অণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই তিনটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ----
সব্যসাচী গোস্বামী-র তিনটি অণুগল্প
মুখ
আমার রঙচটা ঘরের দেয়ালে একটা মুখোশ থাকবে। বিকট, বিভৎস। তুই আমাদের বাড়িতে এলে আমি সেটা মুখে পরে যেই তোর দিকে এগিয়ে আসব অমনি তুই এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা মুখ থেকে ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হবি। আমি সরে যাব যথারীতি। ‘চারিদিকে শুধু ভয় আর ভয়। ভয়ের গল্প এবার একটু থামাবি’, কাঁদো কাঁদো মুখে বলে উঠবি তুই। আমি ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠব সে কথা শুনে আর ভাবব সত্যি তো বাতাসে ফিসফাস করে শুধু ভয়ের গল্প।তারচেয়ে বরং ভয় নয় একটু ঠাট্টা-তামাশা করা যাক তোর সাথে। তাই, এবার একটা মজার জোকারের মুখোশ নিয়ে এসে মুখে পড়ে ভেংচি কাটতে থাকবো তোকে। এবারও তুই যথারীতি রেগে যাবি। বলবি, ‘চারিদিকে তো শুধু মুখোশেরই ভিড়, একটা সত্যিকারের মানুষের মুখ দেখাতে পারিস না। অপাপবিদ্ধ মানুষের মুখ’। তারপর থেকে তোর জন্য আমি খুঁজে যেতে থাকব একটা সত্যিকারের মানুষের মুখ। কিন্তু মুখোশের ভিড়ে মানুষের মুখ যে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে! মুখ খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়বে শুধুই মুখোশ। কোনোটায় হিংস্রতার রক্তমাখা দাঁতগুলোকে ঢেকে দিয়েছে অহিংসার অতি-বিনয়। কোনোটায় লোভ-লালসার লোলচর্মের মুখকে ঢেকে দিয়েছে ধর্মের সাত্ত্বিকতা। তা সত্বেও মাঝেমাঝে দু’চারটে সত্যিকারের মুখ যে খুঁজে পাব না তা নয়, তা তোকে জানাতেই তুই বলবি, ‘মুখের কথায় নয়, আমাকে দেখাতে হবে একটা সত্যিকারের মুখ, অপাপবিদ্ধ।’ একবার একটা ছবি আমি খুঁজে এনে তোকে দেখাব। একজন কৃষকের ছবি। সংবাদ পত্রের প্রথম পাতায় বেরুনো। বহুদিন অনাবৃষ্টির পর হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে এক দরিদ্র চাষির চোখে খুশির ঝিলিক্। আমি ছবিটা নিয়ে এসে তোকে দেখাব। বলব এই দেখ, একটা প্রকৃত মুখের ছবি আমি এনেছি।অপাপবিদ্ধ মানুষের মুখ।’ তুই বলবি, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি তো তোকে মুখের ছবি নয়, একটা সত্যিকারের মানুষের মুখ দেখাতে বলেছি।’ অতঃপর আমি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে ভাবতে থাকব কোথায় গেলে পাওয়া যাবে একটা মানুষের প্রকৃত মুখ। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ছুট্টে গিয়ে নিয়ে আসব ঘরের ছোট্ট আয়নাটা। তোর মুখের সামনে ধরে বলব, এই তো ভালো করে চেয়ে দ্যাখ একটা প্রকৃত মানুষের মুখ, অপাপবিদ্ধ ...’।
তোরই গল্প
... তোরই গল্পটাকে একটু বদলে দিয়ে একটা গল্প লিখবো। হেমন্তের বিকেলকে তোর গল্পে তুই লিখেছিলি ‘সোনালী’ আমি তার বদলে লিখবো ‘বিষন্ন’। সন্ধ্যার শুকতারাটিকে তুই লিখেছিলি ‘দিশারী’, আমি তাকে বদলে দিয়ে লিখবো ‘নিঃসঙ্গ’। প্রবল বৃষ্টিতে তুই যখন তোর গল্পে খুঁজে পাবি টিনের ছাদে ঝম্ঝমাঝম্ শব্দ, আমি তখন তার মধ্যে খুঁজবো পায়ের তলা আলগা হয়ে যাওয়ার কারণে ধ্বসে যাওয়া মাটির কান্নার আওয়াজ। আর এ গল্পের শেষে তুই যখন মাটি আর খড়ের ছাওনি দিয়ে একটা ঘর বাঁধবি, আমি তখন বানের জলে একটা ঘরকে খড়কুঁটোর মতো ভেসে যেতে দেবো। তবু শেষ পর্যন্ত এ গল্পটা তোরই রয়ে যাবে ...
অনন্ত
খুব ছোট্টবেলা থেকেই টুংকা খুব টক্ টক্ করে কথা বলে। তর্কে তাঁকে হারানো মুশকিল। এখন সে ক্লাস নাইন। বাবা মা আর দাদা পিকলুকে নিয়ে তাঁর আনন্দেই দিন কাটে। পিকলু অবশ্য টুংকার চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়। সে এখন কলেজে সেকেন্ড ইয়ার। একদিন পিকলু টুংকাকে বলল:
- হ্যাঁরে টুংকা তুই সবচেয়ে কাকে বেশী ভালবাসিস?
- বাবা’কে, মা’কে আর তোকে।
- না এই তিনজনের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসিস?
- তিনজনকেই সমান ভালবাসি।
- যা! তাই আবার হয় নাকি! একটু উনিশ-বিশ তো থাকবেই না!
- না না তিনজনকেই। একদম সমান সমান।
- কি করে? ধর, তিনজনের জন্য তোর বুকের মধ্যে ভালবাসা আছে ১০০ একক, তাহলে তুই কাকে কতটা ভালাবসা দিবি?
- তিনজনকেই দেবো ৩৩.৩৩ একক করে।
- তাহলে তো .০১ একক কম বেশী হবে?
- হবে না। ওটাকেও আবার .০০৩ একক করে ভাগ করে দেবো।
- তাহলেও আবার সেই .০০১ করে কম বেশী হবেই?
- তখন আবার একইভাবে ভাগ করে দেবো।
- তখনও তো আবার একইভাবে কিছু কমবেশী হবেই। এটা তো ইনফিনিটিতে গিয়ে ঠেকবে!
- সেজন্যই তো বলে ভালবাসা অনন্ত অসীম।
‘সত্যিই টুংকাকে কথায় হারানো যাবে না’। পিকলু হাসতে হাসতে মাকে বলে।
*******************************************************************
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন