মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১

গল্প * প্রদীপ দে

 



" নবমী নিশি ফিরে যাও দ্রুত "

   

প্রদীপ দে 


রায়বাহাদুর জমিদার বাড়ির পুজোমন্ডপে পঞ্চমীর দিনেই মাতৃ প্রতিমা আলোয় আলোকিত হয়ে

অভয়া হস্তে দন্ডায়মান। একই চালচিত্রে পুত্রকন্যা সহ অসুর নিধনে সিংহ পৃষ্ঠ আরূঢ়া। আগামীকাল দেবীর বোধন!


পঞ্চম উত্তরাধিকার মৃত। তার স্ত্রী নয়নতারা বর্তমান এই জমিদার বাড়ির রক্ষাকর্তী। তিন কন্যা চারি পুত্র। আরো তিনটি সন্তান জন্মেই মৃত। বর্তমান সাতটি সন্তানই বিবাহিত। বড় মেয়ে বড় ছেলের ঘরে আবার নাতি নাতনিও বর্তমান। তবে সবাই বাড়ির বাইরে। কেউ রাজ্যে কেউ ভিন রাজ্যে বাকিরা এক্কেবারে ছক্কা হাঁকিয়ে ভিনদেশে।


আজ তারা সব্বাই ঘরমুখো। বছরে একবারই তারা বাড়ির কথা ভাবে -মায়ের কথা মনে পড়ে - মাটির মায়ের টানে। উৎসব করতে আসে। আনন্দে ডুব দেয়,  মাতোয়ারা হয়, বহিঃপ্রকাশ করে জমিদারি পুজোর হাল হকিকত। সব মিটে গেলে জন্মদাত্রীকে " সাবধানে থেকো"  নিয়ম মাফিক বলেই পগারপাড়!


এবারের পুজোটা একটু অন্যরকম। নয়নতারার বয়স হয়ে গেছে। উঠতে বসতে কষ্ট হয় আর সব ছেলে মেয়েরাই বাইরে থাকায় এই পুজোর আয়োজন করা তার পক্ষে একপ্রকার অসুবিধা হয়ে পড়েছে, তাই এই বছরই তার জীবনের শেষ পুজো বলে সবাইকে জানিয়ে  দিয়েছে। অন্য কোন উত্তরাধিকার এই পুজো টেনে নিয়ে যাওয়ার অভিমত প্রকাশতো করেইনি উপরন্তু সব্বাই মনে মনে আনন্দই পেয়েছে কারণ তাদের ভাগের টাকা একটু বেশিই জমবে। আর মাথায় এও রেখেছে এবারেই মায়ের কাছ থেকে তাদের আখেরটা গুছিয়ে নিতেই হবে। মায়ের বয়স হয়েছে - এই সুযোগ এবারেই নিতে হবে।


বোধন দিয়ে শুরুর পুজো সপ্তমী থেকেই ঢাকের বাদ্দি আর কাঁসরের ঢং ঢংয়ের আওয়াজে মুখরিত হয় জমিদার অট্টালিকা। শেষ হয় পঙতি ভোজন দিয়ে। এক এক দিন এক এক রকমের ভোজন। ভোজন রসিকদের জন্য নিরামিষ আমিষ সব ব্যবস্থারই যারপরনাই কিছু অভাব নাই। জামাই - বৌমা যদিবা ভিনদেশি হয়েও থাকে তার অসুবিধার কোন স্থান নাই কারণ বাড়ির কর্ত্তীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তার সব ব্যবস্থাই করা আছে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।


বড়মেয়ে লতিকা দুইকন্যা নিয়ে লন্ডন নিবাসী। জামাই পাঞ্জাবী। দেখে শুনে প্রেম তারপর বিবাহ।বিয়ের আগেই ওর শরীর ছেড়ে বড়কন্যের মর্তে বেরিয়ে আসা অতিশয় বিছানায় প্রেমের লাফালাফির সফল উৎপাদনে। জামাই কমল ভীতু, পালাবার সাহস জোগায়নি উপরন্তু ফল প্রাপ্তি স্বরূপ - লতিকার সঙ্গে তড়িঘড়ি বিবাহ ও লন্ডনে পাড়ি জমানো। পরে আবার পুত্র সন্তানের আশায় দুজনায় নিস্ফল - আরো এক কন্যার মর্তে আগমন।


বড়ছেলে অজয় আমেরিকা থাকে। বিবাহ হয় আমেরিকান মহিলার সঙ্গে। পর পর দুটি পুত্র। কন্যা চেয়েও পায়নি। আমেরিকা থেকে বছরে একবার নিজের বাড়িতে এসে তার দায়িত্ব সমাধাই তার শেষ কথা। তারপর ফিরে গিয়ে ফিছুপানে তাকানো  নৈব নৈব চ !


আর দুটি মেয়ের বিবাহ হয়ে গেছে। যে যার মত পাত্র খুঁজে নিয়ে কলেজে পড়া চলাকালীন কলেজ -পড়াশোনা ছেড়ে সংসারী হয়ে পড়েছে। এতটাই সংসার ভালো লেগেছিল যে পর পর দুবছর ধরে সন্তান উৎপাদন করতেই ব্যস্ত ছিল দুইজনই যেন এক প্রতিযোগিতায় না হারার লড়াই।  অবশ্যই দুইজনেরই দুইটা করে চারটি ' মাইয়া ' । পুত্র আর হয় নাই। বাপের বাড়ি তারা আসে শুধুই নিজেদের জাহির করতে । খুবই কৃপণ । একজন এলাহাবাদ আর একজন অরুণাচল প্রদেশে।


বাকী চারটি ছেলের পরিচয় দেওয়ার মত নয়। অপদার্থ। টুকটাক কাজ করে কিন্তু সকলেই বিবাহিত তো বটেই।  সুন্দর, সুন্দরী বউ পুত্র কন্যায় সকলেই পরিবেষ্টিত। কেউ থাকে শ্বশুরবাড়ি তো কেউ থাকে ভাড়াবাড়ি। পুজো বাড়ি হলেই দঙ্গলে পাড়ি দেয় সেই চুলায়। লাজ -লজ্জে নেই ছিল না কোনোকালেই। মায়ের অনেক টাকা কিছুটা খাবলাতে পারলেই তাদের জীবন ধন্য। আবেগ কোন কাজের নয়। লজ্জার বালাই নেই তাদের জীবনে। ফিরত দেওয়ার জন্যও তাদের মন ভাবে না। তারা নিস্পৃহ শ্রেণীর প্রানী। মানুষের আকার মাত্র।


সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত পুজো আর পেটপুজো নিয়ে সব্বাই ব্যস্ত ছিল। হিসাবনিকাশ করা শুরু হলো নবমীর রাত থেকেই। ছেলেরাই যে এ ব্যাপারে এগিয়ে তা নয় মেয়েরাই বেশী পারদর্শী।

সকলেই ফিরে যাওয়ার আগে বড় বড় ভাষণ দিয়ে নিজের ভাগটা গোছাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিল সবাই। জাহির করলে তাদের ক্ষমতা। 

 

আমেরিকা লন্ডনে বসবাসকারী হয়েও দুই মেয়ে জামাই এমনকি বাইরে জন্মগ্রহণ করা এবং শিক্ষিত নাতনীগুলোও পয়সার লোভে ঠাকুর্মার পিছনে লেগে পড়েছে। এত বৈভবের মধ্যেও এদের লোভ হু হু করে বেড়েছে।  অভিনয়টা তাদের বেশ রক্তে রক্তে মিশে গেছে। ভালোবাসা বলে কিছু নেই। আছে শুধুমাত্র প্রবাসের উশৃঙ্খলতা আর লোভ। লোভীদের জিভ লকলক করে জ্বলছে।


আর যে পুত্রদের অভাব চির বর্তমান তারা একেবারে ক্ষুধার্ত পশুর মত ঝাফিয়ে পড়েছে তাদের গিন্নিদের মদতে। নবমীর রাত রায়বাহাদুর বাড়ির অন্দরমহলে এক তুলকালাম ঝগড়ার রূপ নিল। সবাই বলে -' নবমীর নিশি যেও না চলে '। আর নয়নতারার প্রার্থনা যেন এই রাত যেন তাড়াতাড়ি কেটে ভোর হয়।


ভোর হলেও আলো এল না। নয়নতারা প্রমাদ গুনলো, প্রতিমা কুলীদের কাঁধে চেপে দুপুরে যখন জলাশয়ে  গিয়ে ডুবে গেল তখনই আবার সকলে নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলে বিধবা নিঃসঙ্গে পড়ে থাকা মায়ের সাথে একহাত লড়ে নিল তার প্রতি অবিচারের নিদর্শন দেখিয়ে। সাত ভাই বোনে ঝগড়া বাঁধিয়ে তুললে মা অসুস্থ হয়ে পড়লো। বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠলো ব্যথা। 


উকিল খাজাঞ্চি এসে এযাত্রা বাঁচিয়ে দিল - শীঘ্রই পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত হওয়ার আশ্বাসের মাধ্যমে। 


একাদশী তে পগারপার হলো সকলেই পুত্র কন্যা নিয়ে। বাড়ি ফাঁকা হলো, নিস্তব্ধতার মোড়কে বান্ডিল হয়ে। ঠাকুরদালান অন্ধকারে, দুদিন আগেও যা আলোর রোশনাই মেখে নহবতে সুর ভাঁজছিল। তবুও কে যেন সলতে পাকিয়ে পিতলের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিলো সন্ধ্যাকালে। 


সরকারি নিয়মে নীলকণ্ঠ পাখি আকাশে ওড়েনি-

এ নিয়ম বেশ কয়েক বছর আগের। তবে প্রতিবছরই এই বাড়িতে কাগজের পাখি ওড়ানো হত -এবারে ভুলে এবং বিবাদে তাও হয়নি। 


একাদশী ছাড়ার আগেই মধ্যরাতে নয়নতারার জীবন পাখি কিন্তু উড়ে গেল। হয়তো কৈলাসেই হবে - নচেৎ মায়ের ফিরে আসার খবর কে দেবে?


আসছে বছর আবার কোথাও অন্য কোনোখানে এই চিত্র মঞ্চায়িত হবে না তার আশ্বাস কে দেবে ? আমরা যে ভাবে ক্রমাগত বিদেশী কালচারে 'মানুষ' হয়ে উঠছি  ……!


*************************************************************



প্রদীপ দে 

লেখক  নেশায়। পেশা ছিল হিসেবনিকেশ।  বয়স -৬২ । কলকাতা নিবাসী। বিবাহিত।
নিজের লেখা কয়েকটি বই আছে।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন