[পূর্বানুষঙ্গ : ডিসেম্বরের শেষাশেষি। কোনও এক ছুটির দিনে, অশোক পড়ার টেবিলে বসে, না-পড়া বইগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে কোনটা পড়বে। হঠাৎ চোখ যায় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত বইটির দিকে। মনে পড়ে, এই বইটার শেষ কিছু পাতা পড়া বাকি আছে। সেটাই পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তে এতটাই তন্ময় হয়ে যায় স্থান কাল পাত্র ভুলে, মনে হয় সে-ও সশরীরে শ্রীরামকৃষ্ণ-বঙ্কিম-শ্রীম সকলের মধ্যে উপবিষ্ট। এক অপার্থিব আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় ওর মনে। এই ঘটনারই দু'চার দিন পর.....]
ধুলোর সিংহাসন
দেবাশিস সাহা
পর্ব * দশ
বালিকা গোপাল
গৌরীশঙ্কর দে
প্রথম কী নামে ডেকেছিলাম তোমাকে
আজ মনে নেই। শুধু মনে আছে লাল
মুখবিবরের বিশ্বরূপ তুমি যাকে
দেখিয়েছিলে, সে আমি তোমার বিশাল
উদ্ভাসের সুরেলা ঝঙ্কার। চিরকাল
নিজের অবদমিত ম্লান প্রত্যাশাকে
জ্বলে উঠতে দেখেছি -- ' বালিকা গোপাল
অদম্য তোমার তেজোময় নিশিডাকে।
বাবা আমি ছিলাম যতো না তার চেয়ে
যশোদা ছিলাম বেশি। উড়ে উড়ে পাখি,
হাতের নাগাল ছেড়ে অজানা সফরে
গেলে দূরে,কাঙাল বাবার সোনা মেয়ে
জানি কিছু দিতে আমি পারিনি,জোনাকি
আলোটুকু রেখে গেছো বাবুইয়ের ঘরে।
'আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে' আবহাওয়ার পূর্বাভাস তেমনটাই ছিল।পেপারে দেখেছিল সকালে। কিন্তু 'অংশত' কোথায়,পথে বেরিয়ে অশোক-অলি দেখছে সারা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। উত্তরে হাওয়ার শিরশিরানির সঙ্গে সঙ্গে যে-কনকনে ঠান্ডাটা দু'দিন আগেও রীতিমতো হাড় কাঁপাচ্ছিল, আজ তা একেবারেই উধাও। বাড়ি থেকে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত মিনিট পাঁচেকের এই হাঁটা পথটুকু আসতেই হাঁসফাঁস অবস্থা। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। জ্যাকেটের তলায় বগলটাও ঘেমেছে অল্প অল্প। জামার কলারটা ভেজা ভেজা। এখন মেট্রোর এসিতে বসতে খানিকটা স্বস্তি। সত্যি, বছর কয়েক ধরে আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনা যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরফ-শীতল উত্তরে হওয়ার পথ আগলে হয় পশ্চিমী ঝঞ্ঝা, নয়তো শীতের কান মুলতে উদ্যত বঙ্গোপসাগর কি আরব সাগরে হঠাৎ সৃষ্ট নিম্নচাপ। কলকাতায় এমনিতেই শীত ক্ষণস্থায়ী , তার উপর এই চাপাচাপির জেরে,সোয়েটার-জ্যাকেটের ভাঁজ খুলতে না-খুলতেই শীত পগারপার। এ-সবই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কুফল। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ধ্বংসের পরিণাম। ফি বছর ছাত্রদের পড়িয়ে আসছে অশোক।
আবহাওয়ার এই দুর্যোগ কতক্ষণে কাটবে বা আদৌ কাটবে কিনা,কে জানে! অথচ কত আশ্বাস নিয়ে রোদ ঝলমলে দিনটা শুরু হয়েছিল। ঘুম ভাঙলেও, তখনও বিছানা ছাড়েনি অশোক। গেরস্থালির কাজে নেমে পড়েছে অলি। উপমা তখনও ঘুমিয়ে। অলি সাবধান করে গেছে , ঘুমোচ্ছে ঘুমোক, ডেকো না, রবিবার তো, আজ কোচিং ক্লাস আছে ,ফিরতে দেরি হবে। অশোক তাই বিরক্ত করছে না উপমাকে। অন্যদিন হলে এতক্ষণ ' উঠো উঠো গো ভারত-লক্ষ্মী ' না না, 'ভারতলক্ষ্মী'র জায়গায় ' উঠো উঠো গো অশোকলক্ষ্মী' বলে বেসুরো চিৎকার জুড়ত। আর অমন সারমেয় চিৎকার শুনে উপমাও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারত না, বাবার দিকে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে উঠে পড়তে বাধ্য হত। ইচ্ছে হলেও অলির বারণে আজ তা করতে পারছে না। কাজেই ইচ্ছেটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এল দক্ষিণের জানালায়। একফালি শিশু রোদ্দুর হামা দিচ্ছে বিছানায়। দু 'তিনটে চড়ুই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে এসে জানলার গ্রিলে কিচকিচ শুনিয়ে ফের গিয়ে বসছে সানসেডে। দেহটা কোনোরকমে বিছানায় রেখে অমনি অশোকের মনটাও চড়ুই হয়ে ফুড়ুৎ। একেবারে সানসেডে।
এমন মনোহর প্রভাতী দৃশ্যে হঠাতই অলির অনধিকার প্রবেশ, 'শোনো শোনো,চোখটা একটু বন্ধ করো।'
'কেন?'
' করোই না।' চাপা উচ্ছ্বাস অলির।
চড়ুই পাখির কাছ থেকে মনটাকে কেড়ে এনে চোখ বন্ধ করে অশোক।
'এবার হাত পাতো।'
মুঠো খুলে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয় অশোক। হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে মুঠো বন্ধ করে ফের বলে ওঠে অলি , 'এবার চোখ খোলো। ' চোখ খুলতেই হতবাক অশোক, মুঠোভর্তি কতকগুলো পাঁচশো টাকার নোট!
'কে দিল?'
' আরে,দরজা খুলে ঝাড় দিচ্ছি, দেখি বন্দনা -চন্দনার বাবা। বললাম,দাদা ভিতরে আসুন,তা আসতে চাইল না। বলল ,না ম্যাডাম, একটু বাজার যাব,স্যারকে বলবেন,গতমাসের আর এই মাসের ওদের দুজনের দু'মাসের মাইনেটা দিয়ে গেলাম। আমরা শিমলা যাচ্ছি, দিন পনেরো থাকব না। তাই মাইনেটা দিয়ে গেলাম।'
কম্বলটা এক ঝটকায় সরিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে অশোক।
' টাকাটা গুনেছো?'
'এক.. দুই..তিন... আটটা পাঁচশো টাকার নোট, তার মানে, পাঁচ আটে চল্লিশ... চার হাজার টাকা।'
' অলি, তাড়াতাড়ি চা-টা বসাও , চা খেয়েই বাজারে যাব।'
' কী আনবে বাবাই?' উপমাও উঠে পড়েছে ঘরভর্তি অযাচিত লক্ষ্মী আসার উচ্ছ্বাসের ছড়াছড়িতে।
' মাংস।'
' কীসের? '
' কী খাবি বল, চিকেন, না মটন?'
' মটন।'
' অত বড়লোকি চাল কোরো না, একদিন খেলেই হবে? চিকেনের পাঁচগুণ বেশি দাম মটনের। কী দরকার, চিকেনই আনো না।'
'না,মটন আনবে।'
মেয়ে আর বউয়ের সাঁড়াশি চাপে নাজেহাল অশোক 'আচ্ছা দেখি,আগে বাজারে তো যাই।'
'আগলা স্টেশন কালীঘাট 'পাশের সিটে বসা ঝিমন্ত লোকটা তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে অশোকের চশমায় দিল জোর এক গুঁতো। ছিটকে পড়ল চশমা। ভাবনা ঘেঁটে ঘ। ' কী দাদা মেট্রো তো গড়ের মাঠ,তবু গুঁতোটা লাগাতেই হল!' বিরক্ত অশোক। উল্টো দিকের সিটে বসেছিল অলি, দৌড়ে এল, ' লাগেনি তো?'
' না।' চশমাটা চোখে সেট করতে করতে বলে অশোক।এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন যাত্রী উঠে পড়ল হুড়মুড় করে। প্রায় প্রত্যেকের কপালেই লাল টিপ, মায়ের মন্দির দর্শন করে ফিরছে। দু'একজনের হাতে ছাতা। জল গড়াচ্ছে টপটপ করে। তার মানে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে বাইরে।
'নেক্সট স্টেশন ইজ যতীন দাস পার্ক ' ছুটতে শুরু করেছে মেট্রো। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর একটু গড়াগড়ি দিয়েই বেরিয়ে পড়েছে দুজন। মেট্রোর দুলুনিতে চোখটা জড়িয়ে আসছে। ঘুমে নয়,আরামে।
বাজার থেকে ফিরতে না ফিরতেই অলির প্রশ্ন, ' কী আনলে?'
'মটনই আনলাম একটু, অল্প করে।'
' জানি তো মেয়ে বলেছে, টাকাও আছে হাতে,অশোক বোসকে আজ আর কে পায়!'
' আরে না না ---' আরো কি বলতে যাচ্ছিল থামিয়ে দিয়ে অলি বলল, ' তা বেশ,মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করলে, এবার আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করো,দেখি।'
'তোমার আবার কী ইচ্ছে,শুনি।' সচরাচর অলি মুখ ফুটে কোনদিনই কোনো ইচ্ছের কথা অশোককে বলে না। অশোকের ছেঁড়া পকেট আরো ছিঁড়বে এই আশঙ্কায়। আজ কী হল!
'একটা চটি কিনে দাও, হাওয়াই চটি পরে সব জায়গায় যাওয়া যায়!'
' চটি? চলো, এক্ষুনি কিনবে চলো।' অশোক যেন আজ কল্পতরু।
'এক্ষুণি ! উঠল বাই তো কটক যাই।এখন বেরোলে হবে! ভাত ফুটছে। মেয়ে একটু কিছু খেয়ে ক্লাসে যাবে তো, ন'টা বাজে প্রায়, আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোবে বলেছে। '
' কেন?'
' বড়দিনের জন্য আজ নাকি এক ঘন্টা আগে ক্লাস শুরু হবে, দশটা থেকে।'
' তাই বলে এক ঘন্টা আগে ছুটি হবে?'
' আমি জানি না, মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো। '
'ঠিক আছে , সে এক ঘন্টা আগে পরে যা হওয়ার হবে। কিন্তু কথা হল,এই অল্প সময়ের মধ্যে মাংস রান্না করবে কী করে ?'
'দেখি, প্রেসারে দুটো সিটি দিয়ে নেব।'
'না মা,তাড়াহুড়ো কোরো না,তাহলে টেস্ট ভালো হবে না। আমি রাতে এসেই খাব।' ড্রেস করতে করতে বলে উপমা।
'তাই করো,ধীরে সুস্থে রান্না করো,উপমা ফিরলে রাতে তিনজনে একসঙ্গে খাব।'
' না বাবাই,তোমরা দুপুরে খেয়ে নিয়ো গরম গরম।'
'আচ্ছা,সে দেখা যাবে।'
' তাহলে চটি কখন কিনতে যাবে?'
' বিকেলে এক ফাঁকে যাবখন,কাছেই তো নতুন বাজার।'
' নতুন বাজার থেকে কিনবে!এখানকার চটি দু'দিন বাদেই ফটাস। তারচে বরং -- '
' বরং কী,কোথা থেকে কিনবে?'
'ধর্মতলা থেকে ' তারপর কী যেন একটু ভেবে অশোক যোগ করে 'একটু তাড়াতাড়ি বেরোব, শ্রীলেদার্স থেকে তোমার চটি কিনে, মৌলালি থেকে উপমাকে নিয়ে তিনজন একসঙ্গে ফিরব।'
' তা মন্দ বলোনি, ইনস্টিটিউশনে একটু খোঁজখবরও নেওয়া যাবে,উপমা কেমন পড়াশোনা করছে, কামাই টামাই করছে কিনা।'
উপমার ভাত বাড়ে অলি। ' মা দেরি হয়ে যাচ্ছে , তুমি খাইয়ে দাও।'
বাধ্য মেয়ের মতো অলি উপমাকে এক গ্রোস করে খাইয়ে দিতে থাকে, যেমন দিয়ে এসেছে গত কুড়ি বছর,প্রায় প্রতিদিনই। উপমা যখন ছোট ছিল অশোকও আগে মাঝে মাঝে খাওয়াত, অলি কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলে। মায়ের কাছে বায়না করলেও অশোকের কাছে কিন্তু উপমা চুপটি করে খেত। কারণ,অশোকের খাওয়ানোর কায়দাই ছিল আলাদা। বিচিত্র সব গল্প বলে, কখনো আলিবাবা চল্লিশ চোর,তো কখনো অবীন ঠাকুরের বুড়ো আংলা কি শকুন্তলা আবার কখনো-বা সুকুমার রায়ের হ য ব র ল-র গল্প বলে বলে খাওয়াতো । গল্প শুনতে শুনতে কখনো কখনো বেশি খেয়ে ফেলে উপমা হাঁসফাঁস করত। অশোকের খুব আনন্দ হত, আজ ওর পেটটা ঠিক ভরেছে। পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিত অলি।
' বাবাই আসছি ' খাওয়া শেষ করে, বইপত্র নিয়ে তাড়াহুড়ো করে উপমা বেরিয়ে যায়।ব্যালকনি থেকে টা-টা করতে থাকে অলি।
ঘরে এলেই অলিকে প্ল্যানটার কথা বলে অশোক। সেই প্ল্যান অনুযায়ী দুপুর দুপুর বেরিয়েছে, পথিমধ্যে দুর্যোগ নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ে।
'কোন জগতে থাকো, ধর্মতলা এসে গেছে, নামো নামো ' অলির সজোরে চিমটি অশোকের কাঁধে।
ট্রেন থেকে নেমে উপরে উঠে ওরা। বৃষ্টি!বৃষ্টি! বৃষ্টি! এ অকাল বরিষণ থামবে কখন! ' ছাতা এনেছো অলি?' 'তখন কি বৃষ্টি পড়ছিল,আনব।'
'তুমি আঁচলটা মাথায় দাও,চলো ভিতরটা দিয়ে একটু এগিয়ে ওই মোড়টাতে গিয়ে দাঁড়াই।'
' তুমি রুমালটা মাথায় দাও।'
' দিচ্ছি। ওখান থেকে শিয়ালদার কোনো গাড়িতে উঠে পড়ব। উপমাকে নিয়ে ফেরার পথে আবার তো এখানেই নামতে হবে,তখন তোমার চটিটা কিনে নেব।'
' সে দেখা যাবে,এখন তো চলো।'
রবিবার। রাস্তাঘাট এমনিতেই ফাঁকা। তার উপর নিম্নচাপের ভ্রুকুটি। গাড়ি-ঘোড়া অনেক কম। দু'পাশের দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। ফুটপাথগুলো খাঁ খাঁ করছে যেন। পাঁচটা বাজেনি, মনে হচ্ছে চতুর্দিকে রাত বারোটার ইশারা। যদিও বড়দিন উপলক্ষে আলোর খামতি নেই। তবুও কেমন যেন থমথমে চারিধার। লোকজন না থাকলে যেমন হয়।
'মৌলালি-শিয়ালদা,শিয়ালদা-মৌলালি..' বাসের দরজা চাপড়াতে চাপড়াতে হাঁক পাড়ছে কন্ডাকটর। ' ও ভাই কন্ডাকটর রোক্কে রোক্কে ' হাত দেখিয়ে অলিকে নিয়ে কোনোরকমে বাসে উঠে পড়ে অশোক। বেশিরভাগ সিট ফাঁকা। সাকুল্যে পাঁচ সাত জন যাত্রী। অশোক-অলি বসল জানালার পাশের সিটটাতে। অলির শাড়ির আঁচলের অনেকটা ভিজে গেছে। চুল বেয়ে জল গড়াচ্ছে নাকে- মুখে। রুমালটা নিংড়ে অলির হাতে দেয় অশোক , ' মুছে নাও, নয়তো এক্ষুণি হাঁচতে শুরু করবে।'
'ও কিছু হবে না, শুকিয়ে যাবে। '
' ওই তোমার এক বুলি,কিছু হবে না, কেন পুরী থেকে ফিরে ক'দিন আগে ভুগলে না , ভুলে গেলে?'
এই মৃদু ধমকে কাজ হল। টিপ, সিঁদুর অক্ষত রেখে আলতো করে চুল থেকে গড়ানো জলটা মুছে নেয় অলি।
'মৌলালি মৌলালি...নামুন নামুন ' কন্ডাকটর হাঁক পাড়ে। নেমে পড়ে অশোক-অলি। দু'পা এগোলেই "এসপিরেশনস " উপমার চাকরির পরীক্ষার ইনস্টিটিউশন। ক্লাস করছে উপমা। পাঁচটায় ছুটি হবে।
'কী গো, এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে! '
'লাগবে না, ধর্মতলার মোড়ই কত ফাঁকা,দেখলে না। তাঁর উপর আবার রোববার!'
'রোববার তো কি হয়েছে! এর আগেও তো দু-একবার এসেছি তোমার সঙ্গে, আর সব বন্ধ থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীর ভিড় রাস্তায় উপচে পড়ে। আজ এত ফাঁকা কেন?'
' চলো না, ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করি।'
ইনস্টিটিউশনের গা ঘেঁষে লম্বা রাস্তা। অশোক-অলি এগোতে থাকে। ডানদিকে ঢোকার মুখে বড় কলাপসিবল গেট। তালা বন্ধ। ভেতরে একজন গেটকিপার বসে। খৈনি ডলতে ব্যস্ত।
'আচ্ছা ভাই,কোচিং ক্লাস কখন ছুটি হবে?'
'সাব,আজ তো ক্লাস ছুট্টি আছে।'
' ছুট্টি!কিউ?কিসলিয়ে?'
' কিউ কি,ও ক্রিসমাস হ্যায় না,ইসিলিয়ে এ হপ্তা ক্লাস বন্ধ আছে।'
'এ হপ্তা! '
'জী সাব। পিছলে বৃহস্পতিবার ভি বন্ধ থা।'
'সে কী!' অলির মাথায় যেন বাজ পড়ে।
' উপমার ফোনে ফোন করো তো।'
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অলি। ব্যাগ থেকে কোনোমতে ফোনটা বার করে। হাত কাঁপছে রীতিমতো,ডায়াল করতে পারছে না।
'দাও, আমার কাছে দাও।' অশোক ডায়াল করে।
'রিং হচ্ছে?' উৎকণ্ঠা অলির স্বরে।
' হাঁ।' গম্ভীর অশোক।
'কোথায়, তুই?'
' ক্লাসে।'
' ছুটি হবে কখন?'
' আধঘন্টা পর।'
' ঠিক আছে,আমি-মা নীচে দাঁড়িয়ে আছি, এসো।' শান্ত নিরুত্তাপ অশোক। বুঝতে দেয় না মেয়েকে,কী ভাবে সুনামির তীব্র ঢেউ আছড়াচ্ছে ওর বুকে। দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। ক্রোধে? উদ্বেগ- উৎকণ্ঠায়? কীসের অভিঘাতে ঠিক বুঝতে পারে না। মুহুর্মুহু অগ্ন্যুদগীরণ ঘটছে পাঁজরে, টের পায়।
এইবার ক্ষেপে যায় অলি। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিল সাময়িক। মনে শক্তি সাহস সঞ্চয় করে অশোকের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ফের ডায়াল করে, দ্য ফোন ইউ আর ট্রায়িং ইজ সুইচড অফ। দ্যাখো, কী বদমাশ মেয়ে,ফোন সুইচড অফ করে রেখেছে। বিড়বিড় করে অলি।
কী করা উচিত এই মুহূর্তে,বুঝতে পারছে না অশোক। মিসিং ডায়েরি করবে লালবাজারে গিয়ে? ১০০ নম্বরে ডায়াল করে পুলিশ ডাকবে? থানা -পুলিশ, কোর্ট-কাছারি করে আদৌ লাভ হবে! এতটা অবাধ্য,এতটা অ্যারোগান্ট হয়ে গেছে তাদের উপমা! সব প্রশ্নের উত্তর,সব ক্ষোভ-বিক্ষোভ ক্রোধে রূপান্তরিত হচ্ছে ক্রমশ। এ দিকে বৃষ্টি পড়ছে সমানে।দু'জনেই ভিজে নেয়ে একশা। তবু ক্রোধের আগুন নিভছে না !
' বড়দিকে একটা ফোন করো তো' সাথে সাথে অপর্ণাকে ডায়াল করে অলি। পেয়েও যায়। জানায় সবকিছু। মুহূর্তমাত্র চুপ করে থেকে অপর্ণা বলে, ' অলি, অশোককে খেয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলো, আমি উপমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।'
'আমরা কতবার ফোন করছি বড়দি, ধরছে না' কান্না জড়ানো গলা অলির।
'কেঁদো না অলি, শক্ত হও, তোমরা যেখানে আছো ওখানেই দাঁড়াও,আমি যোগাযোগ করে উপমাকে পাঠানোর চেষ্টা করছি।'
' ভিজে যাচ্ছি তো আরো, ওই ফুটে একটা চায়ের দোকান খোলা আছে মনে হচ্ছে,উপরে প্লাস্টিকের সেড, চলো ওখানে গিয়ে দাঁড়াই।' অশোকের হাত ধরে টানে অলি। যন্ত্রচালিতের মত এগোয় অশোক।
' আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান...' অলির ফোন। 'কে দ্যাখো তো, উপমার?' রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে দুইজন।
' না বড়দি..'
'ধরো' ঠিক এই সময়ে বিকট ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা ফোর হুইলার। ড্রাইভার মুখটা বাড়িয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে, 'ও কাকা,এই বয়সেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে লীলে করছেন! এক্ষুনি চাকায় পিষ্টে যাচ্ছিলেন যে।'
'সরি ভাই, সরি ।'
' সরি বলা বেরোত,ভাগ্যিস ব্রেকটা ধরল, তা না হলে,ভবলীলা সাঙ্গ হচ্ছিল আজই।' পেছনের সিটে হেলান দেওয়া ভদ্রলোকটি বলল।
কাচুমাচু অশোক-অলি ত্রস্ত রাস্তা পেরোয়। ' হ্যাঁ বড়দি বলো, বলো...'
' উপমাকে ফোনে পেয়েছি, বলেছি --এক্ষুনি যাও, বাবা-মা এই বৃষ্টিতে ঘন্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে আছে। তার পর এই টেনশন..বাবার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, ভালো লাগবে! শিগগির যাও।’
' আসছে তাহলে?'
' বলল তো যাচ্ছে, তোমরা দাঁড়াও আর অশোককে বলো যেন মাথা ঠান্ডা রাখে।'
চায়ের দোকানে শেডের তলায় দাঁড়ায় দু'জনে। 'কাঁপছ তো ঠান্ডায়, একটু চা বলি ' অশোক হ্যাঁ না কিছুই বলে না।
'ভাই, দুটো চাঁদ দাও না। '
' লাল চা, না দুধ চা?'
' যা খুশি দাও।'
' চিনি ছাড়া, না চিনি দেওয়া?'
' বললাম তো,যা খুশি দাও,শুধু গরম হলেই চলবে।' চাওয়ালা অবাক হয়ে তাকায়। ভাবখানা এমন এ কেমন খদ্দের !
চা রেডিই ছিল,গরম করে দোকানদার দু'ভাঁড় চা এগিয়ে দেয় দু'জনের হাতে। হাতেই ধরা থাকে চা, মনে জট পাকায় চিন্তার জাল, কোথায় যেতে পারে উপমা,বন্ধুর বাড়ি? চিড়িয়াখানা?ভিক্টোরিয়া?সায়েন্স সিটি?নিকোপার্ক? প্রেম করছে কারো সঙ্গে ,কই অলি তো কোনোদিন কিছু আভাস দেয়নি, তাহলে কেন উপমা এইভাবে মিথ্যে কথা বলে এসেছে দিনের-পর-দিন। হাতেই ধরা চায়ের ভাঁড়। আকাশ-পাতাল ভেবে চলেছে অশোক।
'কী গো,চা-টা মুখে দাও ,ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।'
' ও জীবন রে, ছাড়িয়া যাস না মোরে / তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে মাইনষে কইবে মরা জীবন রে....' কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে এই উথালপাতাল লোকগীতির সুর। অশোকের ক্রোধের উপর শিশিরের প্রলেপ দিচ্ছে যেন সুরটা। সত্যিই তো কাম, ক্রোধ,লোভ,জ্বালা-যন্ত্রণার বশবর্তী হয়ে এ জীবন ছেড়ে চলে গেলে কী দাম থাকে জীবনের। ক্রোধ প্রশমিত করার চেষ্টা করে অশোক। সিনেমায়, বাস্তবে এমন হামেশাই দেখা যায়,অপ্রত্যাশিত মানসিক আঘাত সামলাতে না পেরে কত লোক হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যান।
হঠাৎ খানিকটা দূরে ব্রেক কষে একটা বাইক এসে দাঁড়াল যেন। অলি দেখে বলল, 'ওই তো উপমা, বাইক থেকে নামছে।ওর সামনে একটা ছেলে। মাথায় হেলমেট।এত ঔদ্ধত্য ! আশোক সামলাতে পারে না নিজেকে।দু'পা এগিয়ে উপমার গালে ঠাস করে চড় কষায়, 'কোথায় ছিলি সারাদিন?'
ছেলেটি ততক্ষনে হেলমেট খুলেছে। দুই হাতে উপমাকে আড়াল করে বলছে, 'স্যার ওকে মারবেন না,আমাকে যত খুশি মারুন।'এগিয়ে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়ায় অশোকের সামনে।এতক্ষণে ছেলেটিকে চিনতে পারে অশোক। বছর দশেক আগে ওর কাছেই পড়তো।নামটা কি মনে করতে পারছে না এই মুহূর্তে।
'কে তুই?তোকে আমি চিনি না।' বলে উপমাকে ফের মারতে উদ্যত হয়, 'এইভাবে তুই আমাদের চিটিং করছিস।'' অলি জাপটে ধরে অশোককে। প্রাণপণ ঠেকানোর চেষ্টা করে।খোলা মঞ্চে এমন দুর্যোগের মধ্যে জীবনের জটিল অংক মঞ্চস্থ হতে দেখে, কৌতূহলী দু'একজন দর্শক বৃষ্টি মাথায় দাঁড়িয়ে গেছে কাছে-দূরে।ফুটপাতবাসী একজন আরেকজনকে বলছে, 'প্রেম কাহানি,লায়লা-মজনু ।''
অলি উপমার হাত ধরে টানে, ' চল,বাড়ি চল।'
'না,আমি যাব না। বাড়ি গেলে তোমরা আমাকে আটকে দেবে।'
'তোমরা আমাকে আটকে দেবে' কথাটা যেন বুলেটের মতো অশোকের বুক ফুড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল। বাড়ি উপমার কাছে জেলখানা! এ কোন রক্তে রক্তাক্ত হল ওর পঞ্চাশোর্ধ জীবন,বুঝতে পারে না অশোক। অভিমানাহত, ক্ষতবিক্ষত বুকটাকে কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।
অশোক-অলি কারারক্ষী,বাবা-মা নয়,উপমার কাছে! তুমুল কান্নার বৃষ্টি নামল বুকের ভেতর। বাইরের প্রকৃতির অঝোর ধারা আর অন্তর্নিহিত কান্নার বৃষ্টি দুইয়ের মিলিত জল অশোকের রক্তাক্ত বুক ধুয়ে দিতে পারল না। অলি অনুনয়-বিনয়,কাকুতি-মিনতি করে চলেছে, ' চল, বাড়ি চল।'
' না, আমি আর বাড়ি যাব না। তোমরা চলে যাও।'
' কী বলছিস তুই? বাবার এমনিতেই শরীর ভালো না যদি কিছু একটা হয়ে যায়।'
' কিছু হবে না, তোমরা চলে যাও।' ঘন্টাখানেক ধরে অলি বোঝানোর চেষ্টা করল। উপমা বুঝল না, বাইকে উঠে চলে গেল।বিষণ্ন মর্মাহত অলি এসে দাঁড়াল অশোকের সামনে, ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল ' এল না, চলে গেল!'
'চলে গেল!' অস্ফুটে কথাটা বলে ধপাস করে বসে পড়ল অশোক। চায়ের দোকানের সাউন্ডবক্সে তখন বাজছে অন্য গান ...' মুকুটটা তো পড়ে রইল,রাজাই শুধু নেই...'
'ওঠো,বাড়ি যাই।'
'বাড়ি!কোথায়?' কথাটা বলেই মুহূর্তে সামলে নেয়, ' যাব,একটু বোসো।'
' কি কাকি, কাকুর শরীর খারাপ লাগছে?'
' না, একটু বসি?'
' বসুন না, বিষ্টি-বাস্টার দিন খদ্দের কোথায়!গান শুনছি।
' গানটা বন্ধ করবে প্লিজ ভাই! ' অশোকের কাতর অনুরোধ। এমনিতেই গানটার সুর দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে ভিতরে, অসহ্য লাগছে কানে শুনতে।'পাগল টাগল নাকি 'দোকানদারের চাহনিতে বিস্ময়। তবুও কী ভেবে সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করে লোকটা । ২৫ বছর ধরে তিল তিল করে যে মুকুট গড়ে তুলেছিল, যে পরবে সেই তো চলে গেল। সব সিংহাসন আসলে ধুলোর সিংহাসন। বিধ্বস্ত অশোক ধীরে ধীরে হাতটা বাড়িয়ে দেয় অলির দিকে, ' চলো বাড়ি যাই। '
ওরা বাড়ি এল। উপমা এল না। ঘরে ঢুকতেই ব্যথাটা লক্ষ লক্ষ সূচ হয়ে বিধঁতে লাগল । পাঁজরে? ফুসফুসে? অশ্রুগ্রন্থিতে? সর্বশরীরে? না,শরীরে নয়,আত্মায়-- যেখানে,অশোক জানে,চুপটি করে শুয়ে আছে তার একান্ত আপন হোমাপাখিটি ।যন্ত্রণায় মুখ ঢেকেছে সে-ও? ঢাকতে পারছে না অশোক... ওই উপমার বইপত্র, ছবি আঁকার খাতা, রং-তুলি পেন- পেন্সিল,ওই হারমোনিয়াম গিটার, পুজোয় কেনা লেহেঙ্গা,চিরুনি লিপস্টিক, চুল বাঁধার গার্ডার,পায়ের তোড়া, নুপুর.... সারা ঘরে ছড়ানো ছেটানো অজস্র উপমা...তারা কখনো হেসে উঠছে...জড়িয়ে ধরছে অলিকে.. ঘোড়া বানাচ্ছে অশোককে....লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে... আদরে আবদারে অতিষ্ঠ করে তুলছে ২০৬ খানা হাড়... স্নেহের পুত্তলি হয়ে হুটোপাটি করছে এঘর ওঘর... কারো মুখে ভাষা নেই..চারটি চোখ যেন শূন্যতার চারটি সমুদ্র..শূন্যতার এত ভাষা থাকে,কথা বলে অনর্গল.. কথা বলে বলে কেড়ে নিল অশোক-অলির বাকি রাতটুকু...
বাইশ বছরের মধ্যে এই প্রথম একটি রাত পেরোল, যে-রাতে দু'হাতের সীমায় উপমা নেই...পুবের আকাশ ফর্সা হতেই ডুকরে কেঁদে উঠল অলি, উপমাহীন আরো একটা দিন আসছে....চোখের অশ্রুনদী কোনোরকমে সামলে, অলির মাথায় কোমলস্পর্শ বুলিয়ে অশোক বলল 'ভোর হয়েছে, অলি ওঠো।'
**************************************************************************************************
** দু'বছর ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবার পর, ধুলোর সিংহাসন উপন্যাসটির অন্তিম পর্ব আজ শেষ হল।
***************************************************************************************************
***********************************************************************************************************