যে গ্রামে মৃতদের কেউ ভোলে না
রাহুল দাশগুপ্ত
আমার স্ত্রী যে গ্রামের মেয়ে, সেটা একটা আশ্চর্য জায়গা। ওর মুখ থেকে যখন সেকথা শুনেছিলাম, তখন মোটেই বিশ্বাস করতে পারি নি। ভেবেছিলাম, এ হতে পারে না। অবিশ্বাস্য!
সে বলেছিলো, আসলে তুমি তো এই মৃত শহর ছেড়ে কোথাও যাওনি। তাই ওরকম মনে হচ্ছে। দুনিয়ায় এখনও অনেক আশ্চর্য জায়গা রয়ে গেছে!
আমি তার সব কথাই বিশ্বাস করতাম। সে ছিল এতই নিস্পাপ আর পবিত্র যে তাকে অবিশ্বাস করা ছিল অসম্ভব। অপরাধও বটে। আমাদের শহরটা গোটা দুনিয়ায় ‘মৃত শহর’ বলে পরিচিত। এই শহরেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পড়তে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ। আমার মনে হতো, এখানে যা কিছু দেখছি, গোটা দুনিয়াটাই বুঝি সেরকম! একদিন সেকথা আমার স্ত্রীকে বললাম।
না, না, তুমি ভুল করছে। আমাদের গ্রামে গেলেই বুঝতে পারতে, তা নয়। এই শহরের সঙ্গে কোনও মিলই নেই আমাদের গ্রামের।
কেন? কিসের অমিল? আমি জানতে চেয়েছিলাম।
তোমাদের এখানে মৃতদের কথা কেউ চিন্তা করে না, মৃতদের ভুলে যায়, ভুলে থাকে। আমাদের গ্রামে মৃতদের কেউ ভোলে না!
আমি তাজ্জব বনে গেছিলাম। সত্যিই দুনিয়ায় এরকম জায়গা থাকা সম্ভব?
এই মৃত শহরে গাছগুলো আর সবুজ নেই, সমস্ত হলদেটে, বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাড়িগুলোর রঙ চটে গেছে, হঁট বেরিয়ে গেছে। যানযট আর জায়গায় জায়গায় আবর্জনার স্তূপ পরে থাকায় রাস্তাগুলোয় চলাফেরা করা প্রায় অসম্ভব। বাজার আর ধর্মীয় স্থানগুলো নরকের চেয়েও বেশি দূষিত ও দুর্গন্ধে পরিপূর্ণ। অফিসগুলো নিরেট দেয়ালে তৈরি, বৃহৎ, বিস্তৃত আর আকাশকে ছুঁতে পারে এত উঁচু। একটা অফিসের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় ওখানেই দুনিয়াটা শেষ হয়ে গেছে, পিছনে আর কিছু নেই। যেখানে যত জলাশয় আর কৃষিখেত ছিল সেগুলো বুজিয়ে দিয়ে এই অফিসগুলো তৈরি করা হয়েছে। চড়ায় চড়ায় নদীগুলোর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, হেঁটেই পারাপার করা যায়, তার গায়ের ওপর গড়ে তোলা হচ্ছে কংক্রিটের প্রাসাদ। ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড়। জঙ্গলগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে, সেখানে গড়ে উঠছে নানা বিনোদন পার্ক। গোটা প্রকৃতিকে সমতল করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, মানুষের মতোই।
মানুষগুলো যন্ত্রের মতো, মানবিক অনুভূতিশূন্য, তারা হাসে না, কাঁদে না, প্রতিবেশীর বাড়ি যায় না, বন্ধুত্ব করে না। তারা সবাই মিডিওকার, কারও মধ্যে অতিরিক্ত প্রতিভা দেখলেই শনাক্ত করা হচ্ছে, তারপর সব জায়গা থেকে তাকে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে, বাতিল হতে হতে তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে, সরিসৃপের মতো বুকে হেঁটে তখন সে করুণাপ্রার্থীদের লাইনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, এইভাবে তার গোটা জীবনটাকে নিয়েই যেন একটা কৌতুক বা ঠাট্টা চলতে থাকে। যাদের অর্থ আছে তারা শুধু সঞ্চয় করে, দামি দামি খাদ্য, পোশাক, বিলাস ও বিনোদনের দ্রব্য কিনে আনে। যাদের অর্থ নেই তারা ভিক্ষা করে, করুণাপ্রার্থীর মতো ফুটপাতে, ধর্মীয় স্থানে, ঝা চকচকে অফিসগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, শীতে কাঁপতে থাকে, ঝড়ে বজ্রাঘাতে গাছের চাপে মারা যায়, মিছিলে যোগ দেয়, ধর্মঘট করে, অনাহারে থাকে আর ভালো দিনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে প্রলাপ বকে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, মানুষের কানাকড়িও দাম নেই এই মৃত শহরে, তা তার অর্থ থাক আর না-ই থাক। তবু যতক্ষণ সে জীবিত থাকে, তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। মানুষ হিসাবে তাকে মেনে নিতেই হয়। কিন্তু মারা গেলে তার আর রক্ষে নেই। চিতায় ওঠার পরমুহূর্তেই সবাই তাকে ভুলে যায়। মৃত শহরের বাস্তবতা থেকে সে একেবারে মুছে যায়!
হ্যা, এখানে আমাকে একটু থমকে যেতেই হলো। কারণ, একটা মৃত শহরের শুধু বাস্তবতাই থাকে। তার কোনও স্মৃতি বা ইতিহাস থাকে না। জীবিতদের নিয়েই সে মৃত। সে বাস্তব। তার কোনও অতীত নেই। কারণ অতীতটাকেই মেরে ফেলেছে জীবিতরা। তারা নিজেদের জন্য এমন একটা জীবন ও তার বাস্তবতাকে বেছে নিয়েছে যা নিজেই মৃত! জীবনের কোনও স্পন্দনই পাওয়া যায় না এখানে। জীবিত থেকেও তাই মৃতের ভূমিকায় অভ্যস্ত হয়ে যেতে হয়। আর সেইভাবেই তাকে প্রস্তুত করা হয় শৈশব থেকে। যাতে একমুহূর্তের জন্যও তার সন্দেহ না হয়, পরিবারে-সমাজে-রাষ্ট্রে সে যে ভূমিকা নিচ্ছে তা কোনও জীবিতের হতে পারে না। একমাত্র মৃত মানুষই এইভাবে সমস্ত বোধ, চেতনা ও প্রজ্ঞা ছাড়াই স্বাভাবিক থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে একটা অস্বাভাবিক অবস্থাকেই তাদের কাছে স্বাভাবিক করে তোলা হয়। তাই কেউ মারা গেলে, তৎক্ষণাৎ তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়, যাতে মৃতকে দেখে নিজেদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তারা সচেতন হয়ে উঠতে না পারে। এই ভুলে যাওয়াটাতেই রপ্ত করে তোলা হয় তাদের।
আমার স্ত্রীকে আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো, প্রতিটা শহরেই একদল অভিভাবক থাকেন। তারা কী এই সমস্যাটা নিয়ে ভাবেন না?
আমি বললাম, ১৯৪৭ সালে এই শহরটা কিনে নিয়েছিল একটি সার্কাস কোম্পানি। তারপর থেকে একদল ভাঁড়ের একটি কমিটি এই শহরটা চালায়। তারা শুধু সার্কাস নিয়েই ভাবে। সার্কাস দেখিয়ে ভালো দাম উঠে এলেই তারা খুশি হয়। এই লাভ-লোকসানের হিসেবেই শহরটা চলছে।
আমার স্ত্রী জানতে চাইলো, কিন্তু যারা এই শহরের মালিক ছিল তারাই বা ওই সার্কাস কোম্পানিকে বিক্রি করতে গেলো কেন?
কারণ তারা ছিল ব্যবসায়ী আর তার ওপরে বিদেশি। স্থানীয় ভৃত্যদের কাছে শহরটা বিক্রি করে দিয়ে তারা দেশে ফিরে যেতে চাইছিল। আর যার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি দাম পেয়েছে তাকেই বিক্রি করে দিয়েছে। তাতে এই। শহরের ভালো হলো না মন্দ, ও নিয়ে ভাবার সময় তাদের ছিল না।
আমার স্ত্রী’র চোখ জলে ভরে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো, কী হতভাগ্য এই শহর! কিন্তু তুমি একাই নিশ্চয়ই এই শহরের সত্যকে জানো না...
না, অনেকেই জানে...
তারা কেন চুপ করে থাকে? কেন মৃত সাজার অভিনয় করে যায়? বিশেষ করে যখন তারা জানে যে জীবিত মানুষেরা যে জীবন কাটায় তা মৃতদের চেয়ে অনেক সুন্দর...
না, এটা তোমার ভুল। কারণ সৌন্দর্যের চেয়ে অনেক দামি জিনিস তারা পেয়ে গেছে। আর তা হলো স্থিতাবস্থা। তারা সার্কাস কোম্পানির ভাঁড়েদের মন যুগিয়ে চলে। ভাঁড়েদের শহরে ভাঁড় সেজেই থাকতে চায়। আর এইভাবে। থাকতে থাকতে ভুলে যায় নিজেদের সমস্ত সম্ভাবনাকে। বিনিময়ে এই অস্থির সময়েও পায় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা। অর্থ, বিলাস, বিনোদন তাদের জীবনকে কুৎসিত করে তোলে। আর নিজেরা সমস্ত কুক্ষিগত করে রাখতে চায় বলে বাকিদের জীবন কদর্য হয়ে ওঠে। কদর্য মানুষেরা নিজেদের মধ্যে হিংসায় লিপ্ত হয়, পরস্পরকে হত্যা করে, রক্তের স্রোতে ভিজে যায় গোটা শহর। কিন্তু তারা নিরাপদে থাকে, মদ-মাংস-মেয়ে-পার্টি নিয়ে হুল্লোড়ে-উৎসবে জীবন কাটায়, তাদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগে না। এই স্থিতাবস্থা বছরের পর বছর ধরে চলছে। এই বৈষম্য মানুষের জীবনকে কদর্য করে তুলেছে। সুন্দরের আকাঙ্খা আর কারও মধ্যে বেঁচে নেই, মৃত শহরে সেটাও মরে গেছে...
আমার স্ত্রী’র কণ্ঠস্বর বিলাপের মতো শোনায়, তার মানে শহরটা শুধু শরীরের দিক দিয়েই মরে যায় নি, তার মনেরও মৃত্যু ঘটেছে, নৈতিক মৃত্যু, স্পিরিচুয়াল ডেথ...
আর ভাড়ামি হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী। রাজনীতি, বাণিজ্য, শিল্প, সংস্কৃতি-সর্বত্র চলছে ভাঁড়ামি। ভাঁড়েরা চাইছে নিজেদের উত্তরাধিকার হিসাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে অসংখ্য, অগণিত ভাঁড় তৈরি করে যেতে, যাতে ভবিষ্যতে এই মৃত শহরে আর কখনও ভাড় ছাড়া অন্য কিছু না জন্মায়...
আর যারা স্বপ্ন দেখে, তাদের কী হবে তাহলে?
প্রতিভাবানদের মতোই তাদের শনাক্ত করা হবে, তারপর বাতিল করে দেওয়া হবে, যাতে তাদের স্বপ্নগুলো মরে যায়। মৃত শহরে কোনও স্বপ্ন বেঁচে থাকতে পারে না...
তুমি আর এখানে থেকো না। আমার সঙ্গে আমাদের গ্রামে চলো...
না, আরও কয়েকটা দিন আমাকে থাকতে হবে। তুমি তো জানোই আমার গবেষণার বিষয়, “মৃত শহরে সৌন্দর্যের স্থান। এই শহরে থেকেই আমাকে গবেষণা করতে হবে, ডিগ্রিটা পেয়েই তোমাদের ওখানে আমি চলে যাবো।
কী হবে ডিগ্রি পেয়ে? আমার স্ত্রী ফুসে ওঠে, শুধু নলেজ সংগ্রহ করে করে জড়ো করা আর অজস্র জেনারেল নলেজের বইয়ের ভিড়ে আরও একটার সংযোজন, এই তো! মনে রেখো, জ্ঞান হলো কাঁচামাল, কিন্তু তাকে রান্না করে প্রজ্ঞা তৈরি করতে না পারলে সবই বৃথা। ওই কাঁচামাল বেঁচে তোমাদের মৃত শহরে অনেক অর্থ বা যশ পেতে পারো বটে, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানীর কাছে তার কানাকড়িও মূল্য নেই। তুমি বরং আমার সঙ্গে চলো, সেখানে অনেক। প্রকৃত জ্ঞানীর সন্ধান তুমি পাবে, যারা শুধু জ্ঞান সংগ্রহ করেই বসে থাকে নি, তাদের ভেতরের সারকথাটা বুঝে নিয়ে প্রজ্ঞা অর্জন করতে পেরেছে এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের জীবন বদলে ফেলতেও পেরেছে।
আমি জানি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, জ্ঞান সংগ্রহ করে অর্থ, যশ, সম্মান, প্রতিপত্তি জোটে, লোকে তাকে পণ্ডিত বলে, কিন্তু যে প্রজ্ঞা অর্জন করে, সে-ই জীবনে সার্থক হয়, লোকে তাকে বলে সাধক। আমিও সাধনাই । করতে চাই, কিন্তু আমার গবেষণারও প্রয়োজন আছে, ওটা একটা জরুরি বিষয়, ডিগ্রি পেলাম কী পেলাম না সেটা বড় কথা হয়, হয়তো ডিগ্রির জন্য আমি আবেদনই করবো না...
আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবো। এই কথা বলে আমার স্ত্রী গ্রামে ফিরে গেলো। শহরে সে এসেছিল ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করতে। আমার কাছেই ও পড়তে আসতো। ওর পড়াশুনো শেষ হওয়ার পরই আমরা বিয়ে করে নিয়েছিলাম।
আমি মৃত শহরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থেকে গেলাম। গবেষণার কাজ দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো।
২
বিবর্ণ, একঘেয়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল।
সার্কাস কোম্পানি আমার পর্যবেক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেছিল এক বৃদ্ধ বিচারককে। আমি দ্রুত কাজ করলে সে বলতো, আমি আস্তে কাজ করছি। আমি তৎপরতা দেখালে সে আমাকে 'অলস’ বলে গালিগালাজ করতো। আমি যেহেতু খুবই সিরিয়াস ছিলাম কাজের ব্যাপারে, তাই সে আমাকে সর্বদাই সবার কাছে ‘এ সব ব্যাপারেই ক্যাজুয়াল’ বলে পরিচয় করিয়ে দিতো। আমি বুঝতে পারতাম এই মৃত শহরে তার বিচার-ক্ষমতাও মরে গেছে। তাই বিচারক হিসাবে সে এত সফল হতে পেরেছে। অনেকগুলো সরকারি খেতাবও পেয়েছে।
আসলে সে চাইতো আমিও অন্যদের মতো ভাঁড়ামি করি। আর কাজ করি শুধু তারই স্বার্থে। যাতে তার আরও কয়েকটি সরকারি খেতাব জুটতে পারে, সে মান্যগণ্যদের মধ্যে একেবারে শীর্ষস্থানে চলে যেতে পারে। শুধু এটুকু করলেই সে হয়তো আমাকে ডিগ্রিটা পাইয়ে দিতো। কিন্তু ভাড় হওয়ার ইচ্ছা আমার একেবারেই ছিল না। তাই । লোকের কাছে সর্বদাই সে আমাকে একটি আস্ত ভাঁড়' বলে পরিচয় করিয়ে দিতো। তুচ্ছ তুচ্ছ সব কারণে আমার খুঁত ধরতো। আর এইভাবে আমার মন ভেঙে দিতে চাইতো।
একদিন সে আমাকে বলেই বসলো, তোমার বোধশক্তি ভীষণ কম...
কেন? আমি জানতে চাইলাম।
গবেষণার আর বিষয় পেলে না! মৃত শহরে সৌন্দর্যের স্থান! তা কী সৌন্দর্য দেখতে পেলে তুমি? মৃত শহরে সৌন্দর্যের স্থান কোথায়? ওসব কেউ চায় না মাথা ঘামায়? যত সব ব্যাকডেটেড, মৃত ব্যাপার নিয়ে কালচার... ইউজলেস...
একটা মৃত শহরে থেকে সমস্ত মৃত ব্যাপারের প্রতি আপনাদের এত অনীহা কেন?
শোনো, শহরটা যে মরে গেছে, সেটা কোনও দৈব ব্যাপার নয়। আমরাই তাকে মেরে ফেলেছি। আর যা মরে গেছে তা নিয়ে আমরা আর ভাবতে চাই না। কোনও মৃত ব্যাপার নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। হাতের কাছে যা পাচ্ছাে, তা নিয়েই কাজ করো, নইলে বাতিল হতে বেশি সময় লাগবে না...
তাহলে মৃত শহরে সৌন্দর্যের কোনও স্থান নেই? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি জানতে চাইলাম। না, না, সে চেঁচিয়ে উঠলো, সবই কদর্য, আর কদর্যতার মধ্যেই আমরা ভালো আছি, আনন্দে আছি... এই তো এখনই আমি সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাচ্ছি, সারারাত সেখানে পার্টি হবে, মদ্যপান করবো আর নগ্ন মেয়েদের নাচগান দেখবো, আমার কী কোনও অসুবিধে হচ্ছে? মৃত শহরের জীবনটা তো মন্দ নয়...তাহলে তোমার অত মন্দ খোঁজার বাতিক কেন?
বাতিকই বটে! আর সৌন্দর্যই তো মন্দ! এই লোকটার সমস্ত বিচারবুদ্ধিই মরে গেছে। এ একজন মৃত শহরের। উপাসক। মনমরা হয়ে সেদিন বাড়িতে ফিরে এলাম।
আমার স্ত্রী প্রায়ই আমার জন্য কাঁদতো। তবে নিঃশব্দে। বাবা-মা’কে জানতে দিতো না। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে আমাকে নানারকম এস এম এস পাঠাতো। আর সেইসব বার্তায় ওদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করতো। ফোন করে বলতো, তোমাদের শহরে আমি এতদিন ছিলাম, আমাদের গ্রামে তুমি আসবে না কেন?
আসবো, আর একটু অপেক্ষা করো।
তোমার কাজ কদ্দুর?
আর একটু বাকি সোনা, তারপরই তোমার কাছে আসবো...
কতদিন দেখি না তোমাকে, আমার খুব কষ্ট হয়...
আমারও তো হয়...
তুমি আমার জন্য কাঁদো না তো?
তুমি কাঁদো?
হ্যা, চুপি চুপি, তুমি কিন্তু কেঁদো না, আমার কষ্ট তাহলে আরও বেড়ে যাবে...
কখনও কখনও সে যেন আমার মা হয়ে যেতো। খুব ছোটবেলায় একটা দুর্ঘটনায় আমার মা-বাবা মারা যায়। আমার মধ্যে সেই অভাব আছে সে জানতো। আমার স্ত্রী লিখতো, ‘বড় হও, ভালো হও, পাকামি করো না, মায়ের কথা শুনো। ইতি মা। আবার কখনও লিখতো, ‘কা করছো? মা তোমাকে দেখতে চাইছে। তুমি ছুটি নাও। মা তোমার শহরে কত থাকে, কিন্তু তুমি না থাকো। মনে রেখো। তুমি কেন মায়ের ভালো ছেলে হবে না? অথবা, ‘আপ সে দূর রহে কর আপ কো মিস কিয়া হামনে, আপ কে লিয়ে গড় সে উইশ কিয়া হামনে, আপকি ইয়াদ চুপকে সে চলে আয়ে তো আপকো এক পেয়ারা সা এস এম এস কিয়া হামনে। অথবা, “আমিও তোমা জন্যে কানিচি। মা – বাবার সামনে লজ্জা করে, মা ঘুমোনোর পরে কানিচি, তোমাকে ভেবেছি রাতে ফোন করবো, কিন্তু তুমি ঘুমিয়ে গেছিলা।
প্রকৃতপক্ষে এইসব এস এম এস পাঠানোর সময় সে যেন একটা শিশু হয়ে যেতো। আর চাইতো, আমিও তার সঙ্গে যেন শিশুদের মতো করেই কথা বলি। এ শুধু তার আব্দার ছিল না, রীতিমতো দাবি ছিল। গ্রামের সমস্ত শিশুরাই ছিল তার বন্ধু। সে যতক্ষণ ফোনে কথা বলতো, তার বেশিরভাগই হতো সেই শিশুদের নিয়ে। তাদের খুঁটিনাটি তার মুখস্ত ছিল। তাদের আব্দার, অভিমান, নানারকম মজার কীর্তি। আর সে চাইতো আমিও যেন শিশুর মতো থেকে যাই আর সরল হৃদয়ে আজীবন তার পাশে থাকি। সে ভয় পেতো, আমাকে বড় হওয়া সম্পর্কে সতর্ক করতো, পাকামি করতে বারণ করতো আর মায়ের মতোই শাসন করতো।
মৃত শহরে কোনও হিংসার ঘটনা ঘটলে সে তৎক্ষণাৎ ফোন করতো আর বলতো, আমার খুব ভয় করছে, তোমার কী হবে!
আমি ঠিক আছি।
না, না, ওখানে তুমি একা। তুমি চলে এসো, শিগগিরই চলে এসো...
রাতের পর রাত সে ঘুমোতে পারতো না, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিতো, শেষপর্যন্ত হিংসা থামলে তবে সে শান্ত হতো।
আমার গবেষণার কাজ কিন্তু একেবারেই এগোচ্ছিলো না। আমি বুঝতে পারছিলাম, ওটা শেষ হবে না। আর শেষ হলেও ওটার স্বীকৃতি জুটবে না। মৃত শহরে সৌন্দর্যের কোনও স্থানই কেউ মেনে নেবে না। আর যদি মেনেও নেয়, তবে সৌন্দর্যকে কদর্য করে ছাড়বে, তবেই মেনে নেবে। আমার মন ভেঙে যাচ্ছিলো। ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়ছিলাম।
একদিন বৃদ্ধ বিচারকের জরুরি তলব পেয়ে তার বাড়ি ছুটে গেলাম। সে বললো, তুমি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছো!
অভিযোগ শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তারপর বললাম, কী যা-তা বলছেন আপনি?
হ্যা, ঠিকই বলছি। নইলে আমাকে কাল ফুলের তোড়া পাঠালে কেন? সঙ্গে আবার একটা নিসর্গের ছবি আর কবিতার বই!
কারণ, কাল আপনার জন্মদিন ছিল!
তুমি আমার জন্মটাকেই অভিশপ্ত করে ছাড়লে! তুমি আমাকে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করলে! তুমি ভেবেছো, এইভাবে ষড়যন্ত্র করে তুমি ডিগ্রিটা হাতিয়ে নিতে পারবে, অ্যাঁ? না, আমি আর যাই হোক, নির্বোধ নই। ষড়যন্ত্র আমি বুঝি। অনেক ষড়যন্ত্রকারীকে কঠোর শাস্তিও দিয়েছি।
আমার মন ভেঙে গেছিল। বললাম, শুনুন, কাল আমি আসবো না, আমার জ্বর আসছে...
আসছে? এখনও আসেনি? আর না আসা সত্ত্বেও তুমি ছুটি চাইছো? তাহলেই বোঝাে, আমার অভিযোগগুলো সত্যি কিনা! আসলে তুমি একটি ফাঁকিবাজ! নানা ফাঁকফোকর করে ছুটি বাগিয়ে নিতে তোমার কোনও জুড়ি নেই।
আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিলো। ছুটে পালিয়ে এলাম সেখান থেকে। বাড়ি ফিরেই জামাকাপড় গুছিয়ে নিলাম। তারপর আমার স্ত্রীকে ফোন করে জানালাম, অবশেষে আসছি...
আমার স্ত্রী খুবই আনন্দিত হলো। তারপর একটু ইতস্তত করেই জানতে চাইলো, আর তোমার গবেষণা?
ওটা হবে না। মৃত শহরে সৌন্দর্যের কোনও স্থান নেই। এখানকার মানুষেরা সৌন্দর্যকে দেখতে পায় ঠিকই, কিন্তু ওদের চোখে পড়া মাত্র সেই সৌন্দর্য বিকৃত হয়ে কদর্য রূপ নেয়, এটাই আমার সিদ্ধান্ত। ডিগ্রির কোনও প্রয়োজন। আমার নেই...
৩
ট্রেন থেকে একটা ছোট স্টেশনে নামলাম। দু’পাশে ফুলের বাগান। তার মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে স্টেশনের বাইরে বেরোতেই দেখলাম আমার স্ত্রী তো রয়েছেই, সঙ্গে তার বাবা, মা’ও দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই তারা হাত নাড়তে শুরু করলো। তারপর অভ্যর্থনা করে একটা খোলা ভ্যানে নিয়ে গিয়ে বসালো। একদিকে একটা সরু নদী। স্বচ্ছ তার জল। অন্যদিকে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত, দূরে ছবির মতো পাহাড়ের গায়ে মিলিয়ে গেছে। এ দুইয়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলছিলাম। সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। গোটা চরাচর যেন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিলো। দূর থেকে ভেসে আসছিল সমুদ্রের গর্জন। বহুদিন পর খোলা আকাশের নিচে, মানুষের সহৃদয়তা পেয়ে, মুক্ত বাতাসের ঢেউয়ের ঝাপটা মেখে আমি একেবারে অভিভূত হয়ে গেছিলাম।
আমি অনর্গল কথা বলে চলছিলাম। এত শব্দ আমার ভেতরে লুকিয়ে ছিল দেখে নিজেই বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমি বলছিলাম, আগেই আমি বৃদ্ধ বিচারক সম্পর্কে শুনেছিলাম। যাকে উনি পছন্দ করেন না, যাকে বাতিল করে দিতে চান, তার ওপর উনি এমন একটা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, যার কয়েকটি স্তর আছে। উনি প্রথমে খুব তেড়ে সমালোচনা করেন। এতেই অনেকের মন ভেঙে যায়। কিন্তু যার ভাঙে না, যে তীব্র জেদে কাজ করে যায়, ফলে। ভাগ্যে কিছু প্রশস্তিও জোটে, তাকে তিনি তোষামোদ করতে শুরু করেন। কারণ অন্যরা প্রশংসা করছে এবং তিনি। একা সমালোচনা করছেন, এটা চলতে থাকলে তার উদ্দেশ্য ধরা পড়ে যেতে পারে এটা তিনি জানেন। তখন তিনি নিজে আর সমালোচনা করেন না, নিজে মুখে প্রশংসাই করতে থাকেন, অনেক কিছু পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখান আর ঘুরিয়ে অন্যকে দিয়ে মনগড়া সমালোচনা করে যেতে থাকেন। এভাবে তিনি ক্রমেই মানসিক চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু যে তার উদ্দেশ্য বুঝে গেছে, সে আর ওই মানসিক চাপটা নেয় না, ওইসব অভিযোগকে তখন আর সে কোনও গ্রাহ্যই করে না। আর এভাবেই কেউ কেউ শেষপর্যন্ত তার গবেষণা শেষ করতে পারে, এটা জেনেই যে তার স্বীকৃতি কোনওদিন জুটবে না... আমি অবশ্য আগেই আমার গবেষণার ফলাফল পেয়ে গেছি...
ওসব কথা এখন থাক, আমার স্ত্রী বাধা দিয়ে বলল।
সত্যিই, অন্তত এই পরিবেশে... আমি জানি তোমার মনে অনেক গ্লানি রয়েছে, অনেক কষ্ট...কিন্তু মৃত শহর তোমার কাছে এখন সত্যিই মৃত। চলো, আমরা সেই জায়গায় এসে গেছি...
একটা ঘেরা জায়গা। তার ভেতরে সারি দেওয়া পরপর শাদা মার্বেল পাথরের স্তম্ভ, বাধানো বেদীর ওপর। সেই স্তম্ভের গায়ে ওপর থেকে নীচে পাশাপাশি দু'তিনটে সারিতে ছোট ছোট করে কালো অক্ষরে লেখা একের পর এক নাম। গোটা জায়গাটা আলোয় ঝলমল করছে।
আমার স্ত্রী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো, তোমাকে বলেছিলাম না, আমাদের গ্রামে মৃতদের কেউ ভোলে না...এই দেখ প্রতিটা পরিবারের নামে একেকটা স্তম্ভ, প্রতিটা স্তম্ভে সেই পরিবারের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রত্যেক সদস্যের নাম লেখা, পাশে মৃত্যুর তারিখ...
আমার শ্বশুর মশাই বললেন, এখানে কোনও মানুষকে ভুলে যাওয়ার রীতি নেই। হয়তো সে একটা পাগল বা ফেরিওয়ালা, মেথর বা ঝাড়ুদার, বেকার বা মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত, পঙ্গু বা জড়ভরত, আমরা কাউকে তুচ্ছ মনে করি না। সবাইকেই মনে রাখার উপযুক্ত মনে করি।
আমার শাশুড়ি বললেন, আমরা মনে করি এখানকার জীবন কারও একার নয়, হয়তো কেউ সফল হয়েছে কেউ ব্যর্থ, কিন্তু সাফল্য-ব্যর্থতা কোনও মানুষকে বিচার করার মাপকাঠি হতে পারে না, মানুষের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে মানবতা, কারণ একমাত্র মানবতার কাছেই সে দায়বদ্ধ, বাইরে থেকে দেখে তাকে যত তুচ্ছই মনে হোক, আসলে আমাদের এই যৌথ, সম্মিলিত জীবনে তারও একটা ভূমিকা রয়েছে, সেই ভূমিকাকে সে পালন করেও চলেছে এবং তাকে অস্বীকার করা যায় না, সেটা পাপ।
আশ্চর্য মানুষ আপনারা। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তারপর বললাম, পাপে পরিপূর্ণ একটি মৃত শহরের মানুষ আমি। এরকম কথা কেউ কখনও আমাকে বলেনি...
আমার শাশুড়ি বললেন, আসলে আমরা মনে করি, মৃত বলে কিছু হয় না। আয়ুক্ষয় অনিবার্য, কিন্তু জীবন অবিনশ্বর। কারও আয়ু ফুরিয়ে যাওয়া মানেই সে মৃত নয়। সে তার কাজের মধ্যে দিয়ে বেঁচে আছে, তার । উত্তরাধিকারের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছে, গোটা একটা গ্রামের স্মৃতিতে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকার অনেক উপায়। সে বেঁচে আছে বলেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে আছে, আর জীবনের পর জীবন টিকে আছে বলেই গড়ে উঠতে পারছে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক, আবহমান জীবনের ধারা...
আমার শ্বশুর বললেন, এখানে প্রতিভা, স্বপ্ন বা সৌন্দর্য, কাউকে মেরে ফেলা হয় না, সবাইকে বাঁচিয়ে রাখা হয়, সে যাতে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে, তার জন্য নিরন্তর তাকে প্রেরণা দেওয়া হয়, ঠিক যেভাবে একটি চারাগাছের জন্য জল, মাটি, আলো, বাতাসের ব্যবস্থা করে তার মহীরূহ হয়ে ওঠার পথ প্রশস্ত করা হয়, এমনকী যে প্রতিভা, স্বপ্ন বা সৌন্দর্য আয়ুক্ষয়ের ফলে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তাকেও বাঁচিয়ে রাখা হয় নতুন স্বপ্ন বা স্মৃতির মধ্য দিয়ে, নতুন প্রতিভা বা সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে, পূর্বজনের প্রতি প্রাপ্য ঋণ স্বীকার করেই এবং তাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়েই...
কিছুক্ষণ পরে একটি পরিবারের আগমন ঘটলো। সবার হাতে একটি করে প্রদীপ।
আমার স্ত্রী সেদিকে তাকিয়ে বললো, ওই দেখো, নিশ্চয়ই ওই পরিবারের কারও আজ মৃত্যুদিন। হাতে আলো নিয়ে সবাই তাকে স্মরণ করতে এসেছে। তাকে বলতে এসেছে, আমরা তোমাকে ভুলি নি... একটু চুপ করে থেকে সে আরও বললো, হয়তো যার মৃত্যুদিন, তাকে ওরা কেউ-ই দেখে নি, হয়তো সে অনেক আগের কোনও উর্ধতন পূর্বপুরুষ, তার কাছে ওরা স্বীকারোক্তি করতে এসেছে, ওরা তারই উত্তরাধিকার এবং সেকথা ওরা ভোলেনি...
অল্প কিছু পরে আরেক দল এলো হাতে প্রদীপ নিয়ে ওই একই স্তম্ভের কাছে। আমার এবার কৌতূহল হলো। জানতে চাইলাম, এরা কারা?
আমার স্ত্রী খবর নিয়ে এসে জানালো, প্রথম দলটি সত্যিই ছিল বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার। আর এই দ্বিতীয় দলটি হলো ওনার কাজের উত্তরাধিকার। এরা একদল বিজ্ঞানী, ওনার কয়েকটি সূত্রের ওপরই কাজ করছে, তাই কাজের ক্ষেত্রে পূর্বসূরিকে সম্মান জানাতে এসেছে।
ঘেরা জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে শেষপর্যন্ত আমার স্ত্রীর বাড়িতে এলাম। একতলা বাড়ি। সামনে চমক্কার বারান্দা। সিঁড়ি দিয়ে উঠলে সুন্দর একটা ছাদ। চারপাশে বাগান। প্রচুর গাছগাছালি। বাগানের একদিকে একটা পুকুর। উত্তেজিত মন এমনিই শান্ত হয়ে গেছিল। এখন যেন জুড়িয়ে গেল।
বিছানায় শুয়ে বললাম, মৃত শহরে যখন থাকতাম, রাতে বিছানায় শুয়ে মনে হতো, যেন বারুদের ওপর শুয়ে আছি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন কোনও আলোড়ন নেই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই ফুসছে, একে অপরের দিকে ক্ষিপ্ত চোখে তাকাচ্ছে, পরস্পরের সর্বনাশ করার চেষ্টা করছে। মানুষ যদি একটু সহৃদয় আর স্বার্থহীন হতো, কোথাও বারুদ জমতো না, আমরাও একটা সুস্থ পরিবেশ পেতে পারতাম...
আমার স্ত্রী বললো, কাল তোমাকে এখানকার এক বিখ্যাত চিত্রকরের কাছে নিয়ে যাবো। অত্যন্ত আধ্যাত্মিক মানসিকতার মানুষ। সবসময়ই ক্যানভাসে প্রেম, সত্য ও ঈশ্বরের সম্পর্ক বিচিত্র বর্ণে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
আমি বললাম, মৃত শহরে থাকার সময় সেখানকার সবচেয়ে নামজাদা চিত্রকরকে আমি চিনতাম। সে আবার জীবন থেকে আধ্যাত্মিকতাকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছে। প্রেম বলতে সে বোঝে যৌনতা, সত্য বলতে বোঝে ভোগ আর ঈশ্বর বলতে ক্ষমতা। এদেরই সে রঙে-রেখায় ফুটিয়ে তুলতে চায়।
কয়েকদিন পর ভোরবেলায় সমুদ্রের ধারে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো সেই বৃদ্ধ বিচারকের সঙ্গে। জানতে চাইলাম, আরে, আপনি এখানে?
সে পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো, আরে, কোথায় পালালে তুমি? তোমার মতো এত করিতকর্মা, সৎ, একনিষ্ঠ কর্মীর খুব প্রয়োজন আমার!
দেখলাম এর বিচারবুদ্ধি আবার স্বস্থানে ফিরে এসেছে। রাতে স্ত্রীকে বললাম, তাহলেই দেখো, সুস্থ জায়গায় এলে মানুষ তো সুস্থ হয়েই যায়। তাহলে সে জোর করে একটা অসুস্থ পরিবেশকে জিইয়ে রাখে কেন?
আমার স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, অসুস্থ পরিবেশে বৈষম্য বজায় রাখা যায়। কিছু মানুষ তার সুবিধা নেয়। হয়তো সেই জন্যই...একটু চুপ করে থেকে সে আবার বললো, কিন্তু, ওই মানুষগুলো বোকা। মানুষকে বঞ্চিত করে তারা নিজেরাই আসলে বঞ্চিত হয়, কতটা বঞ্চিত হয় তা দেখতে পেতো যদি তারা এই গ্রামে আসতো, তোমার কী মনে হয়?
আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলাম।
*************************************************************
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন