকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিল। কিন্তু পথে বেরিয়ে ঝড়ে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ,দোকানপাট ,শিকড় বাকড়সমেত উল্টে পড়া গাছপালা দেখতে দেখতে কী যেন হয়ে যায় অশোকের ভিতরে.....কল্পনায় সে দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে মৌর্য সম্রাট অশোক,মুহূর্ত পরে সম্রাট হর্ষবর্ধন। তাঁদেরকেই সে নিজের সামান্য প্রার্থনাটুকুর কথা জানায়। সম্বিৎ ফিরতে তারপর ধীর পায়ে পৌঁছয় ফ্ল্যাটে।)
 |
|
ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে পা দিতেই অশোক শুনতে পেল অলির চিৎকার। অলি চিৎকার করছে ! কিন্তু কার সঙ্গে, কেন ? অবাক হয় অশোক। এই ফ্ল্যাটটা তো এমনিতেই বেশ নি:ঝুম। স্ট্রেট থ্রি ফ্ল্যাট। লিফট নেই। গ্যারেজ নেই । দোকানপাট কিছুই নেই। সেই জন্য দামটাও পড়েছে কম। তিন হাজার টাকা স্কোয়ার ফিট। না হলে মেইন রোডের উপর সাড়ে তিনের কম ফ্ল্যাট পাওয়াই দুষ্কর। প্রত্যেক ফ্লোরে দু'টো করে মোট ছ'টা ফ্ল্যাট। একটা টু বেড রুম,ছ'শো স্কোয়ার ফিটের। আর একটা সিঙ্গেল ,চারশো স্কোয়ার ফিটের। নাম 'সরস্বতী অ্যাপার্টমেন্ট'। নামের সঙ্গে ফ্ল্যাটটার সাদৃশ্যও যথেষ্ট। তিনতলায় অশোক যেমন কোচিং-এ থাকার সময়টুকু বাদে সব সময় নিজের লেখালেখি,পড়াশোনা নিয়ে থাকে, তেমনই দোতালায় থাকেন এক অধ্যাপক দম্পতি। গ্রাউন্ডে ল্যান্ড ওনারদের ফ্যামিলি। বড় ছেলে মানিক চ্যাটার্জী ইঞ্জিনিয়ার আর ছোট ছেলে বাসুদেব কাপড়ের ব্যবসায়ী। সবার সঙ্গেই সবার মিলমিশ। কারও সঙ্গে কারও মন কষাকষি নেই।
তিনতলায় অশোকদের ঠিক উল্টোদিকের ছোট ফ্ল্যাটটাতে থাকে রনির মা। সারাদিনই প্রায় একা। রনির বাবা বছর চল্লিশের পার্থ রায় ব্যাংক এমপ্লয়ি। শান্ত মার্জিত রুচিশীল ভদ্রলোক। রনির মা-ও খুব মিশুকে। আর রনির তো কথাই নেই। ফাঁক পেলেই দৌড়ে চলে আসে উপমার কাছে। দু'টিতে মিলেছেও বেশ। উপমা ওকে মাঝে মাঝেই বলে,' আমার তো ভাই নেই, তুই আমার ছোটভাই, বুঝলি?' রনি ঘাড় কাত করে সায় দেয়, ' হ্যাঁ পমাদি।' উপমার 'উ' ঝরিয়ে ও ইতিমধ্যেই নির্মেদ করেছে 'পমাদি' সম্বোধনে।
অশোক আবার 'উ' এবং 'প' দুটোই ঝরিয়ে প্রায়শই ' মা ' বলে ডাকে উপমাকে।বড়দি অপর্ণা এলে 'প' উধাও হয়ে উপমা হয়ে যায় 'উমা'। 'উমা বল কেন পিসি? '
' উমা মানে কি জানো?'
