শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

রম্যরচনা * দেবাংশু সরকার



কালাচাঁদের সিদ্ধিলাভ

দেবাংশু সরকার


                        এক

আবার পুজো এলো। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে  মানুষের ভিড়। ছেলে বুড়ো সবাই পুজোর আনন্দে মেতে উঠেছে। কিন্তু কালাচাঁদের মনে কোনো শান্তি নেই, কোনো  আনন্দ নেই। 

      দেখতে দেখতে এক বছর হতে চললো। দুর্গাপুজোর পর কালীপুজো, তার কদিন পরেই কার্তিক পুজো। অর্থাৎ বছর ঘুরতে আর বেশি বাকি নেই। অথচ কালাচাঁদ যেন কিছুতেই সেই দিনটাকে, বিশেষ করে সেই রাতটাকে ভুলতে পারছে না। যতক্ষণ দোকানের কাজে ব্যস্ত থাকে বেশ ভালো থাকে। কিন্তু কাজের অবসরে যখন সে একা থাকে, তখন উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে গত বছরের সেই রাতটার কথা।   ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যায় সে! কোথায় যেন হারিয়ে যায়!

   কালাচাঁদ মিত্তিরের জীবনে কোনো কিছুরই অভাব নেই। সে একজন সফল ব্যবসায়ী। তার মুদিখানা দোকানের ব্যবসা ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কয়েক বছর হল সে একটা তেলের ঘানি খুলেছে। সেটাও দিনে দিনে লাভ জনক হয়ে উঠেছে। তার ব্যাঙ্কের খাতাগুলোতে টাকার পাহাড় তৈরি হয়েছে। কালাচাঁদ টাকার ব্যাপারে বেশ হিসেবী। নিন্দুকেরা অবশ্য তাকে হাড় কিপটে বলে। পারিবারিক দিক দিয়েও সে বেশ সুখী। দুই উচ্চ শিক্ষিত ছেলের বাবা সে। বড় ছেলে রবীন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করে। কিছু দিনের মধ্যেই সে বিদেশে পাড়ি দেবে। তার বিয়েও হয়েছে। ছোট ছেলে রমিত ডাক্তারী পড়ছে। তারও ভবিষ্যত উজ্জ্বল। 

      পরিবার নিয়ে, ছেলেদের নিয়ে কালাচাঁদের কোনো চিন্তা না থাকলেও একটা দুশ্চিন্তা তার মনের মধ্যে কাঁটার মত বিঁধে রয়েছে। এতবড় ব্যবসা, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত টাকা আসছে, কিন্তু এর ভবিষ্যত কি? কালাচাঁদের বয়স বাড়ছে। ষাট পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগেই। তার অবর্তমানে কে দেখবে এই ব্যবসা? তার উচ্চ শিক্ষিত দুই ছেলের কোনো আগ্রহ নেই এই ব্যবসাতে। রবীনতো কিছু দিন পরেই বিদেশে যাবে। আর রমিত কি ডাক্তার হয়ে মুদি দোকানের দাঁড়ি পাল্লা ধরবে! এই একটা চিন্তা কালাচাঁদকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

       আজ মহাসপ্তমী। কিন্তু পুজোয় মেতে ওঠার মানসিকতা কালাচাঁদের আর নেই। কর্মচারীদের ছুটি দিয়ে সে একা বসে আছে তার দোকানে। ফাঁকা দোকান। কোনো খদ্দের নেই। একা বসে থাকতে থাকতে আবার তার মনে পড়ে যাচ্ছে গত বছরের কথা।  গত বছরে  পুজোর পর কালাচাঁদ একটা ফিসফিসানি শুনতে পায় যে, রবীনের বন্ধুরা কার্তিক পুজোটা একটু ভালোভাবে এনজয় করতে চায়। এবার তারা নববিবাহিত রবীনের বাড়িতে কার্তিক ঠাকুর ফেলবে। হাড় কিপটে কালাচাঁদ শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তার হাড় মাস কালি করা খাটুনির টাকায় ভুত ভোজন হবে! এটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। পরে যখন মাথা ঠান্ডা হয় তখন অন্য কিছু তার মাথায় আসে। চুপ করে যায় সে। হাসি মুখে মেনে নেয় রবীনের বন্ধুদের পরিকল্পনা। এমনকি ঠাকুর আনা, পুরুত ডাকা, পুজোর আয়োজন, অতিথি আপ্যায়ন যাতে সুচারু রূপে হয় তার পরামর্শ সে দেয় রবীনের বন্ধুদের।

      মহা ধুমধামে কার্তিক পুজো হলো কালাচাঁদের বাড়িতে। হাসি মুখে অতিথি আপ্যায়ন করলো সপুত্র কালাচাঁদ। অনেক রাত অবধি চললো খাওয়া দাওয়া, হৈ হুল্লোড়, গান বাজনা। প্রায় মধ্যরাতে এক এক করে বিদায় নিলো অতিথিরা। ক্রমশ বাড়ি ফাঁকা হল।

      ক্লান্ত অবসন্ন কালাচাঁদের বাড়ির সদস্যরা যে যার ঘরে ঘুমোতে গেল। কিন্তু কালাচাঁদের চোখে ঘুম নেই। ধীর পায়ে সে ঢুকল পুজো মন্ডপে, পদ্মাসনে বসে, সে ঘোর তপস্যা করতে লাগলো, "ভগবান, লোকে  আমাকে কিপটে বলে। কিন্তু সত্যিই কি আমি কিপটে? আমার দুই ছেলেকে আমি লেখা পড়া শিখিয়ে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার তৈরি করলাম আমার রক্ত জল করা খাটুনির টাকায়। তারা বড় হল, মানুষ হল কিন্তু আমার সাধের ব্যবসার দিকে ঘুরেও তাকালো না। সেই ছোট থেকেই আমি কি অমানুষিক পরিশ্রম করেছি। এক একটা টাকার হিসেব নিকেষ করেছি তাই আমাকে লোকে কিপটে বলে। কিন্তু ভগবান আমি কি সত্যই কিপটে? তোমার পুজোয়, তোমার আরাধনায় কি আমি কোনো রকম কার্পণ্য করেছি? শুধু টাকা খরচ নয়, আমি নিষ্ঠার সঙ্গে উপবাস করে তোমাকে অঞ্জলি দিয়েছি। ওরা তো  সব খেতে আর ফুর্তি করতে এসেছিলো। ওদের মধ্যে আমার মত কোনো নিষ্ঠা ছিল না। ভগবান আমি তোমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত। আমাকে বরদান কর।"


                           দুই

      রাজ সভা বসেছে স্বর্গলোকে। রাজ সিংহাসনে বসে আছেন দেবরাজ ইন্দ্র। অনান্য দেবতারাও যে যার আসন অলংকৃত করে বসে আছেন। হঠাৎ দেব সেনাপতি কার্তিক উঠে দাঁড়িয়ে দেবরাজকে বললেন, "দেবরাজ আমাকে অনুমতি দিন, আমাকে এখনই মর্ত্যলোকে যেতে হবে।'" 

      কিছুটা অবাক হয়ে দেবরাজ প্রশ্ন করলেন, "কেন দেব সেনাপতি? মর্ত্যে কি অসুরেরা আবার অত্যাচার শুরু করেছে? তুমি কি সেনাদল নিয়ে মর্ত্যে যাবে?"

     ময়ূর বাহন দেবরাজকে আশ্বস্ত  করে বললেন, "না রাজন, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি না। এখন আর যুদ্ধের পরিস্থিতি নেই। কারন অসুরদের রাজা মহিষাসুরের মনে আর কোনো যুদ্ধের বাসনা নেই। তাছাড়া সে খুব অসুস্থ। বুকের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে।"

      অত্যন্ত উদ্বীগ্ন হয়ে দেবরাজ প্রশ্ন করলেন, "কি হয়েছে আমার প্রিয় মহিষের?"

      কার্তিক ঠাকুর উত্তর দেন, "আমি বিশেষ কিছু জানি না। দেব বৈদ্য অশ্বিনী কুমার যথাযথ  উত্তর দিতে পারবেন।"

      দেবরাজ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন দেব বৈদ্যের দিকে।

      দেব বৈদ্য বলতে থাকেন, "রাজন, মহিষের অসুখ অতি পুরানো। মা দুর্গা মহিষকে ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করার পর তাকে অমরত্ব প্রদান করেন। ফলস্বরূপ তার আঘাত অমর হয়ে যায়। সেই আঘাতজনিত ঘা আর শুকোয় নি। এখনো  রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে। যখন মহিষ আমার ডিস্পেনসারিতে এলো, প্রথমে ওর ইনজুরিটা দেখে  বিনাইন মনে হলেও, ওটা ম্যালিগন্যান্ট ছিল। পরে পজিটিভ কার্সিনোমাতে টার্ণ করে। অমরত্ব লাভের ফলে মহিষ জীবিত থাকলেও ক্যান্সারের ফোর্থ স্টেজের যন্ত্রণাটা সহ্য করতে হচ্ছে।"

      হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেবরাজ বলেন, "দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বল না। যে ভাষা আমার বোধগম্য সেই ভাষা প্রয়োগ কর।''

      হাত জড়ো করে অশ্মিনী কুমার বলতে লাগলেন, "ক্ষমা করবেন  রাজন। স্বর্গলোকে অমৃতের কারনে চিকিৎসা বিদ্যা প্রয়োগের সুযোগ খুব কম । সেই হেতু আমি অবসর সময়ে  ছদ্মবেশে মর্ত্যে গিয়ে ওখানকার চিকিৎসালয়গুলোতে ঘুরে বেড়াই। ওদের চিকিৎসা পদ্ধতি দেখি। ওদের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনি। সেই কারনে  ওদের ভাষাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। যাইহোক মহিষের আঘাত প্রথম থেকেই জটিল ছিল। পরে কর্কট রোগে পর্যবসিত হয়। মর্ত্যলোকের কেউ হলে বহু পুর্বে পরলোক গমন করতো। অবশ্য মহিষের ব্যাপারটা স্বতন্ত্র।


       অশ্মিনী কুমার থামার পর দেব সেনাপতি বলতে শুরু করলেন, "আমার এক পরম ভক্ত  আমার তপস্যা করছে। তার ডাকে সাড়া দিতেই আমাকে অবিলম্বে মর্ত্যলোকে যেতে হবে। আপনি অনুমতি দিন। রাজন, আপনিতো জানেন পিতাশ্রী মহাদেব এবং কৃষ্ণ ঠাকুরের দাপটে মর্ত্যলোকে আমার ভক্ত সংখ্যা অতি নগণ্য। এমন কি ভ্রাতা গনপতিও আমার থেকে এগিয়ে। অবশেষে একজন একনিষ্ঠ ভক্ত আমি পেয়েছি। তার ডাকে সাড়া দিতেই হবে।

      দেবরাজের অনুমতি নিয়ে ময়ূর বাহন পবনের বেগে মর্ত্যলোকে প্রবেশ করলেন।


                       তিন 

মধ্য রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক মনে তপস্যা করে চলেছে কালাচাঁদ। হঠাৎ চারিদিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তীব্র আলোর ঝলকানি সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে নিলো কালাচাঁদ।

      - বৎস তোমার তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। বল কি বর চাও?

      - ভগবান আমার ডাকে সাড়া দিতে তুমি স্বয়ং এসেছো! তার মানে আমি তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেছি! আমি ধন্য। আমার একটাই প্রার্থনা, আমার ব্যবসাটা যেন রক্ষা পায়।

      - পরিস্কার করে বল, তুমি ঠিক কি বর চাও?

      - ভগবান, আমার ছেলেদের আমার ব্যবসার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। আমার বয়স এখন উনষাট বছর। আমার অবর্তমানে কে দেখবে এই ব্যবসা? আমার যোগ্য উত্তরসূরী চাই, যে আমার এই সাধের ব্যবসাটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারবে। আরো বড় করবে। রবীন সবে বিয়ে করেছে, ওর কথা পরে ভাবলেও চলবে। এখন আমাকে কৃপা কর।

      - তথাস্তু। তুমি আমার পরম, একনিষ্ঠ এবং সম্ভবত একমাত্র ভক্ত। তোমাকে আমার অদেয় কিছুই নেই। তুমি এক চাইলে আমি একশো দেবো। সুতরাং এক নয়, তুমি অবিলম্বে শত পুত্রের জনক হবে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তোমার বানিজ্য বিশেষ ব্যাপ্তি লাভ করবে। এই ধরাধামের সর্বোত্তম বানিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হবে।

      - কিন্তু ভগবান আমি এখন বৃদ্ধ। আমার পক্ষেতো এখন সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়।

      - ওসব নিয়ে চিন্তা কর না। তোমাকে দ্বিতীয় বর দান করছি। তুমি এবং তোমার পত্নী অবিলম্বে যৌবন ফিরে পাবে এবং অতি দীর্ঘ জীবন যৌবন লাভ করবে।

      - আমি ধন্য প্রভু।

      - কেবল আমার বর দান নয়। আমি স্বর্গলোকে প্রত্যাবর্তন করে মাতা ষষ্ঠী ঠাকরূণকে অনুরোধ করবো যাতে তার কৃপা দৃষ্টিও তোমাদের উপর বর্ষিত হয়। তোমার মঙ্গল হোক।

      - প্রভু আমার পুত্ররা কি এক সাথে জন্ম গ্রহণ করবে, নাকি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভূমিষ্ঠ হবে?

      - বৎস, এটা দ্বাপর যুগ নয়। ঘোর কলি। সেই কারনে প্রকৃতিগত এবং পদ্ধতিগত নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে তোমার পুত্ররা জন্ম গ্রহণ করতে থাকবে। যতক্ষণ না তোমার শেষতম পুত্র জন্ম গ্রহণ করছে ততক্ষণ তোমাদের যৌবন অক্ষত থাকবে। অর্থাৎ তোমরা শতবর্ষব্যাপী যৌবনের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে।

      কথা শেষ করেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন ময়ূর বাহন।

      একশো বছর ধরে যৌবনের মজা! ভাবতে ভাবতে 'উরে ব্বাস' বলে চিৎকার করে প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লাফিয়ে ওঠে কালাচাঁদ। নিজের শারীরিক সক্ষমতা দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে যায়।

     কার্তিক ঠাকুর চলে যাওয়ার পর আবার চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে যায়। কালাচাঁদ অন্ধকারের মধ্যেই আড়ামোড়া ভেঙে নিজের শারীরিক ক্ষমতা পরখ করলো। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে তার গিন্নীকে ঘুম থেকে তুলে সব খুলে বললো। সারা দিনের খাটা খাটুনি, পুজোর জোগাড়, অতিথি আপ্যায়নের পর অসময়ে ঘুম ভাঙাতে মিত্তির গিন্নীর মেজাজটা বেশ খিঁচড়ে গেছে। তারপর আবোল তাবোল কথা শুনে সপ্তমে চড়লো তার মেজাজটা। শুনিয়ে দিল দু চারটে কথা।

      - আহা, গিন্নী তুমি রাগ করছো কেন? আমাকে দেখো, আমার শরীরে এখন অসুরের শক্তি। এবার তুমিও যৌবন  ফিরে পাবে। আসলে মেয়েদের শরীর কিছুটা জটিলতো, তাই তোমার যৌবন ফিরে পেতে একটু দেরি হচ্ছে।

      - ওরে বাবারে, সারাদিন খাটা খাটুনির পর রাত দুপুরে ঘুম ভাঙিয়ে মুখপোড়া মিনষে কি আষাঢ়ে গল্প জুড়েছে!

      - গিন্নী আমাদের আরো একশোটা ছেলে হবে। তার মানে আরো একশো বছরের যৌবন, প্রেম, ভালোবাসা, আরো কত কিছু! উরি বাবা আমি ভাবতে পারছি না!

      - বলছিলাম কি, আমিও শরীরে কেমন যেন জোর পাচ্ছি। বাতের ব্যথাটাও মনে হচ্ছে আর নেই।

      - হবেইতো গিন্নী, এসব দেবতার বরদান। কিছুক্ষনের মধ্যে তোমার সাদা চুল কালো হবে। শরীর টানটান হয়ে উঠবে।

     আচমকাই দাঁত খিচিয়ে ওঠে মিত্তির গিন্নী,  "সেতো হবে। কিন্তু মুখপোড়া মিনষে, তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান নেই, দেব দ্বীজের কাছে মিথ্যে বলেছো কোন সাহসে? তোমার এখন ছেষট্টি বছর বয়স, আর তুমি কিনা ভগবানের কাছেও বয়স ভাঁড়িয়ে উনষাট বলেছো!" 

      চোখে মুখে চালাকি ভাব এনে কালাচাঁদ বলে "ওসব কথা ছাড়োতো। কার্তিক ঠাকুর বেশি দুর লেখা পড়া করেনি। অঙ্কতেও কাঁচা। সারা জীবনতো অসুরদের সঙ্গে লড়াই মারামারি করে কাটালো। যদি গনেশ ঠাকুর বা মা সরস্বতীর মত পাশ করা শিক্ষিত হতো তাহলে কি আর ওর কাছে বয়সে জল মেশাতাম! ওসব ছাড়ো, এবার আমাদের নতুন যৌবন এসেছে, কিভাবে আমোদ আহ্লাদ করবে সেটাই ভাবো দিকিনি। একশো ছেলে মানে একশো বার হানিমুন।"

     মাথার ঘোমটা কিছুটা টেনে মিত্তির গিন্নী বলে "মরণ! এতোখানি বয়স হলো, ঘাটের মড়ার তিন কাল গিয়ে এক কাল আছে কি না তার ঠিক নেই, এখনো হুলো বেড়ালের মত ছোঁকছোঁকানি গেল না! খালি যৈবন যৈবন করে চলেছে!"

      "আহা গিন্নী রাগ কর কেন?" নরম গলায় বলে কালাচাঁদ, "যৌবন নিয়ে খেলা করতে তোমার ভালো লাগে না? আগামী একশো বছরে তুমি কখনো হয়ে উঠবে হেমা মালিনী, কখনো শ্রীদেবী, কখনো মাধুরী, আবার কখনো...কি?"

      - কি?

      - কা - শ - মী - র     কি    ক - লি - ই!

      কথা শেষ করেই কালাচাঁদ গান গাইতে শুরু করলো,

      "ইয়ে, চাঁদ সা রওশন চ্যাহরা।

       ঝুলপো কা রং সুন্যাহরা..."

      দ্বিতীয় বার ফিরে পাওয়া যৌবনের উদ্দীপনায় জোরে জোরে হাততালি দিতে দিতে, গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকে কালাচাঁদ। সঙ্গে চলে উদ্দাম নৃত্য।

      " ...তারিফ করুঁ শ্বশুর কি।

        জিসনে তুমে বানায়া ...।"

      নেচেই চলেছে কালাচাঁদ। গেয়েই চলেছে কালাচাঁদ। দাপুটে মিত্তির গিন্নীর বিকট দাবড়ানিও থামাতে পারছে না তাকে! বেশ কিছুক্ষণ পরে নাচ গান থামিয়ে একটা চেয়ারে বসে হাঁপাতে থাকে।

      "কি গা তোমার হাঁপানির ব্যামো আবার বাড়লো নাকি?" উদ্বেগের সঙ্গে প্রশ্ন করে মিত্তির গিন্নী।

      "হাঁপানি! আমার! হাসালে গিন্নী!" একটা বাঁকা হাসি খেলে যায় কালাচাঁদের মুখে, "আমি এখন টাট্টু ঘোড়া। টগবগ করছি হানিমুনে যাবো বলে। আসলে তুমি বুঝতে পারছ না এখন আমার হর্স পাওয়ার কত! বুঝবে বুঝবে। সময় হলে সব বুঝবে। এবার আসল কথা শোনো। এবার আর কিপটেমি নয়। এবার আমরা হানিমুন করতে গোয়াতে যাবো। ফাইভ স্টার হোটেলে উঠবো। হানিমুনটাকে এবার আমরা উৎসবে পরিনত করবো। গোয়াতে গিয়ে সকাল সকাল আমরা সুইমিং কস্টিউম পরে সমুদ্র স্নান সেরে এসে আমরা হোটেলের সুইমিং পুলে নেমে অনেকক্ষণ ধরে জলকেলি করবো। তুমি ডুব সাঁতার দেবে, আমি ভেসে উঠবো। আমি ডুববো তুমি ভাসবে, তুমি ডুববে আমি ভাসবো। তারপর এক সময়ে তুমি ছুটতে ছুটতে হোটেলের রুমে গিয়ে সুইমিং কস্টিউম ছেড়ে একটা নীল রঙের  স্লিভলেস টপ, লাল রঙের হটপ্যান্ট আর বেগুনি রঙের সানগ্লাস পরে ছুটতে ছুটতে ফিরে আসবে। তারপর আমরা সুইমিং পুলের ধারে বসে খুনসুটি করবো। কখনো তোমার ডান কোমরে কাতুকুতু দেবো, কখনো তোমার বাঁ কোমরে চিমটি কাটবো। তুমি খিকখিক করে হাসবে। কখনো তুমি আমার দিকে তাকিয়ে ডান চোখ টিপবে, কখনো আমি তোমার দিকে তাকিয়ে বাঁ চোখ টিপবো। কখনো তুমি আমাকে...কখনো আমি তোমাকে ...। তারপর এক সময়ে হোটেলে ফিরে এসে বিকেল বেলাতেই হোটেলের দরজা বন্ধ করে 'ডু নট ডিস্টার্ব' বোর্ড ঝুলিয়ে দেবো। তারপর শুরু হবে আমাদের হানিমুনের মুল উৎসব। উরি বাবা! আর ভাবতে পারছি না! হামদোনো দোপ্রেমী এবার দুনিয়াকে দেখিয়ে দেবো কাকে বলে যৌবনের খেলা!" কথা শেষ করে, কোনো এক অনাবিল সুখের কথা ভেবে, আবার হাততালি দিয়ে লাফাতে থাকে কালাচাঁদ।

      - কি হল কি? বুড়ো মদ্দ রাত দুপুরে লাফাচ্ছো কেন?

      - না, না। আমি আর বুড়ো নই। আমি এখন জাম্পিং জ্যাক। যতক্ষণ না হানিমুনে যাচ্ছি, ততক্ষণ লাফাতে থাকবো।

      অবশ্য কিছুক্ষণ পরে লাফালাফি থামিয়ে, কিছুটা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, "যাক বাবা, এবার হানিমুনে গিয়ে আর ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। প্রথম বার হানিমুনে গিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। একটু এদিক ওদিক হলেই সব শেষ। হলোও তাই। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রবীন এসে গেল। হয়ে গেল! জবানির মজা চলে গেল ভবানীর ভাঁড়ে! ডাক্তার তোমাকে ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়ে কত কিছু বোঝালো। কোনো কথাই শুনলে না। মুখ্যু মেয়েছেলেদের নিয়ে অনেক জ্বালা!" স্পষ্টতই হতাশ লাগে কালাচাঁদকে। পরক্ষণেই হতাশা কাটিয়ে সে বলতে থাকে, "এবার অবশ্য ওসব ব্যাপার নেই। এখন আমরা ফ্রি প্লেয়ার। মানে মজা আন লিমিটেড। কাল সকালেই আমি সুইমিং কস্টিউম, হট প্যান্ট সব কিছু কিনে আনবো।"

      কালাচাঁদকে থামিয়ে আবার বাক্য বাণ ছুঁড়তে শুরু করে তার গিন্নী, "হ্যাঁ গা বেআক্কেলে মিনষে, তুমি যে একশো ছেলের বাপ হবে বলে আনন্দে নেচে উঠেছো, কিন্তু একশো ছেলেকে তোমার চার কামরার বাড়িতে কোথায় শুতে দেবে? অত ঘর, অত ক্যাঁথা কম্বল তোমার আছে? কি খেতে দেবে অতগুলো ছেলেকে? একশো ছেলের খোরাক! ট্যাঁকের জোর আছে? বেআক্কেলে মিনষের ওসব দিকে হুশ নেই খালি যৈবন যৈবন করে চলেছে। কোথা থেকে এলোরে আমার যৈবন ওলা। বুড়ো শকুনের পুলক জেগেছে, এখন গোয়া যাবে ডুব সাঁতার কাটতে! ঘরে ছেলে, ছেলের বউ রয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই, উনি এখন যৈবনের খেলা দেখাবেন! ঝ্যাঁটা মারো অমন যৈবনের মুখে!" 

      চমকে ওঠে কালাচাঁদ। যেন তড়িতাহত হয়ে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে সে বলতে থাকে, "সত্যিইতো গিন্নী, এদিকটাতো ভেবে দেখিনি! হায় হায়! এতো মহা বিপদ হয়ে গেল আমার! কার্তিক ঠাকুরতো বর দিয়ে খালাস। কে হ্যাপা সামলাবে? দশরথের শাপে বর হয়ে ছিল। আমারতো বরে শাপ হয়ে গেল! ভগবান তোমার বর তুমি ফেরত নাও। আমার উত্তরসুরির দরকার নেই।"

      "ওসব বললেতো হবে না। বর বা অভিশাপ একবার দিলে আর ফেরত হয় না। তোমার হ্যাপা তোমাকেই সামলাতে হবে। এবার বোঝো যৈবনের ঠ্যালা। আরো লাফাতে থাকো যৈবন যৈবন করে!" টিপ্পনী কাটে মিত্তির গিন্নী।

      "আমিতো বরটা ফেরত নিতে বলছি না। দেবতার বর ফেরত দেওয়া মহা পাপ। আমি চাই একশোটা ছেলে হোক। একশো বার হানিমুন হোক। একশো বছর ধরে প্রেম, ভালোবাসা, আমোদ, আহ্লাদ,আর যা যা হওয়ার কথা ছিল সব হোক। আমি বলছি একশো ছেলের খাওয়া পরার দায়িত্বটা অন্তত কার্তিক ঠাকুর নিক। এক্ষুনি কার্তিক ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলতে হবে।" হাহুতাশ করতে থাকে কালাচাঁদ।

      "তার মানে, তুমি ডুব সাঁতার কাটবে আর কার্তিক ঠাকুর হ্যাপা সামলাবে! কিন্তু সেতো অনেক আগেই চলে গেছে। এখন তাকে কোথায় পাবে? এখন বসে বসে মাথা চাপড়াও।" ফোড়ন কাটে মিত্তির গিন্নী।

      "যত দুরেই যাক, আমি তাকে ধাওয়া করে ঠিক ধরবো। দরকার হলে সশরীরে স্বর্গে যাবো। আমি চললাম। রক্ষা কর ভগবান। ত্রাহিমাম ত্রাহিমাম।" চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে কালাচাঁদ উদভ্রান্তের মত দৌড়োদৌড়ি করতে থাকে। হয়তো সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার রাস্তাটা খুঁজতে থাকে!


                  চার

      "কি হল কি? ভোগের খিচুড়ি খেয়ে পেট গরম হল না কি? সারারাত হাত পা ছুঁড়ছো, আর বিড় বিড় করে কি সব বলছো? এখন আবার কনুই দিয়ে গুঁতোতে শুরু করেছো। বাবারে, এই বুড়ো ভামকে নিয়ে আর পারা যায় না!" খেঁকিয়ে ওঠে মিত্তির গিন্নী।

      গিন্নীর ধমকানিতে ধড়ফড় করে উঠে বসে কালাচাঁদ, চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলে, "একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম। একটা আইবুড়ো ছোঁড়া কি সব যেন বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল!"


********************************************************************************************************



দেবাংশু সরকার

পেশা মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ। স্কুলের পত্রিকায় নিয়মিত লেখার অভ্যাস থাকলেও, তারপর দীর্ঘ বিরতি।লকডাউনের প্রথম বছরটা (2020) টিভিতে রামায়ণ মহাভারত দেখে কেটে গেলেও। লকডাউনের দ্বিতীয় বছরের অখন্ড অবসরে আবার লেখার দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু। 

সাম্প্রতিক লেখা - প্রজাপতি সাহিত্য পত্রিকা/  সৃজন সাহিত্য পত্রিকা/  রংমিলন্তি প্রকাশনা/  কারুলিপি অনুগল্প সংকলন/  অবেক্ষন/  ড্যাস সাহিত্য পত্রিকা/  লেখা ঘর সাহিত্য পত্রিকা/  সমন্বয় পত্রিকা/  মৌনমুখর সাহিত্য পত্রিকা/ তুলি কলম আকাশ/  ঘোড়সওয়ার/  স্নিগ্ধা প্রকাশনী/ নীরব আলো পত্রিকা এবং স্বরবর্ণতে প্রকাশিত হয়েছে।

                

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন