মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১

দীর্ঘ কবিতা * গৌরীশঙ্কর দে



কবিতা, কবির চেতন-অবচেতনে লালিত কোনও এক চকিত মুহূর্তের তন্ময়তার ফসল । দীর্ঘ কবিতা যেন তারই প্রলম্বিত রূপ । একটি সার্থক দীর্ঘ কবিতা ,কবির কতখানি অভিনিবেশ দাবি করে ,সমস্ত সত্তার কতখানি উজাড় তন্ময়তা ছুঁতে চায় ,তা বলার অপেক্ষা রাখে না । তেমনই মনোমুগ্ধকর একটি দীর্ঘ কবিতা এবার আমরা পড়ব , কবি গৌরীশঙ্কর দে-এর কলমে---- 


স্বরবর্ণে লিখে যেতে হবে। 

গৌরীশঙ্কর দে


বুঝি ছাদে নয়

সান ইসিদ্রোয়

বসেছিলাম কিছুসময় 

        মেয়ের ওভারকোট গায়ে।

                    ঝিরঝির পূর্ণিমা ঝরেছে

   শিশিরে আমার জ্বালাযন্ত্রণা রয়েছে,

যে সবুজ নল বেয়ে ফুসফুসে ঢুকেছে

কুয়াশা সে শাঁই শাঁই শব্দ তোলে বুকে।

                  হিমে ভেজা মাথার উপরে, 

                                   নাকের ভিতরে 

                                   নিঃশব্দ প্রহরে, 

       ছোবল তোলে সে ফুসফুসে। 

   তার শব্দে শ্বাস বন্ধ হয়ে এলে পাশ

   ফিরি, স্বপ্নে নয় কিছু প্রারব্ধ বিশ্বাস

                    নিয়ে বাঁচি, ঈশ্বর নিবাস

তখন ঘুমায়। চাঁদ ওকাম্পোর বেশে

আমার ফুলদানিতে ফুল রেখে কিছু,

   খাতার পাতায় হস্তরেখা দেখে নীচু

                  করে চোখ। ঘুমন্ত লিচুর

ঘ্রাণ বয়ে যায়, কী যে করি উত্তোলিত 

        হাত ছুঁতে চায় নম্র চাঁদের চিবুক।

চাঁদ আরো ঝুঁকে আসে, নিরাসক্ত মুখ

          ভেসে যায় চায়ের গেলাসে, সুখ

 উথলে ওঠে। দুধ টগবগ করে ফোটে,

                জগতে কলঙ্ক মাথা কোটে

         পূর্ণিমার রাতে কে ওভারকোটে

             গোগোলের গল্প নিয়ে আসে!

                              নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে 

                                    সুদূর প্রবাসে—

বাঁশি বাজে চাঁদ বুকে নিয়ে নেমে আসি

                      দেবাশিস সাহার বাড়ির 

                   দিকে হেঁটে যাই, রাবড়ির

             গন্ধ লাগে নাকে। নাকি ক্ষীর

লক্ষীর ভান্ডার, চারিদিকে শান্ত বাতি।

      কলরব সারাদিন পূজাপাঠ সেরে

ঘরে ঘরে শঙ্খ বাজিয়ে, কাঁসর নেড়ে

                  সিন্নির বাটির দিকে ধেড়ে

 ইঁদুরের মতো টুকি মেরে সিরিয়ালে

            সারি সারি মুখ গুঁজে আছে।

                 মৃত্যুভয় ছাড়া ধারেকাছে 

আর কোনো ছায়া নেই ঘুমন্ত গাছের 

                 মৃদু শ্বাস, আকাশ বাতাস

    মধুময় বড়ো। দেবাশিস বাড়ি নেই 

              পড়াতে গিয়েছে। অনেকেই 

যায়। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে সেই

            সুখী। জানিনা কোথায় গিয়ে

                              কবিতা দাঁড়ালো! 

                                   চাঁদের ঝালর 

খুলে গেছে মালোপাড়া বরাবর ঢালো

                 হে পূর্ণিমা, তোমার মহিমা,

                করো উজ্জ্বলিত, তীব্র নয়

                                   সান ইসিদ্রোয়

              শুধু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোয়

হবেনা লাবণ্য দাশ-কেও পাশে চাই।

                     নারীর হৃদয়ে যেই নদী 

   বয়ে যায় সে জলবিভাজিকায় যদি

          স্নান সেরে উঠি আর অদ্যাবধি 

অনেক অক্ষর ঢেলে যা লিখিনি আজ

                                তাই রেখে আসি

                  দেবাশিস বলো কাল হাসি

      ঢেলে বলবে না-কি 'ভীষণ প্রত্যাশী 

ছিলো মন'। ভুল ভেঙে উঠেছে এখন 

                        শব্দে শব্দে রেষারেষি

              থেমে গেছে। এর চেয়ে বেশি 

আর কী প্রত্যাশা বলো অত্যন্ত বিদেশি

উদাসিনী বেশে ধরা দিলো শেষে। 

        দাদা, আপনার কলমে নগরবাসী

   প্রপিতামহের সঙ্গে একটু ঘুরে আসি

                      ওই কম্বুকণ্ঠে রাশিরাশি 

ফুলেল জ্যোৎস্নায় ভরা মধুচন্দ্রিমায়।

  'আয় আয় আয়' দিগ্বসনা চাঁদ ডাকে,

     বহুদিন পরে বাঁধা পড়েছে বিপাকে 

                    নীলিম সময়, তুমি তাকে

                 বেঁধেছ ইমনে দাদরায়।

      এই না সেদিন তুমি বলেছিলে সুর

      খুঁজে পাচ্ছেন না, শুধু মৃত্যুর মধুর 

                 ধ্বনি বাজে। জীবনে কর্পূর 

জ্বলে গেছে। আজ সান ইসিদ্রোয় ভরা

ছাদে একাকিনী কার চোখের আলোয়

   দেখলেন তাকে? চোখের বাইরে, ভয়

   আকাশকুসুমে, এতো এতো অবক্ষয় 

              কল্পনায় আনেননি বলে?

             ছাপা হলে কে কী বলে দেখি।

     কতটা টাটকা আর কতখানি মেকি 

  এই দীর্ঘশ্বাস। মেয়ে না প্রবাসে এ কী

ও-ই তো পাশে বসে হারমোনিয়ামে 

সা মা পা-য় রিড চেপে আপনার সঙ্গে 

   বসেছে সঙ্গতে আর তারাদের অঙ্গে 

     আহা মৃদু পূর্ণিমায় ঘোর ঋতু রঙ্গে 

অঘ্রাণ এসেছে জানি অতি মারাত্মক। 

চাতক পাখির ডাক থেমে গেছে কবে

                     যে অতিমারির কলরবে 

 ঢাকা ছিলো চাঁদ, আজ বলতেই হবে

  সমস্ত আকাশ শ্রুত পূর্ণিমার জলে।

       সাদা পৃষ্ঠা বরাবর চলেছে অক্ষর...

        পরের সংখ্যায় লিখবেন বিশ্বম্ভর

    আর রুক্ষ্মিণীর কথা। রাধায় বিস্তর

    বাধা। তবু লিখে যেতে হবে স্বরবর্ণে।


*********************************************



গৌরীশঙ্কর দে 

বাংলা কবিতায় একটি পরিচিত নাম ছন্দকুশলী এই কবি প্রতিনিয়ত আমাদের কাব্যপিপাসা পরিতৃপ্ত করে চলেছেন নির্বাচিত কবিতাসহ এ পর্যন্ত আটটিরও বেশি কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন তাঁরকয়েকটি উল্লেখযোগ্য  কবিতার বই ---অশ্রু প্রপাতের নিচে * স্খলিত স্বপ্নের নীড় * ভাষামাতৃক্রোড়*আদিসপ্তগ্রাম * আশির বাদকের পত্রলেখা*অনৈশ্বর্য * নির্বাচিত কবিতা 
আমার নিভৃতাবাস (যন্ত্রস্থ)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন