মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী নির্বাণানন্দ



মায়ের কথা 

স্বামী নির্বাণানন্দ

 (১)

  ‎     

        ১৯১২ সালে কাশী সেবাশ্রমে ব্রহ্মচারী হিসেবে আমি যোগদান করি। তখন মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ, হরি মহারাজ, মাষ্টারমশাই ওখানে রয়েছেন। শ্রীশ্রীমাও তখন ওখানে ছিলেন  -লক্ষ্মীনিবাসে। সেই সময় মাকে একদিন পালকি করে সেবাশ্রমে নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে স্বামী শান্তানন্দ ও চারুবাবু (পরে স্বামী শুভানন্দ) ছিলেন। মা একটা চেয়ারে বসলেন। একজন ভক্ত জিজ্ঞাসা করলেন, -'মা কেমন দেখলেন?' মা বললেন, -'দেখলুম ঠাকুরই বিরাজ করছেন। রোগীদের সাক্ষাৎ নারায়ণ জ্ঞানে সেবা করে ছেলেরা তাঁরই সেবা করছে।' মা এই কথা বলার পর আমাদের ভিতরে আরও প্রেরণা এল। সেবাশ্রমে তখন সাধু-ব্রহ্মচারীর সংখ্যা কম। ইন্ডোরের রোগীদের সেবার ভার আমার ওপর দেওয়া হয়েছিল। নারায়ণ জ্ঞানে সেবা বাস্তব ক্ষেত্রে বড় কঠিন। বছর দুয়েক সেবাশ্রমে ছিলাম। খুব চেষ্টা করেছিলাম নারায়ণ জ্ঞানে রোগীদের সেবা করতে। শ্রী শ্রী মায়ের কথার জোর, মহারাজের উৎসাহ, হরি মহারাজের প্রেরণা  -এসবের জন্যই তা করতে পেরেছিলাম।

     কাশীতে, বাগবাজারে এবং বেলুড় মঠে মহারাজ শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করছেন। -'এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমার বহুবার হয়েছে। দেখতাম, মহারাজ মায়ের সামনে গেলে কেমন যেন হয়ে যেতেন -ভাবে বিহ্বল। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না, পা করত, শরীর থরথর করে কাঁপত। কোন রকমে প্রণাম করেই উঠে আসতেন। অনেক সময় কাশীতে এবং মায়ের বাড়িতে প্রণাম করার জন্য ওপরে উঠতেই পারতেন না, নিচে থেকেই দাঁড়িয়ে যুক্তকর মাথায় তুলে উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতেন। বাবুরাম মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ প্রমুখকেও মাকে প্রণাম করতে দেখেছি। তাঁদেরও প্রায় ঐরকম ই অবস্থা, তবে এতটা নয়।


(২)

     ব্রহ্মচর্যের পর (১৯১৪ খ্রীঃ) শ্রীশ্রীমায়ের আশীর্বাদ নিতে উদ্বোধনে গিয়েছি। তখন মায়ের ঘরের সামনে এখনকার মত বড় বারান্দা ছিল না। সিড়ি দিয়ে উঠে কেবল একফালি চওড়া বারান্দা। নিচের উঠোনটি তখন বড় ছিল। মাকে প্রণাম করতে তিনি একটু ভজন শোনাতে বললেন। নিচের উঠোনে শতরঞ্জি পেতে বেশ কয়েকটি ভজন গাইলাম। মা খুশি হয়ে প্রসাদ পাঠিয়ে দিলেন। মঠে ফেরার সময় মাকে প্রণাম করতে গেলে মা মাথায় হাত দিয়ে খুব আশীর্বাদ করলেন।

     ‎ ১৯১৫ সালের মার্চ-এপ্রিল হবে, আমি তখন মহারাজের সেবায় বেলুড় মঠে রয়েছি। দেখতাম, আমার বয়সী অনেক সাধু-ব্রহ্মচারী মহারাজের অনুমতি নিয়ে তপস্যায় যেতেন। হিমালয় বা অন্য কোথাও বছর খানেকের জন্য তপস্যা করে আসতেন। আমিও একদিন মহারাজের কাছে গিয়ে তপস্যার অনুমতি চাইলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, -'তুই তাহলে এখানে কি করছিস? এই যে সেবা করছিস, এ তপস্যার চেয়ে ঢের বেশি হচ্ছে। তোর আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই।' কিন্তু আমি তা সত্ত্বেও যখন বারবার পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম, তখন তিনি আমায় মহাপুরুষ মহারাজের কাছে অনুমতি নিতে বললেন। মহাপুরুষ মহারাজ আমার কথা শুনেই বললেন, -'তুই কি পাগল হয়েছিস? আর কোথায় যাবি তপস্যা করতে? এই যে মহারাজের সেবা করছিস, এতেই সব জানবি।' আমি তবুও জোর করতে লাগলাম। তখন তিনি বললেন, আচ্ছা, বাবুরাম মহারাজের কাছে যা। তিনি অনুমতি দিলে তবেই যাবি।' বাবুরাম মহারাজের কাছে গেলাম। আমার নিবেদন শুনে তিনিও একই উত্তর দিলেন। এবং আরও জোরের সঙ্গে। বললেন, -'তুই কি সত্যি সত্যিই পাগল হলি, সুয্যি? দেখছিস না ঠাকুর রয়েছেন মহারাজের ভিতরে? আর কোথাও গেলে কি তুই ভগবানের মানসপুত্রের সাক্ষাৎ পাবি?' কিন্তু আমি তবুও জেদাজেদি করতে থাকলে তিনি বললেন, -'ঠিক আছে, উদ্বোধনে মা আছেন, মা যদি অনুমতি দেন, যাবি। প্রথমে কালীঘাট গিয়ে মা-কালীকে পূজো দিবি, তারপর মায়ের কাছে যাবি আশীর্বাদের জন্য। জানবি, কালীঘাটে যিনি আছেন আর বাগবাজারে যিনি আছেন, তাঁরা একই।'


   (৩)

     কালীঘাট মন্দিরে প্রণাম করে উদ্বোধনে পৌঁছলাম। দেখলাম, মায়ের দর্শনার্থীদের সারিতে আমি শেষ ব্যক্তি। দূর থেকে দেখছি, মা মুখের উপর ঘোমটা টেনে বসে আছেন আর যে-ই প্রণাম করছে তাকেই আশীর্বাদ করছেন। অবশেষে আমার পালা এল। অন্য সব ভক্ত তখন চলে গেছে। পায়ে মাথা দিয়ে সষ্টাঙ্গ প্রণাম করে যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন দেখি মা ঘুমটা সম্পূর্ণ খুলে ফেলেছেন। খুব হেসে আমাকে বললেন, -'এই মিষ্টিটা নাও বাবা, খাও।' নিজের হাতে আমায় মিষ্টি প্রসাদ দিলেন। মাকে মঠের সব খবর দিলাম। শেষকালে আমার প্রার্থনার কথা জানালাম। সব শুনে মা বললেন, -'বাইরে গিয়ে কঠোরতা করা ঠাকুর পছন্দ করতেন না, বাবা। তাছাড়া মঠ ছেড়ে, রাখালকে ছেড়ে তুমি কোথায় তপস্যা করতে যাবে? রাখালের সেবা করছ -তাতেই কি সব হচ্ছেনা? কিন্তু আমি বাচ্চা ছেলের মতো তাঁর অনুমতি আর আশীর্বাদ এর জন্য আবদার করতে লাগলাম। আমাকে নাছোড় দেখে শেষে মা বললেন, -'আচ্ছা, তুমি তপস্যায় যেতে পার  -কাশীতে যেতে পার। তবে আমাকে একটা কথা দিতে হবে। ইচ্ছে করে অনর্থক কঠোরতা করবে না। যদি পথে অযাচিত ভাবে কোন সাহায্য পাও তা নেবে। কাশীতে তপস্যা করার সময়ও যদি তোমাকে কেউ কিছু দেয়, তাও নেবে। সেবাশ্রমে থাকবে, আর খুব ইচ্ছে হলে বাইরে মাধুকরী করে খেতে পার। কাশীবাসও হবে, আর তপস্যাও হবে।' আমি মাকে কথা দিলাম। তবে তাঁর অনুমতি চাইলাম পদব্রজে কাশী যাওয়ার। মা অনুমতি দিলেন, তবে পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথাটা যে তাঁর মনঃপূত হয়নি তাও বুঝলাম। তারপর মাকে প্রণাম করে তাঁর অজস্র আশীর্বাদ নিয়ে খুশিমনে মঠে ফিরলাম। মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ, বাবুরাম মহারাজকে সব বললাম।

     ‎( ক্রমশ )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন