শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

 



 

স্বরবর্ণ * দশ   * ২০২২   

সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ  করব ২৫ অক্টোবরের পর থেকে । 


***************************************

স্বরবর্ণ * এগারো ২০২২  

দ্বিতীয় বর্ষ * পঞ্চম  সংখ্যা 

*********************************************

শীত সংখ্যারূপে প্রকাশিত হবে আগামী  ৫ ডিসেম্বর  ২০২ 


* এই সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ৫ নভেম্বর ২০২- এর মধ্যে পাঠিয়ে দিন । 

* শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন  

* লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

* "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। প্রতি দুমাস অন্তর মাসের ১৫ তারিখ বেরো আগে থেকে লেখা পাঠানপরিকল্পনার সুবিধার জন্যলেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে 


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                                   

 ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা  

তোমায় খুঁজে ফিরি



অমৃতস্য পুত্রাঃ -স্বামী বীরেশ্বরানন্দ

স্মৃতিকথা 

স্বামী সত্যরূপানন্দ

১)

পূজ্যপাদ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের কাছে আমি সন্ন্যাসদীক্ষা লাভ করেছিলাম। তাঁকে সম্ভবত প্রথম দর্শন করি ১৯৬৩-তে। প্রথম দর্শনেই আমি তাঁর মাতৃবৎ স্নেহ অনুভব করেছিলাম। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ মার্চ পর্যন্ত আমার বেলুড়মঠে বাস করার সৌভাগ্য হয়। পূজ্যপাদ মহারাজের মহাসমাধি হয় মার্চ মাসে। অতএব জুন ১৯৭৬ থেকে মার্চ ১৯৮৫ পর্যন্ত প্রায় নয় বছর তাঁর পবিত্র সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

     আমি কখনও তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা অন্যান্য ঘটনা লিখে রাখেনি। তাই এই দীর্ঘ সময়ের যে সামান্য কয়েকটি পূত ও প্রেরণাদায়ক ঘটনা আমার স্মরণে আছে, সেইগুলো লিখবার চেষ্টা করছি। এই ঘটনাগুলির সময় এবং স্থান ক্রমানুসারে সাজানো সম্ভব নয়। তবুও পূজ্যপাদ প্রভু মহারাজের পবিত্র জীবনের অনুচিন্তন আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রেরণাপ্রদ ও চিত্তশুদ্ধিকারক -এই ভেবেই ভক্তদের সেবায় আমি এই শব্দাঞ্জলি অর্পণ করছি।

     কর্মযোগের রহস্য : ঘটনাটি সম্ভবত ১৯৭০-৭১ সালের। (সেইসময় প্রবীণ সন্ন্যাসী থেকে নবীন ব্রহ্মচারী পর্যন্ত সকলেই পূজ্যপাদ বীরেশ্বরানন্দজীকে 'প্রভু মহারাজ' বলতেন)। প্রভু মহারাজ মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়ারে দীক্ষা দেবার জন্য পদার্পণ করেছেন। গোয়ালিয়রে 'রামকৃষ্ণ আশ্রম' নামে একটি প্রাইভেট আশ্রম রয়েছে। সেই সময়ে মধ্যপ্রদেশের শুধু রায়পুরেই রামকৃষ্ণ মিশনের শাখাকেন্দ্র ছিল। যেহেতু গোয়ালিয়ার মধ্যপ্রদেশে, অতএব রায়পুর আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী আত্মানন্দজী এবং আমি প্রভু মহারাজের সেবার জন্য গোয়ালিয়ারে গিয়েছি। বেলুড় মঠের তুলনায় গোয়ালিয়ারে আমরা সকলে মহারাজের কাছে বেশিক্ষণ বসতে পারতাম। তাঁর বিশ্রামের পর আমরা সব সাধু-ব্রহ্মচারী বসে যেতাম ও তাঁর সঙ্গে নানারকম আধ্যাত্বিক প্রসঙ্গ করতাম। এই প্রসঙ্গেই একদিন আমি তাঁকে বললাম, 'মহারাজ, আমরা সকলে তো মিশনের সাধু-ব্রহ্মচারী। আমরা নিঃস্বার্থভাবে কর্ম করি। অতএব আমাদের সব কর্মই আপনা-আপনি যোগে পরিণত হয়। এখন আমাদের আর অন্য কোন সাধনার প্রয়োজন নেই। স্বামীজীও বলেছেন যে, নিঃস্বার্থ কর্মের দ্বারাই তোমরা মুক্ত হয়ে যাবে। মহারাজ দৃঢ়ভাবে বললেন, 'না।' আমি বললাম, 'স্বামীজী তো বলেছেন কর্মযোগের দ্বারাই মুক্তি হবে।' তখন প্রভু মহারাজ বললেন, 'জান, কর্মযোগের লক্ষণ কি? তারপর তিনি নিজেই উত্তর দিলেন  'Conscious and constant remembrance of God while working' -অর্থাৎ কর্মের সময় সতত ও সজাগ ভাবে ঈশ্বরকে স্মরণ, এটাই কর্মযোগের লক্ষণ। মহারাজের এই উপদেশটি আমাদের জীবনের আলোকস্তম্ভ স্বরূপ।

     নিস্পৃহতা ও লোকশিক্ষা : এক অ্যামেরিকান যুবক-ভক্ত নিজের দেশে পুরানো মোটর গাড়ি কেনা-বেচার ব্যবসা করত। এক-দেড় বছর পর পর সে এসে বেলুড়মঠে কিছুদিন থাকত। একবার সে একটি দামী বড় গাড়ি কিনে জাহাজে করে ভারতে আনিয়ে বেলুড়মঠে নিয়ে এসে মহারাজকে উপহার দিল। কিন্তু মহারাজ সেই গাড়ি ব্যবহার করতেন না। অনেক কষ্টে তাঁকে সেই গাড়িতে বেলুড় মঠেই দু-চারবার ঘোরানো হয়েছিল। অন্য কয়েকজন প্রবীণ সাধু কখন কখনও বেলুড় মঠ থেকে কলকাতা যাওয়ার সময় গাড়িটি ব্যবহার করতেন।  

     একবার মহারাজকে সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য বেলুড় মঠ থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরে রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাপ্রতিষ্ঠান হাসপাতলে যেতে হবে। কয়েকজন প্রবীণ সন্ন্যাসী অনুরোধ করলেন মহারাজ যেন আমেরিকান গাড়িটাতেই হাসপাতালে যান। মহারাজ তাদের মন রাখতে রাজি হয়ে সেই গাড়িতেই রওনা হলেন। এদিকে, মহারাজের গাড়ি প্রায় সেবাপ্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে গেছে। এক জায়গায় অনেক গাড়ি যানজটে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে বেরিয়ে হাসপাতলে পৌঁছাতে সামান্য সময় লাগল। এরমধ্যে সেখানে দাঁড়ানো কয়েকটি ফুর্তিবাজ যুবক ব্যঙ্গ করে বলল, 'রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা তো রাজা, দেখছিস না -কেমন লাখ-লাখ টাকার দামী গাড়িতে চড়ে মজায় বেড়াচ্ছে।' ঠাট্টাচ্ছলে বলা কথাগুলি মহারাজ শুনলেন, মহারাজের সেবকরাও শুনলেন।


     যে-সাধু সম্পত্তি দেখাশোনা ইত্যাদির কাজ দেখতেন তাঁকে ডেকে পূজ্যপাদ মহারাজ কয়েকদিন পরেই বললেন 'তাড়াতাড়ি এই আমেরিকান গাড়িটি বিক্রি করে দাও।' মহারাজের আদেশ শুনে কয়েকজন প্রবীণ সন্ন্যাসী আক্ষেপ করে বলতে লাগলেন যে, বৃদ্ধাবস্থায় মহারাজের সুবিধার জন্য এই গাড়িটি দিয়েছে, তাকে কেন বিক্রি করা হবে? কিন্তু কার এতো সাহস যে, মহারাজকে এই কথা বলে? কয়েকদিন গাড়ি বিক্রির কোন প্রসঙ্গ হলো না। মহারাজ সেই সাধুটিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'গাড়ি বিক্রির কি হলো?' সে বেচারী ঘাবড়ে গিয়ে বলল যে, কয়েকজন প্রবীনদের ইচ্ছা যে উচিত দাম পেলে তবেই গাড়িটি বেঁচা উচিত। এ কথা শুনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে আদেশ দিলেন যে, যা দাম পাওয়া যাচ্ছে তাতেই গাড়িটিকে তখনই বিক্রি করে দিতে।

     বালীর এক ধনী ব্যক্তি, যাঁর বাড়িকে লোকে জাহাজবাড়ি বলত, জানতে পারলেন যে বেলুড় মঠ একটি বিদেশী গাড়ি বিক্রি করতে চাইছেন। তাঁর এক সাধুর সঙ্গে পরিচয় ছিল। তিনি বললেন, 'আমি এক লাখ টাকায় গাড়িটি কিনতে রাজি আছি।' পূজনীয় মহারাজকে বলা হল। মহারাজ বললেন, 'এক্ষুনি বিক্রি করে দাও।' গাড়িটি এক লাখ টাকায় তখনই বিক্রি করে দেওয়া হল। এমনই ছিল মহারাজের নিস্পৃহতা আর আমাদের সাধুদের জন্য তাঁর শিক্ষা।

     কৃপা-বৃষ্টি : সম্ভবত ১৯৮২ বা ৮৩ সালের ঘটনা। চণ্ডীগড় রামকৃষ্ণ মিশনে আমাকে বক্তৃতা দিতে ডাকা হয়েছিল। সেখানে অমৃতসর থেকে কয়েকজন বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন তাঁরা সকলেই পূজ্যপাদ বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজের শিষ্য। তাঁদের মধ্যে একজন আমাকে এই ঘটনাটি বলেছিলেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মহারাজের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন। দীক্ষার সময় হয়তো স্ত্রীর মন ততটা সমনস্ক ছিল না। তাই তিনি মন্ত্রের ঠিক ঠিক উচ্চারণ শুনতে পাননি। অমৃতসরের বাড়িতে ফিরে স্বামী স্ত্রী আলাদা আলাদা ভাবে জপ করতেন। স্ত্রী কিন্তু কিছু বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি তাঁর স্বামীকে বিষয়টি জানিয়ে বলেছিলেন যে, দীক্ষার পর থেকেই তাঁর ওই অবস্থা হচ্ছে। স্বামী বললেন, 'এটা ঠিক নয়। দীক্ষার পর ঠিক ঠিক জপ করলে মনের অশান্তি দূর হয়। তুমি অন্য কোন কারণে অস্থির হচ্ছ।' স্বামীর এই জবাবে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না আর তার অশান্তি বেড়েই চললো। 

     এই ঘটনার কিছুদিন পরে মহিলাটি লাগাতার তিনদিন ধরে স্বপ্নে দেখলেন যে, পূজনীয় মহারাজ তাঁকে বলছেন, তুমি ভুল জপ করছ। স্ত্রীর কথা শুনে তাঁর স্বামী তাঁকে বলেন, 'তুমি স্বপ্নের বৃত্তান্ত লিখে দাও চিঠিতে, আর যে মন্ত্র জপ করছো তাও লেখ। আমি পূজনীয় গুরুদেবের কাছে পাঠিয়ে দেব।' মহিলাটি সেই সমস্ত লিখে দিলে তাঁর স্বামী তা পূজনীয় মহারাজের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ডাকে মহারাজের উত্তর এল, তাতে মন্ত্র কি ভুল ছিল তা নির্দেশ করে সঠিক মন্ত্র লিখে দিয়েছিলেন। মহিলাটি অশুদ্ধ মন্ত্র আর নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। নিষ্ঠাভরে ঠিক মন্ত্র জপের অভ্যাসের ফলে অল্পদিনেই তাঁর মনের অশান্তি দূর হলো।


৩)

     ১৯৮৪-তে বিহারের সহরসা জেলায় কোশী নদীর বাঁধ এক জায়গায় ভেঙে গিয়েছিল। শত শত লোকের বাড়ি জলে ডুবে গিয়েছিল। নিরুপায় গরিব লোকেরা বাঁচার তাগিদে বাঁধের যে দুদিক অক্ষত ছিল, সেদিকে ছুটে গিয়েছিলেন। বিহার সরকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যের জন্য বেলুড়মঠের কাছে আবেদন করেছিলেন। বেলুড় মঠ চারজন সন্নাসী এবং পনেরো জন ব্রহ্মচারীকে ত্রাণকার্যের জন্য সেখানে পাঠিয়েছিলেন। এই ত্রাণকার্য প্রায় পাঁচ বা ছয় সপ্তাহ ধরে চলেছিল। এরমধ্যে বিহার সরকার বন্যাপীড়িত গ্রামবাসীদের বিভিন্ন জায়গায় শিবির ইত্যাদিতে রাখার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। ত্রাণের সময় রামকৃষ্ণ মিশন এবং প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় রাখতে, একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রশাসনিক আধিকারিককে আমাদের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। সেই আধিকারিক জীবনে প্রথমবার রামকৃষ্ণ মিশনের সাধু-ব্রহ্মচারীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন।

     আমাদের সকলকে পুরানো জীর্ণ এক প্রশাসনিক ভবনে থাকার জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছিল। সেই আধিকারিকটি ওই জরাজীর্ণ বাড়িটিতে যা কিছু মোটামুটি ভালো জিনিস ছিল, সব নিজের জন্য নিয়ে রেখেছিলেন। আমরা সাধু-ব্রহ্মচারীরা দুটো বড় ঘরে মাটিতে শুতাম। বাইরের দিকে একটা বারান্দা ছিল, সেখানে রান্না হতো, সেখানেই আমরা খেতাম। আধিকারিকটি প্রথম তিন চারদিন অন্য কোন জায়গায় খেতেন।

     সারাদিন সেবাকার্যে ব্যস্ত থেকে সন্ধ্যার সময় যখন বাসস্থানে ফিরতাম, তখন আমরা স্নান ইত্যাদি সেরে আমাদের শোবার ঘরেই বসে মিশনের আশ্রমগুলিতে যে সন্ধ্যা আরত্রিক ভজন গাওয়া হয়, সেটি গাইতাম। সেখানে আমরা একটা কাঠের উপর ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে বসিয়ে পূজাস্থান তৈরি করে নিয়েছিলাম।

     চার-পাঁচ দিন পরে সেই আধিকারিকটি সন্ধ্যার সময় আরতি, ভজন ইত্যাদির আওয়াজ শুনে সেখানে এসে বসে পড়লেন। সম্ভবত আরত্রিকটা তাঁর পছন্দও হল। রাত্রে খাবার পর আমরা ইংরেজিতে 'গসপেল' ও স্বামীজীর কোন বই পড়তাম। সেদিন রাতে খাবার পর ওই ভদ্রলোকটি আবার আমাদের ঘরে এসে দেখলেন যে, পাঠ ইংরেজিতে হচ্ছে, আলোচনাও ইংরেজিতে। তখনও পর্যন্ত তিনি এমন সাধুদের দেখেননি যাঁরা ইংরেজিতে কথা বলেন। তিনি সাধারণত ভিক্ষাজীবী সাধুদেরই দেখেছিলেন। এইসব দেখে তিনি এত মুগ্ধ হলেন যে, আমাদের সঙ্গে থাকতে-শুতে চলে এলেন, আর খাওয়া-দাওয়াও আমাদের সঙ্গেই করতে লাগলেন। আমাদের সঙ্গে থেকে ঠাকুর মা স্বামীজী সম্বন্ধে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। এইভাবে তিনি আমাদের সঙ্গে বেশ মিলেমিশে গেলেন। আলোচনাপ্রসঙ্গে তিনি মন্ত্রদীক্ষা ইত্যাদি বিষয়েও আমাদের কাছ থেকে শুনলেন। তার মনে দীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা হল। ত্রাণকার্য শেষে আমরা বেলুড়মঠে ফিরে এলাম। মঠে আমি স্বামী প্রমেয়ানন্দজীকে (রামগোপাল মহারাজকে) ওই লোকটির পূজনীয় প্রভু মহারাজের কাছে দীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা জানালাম। স্বামী প্রমেয়ানন্দজী বললেন, 'একবার মহারাজকে বল।' পূজনীয় মহারাজ কৃপা করে তাকে দীক্ষার অনুমতি দিলেন। লোকটি যথাসময়ে বেলুড়মঠে এসে মহারাজের কাছে দীক্ষা নেন। আমি তাকে আরও কয়েকদিন মঠে থেকে প্রতিদিন গুরুদর্শন করার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি পরে কখনও মঠে আসবেন বলে ফিরে গেলেন।

     এই দীক্ষা-অনুষ্ঠান মহারাজের শেষ দীক্ষাদান। এর পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর কিছুদিন পরেই দেহরক্ষা করেন। মহারাজের দেহরক্ষার খবর অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রচারিত হলো। সেই ভক্তটি তখন এক সরকারি কাজে বিহারের কোন একটা দূরবর্তী জেলায় গিয়েছিলেন। মহারাজের মহাসমাধির খবর শুনে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। কাঁদতে কাঁদতে অনুতাপ করতে লাগলেন যে, মঠে আর কিছুদিন কেন থেকে গেলাম না! এই ভেবে তিনি সারারাত কেঁদেছিলেন। শেষে ভোর তিনটের সময় একটি চিঠি লিখে তার মনের ব্যথা আমাকে জানান। আমি সেই চিঠি পেয়ে দুঃখিত হলাম, ভাবলাম তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি লিখি। কিন্তু ব্যস্ততার জন্য সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারলাম না। এর এক সপ্তাহের মধ্যে আমি সেই ভক্তটির দ্বিতীয় চিঠি পেলাম। তার বক্তব্যের সারাংশ ছিল, 'সন্তোষ মহারাজ, সেই রাত্রে মহারাজের মহাসমাধির খবর যেদিন শুনেছিলেন, আমি মনের কষ্ট জানিয়ে আপনাকে চিঠি লিখেছিলাম। সেই চিঠি হয়তো পেয়ে থাকবেন। আপনাকে চিঠি লেখার পর কাঁদতে কাঁদতে ভোর প্রায় চারটার সময় আমার আবার ঘুম আসলো। জানিনা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। এই সময়ে আমি এক দিব্যস্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, চারিদিকে এক দিব্যজ্যোতিতে ছেয়ে গেছে। পূজনীয় বীরেশ্বরানন্দজী মহারাজ সম্পূর্ণ সুস্থ ও জ্যোতির্ময় শরীরে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। কাছে এসে হাত তুলে তিনি আমাকে বললেন, 'তুমি কেন এত কাঁদছ? দীক্ষার সময়ে আমি যা বলেছি, সেই রকম কর আর মন্ত্র জপ কর। যখন দরকার হবে, তখন আমি আবার তোমাকে বলব কি করতে হবে।' মহারাজের কথা অত্যন্ত স্পষ্ট শুনতে পেলাম আর আমার ঘুম ভেঙে গেল। তখন প্রায় সাতটা বাজে। আমার মন থেকে দুঃখ বা অনুতাপ পুরোপুরি দূর হয়ে গেছে। আমার মন আনন্দে ভরপুর আর সেই আনন্দময় মনেই আপনাকে আমি এই দ্বিতীয় চিঠি লিখছি।


                             ******************************************************

প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী




এই বিভাগে আমরা এমন দু-একটি  কবিতা পড়ব , যে-কবিতা আমাদের অন্তর্লোকে বিস্ময় সৃষ্টি করে শুধু নয় ,আমাদের কবিতা পড়ার আনন্দে অবগাহন করায় , প্রতি দিন  প্রতি মুহূর্তে | এই পর্যায়ের কবি যে সব সময়  বিখ্যাতই  হবেন , এমনটা নয় , তিনি অখ্যাত তরুণ তরুণতর কবিও হতে পারেন , কিন্তু ,শর্ত একটাই ,কবিতাটি যেন আমাদের মর্মলোক স্পর্শ করে | স্বরবর্ণ * দশ সংখ্যায় 'প্রিয় কবি  প্রিয় কবিতা ' বিভাগে আমরা পড়ছি কবি  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-র একটি বিখ্যাত কবিতা 'উলঙ্গ রাজা' যা আজকের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ----

 


নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


উলঙ্গ রাজা

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী


সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ,তবুও

সবাই হাততালি দিচ্ছে।

সবাই চেঁচিয়ে বলছে শাবাস, শাবাস।

কারো মনে সংস্কার, কারও ভয়-

কেউ বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে

কেউ বা পরান্নভোজী, কেউ

কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;

কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম,

চোখে পড়ছে না যদিও, তবুও আছে

অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।



গল্পটা সবাই জানে।

কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে

শুধুই প্রশস্তি বাক্য-উচ্চারক কিছু

আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নিবোর্ধ স্তাবকই ছিল না

একটি শিশুও ছিল-

সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।

নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়-

আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু

জমে উঠছে স্তাবক- বৃন্দের ভিড়।

কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি

ভিড়ের ভিতর আজ কোথাও দেখছি না।

শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোন

পাহাড়ের গোপন গুহায় লুকিয়ে রেখেছে?

নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে

ঘুমিয়ে পড়েছে কোন নির্জন নদীর ধারে কিংবা

প্রান্তরের গাছের ছায়ায়


যাও, তাকে যেমন করেই হোক খুজেঁ আনো।

সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে নির্ভয়ে দাঁড়াক।

সে এসে হাততালির উর্ধ্বে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করুক;

রাজা, তোর কাপড় কোথায়?


*********************************************************************************************



************************************************************************************************


উপন্যাস * দেবাশিস সাহা



[পূর্বানুষঙ্গ : ডিসেম্বরের শেষাশেষি। কোনও এক ছুটির দিনে, অশোক পড়ার টেবিলে বসে, না-পড়া বইগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে কোনটা পড়বে। হঠাৎ চোখ যায় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত বইটির দিকে। মনে পড়ে, এই বইটার শেষ কিছু পাতা পড়া বাকি আছে। সেটাই পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তে এতটাই তন্ময় হয়ে যায় স্থান কাল পাত্র ভুলে, মনে হয় সে-ও সশরীরে শ্রীরামকৃষ্ণ-বঙ্কিম-শ্রীম সকলের মধ্যে উপবিষ্ট। এক অপার্থিব আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় ওর মনে। এই ঘটনারই দু'চার দিন পর.....]


ধুলোর সিংহাসন 

দেবাশিস সাহা  

পর্ব * দশ  


বালিকা গোপাল

গৌরীশঙ্কর দে 


প্রথম কী নামে ডেকেছিলাম তোমাকে

আজ মনে নেই। শুধু মনে আছে লাল

মুখবিবরের বিশ্বরূপ তুমি যাকে

দেখিয়েছিলে, সে আমি তোমার বিশাল

উদ্ভাসের সুরেলা ঝঙ্কার। চিরকাল

নিজের অবদমিত ম্লান প্রত্যাশাকে

জ্বলে উঠতে দেখেছি -- ' বালিকা গোপাল

অদম্য তোমার তেজোময় নিশিডাকে।


বাবা আমি ছিলাম যতো না  তার চেয়ে

যশোদা ছিলাম বেশি। উড়ে উড়ে পাখি,

হাতের নাগাল ছেড়ে অজানা সফরে

গেলে দূরে,কাঙাল বাবার সোনা মেয়ে

জানি কিছু দিতে আমি পারিনি,জোনাকি

আলোটুকু রেখে গেছো বাবুইয়ের ঘরে।



'আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে' আবহাওয়ার পূর্বাভাস তেমনটাই ছিল।পেপারে দেখেছিল সকালে। কিন্তু 'অংশত' কোথায়,পথে বেরিয়ে অশোক-অলি দেখছে সারা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। উত্তরে হাওয়ার শিরশিরানির সঙ্গে সঙ্গে যে-কনকনে ঠান্ডাটা দু'দিন আগেও রীতিমতো হাড় কাঁপাচ্ছিল, আজ তা একেবারেই উধাও। বাড়ি থেকে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত মিনিট পাঁচেকের এই হাঁটা পথটুকু আসতেই হাঁসফাঁস অবস্থা। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। জ্যাকেটের  তলায় বগলটাও ঘেমেছে অল্প অল্প। জামার কলারটা ভেজা ভেজা। এখন মেট্রোর এসিতে বসতে খানিকটা স্বস্তি। সত্যি, বছর কয়েক ধরে আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনা যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরফ-শীতল উত্তরে হওয়ার পথ আগলে হয় পশ্চিমী ঝঞ্ঝা, নয়তো শীতের কান মুলতে উদ্যত বঙ্গোপসাগর কি আরব সাগরে হঠাৎ সৃষ্ট নিম্নচাপ। কলকাতায় এমনিতেই শীত ক্ষণস্থায়ী , তার উপর এই চাপাচাপির জেরে,সোয়েটার-জ্যাকেটের ভাঁজ খুলতে না-খুলতেই শীত পগারপার। এ-সবই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কুফল। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ধ্বংসের পরিণাম। ফি বছর ছাত্রদের পড়িয়ে আসছে অশোক।


           আবহাওয়ার এই দুর্যোগ কতক্ষণে কাটবে বা আদৌ কাটবে কিনা,কে জানে! অথচ কত আশ্বাস নিয়ে রোদ ঝলমলে দিনটা শুরু হয়েছিল। ঘুম ভাঙলেও, তখনও বিছানা ছাড়েনি অশোক। গেরস্থালির কাজে নেমে পড়েছে অলি। উপমা তখনও ঘুমিয়ে। অলি সাবধান করে গেছে , ঘুমোচ্ছে ঘুমোক, ডেকো না, রবিবার তো, আজ কোচিং ক্লাস আছে ,ফিরতে দেরি হবে। অশোক তাই বিরক্ত করছে না উপমাকে। অন্যদিন হলে এতক্ষণ ' উঠো  উঠো  গো ভারত-লক্ষ্মী ' না না, 'ভারতলক্ষ্মী'র জায়গায় ' উঠো  উঠো  গো অশোকলক্ষ্মী' বলে বেসুরো চিৎকার জুড়ত। আর অমন সারমেয় চিৎকার শুনে উপমাও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারত না, বাবার দিকে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে উঠে পড়তে বাধ্য হত। ইচ্ছে হলেও অলির বারণে আজ তা করতে পারছে না। কাজেই ইচ্ছেটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এল দক্ষিণের জানালায়। একফালি শিশু রোদ্দুর হামা দিচ্ছে বিছানায়। দু 'তিনটে চড়ুই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে এসে জানলার গ্রিলে কিচকিচ শুনিয়ে ফের গিয়ে বসছে সানসেডে। দেহটা কোনোরকমে বিছানায় রেখে অমনি অশোকের মনটাও চড়ুই হয়ে ফুড়ুৎ। একেবারে সানসেডে।


 এমন মনোহর প্রভাতী দৃশ্যে হঠাতই অলির অনধিকার প্রবেশ, 'শোনো শোনো,চোখটা একটু বন্ধ করো।'

'কেন?'

' করোই না।' চাপা উচ্ছ্বাস অলির।

চড়ুই পাখির কাছ থেকে মনটাকে কেড়ে এনে চোখ বন্ধ করে অশোক।

'এবার হাত পাতো।'

মুঠো খুলে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় অশোক। হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে মুঠো বন্ধ করে ফের বলে ওঠে অলি , 'এবার চোখ খোলো। ' চোখ খুলতেই হতবাক অশোক, মুঠোভর্তি কতকগুলো পাঁচশো টাকার নোট!

'কে দিল?'

' আরে,দরজা খুলে ঝাড় দিচ্ছি, দেখি বন্দনা -চন্দনার বাবা। বললাম,দাদা ভিতরে আসুন,তা আসতে চাইল না। বলল ,না ম্যাডাম, একটু বাজার যাব,স্যারকে বলবেন,গতমাসের আর এই মাসের ওদের দুজনের দু'মাসের মাইনেটা দিয়ে গেলাম। আমরা শিমলা যাচ্ছি, দিন পনেরো থাকব না। তাই মাইনেটা দিয়ে গেলাম।'


কম্বলটা এক ঝটকায় সরিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে অশোক।

' টাকাটা গুনেছো?'

'এক.. দুই..তিন... আটটা পাঁচশো টাকার নোট, তার মানে, পাঁচ আটে চল্লিশ... চার হাজার টাকা।'

' অলি, তাড়াতাড়ি চা-টা বসাও , চা খেয়েই বাজারে যাব।'

' কী আনবে বাবাই?' উপমাও উঠে পড়েছে ঘরভর্তি অযাচিত লক্ষ্মী আসার উচ্ছ্বাসের ছড়াছড়িতে।

' মাংস।'

 ' কীসের? '

' কী খাবি বল, চিকেন, না মটন?'

' মটন।'

' অত বড়লোকি চাল কোরো না, একদিন খেলেই হবে? চিকেনের পাঁচগুণ বেশি দাম মটনের। কী দরকার, চিকেনই আনো না।'

'না,মটন আনবে।'

মেয়ে আর বউয়ের সাঁড়াশি চাপে নাজেহাল অশোক 'আচ্ছা দেখি,আগে বাজারে তো যাই।'

 

'আগলা স্টেশন কালীঘাট 'পাশের সিটে বসা ঝিমন্ত লোকটা তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে অশোকের চশমায় দিল জোর এক গুঁতো। ছিটকে পড়ল চশমা। ভাবনা ঘেঁটে ঘ। ' কী দাদা মেট্রো তো গড়ের মাঠ,তবু গুঁতোটা লাগাতেই হল!' বিরক্ত অশোক। উল্টো দিকের সিটে বসেছিল অলি, দৌড়ে এল, ' লাগেনি তো?'

' না।' চশমাটা চোখে সেট করতে করতে বলে অশোক।এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন যাত্রী উঠে পড়ল হুড়মুড় করে। প্রায় প্রত্যেকের কপালেই লাল টিপ, মায়ের মন্দির দর্শন করে ফিরছে। দু'একজনের হাতে ছাতা। জল গড়াচ্ছে টপটপ করে। তার মানে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে বাইরে।


'নেক্সট স্টেশন ইজ যতীন দাস পার্ক ' ছুটতে শুরু করেছে মেট্রো। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর একটু গড়াগড়ি দিয়েই বেরিয়ে পড়েছে দুজন। মেট্রোর দুলুনিতে চোখটা জড়িয়ে আসছে। ঘুমে নয়,আরামে।


বাজার থেকে ফিরতে না ফিরতেই অলির প্রশ্ন, ' কী আনলে?'

'মটনই আনলাম একটু, অল্প করে।'

' জানি তো মেয়ে বলেছে, টাকাও আছে হাতে,অশোক বোসকে আজ আর কে পায়!'

' আরে না না ---' আরো কি বলতে যাচ্ছিল থামিয়ে দিয়ে অলি বলল, ' তা বেশ,মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করলে, এবার আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করো,দেখি।'

'তোমার আবার কী ইচ্ছে,শুনি।' সচরাচর অলি মুখ ফুটে কোনদিনই কোনো ইচ্ছের কথা অশোককে বলে না। অশোকের ছেঁড়া পকেট আরো ছিঁড়বে এই আশঙ্কায়। আজ কী হল!

'একটা চটি কিনে দাও, হাওয়াই চটি পরে সব জায়গায় যাওয়া যায়!'


' চটি? চলো, এক্ষুনি কিনবে চলো।' অশোক যেন আজ কল্পতরু।

'এক্ষুণি ! উঠল বাই তো কটক যাই।এখন বেরোলে হবে! ভাত ফুটছে। মেয়ে একটু কিছু খেয়ে ক্লাসে যাবে তো, ন'টা বাজে প্রায়, আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোবে বলেছে। '

' কেন?'

' বড়দিনের জন্য আজ নাকি এক ঘন্টা আগে ক্লাস শুরু হবে, দশটা থেকে।'

' তাই বলে এক ঘন্টা আগে ছুটি হবে?'

' আমি জানি না, মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো। '

'ঠিক আছে , সে এক ঘন্টা আগে পরে যা হওয়ার হবে। কিন্তু কথা হল,এই অল্প সময়ের মধ্যে মাংস রান্না করবে কী করে ?'

'দেখি, প্রেসারে দুটো সিটি দিয়ে নেব।'

'না মা,তাড়াহুড়ো কোরো না,তাহলে টেস্ট ভালো হবে না। আমি রাতে এসেই খাব।' ড্রেস করতে করতে বলে উপমা।

'তাই করো,ধীরে সুস্থে রান্না করো,উপমা ফিরলে  রাতে তিনজনে একসঙ্গে খাব।'

' না বাবাই,তোমরা দুপুরে খেয়ে নিয়ো গরম গরম।' 

'আচ্ছা,সে দেখা যাবে।'



' তাহলে চটি কখন কিনতে যাবে?'

' বিকেলে এক ফাঁকে যাবখন,কাছেই তো নতুন বাজার।'

' নতুন বাজার থেকে কিনবে!এখানকার চটি দু'দিন বাদেই ফটাস। তারচে বরং -- '

' বরং কী,কোথা থেকে কিনবে?'

'ধর্মতলা থেকে ' তারপর কী যেন একটু ভেবে অশোক যোগ করে 'একটু তাড়াতাড়ি বেরোব, শ্রীলেদার্স থেকে তোমার চটি কিনে, মৌলালি থেকে উপমাকে নিয়ে তিনজন একসঙ্গে ফিরব।'

' তা মন্দ বলোনি, ইনস্টিটিউশনে একটু খোঁজখবরও  নেওয়া যাবে,উপমা কেমন পড়াশোনা করছে, কামাই টামাই করছে কিনা।'


উপমার ভাত বাড়ে অলি। ' মা দেরি হয়ে যাচ্ছে , তুমি খাইয়ে দাও।'

বাধ্য মেয়ের মতো অলি উপমাকে এক গ্রোস করে খাইয়ে দিতে থাকে, যেমন দিয়ে এসেছে গত কুড়ি বছর,প্রায় প্রতিদিনই। উপমা যখন ছোট ছিল অশোকও আগে মাঝে মাঝে খাওয়াত, অলি কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলে। মায়ের কাছে বায়না করলেও অশোকের কাছে কিন্তু উপমা চুপটি করে খেত। কারণ,অশোকের খাওয়ানোর কায়দাই ছিল আলাদা। বিচিত্র সব গল্প বলে, কখনো আলিবাবা চল্লিশ চোর,তো কখনো অবীন ঠাকুরের বুড়ো আংলা কি শকুন্তলা আবার কখনো-বা সুকুমার রায়ের হ য ব র ল-র গল্প বলে বলে খাওয়াতো । গল্প শুনতে শুনতে কখনো কখনো বেশি খেয়ে ফেলে উপমা হাঁসফাঁস করত। অশোকের খুব আনন্দ হত, আজ ওর পেটটা ঠিক ভরেছে। পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিত অলি।


 ' বাবাই আসছি ' খাওয়া শেষ করে, বইপত্র নিয়ে তাড়াহুড়ো করে উপমা বেরিয়ে যায়।ব্যালকনি থেকে টা-টা করতে থাকে অলি।

ঘরে এলেই অলিকে প্ল্যানটার কথা বলে অশোক। সেই প্ল্যান অনুযায়ী দুপুর দুপুর বেরিয়েছে, পথিমধ্যে  দুর্যোগ নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ে।

'কোন জগতে থাকো, ধর্মতলা এসে গেছে, নামো নামো ' অলির সজোরে চিমটি অশোকের কাঁধে।


ট্রেন থেকে নেমে উপরে উঠে ওরা। বৃষ্টি!বৃষ্টি! বৃষ্টি! এ অকাল বরিষণ থামবে কখন! ' ছাতা এনেছো অলি?' 'তখন কি বৃষ্টি পড়ছিল,আনব।'

'তুমি আঁচলটা মাথায় দাও,চলো ভিতরটা দিয়ে একটু এগিয়ে ওই মোড়টাতে গিয়ে দাঁড়াই।'

' তুমি রুমালটা মাথায় দাও।'

' দিচ্ছি। ওখান থেকে শিয়ালদার কোনো গাড়িতে উঠে পড়ব। উপমাকে নিয়ে ফেরার পথে আবার তো এখানেই নামতে হবে,তখন তোমার চটিটা কিনে নেব।'

' সে দেখা যাবে,এখন তো চলো।'


রবিবার। রাস্তাঘাট এমনিতেই ফাঁকা। তার উপর নিম্নচাপের ভ্রুকুটি। গাড়ি-ঘোড়া অনেক কম। দু'পাশের দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। ফুটপাথগুলো খাঁ খাঁ করছে যেন। পাঁচটা বাজেনি, মনে হচ্ছে চতুর্দিকে রাত বারোটার ইশারা। যদিও বড়দিন উপলক্ষে আলোর খামতি নেই। তবুও কেমন যেন থমথমে চারিধার। লোকজন না থাকলে যেমন হয়।


'মৌলালি-শিয়ালদা,শিয়ালদা-মৌলালি..' বাসের দরজা চাপড়াতে চাপড়াতে হাঁক পাড়ছে কন্ডাকটর। ' ও ভাই কন্ডাকটর রোক্কে রোক্কে ' হাত দেখিয়ে অলিকে নিয়ে কোনোরকমে বাসে উঠে পড়ে অশোক। বেশিরভাগ সিট ফাঁকা। সাকুল্যে পাঁচ সাত জন যাত্রী। অশোক-অলি বসল জানালার পাশের সিটটাতে। অলির শাড়ির আঁচলের অনেকটা ভিজে গেছে। চুল বেয়ে জল গড়াচ্ছে নাকে- মুখে। রুমালটা নিংড়ে অলির হাতে দেয় অশোক ,  ' মুছে নাও, নয়তো এক্ষুণি হাঁচতে শুরু করবে।'


'ও কিছু হবে না, শুকিয়ে যাবে। '

' ওই তোমার এক বুলি,কিছু হবে না, কেন পুরী থেকে ফিরে ক'দিন আগে  ভুগলে না , ভুলে গেলে?'

এই মৃদু ধমকে কাজ হল। টিপ, সিঁদুর অক্ষত রেখে আলতো করে চুল থেকে গড়ানো জলটা মুছে নেয় অলি।

'মৌলালি মৌলালি...নামুন নামুন ' কন্ডাকটর হাঁক পাড়ে। নেমে পড়ে অশোক-অলি। দু'পা এগোলেই  "এসপিরেশনস " উপমার চাকরির পরীক্ষার ইনস্টিটিউশন। ক্লাস করছে উপমা। পাঁচটায় ছুটি হবে।

'কী গো, এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে! '

'লাগবে না, ধর্মতলার মোড়ই কত ফাঁকা,দেখলে না। তাঁর উপর আবার রোববার!'

'রোববার তো কি হয়েছে! এর আগেও তো দু-একবার এসেছি তোমার সঙ্গে, আর সব বন্ধ থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীর ভিড় রাস্তায় উপচে পড়ে। আজ এত ফাঁকা কেন?'

' চলো না, ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করি।'


ইনস্টিটিউশনের গা ঘেঁষে লম্বা রাস্তা। অশোক-অলি  এগোতে থাকে। ডানদিকে ঢোকার মুখে বড় কলাপসিবল গেট। তালা বন্ধ। ভেতরে একজন  গেটকিপার বসে। খৈনি ডলতে ব্যস্ত।


'আচ্ছা ভাই,কোচিং ক্লাস কখন ছুটি হবে?'

'সাব,আজ তো ক্লাস ছুট্টি আছে।'

' ছুট্টি!কিউ?কিসলিয়ে?'

' কিউ কি,ও ক্রিসমাস হ্যায় না,ইসিলিয়ে এ হপ্তা ক্লাস বন্ধ আছে।'

'এ হপ্তা! '

'জী সাব। পিছলে বৃহস্পতিবার ভি বন্ধ থা।'

'সে কী!' অলির মাথায় যেন বাজ পড়ে।

' উপমার ফোনে ফোন করো তো।'

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অলি। ব্যাগ থেকে কোনোমতে ফোনটা বার করে। হাত কাঁপছে রীতিমতো,ডায়াল করতে পারছে না।


'দাও, আমার কাছে দাও।' অশোক ডায়াল করে।

'রিং হচ্ছে?' উৎকণ্ঠা অলির স্বরে।

' হাঁ।' গম্ভীর অশোক।

'কোথায়, তুই?'

' ক্লাসে।'

' ছুটি হবে কখন?'

' আধঘন্টা পর।'

' ঠিক আছে,আমি-মা নীচে দাঁড়িয়ে আছি, এসো।' শান্ত নিরুত্তাপ অশোক। বুঝতে দেয় না মেয়েকে,কী ভাবে সুনামির তীব্র ঢেউ আছড়াচ্ছে ওর বুকে। দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। ক্রোধে? উদ্বেগ- উৎকণ্ঠায়? কীসের অভিঘাতে ঠিক বুঝতে পারে না।  মুহুর্মুহু অগ্ন্যুদগীরণ ঘটছে পাঁজরে, টের পায়। 


এইবার ক্ষেপে যায় অলি। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিল সাময়িক। মনে শক্তি সাহস সঞ্চয় করে অশোকের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ফের ডায়াল করে, দ্য ফোন ইউ আর ট্রায়িং ইজ সুইচড অফ। দ্যাখো, কী বদমাশ মেয়ে,ফোন সুইচড অফ করে রেখেছে। বিড়বিড় করে অলি।


কী করা উচিত এই মুহূর্তে,বুঝতে পারছে না অশোক। মিসিং ডায়েরি করবে লালবাজারে গিয়ে? ১০০ নম্বরে ডায়াল করে পুলিশ ডাকবে? থানা -পুলিশ, কোর্ট-কাছারি করে আদৌ লাভ হবে! এতটা অবাধ্য,এতটা অ্যারোগান্ট হয়ে গেছে তাদের উপমা! সব প্রশ্নের উত্তর,সব ক্ষোভ-বিক্ষোভ ক্রোধে রূপান্তরিত হচ্ছে ক্রমশ। এ দিকে বৃষ্টি পড়ছে সমানে।দু'জনেই ভিজে নেয়ে একশা। তবু ক্রোধের আগুন নিভছে না !


' বড়দিকে একটা ফোন করো তো' সাথে সাথে অপর্ণাকে ডায়াল করে অলি। পেয়েও যায়। জানায় সবকিছু। মুহূর্তমাত্র চুপ করে থেকে অপর্ণা বলে, ' অলি, অশোককে খেয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলো, আমি উপমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।' 

'আমরা কতবার ফোন করছি বড়দি, ধরছে না' কান্না জড়ানো গলা অলির।

'কেঁদো না অলি, শক্ত হও, তোমরা যেখানে আছো ওখানেই দাঁড়াও,আমি যোগাযোগ করে উপমাকে পাঠানোর চেষ্টা করছি।'


 ' ভিজে যাচ্ছি তো আরো, ওই ফুটে একটা চায়ের দোকান খোলা আছে মনে হচ্ছে,উপরে প্লাস্টিকের সেড, চলো ওখানে গিয়ে দাঁড়াই।' অশোকের হাত ধরে টানে অলি। যন্ত্রচালিতের মত এগোয় অশোক।


' আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান...' অলির ফোন। 'কে দ্যাখো তো, উপমার?' রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে দুইজন।

' না বড়দি..'

'ধরো' ঠিক এই সময়ে বিকট ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা ফোর হুইলার। ড্রাইভার মুখটা বাড়িয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে, 'ও কাকা,এই বয়সেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে লীলে করছেন! এক্ষুনি চাকায় পিষ্টে যাচ্ছিলেন যে।'

'সরি ভাই, সরি ।'

' সরি বলা বেরোত,ভাগ্যিস ব্রেকটা ধরল, তা না হলে,ভবলীলা সাঙ্গ হচ্ছিল আজই।' পেছনের সিটে হেলান দেওয়া ভদ্রলোকটি বলল।

কাচুমাচু অশোক-অলি ত্রস্ত রাস্তা পেরোয়। ' হ্যাঁ বড়দি বলো, বলো...'

' উপমাকে ফোনে পেয়েছি, বলেছি --এক্ষুনি যাও, বাবা-মা এই বৃষ্টিতে ঘন্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে আছে। তার পর এই টেনশন..বাবার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, ভালো লাগবে! শিগগির যাও।’

' আসছে তাহলে?'

' বলল তো যাচ্ছে, তোমরা দাঁড়াও আর অশোককে বলো যেন মাথা ঠান্ডা রাখে।'


চায়ের দোকানে শেডের তলায় দাঁড়ায় দু'জনে। 'কাঁপছ তো ঠান্ডায়, একটু চা বলি ' অশোক হ্যাঁ না কিছুই বলে না।

'ভাই, দুটো চাঁদ দাও না। '

' লাল চা, না দুধ চা?'

' যা খুশি দাও।'

 ' চিনি ছাড়া, না চিনি দেওয়া?'

' বললাম তো,যা খুশি দাও,শুধু গরম হলেই চলবে।' চাওয়ালা অবাক হয়ে তাকায়। ভাবখানা এমন এ কেমন খদ্দের !

চা রেডিই ছিল,গরম করে দোকানদার দু'ভাঁড় চা  এগিয়ে দেয় দু'জনের হাতে। হাতেই ধরা থাকে চা, মনে জট পাকায় চিন্তার জাল, কোথায় যেতে পারে উপমা,বন্ধুর বাড়ি? চিড়িয়াখানা?ভিক্টোরিয়া?সায়েন্স সিটি?নিকোপার্ক? প্রেম করছে কারো সঙ্গে ,কই অলি তো কোনোদিন কিছু আভাস দেয়নি, তাহলে কেন উপমা এইভাবে মিথ্যে কথা বলে এসেছে দিনের-পর-দিন। হাতেই ধরা চায়ের ভাঁড়। আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে অশোক।

'কী গো,চা-টা মুখে দাও ,ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।'


' ও জীবন রে, ছাড়িয়া যাস না মোরে / তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে মাইনষে কইবে মরা জীবন রে....' কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে এই উথালপাতাল লোকগীতির সুর। অশোকের ক্রোধের উপর শিশিরের প্রলেপ দিচ্ছে যেন সুরটা। সত্যিই তো কাম, ক্রোধ,লোভ,জ্বালা-যন্ত্রণার বশবর্তী হয়ে এ জীবন ছেড়ে চলে গেলে কী দাম থাকে জীবনের। ক্রোধ প্রশমিত করার চেষ্টা করে অশোক। সিনেমায়, বাস্তবে এমন হামেশাই দেখা যায়,অপ্রত্যাশিত মানসিক আঘাত সামলাতে না পেরে কত লোক হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যান।


হঠাৎ খানিকটা দূরে ব্রেক কষে একটা বাইক এসে দাঁড়াল যেন। অলি দেখে বলল, 'ওই তো উপমা, বাইক থেকে নামছে।ওর সামনে একটা ছেলে। মাথায় হেলমেট।এত ঔদ্ধত্য !  আশোক সামলাতে পারে না নিজেকে।দু'পা এগিয়ে উপমার গালে ঠাস করে চড় কষায়, 'কোথায় ছিলি সারাদিন?'


ছেলেটি ততক্ষনে হেলমেট খুলেছে। দুই হাতে উপমাকে আড়াল করে বলছে, 'স্যার ওকে মারবেন না,আমাকে যত খুশি মারুন।'এগিয়ে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়ায় অশোকের সামনে।এতক্ষণে ছেলেটিকে চিনতে পারে অশোক। বছর দশেক আগে ওর কাছেই পড়তো।নামটা কি মনে করতে পারছে না এই মুহূর্তে।


 'কে তুই?তোকে আমি চিনি না।' বলে উপমাকে ফের মারতে উদ্যত হয়, 'এইভাবে তুই আমাদের চিটিং  করছিস।'' অলি জাপটে ধরে অশোককে। প্রাণপণ ঠেকানোর চেষ্টা করে।খোলা মঞ্চে এমন দুর্যোগের মধ্যে জীবনের জটিল অংক মঞ্চস্থ হতে দেখে, কৌতূহলী দু'একজন দর্শক বৃষ্টি মাথায় দাঁড়িয়ে গেছে কাছে-দূরে।ফুটপাতবাসী একজন আরেকজনকে বলছে, 'প্রেম কাহানি,লায়লা-মজনু ।''

অলি উপমার হাত ধরে টানে, ' চল,বাড়ি চল।'

'না,আমি যাব না। বাড়ি গেলে তোমরা আমাকে আটকে দেবে।'


 'তোমরা আমাকে আটকে দেবে' কথাটা যেন বুলেটের মতো অশোকের বুক ফুড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল। বাড়ি উপমার কাছে জেলখানা! এ কোন রক্তে রক্তাক্ত হল ওর পঞ্চাশোর্ধ জীবন,বুঝতে পারে না অশোক। অভিমানাহত, ক্ষতবিক্ষত বুকটাকে কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।


অশোক-অলি কারারক্ষী,বাবা-মা নয়,উপমার কাছে! তুমুল কান্নার বৃষ্টি নামল বুকের ভেতর। বাইরের প্রকৃতির অঝোর ধারা আর অন্তর্নিহিত কান্নার বৃষ্টি দুইয়ের মিলিত জল অশোকের রক্তাক্ত বুক ধুয়ে দিতে পারল না। অলি অনুনয়-বিনয়,কাকুতি-মিনতি করে চলেছে, ' চল, বাড়ি চল।'

' না, আমি আর বাড়ি যাব না। তোমরা চলে যাও।'

' কী বলছিস তুই? বাবার এমনিতেই শরীর ভালো না যদি কিছু একটা হয়ে যায়।'

' কিছু হবে না, তোমরা চলে যাও।' ঘন্টাখানেক ধরে অলি বোঝানোর চেষ্টা করল। উপমা বুঝল না, বাইকে উঠে চলে গেল।বিষণ্ন মর্মাহত অলি এসে দাঁড়াল অশোকের সামনে, ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল ' এল না, চলে গেল!'


 'চলে গেল!' অস্ফুটে কথাটা বলে ধপাস করে বসে পড়ল অশোক। চায়ের দোকানের সাউন্ডবক্সে তখন বাজছে অন্য গান ...' মুকুটটা তো পড়ে রইল,রাজাই শুধু নেই...'


 'ওঠো,বাড়ি যাই।'

'বাড়ি!কোথায়?' কথাটা বলেই মুহূর্তে সামলে নেয়, ' যাব,একটু বোসো।'

' কি কাকি, কাকুর শরীর খারাপ লাগছে?'

' না, একটু বসি?'

' বসুন না, বিষ্টি-বাস্টার দিন খদ্দের কোথায়!গান শুনছি।

' গানটা বন্ধ করবে প্লিজ ভাই! ' অশোকের কাতর অনুরোধ। এমনিতেই গানটার সুর দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে ভিতরে, অসহ্য লাগছে কানে শুনতে।'পাগল টাগল নাকি 'দোকানদারের চাহনিতে বিস্ময়। তবুও কী ভেবে সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করে লোকটা । ২৫ বছর ধরে তিল তিল করে যে মুকুট গড়ে তুলেছিল, যে পরবে সেই তো চলে গেল। সব সিংহাসন আসলে ধুলোর সিংহাসন। বিধ্বস্ত অশোক ধীরে ধীরে হাতটা বাড়িয়ে দেয় অলির দিকে, ' চলো বাড়ি যাই। '



ওরা বাড়ি এল। উপমা এল না। ঘরে ঢুকতেই ব্যথাটা লক্ষ লক্ষ সূচ হয়ে বিধঁতে লাগল । পাঁজরে? ফুসফুসে? অশ্রুগ্রন্থিতে? সর্বশরীরে? না,শরীরে নয়,আত্মায়-- যেখানে,অশোক জানে,চুপটি করে শুয়ে আছে তার একান্ত আপন হোমাপাখিটি ।যন্ত্রণায় মুখ ঢেকেছে সে-ও? ঢাকতে পারছে না অশোক... ওই উপমার বইপত্র, ছবি আঁকার খাতা, রং-তুলি পেন- পেন্সিল,ওই হারমোনিয়াম গিটার, পুজোয় কেনা লেহেঙ্গা,চিরুনি লিপস্টিক, চুল বাঁধার গার্ডার,পায়ের তোড়া, নুপুর.... সারা ঘরে ছড়ানো ছেটানো অজস্র উপমা...তারা কখনো হেসে উঠছে...জড়িয়ে ধরছে অলিকে.. ঘোড়া বানাচ্ছে অশোককে....লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে... আদরে আবদারে অতিষ্ঠ করে তুলছে ২০৬ খানা হাড়...  স্নেহের পুত্তলি হয়ে হুটোপাটি করছে এঘর ওঘর... কারো মুখে ভাষা নেই..চারটি চোখ যেন শূন্যতার চারটি সমুদ্র..শূন্যতার এত ভাষা থাকে,কথা বলে অনর্গল.. কথা বলে বলে কেড়ে নিল অশোক-অলির বাকি রাতটুকু...


বাইশ বছরের মধ্যে এই প্রথম একটি রাত পেরোল, যে-রাতে দু'হাতের সীমায় উপমা নেই...পুবের আকাশ ফর্সা হতেই ডুকরে কেঁদে উঠল অলি, উপমাহীন আরো একটা দিন আসছে....চোখের অশ্রুনদী কোনোরকমে সামলে, অলির মাথায় কোমলস্পর্শ বুলিয়ে অশোক বলল 'ভোর হয়েছে, অলি ওঠো।'

             

 **************************************************************************************************

**  দু'বছর ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবার পর, ধুলোর সিংহাসন উপন্যাসটির অন্তিম পর্ব আজ শেষ হল।                     

***************************************************************************************************


***********************************************************************************************************

উপন্যাস * দীপংকর রায়



[ 'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৭   

দীপংকর রায়


সে অত্যন্ত সৌখিন মানুষ। জানি না এতদিন তার চোখে পড়েনি কেন এসব । ইদানিং কিছুদিন দেখছি নতুন গোরু লালি আসার পর থেকেই তাঁর নজরটা ঘুরে গেছে । কোথায় তাদের খাবারদাবার সস্তায় পাইকারি দামে পাওয়া যায় , খড়-বিচালীরই বা কোথায় দাম কম ; পন্ডিতের দোকান ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় কি কমে মেলে ------ সে সেইসবের খোঁজই জানায় এসে । বলে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে ।

             খোঁজখবর নিই এখান সেখান থেকে। এবং খোঁজ পাওয়ার পরে শঙ্কর, ফোচন, ওদের সঙ্গে করে ঘুরে আসি , দাম-দস্তুর যাচাই করে।  

            সব সামলেও শরৎ রচনাবলীর প্রথম খণ্ড শেষ করে ফেলেছি। দ্বিতীয় খন্ডও এসে গেছে । অবসর মতো নয় , একেবারে নিয়ম করে , গোরু-বাছুর পরিচর্যা পর্ব সকালে মিটে গেলে কাজের দিদির সঙ্গে, একেবারে স্নান-টান করে নিয়ে দুপুর বেলায় খাওয়ার আগে পর্যন্ত যেন পাঠ্যবই-এর পড়াশোনা চলছে এরকম একটা ভাব নিয়ে শুরু হয়ে যায় পড়াশোনা । 

            বন্ধুবান্ধবেরাও এই সময়টায় আজকাল আর এদিকে ঘেঁষে না । আসে শুধু ফোচনের ঠাকুমা । সে আর কাজের দিদি বারান্দায় লুডুর কোট বসায় । তার ভাজা মশলা দিয়ে পান চিবানোর গন্ধ আসে । কেন জানি না তার কাছে শুনি , ও ঠাকুমা , এই মশলা তুমি কনে পাও ?

            সে বলে , ও বানায়ে নি রে ভাই , নানা ঝক্কি রইছে , নানা কসরৎ রইছে এতি , বছ্ছ কি না , অনেক সময় যায়, বুড়ায় তো বকবক করে মাথা খারাপ করে দেয় .... কি আর করি তাই কও ;  কোক গে  ,  ও দিদি , নেও দান চালো দেহি , এই ছক্কা ..... 

            কোথা দিয়ে সময় পার হয়ে যায়।

            আস্তে আস্তে কীভাবে কখন যেন পাকা গোয়ালা হয়ে উঠছি । ভগ্নিপতি ডেয়ারি ফার্মের স্বপ্ন মাথার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে । তারা শাখাপ্রশাখা মেলে ধরছে । দরমার দোকান খুঁজে পেতে অর্ডার দিয়ে দিলাম । 

             সে বললো , পিঠের বেড়ার কথা বলেছিস তো ? দেখিস বুখোর বেড়া যেন না দেয় ।


             মনে মনে ভাবি, কিছু বলি না তাকে । ভাবি , এসব পিঠ বুখো , এইসব এই মানুষটি চিনলো কী করে রে বাবা ! একেবারে কলকাতার হাড়-পাজরার ভেতরে জন্মে এই মানুষটি এসব কী করে জানতে পারে ! ভাবি , একদিন জিজ্ঞাসা করবো সে কথা । 

            একদিন ছুটির দিনে এসে সে দেখে গেল ফলস্ সিলিং লেগে গেছে । জিজ্ঞাসা করলো , মিস্ত্রি কতো কি নিলো রে ?

            বললাম , মোট সাতশো আশি । লেখা আছে খাতায় ।

             সে বললো , বাকি আছে কিছু ? এই নে চারশো । বাকিটা মাস পড়লে দিয়ে দিবি । আমি দিয়ে দেব পরের দিন এসে না হয় । আচ্ছা থাক গে , বাকি রেখে দরকার নেই ...... আচ্ছা শোন , ইটের দাম হাজার কতো নেয় এখানে শুনিস তো । কয়েক হাজার ইট কিনে গোরুর ঘরের সোলিংটা আর বাথরুমটা ঠিক করা যায় কিনা দেখা যাক । একেবারে পাকা একটা এস্টিমেট নিয়ে নিবি । বলবি মিস্ত্রিকেও, এর পরে একটাকাও বেশি লাগলে দিতে পারবো না কিন্তু ।

            ডাকপিয়োন এখানে আসার পরে আজই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলো ছাই-সুড়কি বিছানো পথ পেড়িয়ে দুপুর বেলায় চিঠি পৌঁছিয়ে দিতে । খামের উপরে ঠিকানায় হাতের লেখা দেখেই বুঝতে পেরেছি , হ্যাঁ ---- এ তো সঞ্চয়েরই হাতের লেখা ! 

             দিদিমার চিঠি এসেছে সঞ্চয়ের হাতের লেখায় --- ওই লিখে দিয়েছে তাকে । দিদিমা লিখেছে দেখছি ---- স্নেহের মা অঞ্জলী , তোমার বড় ছেলে এখান থেকে যাওয়ার পরে আর কোনো যোগাযোগ তোমাদের সঙ্গে আমার হয়নি । শুধু মাত্র কাইলের মুখ দিয়ে যেটুকু জানতে পেরেছি তোমাদের কুশল । তারপরে তোমার ছোটো ছেলে তার সঙ্গে এসে উপস্থিত হলো । তাও তোমাদের তরফ থেকে কোনো খোঁজ খবর নেবার প্রয়োজন অনুভব করলে না তোমরা ! 

             এবার সে তো এলো ; কয়েকটা দিন ভালোই ছিল । কিন্তু এখন সে যা শুরু করেছে , তাতে আমার এখানে টেকা দায় । প্রতিমুহূর্তে তার আবদারের সীমা পরিসীমা নেই । এখন নতুন আর একটা উপসর্গ শুরু হয়েছে ----  যেটা নিয়ে আমার হাত-পা গুটিয়ে আসার উপক্রম , খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি । পাড়ার ছেলেপেলেদের সঙ্গে করে , সেদিন বাবুদের ভাঙা দালানে খোন্তা কোদাল নিয়ে গিয়ে গর্ত খোঁড়া আরম্ভ করে দিয়েছে । কে নাকি তাদের বুঝিয়েছে ওখানে গুপ্তধন আছে । 

           এসব কী আর বলবো বলো !

           যাই হোক , সেসব যা হচ্ছে হোক । এখন মা , তুমি এসে অতি সত্তর এই সব আতঙ্কের হাত থেকে আমায় রক্ষা করো । এই চিঠি পাওয়া মাত্র যত তাড়াতাড়ি পারো ওকে তুমি তোমার দেশে নিয়ে যাও। এখানের মানুষজন আমাকে দায়ী করছে ওর সঙ্গতে নাকি তাদের ছেলেপেলে খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।

তারা বলছে ডেকে , ' ও পিসিমা, সে তো ছিল একরকম , তাই তার সঙ্গে আপনি চেঁচামেচি করতেন ।আর এ কি , এ যে একেবারে লাগামছাড়া ! ' নারান বললো এই সব কথা । এতে মুখ থাকে কোথায় একবার বলো আমায় ? 

     

           যদিও জানি তোমার একটু অসুবিধা হবে এতে ।এই রকমভাবে হঠাৎ করে রওনা  হতে । সেসব যেভাবেই হোক একটু সামলে-সুমলে নিয়ে অতি সত্তর এখানে চলে এসো । ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও।এরপরে কোথায় কি অঘটন বাধিয়ে বসে তখন আমি পড়বো একেবারে বেকায়দায় । শেষে আমার হাজত বাস না করতে হয় ।

            আশাকরি তোমারা সর্বাঙ্গিন কুশল । আশির্বাদ জানিয়ে আজ রাখছি । ইতি তোমার মা -----  

                                                                সুরাজ 

    

           বেশ কিছুক্ষণ চিঠিটি খুলে পড়ার পর চুপ করে বসেছিলাম । ভাবছিলাম, এ কাজ কি ওর একার মস্তিষ্কপ্রসুত ? এ ধরনের কাজকম্মে আর কার ইশারা থাকতে পারে ? টের পেলাম । বুঝতে পারলাম ওকে হুজুগে পেয়ে কাজে লাগিয়েছে, এগিয়ে দিয়েছে । এছাড়া ওর যা যোগাযোগ এ সবের খোঁজ খবর ও পাবে কী করে ? 

           কাজের দিদি বার কয়েক প্রশ্ন করে তারপরে উত্তর পেলো , এটা দিদিমার চিঠি যে । এবং তাকে খানিকটা খুলেই বললাম সব কিছু । এখন কী করা ? 

            সে বললো , মারে আসতি দেও । এখন তুমি এ নিয়ে ভাইবে কীই বা করবা ! 

             চিঠি আসার পর আমার মুখ চোখের ভাব যে পল্টে গেছে তা তো তার চোখেও ধরা পড়েছে । আর সেই কারণেই তার এত জিজ্ঞাসাবাদ --- কী হলো কি ভাই , আমারে এটটু খুলে কও দেখিনি ; আমারে কলি তুমি এটটু হালকা হতি পারবানে যে !

              এই ভাবে আমি খানিকটা , সে খানিকটা, এই করে ঘরের ভেতরের সিলিং, গোরুর ঘরের সোলিং ও বাথরূম এবং ঘরের মেঝের কাজটা শেষ হলো একরকমভাবে । বাকি থাকলো উত্তরের দিকের জানলার পাল্লাটা । সেটাও হলো অবশ্য একদিন একটা ঝড়ের মুখে পড়ে ।

              যাই হোক একটু আগেই বলছিলাম না , আমি এবং সে দুজনে মিলে , এই কথাটির এই আমি ---- গোরুর খাওয়া, গোয়ালার‌ মাহিনা , বাকি সব খরচ-খরচা বাদ দিয়ে লভ্যাংশ যে টুকুন থাকে , সেগুলির যাবতীয় হিসাব পত্রের দেখাশোনা রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব ইদানিং মা আমার হাতেই তুলে দিয়েছে ; আর তার থেকেই বেরিয়ে এলো ওই ( আমি ) কথাটা ।

             এদিকে এই ( আমি ) কথাটা বলার পর থেকেই ভাবতে শুরু করেছি তাহলে কি এই গো-পরিচর্যা করা দিয়েই আমার কর্মজীবন শুরু হয়ে গেল ? 

             ভেতরে ভেতরে সংসারের এই অনটনের শূন্যস্থানটি নিয়ে এই যে আমার উপলব্ধি --- হয়তো সেইখান দিয়েই পথ পেয়ে গেল এই গো-পরিচর্যার বিষয়টি ---- কিন্তু সব কিছুই চলছে যেভাবে ---- আমিও আবৃত হচ্ছি তার দুদিকের দুটি পথের টানেই একটু একটু করে । কাউকেই ছোটো করে সরিয়ে রাখতে পারি না । ওদিকে যে দিকটা তাকালে , কেন জানি না মনের ভেতরটা আবার পেছন দিকে চায় ফিরে । যে যে অনুসঙ্গগুলি সেদিকে ফেরায় বেশি করে , তার মধ্যে ওই ঝাউবন ছাড়াও আর একটি জায়গা রয়েছে, সে হলো আমাদের ঘরের পেছনের বাঁশ - জঙ্গলের মাঝখানে যে ডোবাটি রয়েছে । সেখানে সন্ধ্যা নেমে আসে ডাহুকের ডাকে। দুপুর বেলাগুলিরও স্তব্ধতা ভেঙে দেয় ওই ডাহুকগুলি । এ কোনা ও কোনা সে কোনা থেকে তারা যেন কেবলই মনে করাতে চায় আমার সেই ফেলে আসা সময়গুলি ।

              দুপুরবেলাগুলিতে বাঁশের ঝাড়ের মধ্যে দুপুরের আলো পড়ে দোল খায় দেখি । তখন কেন জানি ভেতরটা ভার হয়ে ওঠে । কিসের এই ভার হওয়া তা কি সবটা ধরতে পারি ! সন্ধ্যাবেলায় ডাহুকগুলি ডাকতে থাকলে , কেন জানি না মনটা ফিরে যায় সেই ওদেশের ইটখোলার ডোবাটার ভেতরেই । নিমেষে আমাকে নিয়ে চলে যায় এই দুপুরের রোদ হাওয়া ----- এই সন্ধ্যা লাগো লাগো ডোবার জল সেই ইটখোলার ডোবাটির কাছেই । আমি চাটুজ্জে মশাইয়ের বাগানের নিচের ডোবাটির ভেতর। সেখানকার বাঁশ জঙ্গলের ঝুপ্সি অন্ধকার আমাকে ডাকে যেন দুহাত দিয়ে । কী জানি কেন, কিসের মায়ায় আজও সেই পেছনের টান ---- আমাকে চুপ করে এনে দাঁড় করায় এই জানলার ধারে ; যেখানে আমার এই মনটা দুদিকেই ছুটে মরে অদ্ভুত এক মুগ্ধতায় ।

              কাজের দিদি সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালতে জ্বালতে বলে , ও দাদাভাই পেছন দিকের জানলাটা এবারে দিয়ে দেও‌ , তা না হলি বড় বড় মশায় ভরে যাবে ! বাগানের মশা তো ভালো না ভাই ।

              আজও তেমনই কিছু চিন্তা ভাবনা নিয়ে দুপুরের রোদের আলোয় সবে যখন এইসব নিয়ে ভাবনা চিন্তায় মগ্ন হয়ে ভাঙাগড়া করে সাজিয়ে নিচ্ছিলাম একাকী ঘুরে ঘুরে এদিক ওদিকটায়, ঠিক সে সময়ই দিদিমার চিঠি এলো । চিঠিটি পড়বার পরেই ভেতরটা কিরকম যেন ভার হয়ে উঠলো । দু'প্রান্তে ভাগ হয়ে গেলাম পুনরায় । ওদিকের জন্যে কত ভাবনা যেন এদিকের সব পরিকল্পনার উপরে অন্য আর একটা ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে গেল । আমি ভাগ হয়ে গেলাম নানা ভাবনায় ।

             দুপুর বেলাটায় অন্যান্য দিন হলে ও বাড়ির ফচনের ঠাকুমা এসে লুডুর কোট বসায় এই সময় । মাঝে মাঝে শিবানী, মলি, কাবেরি, ওরাও এক এক দিন অংশ নেয় এসে ---- আমাকে কখনো পিড়াপিড়ি করলে বাধ্য হই বসতে । আর তা যদি না বসি তাহলে গোরুগুলির পরিচর্যায় এদিক ওদিক করি আর ভাবি কিভাবে কি উপায়ে এই বাড়িটার চারপাশ আর একটু গুছিয়ে তুলতে পারি । কিন্তু অন্তরায় তো অর্থ ! ইতিমধ্যে এদিক ওদিক থেকে ছাই সুড়কি যা পেয়েছি তাই দিয়েই রাস্তাটা উঁচু করে দিয়েছি চলাচলের সুবিধার জন্যে । আর ফুলের বাগান তো কালো গোরুটি একরকম সাবাড় করেই দিয়েছে । তারপরও গাঁদা  ফুলের চারাগুলি আর রজনীগন্ধার গোড়া এনে পুঁতে দেওয়াতে কল বেরিয়েছে তাতে । গাঁদার চারাগুলি বেশ লকলকে হয়ে উঠেছে । ডালিয়ার চরাগুলি আর হবে না । নতুন করে আবার বসালেও সেগুলি বসানোর সময় পেরিয়ে গেছিল যে তা তাদের বেড়ে ওঠার ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে , ভালো হওয়ার নেই আর ।

              সামনের ডোবাটা বুজিয়ে দেওয়া হবে । একেবারে কলতলা ঘেঁষে ওদিকে ডোবার দিকটার সীমানা ঘেঁষে একেবারে লম্বা করে ঘর ওঠাতে হবে । যাতে গোরু-বাছুরগুলিকে বাড়ির ভিতরে না আসতে হয় , ওপাশ দিয়েই মাঠ রাস্তা পেয়ে ওদিক দিয়েই যাতায়াত করে । এইসবের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যাতে একটু বড় করে অনেকগুলি গোরু-বাছুর থাকতে পারে । আর তার সঙ্গে সঙ্গে সীমানার প্রাচিরটাও ।

              এসব পুজো মিটলেই শুরু হয়ে যাবে । তাই মনে মনে পুরো বিষয়টার নকশা তৈরিতেই মনোনিবেশ। যদিও এসবের আর্থিক জোগান আমার কাছে কোথায় ! সবই অশোকদার উৎসাহ । এ বাড়িতে তার আগমন ঘটলেই দুজনের মধ্যে চলতে থাকে নানা আলোচনা। তারও একটা বাড়তি কারণ আছে ,গত দুমাসের এক্ষেত্রের উপার্জনের হিসাব পেয়ে সে আরো নড়েচড়ে বসেছে । ফলাফল যখন ভালো তাহলে বিষয়টাকে আর একটু বানিজ্যিক ভাবে ভাবা যাবে না কেন ?


কেন জানি না, আমার ভেতরেও একটা বাড়তি উৎসাহ কেন তৈরি হয়ে উঠছে যে, সেটাই ভাবছি । ভাবছি এ কাজে যেটুকু সময় ব্যায় হয় ,  সেইটুকু করেও আমি আমার মূল লক্ষ্যে মনোনিবেশ করতে বিশেষ একটা অসুবিধা তো হচ্ছে না , তাহলে এটা করতে অসুবিধে কোথায় ?

              ছুটিছাটার দিনে ওয়ারলেসের বাসায় তাদের ওখানে গেলেও আমাদের দুজনের আলোচনার বিষয় তো ওই একটাই । তাছাড়া এটা যদি দাঁড়িয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যতে আরো অন্যভাবে বড় জায়গাটায়গা নিয়ে জায়গাজমি কিনে আরো অন্যরকমভাবে ভাবা হবে, কিছু করা যায় কি না ।

               তাঁর ঠোঁটে সিগারেট পুড়তে থাকে , আর আমার চোখে সেই পোড়া সিগারেটের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে নানা স্বপ্ন কল্পনা দানা বাঁধতে থাকে ।

আর আজ যা শুনলাম দিদিমার চিঠিতে , সেটা হলো চাটুজ্জে মশাই-এর ভিটের পাশে গলির শেষ মাথায় ঝোঁপ - জঙ্গলে ঘেরা যে ভাঙা দালানটি দাঁড়িয়ে আছে , সেখানে নাকি মাটির নিচে নেমে যাবার মতোন একটি সিঁড়ি আছে এবং ওখানে নাকি একসময় এক রাত্তিরে রক্ষাকালী পুজো হতো । পুজো শেষে বলির মোষ নিয়ে নবগঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসতো এ বাড়ির গৃহস্থেরা । একদিন নাকি কি কারণে পুজোয় কি একটা ত্রুটি হয় , এবং তারই কারণে তারা নাকি নির্বংশ হয়ে যায় ।

          সে গল্প শুনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যাদের কাছ থেকে এই গল্প শুনেছিলাম , একেবারে এক রাত্তিরির মধ্যি সকলেই মরে গ্যালো, এ আবার হয় নাকি?

          তা শুনে পরিমল বলতো , হ্যাঁরে ----- কান পাতলি এহোনো নাকি শোনা যায় নিচির দিকের থে ঝাঁঝ-কাঁশোর-ঘন্টা আরো কত কিছুর আওয়াজ । 

         বিষ্ময় নিয়ে বলতাম  , তাই নাকি ! তাহলি একদিন তো কান পাইতে দেখলি পারি আমরা , কি কোস ?

            যদিও কোনোদিন কোনো আওয়াজ পাইনি । আশপাশ দিয়ে ঘুরেছি অনেক সময়ই একা একা ,কত সকাল দুপুরবেলায় , ভাবতে চেয়েছি , আচ্ছা , সত্যি সত্যিই কি মানুষ বসবাস করতো এখানে ? যদি পুজোপাঠই হতো তাহলে এখনো যেটুকু দালানের অবশিষ্ট আছে তার গায়ে তো পোড়ামাটির নানা ধরণের নৃত্যরত নর্তক নর্তকীদের ভাষ্কর্য , আর মাটির নিচে যে সিঁড়ির কথা ওরা সকলেই বলে , সেটা ঠিকই , সিঁড়ির কয়েকটি ধাপ দেখা যায় মাটির নিচে নেমে গেছে । এবং বাকিটা মাটিতে ঢেকে গেছে অব্যাবহারে হয়তো । তবে তা কত দূর নেমে গেছে , তা কেউই কোনোদিন দেখেনি ।

              এই সব গালগপ্পে তাকে যে আলোড়িত করতো , সে কথা জানতাম । কিন্তু এই রহস্যের ফাঁদে সে ভাইকে কিভাবে উৎসাহিত করে ফেললো ? আমি না হয় গল্পের রহস্যে মাতি  এবং তার জন্যেই হয়তো তার সঙ্গে ঘোরাঘুরিও করেছি , কিন্তু ভাই-এর তো তেমন এই সব নিয়ে খুব একটা উৎসাহ আছে বলে দেখিনি কখনো ; তাহলে সে কেন মাতলো তার কথায় ? সেটাই ভাবছি বসে বসে ।

              এমন কতদিন গেছে যখন মাছ ধরতে যেয়ে বাবুদের গর্তের ভেতর টিপেটিপে বৃষ্টির মধ্যে ওই দিকটায় চেয়ে থেকে দেখেছি , কী একটা ছমছমে ভাব লাগতো যেন ; মন্টু মামাকে জিজ্ঞাসা করেছি কখনো কখনো , যখন সে আমার সঙ্গে তাদের ছাতরানে আম গাছের শেকড়ের উপরে আমাকে নিয়ে বসেছে মাছ ধরতে , তখন কত কথাই না তার সঙ্গে আলোচনা করেছি এই ভাঙা দালানখানি নিয়ে ! কিন্তু তার মুখেও যা শুনেছি তাতেও কিছুই পরিষ্কার নয় , যার একটু এদিক ওদিক করে আগের শোনা কথারই মতোন তার মুখের কথাতেও একই রকম সব --- সেও যেন একই গল্প একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে যেত । 

             এ ছাড়া এর আগে এই জঙ্গলের পাশেই যখন সকাল বেলার প্রাতঃকৃত্য সারবার জায়গা ছিলো প্রায় মানুষের এখানের , তখন তো কত কথাই ভাবতাম ! কত সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছি । কত ভাবেই না কত কিছু ভাবতে ভাবতে কত কল্পলোকে ভেসে গেছি  আপন মনে একাকী ; কিন্তু তাতো শুধুই ভাঙা দালান নিয়েই নয় , তাকে ছাড়িয়ে তপ্ত গ্রীষ্মের রোদ পড়ে যে কচি বেতের ডগাগুলি হাওয়া বাতাসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে স্তম্ভিত করে রাখতো , তাদের সেই সব মায়াজাল ভেঙে আমিও কি বেরিয়ে আসতে পারতাম খুব সহজে ? সেই সব নিস্তব্ধতার স্বরূপে যে জড়িয়েছে , সে আহ্লাদিত হয়েছে যেমন, তেমন ভয়ও পেয়েছে যে এ কথাও তো কম বড় সত্য নয় ! একমাত্র সেই জানে তাঁর কত কথা থাকে চারপাশ জুড়ে দশ হাত মেলিয়ে দিয়ে...

            এক্ষেত্রে ভাই-এর কথা তো তা না , সে তো এসব কিছুই গিয়েই ভাবতে পারেনি বা ভাবার মতোন কোনো ভাবও তার থাকার কথা না । তাহলে সে কেন এ সবে জড়িয়ে গেল ? এইসব রহস্যের ছলনায় যে একবার ধরা খেয়েছে তার যে কোথাও নিস্তার নেই ।

          আচ্ছা ছলনা বলছি কেন ?

         ছলনা বলার কারণ তো আর কিছু না , সত্যিই তো ছলনাই ! তাঁর প্রকৃত সত্য কি সকলের চোখে প্রকৃত সত্যই ------  যার টানে সবাই বাঁধা পড়বে ? আমি না হয় এই ঘোরে পড়েছিলাম , তাই বলে কি মন্টু মামার চোখে এই ঘোরের কোনো অস্তিত্ব আছে নাকি ? সে তো মাঠকে মাঠই দেখে , নদী না কখনোও ; বেত বনকে  বেত বনই দেখে । আমি না হয় সেই গ্রীষ্মের রাত-ভোর ভাঙা চাঁদের আলোয় ঘুরে ঘুরে আম কুড়োতে বেরিয়েও পরে মামার সঙ্গে কত কিছুই না উপলব্ধি করেছি ----  কিন্তু তাও তো আমার একার । তাদের তো কিছুই না !

তারা তো আমাকে , রাত ভোরের চাঁদকে , একই রকম ভাবে তাদের অভ্যাসের সঙ্গে আলোআঁধারিতে দেখেছে , কিন্তু আমি যে দেখেছি কত ভাবেই না তার উপস্থিতি , অদ্ভুৎ এক স্বপ্নঘোরে ; সে তো ঘাস কাটতে গিয়ে পাটের বনের ভেতর থেকে উঁকি মেরেও দেখেছি তাঁকে ; দেখেছি কুয়াশা আবৃত হয়ে সে আমাকে শীতের সন্ধ্যাবেলাগুলিতেও কীভাবে ঘরে ফিরে যাবার জন্যে তাড়িয়ে দিত মাঠ থেকে । যেভাবে আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে কেউ কাউকে ইঙ্গিতে নির্দেশ দেয় ! 

          তাই , সে সব সব ই আমার । 

          এ সবের ঘোরে এই অল্প কদিনের মধ্যে সে পড়বে কীভাবে ?

           কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না সেটাই আমি , নানা রকমভাবে এলোমেলো ভাসতে থাকলাম এই দুপুর বেলার বারান্দার কোণটিতে বসে বসে । বারবার মনে পড়ছিল ফেলে আসা সেই সব দিনগুলির কথা । কত সন্ধ্যা কত দুপুর কত রাত , কত দিন জমিতে মই দেওয়া সকাল বেলাগুলির কথা মনে পড়ছিল । যাকে এরা বলে ভূঁইতে চোঙো দেওয়া । সেই মই-এর উপরে চড়ে দুটি গোরুর লাগাম-এর দড়ি হাতের মুঠোর ভেতরে নিয়ে এই হ্যাট্ ......হ্যাট্ .....সেই..... হেই...... হেই.... ঢি ..রি..... ঢি... রি ..... ঢি ......রি.... চল দেহি ইবার , হেই ..... হে-- ই ..... হে - ই ...... 

            সেই সব চোঙো ( মই ) দেবার দিনগুলির কথা : বিশেষ করে চাষি ঘরের মধ্যেই এই সব শব্দের ব্যবহার । চোঙো দেবার অর্থ হলো মাটিকে লাঙল দেওয়ার পর ভালো করে গুঁড়িয়ে সমতল করে দেওয়া। চোঙো দিয়ে মাটি সমান করার পরে প্রোয়জন বুঝে আবার চোঙো দেওয়া হয়। বীজ ছড়ানোর আগে বা পরে।

             তাহলে কি এই ক'দিনের মধ্যে আমার ভাইটিও পল্লী জীবনের এই সব প্রতিদিনকার অভ্যাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেল ?

           তা যদি হয় তাহলে তো সেসব আরো বেশি চিন্তার বিষয় , তখন কি আর এখানকার সেই সাহেবী স্কুলে পড়ার পর মিশনারী স্কুলে ফিটফাট হয়ে যাবার অভ্যাসের ভেতরে ফিরতে পারবে সহজে ?

     ভাবছি , আচ্ছা আমার এই সব সংশয়ের কথাগুলো আমি কিভাবে এদের সকলকেই বা বুঝিয়ে বলতে পারবো ? কেউ কি বুঝবে আমার কথা ! না সমর্থন করবে, বুঝিয়ে বলতে পারলেও ঠিকঠাক !

           হয়তো ঠাকুমা বুঝতে পারে কিছুটা । মা তাঁর কথা ফেলতে পারবে না । তাহলে তাঁকেই চেষ্টা করে আসি আগে , তারপরে না হয়, সেই মাকে একটা সিদ্ধান্ত দিক , এখুনি ওদেশে গিয়ে ভাইকে নিয়ে আসার বিষয়ে।

           মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে পৌছোনো গেছে । সব কিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে দুই এক দিনের মধ্যেই মা ওদেশে রওনা দেবে । পাসপোর্ট অবশ্য আমার এবং মায়ের দুজনের এক সঙ্গেই তৈরি হলো । ভিসা মা একাই করে আনবে । কারণ এবারে দু 'জন একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব না ।  মা ঘুরে এলে আমাকে পাঠাবে কারো সঙ্গে । এখন কাজের দিদি আর আমি বাড়িতে থাকবো। 

           কথা মতো  মা ক'দিনের মধ্যেই রওনা হয়ে গেল।কথা হলো বনগাঁ লোকাল ধরবে শিয়ালদাহ থেকে । এরপর ওখানে পৌঁছে যে ব্যাবস্থা আছে তার উপরে নির্ভর । হরিদাসপুর পেরিয়ে বেনাপোল পৌছোনো তো যাক আগে ।

      এখানে নির্বাচনের নতুন হৈ চৈ পড়েছে , শোনা যাচ্ছে এবারে নাকি ফ্রন্টই জিতবে । সকলেই ফ্রন্ট ফ্রন্ট করছে ,আমার সেটা বুঝতে বেশ সময় লাগলো । ফ্রন্ট আবার কী ! পরে অনেক কষ্টে বোঝা গেল বাম ফ্রন্ট । সমাজতন্ত্রীয়দের জোট ।

           শরৎ রচনাবলীর দ্বিতীয় খন্ড এসে গেছে । ব্রজদা বলে সেই ব্যাক্তিটি মাকে বই এনে দিয়ে জানালো , তার ওদেশে যাবার আগে আরো একখন্ড দিয়ে দেবে । মা তাঁকে বলেছে , সে কি ব্রজদা , আমি আপনাকে মাসে মাসে একটু একটু করে টাকা দিই ,তাতে আগের টাকা আগে পরিশোধ তো হবে , তা না , তার আগেই  আবার ধার বাড়লে ,  আমার তো একটা মানসিক চাপ বাড়ে বলুন ?

            তাতে সে বলেছে , ঠিক আছে , ছেলে 

বই পড়ছে যখন, তখন আমি তাকে বই দেবো না , সেটা কি কথা ! টাকা পয়সা নিয়ে আপনার এত চিন্তা কীসের ? সে আপনি যে মাসে যেমন পারবেন তেমনই দেবেন । হ্যাঁ, ওর কাছে জিজ্ঞেস করবেন আর কি লাগবে , অন্য আর কোনো কিছু লাগবে কিনা ? যদি অন্য কোনো কিছু লাগে তো আমাকে জানায় যেন সেটা।

             এ কথা শুনে আমি আনন্দ পাইনি যে তা না , খুবই বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি খানিকটা যেন ;  মনে মনে একটা কথাই ভাবছি , আচ্ছা এই মানুষটি থাকেন কোথায় ? সে কি উত্তরের দিকেই থাকে নাকি ? না , বিরাটি উল্টোডাঙা ব্যারাকপুর , নাকি অন্য কোনো স্টেশন সংলগ্ন কোথাও তাঁর বাড়ি ! 

            এভাবে কেন ভাবছি ? তার সঠিক কোনো উত্তর জানা নেই । ভাবছি । কিন্তু কেন তা জানি না । সামনাসামনি যেদিন তাঁকে পাবো সেদিন এই কথাটা জিজ্ঞাসা করবো আগেই । কিন্তু কেন ? ব্রজদার আমাকে বই এনে দেবার সঙ্গে তাঁর অবস্থানগত পরিচয়ের কী যে সূত্র তা কোনোদিনও আমার কাছে ধরা দেয় নি ।

           কিন্তু আমার ভেতরে যে এবারে আরো অন্য এক অভাবের বাজনা বাজছে , তার কি হবে ? 

           পুজো শেষ হয়ে গেল । সাহা বাড়িতে বেশ ধুমধাম করে পুজো হতে দেখলাম । শিবানী মলি অলোক ওরা পুজোয় প্রতিদিন একটি করে নতুন পোশাক পরেছে দেখেছি। শঙ্কর ফোচনও দুই সেট করে । পাড়ার অন্যান্য ছেলে মেয়েরাও একই রকম প্রায় । নতুন টেরিকটের জামা প্যান্ট বেলবটম কাটিং  এবারে , সকলেই একই ডিজাইন । জামার কলারটা কুকুরের জিভের মতোন লম্বা যেন । প্যান্টের ঘের কিছুটা যেন সায়ার মতোন । পরে হাঁটতে গেলে দুপাশে লতপত করে বাড়ি খাচ্ছে । সকলেই প্রায় সেটাই বানিয়ে নিয়ে তাতে সেন্ট লাগিয়ে হই হই করে পুজোর আনন্দ নিচ্ছে দেখতে পেলাম । 

            আমিও একসেট পেয়েছি । তাও দিদি আর মায়ের যৌথ প্রচেষ্টায়। তবে তা নিয়ে আমার অবশ্য বিশেষ কোনো হেলদোল নেই । আর বেলবটমের ধারেকাছেও যাই নি । কেন আমার একসেট, এ নিয়ে ভেতরে কোনো বিষণ্ণতাও জাগেনি ।

           রাত একটু বাড়লে সে সবের বালাই থাকে না আর । এদিকটার সব হইচইই মিইয়ে যায় যেন । পথ পড়ে থাকে তখন পথের মতন । পরনে তার যতোই সাজগোজের বাহার থাকুক না কেন , সে যেন ঘোরনো-ঘারানোর পরের অবস্থার নতুন বউ-এর সাজপোশাকের মতো ; 

          হইচই থাকে দেখেছি, একদিন শঙ্কর ফোচন ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ভবানীপুর পর্যন্ত গিয়ে বুঝতে পেরেছি । সে যেন আমার হাঁসফাঁস অবস্থা। মাঝপথেই তাই পালিয়েছি একটা ডবলডেকার ছনম্বর বাস পেয়েই ।

          এর পরে আরো একদিন ওদের সঙ্গে পঞ্চম না দশম দূর্গা পূজা দেখতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটাই । সে পুজো না দেখলে নাকি বন্ধুবান্ধব মহলে মান থাকে না । কিন্তু মানুষের হইহট্টগোল গাদাগাদি ঠাসাঠাসি ঘাম পারফিউমে মিলেমিশে সে যে গা গুলোনো একটা ব্যাপার তা আমার যৌবনের প্রথম ঢেউলাগানো মনে কোথাও কোনো আশক্তির জন্ম দিল না । কতক্ষণে ঘরে ফিরবো সেটার টানেই উসখুস করতে লাগলাম।

           কোনোদিনই এসবের কোনো প্রভাব পড়েনি। কেবলই মনে হয়েছে , মন বলেওছে শুনেছি যেন, ওই যে বাড়ির এক কোণে মোড়াটি পেতে বসে থাকা চুপ করে , না হলে নতুন বই-এর ভেতরে মনোনিবেশ করে বুঁদ হয়ে থাকা সেই যেন বড় প্রশান্তির জিনিস। এইসব হইহই হট্টগোল লাইট মাইক সাজগোজ এসবের মধ্যে গিয়ে পড়লে কীসের যেন এক মনখারাপের বার্তাই বহন করে সব কিছু মিলিয়ে।

          তাও যাই , যাই না যে তা না । এই তো এখন যেমন গেলাম । কিন্তু কেন যেন মনে হয় উৎসবের আনন্দ উপভোগ করবার মতোন মন আমার নেই । তবে ছিল না যে তাও না, ছিলো , তবে সে আনন্দ যেন কেউ নিয়ে চলে গেছে সবটা । আমি কোথাও যেন তাকে হারিয়ে ফেলেছি । অথচ বাস্তবে তা তো না । তবু কেন যে আমার অবচেতনে তার অভাবই আমাকে কখনোই অধিক আনন্দে মাততে দেয় না । কেবলই যেন কিসের এক শূন্যতা তৈরি করে । আমি তাকে নির্জনে খুঁজে পাবো বলেই আড়ালে ঢুকে পড়ি একান্তে ! 

          যদিও তার কোনো অস্তিত্বই এ পর্যন্ত কোনোদিনই ধরা দিল না । অথচ তাকেই খুঁজে চলেছি যেন সকল মুহূর্তে ---- ।

          যেটা হয়েছে সেটা হলো এত আলোর ঝলকানি , সমস্ত রাস্তাঘাট একেবারে টুনি লাইট দিয়ে মালার মতোন জালি বুনে দেওয়া যেন , হাঁটতে গেলে মনে হয় পথকে যেন বেঁধেছেঁদে গাছ ও  লাইটপোষ্টের সঙ্গে টাইট করে রাখা হয়েছে । 

           অলোকদের বাড়ির সামনেও বড় বড় সার্চলাইট লাগানো। ওদের প্রবেশ পথটির বর্ণ পাল্টে গেছে । তার ওপাশে বারোয়ারি পুজো মন্ডবেও একই অবস্থা। মাইক লাইট আলোর ঝলকানিতে কান একেবারে ঝালাপালা।

            এইসব পরিস্থিতি বেশিই ঘটে দেখেছি এমন সব উৎসবের দিনেই। তাছাড়া হয়তো উৎসব নয় শুধুই , সে তো ওদেশে থাকতেও একই অবস্থা দেখেছি। যাত্রা গান শুনতে গিয়েও একই অবস্থা ঘটেছে। কালীপুজোর ভাসানের নৌকোয় উঠেও, বিসর্জনের নৌকোয় চড়ে যখন শত্রুজিৎপুরের মেলায় যেতাম ; জোড়োনের নৌকোর মাথায় পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে থাকতাম । জোড়নের নৌকোয় মেলায় যেতে যেতে ঘাটে ঘাটে নৌকো লাগানো হতো মহিলাদের সিঁদুর দান, ধান দুর্বা মিষ্টি দেবার জন্যে প্রতিমাকে যখন --- সেই সব পর্বের ভেতরেই আমার মনের ভেতরটা কেবলই যেন ভার হয়ে উঠতো । এই যে ভার হওয়া শুরু হতো , সেটাকেই বহন করতাম সারাক্ষণ । তারপর নৌকা মেলায় পৌঁছলে সকলে হই হই করে নেমে যেত নিচে , আমি নৌকোতেই বসে থাকতাম চুপচাপ ।

           ওদেশে গিয়ে প্রথম যেবার পুজোর জামা-কাপড় কিনতে নারান মামার সঙ্গে দিদিমা আমাকে মাগুরায় পাঠাল, কথা ছিল বাড়ির থেকে সাইকেলে চড়ে শত্রুজিৎপুর যাবো, তারপর শত্রুজিৎপুরে সাইকেল রেখে নারান মামা আমাকে বাসে করে মাগুরায় নিয়ে যাবে । অথচ অন্য সকলের কী যে আনন্দ, তারা 

হই হই করে মেলায় চলে গিয়ে পাঁপড় ভাজা , বাদাম , মিষ্টি , কটকটি খেলনা কিনে নিয়ে এসে নৌকোয় সকলের সঙ্গে হই হই করে আনন্দ করতো । এসব সবই আমি চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখতাম , তাদের সঙ্গে সঙ্গ দিতে পারতাম না । পোড়া মাটির তৈরি সেই কটকটি খেলনা আমার কানের সামনেই বাজাতো এরা সকলে । পোড়া মাটির সেই বাটির মতো দেখতে ; বাটি উল্টোলে যেমনটা হয় তার পেছনটা ঠিক সেরকম । তার সঙ্গে দুটি কাঠি লাগানো থাকতো ,ঠিক যেন ঢাকের কাঠির মতো ; সেই বাটির মতো বস্তুটির গোড়ার দিকটায় চাপ দিলে টং টং করে বাজতে থাকতো । ওদিকে কাঠিতে লাগানো পটকাবাজীর আওয়াজ, এদিকে এই খেলনা ঢাকের বাদ্দি , মানুষ জনের হইহল্লা , বড়দের ঢাকের বাজনা , মাইকের আওয়াজ, নানা ঘোষনা ,ধুপধুনোর ধোঁয়া ---- সবে মিলে আমার জন্যে সে যে কি দুঃসহ যন্ত্রনা যেন ; মনে হতো কতক্ষণে এখান থেকে রেহাই পাবো ! অথচ আমার একার ইচ্ছা অনিচ্ছার সঙ্গে তো এই জগৎ সংসারের কিছুই চলে না ! এদের সকলের এই যে সমস্ত বছরের একটি দুটি দিনের অপেক্ষা , তা কি তারা ছেড়ে দিয়ে আমার ভালোলাগা মন্দলাগার উপর নির্ভর করে বন্ধ করে দেবে সবটা ?

            এই যে এই দিনটার জন্যে কি আমার ভেতরে কোনো অপেক্ষা থাকতো না ! অবশ্যই থাকতো । তবুও এই দুরত্ব তৈরি হয়ে যেত । কেন , সে কথার কোনো অর্থ ধরা দিত না । বুঝতে চাইতাম কি ? হয়তো চাইতাম , হয়তো চাইতাম না কিছুই। মনের যেটাতে ভালোলাগা তাতেই ভালো মন্দের সায় দিতে বাধ্য হতাম তখন। মনে হতো যেন এই আনন্দের , হুল্লোড়ের পেছনেই আছে হয়তো বড় কোনো ভালো না লাগা ; যা হয়তো এখুনি ঘটতে পারে !

          এই সংশয়-দীর্ণ মন কেন জানি না বরাবরই আমাকে সকল উল্লাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে চিরকাল। কোনোদিন তার কোনো আনন্দ-হুল্লোড়ের অংশিদার হতে দিল না কেন যে , তা জানতে পারলাম না আজও ।

           বাড়ি থেকে যাওয়াটা হলো, কিন্তু গোল বাঁধলো শত্রুজিৎপুর পৌঁছে । নারান মামা শত্রুজিৎপুর পৌঁছে এক কলুবাড়িতে ঘাইন ঘরে আমাকে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল কোথাও একটা কাজে । সাইকেল খানি থাকলো ঘাইন ঘরের দেয়ালে হেলান দেওয়া । নারান মামা বললো , বস এখানে , আমি একটু কাজ সেরে আসছি এখুনি ।

            আমার কেন জানি মনে হলো, আচ্ছা , সব সময় নারান মামা মন্টু মামারা আমাকে সাইকেলে চাপিয়ে ঘোরায়, এখন তো খানিকটা সময় পাওয়া গেছে , দেখি না কেন, পারি কি না আমি একবার , তাহলে তো একা একাই এদিকে ওদিকে যেতে পারবো ।

           সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে সাইকেলের ভার সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল তা পায়ের উপর । পা কাটল । রক্তারক্তি একেবারে । নারান মামা ফিরে এসে বললো, কী কাণ্ড ঘটালি তাই ক তো , এহোনে আমি কি করি ? পিসিমা তো আমারে খাবরোয়ে রাখপেনানে !

           সেদিন হাটবার ছিলো । সুনীল ডাক্তারের চেম্বারে দেখিয়ে ওষুধ পত্র ইনজেকশন দেওয়া হলো । সুনীল বাবু বললেন , ও কিছু না , নতুন নতুন সাইকেল চড়া শিখতি গেলি অমন একটু হয় ; আমারও হইছিলো । দুই একদিন একটু ব্যাথা থাকপেনে তারপর ঠিক হয়ে যাবেনে সব ।

            যদিও বাস্তবে সেটা হলো না । পা ফুলে গেল । পেকে গেল কাটা জায়গাটা । পুজো দেখার আনন্দ মাটি হলো । ভাসান দেখতে যাবো বলে টাবুরে নৌকো ভাড়া করা হলো । জোর-জবরদস্তিতে অগত্যা নৌকোর ছোই-এর ভেতর শুয়ে শুয়ে চললাম রসিকদাদু, দিদিমা ও ওদের বাড়ির অন্যান্য সকলের সঙ্গে বিসর্জনের মেলা দেখতে । গায়ে জ্বর যদিও যাচ্ছে না । ব্যাথার তো কোনো বর্ণনা হয় না ! সে যে কি অসহনীয় অবস্থা , পায়ের সেই দাগটার দিকে তাকালে সে কথা মনে পড়ে আজও । সাইকেল চড়া এ জীবনে আর হলো না !

*********************************************************************************

আগামী পর্বে    



***********************************************************************************


কবিতা * অলোক পুষ্পপুত্র



অলোক পুষ্পপুত্র / দু'টি কবিতা

ট্যারেন্টুলা


আমার স্থগিত জলবায়ু স্থির চোখে দেখে 

কী ভাবে নিম্নচাপ জন্মায় সাগরের বুকে।

সে জানে ঝড় তুফান বজ্র যখন প্রয়োজন 

শুধু এক তুড়ি...

ওদিকে নিম্নচাপ এদিকে মনখারাপ


তোমার এক ফুঁয়ে শ্রুতি থেমে যায় মহাকাল!

সে মিথ সত্য করো, দেখাও গরিমা

নিম্নচাপ ফিরে যাক

সমস্ত ঝঞ্ঝা তোমার বশ

আমার নিঃশ্বাস শুষে নেবে শরীরের তাপ


তোমার রমণস্বেদ, জাদুকর, তোমাকেই দেখে অপলক

কী ভাবে শয্যা ছেড়ে উঠে আসো

আমাকে শুইয়ে দিয়ে, জলবায়ু-দর্শক












নিরাময়

নুনছাল উঠে গেলে অপলক চেয়ে থাকে রোদ

হাওয়া অফিসের বড়বাবু, পিওন, মোরগ

সবাই সমুদ্র দেখে নিজস্ব বারান্দায়

আমাদের জানালা নেই কোনো, কাচের দেয়াল

টিকটিকি ছায়া ফেলে ইস্পাতের ফুলে-  বাহুমূলে

তোমাদের ঘরে ট্যালকম সুরভি ছড়ায়


শরীরের নিজস্ব নিয়ম, নুনছাল উঠে গেলে

কাচের দেয়ালে জমে আলোর প্রিজম, রক্তরস

ফার্স্ট-এড-ভোলা বড়বাবু নিম্নচাপ টের পান

পিওন চায়ের কাপ, মোরগ আজান


নুনছাল উঠে গেলে অপলক চেয়ে থাকে রোদ

বাষ্প হয়ে উড়ে যায় জানালার নিছক প্রবোধ


***************************************************************************************************



অলোক পুষ্পপুত্র

অলোক পুষ্পপুত্র(জন্ম ১৯৭২) আদতে গদ্যকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ "একটি রূপকথার জন্ম" তাঁকে ব্যতিক্রমী গদ্যশিল্পী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কাব্যে অলোক সনাতনী ধারার বাহক। তাঁর চতুষ্পদী কাব্যগ্রন্থ "চার(যা)পদ"-এর সাফল্যের পর তিনি মেতেছেন চতুর্দশপদী নিয়ে। নিপুণ দক্ষতায় পুরাতনী পয়ারের কাঠামোয় গড়ে চলেছেন আধুনিক বিষয়। এখানে অবশ্য আমরা পড়ছি ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা তাঁর দু'টি কবিতা।   

পাঠ পরিক্রমা * পার্থসারথি মহাপাত্র



আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়ায় রঞ্জিত কাব্যানুসন্ধান

পার্থসারথি মহাপাত্র


তপন পাত্রের কবিতায় চোখ রাখলেই আমার মন কেমন যেন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে । বিভিন্ন ধরনের কবিতায় তাঁর প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন  চরিত্র চিত্রণ আমাকে বার বার আকৃষ্ট করে, আমি মুগ্ধ হই । তাঁর কবিতা যাঁরা নিয়মিত পড়েন ,  তাঁরাও হয়তো সহমত পোষণ করবেন । 

                 আগের বছর নভেম্বর মাসে প্রকাশিত তপনের ''পারাপার এপার ওপার'' কাব্যগ্রন্থটি ৬৯টি  কবিতার সংকলন । আলাদা করে  কবিতাগুলির নাম নেই, শিরোনামের জায়গায় সংখ্যা বসিয়ে লেখা । এই গ্রন্থে কবির জীবন উপলব্ধি গতানুগতিকতা থেকে এক অনন্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে । জীবন উপলব্ধিতে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া লেগেছে । উপলব্ধির এই স্তরে পৌঁছে যাওয়ার নেপথ্যে কি জীবনযন্ত্রণা ? সেই জীবন যন্ত্রণা কি কবির ব্যক্তিগত নাকি সমকালের অধিকাংশ মানুষেরই জীবন যন্ত্রণা? এরকম কয়েকটি প্রশ্ন মনের মধ্যে দানা বাঁধে , প্রত্যেক পাঠকের মনে দানা বাঁধবেই । কারণ হিসেবে কবিতায় ব্যবহৃত কয়েকটি চরণ উদ্ধার করি । তিনি লিখছেন,

      "সাপের মুখে ব্যাঙের মতোই 

      মানব জীবন 

      গিললেও মরণ 

      উগরে দিলেও...."

আবার বলেছেন ''ভাজা লুচির মতো জীবন আমার''। তাঁর কাছে ''জীবন একটি দ্বিতীয় অংকের নাটক''। তবুও কী অপরূপ উপমায় জীবনে অমলিন থাকার উপায় বলেছেন,

   ''শতদল জন্মসূত্রে পঙ্কজ হলেও  

    কর্মসূত্রে পদ্ম 

    কারণ তার মুখ ঊর্ধ্বমুখী 

    তার পাতায় 

    মলিন জল দাঁড়াতে পারে না ।"

       কিন্তু জীবনযন্ত্রণার মাঝে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখী হওয়া তো সহজ কথা নয় । উর্ধ্বমুখী হতে গেলে নিজের মনটিকে বাঁধতে হয় আগে । পাগলা বিস্রস্ত মনকে না বাঁধতে পারলে ঊর্ধলোকের সোপান বেয়ে  উচ্চে ওঠা যায় না। তিনি বলছেন --

       '' ঊর্ধ্বমুখী হতে গেলে আহার দরকার'' 

          আবার আহার নিয়ে বলছেন --

  

         "আহারে নিরামিষ আমিষ নেই 

          সবকিছু জমে আছে আহার গ্রহণে 

          শঙ্খচূড়ার মতো শুভ্র স্তনে  

          জেগে থাকে সন্তানের প্রাণ ,

          আর কামুকের কামও।"


                   প্রকৃত জীবন পথে এগিয়ে যেতে হলে সেই পথের উপযুক্ত করে মনকে তৈরি করার পর ক্ষণকালের পার্থিব সমস্ত আনন্দ উল্লাসকে পিছনে ফেলে ধীর পদক্ষেপে অথচ অবিচল গতিতে সেই পরম লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে হয়। এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এইভাবে,--


        "এইসব ক্ষণকালের উন্মাদনা আনন্দ-উল্লাস

         মুহূর্তে ধুয়ে মুছে যায়...... 

         এইসব আনন্দ অনিত্য 

         নিয়ত ভঙ্গুর 

         নিত্যানন্দ পেতে হলে 

        ধীরে ধীরে অবিচল 

         এগোতে হবে 

        ভূমানন্দের অন্বেষণে" ।


        আসলে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন কোন এক ঐশ্বরিক শক্তি বা প্রকৃতি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে,

      "হয়তো নিরানব্বই বছরের লিজে দিয়ে 

     সে অলক্ষ্যেই নজর রেখেছে''

     আবার বলছেন,

      ''সুখের উৎস তুমি 

                এবং 

           দুঃখেরও ।"


আমরা এরকম কোন শক্তির সান্নিধ্যে এলে কিছু পাওয়ার মানৎ করি কিন্তু সেই শক্তির কাছে এই কবি নিবেদন করছেন,


      " তুমি কিছু দিও না 

        দিও না 

        আমার ভার বহনের শক্তি নেই 

        বরং আমার সমস্ত ভার-ই 

        তোমার দু'টি পদ্মের নিচে

        জমা করে রেখো ।"


     ---আমার মনে হয় কবি সেই অদৃশ্য শক্তির কাছে জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছেন । তিনি লিখেছেন,


     " আমাকে গ্রহণ করো 

        আমি তোমার মাঝে হারিয়ে যেতে চাই, 

        তোমার অমন উদার বুকে 

       বুক রেখে আমি লীন হতে চাই  ।"


         আসলে তিনি হয়তো দেখেছেন  বৃত্তের পর বৃত্ত আঁকতে আঁকতে ''ব্যাসার্ধ বেড়েই চলেছে'', আবার দেখছেন --

         ''সকালবেলায় শূন্য থেকে শুরু হয়েছিল 

          সন্ধ্যাতেও ...শূন্য''। 


          যে যতই ধন, সম্পদ, ঐশ্বর্যের বড়াই করি না কেন শেষে সব শূন্য ।  তাই তিনি চেয়েছেন,

          ''সকল অহং ভেসে যাক 

           হড়পা বানের তোড়ে ।"

        অবশেষে  লিখছেন,  "আমি নাম শুনছি 

           আমি তো জপ জানি না    

           নাম বুঝি না 

           যুবতি জবালা হয়ে উঠছে টগর বোষ্টমি 

          গুরুদেব নাকি বলেছেন 

          নাম শুনতে শুনতে কাম পদপিষ্ট হয় । " 

          কবির তাই উপলব্ধি হয়েছে, 

   

       ''তুমি আমার অগতির গতি 

        তুমি বিনে এপার ওপার নেই 

        পারাপার নেই''।

       ----তপন পাত্র সম্বন্ধে সর্বোপরি একটা কথা বলতে পারি, তাঁর মনে সৃষ্ট অনুভূতি যখন মননের অক্ষর দ্বারা ছন্দোবদ্ধ হয়ে লিপিমালায় প্রকাশিত হয় তখন সাধারণ একটা বিষয়ও অসাধারণ কবিতা হয়ে ওঠে।

            আমার তো মনে হয় নিত্যনৈমিত্তিক ঈশ্বর সাধনা ছাড়া কোন ব্যক্তির পক্ষে এই উপলব্ধিতে পৌঁছানো সম্ভব নয় যে উপলব্ধির কথা তিনি আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের ৩৮ সংখ্যক কবিতায় লিখলেন --

          "প্রতিমাতে তিনি আছেন 

          প্রতি মা -তে তিনি আছেন 

          প্রতিমাতে তিনি নেই 

          প্রতি মা-তেও তিনি নেই

          তিনি আছেন 

          তৃতীয় নয়নে

          অজ্ঞানতার অবসানে 

          জ্ঞানের আলোকে ।"

         এই  জ্ঞানাণ্বেষণই  ভারতীয় দর্শনের মূল কথা । তবে কি কবি ধীরে ধীরে সাধন পথে এগিয়ে চলেছেন ? তাঁর মানব প্রেম , উদার চিত্তে ছোট বড় জ্ঞানী অজ্ঞানি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে ঈশ্বর প্রেমের রূপান্তরিত হোক । কবিতা রচনার এই ধারাটি সহ তাঁর নানা ধরনের কবিতার অপেক্ষায় রইলাম।  


"পারাপার এপার ওপার " তপন পাত্র

 প্রকাশক--- মানভূম সংবাদ পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড

পুরুলিয়া, মূল্য- ১০০টাকা


************************************************************************************************


**************************************************************************************************

পাঠ পরিক্রমা * সব্যসাচী মজুমদার




আশি এবং অন্তর্বর্তী পাঠ

সব্যসাচী মজুমদার

১.


আশির দশককে আমার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। সময়ের চিহ্ন হিসেবে। একটা অদ্ভুত সমাপতনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল সেই সময়ের বাঙালির মনন। বৈপরীত্যের সঙ্গে আপোস তৈরি হচ্ছিল একটা ‌‌‌। এবং অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে।গত শতাব্দীর তো বটেই, এই শতকের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে বাঙালি যখন আপোস আর সন্দেহের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে,তার অবচেতনের একটা রেখাচিত্র এঁকে দেয়,সেই দশকের বাংলা কবিতা।

বিশদে বলি। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের তখন বহু আন্দোলনের পর বাম জোট সরকারে। বাঙালি তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে,এই পথেই মুক্তি। আবার উল্টো দিকে তখন প্রথম বিশ্বে তখন বামপন্হা অনেকটা কোনঠাসা। এমনকি আসন্ন সোভিয়েত পতনের ব্লু প্রিন্ট‌ও এই দশকেই তৈরি হতে শুরু করলো।আমি কোন‌ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলছি না।বলতে চাইছি, চিন্তার, অর্থনৈতিক ধারণার বিবর্তনটাকে।এই বিবর্তন আবার তখন এই বাংলায় কিন্তু অন্যদিকে। বরং কোনঠাসা সেই ধারণাকেই জাপ্টে বাঙালি মেধা স্বপ্ন দেখছে যৌথ খামারের।দুটো ভিন্ন সময়, ভিন্ন প্যাটার্ন এক‌ই সমান্তরালে,বলা ভালো একটার মধ্যে আরেকটা অদ্ভুত ভাবে জায়মান।ফলত এই সময়ে যাঁরা বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে এলেন, নিঃসন্দেহে দুটো ভিন্ন সময়ের সংঘর্ষের উত্তেজনাকে প্রশমন করেই তাঁদের লিখতে হলো বৈকি। বিজয় সিংহের কবিতা ঠিক সেই মুহূর্তের দ্বন্দ্বগুলিকে তুলে ধরেছে বারবার।ইতিপূর্বেও, বর্তমান পাঠ 'মায়া চতুর্দশ '-এ‌ও।

বিজয় বাবুর কবিকৃতি সম্পর্কে পাঠকের কাছে কিছু বলতে যাওয়াটাই অতিরেক।চার দশকেরও বেশি সময় ধরে জায়মানের গভীরতম সঙ্গোপনে বিজয় সিংহের দর্শন। নান্দনিক বিবিধ প্রক্ষেপে অবিরল তাঁর কাব্যে উপস্থিত। বিজয় সিংহ আশির ক্রান্তি আর উত্তর পর্বের আপোস -দ্বন্দ্বের কথক,

"চতুর্দশপদী যদি দু -পায়ে ঘুঙুর চোখে গীত

তুমি কি সন্ধের হয়ে জাদুকরী দেখাবে চুমায়

নেশা ছড়াবে বানজারা মুদ্রা নিয়ে যাবে দেশাতীত

রাষ্ট্র যদি অসম্মত তুমিই পুষ্প ভূমিতে ভূমায় 


আমার স্বরাজ্য নেই দেশ অর্থ দেওয়াল ও জুঁই

 আমার জুঁইয়ের গন্ধ পারাপার করে স্বপ্নলোক

 স্বপ্নলোকে - ফোয়ারা জল-শীর্ষাসনে আমি শুই

 হেজিমনি বিদ্যুতের বিদ্যুতের পুত্রকন্যা হোক


চতুর্দশপদী তুমি বিদ্যুতের কারুমুদ্রা নিও

আগুন-জলেরর দেশে ছায়া থাক তোমার দু-পায়ে

পংক্তি জুড়ে আলো থাক স্তবকের পাশে কালফনীও

মিথ হয়ে হাওয়া যাক এ বাংলার এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে

চতুর্দশপদী যদি শ্রীচরণে রক্ত জবা রাখি

দেখাও বিম্বন মায়া বিষাকাশে ওড়ে ভস্মপাখি"

                                                  (যদি চতুর্দশপদী)




এই কবিতাটি পাঠের মাধ্যমে আপনি প্রবেশাধিকার পাবেন এই ছাপান্নটি সনেটে তৈরি গ্রন্হে।এবং এক‌ই সঙ্গে আপনি লক্ষ্য করছেন -বানজারা,কারুমুদ্রা,হেজিমনি ,মিথ,কালফনী,বিম্বন,ভস্মপাখি-কী নির্বিকার শব্দ ব্যবহার! অনায়াস সাবলীলতায় কবি বস্তত একটা ক্রম বিবর্তিত,আপোসে নিবেদিত অথচ আপোসকামী নয়, তীব্রভাবে স্বাতন্ত্র্য উদগ্রীব একটা বেঁচে থাকার জটিল ও মনস্তাত্ত্বিক বয়ান তুলে ধরেছেন। ফলত ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন হয়েছে, একটার পর একটা বিপর্যস্ত সময়ভূমাকে সাজিয়ে দেওয়ার কাজটা করে গেছেন নিবিড়ভাবে।আর প্রত্যক্ষে ক্রুদ্ধ হাহাকার রোল নির্মাণ করে বিজয় সিংহের কাব্যবিশ্বের পরিচিত উপস্থাপন,


"আমার সন্ন্যাস তুমি এত যে স্বীকার করো দেবী 

সেজন্য বিস্তৃতি তাঁর তোমার কপালে সুর্যোদয় 

দিয়ে থাকে সকালে যে-কোনো রাত্রি-পাখির সংশয়

তোমার নাভিতে এসে শ্বাস নিয়ে ওড়ে বেহিসেবি।


আমার বিভিন্নে এসে যতকিছু নাগরিক তার  

বিভঙ্গে ছড়িয়ে গেলে তুমি তাকে যত্নে জোড়া দাও

স্বয়ং শহর ফলে নিত্য ঘাসের বিশুদ্ধতায় 

সায় দেয় ট্রাক থামে চারুস্থান নিয়েছে কুঠার


আমি যেই জড়ো করা বাতাসের আসনে বসাই 

অন্তর্বর্তী মণিপুর আজ্ঞাচক্র তাহার সংজ্ঞাই বদলে 

দেয় পুরুষের সব বর্ণ রতিচিহ্ন হয়  

প্রারব্ধের যতকিছু অপমান রাধে সাহা বীর "

কবিতাটির প্রতিটা শব্দই যেন প্রতিনিধিত্ব করে সমসাময়িক ডিসটোপিয়ার।আর সম্পূর্ণাবয়বে সে প্রতিস্পর্ধা স্হাপন করে তার জায়মানতার বিরুদ্ধে।তবে জায়মানতার কিন্তু ঠিক সেইটুকুও যৌথখামারে গৃহীত হয়,যতটুকু মানুষের জন্য 'চারুস্বাদ'। তার‌ও মাত্রা ঠিক করে দেন কবি ব্যাক্তি যাপনে নিহিত স্হবিরকের আদেশে।অবিরল ধ্যান মুদ্রা তৈরি হতে থাকে সনেটগুলিতে।সে মুদ্রায় চিহ্নিত হয় আয়লান কুর্দি থেকে কৃষক মৃত্যু, চিহ্নিত হয় হত্যা,হনন অস্ত্র আর হানাদার‌ও। তীব্রভাবে রাজনৈতিক হয়েও নিরবচ্ছিন্ন অক্ষরবৃত্তে লিখে রাখলেন যাপিত পৃথিবীর একটি ব‌ই প্রতিনির্মাণ,

"বস্তুপুঞ্জ দিয়ে ঘেরা সমস্ত নির্মিত স্বপ্ন বিষ 

মহাপয়ারের মধু নিয়ে বাংলার পিঁপড়েরা সব 

অলৌকিক কাটাকুটি খেলে ও নদীর খোলা শবে

আরূঢ় পাথর ভাবে পুরুষ প্রকৃত সহিস 

বাদাম পাহাড়ে চটি হারিয়েছিলেন কবি ত্রাসে..."

খুব সচেতনভাবে এই 'প্রতিনির্মাণ'শব্দটিকে ব্যবহার করলাম। তীব্রভাবে সমসময়ের প্রত্যেকটা নিত্যবৃত্তে লগ্ন হয়ে আরেকটা চিন্তা বিশ্ব তৈরি করাই অভিপ্রায় হয়ে উঠেছে প্রতিটা ছত্রে। মানে এভাবেও বলা যায় যে, আশির দশকের মানসিক রেম্পারামেন্ট আর বিকল্প বিশ্বের অনুসন্ধান‌ই নিরবিচ্ছিন্ন চলে কবিতাগুলোর অন্তর্জাগতিক চেতনায়।


এই সময়ে অর্থাৎ একটা আরবান জনসঙস্কৃতি জাগরণের জোয়ারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না,বিজয় সিংহের কবিতা একটি অবধারিত টেক্সট। এবং তা সর্বার্থেই।যাপনের ঘনিষ্ঠতম হৃদবিকার ,তার হাহাকার আর উত্তীর্ণ অমিতাভ একত্রিত আলংকারিক নিপুণতায়,সনেটের আট -দশ ফর্মে।পাঠক আপনার গোচরে আসবেই ,এক‌ই সঙ্গে, সনেটের সবরকমের গঠনকেই ব্যবহার করেছেন গ্রন্হের প্রতিবেশে। শব্দ এবং অক্ষরবৃত্ত নিতান্তই অনুগত না হলে এই ব্যাপক বিন্যাস নির্মাণ প্রায় অসম্ভব কাজ।সনেট রসিকের সংগ্রহের একটি মূল্যবান অংশ এই গ্রন্থ। সচেতন ডায়ালগ যেখানে জাদুভরা দৃশ্য হয়ে যায়,

"পাঠ

মাংস জানে গুহ্যতত্ত্বে চাবুকের দাগ কতভাবে 

চামড়ার অতলে গিয়ে নুনের আস্বাদ পেয়ে থাকে 

লহুচিহ্নে নখ কত নন্দন বিস্তার দেয় আঁকে জানে 

সন্ধ্যা ইহাদেরই বিষয়-আশয়ে কিংখাবে


মুদ্রিত দেবীর হলোগ্রাম তাহার অন্তরকারু

পাঠে নিই পাঠে আসে পোড়া তার অগ্নিজল ধূমে 

ওড়া রক্তগন্ধ ফলে পালিয়েছি ব্যভিচার জমে 

ভরন্ত আঁধার হল বহুদুরে জোছনার চারু


চতুর্ভুজ নদী খেলে সর্পশিশু নিয়ে শব্দাচারে 

মণিপদ্ম যোনিপদ্মে ওষধি ঔজার মহীপাল কুহক 

মায়ায় ঘেরা সেসব অস্তিম থেকে ত্রাণ চাইছে আয়ু 

নিখিলেরও ভোর জানে নীল সিন্ধুপারে রৌদ্রমাংস 

খেতে গিয়ে পাখিরাও ভুলে গেছে গান

বিষকুম্ভ পিঠে হাঁটছে ভুসুক ঢেন্ডন কুক্কুরীপা"


মোট দশটি দীর্ঘ কবিতাকে একত্রে 'সামাজিক দায় 'কে উৎসর্গ করেছেন অরুনাংশু ভট্টাচার্য।সদ্য প্রকাশিত 'গতিবিধি সন্দেহজনক 'নামক কাব্যে। শেষ প্রচ্ছদে জানা যাচ্ছে ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে রচিত কবিতাগুলো। লক্ষ্য করবার বিষয় এই সময়টা।অরুনাংশু ভট্টাচার্য মূলতঃ আশির দশক থেকেই লেখালিখি শুরু করেন। বস্তুত এই সেই পূর্বোল্লিখিত সংক্রান্তি কাল।একটা অতিস্পষ্ট বিবর্তন ফুটে উঠছিল সে সময়ের গায়ে।আর তারপর এই দুই হাজার দশ থেকে কুড়ির অন্তর্বর্তী সময় পর্বটিও।এই সময়েও কেবল অর্থনৈতিক নয় মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনটিও সমানভাবে সক্রিয়। ক্রমশঃ সংক্ষিপ্তকরণের সময়ে বিস্তারের ওপর নির্ভরতা এক অর্থে বিকল্প ধারারই ইঙ্গিতবাহী।সেই সংবাহনের সন্ধানে।


লক্ষ্য করার বিষয় কাব্যটিতে দশটি গদ্য কবিতা ব্যবহৃত হয়েছে আলাদা আলাদা ফরম্যাটে। বিভিন্ন সময়ের লেখা হলেও, নিজের তৈরি বিন্যাসের মোহে কবি প্রায়শই আক্রান্ত হন। নিজেকে ভাঙা এবং অবিরল বিপন্নতা থেকে লিখে ফেলা," ধর্ষণচরিত

নাম ধাম জানার আগেই একেবারে 

উপমা-টুপমাশুদ্ধ মাঠে নেমে পড়লে 

পলুপোকা, আমি আর অধিক কী কবো।

দেখো, এই যে একটু রণক্ষেত্র,একটু 

জলীয় বাষ্প আর  একটু মোমবাতির 

মিছিলেই যদি বাণতলা থেকে বদায়ুন। 

পর্যন্ত স্বভাব-রহস্যের প্রকৃতি তৈরি হয়ে 

যেত, তাহলে পক্ষী সকলের আর কী 

দোষ?" বিস্ময়ে লক্ষ্য করি এ রচনার কালীক বিস্তার সম্পন্ন হয় বাইনতলা থেকে বদায়ুনের ব্যাপকতায়।আর অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ভাষাটিও ব্যবহৃত হলো প্রতিবেশের সম্যক চরিতার্থে।আপাত তৎসমগন্ধী এ ভাষা ধীর বিস্তারে সময়ের অতীত থেকে আগতে ঢুকে পড়তে চেয়েছে। ঠিক এই জাদু খেলাটিই করেছেন অরুনাংশু।ভাষার বিবিধ সজ্জায় বিচিত্রগামী দশটি অভিমুখ।যেমন পাঁচালী নান্দীমুখ হয়,গদ্য নির্মাণ করে ভাবনা বিশ্বের শরীর। আবার অক্ষরবৃত্তের সুর বিন্যস্ত হয়ে যায় কবিতার শরীরে।আলাপ থেকে ঝালা অবধি,"

প্রশাসনিক নিয়ম নীতি পরিচ্ছন্ন বটে। যখন 

তোমার রচনা করছে ফাটল এবং ভূত যখন 

একটি খারাপ দৃশ্য বিরক্তিতে ভরা। 

অবলীলায় ঘটছে যা যা রাতের শেষপ্রহরে। 

কৌতুক সব সাজিয়ে রাখা চক্রাকারে আর 

সঙ্গে যেন সিনেম্যাটিক হুইস্কি ভরা গ্লাস- 

ভাবছ এটা সাজানো নাকি, আসলে আমি 

এই" 

জাদু আর জায়মান উভয়ত‌ই এ কাব্যে এক‌ই সঙ্গে মিথোষ্ক্রিয়া করে,আর উপযুক্ত বাহন হয়ে যায় মুক্তক -মিলে নির্মীত শ্লেষ ও আত্মনির্মাণ ও প্রি-নির্মাণ।উৎসের স্বভাব বশতঃ আশির দশকে লিখতে শুরু করা এই কবির কাব্যেও সংযুক্ত হয়ে বিকল্পের সমূহ নির্মাণ।অনিশ্চিত জেনেও উদ্দাম। ঠিক যেন,'হটতে হটতে হটেনটট'

"অস্ত্র বোঝো— ভূমি থেকে ভূমি? এই অবিমৃষ্যকারিতা এই ধারা, এই অবনতি পিঠে ঠেকে তোমারও দেয়াল ? এসো তবে আমার সংহতি

ওই দ্যাখো প্রতিবাদী যারা তোমাদের মতে নির্বাসিত তাদের রচিত বৃন্দগান যাহাদের ভেবেছিলে মৃত: তারা নিচ্ছে ইতিহাস থেকে নির্বাচিত শিক্ষা আর পাঠ তাদের তুলিতে বিচিত্রিত পৃথিবীর আশ্চর্য মলাট। তাহারা কী বলে আজ, শোনো শোনো ওহে ভ্রান্ত আধুনিক তারা নয় তোমার মতন ওই দ্যাখো হাসে পূর্বদিক। এই সেই প্রতিবাদ-ভাষা এই সেই মায়া, জাদুকরী এই সেই যক্ষের ঠিকানা গান গেয়ে যেথা আসে তরী। পারলে তুমিও এসো সখা এ-বরষা এই লেবুবন; প্রসারিত আমাদের হাত তমসা সরাও বন্ধুগণ। মহাজাগতিক রশ্মি আর শস্যে ঘেরা প্রযুক্তির পথ যক্ষ ঘোরে তারায় তারায়; নোটে ঘূর্ণমান ভবিষ্যত।"

একটা মহাকাব্যিক প্যাটার্ন তৈরি করেছেন।ঐ আঙ্গিকটুকুই, তীব্রভাবে উত্তর দু 'হাজার পর্বের যাবতীয় বিবর্তনবোধকে যাপন করেছেন কবি তাঁর এই সাম্প্রতিক কাব্যে। বস্তুতঃ যখন পিডিএফমুখী পাঠরুচি, তুলনামূলক দ্রুতি চাইছে,সে সময় এ হেন মার্গীয় সংগীত রীতির মতো দীর্ঘ কাব্যিক বিস্তার ও রাজনৈতিক সচেতনতা একপ্রকার উল্টো দিকে ঘুরতে চাওয়ার মতন‌ই যেন। গুমড়ে উঠে ফের গর্ভে ঢোকার মতোই। কাব্যটি বাঙালির পাঠরুচির সঙ্গী হোক।


বিজয় সিংহ:মায়া চতুর্দশ: ধানসিঁড়ি:১২০টাকা:প্রচ্ছদ: সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়

গতিবিধি সন্দেহজনক:অরুণাংশু ভট্টাচার্য:লুব্ধক:১৬০টাকা:প্রচ্ছদ:দেবাশিস সাহা  

***********************************************************************************************************


********************************************************************************************************