মঙ্গলবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১

গল্প * চিন্ময় ঘোষ


 


মগ্নমমি 

চিন্ময় ঘোষ


প্রথমদিন কলেজে গিয়েই চৈতন্যের চোখে  পড়ল প্রিন্সিপালের ঘরের সামনে জটলা আর  শ্লোগান। কিছু বুঝে উঠবার আগেই কেউ একজন তার হাত ধরে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলল -  আমি মারুত। তোমার সঙ্গেই এক ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। 


        হাত মিলিয়ে চৈতন্য বলল -  ওয়েলকাম! আমি চৈতন্য। নতুন বন্ধু পেয়ে গেলাম তোমাকে। কিন্তু ভাই প্রিন্সিপালের রুমের সামনে ওইরকম বিক্ষোভ কেন? 


   - আরে ছাড়ো ওসব, বিরক্তমুখে মারুত বলল, এটা গভর্নমেন্ট কলেজ। লোকাল বা অন্য জেলার যে কেউ এখানে এসে অ‍্যাডমিশন নিতে পারে। তুমি ওসব নিয়ে ভেবোনাতো। মারুতের এই কথায় ইঙ্গিতটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল এবং চৈতন্য মনে মনে একটু ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল, নতুন শহরে নতুন কলেজে কিরকম অভ‍্যর্থনা অপেক্ষা করছে তার জন্যে কে জানে। ওর চোখমুখ দেখে মারুত অভয় দেওয়ার চেষ্টা করল - একদম চিন্তা কোরোনা চৈতন্য। আমাদের প্রিন্সিপালস‍্যার কিন্তু খুব ভাল মানুষ। তোমার কোন ভয় নেই। 


     মারুতের কথা যে মিথ্যে নয় তা চৈতন্য প্রিন্সিপালস‍্যারের সঙ্গে দেখা করেই বুঝতে পেরেছিল। নিচু হয়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই উনি চৈতন্যের পিঠে হাত রেখে  আশ্বস্ত করলেন - কোন ভয় নেই তোমার, আমি আছি তো। নিশ্চিন্তে মন দিয়ে ক্লাস করে যাও।

                                 

      তারপর একদিন সব সংশয় দূর হয়ে কলেজ লাইফ বেশ  আনন্দের হয়ে উঠল চৈতন্যের। সহপাঠীরা ছাড়াও অন‍্যান‍্য ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র জুনিয়র আরও অনেক ছেলেমেয়ে তার বন্ধু হয়ে গেল। ছাত্র খারাপ নয় সে, শিগগিরই অধ্যাপক মহলেও  অনেক স‍্যরের কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল চৈতন্য। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা সোশ‍্যাল ফাংশনগুলোতে যথেষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার ভূমিকা। 

                               

      কলেজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় যতক্ষণ না বাসগুলো আসে প্রতিদিনই ছেলেমেয়েদের কলকলানোতে বাসস্ট‍্যান্ড বেশ জমে ওঠে। এক একটা বাস আসে আর দু'চারজন করে  উঠে চলে যায়। চৈতন্য আর মারুত দুজনের রুট একই। বেশিরভাগ দিন ওদের ফেরার বাস বেশ খানিকটা পরে আসে। ক্লাসের পরেও অনেকটা সময়  একসঙ্গে থাকতে থাকতে দুজনের বন্ধুত্ব ক্রমশ গাঢ় হয়ে  উঠেছিল। সেদিনও শেষ পর্যন্ত ওরা দুজনেই বাসের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। গল্পের মাঝখানে মারুত হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে চৈতন্যকে - সত‍্যি কথা বলবি, তোর হার্টথ্রব কে? 


       চৈতন্য কেমন হকচকিয়ে গেল। এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে এমন ভাবনা তার মাথায়  ছিলনা। তবে কি মারুত প্রত‍্যুষার ব‍্যাপারে কিছু বলতে চায়! চৈতন‍্যের মনে সংশয় জাগে। প্রত‍্যুষার সঙ্গে ক্লাসের বাইরেও তার  মেলামেশাটা একটু বেশিই। দু'জনে অনেক সময় একান্তে সময়ও কাটায়, ব‍্যস ওই পর্যন্তই। আহামরি সুন্দরী কিছু নয় মেয়েটি কিন্তু ওর ব‍্যক্তিত্বের মধ‍্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করে চৈতন্য। চলায় বলায় পোশাক আর স্বভাবে  খুবই  রুচিশীল প্রত‍্যুষা। কথাবার্তায় সহজ স্বচ্ছন্দ, যে কোন বিষয়ে স্পষ্ট অভিমত ব‍্যক্ত করে। প্রয়োজনে তীক্ষ্ণ মেজাজীও। প্রত‍্যুষার সঙ্গ চৈতন‍্যের ভিতরে একটা ভাল লাগার আবেশ আনে। কখনো কখনো তার বুকের মধ্যে কেমন এক শিহরণ জাগায়, ভিতরটায় রিন রিন করে নূপুর বেজে ওঠে যেন। মারুত কি কোনো সময় তা টের পেয়েছে! এই ভেবে চৈতন্য মনে মনে অস্বস্তিতে পড়ে গেল, তাই সে থম মেরে গেল। অবস্থাটা লক্ষ্য করে মারুত আবার খোঁচালো - বলনা সত‍্যি করে, এমন কি কেউ নেই যে তোর ভিতরটায় ঘাই মারে? থতমত খেয়ে চৈতন্য বলে -  নাহ্.. মানে সেভাবে তো... তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মারুত বলে উঠল - কি রে লজ্জাপাচ্ছিস কেন? এই দ‍্যাখ, এখন আমি  আর তুই, কাছাকাছি আর কেউ নেই। বলেই ফেলনা! 


          আর ঠিক তখনই অসাবধানে ধনুকের জ‍্যা ছেঁড়ার মত করে চৈতন্যর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে -  প্রত‍্যুষা...তার মুখের কথা  কেড়ে নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মারুত বলে উঠল - অ‍্যাঁ, বলিস কি! সেতো আমারও! 


        এরপর পরিস্থিতি কেমন যেন থম মেরে গেল। দুই বন্ধুর কারো মুখে কোনো কথা নেই। নিঃস্তব্ধ পরিবেশে শুধু গাছের ডালে বসে থাকা দু'একটা পাখির ডাকের শব্দ আর অদূরে চায়ের দোকানে অল্পকিছু মানুষের অস্পষ্ট বাক‍্যালাপের আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ড পর দুজনেই হঠাৎ একসঙ্গে হেসে উঠল - ওহ্ হো হো হো হো....সেই হাসি বেওকুফের মত হাসি না আনন্দের বা উচ্ছ্বাসের, নাকি ভেতর থেকে মুচরে মুচরে উঠে আসা অব‍্যক্ত যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি - কে জানে। ফাঁকা বাসস্ট‍্যান্ডের হাওয়ায় মিশে ' প্রত‍্যুষা আ আ আ.'..নামের প্রতিধ্বনি তুলে একটা শব্দ ঘুরপাক খেতে খেতে সোজা উপরদিকে উঠে গেল আর তা আকাশের বুকে ঘুরে বেড়ানো হাল্কা সাদা মেঘেদের দলে গিয়ে যেন মিলেমিশে কোথায় মিলিয়ে গেল। 

                               

          কিছুক্ষণ পর মারুতই প্রথম মুখ খুলে বলেছিল - আয় চৈতন‍্য, এই মুহূর্তে আমরা প্রতিজ্ঞা করি এই কথা তুই আর আমি ছাড়া কেউ কখনো জানবেনা। আর এখন বা ভবিষ্যতে আমরা  দুজনের কেউই প্রত‍্যুষাকে কোনদিন প্রপোজ করবনা, ঠিক আছে?

                                

     চৈতন্য সেই  প্রতিজ্ঞা স্বীকার করেছিল ঠিকই। কিন্তু তার  বুকটা ভেঙে খান খান হয়ে গেছিল। মনের মধ্যে উদ্দাম উথল-পাথল ঢেউয়ের আঘাতে তার বুকের বাঁদিকটায় গভীর গোপনে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছিল। কিন্তু যথাসম্ভব স্বাভাবিক আচরণে কখনো তা সে বুঝতে দেয়নি কাউকে। দুই বন্ধুর শপথের খেলাপও সে কখনো করতে পারেনি। মারুত কি সে কথা রেখেছে? আর প্রত‍্যুষা? আজও  কখনো সখনো তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় চৈতন‍্যের। শুধুমাত্র চেহারায় বয়সের ছাপ লাগা ছাড়া  প্রত‍্যুষার জীবনে আর কোনো পরিবর্তন দেখতে পায়না চৈতন্য। তবে কি...

                                 

          চৈতন্যর জানতে ইচ্ছা করে রহস‍্যটা কি। কেনই বা প্রত‍্যুষা আজও একা। ভাইয়ের সংসারের  যাবতীয় দায়িত্ব  কাঁধে তুলে নিয়ে নিজের জীবনের পথটা সে একাএকাই কেন হেঁটে চলেছে তার ঋজুতা নিয়ে। ঋজু, দৃঢ় এক শাল্মলী যেন।


                             **********************************



চিন্ময় ঘোষ

দুর্গাপুর ইস্পাতের প্রাক্তন আধিকারিক হিসাবে অবসরপ্রাপ্ত। সাহিত্যচর্চা ও সাহিত‍্যআড্ডা প্রিয়। প্রধানত কবিতা লিখে থাকেন । প্রবন্ধ, মুক্তগদ‍্য, গল্প ইত‍্যাদি অল্পসল্প লেখার চেষ্টা করেন । বিভিন্ন মুদ্রিত পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লেখেন । যুব বয়সে পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করেছেন। কোন ছাপানো বই নেই।


৩টি মন্তব্য:

  1. প্রত্যুষা তো আমাদের অচেনা নয়। শুধু প্রত্যুষারা হারিয়ে যাচ্ছে,হয়তো চৈতন্য আর মারুতরা অবলুপ্ত সেটাই তার কারণ। ভাল গল্প। সুন্দর।

    উত্তরমুছুন
  2. চরিত্রগুলি আমাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করে।গল্পের মাঝখানে আর একটু বিস্তার দাবি করে।

    উত্তরমুছুন
  3. জীবন থেকে নেওয়া। মন বলে উঠে লেখক এর গল্পের চরিত্রগুলোকে যেন আমিও চিনি। হয়তো কখনো দেখেছি কোথাও। কলেজ জীবনের বন্ধুত্ব তো এমনিই। একজন আরেক বন্ধুর জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করতে পারে। অন্তত একটা সময়ে এরকমই ছিল। হয়তো এখনকার জটিল জীবনে এই চিত্রটা পাল্টে গেছে অনেকখানি। তাই সহনশীলতার পরিবর্তে শত্রুতা বড় হয়ে ওঠে। সে রকম ছবিতে বড় একটা কম দেখা যায় না। সে দিক থেকে গল্পটা একটা দৃষ্টান্ত এর মত। তবে চৈতন্য ও মারুতের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আরো একটু বিস্তারিত হওয়ারকথা ছিল। অন্তত পাঠকের স্বার্থে। একটি সুন্দর গল্প পড়লাম। অভিনন্দন চিনময়।


    উত্তরমুছুন