'দুর্গা।'
' বা: ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লেও বাংলায় দেখছি তোমার ভালই নলেজ । 'উমা' ডাকি তার কারণ, তোমার বাবার তো কোনও ছেলে নেই। তোমাকেই বড় হয়ে বাবা-মার পাশে দাঁড়াতে হবে দশভুজা হয়ে, মা দুর্গার মতো।
' কী অশোক, আজ ফিরতে দেরি হল, মনে হচ্ছে?' গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরের মানিকদা সিগারেট টানতে টানতে বললেন ।
' হ্যাঁ দাদা, যা ঝড় ঝাপটা গেল! ' বলেই অশোক সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে।
' অশোক, এক মিনিট,এক মিনিট ' একটু এগিয়ে এসে পিছন থেকে ডাকেন মানিকদা।
'হ্যাঁ দাদা ' থমকে দাঁড়ায় অশোক।
' তোমায় একটা কথা বলি, দেখো, আজকের ঝড়ে সুরবাড়ির নারকেলগাছটা আমাদের ফ্ল্যাটের কার্নিশে এমন ধড়াস ধড়াস করে ঘা মারছিল, মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ভিতটাই নড়ে গেল । নতুন ফ্ল্যাট ক্ষতি হয়ে গেলে দায় কে নেবে বলো। ’
' ঠিকই তো। ' অশোক সায় দেয় বটে, কিন্তু ওই পর্যন্ত ,ওর মন তিনতলায় অলির চিৎকার শুনতে পাচ্ছে। অশোক হু হা কিছুই করছে না দেখে মানিকদা বললেন, ' তোমাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছি না তো?
' না না, ঠিক আছে,বলুন না।'
' চলো , কালই আমরা সবাই মিলে সুরবাবুকে নারকেলগাছটা কাটার কথা বলি। '
'ঠিক আছে, চলুন।'
' তুমি একটু রনির বাবাকে ব্যাপারটা বলে দিও।'
'দেবো।'
ক্রমশ চিৎকারটা বাড়ছে যেন। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে এল অশোক। দেখে দরজা খোলা। রনি,রনির মা দাঁড়িয়ে। অলির চুল উস্কোখুস্কো,চোখমুখ লাল,রাগে গজগজ করছে। অঝোরে কাঁদছে উপমা। ওর হাত ধরে রনি বলে চলেছে ' পমাদি, কেঁদো না, কেঁদো না।' অলিকে বোঝাচ্ছে রনির মা, ' দিদি শান্ত হও, উপমা খারাপ মেয়ে নয়, ও কত ভালো আঁকে,গান গায় ,বাবার মতো কবিতাও লেখে।’
' ছাই গায়, কী হবে ওই আঁকায়,গান গাওয়ায়, যদি না বাবা-মায়ের কথা শোনে? '
' শুনবে না কেন দিদি,শুনবে , বয়সটাও তো ওর দেখতে হবে। এই বয়সে ওরকম ভুল একটু-আধটু হয়েই থাকে।'
কী রকম ভুল! কী ভুল করেছে উপমা, অশোক বুঝতে চেষ্টা করে। এখনও কেউ ওকে দেখতে পায়নি।অশোক শুনতে পাচ্ছে ,অলি বলেই চলেছে ' জুঁই ,তুমি জানো না, ওর বাবা মেয়ের জন্য দু'বেলা রক্ত জল করে ফেলছে। নিজের শখ-আহ্লাদ সব জলাঞ্জলি দিয়েছে। যখন যেটা বলছে, নিজে খাক না খাক এনে দিচ্ছে। যে মোবাইল নিয়ে এত কান্ড, সেই মোবাইলটা কিনে দিল গত মাসেই। কেন? না, মেয়ে কলেজ যায় টিউশন-ক্লাসে যায় কখন ফেরে না ফেরে খবরাখবর নিতে সুবিধে হবে। মেয়ে বলতে তো একেবারে অজ্ঞান। দু'মিনিট আসতে দেরি হইলেই ,এখনো আসছে না কেন এখনো আসছে না কেন করে মাথা একেবারে খেয়ে ফলবে। হাতে পয়সা নেই,তাও পাড়ার কোয়াপারেটিভ থেকে ধার করে কিনে দিলো ।'
কথাগুলো বলতে বলতে রনির মায়ের দিকে একটু এগিয়ে আসে অলি আর ঠিক তখনই চোখে চোখ পড়ে যায় অশোকের। সুর আরও চড়িয়ে বলতে থাকে , 'শোনো তোমার গুণধর মেয়ের কীর্তি শোনো।'
কী হয়েছে কী, এত চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন? নীচতলা থেকে তোমার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী?
অশোককে দেখতে পেয়ে রনির মা বলে, ' অশোকদা, অলিদিকে সামলান। খুব রেগে আছে। রনি, আয় বাবা ,আঙ্কেল এসে গেছে, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যাই ।'
ওরা চলে যায়। রনি সবাইকে টা- টা করতে থাকে।
অশোক ঘরের দমবন্ধ করা পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় উপমার দিকে। উপমার তখনও চোখ ছল ছল। জল পড়ছে টপটপ করে। অশোক আস্তে করে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, ' কী হয়েছে রে ,মা ? '
' কিছু না ' বাবার স্নেহস্পর্শে ছল ছল চোখ এবার বর্ষার ময়ূরাক্ষী।
পাশ থেকে ফুঁসে ওঠে অলি, অশোক আসার আগেই উপমার মোবাইলটা কেড়ে নিজের জিম্মায় রেখেছিল। সেটা এখন অশোকের সামনে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলতে থাকে, ' দেখো, পড়তে বসে কানে হেডফোন গুঁজে কথা বলেই চলেছে। একবার এসে বারণ করে গেলাম। কুড়ি তারিখ পরীক্ষা ,মোবাইল রেখে একটু মন দিয়ে পড়। ওমা, একটু বাদেই দরজার আড়াল থেকে দেখছি যে কে সেই ! কথা বলেই চলেছে। এক সপ্তাহ বাকি নেই পরীক্ষার! কার মাথা ঠিক থাকে? দু'ঘা দিয়ে তাই মোবাইল কেড়ে নিয়েছি। বলেছি,পরীক্ষার পর ফেরত পাবি আর তাতেই এত কান্না!
' আর কিছু না? ' অনুযোগ উপমার ' তুমি আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাকাওনি?' বাবার বুকে মাথা রেখে ফের কান্না।
অশোক মেয়ের পক্ষ নিয়ে বলে, ' আচ্ছা একটু না হয় কথা বলেইছে, তুমিই বা ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়েছ কেন? ও কি বাচ্চা মেয়ে, মেরে ধরে ওকে পড়াতে পারবে, যদি না ও মন থেকে পড়ে। '
' ঠিকই তো ' উপমার মুখে হাসি ফোটে।
' হ্যাঁরে মা, তুই যখন রনিকে নিয়ে কোচিং-এ গেলি, আমি তোকে পল সায়েন্সের দুটো উত্তর মুখস্ত করতে বলেছিলাম, সেটা রেডি হয়েছে?'
' হ্যাঁ ' চোখের জল মুছতে মুছতে বলে উপমা।
'গুড' অলির দিকে ফিরে যোগ করে, ' তবে তুমি অত রাগছ কেন, ওর পড়া তো ও করেইছে।'
' ছাই করেছে,ধরেই দেখো' মা-র দিকে আড়চোখে তাকায় উপমা।
' হ্যাঁ সে তো দেখবই, তার আগে ওর মোবাইলটা ওকে দিয়ে দাও দেখি।' এইবার উপমা হেসে ওঠে।
অশোকের কথামত মোবাইলটা উপমার সামনে রেখে অলি বলে, 'মোবাইলের শোকে চোখে বান ডেকেছিল, এইবার হাসি ফুটেছে।'
ঘরের আবহ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।
' না-ও, তুমি প্যান্ট জামা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।'
' খাবার রেডি ?'
'কী করে রেডি হবে ? তোমায় যে চাল আর সরষের তেল আনতে বলেছিলাম ...?'
'কী করে আনব, যা ঝড় উঠল, যারা টাকা দেবে ভেবেছিলাম,তারা কেউ পড়তে আসেনি। ধারে যে আনব, তা মেজদার দোকানও বন্ধ। ' একটু থেমে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, 'একদম নেই অলি?এবেলাটা ম্যানেজ করতে পারবে না? '
' ঠিক আছে,তোমার অত চিন্তা করতে হবে না।' কী একটা ভেবে নিয়ে বলে অলি ,' তুমি মেয়েকে নিয়ে বসো, আমি দেখছি।'
' চল তো মা,আমরা একটু পড়াশোনা করি।'
'এখন,এত রাতে!'
'এত রাত কোথায়রে! সবে সাড়ে দশটা বাজে মাত্র। তাছাড়া মা-র রান্নাও তো রেডি হয়নি, চল চল যারা পড়াশোনা করে, তাদের কাছে সাড়ে দশটা আবার রাত্তির নাকি!'
অশোক মেয়েকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে। 'দুটো কোশ্চেনই রেডি তো?'
'হ্যাঁ।'
'কোনটা দেব?'
'যেটা খুশি।'
' ঠিক আছে, তুই মা, জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা--- এই উত্তরটা আমাকে লিখে দেখা দেখি ,আধঘণ্টার মধ্যে। ততক্ষণে আমি ফ্রেশ হয়ে নি, মা-র রান্নাও হয়ে যাবে। তারপর খেয়ে দেয়ে তিনজনে গো টু বেড, ঠিক আছে ?
' আচ্ছা যাও ।'
দরজা খুলে অলি রনিদের কলিং বেল বাজায়। রনির মা দরজা খোলে, ' ও অলিদি! এসো ,এসো। সব মিটমাট হয়েছে তো?'
'হ্যাঁ, তা হয়েছে, তোমার কাছে একটা অন্য দরকারে এসেছি কিন্তু ।'
' কী বলো ? ' রনি-পার্থ ডিনার সারছিল। গলার স্বর খুব নামিয়ে কানে কানে বলে, ' আমাকে দু'কৌটো চাল দাও না। দেখ না,ঝড় -বৃষ্টির জন্য তোমার দাদা আনতে পারেনি।'
'এই সামান্য কথাটা বলতে তুমি এত হেসিটেট্ করছ অলিদি? কেন,আমি তোমার কাছ থেকে আলুটা পেঁয়াজটা, টান পড়লে নুন কাঁচালঙ্কা আনতে যাই না?'
'সে যাও। '
'তবে 'এসো, ভেতরে এসো, বসো আগে।'
' অলিদি, অশোকদা ফিরেছে,যা ঝড়-বৃষ্টি গেল।' ডিনারের প্লেট থেকে মুখ তুলে পার্থ জানতে চান ।
' এইতো ফিরল।'
'আমিও তো একটু আগে এলাম। রাস্তাঘাটে গাছপালা পড়ে পুরো জ্যাম। অনেক ঘুরে ঘুরে আসতে হয়েছে।' বাবাকে থামিয়ে রনির সটান প্রশ্ন,' আন্টি ,পমাদিকে আর বকোনি তো?'
' না না, তিনি এখন বাবার কাছে পরীক্ষা দিচ্ছেন। '
জুঁই একটা কন্টেনার এনে অলির হাতে দেয়। বেরোতে বেরোতে অলি বলে, ' রনি, কাল যাস কিন্তু বাবা। '
' হ্যাঁ যাব তো, তুমি বারণ করলেও যাব।' সবাই হেসে ওঠে।
আস্তে করে টিভির সুইচটা অন করে অশোক। বাড়ি ফিরে চা খেতে খেতে খবরের চ্যানেলটা চালিয়ে দেওয়া ওর বরাবরের অভ্যাস। অলি রেগে যায় ও হয়তো তখন 'এখানে আকাশ নীল' কিংবা 'সাধক বামাক্ষ্যাপা ' জাতীয় কোনও জনপ্রিয় সিরিয়ালের শেষ ডায়লগ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আজ অবশ্য সে সব রুটিন এলোমেলো। ভাত বসিয়েছে অলি। 'জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা ' লিখছে উপমা। অলির আজ যা মেজাজ এখন চায়ের কথা বললে ক্ষেপে যাবে। অগত্যা খবরেই মন দেয় অশোক ---- আজ সন্ধ্যায় প্রতি ঘণ্টায় একশ ষাট কিমি বেগে কালবৈশাখী বয়ে গেছে গোটা রাজ্য জুড়ে।সমস্ত জেলাগুলিতে লন্ডভন্ড পরিস্থিতি। গোটা কলকাতা শহর বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিল আধঘন্টার উপর। অফিস ফেরত যাত্রীরা বাড়ি পৌঁছতে নাকাল। ঘোষিকা একটু গলা চড়িয়ে সহযোগীর উদ্দেশে বলতে থাকে ,' পরমেশ ,তুমি ধর্মতলা-ডালহৌইসির এই মুহূর্তের পরিস্থিতিটা একবার দেখাও '
' দেখো মালবিকা , আজ যে ঝড়ের তান্ডব ...' ঠিক এই সময় খাতা হাতে দৌড়ে এসে উপমা বলে উঠল,
' বাবাই লেখা কমপ্লিট, দেখবে এস।'
' খাতা পরে দেখবে, রান্না হয়ে গেছে। দয়া করে খেতে এস, বাপ-বেটিতে।' কিচেন থেকে হাঁক পাড়ে অলি।
টিভির ঘর থেকে বাবার হাত ধরে টানতে টানতে ডাইনিং-এ নিয়ে আসে উপমা। তারপর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ' কী রান্না করলে, মা?'
' কী আবার, তোমার প্রিয় খাবার, বাটার আলু সিদ্ধ ভাত আর ডিমভাজা। এত রাতে আবার কী রান্না করবে, গলা জড়িয়ে ধরলি যে বড়। মা তো খারাপ,খালি বকে মারে, তা মোবাইলের শোক মিটেছে?'
' হ্যাঁ ' বেশ বড় করে টেনে কথাটা বলল উপমা।
' দেখ মা, মায়ের কথায় রাগ করবি না। মা তো ভালোর জন্যই বলে। কদিন বাদেই পরীক্ষা,মন দিয়ে পড়াশোনাটা কর, এই কটা দিন।'
অশোকের কথা শেষ হতে না হতেই অলি যোগ করে, ' দেখিস না বাবার শরীর কি আর আগের মত আছে, একটুতেই হাঁপিয়ে পড়ে।তোর বাবার তো সরকারি চাকরি না, পেনশনও পাবে না। বুড়ো বয়সে দেখবে কে , তুই একটা চাকরি বাকরি পেলে----'
'আমি ছাত্র পড়ানো ছেড়ে দেব, তুই সংসার চালাবি , তোকে তো কতবার বলেছি, দেখ মা আমাদের ছেলে নেই, তুই -ই আমাদের ছেলে,তুই আমাদের মেয়ে। তুই আমাদের না দেখলে, কে দেখবে বল!'
' হ্যাঁ রে বাবা, বুঝেছি বুঝেছি। '
'পাক্কা বুড়ি আমার মাঝে মাঝে মাথা বিগড়ে যায় ' উপমার মাথায় স্নেহস্পর্শ বুলায় অশোক -অলি।
' যাও , এবার বিছানাটা করোগে, বারোটা বাজে প্রায় ।'
সারাদিনে উপমার এই একটাই কাজ, বিছানা করা। এছাড়া অলি ওকে কোনও কাজই করতে দেয় না ,পাছে পড়াশোনার ক্ষতি হয়।না,চা করা, না,বাসন মাজা, ঘর ঝাড় দেওয়া কোনও কিছুই অলি উপমকে করতে দেয় না। নতুন ফ্ল্যাটে এখনও খাট কেনা হয়নি। বড় বেডরুমটাতে বিছানা করে তিনজন একসঙ্গে মেঝেতে শোয়। মাদুরের ওপর তোষক পেতে চাদর পাটপাট করে সুন্দর বিছানাটা করে উপমা। এই একটা কাজই উপমাকে করতে হয়।
বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে উপমা শুয়ে পড়ে। আজ ওয়েদারটা ঠান্ডা ঠান্ডা। তবুও ফ্যান ফুল ফোর্সে চালিয়ে গায়ে একটা চাদর দিয়ে নেয়। অশোকও শুতে যায়। কাজটাজ সেরে লাইট অফ করে অলি শোয় সবার শেষে।
' তোমার চাদর লাগবে না?
' না। ' শুলেও ঘুম আসে না অশোকের।
' উপমা এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল?'
' ঘুমোবে না, তুমি যা কাঁদিয়েছ,তাছাড়া রাতও কি কম হল?'
'আমি কাঁদিয়েছি! মেয়ের কোনও দোষ নেই?'
'থাকবে না কেন,নিশ্চয়ই আছে,তাই বলে সব সময় চিৎকার চেঁচামেচি করবে, ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা ওর সামনে আছাড় মারবে?দোষ করলে বুঝিয়ে বল,বড় হয়েছে তো নাকি।'
'আচ্ছা বাবা আমারই দোষ,মেয়ের কোনও দোষ নেই। এত মেয়ে মেয়ে কর তো বুঝবে একদিন। খালি লাই দেওয়া। একটু শাসন করা নেই।'
'চুপ কর তো, ঘুমাতে দাও।'
অশোক পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে। কিন্ত ঘুমোতে চাইলেও ঘুম আসে না। নানান চিন্তা মাথায় ভিড় করে আসে। কাল সকালে কাদের ক্লাস আছে যেন,ও প্রথমে এইট ছটা থেকে আটটা তারপর নাইন আটটা থেকে দশটা।ওদের মুখগুলো ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। ওরা অনেকেই এখনও মাইনে দেয়নি ,কাল নিশ্চয়ই দেবে কেউ কেউ। কেন যে বড় ফ্ল্যাটটা নিতে গেল! ছোটটা নিলে এতটা দেনায় পড়তে হত না।এখন রনিরা যে ছোট ফ্ল্যাটটাতে থাকে, অশোক ওটাই নিতে চেয়েছিল। উপমাই বায়না ধরল, 'বাবাই বড়টা নাও না,আমার একটা আলাদা ঘর থাকবে আর তোমারও একটা। ড্রইংরুমটা তুমি উপরের দিকে বইয়ের তাক বানাবে ভালো করে। নীচে তোমার পড়ার টেবিল আর একটা সোফা । তোমার বন্ধুবান্ধব এলে ওখানে বসবে। যুক্তিটা অকাট্য। কিন্তু টাকা টাকা আসবে কোত্থেকে? অলিও সায় দিল উপমার দিকে। আর ঠিক এই সময়েই কুড়ি বছর টার্মের এল আই সিটা ম্যাচিওর করল। এগিয়ে এল প্রোমোটারও। ভরসা দিল, 'অ্যাডভান্সটা করুন না, তারপর দেবেন না হয় আস্তে আস্তে। আমি আপনি তো একই পাড়ার লোক। আমিও আপনাকে চিনি, আপনিও আমাকে চেনেন। কেউ কারও টাকা মারব না।'
রাজী হয়ে গেল অশোক। এলআইসি থেকে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে অ্যাডভান্স করল। ছশো স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটের দাম আঠার লাখ টাকা। তার মধ্যে পাঁচ লাখ দেওয়া হল, বাকি তের লাখ টাকা আসবে কোত্থেকে? অলিই দশভূজা হল। সাহস জোগাল, 'আমি তোমাকে তিন চার লাখ টাকা জোগাড় করে দেব।'
'কোত্থেকে?'
'দেখ পঁচিশ বছর ধরে আমার গয়নাগাটিগুলো তো আলমারিতেই পড়ে আছে, ওগুলো বিক্রি করে তিন চার লাখ টাকা পাব না, কী গো?'
'তাই হয় নাকি?' অশোক থম মেরে যায়।
'দেখ, ওই ভাঙা ঘরে আর কতকাল কাটাব। তুমি অমন করো না। উপমাও তো একদিন চাকরি-বাকরি করবে। জমানো টাকাগুলো দুই বছর পর ম্যাচিওর করলে তখন না হয় আবার কিনে দেবে।'
অলির আগ্রহ দেখে শেষমেশ অশোক বলে ফ্ল্যাট যখন নেবেই তাহলে ছোটটা নাও।বারো লাখে হয়ে যাবে। পাঁচ লাখ তো হাতেই আছে।তোমার ওখান থেকে কম করে তিন লাখ তো পাবোই আর লাখ চারেক টাকা ছোটখাট একটা লোন নিয়ে নেব না হয়। লোন যদি না পাই ফিক্সড ডিপোজিটগুলোই ভেঙে দেব।
' না দেখো , ছোটটা নিলে কী করে হবে?ভবিষ্যৎ বলে তো একটা কথা আছে। উপমাকে তো একদিন বিয়ে দিতে হবে। মেয়ে-জামাই থাকবে কোথায়, শুনি?
অশোক আর অমত করতে পারেনা।রাজি হয়ে যায়।কিন্তু একটা পার্মানেন্ট চিন্তা ঢুকে যায়,তেরো লাখ টাকা কীভাবে জোগাড় করা যাবে,অলির গয়নাগাটি বিক্রি না করে।
শুরু হল লোন পাওয়ার লড়াই। প্রথমে সরকারি ব্যাংকের দরজায় দরজায়। সব শুনে ব্যাংক বলল, 'পে স্লিপ দেখাতে পারবেন?' অশোকের যা জীবিকা 'পে স্লিপ' কী করে দেখাবে, একটা সরকারি ব্যাংক অবশ্য বলল, পে স্লিপ না হলেও চলবে, তবে আপনাকে দু'বছরের আই টি ফাইল দেখাতে হবে। আই টি ফাইল? আই টি ফাইল করার কথা অশোক তো কোনদিন ভাবেইনি। দরকারও পড়েনি।
'আইটি ফাইল দেখালে লোনটা পাব?' অশোক জানতে চাইল।
'আপনি ওটা দিলে আমরা ফাইলটা প্রসেসিংয়ের জন্য হেড অফিসে পাঠাব।’ অশোক বুঝল কোনও নিশ্চয়তা নেই। হতেও পারে, না-ও পারে। তবু আশায় বাঁচে চাষা। উঠে-পড়ে লাগল আই টি ফাইল তৈরি করতে। খুঁজে পেতে জোগাড় করল আই টি ফাইল করার লোক। ফাইল তৈরিও হল ,জমাও দিল।
কিছুদিন পর ব্যাংক জানাল, ' সরি ,আপনার লোনটা হল না।'
'কেন?'
হেড অফিস জানিয়েছে,সেম ডেটে দু'বছরের আইটি দেখালে চলবে না। এক বছর গ্যাপ চাই। একটু ভেবে নিয়ে অশোক বলল, ' এক বছর পরে কি পাব সিওর?
'পেতে পারেন। তবে গ্যারান্টি দেওয়া যাচ্ছে না। আইটির সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্সও লাগবে, হেড অফিস জানিয়েছে।
ট্রেড লাইসেন্স? টিউশনির আবার ট্রেড লাইসেন্স? মুষড়ে পড়ে অশোক। কিন্তু হাল ছাড়ে না। চেষ্টা চালাতে থাকে। মোবাইল ঘেঁটে 'ব্যাংক বাজার ' নামে একটা ওয়েবসাইট খুঁজে বার করে। হবে না ধরে নিয়েই অ্যাপ্লাই করে দিল অনলাইনে। কী আশ্চর্য! দু'দিনের মধ্যেই রিপ্লাই এল।একটা প্রাইভেট ব্যাংকের রিপ্রেজেন্টেটিভ ফোনে যোগাযোগ করল। তারপর বাড়িতে এসে দরকারি কাগজপত্র নিয়ে গেল। সত্যি সত্যিই শেষমেষ লোনটা ওখান থেকেই স্যাঙ্কশন হল। কাউকে কিছু উৎকোচ দিতে হল না শুধু প্রসেসিং চার্জ বাবদ বারো হাজার টাকা এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্র করতে খরচ পড়ল হাজার পাঁচেক টাকার মতো..... এই সব ভাবতে ভাবতে চোখটা প্রায় জড়িয়ে আসছিল ঘুমে। এমন এমন সময় ফিসফিস করে ডাকল অলি, 'এই শোনো শোনো...’
' কী,বল না ?'
'ওই দেখো ...'
'কী? '
' উপমার চাদরের ভিতরে মোবাইল জ্বলার আলো!
' তাই তো!' বিস্মিত হয় অশোক। 'রাত প্রায় একটা গড়িয়েছে, না ঘুমিয়ে মোবাইলে... এত রাতে...কী করছে...'
অশোক আর ধৈর্য রাখতে পারে না।এক ঝটকায় উপমার গা থেকে চাদরটা সরিয়ে চিৎকার করে ওঠে, 'এত রাতে মোবাইল নিয়ে কী করছিস?' 'কিছু না বাবাই, কিছু না, হাতের চাপে জ্বলে উঠেছে।'
'হাতের চাপে জ্বলে উঠেছে? জ্বলাচ্ছি দাঁড়া।' বলতে না বলতেই এক ঝটকায় উপমার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে গায়ের জোরে আছাড় মারে মেঝেয়।
তাড়াতাড়ি লাইট জ্বালে অলি। মোবাইলের পার্টসগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে এদিক-ওদিক।
হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে উপমা।' বাবাই অন্যায় হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দাও।আর হবে না ' ততক্ষণে অশোকের মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে অক্সি-হাইড্রোজেন শিখার মতো। ওর হোমাপাখি..জন্ম-মৃত্যুর ওপারের ডাক...সবকিছু যেন মুহূর্তে গিলে নিয়েছে ক্রোধাগ্নি। ওই তো বুকের ভিতর জ্বলছে হোমাপাখির চোখ মুখ, ডানা, ওর পড়া,না -পড়া, লেখা,না-লেখা কবিতার পঙক্তিগুলো..।
মেয়েকে না বকে, না মেরে নিজের মুঠো শক্ত করে সজোরে দেয়ালে ঘুসি মারে অশোক। পরপর দু'বার। থেঁতলে যায় মাঝের দু'টো আঙুল। রক্ত ঝরে। অলি ঠেকাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।
ঘটনার আঁচে উপমা কুঁকড়ে যায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে অপরাধীর মতো। অশোক অলিকে লক্ষ করে বলতে থাকে, 'এই মুহূর্তে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাক। ওর মুখ আমি দেখতে চাই না।'
'কী বলছ যা তা! এত রাতে কোথায় যাবে!' অশোককে টানতে টানতে উপরে নিতে চেষ্টা করে অলি, ' যাও তো তুমি ছাদে যাও, মাথা ঠান্ডা কর।'
তরতর করে ছাদে উঠে যায় অশোক। চুপ করে বসে। একের পর এক চিন্তা ঢেউ খেলে যায়..এত বড় হয়ে গেছে উপমা! কোন রাতের ভ্রুকুটি কেড়ে নিয়েছে ওর চোখের ঘুম! কোন নদীর জলে সাঁতার কাটছে এখন ও! কূল কিনারা পায় না অশোক। এই কি তার সেই ছোট্ট উপমা,কোনও এক জল থৈ থৈ বর্ষার দিনে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রিকশা উল্টে ড্রেনে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে মুখটা জলের উপরে তুলেই প্রশ্ন করেছিল, ' বাবাই কই!' পিঠের ব্যাগ,হাতের ছাতা ফেলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, ' এইতো আমি মা! জীবনের এ কোন বর্ষায় ভেসে গেছে তার সেই নিশ্চিত অবলম্বন, ভেবে পায় না অশোক। হঠাৎ দৃষ্টি যায় দূর আকাশের দিকে। আহা কী সুন্দর স্বচ্ছ পরিষ্কার আকাশ। ঝিকমিক করছে নক্ষত্রের আলো। জোছনা ছড়িয়েছে চাঁদ...যেন এই জ্যোৎস্নার ভেতর অশোক এসে বসবে বলে। অশোকের উত্তপ্ত পাঁজরে ঠান্ডা হাওয়া বুলিয়ে যাচ্ছে মধ্যরাত্রির কোমলস্পর্শ। 'কোন রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে' ... শুনতে পাচ্ছিল যেন অশোক। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বুকের অনেক গভীরে নেমে হন্যে হয়ে খুঁজছিল কোথায় হারাল হোমাপাখি। দেখতে পাচ্ছিল না কোথাও।কোথায় গেল সে! মধ্যরাত ফালাফালা করে আত্মার গভীরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে অশোক।
অনেকক্ষণ পরে ক্রোধের আগুন নিভতেই,টের পেল ওই তো বুকের ভেতর আস্তে আস্তে ডানা মেলে উড়ে এসে বসছে হোমাপাখি।ব্যথায় টনটন করছে আঙুলগুলো।'পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে ' এতদিন শুনেছে..আজ টের পেল। তবু সব ব্যথা কর্পূরের মতো কোথায় উড়ে গেল যেন....যখন টের পেল হোমাপাখি তাকে ছেড়ে যায়নি আত্মা জাপ্টে চুপটি করে বসে আছে বুকের ভেতরে কোথাও।
( আগামী পর্বে )