শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

গল্প * সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়



আজ বসন্ত  

সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়


বৃষ্টি থামার পরে তখন সোনালী রোদটা একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে মেঘের আড়াল থেকে, আকাশটার একদিক কালো মেঘে মোড়া তো আরেকদিক সোনালী ছটায় ঝলমলে । চারপাশে ভিজে মাটি, সোঁদা গন্ধ, কয়েক পশলা বৃষ্টির পর যেন অনেকটা সতেজতা, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার পালা যেন এবার ।

ফুরিয়ে আসা বিকেলের এই সময়টুকু তিস্তা ছাদে চলে আসে। পৃথিবীর মতো একটা ছাদ ফাঁক ফাঁক ইঁটের দেওয়ালে ঘেরা। রঙহীন নতুন নতুন শ্যাওলার হেলিপ্যড যেন। ছাদের মোটা আলসেতে ভর দিয়ে আকাশের কোন প্রান্তে মা আর বাবার মুখটা খুঁজে চলে সে। 

আজ প্রায় একবছর হলো সে বড় একা।সেদিনটা আজও মনে পড়ে তিস্তার। কার্শিয়াং এর মিরিকের কাছে গাড়ি এক্সিডেন্টে দু'জনেই একসাথে চলে গেলো। কি তীব্র ভালোবাসা।তাঁদের দিনরাতের দাম্পত্য জীবনে একসাথে পড়ন্ত সূর্যের রশ্মি ছুঁয়ে গেলো-- 


এক শেষ আষাঢ়ের বিকেল ছিল সেটা । আষাঢ় বটে কিন্তু সেদিন কোন বৃষ্টি ছিল না । আকাশ ও কাঁদতে ভুলেছিল কি ? সেদিন দুটি মানুষকে একইসাথে চিতায় তুলে দিয়েছিল সে যাদের সাথে সাথে তিস্তার শৈশব , কৈশোর ও সদ্য যৌবন যেন দাউ, দাউ করে জ্বলে যাচ্ছিল। শেষ বিকেলের আলোয় আকাশের গায়ে সুস্পষ্ট ছবি দেখেছিলো বাবা মায়ের। 


আকাশের কালো রঙ আগাম ঘোষনা করেছিলো তিস্তার জীবন টা হয়ত আস্তে  আস্তে বদলে যাবে এর পর থেকে । যে মানুষটার হাত ধরে আমার প্রথম অক্ষর চেনা , প্রায় প্রথম সব কিছুই ওই হাত ধরেই -- সেই বাবাকে যেন কালো মেঘের আড়ালে একঝলক দেখতে পেলো সে।


তারপর থেকে পাহাড়ের বাড়িটা যেন তিস্তাকে গিলতে আসতো।দিনরাত নিজের ঘরে বন্দী যৌবন।ছোট্ট একটুকরো জানালা, অনেকটা রহস্যময় অন্ধকার,  আকাশচুম্বী পাইনের সারি, পাখির শব্দ আর দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের ঢেউ। দিনের প্রথম আলোটুকু শরীরময় শিশুর মতো দাপাদাপি শুরু করে দিতো।কখনো বৃষ্টি নামতো ধীর গতিতে। সারি সারি পামগাছের মাথায় থমকে থাকতো মেঘ।পাতার গায়ের শিরা বেয়ে জলধারা -- অনবরত বৃষ্টি। আবার কখনো কালো ঘন মেঘ সরিয়ে বিশালাকার পর্বতশ্রেণী শ্বেতশুভ্র রথে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো হাজির হতো।সাদা রেশমে ঢাকা মোলায়েম গা বেয়ে পিছলে পরতে চাঁদের আলো। সেসময় খুব মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করতো তিস্তার। ধীরে ধীরে যেন অবসাদের কোলে আলস্যে তিস্তা তলিয়ে যাচ্ছিল। অচেনা পৃথিবীতে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিতে নিতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো তিস্তার।


এর পর থেকে সব কিছু ছন্নছাড়া হয়ে গেল কেমন যেন ! একের পর এক কাছের মানুষরা ছেড়ে যাচ্ছিল আর তিস্তা মনে মনে ভেঙ্গেচুরে যেন তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। আত্মীয় বলতে যা বোঝায় তিস্তাদের তা বরাবরই সংখ্যায় খুব কম। এখন দায় নেবার ভয় সবাই যে যার মত মুখ ঢেকেছে।তিস্তার সব অনুভূতিকে ওলটপালট করে দেয়।


আর তখনই সুধীরকাকু তিস্তাকে বুকে টেনে নেয়।বাবা মায়ের মৃত্যুর পরে বাবার বন্ধু সুধীরকাকু আর রমলা কাকিমা তিস্তাকে আধা মফঃস্বলে তাঁদের এই বিশালাকার পৈত্রিক  বাড়িতে নিয়ে এসেছে।  সুধীরকাকু বাবার ছোটবেলার বন্ধু। 


সুধীরকাকুর একমাত্র ছেলে রঙ্গনের উপর সেই ছেলেবেলা থেকেই তিস্তার ক্রাশ। খুনসুটি মারামারি সবকিছু ঘিরে তাদের ছেলেবেলা থেকে বড় হওয়া।প্রতিবছর গরমের ছুটিতে সুধীরকাকুরা তাদের কার্শিয়াং এর বাড়িতে চলে আসতো। মাসখানেক দেদার মজা আর মজা। মনে যৌবনের ছোঁয়া লাগতেই রঙ্গনের প্রতি এক অদম্য আর্কষণ যেন তিস্তাকে পাগল করতে থাকে।রঙ্গনকে দেখেই যেন তার পুরুষ চিনতে শেখা। ক্রাশ কখন যে গভীর ভালোবাসায় বদলে গেলো তা বোধহয় তিস্তারও অজানা।


এ বাড়িতে আসার পর রঙ্গনের বৃষ্টি ভেজা ফলসার মতো গায়ের রঙ সোনালী সাপের মতো রহস্যময় চোখে তিস্তা নতুন স্বপ্নের দেশ খুঁজেছিলো।জীবনের আনাচ কানাচ সঙ্কীর্ণ পৃথিবীর চাদর সরিয়ে আস্ত একটা নতুন পৃথিবী যেন ধরা দেওয়ার প্রহর গুনছে !!


মফস্বলে বৃষ্টি মানে রূপোর কুচি।

ওদের বাড়ির পাশে শানবাঁধানো পুকুরঘাটের গা ঘেঁষে সবজেটে হলুদ আঁশফলে ছাওয়া বিশাল গাছটা ছিলো হলুদ ছাতার মতো। গাছের মাথায় ঘুড়ির মতন আটকানো থাকতো মেঘ।চিলেকোঠার টিনের ছাদে টুপটাপ ঘুম পাড়ানী গান। জানালার আড়াআড়ি শিকে থুতনি ঠেকিয়ে অপলক চেয়ে বৃষ্টি দেখা।


তিস্তার মন ভালো করার জন্য রঙ্গনের যাবতীয় প্রচেষ্টার মধ্যে তিস্তা ভালোবাসা খুঁজে যায়-- আঁকড়ে ধরতে চায় রঙ্গনকে। বুক জুড়ে ফুটে থাকা না বলা কথার দুরন্ত ক্যাকটাসে রঙিন ফুল ধরে যেন।কিন্তু রঙ্গনের রাশভারি ব্যক্তিত্বের কাছে তিস্তা উপেক্ষাই পেয়েছে বারবার। একদিকে অবহেলা আর অন্যদিকে তীব্র দায়িত্ববোধ --মাঝে মাঝে রঙ্গনকে বুঝে উঠতে পারে না তিস্তা।দুই মেরুর দুই মানুষ একে অপরকে আদৌ কি কোনদিন ভালবাসতে পারবে? 


না পাওয়া সম্পর্ক গুলোর মধ্যে কেমন যেন আলাদা একটা  মাদকতা থাকে।

থাকে সুপ্ত এক আলপিন ফোটানো বেদনা, যা পেতেও যেন বড্ডো ভালো লাগে ... 

সমস্তটাই ক্ষণিক... সমস্তটাই ম্রিয়মান... কোনওটাই নিজের চাইতে বড় নয়।


"কাকা, ফুচকায় আর একটু ঝাল দাও তো”- বলেই হাপুস হুপুস করে চোখ নাক মুছে আবার ফুচকাটা মুখে পুরল তিস্তা।

“ঝাল খেতে গিয়ে নাকের জল চোখের জল এক হচ্ছে তবু খাওয়া চাই”- বলেই তিস্তাকে ভালবেসেই দু ঘা বসাল সৌভিক।


সৌভিক তিস্তার কলেজে দুবছরের সিনিয়র। রঙ্গনের কাছে উপেক্ষিত তিস্তার মন সৌভিকের ভালোবাসায় আশ্রয় খুঁজে চলেছিলো। আসলে একলা মন বোধহয় কোন এক নিরাপত্তাহীনতায় অবুঝ হয়ে ওঠে। সাময়িক মোহ আর প্রকৃত ভালোবাসা বড্ড দ্বিধায় ফেলে দেয় সদ্য যৌবনকে।

সৌভিকে স্বপ্নালু চোখে তিস্তা আশ্রয় খোঁজে কিন্তু  পাহাড়ি আকাশের মত মনে মেঘ ঘনায়--সৌভিকের বদলে মনের মধ্যে বারবার রঙ্গনের মুখটা ভেসে ওঠে। 


তিস্তা মাঝে মাঝে ভাবে যখন মানুষের খুব প্রিয় কেউ তাকে অপছন্দ অবহেলা করে তখন প্রথম প্রথম মানুষ খুব কষ্ট পায়। কিছুদিন পরে প্রিয় ব্যক্তিটিকে ছাড়া থাকতে শিখে যায়। সৌভিকের চোখে মুখে তার প্রতি ভালোলাগা,  অকারণে হাতের সাথে হাত ছুঁয়ে যাওয়া, শ্রাবণে শ্রাবণে বিস্মৃতির প্লাবনে ভেসে গিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে যাওয়ার প্রবল বাসনা সে কি শুধুই মোহ!!

আউটট্রাম ঘাটের সিঁড়িতে বসে সেদিন সৌভিক আপন মনে কবিতা বলে যাচ্ছিল একের পর এক । 


"থাক

যে কথা হয়নি বলা আগে

শুরুতেই যে কথা শেষ হয়ে গেছে

সে কথা তুলে আর কি হবে ?

আমিতো বেশ আছি ভালো

গুছিয়ে নিজেকে নিজেই

না বলে গিয়েছো চলে,নিয়েছি তো মেনে"


তিস্তা হারিয়ে যায় কোথায় -- না না, রঙ্গনকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। মানুষ যখন মিথ্যে স্বপ্ন আর আবেগের মাঝে থাকে তখন মনে হয় জীবনটা অনেক সহজ আর যখন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন বোঝা যায় জীবন কতটা কঠিন। কিছু কিছু নীরব কষ্ট থাকে যা চাইলেও  কাউকে দেখানো যায় না, শুধু নীরবে কাঁদিয়ে যায়।


নীরব তিস্তা সৌভিককে অশান্ত করে তোলে। সহ্যেরও সীমা থাকে। মানুষ তো পাষান নয় যে বর্ষার প্রবল জলের প্রকোপ, গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ আর কনকনে ঠান্ডা একসাথে সইবে।


কমলারঙা বিকেলটা তিস্তার টুকটুকে লালচে চিবুক ছুঁয়ে জলের সাথে মিশেছে। সৌভিক তিস্তার হাতে আলতো চাপ দেয়। খানিক সময় নিশ্চুপ নীরবতা। একসময় সৌভিক বলতে শুরু করে

-- জানিস তিস্তা, মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত ভালোলাগা ছুঁয়ে যায়। জানি না এটা ভালোবাসা নাকি অন্য কিছু। তুই কি একবারও বুঝবি না আমার না বলা কথাগুলো। তুই কি আমার চোখে দেখতে পাস না তোর জন্য সাজানো স্বপ্নগুলো। তোর কি ইচ্ছে হয় না নীল দিগন্তে  হারিয়ে যেতে!! তোর কি ইচ্ছে হয় না শুনতে ভালোবাসি তোমায়!!


তিস্তার মনে হয় যে শীতল হিমবাহ সে বুকে চেপে রেখেছে আজ বুঝি তা জল হয়ে চোখের আগল ভাঙ্গবে।শুধু বলে


---- শুধু হাত ধরে কিছু পথ চলার নামি সম্পর্ক নয়।তাকে আঁকড়ে ধরে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুখে দুখে পাশে থেকে স্বান্তনা দেওয়ার নামই সম্পর্ক। সে সম্পর্কে তো আমি শৈশবেই বাঁধা পরে গেছি। পারবে সবটুকু মেনে নিয়ে আমার বন্ধু হয়ে থাকতে!


সৌভিকের মুখে ঝুপ করে নেমে যাওয়া সন্ধ্যার আঁধার।


-- তোকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মাঝপথে ঝড় এসে সেই অর্ধেক লেখা গল্পটার পৃষ্ঠা ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে গেলো।

গলাটা ধরে আসে সৌভিকের। তিস্তার মন বলে ওঠে -- ক্ষমা কোরো সৌভিক।


সেদিন হঠাৎ রঙ্গন কলেজে হাজির। অকারণে সৌভিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বসে সে--- তিস্তাকে প্রায় জোর করেই কলেজ থেকে বের করে নিয়ে আসে রঙ্গন।

 অভিমানে তিস্তা শুধু বলেছিলো--

--" তুমি কেন আমাকে নিয়ে এত ভাবো?" 

উত্তর এসেছিলো--

--" তুই আমার দায়িত্ব "

তিস্তার মন গুমরে বলে --

---" আমি তোমার শুধুই দায়িত্ব?? "


রঙ্গন আর তিস্তার এই হেদুয়া পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটাটা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘ বেশ কয়েক বছরের অভ্যাস।যখনই শীতের ছুটিতে ওরা কোলকাতায় আসতো তখন প্রায় প্রতিদিন এসব জায়গায় যাতায়াত ছিলো ওদের।

বহুদিন ধরেই এই রাস্তা, দোকান, পার্কের বসার বেদি ফুচকাওয়ালা,কৃষ্ণচূড়া গাছটা এরা সবাই ওদের চেনে । 


সেদিন  প্রথম  হাত ধরেছিল রঙ্গন।  রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই, আচমকা। সেদিন তিস্তার সাথে সাথে লাল কৃষ্ণচূড়াটাও লজ্জা পেয়েছিল।রাঙা হয়েছিল তিস্তার কানের লতি।গালের লালাভ আভা সেদিন বোধহয় রঙ্গনের চোখ এড়ায়নি ।আনমনে দুজনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসব কথাই বারবার মনে আসছিল দুজনের ।


শূণ্য বাড়িতে সেদিন তিস্তার ঠোঁটে চেপে বসেছিলো রঙ্গনের উষ্ণ ঠোঁট। রঙ্গনের তীক্ষ্ণ দাঁতের কামড়ে তিস্তার ঠোঁট ক্ষত বিক্ষত। দুইপক্ষের মৌনতায় যেন অনেকগুলো কথা বলে দিচ্ছিল, হাতদুটো একে অপরকে সবসময় আঁকড়ে রাখতে চাইছিলো। 


--" কাল  অন্য কলেজে তোর ভর্তির ব্যবস্থা করেছি--মনে রাখিস তুই আমার দায়িত্ব "

কান্নায় ভেঙে পড়ে তিস্তা। প্রকৃতিও যেন একসাথে কান্নায় ভেঙে পড়েছে, আকাশ ভেঙে তখন বৃষ্টি। শূণ্য বাড়িতে চিৎকার করে তিস্তার বলতে ইচ্ছে করছিলো

---আমি কি তোমায় পাবোনা রঙ্গনদা,

নাকি তুমি নিজেই আমার হবেনা।

তুমি হয়তো আমার চেয়ে ভাল কাউকে পাবে! কিন্তু কেউ কি তোমাকে আমার মত এতো বেশি ভালোবাসবে বলো।।এই যে তুমি আমায় ছুৃঁয়ে গেলে কিসের অধিকারে-- শুধুই দায়িত্ব!! শুধু দায়িত্বের অজুহাতে কারে শরীর মন ছোঁয়া যায়!! তোমার আমার সম্পর্কের নাম কি রঙ্গনদা!!


অশান্ত মন নিয়ে সৌভিককে ফোন করার চেষ্টা করে দেখেছে ওর ফোন থেকে নং ডিলিট হয়ে গেছে। বুঝতে বাকি থাকেনি এ কার কাজ।তবে কি রঙ্গনের মনে তিস্তার উপস্থিতি গাঢ় হচ্ছে।  সৌভিক তো মুক্তির জানালা মাত্র।  তিস্তা তো রঙ্গন নামের ভালোবাসার ঘরটাতে আজীবন বন্দী হতে চেয়েছে -- নিশ্চিন্তে মাথা রাখতে চেয়েছে ওর লোমশ বুকে।


সেদিন ছাদে বসে ছিলো তিস্তা। কালো হয়ে আসা আকাশ যেন ঝুঁকে পরেছে খোলা ছাদটার বুকের পরে কোন এক আদিম সুখে। তিস্তা একমনে গেয়ে চলেছে  ' পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমান '

কাকিমা এসে মাথায় হাত রাখে তিস্তার 

-- " মনখারাপ লাগছে না রে!! বুঝি-- আমি তো তোর মা হয়ে উঠতে পারি নি "

-- " অমন করে বোলো না কাকিমা-- তুমি আর কাকু ছাড়া আমার কে আছে বলো?"

-- এবার তোর একটা সংসার হবে রে মা। তোর মা বেঁচে থাকলে তিনিই এ কাজ করতেন। আমি যদি তোকে নিজের সংসারে বসিয়ে দিতে না পারি তবে তোর মা'কে কি জবাব দেবো বলতো। তুই আর অমত করিস না মা। ভালো ঘর-- তোর কাকু নিজে সব দেখে এসেছে। ছেলেটিও বড় ভালো"


তিস্তার বুকে যেন সাগরের ঢেউ ওঠে-- কালবৈশাখী আছড়ে পরে নদীর তীরে। কিছুই বলতে পারে না সে--কান্নায় ভেঙে পরে কাকিমার কোলে মাথা গুঁজে।


-- " সব বুঝি রে মা। আমিও তো চেয়েছিলাম সারা জীবন তুই আমার কোল জুড়ে থাক। কিন্তু ছেলেটার মতিগতি কিছুই বুঝি না। অনেকবার বলেও কোনো উত্তর পাই নি। অমন বাউণ্ডুলে খ্যাপা ছেলের হাতে তোকে তুলে দিতে পারবো না মা-- কিছুতেই পারবো না"

কাকিমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উঠে যায়।


সদর দরজায় তীব্র গতিতে বাইকের আওয়াজ শোনা গেলো। তবে কি রঙ্গনদা এতক্ষণ ওদের কথা সব শুনছিলো!!


আজ গোধূলিবেলায় কাকুর পছন্দের পাত্র পক্ষ দেখতে আসলো তিস্তাকে ।  ছবি দেখে অসম্ভব পছন্দ হওয়া পাত্রপক্ষ আজ স্বচক্ষে  তিস্তাকে দেখে একেবারে পাকা কথাই দুয়ে গেলো বলা যায়!! তিস্তা হবু পাত্রকে একবারও চোখ তুলে দেখলো না-- দেখার ইচ্ছেই হলো না। বলি প্রদত্ত জীবের কাছে হাঁড়িকাঠের রূপ দেখে লাভ কি?

আসলে সমাজে ছেলেরা বিয়ে করে আর মেয়েদের বিয়ে হয়-- সেখানে পাত্রীর পছন্দ বা অপছন্দ  অত্যন্ত নেতিবাচক প্রসঙ্গ। 


রঙ্গন দাঁড়িয়ে থেকে তার সব দায়িত্ব ওালন করে গেলো।

হালকা চাপদাড়ির সৌম্যকান্তির রঙ্গনের দিকে চেয়ে থেকেছে তিস্তা কিন্তু---


একে কি বাঁচা বলে? আজ এতগুলো বছর পর এত খুনসুটি মারামারি আবদার আদর ভালবাসার পর হঠাৎ করে সে আর কেউ নয় এটা কী মেনে নেওয়া সম্ভব?


আবহাওয়া দপ্তর বলছে, এখনও বেশ কিছুদিন চলবে এই দুর্যোগ, প্রবল নিম্নচাপ । ঘন কালো মেঘে মোড়া আকাশটা, ততোধিক দুর্যোগ চলছে তিস্তার মনে। 


বাড়ির সকলে খুব খুশি ।তিস্তার বিয়ের পাকা কথা আজ। তিস্তা নিজের ঘরে আয়নাটার সামনে । আজ সবকিছু এলোমেলো ওর সামনে, হাতে রঙ্গনের দেওয়া প্রথম উপহার লাল চুনীর হার দুল-এর সেট । এ বাড়িতে আসার পর জন্মদিনের উপহার। খুব যত্ন করে এগুলো রেখে দেয় তিস্তা । সেদিন তো এগুলোই খুব দামী ছিল ওর কাছে, আর আজ এগুলো বাড়তির খাতায় নাম লিখিয়েছে । ও স্বপ্ন দেখেছিল একটা সুন্দর ঘরের, বড় না হোক, ছোটই সই । স্বপ্ন দেখেছিল একসাথে পথ চলার। দামী গাড়িতে না হোক-- পায়েই সই । স্বপ্ন দেখেছিল একসাথে রাতের আকাশের তারা গোনার-- জড়িয়ে ধরে সারা রাত গল্প করার ।আজ সব স্বপ্নগুলো রং হারিয়েছে। আগামী ফাল্গুনে তিস্তার বিয়ে।


রাত অনেক গভীর। একটু একটু করে বেলফুলের কুঁড়ি ফুটে গন্ধ ছড়াচ্ছে স্নিগ্ধ বৈশাখী রাতে। দরজার ওপারে রঙ্গন দাঁড়িয়ে। 

--" কি চাও রঙ্গনদা? ঠোঁটের সাথে আমার মনটাও যে ক্ষত বিক্ষত আজ। বোঝো তুমি?"

--- আজ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক।  আজ পাগল হওয়ার দিন। চল একটু ঘুরে আসি। বেশিদূর যাবাে না, পুকুর  পাড় পর্যন্ত। হাঁটুতে মুখ ঠেকিয়ে রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে সামান্য ক্ষণ ভাবলাে তিস্তা। তার আপত্তি নেই, সে বললাে-চলাে,আমি রাজি।

 

জ্যোস্নায় চারিদিক সদ্য ধােয়া আয়নার মতাে কিছুটা ফাঁপা কিছুটা পরিস্কার। আজ যেন জ্যোৎস্নার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বইছে বাতাস।সামনে পুকুর আর বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।খােলা জায়গা পেয়ে সে এখন হু-হ্ করে ছুটে আসে। যেন খুব সহজে ইচ্ছে করলেই সে ভেঙ্গে দিতে পারে, উড়িয়ে নিতে পারে অনেক কিছু। ওরা পুকুর ধারে বসলাে।

তিস্তার মনে তোলপাড় -- অস্ফুটে বলে ওঠে 

---এই নদী যেভাবে গ্রহণ করছে বাতাস এবং চাঁদের আলাে, নির্বিঘ্নে এবং নানাভাবে, তুমি কি সেভাবে গ্রহণ করাে না আমাকে রঙ্গনদা?


 আড়ষ্ট ভাব কাটিয়ে রঙ্গন ধীরে ধীরে সহজ হয়। জ্যোৎস্নার আলোয় রঙ্গনকে পাথরের মূর্তির মতো দেখাচ্ছিল।


-- এতদিন তোর দায়িত্ব ছিলো আমার। আর আজ--"

-- আজ কি? ছেড়ে দিচ্ছো তো দায়িত্ব? 


রঙ্গন অনেকটা কাছে চলে আসে তিস্তার। পুকুরের ওপর ঝুঁকে পরা বটগাছটার পাতাগুলো চাঁদের আলোয় তিরতির করে কাঁপা কাঁপা ছায়া দিয়ে শান বাঁধানো সিঁড়ি ছুঁয়ে রঙ্গনের মুখে এক অদ্ভুত জ্যমিতিক নক্সা তৈরি করেছে। তাকে বড় রহস্যময় করে তুলেছে যেন।


রঙ্গন এমন জেদী এবং তেজী- তীব্র হয়ে ওঠে যেন পৃথিবীর যে কোন বাধা মুহূর্তের মধ্যে গুঁড়িয়ে যাবে তার ক্রোধের সামনে।


--" যদি বলি আজ থেকে তুই আমার দায়িত্ব নিবি?"


বাগানের গাছের সারির উপর প্রবল বাতাস তার বিশাল শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।এলোমেলো করে তোলপাড় করে তুলছে ঠিক তিস্তার মনের মতো।শরীরের শুকনো মাটি ভেঙ্গে- চুরে যাচ্ছে -- ঘাস লেপ্টে যাচ্ছে যেন মাটির বুকে। গাছগুলো নুয়ে পড়ছে বটে কখনাে-কখনো কিন্তু আবার কি অবলীলার সেই প্রবল বাতাসকে শরীর গ্রহণ করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে।


রঙ্গনকে কথাগুলো শেষ করতে না দিয়েই আচমকা নিজের ভালবাসার আবরণে জড়িয়ে নেয় তিস্তা । উফফ, কী অপার শান্তি, এটাই তো কতদিন ধরে চেয়ে এসেছে  তিস্তা, কিছু না পেয়েও যেন সবটুকু পাওয়ার সুখ এখানে। আস্তে আস্তে রঙ্গনের হাতদুটোও আর শুনল না কোন কথা, জড়িয়ে ধরল প্রাণের মানুষটাকে। যাকে ছাড়া বাঁচার চেষ্টা করে একটু একটু করে মরে যাচ্ছিল ও। যাকে ছাড়া বাঁচা আজ অসম্ভব । 

হাউহাউ করে কাঁদছে তিস্তা। রঙ্গনের চোখেও বাঁধ ভেঙেছে তখন, গভীর চুম্বনে আবদ্ধ হলো দুটি ঠোঁট। পরস্পরকে সমস্ত শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে আকাশের চাঁদকে সাক্ষী রেখে বাধা পড়লো দুটি হৃদয়।


অবশেষে অনেক ঝড় ঝাপ্টা পেরিয়ে আজ তিস্তা weds রঙ্গন লেখা বোর্ডটা জ্বলজ্বল করছে আলোয় । বিয়ে বাড়ির সানাই, আলোর মাঝেই আজ চার হাত এক হচ্ছে । কপালে চন্দনের টিপ, মাথায় টোপর, গলায় মালা পরা রঙ্গনকেই  তো দেখার স্বপ্ন দেখেছিল তিস্তা । লাল বেনারসী সামলে বারবার তাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল ভালবাসার মানুষটার দিকে। আর রাহুল? কখন বলবে ও কথাটা? বিয়ের আগে নাকি পরে?  ও যে চিৎকার করে বলতে চায় সেই ছোটবেলা থেকপ তোকে ভালোবাসি তিস্তা -- কিন্তু  নিজেকে চিনতে এতোটা সময় লেগে গেলো।আর যে তর সইছে না রঙ্গনের-- মনে হচ্ছে এক্ষুণী সবার সামনে কথাগুলো বলপ ফেলতে । লাল টিপ, কপালের টিকলি, মুকুটে কী মিষ্টিই না দেখাচ্ছে ওর তিস্তাকে ।


অবশেষে শুভক্ষণ উপস্থিত, মালাবদলের পর পুরুত মশাই-এর চার হাত নিয়ে মন্ত্র পড়ার সাথে সাথে হোমাগ্নির সামনে তখন পরিণতি পাচ্ছে দীর্ঘ দশ বছরের প্রেমটা, হোমের আগুনে গমগমিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে, এক হচ্ছে চার হাত ।


জীবন নামের বহতা নদী আপনবেগেই বয়ে যায়। এই চঞ্চলা নদীর স্রোতের মাঝে কেউ কেউ হয়তো হঠাৎ করেই খুঁজে পায় কিছু সুখ। কিন্তু একটামাত্র জীবনে সময় যে বড্ড কম। চাইবার থাকে অনেককিছু, কিন্তু পূরণ হয় স্বল্পই। পরিণামের কথা চিন্তা না করে জীবন নদী ছুটে চলে তার নিজের গন্তব্যের দিকে। নদীর পাড়ে পড়ে থাকে ভালোবাসার উষ্ণতা তার আশার বসতি নিয়ে। নিরন্তর চলতে থাকে ভালোবাসার মানুষটিকে খোঁজার প্রচেষ্টা।মানুষের জীবনে কোন না কোন খোঁজ আজীবন চলতেই থাকে। যে মানুষের জীবনে খোঁজ নেই সে মৃত।কে জানে এভাবেই খুঁজতে খুঁজতে জীবনপথের কোন বাঁকে হয়তো বা তার দেখা মিলতেও পারে।তীব্র বেগে ধাবমান জীবনপথের আঁকেবাঁকে পড়ে থাকা কয়েকজন মানুষ ও তাদের জীবনের গল্পগুলো কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।











*****************************************************************************************************



সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়

কোলকাতার উপকন্ঠে  জন্ম। বারাসাত সরকারি মহাবিদ্যালয়, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতোকত্তর শিক্ষাগ্রহন। লেখালেখির শখ স্কুলজীবন থেকেই। স্কুল ও কলেজ জীবনে নানা লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা লেখা  দিয়ে আত্মপ্রকাশ।   স্বামীর কর্মসূত্রে বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসের সুযোগে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মাথে যোগাযোগ ও নানা ধরনের ঘটনার বর্ননা স্থান পেয়েছে খাতার পাতায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ জীবন ক্যানভাস * প্রকাশিত গল্পসংকলনঃ নষ্ট মেয়ে




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন