বাংলা ভাষার একটি কবিতার গোলার্ধে
সব্যসাচী মজুমদার
বাংলা ভাষা কেন পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা ও সাহিত্যের একটি বিভেদ রেখা টানলে একদিকে থাকে সুফিয়ানা,অন্যদিকে কলাবৎ। এবার আপনার কাছে কে বেশি দ্যুতিময়, সে আপনার নির্মাণ জানে। আমার আপাতত মনে পড়ছে'শতভিষা'র নাম। অরুণ কুমার সরকারের বিপরীতে কেন পুরো বাংলা কবিতার প্রবহমান কথাবিশ্বের প্রতিস্পর্ধায় দাঁড়িয়ে আলোক সরকার গড়ে তুলেছেন এক ভূমা।যার মানচিত্র কেবল স্বতোৎসারিত,অবিরল দৃশ্য গ্রন্থনে তৈরি হয়েছে।এ কেবল আলোক সরকারেরই ভূমা।প্রকৃতই সারসের মতো যাপনকে একটি বিশ্লিষ্ট-সংশ্লিষ্ট সত্তা হিসেবে লিখে যাওয়াই ছিলো আলোক বাবুর কবিতা।পরবর্তী কালে বিনয় মজুমদারের লেখাতেও একটা আলাদা স্ফিয়ার নির্মানের নির্ভার চেষ্টা দেখা যায়।এ প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র।
আলোক সরকার লিখছেন,"যা আছে,তারই ঘোষণা আছে/বর্তমান আছে।/বর্তমান অর্থাৎ স্হান কাল আর একটা পাত্রও।/পাত্রটাই বেশি উচ্চারণ হয়।/শরৎকাল যত বেশি আছে তার চেয়ে অনেক বেশি আছে /শিউলি গাছ,কাশ ফুল, রোদ্দুরের /সোনালী, শরৎকাল কোনদিকে?"(নিভৃত লোক: ভিখিরি গুলো)। অনাক্রান্ত কথন কেবল জায়মানতাকেই নথীবদ্ধ করে রাখছে অনুগত চাক্ষিকের ভূমিকায়।
রসানুগমন ব্যাতিত কিছু গ্রহণ করে না সে।ছিন্ন ভ্রুণের অভিঘাত শেষে সে লিখতে পারে,"বহিঃদৃশ্য অর্থাৎ যার কোনও /চতুষ্পার্শ নেই তাকে ,/বসবাসের পরিমাণের ভিতর/নিয়ে আসা।"(বর্হিদৃশ্য: নিভৃতলোক)।--এই 'বসবাসের পরিমাণ'-এর ভেতর চাক্ষিক যতটুকু চান,ততটুকুনি থাকবে আর বাদবাকি সবকিছুই অগৃহীত।এই উপাদানেই হয়তো তৈরি হয়েছে আলোক সরকারের পৃথিবীখণ্ড।আর সেই দহলিজেই উত্তরপর্বে মৃদু শোনা গেল,"আবার মহানন্দা পেরোলাম/পাশ দিয়ে একটা লাইন গেছে/দুটির মাঝখানে ভ্যালির মতো /বুনো জঙ্গলে ভরে আছে/একটা দৃশ্য লিখতে লিখতে দৃশ্যান্তর ঘটে যাচ্ছে।"(March 17,2017:হাতটান)।তপেশ দাশগুপ্ত লিখেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের উত্তর প্রান্ত থেকে লিখে চলেছেন তাঁর পৃথিবীর কথা। শতাব্দী শতাব্দী পরের মানুষেরা হয়তো বা যে দৃশ্য দেখতে পছন্দ করবেন, হয়তো বা নস্যাৎ করে দেবেন--এই দ্বিবিধ সম্ভাবনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তপেশ নির্বিকার জানাচ্ছেন,"কখনও কবিতার শেষে ম্যাজিক থাকে/কখনও মাঝখানে/কখনও শুরুতে/আপাদমস্তক বোরখা পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমার প্রেমিকা।"(December 24,2016) কিংবা "৮.তোমার সামনে আমি ট্রেন থেকে পড়ে যাব/লাগবে না।"৯.সন্ধের আগে/মাঠের রঙ/আমার মুখের রঙ পাল্টে দেয়।"
'এখন বাংলা কবিতার কাগজ '-এর উদ্যোগে ২০১৬ থেকে ২০১৮-এর মধ্যে রচিত সমস্ত রচনাকেই ধরে রাখা হলো 'হাতটান'-এর মতো ১৮২ পাতার সংকলনে। বিস্তারিত পরিসর পেয়ে কবি লোকায়তিক রীতিতে শুরু করলেন বিলম্বিত আলাপ।তারপর ধীরে ধীরে বিস্তারে গিয়েছেন কিন্তু ছাড়েননি বিলম্বিত চলন,"আমি তো তোমাকে দেখানোর জন্য কবিতা লিখি/তোমার মন ভালো করার জন্য/আমার মন ভালো হয়ে যায়/অথবা /তুমি তো আমাকে দেখাও /আমার মন ভালো করার জন্য/আমি দেখতে পারি না।"(October 3,2018)। লক্ষ্য করুন কী তীব্র স্বীকারোক্তি মূলক এই পংক্তিকটি।কোমলে বাজলো কেবল।এ স্বরের পুনরুত্থান ঘটে না। দৈনন্দিন স্পন্দে রচিত হয় এই কথকতা,এই যাবৎ জীবনের কথকতা,"ডান দিক বাঁ দিক মনে হয়/তোমার জড়ুল দেখে চিনেছি/ইছাপুর স্টেশনে নেমে আমার এই ভুল হয় "(মহাষ্টমী)।
নির্লিপ্ত হওয়া সহজ নয়। অন্ততঃ উত্তর দু হাজারে যে বিকল্প বিশ্বায়ন ঘটেছে,সেই প্রেক্ষিতে তো নয়ই।পুঁজির প্রান্তে দাঁড়িয়ে একজন আধুনিক প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠবেন--এটা স্বাভাবিক।অথচ তপেশ দাশগুপ্ত,"ত্রাণে যারা আছে কষ্ট ছুঁতে পারছে না।/হাসতে হাসতে কতদূর চলে যাচ্ছে /ত্রিপলের আড়ালে সিগেরেট /ধরিয়েছে দেখো/দাদা বাসন নিয়ে আসার ফাঁকে /মেঘলা আর মেঘলা রইতে চাইছে না।"(August 19,2017)লিখেই আবার পরক্ষণেই লিখেছেন,"তোমার থেকে আমি মুক্ত হয়ে গেছি/তোমার চাওয়া পাওয়ার বাইরে চলে আসছি...(my name is lakhan)।
প্রাজ্ঞ আপনার সঙ্গেই আমি বিস্মিত হয়ে দেখছি কবিতার শরীর যেমন ক্রমান্বয় পরীক্ষায় সংগঠিত, শিরোনামগুলিও।আলোকবৃত্ত থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছেন তপেশ।আলোক সরকার ধ্রুপদীপ্রবণ ছিলেন।তপেশ ঠিক একই নির্লিপ্ত-লিপ্তের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন চলতির ব্যবহারে আর স্বস্তঃস্ফূর্ত নামকরণে।আলোক সরকার লিখছেন,"অন্ধকার ক্রম নিশ্চেতন, অন্ধকার ক্রম অনুচ্চার---/আলো যত কমে অন্ধকার তত/নির্দ্বন্দ্ব হয়, অতিক্রম হয়।"(লাল বল: নিভৃত লোক :আলোক সরকার)।আর পাশাপাশি যদি তপেশ দাশগুপ্তের এই পংক্তিকে রাখি,"অনেক দূর চলে যেতে চাই/মাঠ ঘাট পেড়োতে পেড়োতে/দূরে কোথাও নয়/দূরে দূরে চলে যেতে যেতে...(জুলাই-এর যাতায়াতগুলি)।এ প্রবণতা অন্ততঃ উত্তর দু হাজার পর্বে ঈষৎ বিরল।এই সমসময়ে তপেশ সম্ভবত একাই বলেছেন এভাবে,"তুমি তো কিছুই বলোনি/ধান পাকছে/ধারে দাঁড়িয়ে আছ ক্ষেতের পাশে/শস্য ভাণ্ডারে অবনত সন্ধ্যের আকাশ/তোমাকে ওখানে রেখে এসেছি/সব শস্য তোমার/দু মুঠো ছড়িয়ে আছে পাখিদের দিকে।"(জানু পেতে দাও)।
শব্দরীতির সচরাচর থেকে বেরিয়ে এবং একই সঙ্গে ভাষা ধারণার প্রচলিতকে ঈষৎ অতিক্রম করে তপেশ পৌঁছে যেতে চাইছেন বাস্তবতার চতুর্মাত্রিক বিন্যাসে,"৩.ছোট্টো স্টেশন/ গাড়ি দাঁড়িয়ে/ডানদিকে একটা মালগাড়ি/বাঁ দিকে একটা মালগাড়ি/ছোটার অপেক্ষায় বসে আছি...৪.u are my strength/এরপরে তুমুল মাঠে এসো শেষ না হওয়া/শেষ দাড়ি ঐ মাঠে গিয়ে পড়বে না/মাঠের শেষে গাড়ি চলে যায় সরু রাস্তাটি অনুভবে পাই।...৫.এ দৃশ্য দেখাও কেন/ছোট্টো একটা পুকুর ঘাটে একটি নৌকো বাঁধা আছে/কেউ কোথ্থাও নেই /একটা কুড়ে ঘর হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।"(চৈত্র একটি অসময়ে বৃষ্টির দিনে ট্রেনে করে)।
নিয়ত যাপিত অধিচেতনার আর চেতনার ভেতরে যাতায়াত করতে করতে এ কাব্য বলে ফেলেছে খণ্ড খণ্ড সময় পর্বের একটা নিরবচ্ছিন্ন মৌলকোলাজ।অচিন্তিত সময় থেকে যে মৌলগুলি সমাজমানুষের জৈবধারনায় গৃহীত হয়েছে,"একমুঠো চাল ছড়িয়ে দাও/বকবকম করে/ ঢুকে যায় আমার ভিতরে/বার করি হিজল গাছ/শুধু ঐ শব্দটুকু /তার আর কোনো তারাপীঠ হয় না।"(এইটুকুই: October 3,2018)। একটা দৃশ্যের ভেতর থেকে কবিভাবনায় অনাবশ্যক কিছু খণ্ডদৃশ্য তুলে নিয়ে রাখা হলো একটি আলোচিত পৃথিবীর স্বতন্ত্র এক অনালোকিত অবস্হান,"ক্ষমা চাইব কিভাবে/কপর্দকশূন্য ক্ষমাশূন্য বসে আছি/কুয়ো ও শেফালি তলার কথা শুনতে।"(দেওয়ানি: November,2018)
আপনি গ্রন্থটি হাতে নিলেই বুঝতে পারবেন লেখাগুলো পরপর পড়িনি। বিচ্ছিন্ন ভাবে এ পাঠষ্ক্রিয়া তৈরি করেছি।তার প্রধান কারণ,এ গ্রন্থ বা এ গ্রন্থের লেখাগুলি কেবল অনিশ্চিতের দায়ভার বহন করছে।এরা কোথাও পৌঁছতে চায় না। কেবল প্রলম্বিত দৃশ্যগুলি ছাড়া তারা আর কিছু বলতে চায় না,"আজকে যে কবিতাই লেখ/মেঘলা হয়ে যাচ্ছে।"(দেওয়ালি)
গদ্য ছন্দে লেখা এ বইয়ের ভারি চমৎকার একটি প্রচ্ছদ করেছেন শান্তনু মজুমদার ও অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়।
হাতটান:তপেশ দাশগুপ্ত: এখন বাংলা কবিতার কাগজ-এর উদ্যোগ:২০০টাকা
সমৃদ্ধ হলাম
উত্তরমুছুন