'স্বরবর্ণে'র বিগত সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ব, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ২
দীপংকর রায়
এই কথাগুলি শুনতে যে রকম, কিন্তু সেই পথটুকু পেরিয়ে আসতে ঠিক কী যে হয়েছিল, সে কথার যেন ঠিক ঠিক বর্ণনা দেওয়া যায় না কখনোই। বারবার কেন যে ভাবছিলাম, আচ্ছা কথাবার্তা শুনে কাইলে মামাকে যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তাহলে কী দাঁড়াবে পরিস্থিতিটা ?আমাকে যদিও বা কলকাতার ছেলে বলে চালিয়ে দেবে বলেছিল কাইলে মামার মামা শ্বশুর, কিন্তু কথায়- বার্তায় বিষয়টা কি খুব একটা ধোপে টিকবে? কথা বললেই তো ধরা পড়ে যাবো আমিও। আমাকে কি আর এদেশের নাগরিক বলে চালানো যাবে? আমার কথাবার্তা, চাল-চলন, জানা-শোনা সবই তো এই দেশ থেকে কবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সব দিক দিয়ে! তাহলে আমি আর কীভাবেই বা এদেশের মানুষ বলে বিশ্বাস করাতে পারবো পুলিশ তো ছাড়ো, সাধারণ মানুষকেও?
তাই ভাবনার এই গোটা পরিস্থিতিটা সামলে ভাই এবং মামাকে তো ওই পথটুকু পার করতে হয়েছে এতদিনে? সেটা যে কী দুঃসহ আতঙ্কের, তা শুধু আমিই জানি। সে কথা মা বুঝতে পারছে না সেভাবে। এ কথা খুব ভালো করেই জানি। তাই পরদিন যখন মা আমার কথা শুনে দমদমে যেতে রাজি হলো , তখন আর একমুহূর্তও দেরি করলাম না ।
সেখানে যখন পৌঁছলাম তখন জানতে পারলাম আমার ধারণাই সঠিক। কাইলে মামা যাবার দিন এখানে একদিন থেকে সমস্ত রকম বর্ডারের খোঁজখবর নিয়ে তবেই রওনা হয়েছিল ভাইকে নিয়ে । এরাও ভাইকে বুঝিয়েছিল , এইরকম একটা সময়ে তার ওদেশে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সে নাছোড়। কারো কথাই শোনেনি। শেষ পর্যন্ত মামা হয়তো ভেবেছিল, যাকগে, একা একা যাবার চাইতে এই সময়ে দু'জন হলে মনে আলাদা একটা ভরসাও পাওয়া যাবে। বেশ, বেলা গড়িয়ে ফিরে আসা হলো দমদম থেকে। খানিকটা আশ্বস্ত হওয়া গেল অন্তত এই ভেবে, তাহলে সত্যি সত্যিই সে মামার সঙ্গে ওদেশেই রওনা হয়েছে।
দু'দিন নানা কথা ভেবে ভেবেই সময় কেটেছে। একটুও স্বস্তি পাইনি। কীভাবে যে এই ক'টা দিন চলে গেছে , তা যেন নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি। একেকবার এও ভেবেছি, এই বুঝি ওরা না যেতে পেরেই ফিরে এল ! এবার ভাবনা পরিবর্তিত হয়ে আরো অন্য কথায় ভাবিত করে তুলতে লাগলো------ ওকি ওদেশে থাকতে পারবে? শেষে কিছুদিন গেলে আবার না হুটোপাটি শুরু করে দেয় ফিরে আসার জন্য! আবার ভাবছি একথা তো ঠিক, আমি চলে আসাতে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে দিদিমার মনে, সেই শূন্যস্থানটিও তার যাওয়াতে হয়তো পূরণ হয়েছে। তাই আলাদা একটা খাতির যত্নও পাবে হয়তো সকলের কাছ থেকেই । কিন্তু ও কি থাকতে পারবে? পড়াশোনার ক্ষতি করে এইভাবে বছরের মাঝখানে চলে গেল ও! এ বছরটাই তো মার যাবে। এতে যে কত বড় ক্ষতি হলো এ কথা কি একবারও ভেবে দেখেছে? মাও যেন সেসব একবারের জন্যেও ভাবছে না। হয়তো সে এ কথাই ভাবছে ,যেভাবে বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছিল, তাতে ক'দিন একটু ঘুরে এলে হয়তো এই বেলাগাম অবস্থাটা পাল্টালেও পাল্টাতে পারে।
মা অফিস ফেরতের সময় একরকম প্রতিদিনই দিদির বাড়িতে অনেকটা সময় কাটিয়ে আসে। একেকদিন তো বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে। আচ্ছা, আমি আসার আগেও কি এরকমই করতো সে ? তাহলে তার এইসব ঠাকুর-দেবতা, গোরু, সংসার, রান্নাবান্না সবই কি কাজের মানুষজনের উপরেই নির্ভর করে?
এ বিষয়ে কালো দিদি জানিয়েছে, না, তা সবটা ঠিক না। ছোটো ভাই ওদেশে চলে যাবার পরেই এরকম করছে মা । ইতিমধ্যে মা হয়তো খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে গেছে তোমার এখানে চলে আসাতে। ভাবছে, বড় ছেলে এসে গেছে তো, ও তো খানিকটা বুঝেও গেছে এই ক'দিনে। এখন আর একা একা থাকতে হয় না আমাকে। কথা বলার একজন মানুষ আছে বাড়িতে। তাই হয়তো নাতির সঙ্গে খানিকটা সময় কাটায়। কাইলে মামা যে দু'দিন ছিল সে দু'দিনও এতটা রাত তো করতো না মা! তাই তার এই দেরি করে ফেরা নিয়ে আমিও অভিযোগ না করে পারলাম না। বলেছিও ,আচ্ছা মা, দিদি কি তার সংসার- ধর্ম ফেলায়ে এ বাড়িতি আইসে থাকে নায়ি, তাই কও তো দেহি আমারে?
তাতে তার উত্তরটাও জানতে পেরেছিলাম, ওর ছেলেটির বয়স তো সবে দেড়দুই বছর, এই সময় ও ছোটো ছেলেপুলেদের পরিচর্যা সম্মন্ধে কতটুকু জানে! তাই ওখানে না গেলে কি চলে তাই ক? এ দায়িত্ব কি এড়িয়ে যেতে পারি আমি তাই বল তুই-ই একবার?
বুঝলাম, মা হয়তো নিজেও জানে তার এই সংসারের প্রতি কিছুটা ত্রুটির কথা। আর সেই জন্যেই হয়তো সে আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্যে ওইভাবে চিঠি লিখেছিল তার মায়ের কাছে। এবং সে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভেবেছে, তার বিশ্বাসও বলা যেতে পারে, আমি ওদেশ থেকে চলে আসলে তার মাও হয়তো তাড়াতাড়ি ওদেশ থেকে চলে আসবে।
কিন্তু ঘটনার চাকা ঘুরে গেল অন্যদিকে। তার পরিকল্পনা মতো কিছুই চললো না। এখন এমনই এক অবস্থা তৈরি হলো, যা ভেবে সেও খানিকটা যেন চিন্তিত হচ্ছে এবারে। ভাই হয়তো ঠিক ভাবে পৌঁছেছে। কিন্তু তারপর পুরো অবস্থাটা কোন দিকে যাবে! দু'দিন তাকে নানা কারণে প্রশ্ন করা এবং দমদম থেকে ঘুরে আসার পরে, সে রাত্রে সে এসব নিয়ে নানা কথাই ভাবছে না এমনটা না, ভাবছে। কিন্তু অস্থির হয়ে কী লাভ এখন? দেখা যাক কী করা যায় এরপর।
এদিকে সব খবরা খবর পাবার পরে খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে মনটা এবং নানা ভাবে কালো দিদির সঙ্গে গোরুর পরিচর্যা করা ও ঘরদুয়োর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করায় মন দিয়েছি। কোদাল নিয়ে দাওয়ার সামনের ঘাস-জঙ্গলও পরিস্কার করা যায় কীভাবে তার একটা চেষ্টা চালাচ্ছি কালো দিদির সঙ্গে। এসব কথা মা অফিস থেকে ফিরলে মাকে সব আস্তে আস্তে বলে দিয়েছে কালো দিদি। আজ গোয়ালা কখন এসেছে দুধ দুইতে ,এবং সকলে দুধ ঠিক মতো পেল কি না, এসব সব বাড়ি ফিরলে মাকে বলে দিয়েছে। যেন আর কোনো চিন্তার কারণ নেই, এবারে সব আমিই যেন সামলে নিতে পারবো, এমনই সব সম্ভাবনার কথা মাকে বলে বোঝাতে লাগলো সে আস্তে আস্তে। এই কথাগুলো মাকে বললে মা যেন বেশ নিশ্চিন্ত হতে পারে, সে হয়তো এমনই কিছু ভেবেছে ----
হয়তো বা তার ধারণাও ভুল না, খানিকটা না ভেবেই বা কী করি, কতো আর শুয়ে-বসেই ভালো লাগে, তাই খানিকটা তো ভাবছিই, বাড়িটার যা অবস্থা , এভাবে কি থাকা যায়? কিন্তু আমি এবং কালো দিদি মিলে সবটা কি পেরে উঠবো? আচ্ছা এই মানুষটিকে কালো দিদি কালো দিদি বলছি কেন আসার পর থেকেই ? একজন মানুষকে তার শরীরের রঙ দিয়ে কি বিচার করা উচিৎ ? এ কেমন সম্বোধনের ভাষা! কেনই বা তা হবে?
এ কথা আজই যেন প্রথম মনে এলো, এবং সেকথা মাকে বললামও। মা তা শুনে আমাকেই সমর্থন করলো। বললো, হ্যাঁ, সে তো ঠিকই ---- যদিও আমরা তাকে কেউই সামনা-সামনি ওভাবে বলি না। কখনো সখনো সুশীলা অভ্যাসবশত বলে। তবে সত্যিই তুমি একটা অত্যন্ত সঠিক বিষয় বলেছ আজ। আজই তাকেও বলে দেব, বারণ করে দেব, আর তুমি বলো না ওভাবে। আমি বললাম, না, বলি না যদিও, কিন্তু কাউকে তার সম্মন্ধে বলতে গেলে হয়তো কয়েকবার বলেছিও। তবে বলার পরে, এসে পর্যন্ত মনে হচ্ছে, না, এভাবে একজন মানুষকে তার গায়ের বর্ণ দিয়ে সম্বোধন করাটা ঠিক না। তাই ঠিক করেছি আজ থেকে তাকে শুধু মাত্র দিদি বলেই ডাকবো। বড়জোর কাউকে বললে হয়তো বলবো কাজের দিদি।
এইসব সাতপাঁচ নিয়েই এ ক'টা দিন কেটে গেল যেন কিভাবে। এর মধ্যে বাড়ির সামনের দিকটা অনেকটাই দুু'জনে মিলে পরিষ্কার করে ফেলেছি। ঘর-দুয়োরও আগের থেকে অনেকটাই ঝরঝরে। বুঝতে পারছি না অন্তরালে অন্তরালে কীভাবে যেন বেশ সংসারী মানুষ হয়ে উঠছি ! একথা আজই প্রথম মাথায় এল হঠাৎই --- হঠাৎ করেই সেদিন বৃষ্টির মধ্যে বেশ রাতে বারান্দায় বসে আছি, তখনই কথাটা মাথায় এল। এতটা ঘরগেরস্থালি নিয়ে আমি জড়িয়ে যাচ্ছি কেন? এসব জিনিস নিয়ে এর আগে কোনোদিনও তো ভাবিনি! তা যদি ভাবতাম, তাহলেও তো দিদিমা আমায় মাথায় তুলে নাচতে চাইতো! কিন্তু এখানে এসে এসব নিয়ে এত ভাবছিই বা কেন….!
এর মধ্যে একদিনও বই -খাতা লেখালিখি এসব নিয়ে কিছুই ভাবিনি। আজ কেন জানি না বারবার মনে হতে লাগলো সেসবের কথা। এ আমি কেমন ভাবে এতটা পাল্টে গেলাম, কেনই বা ওসব দিকে অমন ভাবে নজর পড়লো আমার?
রসিক দাদু শিক্ষাগুরুর কথা বলেছিল। বলেছিল বড়ো জায়গার কথা । কই , সেসব নিয়ে তো কোনো কিছুই ভাবছি না! এ ক'দিনে একবারও সে সব কিছুই ভাবিনি। এসে দিদিমা বা রসিক দাদু কাউকেই একটা কিছুই জানাইনি । সঞ্চয়কে কেন্দ্র করে ওদেরগুলি একসঙ্গে একটি খামে পুরে পাঠিয়ে দিতে পারতাম তো; কই , চিঠি লেখায়ও কি মন দিয়েছি সেভাবে--- ? এ ক'দিনে এসব নিয়ে কিছুই ভাবিনি ! নিজের কাছে নিজেই অবাক হচ্ছি, ভাবছি , একবারও এসব ভাবলাম না! যাদের সঙ্গে এতগুলি দিন কাটিয়ে এলাম, যাদেরকে নিয়ে একমুহূর্তও না ভেবে থাকতে পারতাম না , তাদের এভাবে বেমালুম ভুলে গেলাম কীভাবে? এতটা পরিবর্তন আমার মধ্যে নিয়ে এলো কে?
বৃষ্টির রাত, উঠোনে বাইরের লাইটপোষ্টের খানিকটা আলো পড়েছে মিটার ঘরের মাথা পেরিয়ে রাঙচিতের বেড়ার উপর। রাঙচিতে গাছে বাঁশের চটা দিয়ে তাদের গোড়ার দিকটায় বাঁধন দিয়ে বাড়ির সামনের দিকটায় বেড়া দেওয়া হয়েছে। সেই রাঙচিতে গাছের পাতায়, ঘাসের জঙ্গলে, বারান্দার আলো এবং লাইটপোষ্টের আলো মিলেমিশে এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির ভেতর হাওয়ায় সকলে মিলে ঢেউ খেলিয়ে খেলিয়ে যেন লুকোচুরি খেলছে। ডানদিকের ডোবাটার ভেতরে ব্যাঙ ডাকছে। থেকে থেকে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। ঘরের ভেতর এরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিই বারান্দায় মোড়া পেতে একা একা বসে বসে এইসব নানা কিছু দেখছি এবং নানা কথা ভাবছি। মনে মনে ঠিক করছি কাল যেভাবেই হোক একবার দিদিমাকে ও রসিক দাদুকে একটা কিছু লিখতেই হবে। পারলে সঞ্চয়কেও। আরো ভাবছি, এই যে ক'দিন হলো এসেছি, এর মধ্যে একদিনও তো ঠাকুমার বাড়ি-মুখো হলাম না! দিদির বাড়িতেও যাইনি। যাওয়া উচিত ছিল না কি? ঠাকুমার ওখানে গেলে হয়তো ছোটবেলার কারোর না কারোর সঙ্গে দেখা হলেও হতে পারত! যদিও বা তারা কেউ আমাকে চিনতেই পারবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ। তাহলেও তো কথা বলার কাউকে পাওয়া যাবে অন্তত! সঙ্গে সঙ্গে আবার একথাও ভাবছি, এই তো ক'বছর আগে যখন এসেছিলাম এদেশে, তখন তো ঘনঘন ও বাড়িতে যেতাম, কই ,ছেলেবেলার একজন বন্ধুর সঙ্গেও কি আমার ভাব জমেছিল ? না। কারণ আমি যে ওদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছি। সেই ছেলেবেলার কোনো ছন্দ, গন্ধ, সুরই আমার সঙ্গে আর নেই। তারা কবে কোথায় নানা জল হাওয়া লাগিয়ে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে আমার থেকে হয়তো বা! তাদের কোনো সুর -তালই নেই আর এখন আমার মধ্যে ; যার কিছুটা দিয়ে তাদের কাছে কেউ একজন হয়ে উঠতে পারি অন্তত! তাহলে কি এখানেও সেটাই ঘটেছে?
ক'দিন হলো ওপাশের কর্মকার বাড়ির শংকর, মজুমদার বাড়ির সুভাষ, ফচন , ওপাশে মানু , এরা সকলেই আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে যখন খেলাধুলো করে, আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিসব যেন ওদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে, কিন্তু কখনো আমাদের বাড়ির ভেতরে আসে না বা আমাকে ডাকে না। শরণার্থী হয়ে ফিরে এসে এদের সঙ্গে সামান্য ক'দিনের একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছিল বলে, এদের সকলের নাম বলে দিতে পারি। তাছাড়া আমিও তো ওদের তেমন করে ডাকিনি ! তারও কারণ আছে, নানা কারণে নানা ধরনের হীনমন্যতা ভেতরে ভেতরে কাজ করে চলেছে, যা আমি টের পাচ্ছি, তবু সেও নাছোড়, সে তার জায়গাটাও ধরে বসে আছে দেখছি, সেও কিছুতেই তার সীমানা অতিক্রম করতে চাইছে না যেন, তাই আমিও পারছি না তাকে ডিঙোতে । সেটা আবার কি রকম! যা একাত্তরে ছিল না অথচ এই পঁচাত্তরে, সামান্য এই কিছুদিনের ব্যবধানে সে এরকম একটা জায়গা পেয়ে গেল?
হয়তো সেটা এরকম, এই মুহুর্তে এ পাড়ায় সকলের থেকে বাড়ি -ঘর- দুয়োরের অবস্থা আমাদেরই খারাপ একটু। এদের সকলের দালান বাড়ি। খুব নামিদামি স্কুলে পড়াশোনা করে। এদের বাবা-মা-রাও সমাজের খুব উঁচু তলার মানুষ-জন , যা ঠিক আমাদের বাড়ির সঙ্গে মানায় না হয়তো। যেমন ধরা যাক এরকম, আমাদের এই যে একখানা টালির ঘর , আলগা বাথরুম , বারান্দায় গ্রিল নেই, এমনকি আমাদের একখানা ঘরের মেঝেতেও সান করা হয়নি। মা সেসময় তাড়াতাড়ি কোনোরকমে মেঝেটাতে একটা রাফ ঢালাই দিয়ে নিয়েই গৃহপ্রবেশ করে নেয়। এখানে চলে আসে। তারপর আর নানা কারণে সে ঘরের মেঝে আর পাকা করা হয়ে ওঠেনি।
তাই তথাকথিত সামাজিক অবস্থানের জায়গাটা যা দিয়ে বিচার্য হয়, সেখানে আমরা এদের থেকে দুর্বল। ঠিক যেন এদের সঙ্গে মেলামেশা করার মতন নয়। কিন্তু আমার ভেতরে এ ধরণের চিন্তা-ভাবনা প্রবেশের পথ পেল কী করে? এরা যে সে কারণেই আমার সঙ্গে মেলামেশা করতে চাইছে না এমন ভাবনাই বা ভাবছি কেন আমি? এরা কি সেরকম কোনো কথা বা ইঙ্গিতও করেছে নাকি? যে কারণে আমি এরকম ভাবছি? ছোটো-বড়ো, উঁচু-নিচু, বড়ো বাড়ি, ছোটো বাড়ি, এসব আজ আমাকে কে চেনালো? তাহলে কি সত্যি সত্যিই এবারে আমি নাগরিক হয়ে উঠছি? মাত্র এই ক'দিনের মধ্যেই নাগরিকতা আমাকে তার ভেতরে জড়িয়ে ধরে এমন ছুরি-কাটারি ঘোরানো আরম্ভ করে দিয়েছে ? আর তা যদি না হবে তাহলে এসব ভাবছিই বা কেন? কোথা দিয়ে সে আমার ভেতরে এভাবে প্রবেশ করলো? নিজের কাছে নিজেই তার কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না যেন কিছুতেই।
এইসবের মধ্যে দিয়েও বারবারই মনে পড়ছে ওখানের কথা আজ ক'দিন ধরে। একে একে প্রত্যেকে সামনে এসে দাঁড়াতে চাইছে। আর আমি একে একে তাদের সকলের সঙ্গে এই মুহূর্তের এই নিঃসঙ্গতার কথা বিনিময় করতে চাইছি যেন ----- এই বর্ষার বাগানগুলি জঙ্গলের পথগুলি বলছে : কী….. কী করছ কি….? ওদিকে যে বিলের জল এসে ভরে গ্যাছে গলির খাব-গর্ত সবগুলির ভেতর। নগেনের মা বুড়ির তাল গাছ থেকে এই বর্ষায় ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে কত তাল পড়ল যে ঢপ ঢপ করে, তোমার মতন আর তো কেউ কান খাড়া রাখেনি তাল কুড়নোর জন্যে এখন! তোমার মনে পড়ছে না, বর্ষায় বুক ঢিপঢিপ করা সেই বাগানের পথটুকু , তারপরেই তালটা কুড়িয়ে নিয়েই চোখ বুঁজে দৌড় মারতে। সেসব কি ভুলে মেরে দিলে এই ক'দিনের ভেতরেই? আমাদের যে তোমার কথা বড্ড মনে পড়ছে গো…… সকালের ঠাকুর নালার মাঠ বলছে : দেখলে না তো এবার কতো জলে ভরে গ্যালো চারদিক, মাঠ-ঘাট সব একেবারে জল আর জল ---- কতো ধানগাছের গোড়ায় পেট-লাল পুঁটি মাছেরা ঠোকরাচ্ছে ! ষোল-ল্যাটা -টাকি - ট্যাংরা -কই মাছেরা ,সব কীরকম এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ! শুধু মুসলমান পাড়ার কেউ কেউ সেই জলের স্রোতের মুখে রাবানি-ঘুনি পেতে জিয়া মাছ, পুঁটি মাছ, ট্যাংরা ,মৌরোল্লা মাছ ধরছে, যা তুমি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন সব হারিয়ে-ফুরিয়ে গ্যালো এমনই একটা ভাব।
বাবুদের ভাঙনের বট গাছও বলছে একই কথা। নবগঙ্গার জলে এই বর্ষায় তুমি যেভাবে বড়ো নৌকো খানা নিয়ে বসে থাকতে টিটি-পক্ষীর মতন নারান ডাক্তারের ছোটো মেয়েটিকে সঙ্গে করে ছাতি মাথায় দিয়ে নিশ্চুপে , তেমন অবসর সময় আর কারো কি আছে ? যে যেভাবে পারে অন্য কাজেই ব্যস্ত থাকে বেশি সময়। দোয়াড় পাতা কি কারো আছে এখন? যে যেভাবে পারে অন্য দিকেই পরিত্রাহি ছুটছে শুধু ; যদিও সেসব পাতাপাতি কখনো কখনো হয়, টগি-বঁড়শিও ফ্যালে কেউ কেউ, তবে তা দুই পাড় জুড়েই হাতে গোনা, তুমি থাকতে যেমন ছিল তেমন আর নেই, সব যেন তোমার সাথে সাথেই চলে গেল মাত্র এই ক'দিনের মধ্যেই! তা যাক, কিন্তু আমার নিচে অমন নিশ্চুপে অনন্ত অপেক্ষা নিয়ে কেউ বসে না আর, ছিপ-বঁড়শি নিয়ে একা একা!
এ নিয়ে নবগঙ্গারও প্রতিবাদ আছে যেন। সে বলছে, এত জেলেরা জাল ফেলছে, টগি-বঁড়শিও পড়ছে দুপারেই দু'একটা, খ্যাপলা , ভেসাল জালে নিঃশব্দে মাছ মেরে নিয়েও তো যাচ্ছে মালো সম্প্রদায়। রাত-ভোর টানা বড়শিতেও তো ডিঙি নৌকো নিয়ে মালোরা এদিক থেকে ওদিক আদার গাঁথছে না যে তা না, গাঁথছে তো, মাছও ভোর ভোর তুলে নিয়ে যাচ্ছে নৌকোয় ; তাতে কি, ওহে বটগাছ, তোমার নিচ দিয়ে কেউ যাওয়া আসা করছে না একেবারেই? তুমি এমন করছ, যেন নালিশ জানিয়েই খালাস হলে তার কাছে সব! হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝলাম না হয়, অমন ভাবে জলশ্যাওলার গন্ধে মাখামাখি হয়ে বুঁদ হয়ে থাকে না নাহয় সকলে একরকম ভাবে, কিন্তু চলছে তো সবই ! তাই বলে যে একবারও পিছনে ফিরে দেখলো না, তার কাছে এসব বলে কী হবে? দেখলো কি একবারও, পিছনে ফিরে? এত যে দাপাদাপি করলো, গরম শীত বর্ষা সবই উপভোগ করলো, পাতিশ্যাওলা শরীরে মেখে ; তাহলে, সব কিছু ফেলে এভাবে চলে গ্যালো কীভাবে? কীভাবে গ্যালো? যতই তার জন্ম-দেশ হোক ওটা, এটা তার দেশ না! একে তুমি কী স্মরণ করাচ্ছ ওহে বট-পাকুড় গাছেরা ,তোমার শাখা প্রশাখারা এত যে হেলেদুলে তাকে হাওয়া বাতাস খাওয়ালো , সে কি তার কিছুই মনে রাখলো, বলো তো? আমরা কি কেউ ছিলাম কখনো তার?
এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির রাত্রি, চোখে ঘুম নেই আমার। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বারান্দার পিলার । রেলিং। হাওয়ায় জল এসে লাগছে পায়ের কাছেও । ডানপাশের ডোবার ভেতর জলকলমির ডাঁটাগুলি হাওয়ায় একবার এদিক একবার ওদিক করছে। ব্যাঙগুলিও ডাকছে জল পেয়ে। ঝিঁঝিঁরাও ।কালো গোরুটি শুয়ে শুয়ে মুরগির ঘরের নিচে জাবর কাটছে একাকী। এসব সব কিছু মিলে কেন জানি না বুকের ভেতরটায় একবার এদের সাথে, একবার সেই ফেলে আসা জল-জঙ্গল নদীর দেশটায় চালান হয়ে যাচ্ছে যেন। বড়ো হু হু করছে ভেতরটায় । কারোর সঙ্গে আমি নেই এখন । আমি শুধু এই বৃষ্টির রাতে একবার এদের মধ্যে হারাচ্ছি আর একবার হারিয়ে যাচ্ছি ক'দিন আগের ফেলে আসা সেই ঝাপসা গ্রামখানির জগতে !
একবার মনে হচ্ছে ভাইটা কী করছে এখন কে জানে! দিদিমা তার সাথে আমার কথা কি বলাবলি করে একবারও ? সে কি আমার মতন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন-জঙ্গল নদীতে? জানি না তো কিছুই! কেনই বা ও চলে গেল? আমি এখানে এলাম দেখে? নাকি আমাদের আসার পথের গল্প শুনেই ও অমন আবেগ তাড়িত হয়ে ছুটলো মামার পেছন পেছন? কোনটা ওকে যে টেনে নিয়ে গেল ওদেশে তা কে জানে ! কোথাও কোনো কিছুই কারো অপেক্ষায় দিন গোনে না। একদিন সকলেই আমাকেও ভুলে যাবে জানি। হয়তো ভাইকে আবার আপন করে নেবে তাদের জীবন ছন্দের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে আমার মতো।
ইদানিং মলন মলায় খুব মনোনিবেশ করেছিলাম। সকাল বেলায় বতরের সময় যে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে গোরু চেয়ে নিয়ে এসে ধান মাড়াই করবার জন্যে সকাল বেলায় হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, সেই ছন্দে আমিও জুড়ে গেছিলাম। সেই গোরুগুলিকে একে একে জুড়ে দিয়ে তারপর ঘুরতে থাকা মলনের খুঁটোয় আমিও ওদের সাথে সাথে ঘুরতাম। মাঝে মাঝে ক্যারাল দিয়ে খুঁচিয়ে দেওয়া খড়গুলিকে । যাতে মাড়ানো ধান নিচে পড়ে যায় , আর যে গুলিতে গোরুর পা পড়েনি বা খড় থেকে ধানগুলি আলাদা হয়নি , তাদেরকে ক্যাড়ালের মাথায় তুলে তুলে উল্টে পাল্টে দেওয়া; সে এক কাজে পেয়ে বসেছিল আমায় কেন জানি না। ধান মাড়াই হয়ে গেলে সেই মাড়ানো ধান থেকে গোরুগুলিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে, খড়গুলিকে আলাদা একজায়গায় দলা করে রাখাকে এক অদ্ভুত ভালো লাগায় পরিণত করে ফেলেছিলাম। তারপর শীতকালে সেই পালো দেওয়া খড়ের ভেতর থেকে যে গুমোনো ধোঁয়া বের হত, তাই দেখে প্রথম প্রথম ভয় পেয়ে গিয়ে দিদিমাকে বলতাম, ও কি গো দিদিভাই! খ্যাড়ে কি আগুন লাগে গ্যালো নায়ি ? তাই শুনে দিদিমা বলতো, না না আগুন লাগতি যাবে ক্যান, ও তো গুমোনো খ্যাড়ের ভেতরে জল পাইয়ে অমন গুমসে উঠিছে , ও কিছু না। আস্তে আস্তে বেলা উঠলি থামে যাবে নে, ভয়ের কিছু নেই।
ধান সেদ্ধ করার গন্ধ কী মুগ্ধ করতো ! শীতকালে লাল আলু নিয়ে এসে সেদ্ধ ধানের চাড়ির ভেতরে দিয়ে দিতাম। ধান সেদ্ধ হয়ে গেলে আলুগুলি তুলে নিয়ে এসে পড়ার মাদুরের উপর বসে বসে সেই সুস্বাদু মিষ্টি আলু খেতাম গভীর তৃপ্তি সহকারে, ওখানকার মানুষজনের মতোই। কার্তিক- অঘ্রাণ মাসগুলির সকালবেলাগুলি ছিল এই সেদ্ধ ধানের গন্ধে ম ম করা। সেই সুবাস কোথায় কোথায় যে আমাকে ভাসাতো ,সে কথা এই সদ্য গড়ে ওঠা নিচু অঞ্চলের কলকাতার মানুষজনের জানার কথা নয় মোটেই। এ সব কি এখানে কাউকে বোঝানো যাবে ? হয়তো যাবে এখনো, যারা এই কয়েক বছর আগেও ও দেশ ছেড়ে এসেছে বা ভিটেমাটি ছেড়ে এসেছে। তাদের স্মৃতিতে হয়তো এখনো কিছুটা ধরে রাখা আছে কারো কারো মাঝে----
এসে পর্যন্ত রাতের বেশিরভাগ সময়টা এমন সব ভাবনা-চিন্তার ভেতর দিয়েই বারান্দায় বসে বসে কাটে। তারপর কখন যে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, না হলে বারান্দাতেই দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি তার ঠিক থাকে না। তারপর হয়তো ভোর হবার একটু আগে আগে কাজের দিদি বা মা জেগে গেলে তারা এসে যখন ডাক দেয়, তখন হয়তো ঘরে যাই ধরফড়িয়ে উঠে তাড়াতাড়ি। এ ছাড়া সমস্ত দিন কাটে এ কোনা ও কোনা ঘোরাঘুরি করেই। এ ছাড়া আর যে অফুরন্ত অবকাশ তার খানিকটা নেয় কালো গোরুটি , সেই ঘরের পেছনের বাঁশজঙ্গলের নিচের ডোবাটি। আর আছে কাজের দিদি --- তার সঙ্গে তার বাড়ির কথা, তার নিজের নানা রকমের অভিজ্ঞতার কথা তার মুখ থেকে চুপচাপ শুনে যাই বসে বসে।
এই তো, এর মধ্যে একদিন কাজের দিদি একবেলার জন্যে তার বাড়িতে গেল । আবার সন্ধ্যার আগে আগেই যদিও বা ফিরে এল, তবু কি ফাঁকা ফাঁকা নিঃসঙ্গ লাগছিল সমস্ত বাড়িটার ভেতরে! গোরুটিকে সকাল দুপুর বিকেল জাবনা মেখে দিলাম সেদিনই প্রথম টানা একটা দিন। কাজের দিদি যেভাবে দেখিয়ে দিয়ে গেছিল কোনটা কতটা দেব। তার জাবনায় চার বাটি দানাভুসি, গলা পর্যন্ত খাবার টবে খড়-বিচালি, তার সঙ্গে এক বালতি জল , এইসব দিয়ে বেশ করে দু'হাতে মেখে দিয়েছিলাম দিদির মতো করেই। সে নতুন হাতের বেড়ে দেওয়া খাবারে প্রথমে একটু মুখ ঢুকিয়ে দেখে তারপর বেশ মনের আনন্দেই খেয়ে গেল দেখলাম। একটুও এদিক ওদিক করল না। দুপুর বেলায় আমিও ভাতের হাঁড়ি থেকে ভাত , তরিতরকারি নিলাম অন্য পাত্র থেকে, সেদিনই প্রথম নিজের হাতে খাবার বেড়ে খেলাম। কাজের দিদি ফিরে এসে জানতে চাইল ঠিকঠাক সব কিছু নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করেছি কি না। রান্নাবান্না রাখার সেল্ফটা ভালো করে খুলে দেখেও নিল, সত্যি সত্যি সব কিছু নিয়েছি কি না । যেন তার সন্দেহ ছিল এ বিষয়ে খানিকটা , হয়তো কোনোরকমে খেয়ে -দেয়ে উঠে পড়েছি।
রসিক দাদু বলেছিল, এবার তোর বড় জায়গায় যাইয়ে শিক্ষাগুরু খোঁজার দরকার। শিক্ষাগুরু না হলি তুই নিয়ম ডা জানতি পারবিনে ভাইডি, জানবি, এ শিক্ষে তো সে শিক্ষে নয়, এ যে আর এক শিক্ষে, যা সেই গুরুই এসে দিয়ে দেন শেখায়ে। রসিক দাদুর কথা মতো সেই শিক্ষাগুরু খোঁজা তো দূরে থাক, এখন যে শিক্ষাগুরু হয়েছে এখানে তার ঠেলা সামলানোই তো দেখছি ভার !
আজ ক'দিন হয়েছে আমাদের বাড়ির সামনে যে ফাঁকা মাঠটা আছে, তার ওপাশের সাহা বাড়ির তিন ছেলে মেয়ের এ বাড়িতে দেখছি আসা যাওয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গত বৃহস্পতিবার থেকে। এর আগেও বৃহস্পতিবারগুলোতে ওরা নাকি আসে। সে দিনগুলিতে যদি মায়ের অফিস যাওয়ার বিশেষ তাড়া থাকে তাহলে শিবানী নামের মেয়েটি এসে মায়ের ঠাকুর দেবতার সিংহাসনের সামনে বসে ঠাকুরের পুজো দিয়ে যায়। ইদানিং দেখছি বাকি দিনগুলিতেও ও অথবা ওর ছোটো বোন দু'জনের কেউ একজন দু'বেলা এসে পুজো দিয়ে যায় ঠাকুরের। দিদিমার সেই রাধা কৃষ্ণকে জামা কাপড় পাল্টিয়ে দেয় বেশ যত্ন সহকারে। বেশ নিষ্ঠা আছে এ কাজে বোঝা যায়। মা'র গুরুদেবের ছবিতেও জামা পরায়। আমি এই সবই অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখি। মনে মনে বেশ আশ্চর্য হই গুরুদেবের ছবিতে কীভাবে জামা পরায় সেটা দেখে। পটের গায়ে জামা পরানোর কায়দাটা বেশ হতবাক করে দেয় আমায়। মনে মনে ভাবি, এইভাবে মাও সেদিন পরিয়ে ছিলো তাহলে!
পুজোপাট শেষ হলে ওরা দুই বোনই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে চায়। আমিও তাদের সঙ্গে বেশ মিশছি দেখতে পাচ্ছি। ওদের বাড়ির ছোটো ছেলে অলোক, ওদের দু'জনের থেকেই বড়ো , সেও ভীষণ আন্তরিক। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরার কথাও বলে মাঝে মাঝে। একদিন ওদের সকলের অনুরোধে ওদের বাড়িতে গেছিলাম। কী বড়ো বড়ো প্রশস্ত ঘর দুয়োর ওদের ! অলোকেরই তো নিজস্ব একটি ঘর আছে। তাতে বড়ো একটি একোরিয়াম । তার ভেতর কত রঙবেরঙের মাছ ! জলের ভেতরে ঘোরাঘুরি করে। একরিয়াম জিনিসটি যে এরকম তা এর আগে তো কখনো দেখিনি! যেন কাঁচের একটি ঘর । তার মধ্যে কী নেই! যে পাতিশ্যাওলাদের গায়ে মেখে দোয়াড় পেতেছি, তারাও দেখি মাছের এই ঘরের মধ্যে অতি যত্নে জায়গা করে নিয়েছে! কাঁটা-শ্যাওলাও আছে দু'একটা, আর আছে একটি যন্ত্র যাতে বুড়বুড়ি কাটছে নাকি জল। আচ্ছা, যন্ত্রটা কি ওই ব্যাঙটার মুখের ভেতরে বসানো? নাকি একরিয়ামের বাইরে?
জিজ্ঞাসা করবো ভাবলাম কয়েকবার কিন্তু কি এক সংকোচ বোধে বারবারই পিছিয়ে এসেছে মনটা। এ মা, অলোক যদি বলে, কী হাঁদারে বাবা, এটাও জানিস না! তাই কিছু আর না বলে শুধু দেখতে থাকলাম, ব্যাঙটি যেই হাঁ করছে আর অমনি বুড়বুড়ি বের হচ্ছে তার মুখের ভেতর থেকে। এই অতি আশ্চর্য বিষয়টি চেয়ে চেয়ে দেখছি আর অবাক হচ্ছি। শাদা শাদা পাথর দিয়ে কী সুন্দর সাজানো কাঁচের বাক্সটার ভেতরে জলের নিচে ! মাছগুলি চলাচল করছে যে জায়গাটায় তার মধ্যে কী নেই! পাহাড়, গুহা, বাড়ি-ঘর ছোটো ছোটো সবই আছে। অলোক জানালো ওগুলি সবই চিনেমাটির। কিনতে পাওয়া যায় বাজারে।
সে গানও শোনালো , বড়ো একটি বাক্সের মধ্যে থেকে আওয়াজ আসছে দেখি, জানতে পারলাম ওটার নাম নাকি চেঞ্জার। বড়ো বড়ো থালার মতোন চাকতিগুলির ওপরে কী একটা ঘাড় ঘোরানো মতো, একটা ডান্ডির মতোন দেখতে সেটা এসে বসে যাচ্ছে নিজে নিজেই , আর গান হচ্ছে। ঠিক যেমনটি দেখেছি মাইকওয়ালাদের কাছে, এ যেন তারই একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ মাত্র, আর কিছু না!
তবুও খানিকটা বিস্ময় যেন থেকে গেল। বেশ একটা আলাদা অনুভব। শিবানী ও মলি দুই বোন ভীষণ আন্তরিক ভাবে ওদের বাড়িটার সমস্ত ঘরগলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিল। কোন্ ঘরে ওদের বড়দা-ছোটদারা, আরো অন্যান্য যারা রয়েছে তারা কে কোথায় থাকে।
আমার বারবার মনে হতে লাগলো, আচ্ছা, ওরা যে আমাকে এত ঘটা করে সব ঘর -দুয়োর, ওদের বাড়ির নানা আধুনিক সরঞ্জামগুলি একে একে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে এর কারণ কী? আমি তো ওই একখানা টালির ঘরের ছেলে! এসবের আমি কিই বা বুঝি এত!
কিন্তু না, সেরকম কোনো ধরণের অহংকার বোধ বা নিজেদের আভিজাত্য দেখানো মনোভাবের কোনো ইঙ্গিত তো পেলাম না ওদের ব্যবহারের মধ্যে! তাই বেশ ভালো লাগলো ওদের এই আন্তরিকতাটুকু ! এবং একটা বিষয় তো আরো অদ্ভুৎ, এই দুটি মেয়ে দু'টি পালা করে করে নিপুনভাবে মার ঠাকুর দেবতার সিংহাসন যত্ন সহকারে সাজিয়ে দেয়, ফলফলাদি, নকুলদানা, মিছরি কত কি দিয়ে। তাছাড়াও মাঝে মাঝে উনুনে কাজের দিদির সঙ্গে এটা ওটা রান্নাবান্নাও করে দেয়। মাঝে মধ্যে আমাকে ভাতও বেড়ে দেয়। ওদের পেয়ে ভীষণ অবাক হচ্ছি এই ভেবে, মানুষের সম্পর্কগুলো কী অদ্ভুত তাই না!
আজ ক'দিন এসেছি, এর মধ্যে মাঝে মধ্যেই মা'কে দেখেছি অফিস যাবার আগে তাড়া থাকলে ওদেরকেই মাঠ আড়াআড়ি চিৎকার করে ডাকতে, ' এই মলি, এই শিবানী, মা রে আজ আর পারলাম না রে মা, তোরা একটু এসে ঠাকুরদের সামলে দিস রে মা, আর সব দেখিস, যা লাগে লাগাস মা একটু বুঝেসুজে…… '।
ওরা ওদের দু'জনের কেউ না কেউ সেই হাঁক - ডাকে চলে আসে, তারপর সব দায় দায়িত্ব সামলায় একেবারে নিজের মতোন। আমি যত দেখি ততই বিস্ময়ে হতবাক হই ! এবং এই ক'দিনে আস্তে আস্তে আমি ওদের সঙ্গে বেশ মিশে গেছি যে তাও দেখতে পাচ্ছি। এবং কাজ-কর্ম শেষে কাজের দিদির সঙ্গে লুডো খেলতেও বসে যায় দেখি।
সেই আমার প্রথম এদেশে এসে নিকট জনের সংস্পর্শ পাওয়া যেন…..!
( আগামী পর্বে )
দীপংকরদার এই উপন্যাসের ভিতর দিয়ে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার মধ্যে ওনার যে একটা গভীর টান এবং গভীর সম্পর্ক তা প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে স্পষ্টরূপে। এছাড়া ওপার বাংলার খোলা প্রকৃতি এবং সেখানকার খোলা মনের মানুষগুলোর সাথে ওনার যে ভাব বিনিময়, তাদের প্রতি ওনার যে দুর্নিবার আকর্ষণ তাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে।
উত্তরমুছুন