মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১

পাঠ প্রতিক্রিয়া * বিশ্বনাথ পাল




ভিনসেন্ট ভ্যান গখ : ছবি আঁকাই ছিল তাঁর জীবনের নিয়তি


               বিশ্বনাথ পাল 


বই যতই যত্ন করে আলমারিতে সাজিয়ে রাখা হোক না কেন, যদি না পড়ে ফেলে রাখা হয়, তবে তার মতো অনাদর আর হয় না। সম্প্রতি এমনই অনুভব হল বুক সেলফ ঘাঁটতে গিয়ে একটি না-পড়া বই আবিষ্কার করে। সম্ভবত কোনও এক বইমেলা থেকে কেনা, ‘পরে পড়ব’ বলে বছরের পর বছর গড়িয়ে গেছে। আর সেই বইটির কথা মনে পড়েনি। সে যাইহোক, কথায় বলে বেটার লেট দ্যান নেভার। তো, সেই অতুলনীয় বই-পড়ার আনন্দ ভাগ করে নিতেই কলম ধরা। বইটি হল ভিনসেন্ট ভান গখের জীবনের শেষ সাত মাসের (১৮৯০-এর ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত) ৩৭ টি চিঠির সংকলন—‘এভাবেই চলে যেতে হয়’। এই বইয়ের অধিকাংশই চিঠিই ভিনসেন্ট তাঁর ভাই থিয়োডর ভ্যান গখকে লিখেছেন, কয়েকটি মা আর বোনকে লেখা। জন রাসেল, আলব্যের অ্যরিয়ের ও পল গঁগ্যা-কে  লেখা চিঠি একটি করে। চিঠিগুলির বাংলায় অনুবাদ ও সংকলনের কাজটি করেছেন সন্দীপন ভট্টাচার্য (প্রকাশক :  মনফকিরা)।  


         মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ভ্যান গখ আত্মহত্যা করেছিলেন। মৃত্যুর সময় আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতরা ছাড়া কেউ তাঁর নাম জানত না। অথচ পরবর্তীকালে লেখাপড়া জানা মানুষ তাঁর নাম জানবে না এমন খুঁজে পাওয়া ভার। তাঁর আঁকা ছবি লক্ষ লক্ষ বইয়ে ছাপা হবে, তাঁর ছবি নিয়ে লেখা হবে অজস্র বই, প্রবন্ধ। তাঁর জীবন নিয়ে উপন্যাস শুধু নয়, সিনেমাও বানানো হবে। অথচ বেঁচে থাকতে তাঁকে চূড়ান্ত অর্থকষ্টে দিন কাটাতে হয়েছে। অনেক চিঠিতেই অভাবের ছাপ রয়েছে। ভাইকে আক্ষেপ করে বলছেন যে আঁকার খরচটুকুও যদি ছবি বিক্রি করে উঠত। সংকলক জানাচ্ছেন যে জীবদ্দশায় তাঁর একটি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল, নাম—রেড ভিনিয়ার্ড। কিনেছিলেন মিস আন্না বোক। 


অর্থকষ্টের পাশাপাশি মানসিক অসুস্থতাও তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল। ফলে তাঁর জীবনের অনেকটা সময় তাঁকে অ্যাসাইলামে কাটাতে হয়। এই বইয়ের বেশির ভাগ চিঠি স্যাঁ রেমি-র অ্যাসাইলাম থেকেই লেখা। ১৮৮৯ সালে এখানকার জানলা দিয়ে দেখা সূর্য ওঠার আগের মুহূর্তের দৃশ্য আঁকা হয়েছে তাঁর বিখ্যাত ‘স্টারি নাইট’ ছবিতে। একটি কাল্পনিক গ্রামও এঁকেছিলেন তাতে। একটি চিঠিতে ভাইকে লিখছেন, ‘ছবি আঁকলে আমার ভারসাম্য তবু কিছুটা বজায় থাকে...’ আবার আরেকটি চিঠিতে লিখছেন, ‘কাজের সময় আমার মাথা একেবারে শান্ত থাকে, তুলির টান আসে যথোচিত এবং পরস্পরকে তা যুক্তিসঙ্গত ভাবে অনুসরণ করে।’ দুশ্চিন্তা সম্পর্কে তাঁর অভিমত, ‘এ সব না-থাকলে  জীবনটাকে ঠিক জীবন বলে মনেও হয় না, আর এ সমস্তই জীবনের প্রতি আমাদের মনোযোগ  বাড়ায়।’ ভাবতে আশ্চর্য লাগে জীবন সম্পর্কে এত পজিটিভ যাঁর মনোভাব তিনিই কিনা আত্মহত্যা করেন। অবশ্য তাঁর মতো প্রতিভাকে আমাদের সাধারণ বিচারবুদ্ধি দিয়ে ধরা যাবে না। চিঠিগুলি পড়তে পড়তে একজন শিল্পীমানুষের জীবন আমাদের মানসচোখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যাঁর জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছবি আঁকা, তাতে স্বীকৃতি জুটুক আর ছাই না জুটুক। বিষন্নতাও কি গ্রাস করে না  আমাদের? লিখছেন, ‘এ-ও বোধ হয় আর এক শিক্ষা যে সোজাসরল ভাবে কাজ করো, খুব বেশি গোপন অর্থভাবনার দরকার নেই—চেতনাকে তা অযথাই বিক্ষিপ্ত করে। একটা ছবি বা একটা বই—মোটেই তা ঘেন্না করার জিনিস নয়। আর ছবি আঁকাই যদি আমার নিয়তি হয়, তবে অন্য কোনও কিছুর জন্য লালায়িত হওয়াটাও ঠিক নয়।’ চিঠির এই সব কথা পড়ে কে বলবে যে পত্রলেখক মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন। বরং তথাকথিত সুস্থ মানুষ, যাদের জীবন প্রতিনিয়ত প্রলোভনের হাতছানিতে সাড়া না দিয়ে পারে না, তাদের থেকে তিনি বেশি সুস্থ। 

অনেক চিঠিতেই অসুস্থতার কথা আসছে—‘আমি এখন ঠিক সুস্থ নেই, বেশ কঠিন স্নায়ুপীড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম, সাময়িক অপ্রকৃতিস্থতা বলা যায় তাকে, আর সেটা ফিরে ফিরে আসে।’ আবার লিখছেন ‘যদিও অসুস্থ হয়ে পড়াটা খুব সুখের নয়, তবু এ নিয়ে নালিশ করার হক নেই আমার, কেননা আমার মনে হয় অসুখও আমাদের নিজের পায়ে দাঁড় করানোর ও আমাদের সারিয়ে তোলার একটা পদ্ধতি, আর প্রকৃতিই সেটা দেখে, চূড়ান্ত অনিষ্ট বলে তাকে বিবেচনা করা ঠিক নয়।’   

তাঁর নিজের জীবন যত হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে, বিবর্ণ হয়েছে, ছবিতে এসেছে উজ্জ্বল রং, তাঁর প্রিয় রং হলুদের ছটা। তিনি মনে করতেন ‘রঙের বাজনদার’ হওয়া শিল্পীর কাজ নয়। ভাই  থিয়োর সঙ্গে ছিল ভ্যান গখের এক বিস্ময়কর ভাল সম্পর্ক। ভিনসেন্টকে থিয়ো নিয়মিত অর্থসাহায্য পাঠাতেন, ছবি আঁকার সরঞ্জাম কিনে পাঠাতেন। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিয়ে আর্ট ডিলারের ব্যবসা শুরু করার পর থিয়োর জীবনেও নেমে এল আর্থিক অনিশ্চয়তা। এই আর্থিক অবনতিই কি শেষে  ভ্যান গখের জীবনদীপ নেভাতে প্ররোচিত করল? একদল গবেষকের অবশ্য দাবি ভ্যান গখ আত্মহত্যা করেননি, তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। একটি বালক খেলাচ্ছলে তাঁর বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল। গবেষকদলের দাবি আমষ্টারডামের ভ্যান গখ মিউজিয়াম মানেনি। 

১৮৯০ সালের ২৯ জুলাই ভ্যান গখ প্রাণ হারান। তাঁর মৃত্যুর শোক ভাই থিয়ো সামলাতে না পেরে ছ’মাসের মধ্যে তিনিও মারা যান। থিয়োর স্ত্রী যোহানা ভ্যানগখের চিঠিগুলি সযত্নে রক্ষা না করলে আমরা অমূল্য সম্পদ হারাতাম।  

যারা কবিতা লেখেন ছবি আঁকেন বা গান করেন, অথচ জীবনে কোনও স্বীকৃতি জোটে না, তাঁদের যেন চিরন্তন আশার বাণী শোনান ভিনসেন্ট : হতাশ হোয়ো না, নিষ্ঠা সহকারে মন দিয়ে নিজের কাজ করো। জানো তো এ-জীবনই শেষ কথা নয়, আমাকে দেখো, মৃত্যুর একশো একত্রিশ বছর পরেও আমি কেমন বহাল তবিয়তে বেঁচে আছি।  




এভাবেই চলে যেতে হয় * সন্দীপন ভট্টাচার্য (প্রকাশক :  মনফকিরা)।  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন