“যতো ধর্ম্মস্ততো জয়ঃ”
অলোক কোরা
“Religion is realization; not talk, nor doctrine, nor theories however beautiful they may be. It is being and becoming, not hearing, or acknowledging; it is the whole soul becoming what it believes.” Swami Vivekananda
সারা পৃথিবীতে প্রায় দশ হাজারের মতো স্বতন্ত্র্য ধর্ম রয়েছে। প্রতিটি মানুষ কোন না কোন ধরনের সঙ্গে যুক্ত। যা মানুষের আচরণকে ও অনুশীলনকে পরিবর্তিত করে। আমার লেখনীতে সেই ধর্মের প্রতি আলোকপাত করা হয়নি। সেই ধর্মকে বিশ্লেষিত করার প্রয়াস করছি, যার দ্বারায় মানুষের মানবতার আভ্যন্তরীণ চৈতন্য প্রস্ফুটিত হয়েছে।
নিজের ঢাক না পিটিয়ে অবলীলায় বলতে পারি স্মৃতির ধারণ ক্ষমতাটা একটু শক্তপক্ত- শৈশব থেকেই। যেটা শুনতাম যেটা পড়তাম ভেতরেই থাকতো, প্রয়োজন মেটাত। ঠাকুর দেবতাদের প্রতি বিশ্বাস, ভালো লাগা, ভালোবাসা সবই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। কখনো নিয়ম থেকে ছিটকে পড়িনি। অনেক সময় আবেগতাড়িত হয়ে উদ্বেল হয়েছি ঠিকই কিন্তু বিপথে যাইনি। ভালো মন্দের তফাতটা খুব বুঝতাম। কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় অনুধাবন করতে পেরে ছিলাম সেই শিশু বয়েসেই। প্রাইমারীতে কখনো কোন শ্রেণীতে দ্বিতীয় হইনি, এটা আমার অহংকার নয়- আমি চাইতাম না কেউ আমার এই স্থান নিয়ে নিক। মাস্টারমশাই থেকে শুরু করে সবাই আমাকে খুব ভালোবাসতেন ও ভালোবাসতো।
সব দিক থেকে আমার স্থান ছিল অনেক উর্দ্ধে। একদিন আমার প্রিয় মাস্টারমশাই দাদাদের ক্লাস নিচ্ছেন, আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। উনাকে বিচলিত করার জন্য স্কুলের ব্যাগ থেকে খেলনা পিস্তলটা বের করে বিকট এক শব্দে উনাকে চমকিত করে দিলাম দৌড়। দূরে দাঁড়িয়ে একটা আম গাছের আড়াল থেকে উনার আচরণ দেখতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে সব শান্ত হয়ে গেল। আর দশটা স্কুল ছাত্রের মতো বাড়িতে চলে এলাম। বাড়ি ফিরে সব কিছু ভুলেই গেছি। একটা ভালো গুন ছিল, এখনও আছে- স্কুল কখনো বন্ধ করতাম না। যাই হয়ে যাক স্কুল আমি যাবই। গেলাম স্কুলে। ক্লাস হল বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করলাম, টিফিনে খেলাধুলাও হল কিন্তু আমার প্রিয় মাস্টারমশাই আমার সঙ্গে কথা বললেন না। শুধু আর পাঁচটা ছেলেকে প্রশ্ন করার মতো আমাকেও প্রশ্ন করলেন আমি উত্তরও দিলাম। ছোট ছিলাম কিছু না বুঝলেও কি হবে আমাকে কে ভালবাসে আর কে বাসে না তা বুঝতে পারতাম। দু-তিন দিন এভাবে কাটল। স্কুলে কষ্ট হতো আবার বাড়িতে চলে এলে ভুলে যেতাম। এভাবেই দিনটা সপ্তাহের শেষে এসে দাঁড়ালো। শনিবার স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হবে এটাই একটা বাড়তি আনন্দ। প্রথম ক্লাসটা আমার প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের। কিন্তু দেখতে পেলাম না, পরিবর্তে অন্যজন। স্বাভাবিক কারণে মনটা একটু খারাপ হল। একটু পরেই তো ছুটি- তার পর সোজা বাড়ি। কিন্তু মনটা কেমন কেমন করছে। কি করছে বুঝতে পারছি না। এই সব হাবিজাবি ভাবছি। সময় শেষ হল ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠল, কিন্তু অন্যদিনের থেকে কেমন যেন বিকট শব্দে। বইপত্র গুছিয়ে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে মাথানিছু করে আসছি, এমন সময় উনাকে দেখতে পেলাম। একটা শিহরণ খেলে গেল সারা শরীর জুড়ে। অযাচিতভাবে, অবলীলায় দৌড়ে গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। উনি কোলে তুলে নিলেন। চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন “বোকা ছেলে”। তৎক্ষণাৎ আমি আমার দুটি কান ধরে বললাম আর কখনো এই কাজ করবনা। সেই থেকে যাত্রা শুরু। সে দিনের সেই স্নেহের হাতটা বোধ হয় সঠিক ধর্মের শিক্ষা দিয়ে ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম যেখানে অপরাধ শিকার করার জায়গা আছে সেখানেই উত্তরণের পথ রয়েছে। জয়ের বার্তা রয়েছে সেখানে। নতুন এক শিক্ষা পেলাম জীবনে। পরে বুঝলাম। অতীতের এই ভুল থেকে লাভ করলাম- যেখানে ধর্ম সেখানেই জয়। সেই জয়লাভ কখনো বাহ্যিক কখনো আপেক্ষিক। বিন্দুমাত্র কার্পণ্যতা থাকে না সেই মহতী সাধনায়। আমার মধ্য দিয়ে সেই জয়ের ধ্বনি যদি সূচিত হয়, তখন ফেলে আসা অতীতের শিক্ষাকে কুর্নিস করি বারে বারে।
স্রষ্টার সৃষ্টি বড়ই সুন্দর ও পবিত্র। সেই পবিত্রতা ও সুন্দরতাকে রক্ষণ করার এক মহান পূজকের বড়ই প্রয়োজন। যুগে যুগে হয়ত সেই পূজকের হাত ধরেই ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সুদূর অতীতের কথা বেশি বলা আমাদের সম্ভব নয়। ইতিহাসের পাতাতে আঙ্গুল চেপে বসলেই ধর্মের সরূপ কি তা নজরে আসে। সারা বিশ্ব জুড়ে সময়ের পট পরিবর্তনের হাত ধরে একাধিক সভ্যতা ধরিত্রীর বুকে অবস্থান করেছে, আবার সেই সভ্যতাও ধর্ম-অধর্মের বেড়াজালে সঠিক সত্যের সন্ধান দিয়েছে। সত্যই ধর্ম আর ধর্মই সত্য।
রামায়ণ ও মহাভারত আমাদের গর্ব, অহংকারও। রামায়ণের কাহিনীর মধ্যে ধর্মের এক নতুন মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। ভগবান রামের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু রাবণের মধ্যেও যে ধর্মের সরূপ আছে আমরা তাকে কখনো দেখিনি। ভগবান শিবের ভক্ত রাবণ। দশ মাথার অধিকারী। তাই তিনি দশানন। একাই দশ জন মানুষের বুদ্ধি নিজের মাথায় ধারণ করতে পারতেন, তাই দিয়ে তিনি বাস্তবিক পরিবেশ পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতেন। তিনিও অধর্মের পথে থেকে ধর্মকে জয়ী হতে সাহস যুগিয়েছে। মুদ্রার এক পিঠ বিচার করতে হলে মুদ্রার উভয় দিকে দৃষ্টি অবলোকন করাটাও আবশ্যক। তাতে বিশ্বাসটা আরো দৃঢ় হয়।
মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনী আমাদের অজানা নয়। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে কৌরব-পান্ডপের ভয়ংকর মহাসংগ্রামের কথা আমারা কখনোই বিস্মিত হইনা। ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে যার কথা আমাদের প্রথমে স্মরনে আসে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যুগে যুগে যখনই অধর্ম আসবে তাকে লয় করতে তিনি অবতার রুপে প্রতীয়মান হবেন। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে ধর্ম।
“ যদা যদাহিধর্মস্যঃ গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্যঃ তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।
পরিত্রাণায় চ সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। ”
এই ধর্মের বাণী কেবল মহাভহারতের চরিত্রকে পরিবর্তন করেছে তা কিন্তু নয়। সংসারকে এক কঠিন পথে এনে দাঁড় করিয়েছে। মাতা গান্ধারীও সেই পথ থেকে কখনোই সরতে পারেননি। যুদ্ধের পরিণতি কি হতে পারে সে কথা জেনেও তিনি কখনোই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। নীতি বাক্য দিয়ে তিনি পুত্র দুর্যোধনের মন পরিবর্তনের পাশাপাশি সত্যের সন্ধান দিয়ে গেছেন। “যুদ্ধ আরম্ভ হইলে দুর্যোধন প্রত্যহই সময়ে সময়ে জননীর নিকট গিয়া স্বপক্ষের জয় কামনা করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে অনুরোধ করেন, কিন্তু প্রতিবারই গান্ধারী কেবলমাত্র এই কথাই বলেন, যতো ধর্ম্মস্ততো জয়ঃ, ধর্ম যেখানে জয় সেখানে”।
সংসার হল মায়া। প্রতিনিয়ত আমরা সেই জালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি। সুখ ভোগের আর এক নাম বিলাসিতা। মানুষ ভেদে এর পরিবর্তন হতেই পারে। আত্মসুখের বাসনা আমাদেরকে ক্রমশ বিলাসিতায় আছন্ন করে রাখে। যারা এর থেকে মুক্ত হতে পারে তারা বিশ্বের সকলের কল্যাণের বাসনায় সাধনা করে। সকল জীবের কল্যাণ তখন তাঁর কাছে প্রধান বলে প্রতীয়মান হয়। ধর্মও সেখানে জয় লাভ করে। সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে সিদ্ধার্থ জগতের মুক্তির পথ খুঁজতে বের হবেন, সন্ন্যাস তাঁর ব্রত। শুদ্ধোদনের মাথায় যেন বজ্রাঘাত এসে পড়ল। পুত্রকে অনুরোধ করলেন এ ধরণের সংকল্প ত্যাগ করতে। সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগ না করার প্রতিশ্রুতি সরূপ চারটি বর চাইলেন পিতার কাছে- প্রথমতঃ জরা যেন তার যৌবন নাশ না করে। দ্বিতীয়তঃ ব্যাধি যেন তার স্বাস্থ্য ভগ্ন না করে। তৃতীয়তঃ মৃত্যু যেন তার জীবন হরণ না করে। চতুর্থতঃ বিপত্তি যেন তার সম্পদ অপহরণ না করে।
কোন বাধাই সিদ্ধার্থ এর পথে বাধা দান করতে পারল না। জয়ী হল সিদ্ধার্থ। জয়ী হল ধর্ম। সংসার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিনি নতুন এক ধর্ম সৃষ্টির সন্ধানে চললেন। সেখানেও তার অবিচল নিষ্ঠা।
ইহাসনে শুষ্যতু মে শরিরং
ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ংঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।।
দেহ শুকিয়ে যাক, কিংবা অস্থি ভঙ্গুর হয়ে গিয়ে মৃত্যু এসে শরীর নিয়ে যাক, কঠোর নিষ্ঠাই তাকে সমস্ত প্রকার কলুষতা ও প্রলোভন থেকে বিরত রেখেছে। জয়ী হয়েছেন তিনি। সমস্ত বিভেদের ঊর্দ্ধে উঠে তিনি ধর্মকে আপন করতে পেরেছেন। মানুষ তার আচরণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দশের মন পাওয়ার চেষ্টা করে, সফলতা যে তাকে খুব কাছে টানতে পারে তা কিন্তু নয়। যে মানুষটি সফলতাকে উপলব্ধি করতে গিয়ে ত্যাগ ও সাধনাকে অবলম্বন করে ধর্মের কাছে সে চিরঞ্জীবী হয়ে ওঠে।
চিকাগো ধর্ম সভাতে গিয়ে আর দশ জনের মতো অন্তরের স্বাভাবিক মননের চেতনাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে ছিলেন স্বামীজি। সে ভাষা স্বাভাবিক ছিল, ছিল সবাইকে আপন করে নেওয়ার বাসনা। তাই তিনি জয়ী হয়েছেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভাষাতে আড়ষ্টতা নেই, নেই গাম্ভীর্য। ছিল কেবল স্পষ্টতা। ছিল সরলতা, অন্তরকে কম্পিত করে বাস্তবিক করে তোলার তীব্র বেদনা। অধিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে লেখার ব্যাপ্তি না ঘটিয়ে, কেবলমাত্র এই ধারণা দেবার চেষ্টা করলাম যে, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে কেউ নেই। সেই মানব ধর্মের একটু ব্যাখ্যা করলাম, যার মধ্য দিয়ে অন্তরাত্মাকে বিশ্বজনীন করা যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন