বৃহস্পতিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২১

পাঠকের চোখে : স্বরবর্ণ * পাঁচ * ১৪২৮

  

পাঠকের চোখে 
:  স্বরবর্ণ * 
পাঁচ ১৪২৮


' স্বরবর্ণ * পাঁচ ' সংখ্যাটি কেমন হল ? কী বলছেন সুধী পাঠকমন্ডলী ? এ বিষয়ে ব্লগে অনেকেই মতামত দিয়েছেন । আবার ব্লগে সড়গড় না হওয়ায়, অনেকে সম্পাদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মতামত জানিয়েছেন। ফোনেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, এ সংখ্যার কবি লেখকেরা অনেকেই তাঁদের নিজস্ব ওয়ালে সংশ্লিষ্ট লেখাটি শেয়ার করেছেন। সেখানেও অনেকে মতামত দিয়েছেন। সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার জন্য সকল পাঠককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

ব্লগে এবং হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া মতামতগুলি হাতের কাছে থাকায়, ক্রমান্বয়ে সেগুলি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেব। আজ কয়েকটি  -----


শতদল মিত্র লিখছেন ------ 

'স্বরবর্ণ-৫' * এই সংখ্যায় সবচেয়ে ভালো লেগেছে 'প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা' বিভাগটি এবং এই বিভাগের অরুণ মিত্র-র কবিতা ফিরে পড়া পাঠক আমার কাছে বাড়তি পাওনা। 'পাঠ প্রতিক্রিয়া' বিভাগে সব্যসাচী মজুমদার খুব সুন্দর ভাবে কবি তপেশ দাশগুপ্তর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সন্দীপন ভট্টাচার্যের অনুবাদে ভ্যান গখের চিঠির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বনাথ পাল যথাযথ। 'অনুবাদ কবিতা' বিভাগটিও উজ্জ্বল প্রাপ্তি। সৈয়দ কওসর জামালের মূল ফরাসি থেকে অনুদিত এমে সেজের কবিতা আগ্রহ জাগায়। স্বপন নাগ কৃত কেদারনাথ সিং-এর কবিতার অনুবাদ বেশ সাবলীল। একগুচ্ছ কবিতার অনুবাদের মাধ্যমে হিন্দি কবিতার পরম্পরাকে উপস্থাপিত করে নীলকমল পাঠক আমাকে  কৃতজ্ঞ করে তুলেছেন।

    গল্প-কবিতা বিভাগ সুন্দর, সুসম্পাদিত। সমগ্র পত্রিকা জুড়েই এক রুচিশীল মননশীলতার স্পর্শ। শুভেচ্ছা 'স্বরবর্ণ'কে।


স্বপন নাগ লিখেছেন----- 

'স্বরবর্ণ'-এ লিখতে পারার সুযোগ আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের, এ আমার অকপট স্বীকারোক্তি।একসাথে এতগুলি ভালো কবিতা পড়তে পাবার সুযোগও খুব কম সংখ্যক পত্রিকায় পাওয়া যায়। প্রায় ঝড়ের গতিতে পড়েছি কবিতাগুলি। নির্মল হালদার, হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়, তৈমুর খান, পলাশ দাশ, দীপঙ্কর বাগচী প্রমুখের কবিতা আলাদা করে ভালো লেগেছে। আর ভালো লেগেছে পত্রিকার 'প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা'-য় চিরতরুণ অরুণ মিত্রের কবিতা। নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে কবির টুকরো উদ্ধৃতি এ সংখ্যার মাস্টার স্ট্রোক। পৃথক ভাবে আধুনিক হিন্দি কবিতার প্রতি যেহেতু আমার পক্ষপাত , বেশ কিছু চেনা কবির চেনা কবিতা পড়ারও সুযোগ করে দিয়েছেন নীলকমল তাঁর সুন্দর অনুবাদে।

আপনাদের সৃজনশীল এই সাহিত্য সাধনায় আমার অপার শুভেচ্ছা রইল। ভালো থাকবেন।


সৌমনা দাশগুপ্ত জুয়েল মাজহারের কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন  এতরকম ভাঙচুর, কবিতার ভাষা ও আঙ্গিক নিয়ে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা... বিস্মিত হই বারবার।


সুদীপ দাস- এর কবিতা সম্পর্কে রঞ্জিত ভট্টাচার্য লিখছেন  খুব ভালো লাগলো। দুটোর ভাবনাই নাড়া দিলো। সত্যিই, সবাই ভাবছি এগোচ্ছি, আসলে গোল রাস্তায় ঘুরপাক খাচ্ছি। আর শরীরের আস্তাবল ছেড়ে ঘোড়াদের সমুদ্র যাত্রা... যোগসূত্রে অসামান্য চিত্রকল্প ।


 চিন্ময় ঘোষ -এর গল্প পড়ে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন----

জীবন থেকে নেওয়া। মন বলে উঠে লেখক এর গল্পের চরিত্রগুলোকে যেন আমিও চিনি। হয়তো কখনো দেখেছি কোথাও। কলেজ জীবনের বন্ধুত্ব তো এমনিই। একজন আরেক বন্ধুর জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করতে পারে। অন্তত একটা সময়ে এরকমই ছিল। হয়তো এখনকার জটিল জীবনে এই চিত্রটা পাল্টে গেছে অনেকখানি। তাই সহনশীলতার পরিবর্তে শত্রুতা বড় হয়ে ওঠে। সে রকম ছবিতে বড় একটা কম দেখা যায় না। সে দিক থেকে গল্পটা একটা দৃষ্টান্ত এর মত। তবে চৈতন্য ও মারুতের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আরো একটু বিস্তারিত হওয়ারকথা ছিল। অন্তত পাঠকের স্বার্থে। একটি সুন্দর গল্প পড়লাম। অভিনন্দন চিনময়


অমিত চক্রবর্তী-র কবিতা সম্পর্কে সমর সুর লিখছেন   অসাধারণ। কী সুন্দর সব শব্দের মেলবন্ধন। চিত্রকল্পের মধ্যেও ঝিঙাফুল মুদ্রার ঝলমল পিঠ। ভীষন স্মার্ট লেখা।


রাজীব দে রায়-এর কবিতা সম্পর্কে অদিতি সিংহ লিখেছেন  প্রথম কবিতাটির ব্যঞ্জনা বেশি স্পর্শ করলো মন। দ্বিতীয় কবিতার প্রথম লাইনটি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা "আমি দেখি " কবিতার প্রথম লাইন মনে করায় * বহুদিন জঙ্গলে যাইনি। দুটি কবিতাই ভাল লেগেছে।


কৌশিক সেন- এর কবিতা সম্পর্কে সমিধ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন  অনবদ্য লেখা দাদা! বিশেষত "ক্রশওয়ার্ড" অসাধারণ। ফিরে ফিরে আঘাত করা অস্ত্রের মতো তীব্র।


দীপংকর রায়-এর উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে ' পর্ব*২ পড়ে কল্পোত্তম লিখেছেন -----

দীপংকর রায় -এর  এই উপন্যাসের ভিতর দিয়ে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার মধ্যে ওনার যে একটা গভীর টান এবং গভীর সম্পর্ক তা প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে স্পষ্টরূপে। এছাড়া ওপার বাংলার খোলা প্রকৃতি এবং সেখানকার খোলা মনের মানুষগুলোর সাথে যে ভাব বিনিময়, তাদের প্রতি ওনার যে দুর্নিবার আকর্ষণ তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে।


দেবাশিস সাহার উপন্যাস ' ধুলোর সিংহাসন ' পর্ব * ৪ পড়ে শীলা দাস লিখছেন ----

স্বরবর্ণ শারদীয়াতে আপনার লেখা কবিতা ও উপন্যাস পড়লাম। লেখায় চুম্বক আকর্ষন অনুভব করলাম।আর বিশেষত উপন্যাসে প্রাজ্ঞতা গভীরতর।


( আগামী দিন )


পাঠকের চোখে :  স্বরবর্ণ * পাঁচ ১৪২৮


' স্বরবর্ণ * পাঁচ ' সংখ্যাটি কেমন হল ? কী বলছেন সুধী পাঠকমন্ডলী ? এ বিষয়ে ব্লগে অনেকেই মতামত দিয়েছেন । আবার ব্লগে সড়গড় না হওয়ায়, অনেকে সম্পাদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মতামত জানিয়েছেন। ফোনেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, এ সংখ্যার কবি লেখকেরা অনেকেই তাঁদের নিজস্ব ওয়ালে সংশ্লিষ্ট লেখাটি শেয়ার করেছেন। সেখানেও অনেকে মতামত দিয়েছেন। সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার জন্য সকল পাঠককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

ব্লগে এবং হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া মতামতগুলি হাতের কাছে থাকায়, ক্রমান্বয়ে সেগুলি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেব। পাঠকের মতামতের আজ দ্বিতীয় পর্ব -------


গৌরীশঙ্কর দে-র দীর্ঘ কবিতা পড়ে চন্দন মুখার্জি জানাচ্ছেন   অসাধারণ অনবদ্য দুরন্ত।

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্প পড়ে পলাশ দাস লিখছেন   খুব ভালো লাগল। খুব সুন্দর লিখেছেন। শুভেচ্ছা জানবেন।

পঙ্কজ মান্নার কবিতা সম্পর্কে নাম জানাননি এমন একজন পাঠক লিখেছেন  জাত কবি...কবি'র অনুভব অন্তরে জারিত হয়ে যায়।

অর্কায়ন বসু শুভশ্রীর সাহা-র অণুগল্প পড়ে লিখছেন   অনবদ্য। বাস্তবতার নির্মম এক ছবি।মুগ্ধতা। আর আপনার বলার স্টাইলটাও দারুণ।

রঞ্জনা ভট্টাচার্য -এর কবিতা পড়ে রাজীব দে রায় জানাচ্ছেন   এক্ষুনি পড়লাম, দুটোই ভালো। দ্বিতীয়টি বেশি ভালো লাগলো।

অভিষেক চক্রবর্তী সুদেষ্ণা ব্যানার্জীর কবিতা পড়ে লিখছেন   দারুন। প্রথম কবিতাটি অসাধারণ।

শীলা দাশ-এর কবিতা সম্পর্কে নাম জানাননি এমন একজন পাঠক লিখেছেন  জীবন যন্ত্রণায় মিশে যাওয়া খুব সুন্দর দুটি কবিতা।

প্রদীপ ঘোষ এর কবিতা সম্পর্কে নবনীতা বিশ্বাস চক্রবর্তী লিখেছেন   দুটো কবিতাই ভীষণ ভালো লাগল...বিশেষত দ্বিতীয়টিতে অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ডুবে গেলাম,গভীর উপলব্ধির অদ্ভুত নিবিড় শব্দের রূপ!

দেবজ্যোতি দাশগুপ্তের কবিতা সম্পর্কে শ্যামশ্রী রায় কর্মকার জানাচ্ছেন  বিয়োগ বড় ভালো লাগলো।

উদয় ভানু চক্রবর্তীর কবিতা পড়ে নাম জানাননি এমন একজন পাঠক লিখছেন  সুন্দর প্রকাশ কবির

ইন্দ্রজিৎ নন্দীর কবিতা সম্পর্কে দেবলিনা জানাচ্ছেন  তুমি মেঘ সেফটিপিন আটকানো বর্ষা জলের রানী ... বাহ দারুণ দারুণ !! দুটি কবিতাই খুব ভালো লাগলো ।

মৃন্ময় মাজীর কবিতা সম্পর্কে বিদ্যুৎ প্রামানিক লিখলেন   একটি পরিনত কবিতা । খুব খুব খুবই ভালো লাগলো ।

নিমাই জানা এর কবিতা সম্পর্কে কিংকর দাস জানাচ্ছেন  দুটোই অসাধারণ...দ্বিতীয় টি অনবদ্য।

( আগামী দিন )


পাঠকের চোখে :  স্বরবর্ণ * পাঁচ ১৪২৮


' স্বরবর্ণ * পাঁচ ' সংখ্যাটি কেমন হল ? কী বলছেন সুধী পাঠকমন্ডলী ? এ বিষয়ে ব্লগে অনেকেই মতামত দিয়েছেন । আবার ব্লগে সড়গড় না হওয়ায়, অনেকে সম্পাদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মতামত জানিয়েছেন। ফোনেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, এ সংখ্যার কবি লেখকেরা অনেকেই তাঁদের নিজস্ব ওয়ালে সংশ্লিষ্ট লেখাটি শেয়ার করেছেন। সেখানেও অনেকে মতামত দিয়েছেন। সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার জন্য সকল পাঠককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

ব্লগে এবং হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া মতামতগুলি হাতের কাছে থাকায়, ক্রমান্বয়ে সেগুলি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেব। পাঠকের মতামতের আজ অন্তিম পর্ব -------


গৌরীশঙ্কর দে  দেবাশিস সাহার 'ধুলোর সিংহাসন' উপন্যাসের পঞ্চম পর্ব পড়ে লিখছেন  অনেক হয়েছে পড়ালেখা। বিদেশি পাঠের অভ্যাস। যদি সত্যি ভালোবাসো মেয়েকে, আত্মজাকে আর পরিবারের মতো করে নিতে চাও এই দুনিয়াদারিকে, পড়ো পড়ো, এই হৃদয়মথিত আলো-আঁধারের উপকথা। কাঁদো আর কাঁদতে শেখো। নিখিল কন্যার পিতাপিতৃহৃদয় স্পর্শ করে এই পর্ব রহমতের মতো আফগানিস্তানের পথে এগিয়ে গেল যেন .....


শীলা দাস লিখেছেন  চমৎকার সম্পাদকীয়। মুগ্ধ হলাম। যে কটা কবিতা পড়লাম খুবভালো লাগলো।


সোমা দাস এর কবিতা সম্পর্কে নাম জানাননি এমন একজন পাঠক লিখেছেন   দুটি কবিতাই ভালো লাগলো


সুদীপ চক্রবর্তী ধৃতিরুপা দাস-এর কবিতা পড়ে লিখছেন  বেশ একটা নতুন কিছু পড়লাম অনেকদিন পর 


অনিন্দিতা স্বপন নাগ এর অনুবাদ কবিতা পড়ে জানাচ্ছেন   অনুবাদ ও মূল, দুইই মনে ছাপ রাখল। স্বতন্ত্রভাবে দুটি ভাষাতেই অপূর্ব মাত্রা পেয়েছে। 


মৃন্ময় মাজী বিধান ঘোষের কবিতা পড়ে লিখছেন  দারুণ হে , ভালো লেগেছে খুব।


শতদল মিত্রের কবিতা পড়ে রবিন বসু লিখছেন  সুন্দর দুটি কবিতা পড়লাম। কবিকে অভিনন্দন জানাই।


তৈমুর খান- এর কবিতাগুচ্ছ পড়ে আব্দুস সালাম লিখেছেন  প্রতিটি কবিতা সুন্দর।


মিতালী চক্রবর্তীর কবিতা সম্পর্কে দেবজ্যোতি লিখছেন  অপূর্ব লেখা 


**********************

 স্বরবর্ণ * ছয় * ২০২২  

বর্ষপূর্তি সংখ্যা হিসাবে 

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ ফেব্রুয়ারি   ২০২ 


* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ জানুয়ারি  ২০২- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

debasishsaha610@gmail.com

WhatsApp no 8777891532



মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

স্বরবর্ণ * পাঁচ * ২০২১   সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করব ২৫ ডিসেম্বরের পর থেকে । 


**********************

 স্বরবর্ণ * ছয় * ২০২২  

বর্ষপূর্তি সংখ্যা হিসাবে 

*************************

প্রকাশিত হবে আগামী  ১৫ ফেব্রুয়ারি   ২০২ 


* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ১৫ জানুয়ারি  ২০২- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর মাসের ১৫ তারিখ বেরো আগে থেকে লেখা পাঠানপরিকল্পনার সুবিধার জন্যলেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে 


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

 ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা  

স্বরবর্ণ-এর অন্তরঙ্গ কিছু বই


স্বপন চক্রবর্তী বহু অবিস্মরণীয়  গ্রন্থের প্রণেতা |

 তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গ্রন্থ ----


মিথ্যার দ্বিপাক্ষিক চুক্তি * লৌকিক মাঘোৎসব * আত্মপ্রতিকৃতি * গীতবিতানের হাট 

যে কুসুম নিজের নাম না -জেনেই ফুটে আছে * স্মৃতি স্বপ্ন কান্না দরবারি *

হেমন্তের কাক তুমি অপরাহ্নের ডাক ইত্যাদি |




শুভঙ্কর দে  সম্পাদিত 

Health has a History Revisiting Bengal

বিজ্ঞানের ইতিহাস ভবিষ্যতের সন্ধান 

ভারতের সামাজিক ইতিহাস  









দীপংকর রায় 

কবিতার বই  *  

অন্তর অয়ন * আঁধার আলোকলতা *   অপ্রচলিত 

আর এক শরণার্থী দিন * মৎস্য কুমারীর জোছনা 



         



কবিতা উপন্যাস

অসমাপ্ত ছোঁয়া * ছায়ার খিদে *

গল্পগ্রন্থইচ্ছে পতঙ্গের  কান্না    আত্মজৈবনিক  উপন্যাস কোথাকার অতিথি আমি  

 





আমি-ই তোমার একমাত্র সাক্ষী , আমি-ই তোমার একমাত্র প্রতিপক্ষ



মাধুরী দাশগুপ্ত

বাতাসে কার কান্না


 

শুভজিৎ গুপ্ত  

পাখিদের আহিরভৈরব 


দেবাশিস সাহা 

    কবিতার বই 

তোমায় খুঁজে ফিরি * স্বামী নির্বাণানন্দ



মায়ের কথা 

স্বামী নির্বাণানন্দ

 (১)

  ‎     

        ১৯১২ সালে কাশী সেবাশ্রমে ব্রহ্মচারী হিসেবে আমি যোগদান করি। তখন মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ, হরি মহারাজ, মাষ্টারমশাই ওখানে রয়েছেন। শ্রীশ্রীমাও তখন ওখানে ছিলেন  -লক্ষ্মীনিবাসে। সেই সময় মাকে একদিন পালকি করে সেবাশ্রমে নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে স্বামী শান্তানন্দ ও চারুবাবু (পরে স্বামী শুভানন্দ) ছিলেন। মা একটা চেয়ারে বসলেন। একজন ভক্ত জিজ্ঞাসা করলেন, -'মা কেমন দেখলেন?' মা বললেন, -'দেখলুম ঠাকুরই বিরাজ করছেন। রোগীদের সাক্ষাৎ নারায়ণ জ্ঞানে সেবা করে ছেলেরা তাঁরই সেবা করছে।' মা এই কথা বলার পর আমাদের ভিতরে আরও প্রেরণা এল। সেবাশ্রমে তখন সাধু-ব্রহ্মচারীর সংখ্যা কম। ইন্ডোরের রোগীদের সেবার ভার আমার ওপর দেওয়া হয়েছিল। নারায়ণ জ্ঞানে সেবা বাস্তব ক্ষেত্রে বড় কঠিন। বছর দুয়েক সেবাশ্রমে ছিলাম। খুব চেষ্টা করেছিলাম নারায়ণ জ্ঞানে রোগীদের সেবা করতে। শ্রী শ্রী মায়ের কথার জোর, মহারাজের উৎসাহ, হরি মহারাজের প্রেরণা  -এসবের জন্যই তা করতে পেরেছিলাম।

     কাশীতে, বাগবাজারে এবং বেলুড় মঠে মহারাজ শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করছেন। -'এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমার বহুবার হয়েছে। দেখতাম, মহারাজ মায়ের সামনে গেলে কেমন যেন হয়ে যেতেন -ভাবে বিহ্বল। স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না, পা করত, শরীর থরথর করে কাঁপত। কোন রকমে প্রণাম করেই উঠে আসতেন। অনেক সময় কাশীতে এবং মায়ের বাড়িতে প্রণাম করার জন্য ওপরে উঠতেই পারতেন না, নিচে থেকেই দাঁড়িয়ে যুক্তকর মাথায় তুলে উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতেন। বাবুরাম মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ প্রমুখকেও মাকে প্রণাম করতে দেখেছি। তাঁদেরও প্রায় ঐরকম ই অবস্থা, তবে এতটা নয়।


(২)

     ব্রহ্মচর্যের পর (১৯১৪ খ্রীঃ) শ্রীশ্রীমায়ের আশীর্বাদ নিতে উদ্বোধনে গিয়েছি। তখন মায়ের ঘরের সামনে এখনকার মত বড় বারান্দা ছিল না। সিড়ি দিয়ে উঠে কেবল একফালি চওড়া বারান্দা। নিচের উঠোনটি তখন বড় ছিল। মাকে প্রণাম করতে তিনি একটু ভজন শোনাতে বললেন। নিচের উঠোনে শতরঞ্জি পেতে বেশ কয়েকটি ভজন গাইলাম। মা খুশি হয়ে প্রসাদ পাঠিয়ে দিলেন। মঠে ফেরার সময় মাকে প্রণাম করতে গেলে মা মাথায় হাত দিয়ে খুব আশীর্বাদ করলেন।

     ‎ ১৯১৫ সালের মার্চ-এপ্রিল হবে, আমি তখন মহারাজের সেবায় বেলুড় মঠে রয়েছি। দেখতাম, আমার বয়সী অনেক সাধু-ব্রহ্মচারী মহারাজের অনুমতি নিয়ে তপস্যায় যেতেন। হিমালয় বা অন্য কোথাও বছর খানেকের জন্য তপস্যা করে আসতেন। আমিও একদিন মহারাজের কাছে গিয়ে তপস্যার অনুমতি চাইলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, -'তুই তাহলে এখানে কি করছিস? এই যে সেবা করছিস, এ তপস্যার চেয়ে ঢের বেশি হচ্ছে। তোর আর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই।' কিন্তু আমি তা সত্ত্বেও যখন বারবার পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম, তখন তিনি আমায় মহাপুরুষ মহারাজের কাছে অনুমতি নিতে বললেন। মহাপুরুষ মহারাজ আমার কথা শুনেই বললেন, -'তুই কি পাগল হয়েছিস? আর কোথায় যাবি তপস্যা করতে? এই যে মহারাজের সেবা করছিস, এতেই সব জানবি।' আমি তবুও জোর করতে লাগলাম। তখন তিনি বললেন, আচ্ছা, বাবুরাম মহারাজের কাছে যা। তিনি অনুমতি দিলে তবেই যাবি।' বাবুরাম মহারাজের কাছে গেলাম। আমার নিবেদন শুনে তিনিও একই উত্তর দিলেন। এবং আরও জোরের সঙ্গে। বললেন, -'তুই কি সত্যি সত্যিই পাগল হলি, সুয্যি? দেখছিস না ঠাকুর রয়েছেন মহারাজের ভিতরে? আর কোথাও গেলে কি তুই ভগবানের মানসপুত্রের সাক্ষাৎ পাবি?' কিন্তু আমি তবুও জেদাজেদি করতে থাকলে তিনি বললেন, -'ঠিক আছে, উদ্বোধনে মা আছেন, মা যদি অনুমতি দেন, যাবি। প্রথমে কালীঘাট গিয়ে মা-কালীকে পূজো দিবি, তারপর মায়ের কাছে যাবি আশীর্বাদের জন্য। জানবি, কালীঘাটে যিনি আছেন আর বাগবাজারে যিনি আছেন, তাঁরা একই।'


   (৩)

     কালীঘাট মন্দিরে প্রণাম করে উদ্বোধনে পৌঁছলাম। দেখলাম, মায়ের দর্শনার্থীদের সারিতে আমি শেষ ব্যক্তি। দূর থেকে দেখছি, মা মুখের উপর ঘোমটা টেনে বসে আছেন আর যে-ই প্রণাম করছে তাকেই আশীর্বাদ করছেন। অবশেষে আমার পালা এল। অন্য সব ভক্ত তখন চলে গেছে। পায়ে মাথা দিয়ে সষ্টাঙ্গ প্রণাম করে যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন দেখি মা ঘুমটা সম্পূর্ণ খুলে ফেলেছেন। খুব হেসে আমাকে বললেন, -'এই মিষ্টিটা নাও বাবা, খাও।' নিজের হাতে আমায় মিষ্টি প্রসাদ দিলেন। মাকে মঠের সব খবর দিলাম। শেষকালে আমার প্রার্থনার কথা জানালাম। সব শুনে মা বললেন, -'বাইরে গিয়ে কঠোরতা করা ঠাকুর পছন্দ করতেন না, বাবা। তাছাড়া মঠ ছেড়ে, রাখালকে ছেড়ে তুমি কোথায় তপস্যা করতে যাবে? রাখালের সেবা করছ -তাতেই কি সব হচ্ছেনা? কিন্তু আমি বাচ্চা ছেলের মতো তাঁর অনুমতি আর আশীর্বাদ এর জন্য আবদার করতে লাগলাম। আমাকে নাছোড় দেখে শেষে মা বললেন, -'আচ্ছা, তুমি তপস্যায় যেতে পার  -কাশীতে যেতে পার। তবে আমাকে একটা কথা দিতে হবে। ইচ্ছে করে অনর্থক কঠোরতা করবে না। যদি পথে অযাচিত ভাবে কোন সাহায্য পাও তা নেবে। কাশীতে তপস্যা করার সময়ও যদি তোমাকে কেউ কিছু দেয়, তাও নেবে। সেবাশ্রমে থাকবে, আর খুব ইচ্ছে হলে বাইরে মাধুকরী করে খেতে পার। কাশীবাসও হবে, আর তপস্যাও হবে।' আমি মাকে কথা দিলাম। তবে তাঁর অনুমতি চাইলাম পদব্রজে কাশী যাওয়ার। মা অনুমতি দিলেন, তবে পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথাটা যে তাঁর মনঃপূত হয়নি তাও বুঝলাম। তারপর মাকে প্রণাম করে তাঁর অজস্র আশীর্বাদ নিয়ে খুশিমনে মঠে ফিরলাম। মহারাজ, মহাপুরুষ মহারাজ, বাবুরাম মহারাজকে সব বললাম।

     ‎( ক্রমশ )

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা

 

এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সবসময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ *৫   সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয়  কবিতা ' বিভাগের কবি হলেন অরুণ মিত্র   |






এক একটা শান্ত দিন

অরুণ মিত্র


এক একটা শান্ত দিন নিয়ে বিভোর হই

তাঁকে মৃত নদী দিয়ে ঘিরে রাখি 

কুয়াশায় মুড়ে  রাখি

ভোর ভোর আলো কিংবা গোধূলির গভীরে নিয়ে যাই  

আমার জানাশোনা মানুষেরা স্থিমিত হয়ে হয়ে নিবে  যায়

তাদের কথাগুলো  হিম হয়ে থাকে

হিম শীতের রোদ আর ছায়া

কোন জলের শব্দ

নিস্তব্ধ মাঠ

মনের কপাট খুলে এইসব সংগ্রহ করি।


 রাশি রাশি পাতায় আমার উঠোন ঢেকে যায়

 রাশি রাশি ঘুম যেন ভর দেয়

সমস্ত চিন্তার উপর

পৃথিবী এক ছবি হয়ে থাকে চোখে

অপলকে তাকে  দেখি যতক্ষণ  পারা যায়

শুধু বুকের ঢিপঢিপটুকু

তাকে পুষে যেন বেঁচে থাকি  ঘুমন্ত শিশুর মতো

আর সব দূর পাখি

শীতের দিন ফেলে উষ্ণ আকাশের দিকে চলে গেল 

তারা কি যেন বলে গেল

আহা আমার নিভৃত প্রাণ আমার গুঞ্জন আমার মুগ্ধ বিশ্বাস।


 সন্ধ্যা নেমে এলে খেলাঘরে বাতি নেই

তখন হৃদয় জ্বালাতে ইচ্ছে করে মোমের  মতো

শত সহস্র সন্ধ্যার ভিতরে  এক নিবন্ত  শিখা

তার চারিপাশে আদ্দিকালের গল্প

যার দিকে দিকে মনের আগ্রহ

আস্তে আস্তে গলে গলে ঘুম হয়ে যায়।


এক একটা দিন এমন

সমস্ত তারের ঝনঝন যেন এক দীর্ঘ স্থির রেখা

সমস্ত বিক্ষোভ এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি

সমস্ত অশ্রু জমাট তুষার।।



*********************************************


    নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে অরুন মিত্র 

                           সৌজন্য-- শতদল মিত্র  

উপন্যাস * দেবাশিস সাহা

 



ধুলোর সিংহাসন

পর্ব * পাঁচ

দেবাশিস সাহা 


(পূর্বানুষঙ্গ : বৈশাখী দুর্যোগ শেষ হলে অশোক কোচিং ছুটি দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ায়। মাথায় ঘুরতে থাকে দু'কিলো চাল আর একটা সরষের তেল নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। স্ত্রী অলি মেয়েকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিল। কিন্তু পথে বেরিয়ে ঝড়ে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ,দোকানপাট ,শিকড় বাকড়সমেত উল্টে পড়া গাছপালা দেখতে দেখতে কী যেন হয়ে যায় অশোকের ভিতরে.....কল্পনায় সে দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে মৌর্য সম্রাট অশোক,মুহূর্ত পরে সম্রাট হর্ষবর্ধন। তাঁদেরকেই সে নিজের সামান্য প্রার্থনাটুকুর কথা জানায়। সম্বিৎ ফিরতে তারপর ধীর পায়ে পৌঁছয় ফ্ল্যাটে)


     ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে পা দিতেই অশোক শুনতে পেল অলির চিৎকার। অলি চিৎকার করছে ! কিন্তু  কার সঙ্গে, কেন ? অবাক হয় অশোক। এই ফ্ল্যাটটা তো এমনিতেই বেশ নি:ঝুম। স্ট্রেট থ্রি ফ্ল্যাট। লিফট নেই। গ্যারেজ নেই । দোকানপাট কিছুই নেই। সেই জন্য দামটাও পড়েছে কম। তিন হাজার টাকা স্কোয়ার ফিট। না হলে মেইন রোডের উপর সাড়ে তিনের কম ফ্ল্যাট পাওয়াই দুষ্কর। প্রত্যেক ফ্লোরে দু'টো করে মোট ছ'টা ফ্ল্যাট। একটা টু বেড রুম,ছ'শো স্কোয়ার  ফিটের। আর একটা সিঙ্গেল ,চারশো স্কোয়ার ফিটের। নাম 'সরস্বতী অ্যাপার্টমেন্ট'। নামের সঙ্গে ফ্ল্যাটটার সাদৃশ্যও যথেষ্ট। তিনতলায় অশোক যেমন কোচিং-এ থাকার সময়টুকু বাদে সব সময় নিজের লেখালেখি,পড়াশোনা নিয়ে থাকে, তেমনই দোতালায় থাকেন এক অধ্যাপক দম্পতি। গ্রাউন্ডে ল্যান্ড ওনারদের ফ্যামিলি। বড় ছেলে মানিক চ্যাটার্জী ইঞ্জিনিয়ার আর ছোট  ছেলে বাসুদেব কাপড়ের ব্যবসায়ী। সবার সঙ্গেই সবার মিলমিশ। কারও সঙ্গে কারও মন কষাকষি নেই।


       তিনতলায় অশোকদের ঠিক উল্টোদিকের ছোট ফ্ল্যাটটাতে থাকে রনির মা। সারাদিনই প্রায় একা। রনির বাবা বছর চল্লিশের পার্থ রায় ব্যাংক এমপ্লয়ি। শান্ত মার্জিত রুচিশীল ভদ্রলোক। রনির মা-ও খুব মিশুকে। আর রনির তো কথাই নেই। ফাঁক পেলেই দৌড়ে চলে আসে উপমার কাছে। দু'টিতে মিলেছেও বেশ। উপমা ওকে মাঝে মাঝেই বলে,' আমার তো ভাই নেই, তুই আমার ছোটভাই, বুঝলি?' রনি ঘাড় কাত করে সায় দেয়, ' হ্যাঁ পমাদি।' উপমার 'উ' ঝরিয়ে ও ইতিমধ্যেই নির্মেদ করেছে 'পমাদি' সম্বোধনে।


অশোক আবার 'উ' এবং 'প' দুটোই ঝরিয়ে প্রায়শই ' মা ' বলে ডাকে উপমাকে।বড়দি অপর্ণা এলে 'প' উধাও হয়ে উপমা হয়ে যায় 'উমা'। 'উমা বল কেন পিসি? '

' উমা মানে কি জানো?'

'দুর্গা।'

' বা: ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লেও বাংলায় দেখছি তোমার ভালই নলেজ । 'উমা' ডাকি তার কারণ, তোমার বাবার তো কোনও ছেলে নেই। তোমাকেই বড় হয়ে বাবা-মার পাশে দাঁড়াতে হবে দশভুজা হয়ে, মা দুর্গার মতো।


' কী  অশোক, আজ ফিরতে দেরি হল, মনে হচ্ছে?' গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরের মানিকদা সিগারেট টানতে টানতে বললেন ।

' হ্যাঁ দাদা, যা ঝড় ঝাপটা গেল! ' বলেই অশোক সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে।

' অশোক, এক মিনিট,এক মিনিট ' একটু এগিয়ে এসে পিছন থেকে ডাকেন মানিকদা।

 'হ্যাঁ দাদা ' থমকে দাঁড়ায় অশোক।

' তোমায় একটা কথা বলি, দেখো, আজকের ঝড়ে  সুরবাড়ির নারকেলগাছটা  আমাদের ফ্ল্যাটের কার্নিশে এমন  ধড়াস ধড়াস করে ঘা মারছিল, মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ভিতটাই নড়ে গেল । নতুন ফ্ল্যাট ক্ষতি হয়ে গেলে দায় কে নেবে বলো। ’

' ঠিকই তো। ' অশোক সায় দেয় বটে, কিন্তু ওই পর্যন্ত ,ওর মন তিনতলায় অলির চিৎকার শুনতে পাচ্ছে। অশোক হু হা  কিছুই করছে না দেখে মানিকদা বললেন, ' তোমাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছি না তো?

' না না, ঠিক আছে,বলুন না।'

' চলো , কালই আমরা সবাই মিলে সুরবাবুকে নারকেলগাছটা কাটার কথা বলি। '

 'ঠিক আছে, চলুন।'

' তুমি একটু রনির বাবাকে ব্যাপারটা বলে দিও।'

 'দেবো।'



ক্রমশ চিৎকারটা বাড়ছে যেন। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে এল অশোক। দেখে দরজা খোলা। রনি,রনির মা দাঁড়িয়ে। অলির চুল উস্কোখুস্কো,চোখমুখ লাল,রাগে গজগজ করছে। অঝোরে কাঁদছে উপমা। ওর হাত ধরে রনি বলে চলেছে ' পমাদি, কেঁদো না, কেঁদো না।' অলিকে বোঝাচ্ছে রনির মা, ' দিদি শান্ত হও, উপমা খারাপ মেয়ে নয়, ও কত ভালো আঁকে,গান গায় ,বাবার মতো কবিতাও লেখে।’

' ছাই গায়, কী হবে ওই আঁকায়,গান গাওয়ায়, যদি না বাবা-মায়ের কথা শোনে? '

' শুনবে না কেন দিদি,শুনবে , বয়সটাও তো ওর দেখতে হবে। এই বয়সে ওরকম ভুল একটু-আধটু হয়েই থাকে।'

কী রকম ভুল! কী ভুল করেছে উপমা, অশোক বুঝতে চেষ্টা করে। এখনও কেউ ওকে দেখতে পায়নি।অশোক শুনতে পাচ্ছে ,অলি বলেই চলেছে  ' জুঁই ,তুমি জানো না, ওর বাবা মেয়ের জন্য দু'বেলা রক্ত জল করে ফেলছে। নিজের শখ-আহ্লাদ সব জলাঞ্জলি দিয়েছে। যখন যেটা বলছে, নিজে খাক না খাক এনে দিচ্ছে। যে মোবাইল নিয়ে এত কান্ড, সেই মোবাইলটা কিনে দিল গত মাসেই। কেন? না, মেয়ে কলেজ যায় টিউশন-ক্লাসে যায় কখন ফেরে না ফেরে খবরাখবর নিতে সুবিধে হবে। মেয়ে বলতে তো একেবারে অজ্ঞান। দু'মিনিট আসতে দেরি হইলেই ,এখনো আসছে না কেন এখনো আসছে না কেন করে মাথা একেবারে খেয়ে ফলবে। হাতে পয়সা নেই,তাও পাড়ার কোয়াপারেটিভ থেকে ধার করে কিনে দিলো ।'


কথাগুলো বলতে বলতে রনির মায়ের দিকে একটু এগিয়ে আসে অলি আর ঠিক তখনই চোখে চোখ পড়ে যায়  অশোকের। সুর আরও চড়িয়ে বলতে থাকে , 'শোনো তোমার গুণধর মেয়ের কীর্তি শোনো।'

কী হয়েছে কী, এত চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন? নীচতলা থেকে তোমার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী?

অশোককে দেখতে পেয়ে রনির মা বলে, ' অশোকদা, অলিদিকে সামলান। খুব রেগে আছে। রনি, আয় বাবা ,আঙ্কেল এসে গেছে, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যাই ।'

ওরা চলে যায়। রনি সবাইকে টা- টা করতে থাকে।



অশোক ঘরের দমবন্ধ করা পরিবেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় উপমার দিকে। উপমার তখনও চোখ ছল ছল। জল পড়ছে টপটপ করে। অশোক আস্তে করে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, ' কী হয়েছে রে ,মা ? '

' কিছু না ' বাবার স্নেহস্পর্শে ছল ছল চোখ এবার বর্ষার ময়ূরাক্ষী।

পাশ থেকে ফুঁসে ওঠে অলি, অশোক আসার আগেই উপমার মোবাইলটা কেড়ে নিজের জিম্মায় রেখেছিল। সেটা এখন অশোকের সামনে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলতে থাকে, ' দেখো, পড়তে বসে কানে হেডফোন গুঁজে কথা বলেই চলেছে। একবার এসে বারণ করে গেলাম। কুড়ি তারিখ পরীক্ষা ,মোবাইল রেখে একটু মন দিয়ে পড়। ওমা, একটু বাদেই দরজার আড়াল থেকে দেখছি যে কে সেই ! কথা বলেই চলেছে। এক সপ্তাহ বাকি নেই পরীক্ষার! কার মাথা ঠিক থাকে? দু'ঘা দিয়ে তাই মোবাইল কেড়ে নিয়েছি। বলেছি,পরীক্ষার পর ফেরত পাবি আর তাতেই এত কান্না!

' আর কিছু না? ' অনুযোগ উপমার  ' তুমি আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাকাওনি?'  বাবার বুকে মাথা রেখে ফের কান্না।

অশোক মেয়ের পক্ষ নিয়ে বলে, ' আচ্ছা একটু না হয় কথা বলেইছে, তুমিই বা ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়েছ কেন? ও কি বাচ্চা মেয়ে, মেরে ধরে ওকে পড়াতে পারবে, যদি না ও মন থেকে পড়ে। '

' ঠিকই তো ' উপমার মুখে হাসি ফোটে।

 ' হ্যাঁরে মা, তুই যখন রনিকে নিয়ে কোচিং-এ গেলি, আমি তোকে পল সায়েন্সের দুটো উত্তর মুখস্ত করতে বলেছিলাম, সেটা রেডি হয়েছে?'

' হ্যাঁ ' চোখের জল মুছতে মুছতে বলে উপমা।

'গুড' অলির দিকে ফিরে যোগ করে, ' তবে তুমি অত রাগছ কেন, ওর পড়া তো ও করেইছে।'

' ছাই করেছে,ধরেই দেখো' মা-র দিকে আড়চোখে তাকায় উপমা।

 ' হ্যাঁ সে তো দেখবই, তার আগে ওর মোবাইলটা ওকে দিয়ে দাও দেখি।' এইবার উপমা হেসে ওঠে।

 অশোকের কথামত মোবাইলটা উপমার সামনে রেখে অলি বলে, 'মোবাইলের শোকে চোখে বান ডেকেছিল, এইবার হাসি ফুটেছে।'


ঘরের আবহ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।

' না-ও, তুমি প্যান্ট জামা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।'

' খাবার রেডি ?'

'কী করে রেডি হবে ? তোমায় যে চাল আর সরষের তেল আনতে বলেছিলাম ...?'

'কী করে আনব, যা ঝড় উঠল, যারা টাকা দেবে ভেবেছিলাম,তারা কেউ পড়তে আসেনি। ধারে যে আনব, তা মেজদার দোকানও বন্ধ। '  একটু থেমে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, 'একদম নেই অলি?এবেলাটা ম্যানেজ করতে পারবে না? '

' ঠিক আছে,তোমার অত চিন্তা করতে হবে না।' কী একটা ভেবে নিয়ে বলে অলি ,' তুমি মেয়েকে নিয়ে বসো, আমি দেখছি।'

' চল তো মা,আমরা একটু পড়াশোনা করি।'

 'এখন,এত রাতে!'

'এত রাত কোথায়রে! সবে সাড়ে দশটা বাজে মাত্র। তাছাড়া মা-র রান্নাও তো রেডি হয়নি, চল চল যারা পড়াশোনা করে, তাদের কাছে সাড়ে দশটা আবার রাত্তির নাকি!'

অশোক মেয়েকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে। 'দুটো কোশ্চেনই রেডি তো?'

'হ্যাঁ।'

'কোনটা দেব?'

'যেটা খুশি।'

' ঠিক আছে, তুই মা, জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা--- এই উত্তরটা আমাকে লিখে দেখা দেখি ,আধঘণ্টার মধ্যে। ততক্ষণে আমি ফ্রেশ হয়ে নি, মা-র রান্নাও হয়ে যাবে। তারপর খেয়ে দেয়ে তিনজনে গো টু বেড, ঠিক আছে ?

' আচ্ছা যাও ।'



দরজা খুলে অলি রনিদের কলিং বেল বাজায়। রনির মা দরজা খোলে, ' ও অলিদি! এসো ,এসো। সব মিটমাট হয়েছে তো?'

'হ্যাঁ, তা হয়েছে, তোমার কাছে একটা অন্য দরকারে এসেছি কিন্তু ।'

' কী বলো ? ' রনি-পার্থ ডিনার সারছিল। গলার স্বর খুব নামিয়ে কানে কানে বলে, ' আমাকে দু'কৌটো  চাল দাও না। দেখ না,ঝড় -বৃষ্টির জন্য তোমার দাদা আনতে পারেনি।'

'এই সামান্য কথাটা বলতে তুমি এত হেসিটেট্ করছ অলিদি? কেন,আমি তোমার কাছ থেকে আলুটা পেঁয়াজটা, টান পড়লে নুন কাঁচালঙ্কা  আনতে যাই না?'

'সে যাও। '

'তবে 'এসো, ভেতরে এসো, বসো আগে।'

' অলিদি, অশোকদা ফিরেছে,যা ঝড়-বৃষ্টি গেল।' ডিনারের প্লেট থেকে মুখ তুলে পার্থ জানতে চান ।

' এইতো ফিরল।'

'আমিও তো একটু আগে এলাম। রাস্তাঘাটে গাছপালা পড়ে পুরো জ্যাম। অনেক ঘুরে ঘুরে আসতে হয়েছে।' বাবাকে থামিয়ে রনির সটান প্রশ্ন,' আন্টি ,পমাদিকে আর বকোনি তো?'

' না না, তিনি এখন বাবার কাছে পরীক্ষা দিচ্ছেন। '

জুঁই একটা কন্টেনার এনে অলির হাতে দেয়। বেরোতে বেরোতে অলি বলে, ' রনি, কাল যাস কিন্তু বাবা। '

' হ্যাঁ যাব তো, তুমি বারণ করলেও যাব।' সবাই হেসে ওঠে।



আস্তে করে টিভির সুইচটা অন করে অশোক। বাড়ি ফিরে চা খেতে খেতে খবরের চ্যানেলটা চালিয়ে দেওয়া ওর বরাবরের অভ্যাস। অলি রেগে যায় ও হয়তো তখন 'এখানে আকাশ নীল' কিংবা 'সাধক বামাক্ষ্যাপা ' জাতীয় কোনও জনপ্রিয় সিরিয়ালের শেষ ডায়লগ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আজ অবশ্য সে সব রুটিন এলোমেলো। ভাত বসিয়েছে অলি। 'জাতিসংঘের সাফল্য ও ব্যর্থতা ' লিখছে উপমা। অলির আজ যা মেজাজ এখন চায়ের কথা বললে ক্ষেপে যাবে। অগত্যা খবরেই মন দেয় অশোক ---- আজ সন্ধ্যায় প্রতি ঘণ্টায় একশ ষাট কিমি বেগে কালবৈশাখী বয়ে গেছে গোটা রাজ্য জুড়ে।সমস্ত জেলাগুলিতে লন্ডভন্ড পরিস্থিতি। গোটা কলকাতা শহর বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিল আধঘন্টার উপর। অফিস ফেরত যাত্রীরা বাড়ি পৌঁছতে নাকাল। ঘোষিকা একটু গলা চড়িয়ে সহযোগীর উদ্দেশে বলতে থাকে ,' পরমেশ ,তুমি ধর্মতলা-ডালহৌইসির এই মুহূর্তের পরিস্থিতিটা একবার দেখাও '

' দেখো মালবিকা , আজ যে ঝড়ের তান্ডব ...' ঠিক এই সময় খাতা হাতে দৌড়ে এসে উপমা বলে উঠল,

' বাবাই লেখা কমপ্লিট, দেখবে এস।'

' খাতা পরে দেখবে, রান্না হয়ে গেছে। দয়া করে খেতে এস, বাপ-বেটিতে।'  কিচেন থেকে হাঁক পাড়ে অলি।

টিভির ঘর থেকে বাবার হাত ধরে টানতে টানতে ডাইনিং-এ নিয়ে আসে উপমা। তারপর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ' কী রান্না করলে, মা?'

' কী আবার, তোমার প্রিয় খাবার, বাটার আলু সিদ্ধ ভাত আর ডিমভাজা। এত রাতে আবার কী রান্না করবে, গলা জড়িয়ে ধরলি যে বড়। মা তো খারাপ,খালি বকে মারে, তা মোবাইলের শোক  মিটেছে?'

' হ্যাঁ ' বেশ বড় করে টেনে কথাটা বলল উপমা।

' দেখ মা, মায়ের কথায় রাগ করবি না। মা তো  ভালোর জন্যই বলে। কদিন বাদেই পরীক্ষা,মন দিয়ে পড়াশোনাটা কর, এই কটা দিন।'

অশোকের কথা শেষ হতে না হতেই অলি যোগ করে, ' দেখিস না বাবার শরীর কি আর আগের মত আছে, একটুতেই হাঁপিয়ে পড়ে।তোর বাবার তো সরকারি চাকরি না, পেনশনও পাবে না। বুড়ো বয়সে দেখবে কে , তুই  একটা চাকরি বাকরি পেলে----'

'আমি ছাত্র পড়ানো ছেড়ে দেব, তুই সংসার চালাবি , তোকে তো কতবার বলেছি, দেখ মা  আমাদের ছেলে নেই, তুই -ই আমাদের ছেলে,তুই আমাদের মেয়ে।  তুই আমাদের না দেখলে, কে দেখবে বল!'

' হ্যাঁ রে বাবা, বুঝেছি বুঝেছি। '

'পাক্কা বুড়ি আমার মাঝে মাঝে মাথা বিগড়ে যায় ' উপমার মাথায় স্নেহস্পর্শ বুলায় অশোক -অলি।

' যাও , এবার বিছানাটা করোগে, বারোটা বাজে প্রায় ।'


সারাদিনে উপমার এই একটাই কাজ, বিছানা করা। এছাড়া অলি ওকে কোনও কাজই করতে দেয় না ,পাছে পড়াশোনার ক্ষতি হয়।না,চা করা, না,বাসন মাজা, ঘর ঝাড় দেওয়া কোনও কিছুই অলি উপমকে করতে দেয় না। নতুন ফ্ল্যাটে এখনও খাট কেনা হয়নি। বড় বেডরুমটাতে বিছানা করে তিনজন একসঙ্গে মেঝেতে শোয়। মাদুরের ওপর তোষক পেতে চাদর পাটপাট করে সুন্দর বিছানাটা করে উপমা। এই একটা কাজই উপমাকে করতে হয়।

বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে উপমা শুয়ে পড়ে। আজ ওয়েদারটা ঠান্ডা ঠান্ডা। তবুও ফ্যান ফুল ফোর্সে চালিয়ে গায়ে একটা চাদর দিয়ে নেয়।  অশোকও শুতে যায়। কাজটাজ সেরে লাইট অফ করে অলি শোয় সবার শেষে।

' তোমার চাদর লাগবে না?

' না। ' শুলেও ঘুম আসে না অশোকের।

' উপমা এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল?'

' ঘুমোবে না, তুমি যা কাঁদিয়েছ,তাছাড়া রাতও  কি কম হল?'

'আমি কাঁদিয়েছি! মেয়ের কোনও দোষ নেই?'

 'থাকবে না কেন,নিশ্চয়ই আছে,তাই বলে সব সময় চিৎকার চেঁচামেচি করবে, ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা ওর সামনে আছাড় মারবে?দোষ করলে বুঝিয়ে বল,বড় হয়েছে তো নাকি।' 

'আচ্ছা বাবা আমারই দোষ,মেয়ের কোনও দোষ নেই। এত মেয়ে মেয়ে কর তো বুঝবে একদিন। খালি লাই দেওয়া। একটু শাসন করা নেই।'

'চুপ কর তো, ঘুমাতে দাও।'



অশোক পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে। কিন্ত ঘুমোতে চাইলেও ঘুম আসে না। নানান চিন্তা মাথায়  ভিড় করে আসে। কাল সকালে কাদের ক্লাস আছে যেন,ও প্রথমে এইট ছটা থেকে আটটা তারপর নাইন আটটা থেকে দশটা।ওদের মুখগুলো ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। ওরা অনেকেই এখনও মাইনে দেয়নি ,কাল নিশ্চয়ই দেবে কেউ কেউ। কেন যে বড় ফ্ল্যাটটা নিতে গেল! ছোটটা নিলে এতটা দেনায় পড়তে হত না।এখন রনিরা যে ছোট ফ্ল্যাটটাতে থাকে, অশোক ওটাই নিতে চেয়েছিল। উপমাই বায়না ধরল, 'বাবাই বড়টা নাও না,আমার একটা আলাদা ঘর থাকবে আর তোমারও একটা। ড্রইংরুমটা তুমি উপরের দিকে বইয়ের তাক বানাবে ভালো করে। নীচে তোমার পড়ার টেবিল আর একটা সোফা । তোমার বন্ধুবান্ধব এলে ওখানে বসবে। যুক্তিটা অকাট্য। কিন্তু টাকা টাকা আসবে কোত্থেকে? অলিও সায় দিল উপমার দিকে। আর ঠিক এই সময়েই কুড়ি বছর টার্মের এল আই সিটা ম্যাচিওর করল। এগিয়ে এল প্রোমোটারও। ভরসা দিল, 'অ্যাডভান্সটা করুন না, তারপর দেবেন না হয় আস্তে আস্তে। আমি আপনি তো একই পাড়ার লোক। আমিও আপনাকে চিনি, আপনিও  আমাকে চেনেন। কেউ কারও টাকা মারব না।'


রাজী হয়ে গেল অশোক। এলআইসি থেকে পাওয়া পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে অ্যাডভান্স করল। ছশো স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটের দাম আঠার লাখ টাকা। তার মধ্যে পাঁচ লাখ দেওয়া হল, বাকি তের লাখ টাকা আসবে কোত্থেকে? অলিই  দশভূজা হল। সাহস জোগাল, 'আমি তোমাকে তিন চার লাখ টাকা জোগাড় করে দেব।'

'কোত্থেকে?'

'দেখ পঁচিশ বছর ধরে আমার গয়নাগাটিগুলো তো আলমারিতেই পড়ে আছে, ওগুলো বিক্রি করে তিন চার লাখ টাকা পাব না, কী গো?'

'তাই হয় নাকি?' অশোক থম মেরে যায়।

'দেখ, ওই ভাঙা ঘরে আর কতকাল কাটাব। তুমি অমন করো না। উপমাও তো একদিন চাকরি-বাকরি করবে। জমানো টাকাগুলো দুই বছর পর ম্যাচিওর করলে তখন না হয় আবার কিনে দেবে।'


অলির আগ্রহ দেখে শেষমেশ অশোক বলে ফ্ল্যাট যখন নেবেই তাহলে ছোটটা নাও।বারো  লাখে হয়ে যাবে। পাঁচ লাখ তো হাতেই আছে।তোমার ওখান থেকে কম করে তিন লাখ তো পাবোই আর লাখ চারেক টাকা ছোটখাট একটা লোন নিয়ে নেব না হয়। লোন যদি না পাই ফিক্সড ডিপোজিটগুলোই ভেঙে দেব।


' না দেখো , ছোটটা নিলে কী করে হবে?ভবিষ্যৎ বলে তো একটা কথা আছে। উপমাকে তো একদিন বিয়ে দিতে হবে। মেয়ে-জামাই থাকবে কোথায়, শুনি?


অশোক আর অমত করতে পারেনা।রাজি হয়ে যায়।কিন্তু একটা পার্মানেন্ট চিন্তা ঢুকে যায়,তেরো লাখ টাকা কীভাবে জোগাড় করা যাবে,অলির গয়নাগাটি বিক্রি না করে।


শুরু হল লোন পাওয়ার লড়াই। প্রথমে সরকারি ব্যাংকের দরজায় দরজায়। সব শুনে ব্যাংক বলল, 'পে স্লিপ দেখাতে পারবেন?' অশোকের যা জীবিকা 'পে স্লিপ' কী করে দেখাবে, একটা সরকারি ব্যাংক অবশ্য বলল, পে স্লিপ না হলেও চলবে, তবে আপনাকে দু'বছরের আই টি ফাইল দেখাতে হবে। আই টি ফাইল? আই টি ফাইল করার কথা অশোক তো কোনদিন ভাবেইনি। দরকারও পড়েনি।


'আইটি ফাইল দেখালে লোনটা পাব?' অশোক জানতে চাইল।


'আপনি ওটা দিলে আমরা ফাইলটা প্রসেসিংয়ের জন্য হেড অফিসে পাঠাব।’ অশোক বুঝল কোনও নিশ্চয়তা নেই। হতেও পারে, না-ও পারে। তবু আশায় বাঁচে চাষা। উঠে-পড়ে লাগল আই টি ফাইল তৈরি করতে। খুঁজে পেতে জোগাড় করল আই টি ফাইল করার লোক। ফাইল তৈরিও হল ,জমাও দিল।

কিছুদিন পর ব্যাংক জানাল, ' সরি ,আপনার লোনটা হল না।'

'কেন?'

হেড অফিস জানিয়েছে,সেম ডেটে দু'বছরের আইটি দেখালে চলবে না। এক বছর গ্যাপ চাই। একটু ভেবে নিয়ে অশোক বলল, ' এক বছর পরে কি পাব সিওর?

'পেতে পারেন। তবে গ্যারান্টি দেওয়া যাচ্ছে না। আইটির সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্সও লাগবে, হেড অফিস জানিয়েছে।


ট্রেড লাইসেন্স? টিউশনির আবার ট্রেড লাইসেন্স? মুষড়ে পড়ে অশোক। কিন্তু হাল ছাড়ে না। চেষ্টা চালাতে থাকে। মোবাইল ঘেঁটে 'ব্যাংক বাজার ' নামে একটা ওয়েবসাইট খুঁজে বার করে। হবে না ধরে নিয়েই অ্যাপ্লাই করে দিল অনলাইনে। কী আশ্চর্য! দু'দিনের মধ্যেই রিপ্লাই এল।একটা প্রাইভেট ব্যাংকের রিপ্রেজেন্টেটিভ ফোনে যোগাযোগ করল। তারপর বাড়িতে এসে  দরকারি কাগজপত্র নিয়ে গেল। সত্যি সত্যিই শেষমেষ লোনটা ওখান থেকেই স্যাঙ্কশন হল। কাউকে কিছু উৎকোচ দিতে হল না শুধু প্রসেসিং চার্জ বাবদ বারো হাজার টাকা এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্র করতে খরচ পড়ল হাজার পাঁচেক টাকার মতো..... এই সব ভাবতে ভাবতে চোখটা প্রায় জড়িয়ে আসছিল ঘুমে। এমন এমন সময় ফিসফিস করে ডাকল অলি, 'এই শোনো শোনো...’

' কী,বল না ?'

'ওই দেখো ...'

'কী? '

' উপমার চাদরের ভিতরে মোবাইল জ্বলার আলো!

' তাই তো!' বিস্মিত হয় অশোক। 'রাত প্রায় একটা গড়িয়েছে, না ঘুমিয়ে মোবাইলে... এত রাতে...কী করছে...'


অশোক আর ধৈর্য রাখতে পারে না।এক ঝটকায় উপমার গা থেকে চাদরটা সরিয়ে চিৎকার করে ওঠে, 'এত রাতে মোবাইল নিয়ে কী করছিস?' 'কিছু না বাবাই, কিছু না, হাতের চাপে জ্বলে উঠেছে।'

'হাতের চাপে জ্বলে উঠেছে? জ্বলাচ্ছি দাঁড়া।' বলতে না বলতেই এক ঝটকায় উপমার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে গায়ের জোরে আছাড় মারে মেঝেয়।


তাড়াতাড়ি লাইট জ্বালে অলি। মোবাইলের পার্টসগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে এদিক-ওদিক।


হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে উপমা।' বাবাই অন্যায় হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দাও।আর হবে না ' ততক্ষণে অশোকের মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে অক্সি-হাইড্রোজেন শিখার মতো। ওর হোমাপাখি..জন্ম-মৃত্যুর ওপারের ডাক...সবকিছু যেন মুহূর্তে গিলে নিয়েছে ক্রোধাগ্নি। ওই তো বুকের ভিতর জ্বলছে  হোমাপাখির চোখ মুখ, ডানা, ওর পড়া,না -পড়া, লেখা,না-লেখা কবিতার পঙক্তিগুলো..।


মেয়েকে না বকে, না মেরে নিজের মুঠো শক্ত করে সজোরে দেয়ালে ঘুসি মারে অশোক। পরপর দু'বার। থেঁতলে যায় মাঝের দু'টো আঙুল। রক্ত ঝরে। অলি ঠেকাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।


ঘটনার আঁচে উপমা কুঁকড়ে যায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে অপরাধীর মতো। অশোক অলিকে লক্ষ করে বলতে থাকে, 'এই মুহূর্তে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাক। ওর মুখ আমি দেখতে চাই না।'

'কী বলছ যা তা! এত রাতে কোথায় যাবে!' অশোককে টানতে টানতে উপরে নিতে চেষ্টা করে অলি, ' যাও তো তুমি ছাদে যাও, মাথা ঠান্ডা কর।'


তরতর করে ছাদে উঠে যায় অশোক। চুপ করে বসে। একের পর এক চিন্তা ঢেউ খেলে যায়..এত বড় হয়ে গেছে উপমা! কোন রাতের ভ্রুকুটি কেড়ে নিয়েছে ওর চোখের ঘুম! কোন নদীর জলে সাঁতার কাটছে এখন ও! কূল কিনারা পায় না অশোক। এই কি তার সেই ছোট্ট উপমা,কোনও এক জল থৈ থৈ বর্ষার দিনে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রিকশা উল্টে ড্রেনে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে মুখটা জলের উপরে তুলেই প্রশ্ন করেছিল, ' বাবাই কই!' পিঠের ব্যাগ,হাতের ছাতা ফেলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, ' এইতো আমি মা! জীবনের এ কোন বর্ষায় ভেসে গেছে তার সেই নিশ্চিত অবলম্বন, ভেবে পায় না অশোক। হঠাৎ দৃষ্টি যায় দূর আকাশের দিকে। আহা কী সুন্দর স্বচ্ছ পরিষ্কার আকাশ। ঝিকমিক করছে নক্ষত্রের আলো।  জোছনা ছড়িয়েছে চাঁদ...যেন এই জ্যোৎস্নার ভেতর অশোক এসে বসবে বলে। অশোকের উত্তপ্ত পাঁজরে ঠান্ডা হাওয়া বুলিয়ে যাচ্ছে মধ্যরাত্রির কোমলস্পর্শ। 'কোন রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে' ... শুনতে পাচ্ছিল যেন অশোক। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বুকের অনেক গভীরে নেমে হন্যে হয়ে খুঁজছিল কোথায় হারাল হোমাপাখি। দেখতে পাচ্ছিল না কোথাও।কোথায় গেল সে! মধ্যরাত ফালাফালা করে আত্মার গভীরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে অশোক।


অনেকক্ষণ পরে ক্রোধের আগুন নিভতেই,টের পেল ওই তো বুকের ভেতর আস্তে আস্তে ডানা মেলে উড়ে এসে বসছে হোমাপাখি।ব্যথায় টনটন করছে আঙুলগুলো।'পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে ' এতদিন শুনেছে..আজ টের পেল। তবু সব ব্যথা কর্পূরের মতো কোথায় উড়ে গেল যেন....যখন টের পেল হোমাপাখি তাকে ছেড়ে যায়নি আত্মা জাপ্টে চুপটি করে বসে আছে বুকের ভেতরে কোথাও।


( আগামী পর্বে )



উপন্যাস * দীপংকর রায়




'স্বরবর্ণে'র  বিগত  সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ২ 

দীপংকর রায়


এই কথাগুলি শুনতে যে রকম, কিন্তু সেই পথটুকু পেরিয়ে আসতে ঠিক কী যে হয়েছিল, সে কথার যেন ঠিক ঠিক বর্ণনা দেওয়া যায় না কখনোই। বারবার কেন যে ভাবছিলাম, আচ্ছা কথাবার্তা শুনে কাইলে মামাকে যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তাহলে কী দাঁড়াবে পরিস্থিতিটা ?আমাকে যদিও বা কলকাতার ছেলে বলে চালিয়ে দেবে বলেছিল কাইলে মামার মামা শ্বশুর, কিন্তু কথায়- বার্তায় বিষয়টা কি খুব একটা ধোপে টিকবে? কথা বললেই তো ধরা পড়ে যাবো আমিও। আমাকে কি আর এদেশের নাগরিক বলে চালানো যাবে? আমার কথাবার্তা, চাল-চলন, জানা-শোনা সবই তো এই দেশ থেকে কবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সব দিক দিয়ে! তাহলে আমি আর কীভাবেই বা এদেশের মানুষ বলে বিশ্বাস করাতে পারবো পুলিশ তো ছাড়ো, সাধারণ মানুষকেও? 


          তাই ভাবনার এই গোটা পরিস্থিতিটা সামলে ভাই এবং মামাকে তো ওই পথটুকু পার করতে হয়েছে এতদিনে?  সেটা যে কী দুঃসহ আতঙ্কের, তা শুধু আমিই জানি। সে কথা মা বুঝতে পারছে না সেভাবে। এ কথা খুব ভালো করেই জানি। তাই পরদিন যখন মা আমার কথা শুনে দমদমে যেতে রাজি হলো , তখন আর একমুহূর্তও দেরি করলাম না ।


        সেখানে যখন পৌঁছলাম তখন জানতে পারলাম আমার ধারণাই  সঠিক। কাইলে মামা যাবার দিন এখানে একদিন থেকে সমস্ত রকম বর্ডারের খোঁজখবর নিয়ে তবেই রওনা হয়েছিল ভাইকে নিয়ে । এরাও ভাইকে বুঝিয়েছিল , এইরকম একটা সময়ে তার  ওদেশে  যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সে নাছোড়। কারো কথাই শোনেনি। শেষ পর্যন্ত মামা হয়তো ভেবেছিল, যাকগে, একা একা যাবার চাইতে এই সময়ে দু'জন হলে মনে আলাদা একটা ভরসাও পাওয়া যাবে। বেশ, বেলা গড়িয়ে ফিরে আসা হলো দমদম থেকে। খানিকটা আশ্বস্ত  হওয়া গেল অন্তত এই ভেবে, তাহলে সত্যি সত্যিই সে মামার সঙ্গে ওদেশেই রওনা হয়েছে। 


         দু'দিন নানা কথা ভেবে ভেবেই সময় কেটেছে। একটুও স্বস্তি পাইনি। কীভাবে যে এই  ক'টা দিন চলে গেছে , তা যেন নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি। একেকবার  এও ভেবেছি, এই বুঝি ওরা না যেতে পেরেই ফিরে এল ! এবার ভাবনা পরিবর্তিত  হয়ে আরো অন্য কথায় ভাবিত করে তুলতে  লাগলো------ ওকি ওদেশে থাকতে পারবে? শেষে কিছুদিন গেলে আবার না হুটোপাটি শুরু করে দেয় ফিরে আসার জন্য! আবার ভাবছি একথা তো ঠিক, আমি চলে আসাতে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে দিদিমার মনে, সেই শূন্যস্থানটিও তার যাওয়াতে হয়তো পূরণ হয়েছে। তাই আলাদা একটা খাতির যত্নও পাবে হয়তো সকলের কাছ থেকেই । কিন্তু ও কি থাকতে পারবে? পড়াশোনার ক্ষতি করে এইভাবে বছরের মাঝখানে চলে গেল ও! এ বছরটাই তো মার যাবে। এতে যে কত বড় ক্ষতি হলো এ কথা কি একবারও ভেবে দেখেছে? মাও যেন সেসব একবারের জন্যেও ভাবছে না। হয়তো  সে এ কথাই ভাবছে ,যেভাবে বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছিল, তাতে ক'দিন একটু ঘুরে এলে হয়তো এই বেলাগাম অবস্থাটা পাল্টালেও  পাল্টাতে পারে। 


           মা অফিস ফেরতের সময় একরকম প্রতিদিনই দিদির বাড়িতে অনেকটা সময় কাটিয়ে আসে। একেকদিন তো বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে। আচ্ছা, আমি আসার আগেও কি এরকমই করতো সে ? তাহলে  তার এইসব ঠাকুর-দেবতা, গোরু, সংসার, রান্নাবান্না সবই কি কাজের মানুষজনের উপরেই নির্ভর করে? 


          এ বিষয়ে কালো দিদি জানিয়েছে, না, তা সবটা ঠিক না। ছোটো ভাই ওদেশে চলে যাবার পরেই এরকম করছে মা । ইতিমধ্যে মা হয়তো খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে গেছে তোমার এখানে চলে আসাতে। ভাবছে, বড় ছেলে এসে গেছে তো, ও তো খানিকটা বুঝেও গেছে এই ক'দিনে। এখন আর একা একা থাকতে হয় না আমাকে। কথা বলার একজন মানুষ আছে বাড়িতে। তাই হয়তো নাতির সঙ্গে খানিকটা সময় কাটায়। কাইলে মামা যে দু'দিন ছিল সে দু'দিনও এতটা রাত তো করতো না মা! তাই তার এই দেরি করে ফেরা নিয়ে আমিও অভিযোগ না করে পারলাম না। বলেছিও ,আচ্ছা মা, দিদি কি তার সংসার- ধর্ম ফেলায়ে এ বাড়িতি আইসে থাকে নায়ি, তাই কও তো দেহি আমারে? 


            তাতে তার উত্তরটাও জানতে পেরেছিলাম, ওর ছেলেটির বয়স তো সবে দেড়দুই বছর, এই সময় ও ছোটো ছেলেপুলেদের পরিচর্যা সম্মন্ধে কতটুকু জানে! তাই ওখানে না গেলে কি চলে তাই ক? এ দায়িত্ব কি এড়িয়ে যেতে পারি আমি তাই বল তুই-ই একবার?


           বুঝলাম, মা হয়তো নিজেও জানে তার এই সংসারের প্রতি কিছুটা ত্রুটির কথা। আর সেই জন্যেই হয়তো সে আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্যে ওইভাবে চিঠি লিখেছিল তার মায়ের কাছে। এবং সে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভেবেছে, তার বিশ্বাসও বলা যেতে পারে, আমি ওদেশ থেকে চলে আসলে তার মাও হয়তো তাড়াতাড়ি ওদেশ থেকে চলে আসবে। 


          কিন্তু ঘটনার চাকা ঘুরে গেল অন্যদিকে। তার পরিকল্পনা মতো কিছুই চললো না। এখন এমনই এক অবস্থা তৈরি হলো, যা ভেবে সেও খানিকটা যেন চিন্তিত হচ্ছে এবারে। ভাই হয়তো ঠিক ভাবে পৌঁছেছে। কিন্তু  তারপর পুরো অবস্থাটা কোন দিকে যাবে! দু'দিন তাকে নানা কারণে প্রশ্ন করা এবং দমদম থেকে ঘুরে আসার পরে, সে রাত্রে সে এসব নিয়ে নানা কথাই ভাবছে না এমনটা না, ভাবছে। কিন্তু  অস্থির হয়ে কী লাভ এখন? দেখা যাক কী করা যায় এরপর। 


            এদিকে সব খবরা খবর পাবার পরে খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে মনটা এবং নানা ভাবে কালো দিদির সঙ্গে গোরুর পরিচর্যা করা ও ঘরদুয়োর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করায় মন দিয়েছি। কোদাল নিয়ে দাওয়ার সামনের ঘাস-জঙ্গলও পরিস্কার করা যায় কীভাবে তার একটা চেষ্টা চালাচ্ছি কালো দিদির সঙ্গে। এসব কথা মা অফিস থেকে ফিরলে মাকে সব আস্তে আস্তে বলে দিয়েছে কালো দিদি। আজ গোয়ালা কখন এসেছে দুধ দুইতে ,এবং সকলে দুধ ঠিক মতো পেল কি না, এসব সব বাড়ি ফিরলে মাকে বলে দিয়েছে। যেন আর কোনো চিন্তার কারণ নেই, এবারে সব আমিই যেন সামলে নিতে পারবো, এমনই সব সম্ভাবনার কথা মাকে বলে বোঝাতে লাগলো সে আস্তে আস্তে। এই কথাগুলো মাকে বললে মা যেন বেশ নিশ্চিন্ত হতে পারে, সে হয়তো এমনই কিছু ভেবেছে ----


          হয়তো বা তার ধারণাও ভুল না, খানিকটা না ভেবেই বা কী করি, কতো আর শুয়ে-বসেই ভালো লাগে, তাই খানিকটা তো ভাবছিই, বাড়িটার যা অবস্থা , এভাবে কি থাকা যায়? কিন্তু আমি এবং কালো দিদি মিলে সবটা কি পেরে উঠবো? আচ্ছা এই মানুষটিকে কালো দিদি  কালো দিদি  বলছি কেন আসার পর থেকেই ? একজন মানুষকে তার শরীরের রঙ দিয়ে কি বিচার করা উচিৎ ? এ কেমন সম্বোধনের ভাষা! কেনই বা তা হবে? 


             এ কথা আজই যেন প্রথম মনে এলো, এবং সেকথা মাকে বললামও। মা তা শুনে আমাকেই সমর্থন করলো। বললো, হ্যাঁ, সে তো ঠিকই ---- যদিও আমরা তাকে কেউই সামনা-সামনি ওভাবে বলি না। কখনো সখনো সুশীলা অভ্যাসবশত বলে। তবে সত্যিই তুমি একটা অত্যন্ত সঠিক বিষয় বলেছ আজ। আজই তাকেও বলে দেব, বারণ করে দেব, আর তুমি বলো না ওভাবে। আমি বললাম, না, বলি না যদিও, কিন্তু কাউকে তার সম্মন্ধে বলতে গেলে  হয়তো কয়েকবার বলেছিও। তবে বলার পরে, এসে পর্যন্ত মনে হচ্ছে, না, এভাবে একজন মানুষকে তার গায়ের বর্ণ দিয়ে সম্বোধন করাটা ঠিক না। তাই ঠিক করেছি আজ থেকে তাকে শুধু মাত্র দিদি বলেই ডাকবো। বড়জোর কাউকে বললে হয়তো বলবো কাজের দিদি। 


             এইসব সাতপাঁচ নিয়েই এ ক'টা দিন কেটে গেল যেন কিভাবে। এর মধ্যে বাড়ির সামনের দিকটা অনেকটাই দুু'জনে মিলে পরিষ্কার  করে ফেলেছি। ঘর-দুয়োরও আগের থেকে অনেকটাই ঝরঝরে। বুঝতে পারছি না অন্তরালে অন্তরালে কীভাবে যেন বেশ সংসারী মানুষ হয়ে উঠছি ! একথা আজই প্রথম মাথায় এল হঠাৎই --- হঠাৎ করেই সেদিন বৃষ্টির মধ্যে বেশ রাতে বারান্দায় বসে আছি, তখনই কথাটা মাথায় এল। এতটা ঘরগেরস্থালি নিয়ে আমি জড়িয়ে যাচ্ছি কেন? এসব জিনিস নিয়ে এর আগে কোনোদিনও তো ভাবিনি! তা যদি ভাবতাম, তাহলেও তো দিদিমা আমায় মাথায় তুলে নাচতে চাইতো! কিন্তু এখানে এসে এসব নিয়ে এত ভাবছিই বা কেন….!


            এর মধ্যে একদিনও বই -খাতা লেখালিখি এসব নিয়ে কিছুই ভাবিনি। আজ কেন জানি না বারবার মনে হতে লাগলো সেসবের কথা। এ আমি কেমন ভাবে এতটা পাল্টে গেলাম, কেনই বা ওসব দিকে অমন ভাবে নজর পড়লো আমার?


            রসিক দাদু শিক্ষাগুরুর কথা বলেছিল। বলেছিল বড়ো জায়গার কথা । কই , সেসব নিয়ে তো কোনো কিছুই ভাবছি না! এ ক'দিনে একবারও সে সব কিছুই ভাবিনি। এসে দিদিমা বা রসিক দাদু কাউকেই একটা কিছুই জানাইনি । সঞ্চয়কে কেন্দ্র করে ওদেরগুলি একসঙ্গে একটি খামে পুরে পাঠিয়ে দিতে পারতাম তো; কই , চিঠি লেখায়ও কি মন  দিয়েছি সেভাবে--- ? এ ক'দিনে এসব নিয়ে কিছুই ভাবিনি ! নিজের কাছে নিজেই অবাক হচ্ছি, ভাবছি , একবারও এসব ভাবলাম না! যাদের সঙ্গে এতগুলি দিন কাটিয়ে এলাম, যাদেরকে নিয়ে একমুহূর্তও না ভেবে থাকতে পারতাম না , তাদের এভাবে বেমালুম ভুলে গেলাম কীভাবে? এতটা পরিবর্তন আমার মধ্যে নিয়ে এলো কে?


           বৃষ্টির রাত, উঠোনে বাইরের লাইটপোষ্টের খানিকটা আলো পড়েছে মিটার ঘরের মাথা পেরিয়ে রাঙচিতের বেড়ার উপর। রাঙচিতে গাছে বাঁশের চটা দিয়ে তাদের গোড়ার দিকটায় বাঁধন দিয়ে বাড়ির সামনের দিকটায় বেড়া দেওয়া হয়েছে। সেই রাঙচিতে গাছের পাতায়, ঘাসের জঙ্গলে, বারান্দার আলো এবং লাইটপোষ্টের আলো মিলেমিশে এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির ভেতর হাওয়ায় সকলে মিলে ঢেউ খেলিয়ে খেলিয়ে যেন লুকোচুরি খেলছে। ডানদিকের ডোবাটার ভেতরে ব্যাঙ ডাকছে। থেকে থেকে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। ঘরের ভেতর এরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিই বারান্দায় মোড়া পেতে একা একা বসে বসে এইসব নানা কিছু দেখছি এবং নানা কথা ভাবছি। মনে মনে ঠিক করছি কাল যেভাবেই হোক  একবার দিদিমাকে ও রসিক দাদুকে একটা কিছু লিখতেই হবে। পারলে সঞ্চয়কেও। আরো ভাবছি, এই যে ক'দিন হলো এসেছি, এর মধ্যে একদিনও তো ঠাকুমার বাড়ি-মুখো হলাম না! দিদির বাড়িতেও যাইনি। যাওয়া উচিত ছিল না কি? ঠাকুমার ওখানে গেলে হয়তো ছোটবেলার কারোর না কারোর সঙ্গে দেখা হলেও হতে পারত! যদিও বা তারা কেউ আমাকে চিনতেই পারবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ। তাহলেও তো কথা বলার কাউকে পাওয়া যাবে অন্তত! সঙ্গে সঙ্গে আবার একথাও ভাবছি, এই তো ক'বছর আগে যখন এসেছিলাম এদেশে, তখন তো ঘনঘন ও বাড়িতে যেতাম, কই ,ছেলেবেলার একজন বন্ধুর সঙ্গেও কি আমার ভাব জমেছিল ? না। কারণ আমি যে ওদের থেকে  অনেক দূরে চলে গেছি। সেই ছেলেবেলার কোনো ছন্দ, গন্ধ, সুরই আমার সঙ্গে আর নেই। তারা কবে কোথায় নানা জল হাওয়া লাগিয়ে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে আমার থেকে হয়তো বা! তাদের কোনো সুর -তালই নেই আর এখন আমার মধ্যে ; যার কিছুটা দিয়ে তাদের কাছে কেউ একজন হয়ে উঠতে পারি অন্তত! তাহলে কি এখানেও সেটাই ঘটেছে?


              ক'দিন হলো ওপাশের কর্মকার বাড়ির শংকর, মজুমদার বাড়ির সুভাষ, ফচন , ওপাশে মানু , এরা সকলেই আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে যখন খেলাধুলো করে, আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিসব যেন ওদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে, কিন্তু কখনো আমাদের বাড়ির ভেতরে আসে না বা আমাকে ডাকে না। শরণার্থী হয়ে ফিরে এসে এদের সঙ্গে সামান্য ক'দিনের একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছিল বলে, এদের সকলের নাম বলে দিতে পারি। তাছাড়া আমিও তো ওদের তেমন করে ডাকিনি ! তারও কারণ আছে, নানা কারণে নানা ধরনের হীনমন্যতা ভেতরে ভেতরে কাজ করে চলেছে, যা আমি টের পাচ্ছি, তবু সেও নাছোড়, সে তার জায়গাটাও ধরে বসে আছে দেখছি, সেও কিছুতেই তার সীমানা অতিক্রম করতে চাইছে না যেন, তাই আমিও পারছি না তাকে ডিঙোতে । সেটা আবার কি রকম! যা একাত্তরে ছিল না অথচ এই পঁচাত্তরে, সামান্য এই কিছুদিনের ব্যবধানে সে এরকম একটা জায়গা পেয়ে গেল? 


            হয়তো সেটা এরকম, এই মুহুর্তে এ পাড়ায় সকলের থেকে বাড়ি -ঘর- দুয়োরের অবস্থা আমাদেরই খারাপ একটু। এদের সকলের দালান বাড়ি। খুব নামিদামি স্কুলে পড়াশোনা করে। এদের বাবা-মা-রাও সমাজের খুব উঁচু তলার মানুষ-জন , যা ঠিক আমাদের বাড়ির সঙ্গে মানায় না হয়তো। যেমন ধরা যাক এরকম, আমাদের এই যে একখানা  টালির ঘর , আলগা বাথরুম , বারান্দায় গ্রিল নেই, এমনকি আমাদের একখানা ঘরের মেঝেতেও সান করা হয়নি। মা সেসময় তাড়াতাড়ি কোনোরকমে মেঝেটাতে একটা রাফ ঢালাই দিয়ে নিয়েই গৃহপ্রবেশ করে নেয়। এখানে চলে আসে। তারপর আর নানা কারণে সে ঘরের মেঝে আর পাকা করা হয়ে ওঠেনি।


             তাই তথাকথিত সামাজিক অবস্থানের জায়গাটা যা দিয়ে বিচার্য হয়, সেখানে আমরা এদের থেকে দুর্বল। ঠিক যেন এদের সঙ্গে মেলামেশা করার মতন নয়। কিন্তু আমার ভেতরে এ ধরণের চিন্তা-ভাবনা প্রবেশের পথ পেল কী করে? এরা যে সে কারণেই আমার সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইছে না এমন ভাবনাই বা ভাবছি কেন আমি? এরা কি সেরকম কোনো কথা বা ইঙ্গিতও করেছে নাকি? যে কারণে আমি এরকম ভাবছি? ছোটো-বড়ো, উঁচু-নিচু, বড়ো বাড়ি, ছোটো বাড়ি, এসব আজ আমাকে কে চেনালো? তাহলে কি সত্যি সত্যিই এবারে আমি নাগরিক হয়ে উঠছি? মাত্র এই ক'দিনের মধ্যেই নাগরিকতা আমাকে তার ভেতরে জড়িয়ে  ধরে এমন ছুরি-কাটারি ঘোরানো আরম্ভ করে দিয়েছে ? আর তা যদি না হবে তাহলে এসব ভাবছিই বা কেন? কোথা দিয়ে সে আমার ভেতরে এভাবে প্রবেশ করলো? নিজের কাছে নিজেই তার কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না যেন কিছুতেই। 


           এইসবের মধ্যে দিয়েও বারবারই মনে পড়ছে ওখানের কথা আজ ক'দিন ধরে। একে একে প্রত্যেকে সামনে এসে দাঁড়াতে চাইছে। আর আমি একে একে তাদের সকলের সঙ্গে এই মুহূর্তের এই নিঃসঙ্গতার কথা বিনিময় করতে চাইছি যেন ----- এই বর্ষার বাগানগুলি জঙ্গলের পথগুলি বলছে : কী….. কী করছ কি….? ওদিকে যে বিলের জল এসে ভরে গ্যাছে গলির খাব-গর্ত সবগুলির ভেতর। নগেনের মা বুড়ির তাল গাছ থেকে এই বর্ষায় ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে কত তাল পড়ল যে ঢপ ঢপ করে,  তোমার মতন আর তো কেউ কান খাড়া রাখেনি তাল কুড়নোর জন্যে এখন! তোমার মনে পড়ছে না, বর্ষায় বুক ঢিপঢিপ করা সেই বাগানের পথটুকু , তারপরেই তালটা কুড়িয়ে নিয়েই চোখ বুঁজে দৌড় মারতে। সেসব কি ভুলে মেরে দিলে এই ক'দিনের ভেতরেই? আমাদের যে তোমার কথা বড্ড মনে পড়ছে গো…… সকালের ঠাকুর নালার মাঠ বলছে : দেখলে না তো এবার কতো জলে ভরে গ্যালো চারদিক, মাঠ-ঘাট সব একেবারে জল আর জল ---- কতো ধানগাছের গোড়ায় পেট-লাল পুঁটি  মাছেরা ঠোকরাচ্ছে ! ষোল-ল্যাটা -টাকি - ট্যাংরা  -কই মাছেরা ,সব কীরকম এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ! শুধু মুসলমান পাড়ার কেউ কেউ সেই জলের স্রোতের মুখে রাবানি-ঘুনি পেতে জিয়া মাছ, পুঁটি মাছ, ট্যাংরা ,মৌরোল্লা মাছ ধরছে, যা  তুমি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সব হারিয়ে-ফুরিয়ে গ্যালো এমনই একটা ভাব। 


            বাবুদের ভাঙনের বট গাছও বলছে একই কথা। নবগঙ্গার জলে এই বর্ষায় তুমি যেভাবে বড়ো নৌকো খানা নিয়ে বসে থাকতে টিটি-পক্ষীর মতন নারান ডাক্তারের ছোটো মেয়েটিকে সঙ্গে করে ছাতি মাথায় দিয়ে নিশ্চুপে , তেমন অবসর সময় আর কারো কি আছে ? যে যেভাবে পারে অন্য কাজেই ব্যস্ত থাকে বেশি সময়। দোয়াড় পাতা কি কারো আছে এখন?  যে যেভাবে পারে অন্য দিকেই পরিত্রাহি ছুটছে শুধু ; যদিও সেসব পাতাপাতি কখনো কখনো হয়, টগি-বঁড়শিও ফ্যালে কেউ কেউ, তবে তা দুই পাড় জুড়েই হাতে গোনা, তুমি থাকতে যেমন ছিল তেমন আর নেই, সব যেন তোমার সাথে সাথেই চলে গেল মাত্র এই ক'দিনের মধ্যেই!  তা যাক, কিন্তু আমার নিচে অমন নিশ্চুপে অনন্ত অপেক্ষা নিয়ে কেউ বসে না আর, ছিপ-বঁড়শি  নিয়ে একা একা! 


            এ নিয়ে নবগঙ্গারও প্রতিবাদ আছে যেন। সে বলছে, এত জেলেরা জাল ফেলছে, টগি-বঁড়শিও পড়ছে দুপারেই দু'একটা, খ্যাপলা , ভেসাল জালে নিঃশব্দে মাছ মেরে নিয়েও তো যাচ্ছে মালো সম্প্রদায়। রাত-ভোর টানা বড়শিতেও তো ডিঙি নৌকো নিয়ে মালোরা এদিক থেকে ওদিক আদার গাঁথছে না যে তা না, গাঁথছে তো,  মাছও ভোর ভোর  তুলে নিয়ে যাচ্ছে নৌকোয় ; তাতে কি, ওহে বটগাছ, তোমার নিচ দিয়ে কেউ যাওয়া আসা করছে না একেবারেই? তুমি এমন করছ, যেন নালিশ জানিয়েই খালাস হলে তার কাছে সব! হ্যাঁ হ্যাঁ  বুঝলাম না হয়, অমন ভাবে জলশ্যাওলার গন্ধে মাখামাখি হয়ে বুঁদ হয়ে থাকে না নাহয় সকলে একরকম ভাবে, কিন্তু চলছে তো সবই ! তাই বলে যে একবারও পিছনে ফিরে দেখলো না, তার কাছে এসব বলে কী হবে? দেখলো কি একবারও, পিছনে ফিরে? এত যে দাপাদাপি করলো, গরম শীত বর্ষা সবই উপভোগ করলো, পাতিশ্যাওলা শরীরে মেখে ; তাহলে, সব কিছু  ফেলে এভাবে চলে গ্যালো কীভাবে? কীভাবে গ্যালো? যতই  তার জন্ম-দেশ হোক ওটা, এটা তার দেশ না!  একে তুমি কী স্মরণ করাচ্ছ ওহে বট-পাকুড়  গাছেরা ,তোমার শাখা প্রশাখারা এত যে হেলেদুলে তাকে হাওয়া বাতাস খাওয়ালো , সে কি তার কিছুই মনে রাখলো, বলো তো? আমরা কি কেউ ছিলাম কখনো তার?


            এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির রাত্রি, চোখে ঘুম নেই আমার। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বারান্দার পিলার । রেলিং।  হাওয়ায় জল এসে লাগছে  পায়ের কাছেও । ডানপাশের ডোবার ভেতর জলকলমির ডাঁটাগুলি হাওয়ায় একবার এদিক একবার ওদিক করছে। ব্যাঙগুলিও ডাকছে  জল পেয়ে। ঝিঁঝিঁরাও ।কালো গোরুটি শুয়ে শুয়ে মুরগির ঘরের নিচে জাবর কাটছে একাকী। এসব সব কিছু মিলে কেন জানি না বুকের ভেতরটায় একবার এদের সাথে, একবার সেই ফেলে আসা জল-জঙ্গল নদীর দেশটায় চালান হয়ে যাচ্ছে যেন। বড়ো হু হু করছে ভেতরটায় । কারোর  সঙ্গে আমি নেই এখন । আমি শুধু এই বৃষ্টির রাতে একবার এদের মধ্যে  হারাচ্ছি আর একবার হারিয়ে যাচ্ছি ক'দিন আগের ফেলে আসা সেই ঝাপসা গ্রামখানির জগতে  !


           একবার মনে হচ্ছে ভাইটা কী করছে এখন কে জানে! দিদিমা তার সাথে আমার কথা কি বলাবলি করে একবারও ? সে কি আমার মতন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন-জঙ্গল নদীতে?  জানি না তো কিছুই! কেনই বা ও চলে গেল?  আমি এখানে এলাম দেখে? নাকি আমাদের আসার পথের গল্প শুনেই ও অমন আবেগ তাড়িত হয়ে ছুটলো  মামার পেছন পেছন? কোনটা ওকে যে টেনে নিয়ে গেল ওদেশে তা কে জানে ! কোথাও কোনো কিছুই  কারো অপেক্ষায় দিন গোনে না। একদিন সকলেই আমাকেও ভুলে যাবে জানি। হয়তো ভাইকে আবার আপন করে নেবে তাদের জীবন ছন্দের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আমার মতো। 


          ইদানিং মলন মলায় খুব মনোনিবেশ করেছিলাম। সকাল বেলায় বতরের সময় যে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে গোরু চেয়ে নিয়ে এসে ধান মাড়াই করবার জন্যে  সকাল বেলায় হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, সেই ছন্দে আমিও জুড়ে গেছিলাম। সেই গোরুগুলিকে একে একে জুড়ে দিয়ে তারপর ঘুরতে থাকা মলনের খুঁটোয় আমিও ওদের সাথে সাথে ঘুরতাম। মাঝে মাঝে ক্যারাল দিয়ে খুঁচিয়ে দেওয়া খড়গুলিকে । যাতে মাড়ানো ধান নিচে পড়ে যায় , আর যে গুলিতে গোরুর পা পড়েনি বা খড় থেকে ধানগুলি আলাদা হয়নি , তাদেরকে ক্যাড়ালের মাথায় তুলে তুলে উল্টে পাল্টে দেওয়া; সে এক কাজে পেয়ে বসেছিল আমায় কেন জানি না। ধান মাড়াই হয়ে গেলে সেই মাড়ানো ধান থেকে গোরুগুলিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে, খড়গুলিকে  আলাদা একজায়গায় দলা করে রাখাকে  এক অদ্ভুত ভালো লাগায় পরিণত করে ফেলেছিলাম। তারপর শীতকালে সেই পালো দেওয়া খড়ের ভেতর থেকে যে গুমোনো ধোঁয়া  বের হত, তাই দেখে প্রথম প্রথম ভয় পেয়ে গিয়ে দিদিমাকে বলতাম, ও কি গো দিদিভাই! খ্যাড়ে কি আগুন লাগে গ্যালো নায়ি ? তাই শুনে দিদিমা বলতো, না না আগুন লাগতি যাবে ক্যান, ও তো গুমোনো খ্যাড়ের ভেতরে জল পাইয়ে অমন গুমসে উঠিছে , ও কিছু না। আস্তে আস্তে বেলা উঠলি  থামে যাবে নে, ভয়ের কিছু নেই।


              ধান সেদ্ধ করার গন্ধ কী মুগ্ধ করতো ! শীতকালে লাল আলু নিয়ে এসে সেদ্ধ ধানের চাড়ির ভেতরে দিয়ে দিতাম। ধান সেদ্ধ হয়ে গেলে আলুগুলি তুলে নিয়ে এসে পড়ার মাদুরের উপর বসে বসে সেই সুস্বাদু মিষ্টি আলু খেতাম গভীর তৃপ্তি সহকারে, ওখানকার মানুষজনের মতোই। কার্তিক- অঘ্রাণ মাসগুলির সকালবেলাগুলি ছিল এই সেদ্ধ ধানের গন্ধে ম ম করা। সেই সুবাস কোথায় কোথায় যে আমাকে ভাসাতো ,সে কথা এই সদ্য গড়ে ওঠা নিচু অঞ্চলের কলকাতার মানুষজনের জানার কথা নয় মোটেই। এ সব কি এখানে কাউকে বোঝানো যাবে ? হয়তো যাবে এখনো, যারা এই কয়েক বছর আগেও ও দেশ ছেড়ে এসেছে বা ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছে। তাদের স্মৃতিতে হয়তো এখনো কিছুটা ধরে রাখা আছে কারো কারো মাঝে----


          এসে পর্যন্ত রাতের বেশিরভাগ সময়টা এমন সব ভাবনা-চিন্তার ভেতর দিয়েই বারান্দায় বসে বসে কাটে। তারপর কখন যে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, না হলে বারান্দাতেই দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি তার ঠিক থাকে না। তারপর হয়তো ভোর হবার একটু আগে আগে কাজের দিদি বা মা জেগে গেলে তারা এসে যখন ডাক দেয়, তখন হয়তো ঘরে যাই ধরফড়িয়ে উঠে তাড়াতাড়ি। এ ছাড়া সমস্ত দিন  কাটে এ কোনা ও কোনা ঘোরাঘুরি করেই। এ ছাড়া আর যে অফুরন্ত অবকাশ তার খানিকটা নেয় কালো গোরুটি , সেই ঘরের পেছনের বাঁশজঙ্গলের নিচের ডোবাটি। আর আছে কাজের দিদি --- তার সঙ্গে তার বাড়ির কথা, তার নিজের নানা রকমের অভিজ্ঞতার কথা তার মুখ থেকে চুপচাপ শুনে যাই বসে বসে। 


            এই তো, এর মধ্যে একদিন কাজের দিদি একবেলার জন্যে তার বাড়িতে গেল । আবার সন্ধ্যার আগে আগেই যদিও বা ফিরে এল, তবু কি ফাঁকা ফাঁকা নিঃসঙ্গ লাগছিল সমস্ত বাড়িটার ভেতরে! গোরুটিকে সকাল দুপুর বিকেল জাবনা মেখে দিলাম সেদিনই প্রথম টানা একটা দিন। কাজের দিদি যেভাবে দেখিয়ে দিয়ে গেছিল কোনটা কতটা দেব। তার জাবনায় চার বাটি দানাভুসি, গলা পর্যন্ত খাবার টবে খড়-বিচালি, তার সঙ্গে এক বালতি জল , এইসব দিয়ে বেশ করে দু'হাতে মেখে দিয়েছিলাম দিদির মতো করেই। সে নতুন হাতের বেড়ে দেওয়া খাবারে প্রথমে একটু মুখ ঢুকিয়ে দেখে তারপর বেশ মনের আনন্দেই খেয়ে গেল দেখলাম। একটুও এদিক ওদিক করল না। দুপুর বেলায় আমিও ভাতের হাঁড়ি থেকে ভাত , তরিতরকারি নিলাম অন্য পাত্র থেকে, সেদিনই প্রথম নিজের হাতে খাবার বেড়ে খেলাম। কাজের দিদি ফিরে এসে জানতে চাইল ঠিকঠাক সব কিছু নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করেছি কি না। রান্নাবান্না রাখার সেল্ফটা  ভালো করে খুলে দেখেও নিল, সত্যি সত্যি সব কিছু নিয়েছি কি না । যেন তার সন্দেহ ছিল এ বিষয়ে খানিকটা , হয়তো কোনোরকমে খেয়ে -দেয়ে উঠে পড়েছি। 


           রসিক দাদু বলেছিল, এবার তোর বড় জায়গায় যাইয়ে শিক্ষাগুরু খোঁজার দরকার। শিক্ষাগুরু না হলি তুই নিয়ম ডা জানতি পারবিনে ভাইডি, জানবি, এ শিক্ষে তো সে শিক্ষে নয়,  এ যে আর এক শিক্ষে, যা সেই গুরুই এসে দিয়ে দেন শেখায়ে। রসিক দাদুর কথা মতো সেই শিক্ষাগুরু খোঁজা তো দূরে থাক, এখন যে শিক্ষাগুরু হয়েছে এখানে তার ঠেলা সামলানোই তো দেখছি ভার !


              আজ ক'দিন হয়েছে আমাদের বাড়ির সামনে যে ফাঁকা মাঠটা আছে, তার ওপাশের সাহা বাড়ির তিন ছেলে মেয়ের এ বাড়িতে দেখছি আসা যাওয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গত বৃহস্পতিবার থেকে। এর আগেও বৃহস্পতিবারগুলোতে ওরা  নাকি আসে। সে দিনগুলিতে যদি মায়ের অফিস যাওয়ার বিশেষ তাড়া থাকে তাহলে শিবানী নামের মেয়েটি এসে মায়ের ঠাকুর দেবতার সিংহাসনের সামনে বসে ঠাকুরের পুজো দিয়ে যায়। ইদানিং দেখছি বাকি দিনগুলিতেও ও অথবা ওর ছোটো বোন দু'জনের কেউ একজন দু'বেলা এসে পুজো দিয়ে যায় ঠাকুরের। দিদিমার সেই রাধা কৃষ্ণকে জামা কাপড় পাল্টিয়ে দেয় বেশ যত্ন সহকারে। বেশ নিষ্ঠা আছে এ কাজে বোঝা যায়। মা'র গুরুদেবের ছবিতেও জামা পরায়। আমি এই সবই অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখি। মনে মনে বেশ আশ্চর্য হই গুরুদেবের ছবিতে কীভাবে জামা পরায় সেটা দেখে। পটের গায়ে জামা পরানোর কায়দাটা বেশ হতবাক করে দেয় আমায়। মনে মনে ভাবি, এইভাবে মাও সেদিন পরিয়ে ছিলো তাহলে! 


          পুজোপাট শেষ হলে ওরা দুই বোনই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে চায়। আমিও তাদের সঙ্গে বেশ মিশছি দেখতে পাচ্ছি। ওদের বাড়ির ছোটো ছেলে অলোক, ওদের দু'জনের থেকেই বড়ো , সেও ভীষণ আন্তরিক। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরার কথাও বলে মাঝে মাঝে। একদিন ওদের সকলের অনুরোধে ওদের বাড়িতে গেছিলাম। কী বড়ো বড়ো প্রশস্ত ঘর দুয়োর ওদের ! অলোকেরই তো নিজস্ব একটি ঘর আছে। তাতে বড়ো একটি একোরিয়াম । তার ভেতর কত রঙবেরঙের মাছ !  জলের ভেতরে ঘোরাঘুরি করে। একরিয়াম জিনিসটি যে এরকম তা এর আগে তো কখনো দেখিনি! যেন কাঁচের একটি ঘর । তার মধ্যে কী নেই! যে পাতিশ্যাওলাদের  গায়ে মেখে দোয়াড় পেতেছি, তারাও দেখি মাছের এই ঘরের মধ্যে অতি যত্নে জায়গা করে নিয়েছে! কাঁটা-শ্যাওলাও আছে দু'একটা, আর আছে একটি যন্ত্র যাতে বুড়বুড়ি কাটছে নাকি জল। আচ্ছা, যন্ত্রটা কি ওই ব্যাঙটার মুখের ভেতরে বসানো?  নাকি একরিয়ামের বাইরে? 


         জিজ্ঞাসা করবো ভাবলাম কয়েকবার কিন্তু কি এক সংকোচ বোধে বারবারই পিছিয়ে এসেছে মনটা। এ মা, অলোক যদি বলে, কী হাঁদারে বাবা, এটাও জানিস না! তাই কিছু আর না বলে শুধু দেখতে থাকলাম, ব্যাঙটি যেই হাঁ করছে আর অমনি বুড়বুড়ি বের হচ্ছে তার মুখের ভেতর থেকে। এই অতি আশ্চর্য  বিষয়টি চেয়ে চেয়ে দেখছি আর অবাক হচ্ছি। শাদা শাদা পাথর দিয়ে কী সুন্দর সাজানো কাঁচের বাক্সটার ভেতরে জলের নিচে ! মাছগুলি চলাচল করছে যে জায়গাটায় তার মধ্যে কী নেই! পাহাড়, গুহা, বাড়ি-ঘর ছোটো ছোটো সবই আছে। অলোক জানালো ওগুলি সবই চিনেমাটির। কিনতে পাওয়া যায় বাজারে। 


            সে গানও শোনালো , বড়ো একটি বাক্সের মধ্যে থেকে আওয়াজ আসছে দেখি, জানতে পারলাম ওটার নাম নাকি  চেঞ্জার। বড়ো বড়ো  থালার  মতোন চাকতিগুলির ওপরে কী একটা ঘাড় ঘোরানো মতো,  একটা ডান্ডির মতোন দেখতে সেটা এসে বসে যাচ্ছে নিজে নিজেই , আর গান হচ্ছে। ঠিক যেমনটি দেখেছি মাইকওয়ালাদের কাছে, এ যেন তারই একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ  মাত্র, আর কিছু না!


           তবুও খানিকটা বিস্ময় যেন থেকে গেল। বেশ  একটা আলাদা অনুভব। শিবানী ও মলি দুই বোন ভীষণ আন্তরিক ভাবে ওদের বাড়িটার সমস্ত  ঘরগলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিল। কোন্ ঘরে ওদের বড়দা-ছোটদারা, আরো অন্যান্য যারা রয়েছে তারা কে কোথায় থাকে। 


         আমার বারবার মনে হতে লাগলো, আচ্ছা, ওরা যে আমাকে এত ঘটা করে সব ঘর -দুয়োর, ওদের বাড়ির নানা আধুনিক  সরঞ্জামগুলি একে একে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে এর কারণ কী? আমি তো ওই একখানা টালির ঘরের  ছেলে! এসবের আমি কিই বা বুঝি এত! 


            কিন্তু না, সেরকম কোনো ধরণের অহংকার বোধ বা নিজেদের আভিজাত্য দেখানো মনোভাবের কোনো ইঙ্গিত তো পেলাম না ওদের ব্যবহারের মধ্যে! তাই বেশ ভালো লাগলো ওদের এই আন্তরিকতাটুকু ! এবং একটা বিষয় তো আরো অদ্ভুৎ, এই দুটি মেয়ে দু'টি পালা করে করে নিপুনভাবে মার ঠাকুর দেবতার সিংহাসন  যত্ন সহকারে সাজিয়ে দেয়, ফলফলাদি, নকুলদানা, মিছরি কত কি দিয়ে। তাছাড়াও মাঝে মাঝে উনুনে কাজের দিদির সঙ্গে এটা ওটা রান্নাবান্নাও করে দেয়। মাঝে মধ্যে আমাকে ভাতও বেড়ে দেয়। ওদের পেয়ে ভীষণ অবাক হচ্ছি এই ভেবে, মানুষের সম্পর্কগুলো কী অদ্ভুত তাই না! 


            আজ ক'দিন এসেছি, এর মধ্যে মাঝে মধ্যেই মা'কে দেখেছি অফিস যাবার আগে তাড়া থাকলে ওদেরকেই মাঠ আড়াআড়ি চিৎকার করে ডাকতে, ' এই মলি, এই শিবানী, মা রে আজ আর পারলাম না রে মা, তোরা একটু এসে ঠাকুরদের  সামলে দিস রে মা, আর সব দেখিস, যা লাগে লাগাস মা একটু বুঝেসুজে…… '।


           ওরা ওদের দু'জনের কেউ না কেউ সেই হাঁক - ডাকে চলে আসে, তারপর সব দায় দায়িত্ব সামলায় একেবারে নিজের মতোন। আমি যত দেখি ততই বিস্ময়ে হতবাক হই ! এবং এই ক'দিনে আস্তে আস্তে আমি ওদের সঙ্গে বেশ মিশে গেছি যে তাও দেখতে পাচ্ছি। এবং কাজ-কর্ম শেষে কাজের দিদির সঙ্গে লুডো খেলতেও বসে যায় দেখি। 


            সেই আমার প্রথম এদেশে এসে নিকট জনের সংস্পর্শ পাওয়া যেন…..!


( আগামী পর্বে )

মুক্তগদ্য * অলোক কোরা

 


“যতো ধর্ম্মস্ততো জয়ঃ”

অলোক কোরা


“Religion is realization; not talk, nor doctrine, nor theories however beautiful they may be. It is being and becoming, not hearing, or acknowledging; it is the whole soul becoming what it believes.” Swami Vivekananda

     সারা পৃথিবীতে প্রায় দশ হাজারের মতো স্বতন্ত্র্য ধর্ম রয়েছে। প্রতিটি মানুষ কোন না কোন ধরনের সঙ্গে যুক্ত। যা মানুষের আচরণকে ও অনুশীলনকে পরিবর্তিত করে। আমার লেখনীতে সেই ধর্মের প্রতি আলোকপাত করা হয়নি। সেই ধর্মকে বিশ্লেষিত করার প্রয়াস করছি, যার দ্বারায় মানুষের মানবতার আভ্যন্তরীণ চৈতন্য প্রস্ফুটিত হয়েছে। 

     নিজের ঢাক না পিটিয়ে অবলীলায় বলতে পারি স্মৃতির ধারণ ক্ষমতাটা একটু শক্তপক্ত- শৈশব থেকেই। যেটা শুনতাম যেটা পড়তাম ভেতরেই থাকতো, প্রয়োজন মেটাত। ঠাকুর দেবতাদের প্রতি বিশ্বাস, ভালো লাগা, ভালোবাসা সবই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। কখনো নিয়ম থেকে ছিটকে পড়িনি। অনেক সময় আবেগতাড়িত হয়ে উদ্বেল হয়েছি ঠিকই কিন্তু বিপথে যাইনি। ভালো মন্দের তফাতটা খুব বুঝতাম। কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় অনুধাবন করতে পেরে ছিলাম সেই শিশু বয়েসেই। প্রাইমারীতে কখনো কোন শ্রেণীতে দ্বিতীয় হইনি, এটা আমার অহংকার নয়- আমি চাইতাম না কেউ আমার এই স্থান নিয়ে নিক। মাস্টারমশাই থেকে শুরু করে সবাই আমাকে খুব ভালোবাসতেন ও ভালোবাসতো।

     সব দিক থেকে আমার স্থান ছিল অনেক উর্দ্ধে। একদিন আমার প্রিয় মাস্টারমশাই দাদাদের ক্লাস নিচ্ছেন, আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। উনাকে বিচলিত করার জন্য স্কুলের ব্যাগ থেকে খেলনা পিস্তলটা বের করে বিকট এক শব্দে উনাকে চমকিত করে দিলাম দৌড়। দূরে দাঁড়িয়ে একটা আম গাছের আড়াল থেকে উনার আচরণ দেখতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে সব শান্ত হয়ে গেল। আর দশটা স্কুল ছাত্রের মতো বাড়িতে চলে এলাম। বাড়ি ফিরে সব কিছু ভুলেই গেছি। একটা ভালো গুন ছিল, এখনও আছে- স্কুল কখনো বন্ধ করতাম না। যাই হয়ে যাক স্কুল আমি যাবই। গেলাম স্কুলে। ক্লাস হল বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করলাম, টিফিনে খেলাধুলাও হল কিন্তু আমার প্রিয় মাস্টারমশাই আমার সঙ্গে কথা বললেন না। শুধু আর পাঁচটা ছেলেকে প্রশ্ন করার মতো আমাকেও প্রশ্ন করলেন আমি উত্তরও দিলাম। ছোট ছিলাম কিছু না বুঝলেও কি হবে আমাকে কে ভালবাসে আর কে বাসে না তা বুঝতে পারতাম। দু-তিন দিন এভাবে কাটল। স্কুলে কষ্ট হতো আবার বাড়িতে চলে এলে ভুলে যেতাম। এভাবেই দিনটা সপ্তাহের শেষে এসে দাঁড়ালো। শনিবার স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হবে এটাই একটা বাড়তি আনন্দ। প্রথম ক্লাসটা আমার প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের। কিন্তু দেখতে পেলাম না, পরিবর্তে অন্যজন। স্বাভাবিক কারণে মনটা একটু খারাপ হল। একটু পরেই তো ছুটি- তার পর সোজা বাড়ি। কিন্তু মনটা কেমন কেমন করছে। কি করছে বুঝতে পারছি না। এই সব হাবিজাবি ভাবছি। সময় শেষ হল ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠল, কিন্তু অন্যদিনের থেকে কেমন যেন বিকট শব্দে। বইপত্র গুছিয়ে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে মাথানিছু করে আসছি, এমন সময় উনাকে দেখতে পেলাম। একটা শিহরণ খেলে গেল সারা শরীর জুড়ে। অযাচিতভাবে, অবলীলায় দৌড়ে গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। উনি কোলে তুলে নিলেন। চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন “বোকা ছেলে”। তৎক্ষণাৎ আমি আমার দুটি কান ধরে বললাম আর কখনো এই কাজ করবনা। সেই থেকে যাত্রা শুরু। সে দিনের সেই স্নেহের হাতটা বোধ হয় সঠিক ধর্মের শিক্ষা দিয়ে ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম যেখানে অপরাধ শিকার করার জায়গা আছে সেখানেই উত্তরণের পথ রয়েছে। জয়ের বার্তা রয়েছে সেখানে। নতুন এক শিক্ষা পেলাম জীবনে। পরে বুঝলাম। অতীতের এই ভুল থেকে লাভ করলাম- যেখানে ধর্ম সেখানেই জয়। সেই জয়লাভ কখনো বাহ্যিক কখনো আপেক্ষিক। বিন্দুমাত্র কার্পণ্যতা থাকে না সেই মহতী সাধনায়। আমার মধ্য দিয়ে সেই জয়ের ধ্বনি যদি সূচিত হয়, তখন ফেলে আসা অতীতের শিক্ষাকে কুর্নিস করি বারে বারে।

     স্রষ্টার সৃষ্টি বড়ই সুন্দর ও পবিত্র। সেই পবিত্রতা ও সুন্দরতাকে রক্ষণ করার এক মহান পূজকের বড়ই প্রয়োজন। যুগে যুগে হয়ত সেই পূজকের হাত ধরেই ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সুদূর অতীতের কথা বেশি বলা আমাদের সম্ভব নয়। ইতিহাসের পাতাতে আঙ্গুল চেপে বসলেই ধর্মের সরূপ কি তা নজরে আসে। সারা বিশ্ব জুড়ে সময়ের পট পরিবর্তনের হাত ধরে একাধিক সভ্যতা ধরিত্রীর বুকে অবস্থান করেছে, আবার সেই সভ্যতাও ধর্ম-অধর্মের বেড়াজালে সঠিক সত্যের সন্ধান দিয়েছে। সত্যই ধর্ম আর ধর্মই সত্য। 

     রামায়ণ ও মহাভারত আমাদের গর্ব, অহংকারও। রামায়ণের কাহিনীর মধ্যে ধর্মের এক নতুন মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। ভগবান রামের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু রাবণের মধ্যেও যে ধর্মের সরূপ আছে আমরা তাকে কখনো দেখিনি। ভগবান শিবের ভক্ত রাবণ। দশ মাথার অধিকারী। তাই তিনি দশানন। একাই দশ জন মানুষের বুদ্ধি নিজের মাথায় ধারণ করতে পারতেন, তাই দিয়ে তিনি বাস্তবিক পরিবেশ পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতেন। তিনিও অধর্মের পথে থেকে ধর্মকে জয়ী হতে সাহস যুগিয়েছে। মুদ্রার এক পিঠ বিচার করতে হলে মুদ্রার উভয় দিকে দৃষ্টি অবলোকন করাটাও আবশ্যক। তাতে বিশ্বাসটা আরো দৃঢ় হয়। 

     মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনী আমাদের অজানা নয়। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে কৌরব-পান্ডপের ভয়ংকর মহাসংগ্রামের কথা আমারা কখনোই বিস্মিত হইনা। ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে যার কথা আমাদের প্রথমে স্মরনে আসে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যুগে যুগে যখনই অধর্ম আসবে তাকে লয় করতে তিনি অবতার রুপে প্রতীয়মান হবেন। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে ধর্ম। 

                “ যদা যদাহিধর্মস্যঃ গ্লানির্ভবতি ভারত।

                  অভ্যুত্থানমধর্মস্যঃ তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌।।

                 পরিত্রাণায় চ সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্‌।

                  ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। ”

     এই ধর্মের বাণী কেবল মহাভহারতের চরিত্রকে পরিবর্তন করেছে তা কিন্তু নয়। সংসারকে এক কঠিন পথে এনে দাঁড় করিয়েছে। মাতা গান্ধারীও সেই পথ থেকে কখনোই সরতে পারেননি। যুদ্ধের পরিণতি কি হতে পারে সে কথা জেনেও তিনি কখনোই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি। নীতি বাক্য দিয়ে তিনি পুত্র দুর্যোধনের মন পরিবর্তনের পাশাপাশি সত্যের সন্ধান দিয়ে গেছেন। “যুদ্ধ আরম্ভ হইলে দুর্যোধন প্রত্যহই সময়ে সময়ে জননীর নিকট গিয়া স্বপক্ষের জয় কামনা করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে অনুরোধ করেন, কিন্তু প্রতিবারই গান্ধারী কেবলমাত্র এই কথাই বলেন, যতো ধর্ম্মস্ততো জয়ঃ, ধর্ম যেখানে জয় সেখানে”।

     সংসার হল মায়া। প্রতিনিয়ত আমরা সেই জালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি। সুখ ভোগের আর এক নাম বিলাসিতা। মানুষ ভেদে এর পরিবর্তন হতেই পারে। আত্মসুখের বাসনা আমাদেরকে ক্রমশ বিলাসিতায় আছন্ন করে রাখে। যারা এর থেকে মুক্ত হতে পারে তারা বিশ্বের সকলের কল্যাণের বাসনায় সাধনা করে। সকল জীবের কল্যাণ তখন তাঁর কাছে প্রধান বলে প্রতীয়মান হয়। ধর্মও সেখানে জয় লাভ করে। সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে সিদ্ধার্থ জগতের মুক্তির পথ খুঁজতে বের হবেন, সন্ন্যাস তাঁর ব্রত। শুদ্ধোদনের মাথায় যেন বজ্রাঘাত এসে পড়ল। পুত্রকে অনুরোধ করলেন এ ধরণের সংকল্প ত্যাগ করতে। সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগ না করার প্রতিশ্রুতি সরূপ চারটি বর চাইলেন পিতার কাছে- প্রথমতঃ জরা যেন তার যৌবন নাশ না করে। দ্বিতীয়তঃ ব্যাধি যেন তার স্বাস্থ্য ভগ্ন না করে। তৃতীয়তঃ মৃত্যু যেন তার জীবন হরণ না করে। চতুর্থতঃ বিপত্তি যেন তার সম্পদ অপহরণ না করে। 

     কোন বাধাই সিদ্ধার্থ এর পথে বাধা দান করতে পারল না। জয়ী হল সিদ্ধার্থ। জয়ী হল ধর্ম। সংসার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিনি নতুন এক ধর্ম সৃষ্টির সন্ধানে চললেন। সেখানেও তার অবিচল নিষ্ঠা।

                          ইহাসনে শুষ্যতু মে শরিরং

                          ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ংঞ্চ যাতু।

                          অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং

                          নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।।

     দেহ শুকিয়ে যাক, কিংবা অস্থি ভঙ্গুর হয়ে গিয়ে মৃত্যু এসে শরীর নিয়ে যাক, কঠোর নিষ্ঠাই তাকে সমস্ত প্রকার কলুষতা ও প্রলোভন থেকে বিরত রেখেছে। জয়ী হয়েছেন তিনি। সমস্ত বিভেদের ঊর্দ্ধে উঠে তিনি ধর্মকে আপন করতে পেরেছেন। মানুষ তার আচরণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দশের মন পাওয়ার চেষ্টা করে, সফলতা যে তাকে খুব কাছে টানতে পারে তা কিন্তু নয়। যে মানুষটি সফলতাকে উপলব্ধি করতে গিয়ে ত্যাগ ও সাধনাকে অবলম্বন করে ধর্মের কাছে সে চিরঞ্জীবী হয়ে ওঠে।

     চিকাগো ধর্ম সভাতে গিয়ে আর দশ জনের মতো অন্তরের স্বাভাবিক মননের চেতনাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে ছিলেন স্বামীজি। সে ভাষা স্বাভাবিক ছিল, ছিল সবাইকে আপন করে নেওয়ার বাসনা। তাই তিনি জয়ী হয়েছেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভাষাতে আড়ষ্টতা নেই, নেই গাম্ভীর্য। ছিল কেবল স্পষ্টতা। ছিল সরলতা, অন্তরকে কম্পিত করে বাস্তবিক করে তোলার তীব্র বেদনা। অধিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে লেখার ব্যাপ্তি না ঘটিয়ে, কেবলমাত্র এই ধারণা দেবার চেষ্টা করলাম যে, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে কেউ নেই। সেই মানব ধর্মের একটু ব্যাখ্যা করলাম, যার মধ্য দিয়ে অন্তরাত্মাকে বিশ্বজনীন করা যায়।



অলোক কোরা

জন্ম ৮ মে , ১৯৮৭  পাথরপ্রতিমা,দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে লিখছেন । 
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের  তরুণ গবেষক এবং প্রতিশ্রুতিমান লেখক অলোক । ইতিহাসের পাতায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ।