কবিতাগুচ্ছ * তৈমুর খান
জবাব
স্মৃতিময়ীর কাছে
আমার সমস্ত স্মৃতি গচ্ছিত আছে।
কিছু স্মৃতি রোজ চেয়ে নিয়ে
শব্দে শব্দে ওদের বিয়ে দিই।
বাইরে শুধু কোলাহল রক্তময় বর্ষাকাল
দাদুরির মৈথুনে রাজনীতি ছয়লাপ।
সম্প্রদায়ের বাঁশ ঝুঁকে ঝুঁকে নেয় শ্বাস
হরদম দেখি তারা বিলি করে উচ্ছ্বাস।
ছোট্ট বাতায়নে উপলব্ধির গান
ঘুমহীন জাগরণে সারারাত ভিজে গেছে—
কে দেবে করুণা তাকে?
রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে প্রলুব্ধ আন্ধার আছে
সময় মোচড় খায় নষ্ট ইতিহাসে।
পাশ ফিরি। উদাসীন হই।
আমার প্রেমিকা শুধু একান্ত নিরিবিলি।
উদ্বিগ্ন
ভাঙা নৌকা আর দুপুরের মেঘ
আমরা কোথায় চলেছি আবেগ?
ঝড় আসবে সেসব আততায়ী ঝড়
কী করে বাঁচাবে মূর্খ আবেগ আমাদের?
চারিপাশ ঘিরে দাঁড়াবে কাতিল অন্ধকার।
সাধনা
তবুও একটা গাছ হয়ে দাঁড়াই
চেতনাগুলি পাতা
আত্মবিশ্বাস ফুল ও ফল;
যতই কুড়ুল শান দিক
কেটে ফেলতে পারে না আত্মবোধ—
বাতাসের কাছে পাই বোধিবৃক্ষের বারতা।
সাপ
ভিতরে ভিতরে সবাই সাপ পোষে
সুযোগ পেলে নাচায়
বাইরে শুধু সাপুড়েকেই দ্যাখে
আমারও অনেক সাপ আছে
মাঝে মাঝে তারাও গর্জন করে
সাবধানে থাকি
কত যে রঙিন ওরা
দ্বি-ফলা জিভ বের করে
মনের ভিতরে অনেক গর্ত
গর্তে গর্তে ওরা বাস করে
বাইরে শুধু ঢেউখেলা চুল
টেরি কাটা, রঙিন পোশাক
সুগন্ধ ছড়ায়, হাসে
কোনও কোনও দিন
আত্মদংশনের ক্ষত সারাই করি নিজে
কোনও কোনও দিন ঝলসে যাই
আত্মদংশনের বিষে।
আয়নার সামনে মুখ দেখা যায় না আর
গার্হস্থ্য বিষাদগুলি আমার একান্ত নিরিবিলি খেয়ে যায়
আয়নায় মুখ দেখা যায় না আর
আয়নার সামনে দাঁড়াই প্রাচীন অন্ধকার
কতটুকু নীল জ্যোৎস্না ছিল তবে
রক্তে উচ্ছল স্রোত জেগে উঠেছিল
দেখি তার কিছু অংশ বাল্য ও যৌবনে
স্বরলিপি হয়ে বেজেছিল রূপকথা আর গানে
আজ পরিত্যক্ত বাড়ি
প্রদীপ জ্বালায় না কেউ
শাঁখ বাজানোর সন্ধ্যায়
পরে না শ্বেতশুভ্র শাড়ি
তবুও অক্ষরবৃত্তে পাক খাই
বিষণ্ন সঙ্গমে পার হই যুগ
মৃত কোকিলকে স্মৃতির জাদুঘরে রেখে
নষ্ট বিব্রত আমি সারাই অসুখ
অবনত জীবন
অশান্তির ক্ষুব্ধ ছায়ায়
আমাদের বিশ্রাম মরে যেতে থাকে
জেগে জেগে ঘুম শুধু
ঘুমে ঘুমে তেতো বিষ জমে
দেশ উঠে গেছে
মানুষও মানুষ নেই
শহর জুড়ে যান্ত্রিক অরণ্য
উৎপাত খেচরের ডাক
আততায়ী সিংহের গর্জন
কার সন্তান আমি ?
ভুলে যাচ্ছি —নিরুত্তর
ভুলে যাচ্ছি —এই অবনত জীবন আমার।
সর্বনাশ
খুব ভালো ভালো অস্ত্র তৈরি হচ্ছে এখন
অস্ত্র চালনার ট্রেনিংও হচ্ছে
কী করে মানুষ মারা হবে
তাও বলে দেওয়া হচ্ছে
আমাদের রাষ্ট্রের নাম সর্বনাশ
আমাদের শাসকের নাম সর্বনাশ
আমাদের পুলিশের নাম সর্বনাশ
কী করে মরতে হয়
আমরা এখন তার অভ্যাস করছি
কী করে চিৎকার করতে হয়
আমরা এখন তার অভ্যাস করছি
মরার সময় কাঁদব নাকি,না প্রতিবাদ জানাব
চিৎকার করব নাকি, না নিঃশব্দে মরে যাব
এইসব ভাবতে ভাবতে আমাদের দিনগুলি
আমাদের রাতগুলি
এখন কাপুরুষের দিন
এখন কাপুরুষের রাত
আতঙ্ক এসে ধর্ষণ করে যাচ্ছে আমাদের
জব্দ
এখন তলায় তলায় জব্দ আসছে
জব্দ এসে জব্দ করবে আমাদের
সাইকেল চালিয়ে বারো ক্রোশ যেতে যেতে
রাস্তার ধারে কারো কাছে জল চাইতে পারব না
কারো বাগানের পোষা ময়ূরের নাচ দেখার জন্য দাঁড়াতে পারব না
রাস্তার ধারে কলাগাছ নুয়ে থাকলে
বলতে পারব না সরিয়ে নিন
হাওয়া কোন দিক থেকে উঠবে
কোন দিক দিয়ে বয়ে যাবে
আমরা কেউ জানি না
এখন আমাদের ঠোঁট নষ্ট হয়ে গেছে
এখন আমাদের সব কথা পচে গেছে
এখন আমরা অন্ধকারে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
নিজেদের সুরক্ষার গুহা বানিয়ে নিচ্ছি
মৃত পূর্বপুরুষদের হাড়ে বানিয়ে নিচ্ছি জানালা-কপাট
এখন আমরা কে কোন জন্তু
তা আমাদের শিকার কৌশলেই বোঝা যাবে
চারিদিকেই জব্দ করা দিন
চারিদিকেই জব্দ করা রাত
আমাদের কলমটিও এখন তির-ধনুক!
ছোবল
কতযে ছোবল আসে!
ছোবলে ছোবলে ক্ষত গণনার নয়
তবু কোনো কোনো বৃষ্টির রাতে
ক্ষত ধুয়ে ফেলি
শুধু দাগ থেকে যায়
দাগে দাগে বেদনাপ্রহর
ওহে আমার ধূসর নম্র বধূ,
আলো জ্বালিয়ো না আর
থাকুক আঁধারে সব অস্পষ্ট যাতনা
চন্দ্রাহত একাকী বিষণ্ণ প্রহরগুলি
নিরুচ্চার শব্দে শব্দে লিখি;
শব্দেরা এসে ভিক্ষা চায়
এই ক্ষয় আয়ু, চাপা দীর্ঘশ্বাস
নির্বাক স্তব্ধতায় ভাঙা চুরমার
আত্মক্ষরণের বিপন্ন বিস্ময়
ভিক্ষা দিতে দিতে কেবলই ফতুর হই
জীবনের কাঁধে চেপে চলে যাই
নির্জীবনের অবসিত লাশ...
ঝড়
হাওয়ার আসার কথা ছিল
কিন্তু ঝড় এলো
ছোট্ট প্রদীপটি নিভে গেলে
সব অন্ধকার
যদিও এখন অন্ধ চোখ
কিছুই দেখি না বলে
নিজেকেও অচেনা মনে হয়
শুধু স্পর্শে ও গর্জনে তফাত বুঝি
হাওয়া শান্ত নিরিবিলি
ঝড় শুধু চোখ রাঙায়।
ঘাতক
হিংস্রতাগুলি এখনো রূপক হয়ে
মাঠে নামে রোজ
রূপকথা ভেবে ওদের ডেকে আনি ঘরে
বন্ধুত্ব হয়
কখনো কখনো ঠোঁট ছুঁয়ে ফেলি
অথবা দুই হাত
নিমগ্ন আলোর মতো ওদের রোশনাই
বারান্দায় ছড়িয়ে পড়লে
নিজেকে অপার্থিব মনে হয়
ভ্রান্তির পথে বাসনাদের গূঢ় যাতায়াত
কখনো কখনো ছায়ায় মায়াসাপ ঘোরে
বিশ্বাস ভঙ্গ হয় আলোও যখন তরবারি
ঘাতকেরা বেরিয়ে আসে সব সর্বনামে
বিশেষ্য তখন একাই দাঁড়ায়
সিজারও খুন হয় ব্রুটাসের কাছে...
কপোতাক্ষ নদীতীরে
অনেক অনেক রাত হয়ে যায়
জানালা খোলো,ও ঈশ্বর!
তোমার আকাশ দেখতে দেখতে
আকাঙ্ক্ষারা উট হয়ে যায়।
কোথায় আছে ঐশী আলো?
রাস্তাগুলি সবই বাঁকা
খুঁজতে খুঁজতে অবাক দৃশ্য
নিজেই শুধু নিজেকে ডাকা।
অন্ধকারেই একটি অন্ধ
শুঁকতে থাকে জীবনগন্ধ
কী মসৃণ! কী পিচ্ছিল!
সারাজীবন তারই ধন্দ।
স্বপ্নকন্যার মন পেতে
স্বপ্নে ঢোকে স্বপ্নবাড়ি
ঘুম ভাঙলে মিথ্যে সবই
কপোতাক্ষ নদীতীরে
জেগে থাকে সাগরদাঁড়ি।
বিষণ্ণপুর
গ্রামটি বিষণ্নপুর হয়ে যাচ্ছে বলে
মানুষেরা মাছরাঙা
কিছু কিছু মাছ অথবা মাছের মতো কিছু
শিকার করছে চোখের জলে
হৃদয় থাকে না এখানে
শুধু তার ভাষা পড়ে থাকে ধুলোয়
ম্রিয়মান কবিরাই ভাষা খুঁজতে আসে
কী করবে এত ভাষা?উড়িয়ে দেয় কুলোয়
পাতা পাতা উড়ে যাচ্ছে ঘুম,ঘুমের অভিষেক
নিঃঝুমের ঘরদোর পড়ে আছে
উঠোনে তার ভাঙা বাঁশি,নিঃসঙ্গ বিষহরি
আলোর বিকেল খেয়ে ভেসে যাচ্ছে মেঘ
দুয়ার কেউ আগলে রাখে না
ভয় এসে ঢোকে আর বের হয়
কার নারী কার সঙ্গে গেছে
ইচ্ছে আর অনিচ্ছে সব একসঙ্গে শোয়।
********************************************************
তৈমুর খান
বাংলা কবিতায় একটি পরিচিত নাম।ছোট বড় বিভিন্ন কাগজে নিয়মিত লিখে থাকেন।তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ----কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭)
প্রতিটি কবিতা সুন্দর
উত্তরমুছুন