মির্জা গালিব
শংকর ব্রহ্ম
'নিয়তির হরফে লেখা এক নাটকীয় অশান্তির নাম 'মির্জা গালিব'
খুব সম্ভবত ভারতের ইতিহাসে মির্জা গালিবের মতো প্রভাবশালী কবি দ্বিতীয়টি আর নেই। তিনি প্রথম এগারো বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। বিয়ে করেন প্রথম তেরো বছর বয়সে। তার লেখা অজস্র গজল, শায়েরি, রুবাইয়াতে বিহ্বল হয়েছে সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ থেকে পরিণত পণ্ডিত পর্যন্ত।
এই উপমহাদেশে সঙ্গীতের পুরোধা জগজিৎ সিং, মেহদি হাসান, মোহাম্মদ রফি, গুলাম আলী, গুলজার কিংবা রাহাত ফতেহ আলী খানও ব্যবহার করেছেন তার অজস্র পঙক্তি। বিভিন্ন আসরে গেয়েছেন সমৃদ্ধ সব গজল। তার চেয়ে বড় কথা, তিনি একটি যুগ সন্ধিক্ষণের সচেতন সাক্ষী। মোঘল সাম্রাজ্যের পতন, ও কোম্পানির শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে। নাটকীয় সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গালিবের জীবন যেন তার লেখা কবিতার চেয়েও নাটকীয়।
মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান - জন্ম ২৭শে ডিসেম্বর ১৭৯৭ সালে ((আগ্রা , উত্তরপ্রদেশ , ভারত) - মারা যান ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৮৬৯ সালে, (চাঁদনী চৌক , দিল্লিতে , ব্রিটিশ ভারত), ৭১ বছর বয়সে। তাঁর ছদ্মনাম - গালিব (মানে সর্বোত্তম)। তাঁর প্রদত্ত নাম আসাদুল্লাহ খান থেকে আসাদ। সময়টা -মোগল যুগ, ব্রিটিশ রাজ। তাঁর পিতা-মাতা ----মির্জা আবদুল্লাহ বৈগ খান (পিতা), ইজ্জত-উন-নিসা বেগম (মা) । তিনি উর্দু এবং ফারসি উভয় ভাষায় লিখেছিলেন । গালিব আজ কেবল ভারত উপমহাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
মির্জা আব্দুল্লাহ বেগ (গালিব এর পিতা) বিয়ে করেন ইজ্জত-উন-নিসা বেগমকে(কাশ্মীরি),এবং তিনি শ্বশুর বাড়ি বাস করতেন। ১৮০৩ সালে আলওয়ারে এক যুদ্ধে তিনি মারা যান এবং রাজগড়ে ( রাজস্থান) তাকে দাফন করা হয়। তখন, গালিবের বয়স পাঁচ বছরের বেশি ছিল। তারপরে তাকে তার চাচা মির্জা নসরুল্লাহ বৈগ খান নিয়ে আসেন নিজের কাছে। নাসরুল্লাহ একটি হাতির থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়ে মারা যান।
তের বছর বয়সে গালিব নবাব ইলাহী বখশের (ফিরোজপুর ঝিরকার নবাবের ভাই) কন্যা উমরাও বেগমকে বিয়ে করেন। এবং তিনি তার ছোট ভাই মির্জা ইউসুফ কে নিয়ে দিল্লিতে চলে আসেন, সেখানে সে সিজোফ্রেনিয়া রোগে মারা যান । বিয়ের পর তিনি দিল্লিতে স্থায়ী হন। তাঁর একটি চিঠিতে তিনি তাঁর বিবাহকে প্রাথমিক কারাবাস হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন ।স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক তিক্ত ছিল।
'জীবন একটি ধারাবাহিক বেদনাদায়ক সংগ্রাম যা এই জীবনটি নিজেই শেষ হলেই শেষ হতে পারে' - এই ধারণাটি তাঁর কবিতায় একটি বিষয় হয়েছে বারবার। বিশ্বকে মির্জা গালিব মনে করেছেন একটি খেলার মাঠের মতো। তিনি লিখেছেন, 'পৃথিবী আমার কাছে একটি শিশুর খেলার মাঠ। ' তিনি একবার জুয়া খেলার জন্য কারাগারে বন্দী হয়েছিলেন, কিন্তু পরে লজ্জার সাথে বিষয়টি এড়িয়ে যান। মোগল আদালতের তিনি "মহিলা পুরুষ" হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
একবার কেউ যখন তাঁকে ধার্মিক শেখ সাহাইয়ের কবিতার প্রশংসা করেন, তখন গালিব তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: " সাহাবাই কীভাবে কবি হতে পারেন? সে কখনও মদ খায় নি, কখনও জুয়া খেলেনি; প্রেমিকরা তাকে চপ্পল মারেনি, কখনও জেলের অভ্যন্তর কখনও দেখেনি। তাঁর লেখা, "দেয়াল এবং দরজায় সবুজ রঙ বাড়ছে / আর আমি গলিব মরুভূমিতে আছি ।"
গালিব ১১ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। তিনি অল্প বয়সেই ফারসি ও আরবিতে শিক্ষা লাভ করেছিলেন । গালিবের গজল নিয়ে অসংখ্য ভাষ্য উর্দু পন্ডিতদের দ্বারা রচিত হয়েছে। গালিবের আগে গজল মূলত বেদনাযুক্ত প্রেমের প্রকাশ ছিল,কিন্তু গালিব প্রেম , দর্শন , জীবনের রহস্য এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ের উপর,গজল লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
গালিবের গজলের প্রথম সম্পূর্ণ ইংরেজী অনুবাদ করে ছিলেন 'সরফরাজ কে নিয়াজি' 'লাভ সনেটস' নামে (ভারতের রূপা অ্যান্ড কো এবং পাকিস্তানের ফিরোজসন) প্রকাশনী দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি কলকাতা ভ্রমণ করেছিলেন।
গালিবের জীবনের অন্যতম উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল রাজকীয় মুঘল দরবারের সর্বোচ্চ স্তরের ওস্তাদ হয়ে ওঠা। কারণ তাঁর ধারণা ছিল এতে তাঁর কবিতার প্রসার বাড়বে।
মির্জা গালিব একজন মেধাবী চিঠি লেখক ছিলেন। গালিবের চিঠিগুলির একটি পৃষ্ঠার মধ্যে ছিল। কেবল উর্দু কবিতা নয় উর্দু গদ্যও মির্জা গালিবের কাছে ঋণী। তাঁর চিঠিগুলি সহজ এবং জনপ্রিয় উর্দু ভাষায় লেখা হয়েছে। গালিবের আগে উর্দুতে চিঠি লেখা অত্যন্ত সাজানো গোছানো ভাষায় ছিল। শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে তিনি তাঁর চিঠিগুলিতে এমন ভাবে "আলাপ" করেছিলেন যেন তিনি পাঠকের সাথে কথা বলছেন। তার ভাষায় চিঠিগুলি (একশো মাইল দূরে কলমের জিহ্বার সাথে কথা বলুন এবং আলাদা হয়ে যাওয়ার পরেও মিলনের আনন্দ উপভোগ করুন)। তাঁর চিঠিগুলি খুবই অনাড়ম্বর ছিল; কখনও কখনও তিনি কেবল ব্যক্তির নাম লিখেই চিঠি লেখা শুরু করতেন। তিনি খুব হাস্যরসিক ছিলেন এবং খুব আকর্ষণীয় চিঠি লিখতে পারতেন। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, "মেন কোশিশ কর্তা হুন কে কোন আইস বাত লিখুন জো পধে খুশ হো জায়ে" "(আমি এমন লাইন লিখতে চাই যে যারাই পড়বে সে সে উপভোগ করবে)। পণ্ডিতদের মতে, গালিব কেবল তাঁর চিঠির জন্যই উর্দু সাহিত্য স্থান পাবে। সেই সব চিঠির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন 'রালফ রাসেল' এবং তা অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
২০১০ সালে মাওলানা আজাদ জাতীয় উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় গালিবের "কুলিয়াত-ই-গালিব ফারসি" নামে ১১,৩৩৭ টি কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছিল। গালিব সাড়ে এগারো হাজারেরও বেশি ফার্সি কবিতা লিখেছিলেন এবং সতেরো'শ-র বেশি উর্দু কবিতা লিখেছিলেন।
“হাম থে মরণে কো খাড়ে, পাস না আয়া না সহি,/ আখির উস্ শোখকে তারকাশমে কোয়ি তীর ভি থা-?” (আমি তো মরবার জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিলাম; সে-ই তো কাছে এলো না। আচ্ছা, মারবার জন্য কোনো তীরই কি ছিল না আজ রূপময়ীর তূণে?)
তার শায়েরি এবং গজল প্রভাবিত করে চলছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। “ইয়ে না থি হামারি কিসমাত্ কি বিসাল-এ ইয়ার হোতা,/ আগার অওর জিতে রেহতে ইয়েহি ইনতেজার হোতা।” (প্রিয়ের সাথে মিলন হবে; আসলে এ আমার ভাগ্যেই ছিল না। যদি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতাম, অপেক্ষাটাই দীর্ঘতর হতো শুধু।)
গল্পের আগের গল্প
জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন সময়ে বহু মানুষ ঠাঁই নিয়েছে ভারতের মাটিতে। আরব, আফগান, তুর্কি এবং মোঙ্গল- তাদের অনেকেই আর ফিরতে পারেননি নিজেদের দেশে। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে এমন এক ভাগ্যান্বেষী তুর্কি সৈনিক আগমন করলেন কুক্বান বেগ খান নামে। কিছুদিন লাহোরে বসবাস করে দিল্লিতে গিয়ে চাকুরি নেন সম্রাট শাহ আলমের দরবারে। সেখানেও মন টিকল না তাঁর। তিনি চলে গেলেন জয়পুরে। সেখানে মহারাজার অধীনে কাজ নেন। স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন আগ্রায়। দুই ছেলের মধ্যে নাসরুল্লাহ বেগ খান চাকরি জুটিয়ে নেন মারাঠা শিবিরে। অন্য ছেলে আবদুল্লাহ বেগ খান অতটা ভাগ্যবান ছিলেন না। বহু দরবার ঘুরে ফিরে আলোয়ার মহারাও বক্তাওর সিং- এর সেনাধিনায়ক হিসাবে যোগ দেন তিনি। কিন্তু সেখানেও থাকা হয়ে উঠেনি তাঁর।
১৮০২ সালে মৃত্যু বরণ করলেন বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে।
ইতিমধ্যে দুই পুত্র এবং এক কন্যা রেখে যান আবদুল্লাহ বেগ। বড় ছেলের নাম আসাদুল্লাহ বেগ খান ; পরবর্তী সময়ে যিনি মির্জা গালিব নামে বিখ্যাত হন। ১৭৯৭ সালের ২৭শে ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া গালিব বেড়ে উঠেছিলেন চাচা নাসরুল্লাহ খানের তত্ত্বাবধানে। হাতির পিঠ থেকে পড়ে ১৮০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন নাসরুল্লাহ। নবাবের প্রচেষ্টায় লর্ড লেক মৃতের পরিবারের জন্য ভাতা বরাদ্দ দেন। গালিবের ভাগ্যে জুটেছিল বাৎসরিক ৭৫০ টাকা। তাও পরের দিকে সে ভাতাও পারিবারিক টানাপোড়েনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান ‘গালিবের মা’ যতদিন বেঁচেছিলেন ; অর্থের কিছুটা পেতেন। জীবনের উপলব্ধি নিয়েই পরে তিনি লিখেছেন-
“বাজিচায়ে আতফাল হ্যায় দুনিয়া মেরে আগে,/হোতা হ্যায় সব রোজ তামাশা মেরে আগে।”(আমার সামনে পৃথিবীটা যেন বাচ্চাদের খেলার মাঠ, প্রতিটা রাত্রি আর দিনে কেবল তামাশাই ঘটে যাচ্ছে।)
প্রাথমিক দিনগুলো আগ্রায় এক মাদ্রাসার প্রসিদ্ধ শিক্ষক মুহম্মদ মুয়াজুমের ছাত্র ছিলেন মির্জা গালিব। তৎকালীন মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় আরবি ভাষা ও ধর্মকে গুরুত্ব দেয়া হতো। সরকারি ভাষা হবার দৌলতে পড়তে হতো ফার্সি। শীঘ্রই আবদুস সামাদ নামক জনৈক ব্যক্তির জ্ঞান এবং চিন্তা তাকে প্রভাবিত করে। ভদ্রলোক প্রথম জীবনে জরাথুস্ত্রবাদী থাকলেও পড়াশোনা করে ইসলামে দীক্ষা নেন। আরবি-ফারসি ভাষা এবং বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়। গালিব দুই বছর (১৮১০-১২) তাকে নিজের পরিবারে রেখে জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তী জীবনেও তার সাথে গালিবের পত্রালাপে যোগাযোগ ছিল।
"কয়েদ-এ-হায়াত ওয়া বন্দ-এ-গাম আসল্ মে দুনো এক হ্যায়,/মওতসে পেহলে আদমি গাম সে নাজাত পায়ে কিউ?”(জীবনের মেয়াদ আর বিষাদের বন্দীত্ব আসলে এক ও অভিন্ন, মৃত্যুর আগেই মানুষ বিষাদ থেকে মুক্তি পাবে কেন?
এর মধ্যে ১৮১০ সালের আগস্ট মাসে ইলাহি বক্স খানের কন্যাকে বিয়ে করেন গালিব। ইলাহি বক্স ছিলেন ফিরোজপুরের ঝিরকা এবং লোহারুর নবাব আহমদ বক্স খানের ভাই। খুব সম্ভবত তাদের অনুরোধেই আগ্রা ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন।
আগ্রার মকতবে থাকতেই শায়েরি লেখায় হাত পাকে গালিবের। প্রথম দিকে ফার্সিতে লেখলেও দ্রুতই উর্দুকে বেছে নেন ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে। ততদিনে শিক্ষিত সমাজে উর্দুর ব্যবহার এবং মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবদুস সামাদের মাধ্যমে পরিচিত হন ফারসি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বেদিল, বুখারী, আসির, রুমি, জামিদের সাথে। গালিব প্রথমদিকে তাদের ব্যর্থ অনুকরণ করেন। লেখাগুলো তাই তখনও ঠিক কবিতা হয়ে ওঠেনি তাঁর। হতাশ না হয়ে এগিয়ে গিয়েছেন গালিব নিজের পথ ধরে ধীরে ধীরে।
নবাব হুসামুদ্দৌলা গালিবের কবিতার ভক্ত ছিলেন। একবার কিছু গজল সাথে নিয়ে সেই সময়ের বিখ্যাত কবি মীরকে দেখান হুসাম। লক্ষ্ণৌতে বসে উদীয়মান কবির লেখা দেখে মীর আক্ষেপ করে বলেছিল, 'একটা ভাল গুরু পেলে বালকটির বড় কবি হয়ে উঠার সম্ভাবনা আছে ; আর না পেলে অসার কথামালা গেঁথেই প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাবে তার।
মীরের অবস্থান তখন উর্দু কবিতায় সব থেকে উঁচুতে আর তার মৃত্যুর সময় গালিবের বয়স মাত্র তেরো বছর। ঠিক সেই বয়সের লেখা কবিতা হুসামুদ্দৌলার মাধ্যমে মীরকে দেখানোর ঘটনাই প্রমাণ দেয় গালিবের সম্ভাবনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গালিব কোনো প্রকার গুরুর ছায়ায় না দাঁড়িয়েই স্মরণীয় হয়ে উঠেছিলেন।
গালিবের অনেক লেখাতেই তকী মীরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। গালিবের চিঠিতে 'ডোমনি' সম্বোধনে এক নারীকে দেখা যায়। শব্দটির অর্থ একাধারে গায়িকা ও নর্তকী হলেও তিনি ছিলেন উচ্চবংশীয়া এক সম্ভ্রান্ত মহিলা। কবির শোকগীতি দেখে সহজেই অনুমেয়, সেই প্রেয়সী খুব অল্প বয়সেই মারা যান।
“ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতে, কলঙ্ক থেকে বাঁচতে হায়, তোমার ধুলার ঘোমটা পরার ব্যাপারটা বড়ই বাড়াবাড়ি নয় কি!”
খুব সম্ভবত গালিবের প্রণয়ণী লোকনিন্দার ভয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। তাই, পরবর্তী লেখাগুলোতে বিরহ এক প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে উঠে ছিল। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে তখনকার জনগণের মদ-জুয়ার মতো কিছু কুস্বভাব থাকতো ; গালিবেরও ছিল। আগ্রা থেকে মা এবং দিল্লি থেকে আহমদ বক্স খান তাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। কিন্তু আহমদ বক্স নবাবী থেকে ইস্তফা দিলে গালিবের অবস্থা হয়ে উঠলো শোচনীয়। হু হু করে বেড়ে উঠতে থাকলো ধার-দেনা।
কলকাতায় গালিব
নাসরুল্লাহ খানের মৃত্যুর পর সরকার থেকে দশ হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করা হলেও পরে তা সংশোধন করা হয়। নতুন সংশোধনে পাঁচ হাজার টাকা গালিবের পরিবার এবং পাঁচ হাজার টাকা খাজা হাজী নামে এক ব্যক্তির জন্য বরাদ্দ হয়। দ্বিতীয় সংশোধনের বিষয়টি পরিবারকে জানানো হয়নি। তাই প্রাপ্য দশ হাজার টাকার জন্য আহমদ বক্সের মারফত অনুরোধ জানান গালিব। দিনের পর দিন পার হয়ে গেলেও কোন কাজ হলো না। এবার গালিব নিজেই চলে এলেন কলকাতায়। ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধির সাথে দেখা করার জন্য। ১৮২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কানপুর, লক্ষ্ণৌ, এলাহাবাদ, মুর্শিদাবাদ হয়ে পৌঁছালেন কলকাতা। এপ্রিলে গভর্নর জেনারেলের কাছে আবেদন পেশ করলেন। পক্ষে মজবুত যুক্তি থাকলেও হেরে যেতে হলো। বঞ্চিত হলেন পারিবারিক পেনশনের টাকা উদ্ধারে।
ফোর্ট উইলিয়ামের উর্দু সংস্কার গালিবকে স্বতন্ত্র পথে, সাহস বাড়িয়ে দেয় । ১৮২৯ সালে কলকাতা ত্যাগ করেন গালিব। তার আগে কবি-সমাজের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। গালিব মোটা দাগে নিজের মন্তব্য জানালেন, 'মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় সুপণ্ডিত হওয়া গেলেও প্রয়োগের ভালোমন্দ বিচার গড়ে উঠে না।'
গালিব নিজে বেশ কিছু লেখা ফার্সিতে লিখলেও উর্দু্র প্রতি তার দরদ ছিল অনন্য।
“না সাতায়িশ কি তামান্না, না ছিলে কি পারওয়া,/গার নেহি হ্যায় মিরে আশার ম্যায় মানি না সাহি।”(প্রশংসা পাবার বাসনা নেই; কোনো বিনিময়েরও প্রত্যাশা করি না। এমন যেন না হয় যে, আমার লেখার কোনো অর্থ নেই।)
কলকাতার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থা গালিবের সাহিত্য চিন্তার গতি পরিবর্তন করে দেয়। ফার্সি শাসিত উর্দু তখন অনেকটাই অপরিণত ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ মারফত বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস সবার জানা। এই কলেজই প্রবর্তন করে উর্দু ভাষার নতুন শৈলী; যা আগের অনেক সমস্যা থেকে মুক্ত। গালিব এ থেকে নিজস্ব ভাষা শৈলীকে মজবুত করার প্রেরণা লাভ করেন।
দ্বিতীয় জীবন
মোঘল দরবারে গালিবের ঠাঁই হয়নি বেশ কিছু কারণে। তাই নিজে নিজেই পথ চলতে উদ্যমী হলেন। বন্ধুর পরামর্শে ১৮৪১ সালে ১১০০টি শায়ের নিয়ে প্রকাশ করেন প্রথম দিওয়ান। দিল্লি কলেজের ফার্সি ভাষাশিক্ষার চাকুরিও চলে এসেছিল তার হাতে প্রায়। দিল্লি কলেজের পরিদর্শক ছিলেন জেমস্ থমসন। ফার্সি ভাষায় গালিবের দক্ষতা শুনে তার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলো পড়ানোর জন্য। গালিবও প্রস্তাব মেনে থমসনের বাড়ি এলেন। অপেক্ষা করলেন অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে ভেতরে ডেকে নেবার জন্য।
কেউ এলো না, গালিবও গেলেন না ভেতরে। কিছুক্ষণ পরে থমসন নিজে বেরিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ভেতরে না যাবার কারণ। তিনি জানালেন, আগে প্রতিবারই তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে ; আজ এমন ব্যতিক্রম হবার কারণ কী? থমসন স্পষ্ট করে দিলেন বিষয়টি। আগে প্রতিবার গালিব ছিলেন দরবারের অতিথি, আর এখন তিনি একজন অধীনস্ত চাকুরে মাত্র। শুনে সাথে সাথেই চাকুরি না নিয়ে ফিরে আসেন মির্জা গালিব। এই ঘটনাই নির্ধারণ করে দেয় কবির আত্মসম্মান বোধ।
“কাহো কিসসে ম্যাঁয় কি কিয়া হ্যায় শাবে গাম বুরি বালা হ্যায়,মুজে কিয়া বুরা থা মারনা আগার এক বার হোতা?”(এই নিঃসঙ্গ আর বিষণ্ন রাতের অভিযোগ আমি কার কাছে করব? প্রতি সন্ধ্যায় মরার চেয়ে একবারে মৃত্যুটাই কি শ্রেয় ছিল না?)
অর্থকষ্টে গালিব তখন জর্জরিত। তাই যেন আরো বেশি করে জড়িয়ে গেলেন জুয়ার নেশায়। এই অপরাধেই গ্রেফতার হয়ে তিনমাসের জন্য ঢুকলেন জেলে। সেখানেও প্রচলিত আছে এক গল্প। জেলে থাকার সময় একদিন এক যুবককে কাঁদতে দেখেন গালিব। কারণ জানতে চাইলে যুবক উত্তর দেয়, তিনদিনের জেল হয়েছে। গালিব বিস্মিত হয়, মাত্র তিনদিনের জন্য কান্না! ফোঁপাতে ফোঁপাতে যুবক জানায়, তার বিয়ে হবার কথা ছিল ; বিয়েটা ভেঙে গেলো। গালিবের উত্তর দিলেন, রসাত্মক -
' বাহ! মাত্র তিনদিনের জেলের বিনিময়ে সারাজীবনের জেল খাটা থেকে বেঁচে গেলে। তোমার তো বরং আনন্দ করার কথা। '
জেল থেকে বের হলে সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন মৌলানা নাসিরুদ্দিন। সম্রাটের কাছে সুপারিশ করে দরবারী ইতিহাসকারের কাজ দেয়া হয়।বাহাদুর শাহের দরবারে লেখার কাজ নেন গালিব। বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের সাথে তার সম্পর্ক বেশ ভালো হয়ে ওঠে। ১৮৫০ সালে বাদশাহ তাকে ফার্সি ভাষায় তৈমুর বংশের ইতিহাস রচনার ভার দিয়ে বছরে ছ'শো টাকা বরাদ্দ করে দেন। হঠাৎ ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে শুরু করে তাঁর।
মির্জা ফখরুদ্দীন এবং ওয়াজেদ আলি শাহ ভাতার ব্যবস্থা করলেন গালিবের জন্য। কিন্তু এই স্বাচ্ছন্দ্য বেশীদিন স্থায়ী হয় নি।১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন গোটা গল্পটা বদলে দিল। গালিব সরাসরি কোন পক্ষকে সমর্থন না করে অপেক্ষা করে থাকলেন অনেক আশায়।
“হাজারো খাওয়ায়িশে অ্যাইসি কি হার খাওয়ায়িশ পে দাম নিকলে,বহুত নিকলে মিরে আরমা লেকিন ফিরভি কাম নিকলে।(হাজার আকুল আকাঙ্ক্ষা, প্রতিটাই পীড়িত করে সমান ভাবে। অনেকগুলোই পূরণ হয়ে গেছে, তারপরেও যেন পর্যাপ্ত হয়নি।)
সিপাহি বিদ্রোহের পর গালিবের আশ্রয়স্থল হয় রামপুরের নবাব ইউসুফ আলি খানের কাছে। বরাদ্দ হয় মাসিক বৃত্তি। সিপাহি বিদ্রোহের অশান্ত সময়ে টুকে রাখা নোটগুলো গুছিয়ে নিয়ে প্রকাশ করেন দাস্তাম্বু। সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস চর্চার জন্য বইটি অনন্য দলিল। সিপাহি বিদ্রোহ বদলে দেয় গোটা ভারতের ভবিষ্যৎ।ব্রিটিশদের কোপদৃষ্টিতে পড়ার ভয়েই হোক কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা পাবার জন্যই হোক, ব্রিটিশদের তোষামোদির চেষ্টা তাকে তার পূর্বতন সুযোগের অনেকটাই ফিরিয়ে দেয়।
১৮৬০ সালে পুনরায় চালু হয় পেনশন। ১৮৬৩ সাল থেকে যোগ দেন দরবারে। অবস্থা আরো ভালো হতে পারত। কিন্তু ব্রিটিশ তদন্তে সিদ্ধান্ত আসে, গালিব ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত না থাকলেও বিরোধীদের প্রতি তাঁর গোপন সহানুভূতি ছিল। আসলে এতে তার দোষ নেই ; কারণ তিনি ভালোভাবেই টের পেয়েছিলেন-“ কিতনা খাওফ হোতা হ্যায় শাম কে আন্ধারো মে/পুছ উন পারিন্দোছে জিনকো ঘর নেহি হোতে।”(সন্ধ্যার অন্ধকার কতটা ভয়ঙ্কর, তা সেই পাখিকে জিজ্ঞাসা করো; যার কোনো ঘর নেই।)
শরীর ভেঙে পড়তে থাকে তাঁর ধীরে ধীরে। তারপরও রামপুর রাজ্যের সভাকবির ভূমিকা পালন করে গেছেন গালিব। ১৮৬৬ সালের দিকে আবার ফেরেন দিল্লি। ১৮৬৯ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারান তিনি। আর ফেরানো যায়নি তাকে। পরদিন ১৫ই ফেব্রুয়ারি দুপুরের পরই মৃত্যুবরণ করেন মির্জা গালিব। দিল্লিতেই তাকে সমাহিত করা হয় বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সুফি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সমাধির কাছে।
গালিবের চিন্তাধারা
মির্জা গালিব ছিলেন ফার্সি সাহিত্যের ক্লাসিক কবি এবং উর্দু সাহিত্যের পথিকৃৎ। এতদিন কবিরা প্রায়ই জীবন ও বাস্তবতার বাইরে বসবাস করতেন। গালিবের কবিতায় ফুটে উঠলো জীবনের সুর, বাস্তবতার আঘাত, নিয়তি এবং চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ।
এজন্য জনপ্রিয়তা এতটাই উচ্চতায় পৌঁছালো যে, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে চারবার পুনর্মুদ্রণ করতে হয় দিওয়ান। আবচারজাত ধর্মের থেকে অন্তরজাত ধর্মের দিকে গালিবের মনোযোগ ছিল বেশি। এজন্য সমকালীন ধর্মতত্ত্ববিদদের অনেকেরই কোপানলে পড়তে হয়েছে তাকে বারবার। প্রতিষ্ঠিত ধর্মচর্চার প্রতি গালিবের কটাক্ষ ফুটে উঠেছে-
“কাবা কিস মুহসে যাওগে গালিব,/শরম তোমকো মাগার নেহি আতি।”(কোন দিক ঘুরে তুমি কাবায় যাবে গালিব; যখন তুমি লজ্জিত আর অনুতপ্ত নও?)
আত্মশুদ্ধি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তার ধর্মচিন্তা। স্মরণ করা যেতে পারে, গালিব পারস্য ও ভারতের সুফিবাদ এবং ক্লাসিক যুগের ফারসি কবিতার সাথে সুপরিচিত ছিলেন।
“উমর ভার গালিব ওহি গালতি করতা রাহা
ধুল চেহরে পর থি ওর আয়না সাফ করতা রাহা।”
(জীবনটা ভরে গালিব একই ভুল করে গেছে। ধুলো ছিলো মুখে আর সে বারবার পরিষ্কার করেছে আয়না।)
আত্মা এবং পরমাত্মার মধ্যকার সম্পর্ক গালিবের চোখে ধরা দিয়েছে অন্যভাবে।
“না থা কুচ তো খোদা থা, কুচ না হোতা তো খোদা হোতা
ডুবায় মুজকো হুনে নে, না হোতা ম্যায় তো কিয়া হোতা?”
( যখন কিছুই ছিলো না, খোদা ছিলেন। যদি কিছু নাও হতো, খোদা থাকতেন; আমার অস্তিত্বই আমাকে ডুবিয়েছে, আমি না থাকলে কি এমন হতো?)
জীবন, পৃথিবী, প্রেম, ধর্ম এবং ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি বিষয়কে গালিব কবিতায় রূপান্তরিত করে গেছেন। অজস্র অনুভূতি তার ছন্দে বাহিত হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে। পথ দেখিয়েছেন পরবর্তী অনেক কবিকেই। গালিবকে কেন্দ্র করে তৈরী হয়েছে নানা গবেষণা ; তৈরি হয়েছে উপন্যাস, সিনেমা এবং টিভি সিরিজ। উর্দুর গণ্ডি ছাপিয়ে দিওয়ান অনূদিত হয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু ভাষায়। এইজন্যই হয়তো ‘মুহাসিনে কালামে গালিব’ গ্রন্থের প্রথম লাইনেই নাসিরি বলেছেন -
“হিন্দুস্তানে দু'টি আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে; একটি পবিত্র বেদ এবং অন্যটি দিওয়ানে গালিব”।
কাব্যবিশারদ জাভেদ ইকবাল বলতে পেরেছেন আরো এক ধাপ সামনে গিয়ে।
"কাব্য যদি হয় ইমান, তবে গালিবের অনুসারী না হওয়ার অর্থ হচ্ছে কাফের হওয়া”। (জান-এ- গালিব, পৃষ্ঠা- ১৫)
মির্জা গালিবের কয়েকটি লেখা
জাবেদ হুসেনের বঙ্গানুবাদে দেওয়া হলো নীচে।
১).
'হর কদম দুরিয়ে মনযিল হ্যায় নুমায়া মুঝ সে
মেরি রাফতার সে ভাগে হ্যায় বিয়াবা মুঝ সে'
(প্রতি পদক্ষেপে গন্তব্যের দূরত্ব আমার কাছে স্পষ্ট হয়
আমার গতি দেখে বিরান মরু আমার কাছ থেকে ছুটে পালায়।)
২).
রাত-দিন গর্দিশ মে হ্যায় সাত আসমা,
হো রহেগা কুছ না কুছ ঘাবড়ায়ে কেয়া'
(রাত-দিন আবর্তনে আছে সাত আসমান
কিছু না কিছু তো হবেই, ঘাবড়ে কী লাভ ! )।
৩).
'গালিব বুরা না মান জো বায়িয বুরা কহে
আয়সা ভি কোয়ি হ্যায় কে সব আচ্ছা কহে জিসে'
(গালিব, যদি ধর্মগুরু মন্দ বলেন মন খারাপ কোরো না
এমন কি কেউ আছে, যাকে সবাই ভালো বলে।)।
৪).
'দেখনা তকরির কি লযযত কে জো উসনে কাহাঁ
ম্যায় নেয়ে জানা কে গোয়া য়ে ভি মেরা দিল মে হ্যায়'
(দেখো তার কথার জাদু, সে যা-ই বলে
আমার মনে হয়, এ-ও তো আমার মনেই ছিল।)
৫).
'সুখন কেয়া কেহ নেহি সাকতে কে জোয়া হু জওয়াহির কে
জিগর কেয়া হাম নেহি রাখতে কে খোদে জাকে মাদাআন কো?'
(আমি কি কবিতা লিখতে পারি না যে রত্ন খুঁজে বেড়াব?
আমার কি হৃদয় নেই যে খনির খনন করব?)
আরও কিছু গালিবের কবিতা
৬).
হাম থে মরণে কো খাড়ে, পাস না আয়া না সহি,
আখির উস্ শোখকে তারকাশমে কোয়ি তীর ভি থা-?”
(আমি তো মরবার জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিলাম; সে-ই তো কাছে এলো না। আচ্ছা, মারবার জন্য কোনো তীরই কি ছিল না আজ রূপময়ীর তূণে?)
৭).
“ইয়ে না থি হামারি কিসমাত্ কি বিসাল-এ ইয়ার হোতা,
আগার অওর জিতে রেহতে ইয়েহি ইনতেজার হোতা।”
(প্রিয়ের সাথে মিলন হবে; আসলে এ আমার ভাগ্যেই ছিল না। যদি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতাম, অপেক্ষাটাই দীর্ঘতর হতো শুধু।)
৮).
“বাজিচায়ে আতফাল হ্যায় দুনিয়া মেরে আগে,
হোতা হ্যায় সব রোজ তামাশা মেরে আগে।”
(আমার সামনে পৃথিবীটা যেন বাচ্চাদের খেলার মাঠ, প্রতিটা রাত্রি আর দিনে কেবল তামাশাই ঘটে যাচ্ছে।)
৯).
“কয়েদ-এ-হায়াত ওয়া বন্দ-এ-গাম আসল্ মে দুনো এক হ্যায়,
মওতসে পেহলে আদমি গাম সে নাজাত পায়ে কিউ?”
(জীবনের মেয়াদ আর বিষাদের বন্দিত্ব আসলে এক ও অভিন্ন, মৃত্যু আগেই মানুষ বিষাদ থেকে মুক্তি পাবে কেন?)
১০).
“কাহো কিসসে ম্যাঁয় কি কিয়া হ্যায় শাবে গাম বুরি বালা হ্যায়,
মুজে কিয়া বুরা থা মারনা আগার এক বার হোতা?”
(এই নিঃসঙ্গ আর বিষণ্ন রাতের অভিযোগ আমি কার কাছে করব? প্রতি সন্ধ্যায় মরার চেয়ে একবারে মৃত্যুটাই কি শ্রেয় ছিল না?)
১১).
“হাজারো খাওয়ায়িশে অ্যাইসি কি হার খাওয়ায়িশ পে দাম নিকলে,
বহুত নিকলে মিরে আরমা লেকিন ফিরভি কাম নিকলে।
(হাজার আকুল আকাঙ্ক্ষা, প্রতিটাই পীড়িত করে সমান ভাবে। অনেকগুলোই পূরণ হয়ে গেছে, তারপরেও যেন পর্যাপ্ত হয়নি।)
১২).
“কিতনা খাওফ হোতা হ্যায় শাম কে আন্ধারো মে
পুছ উন পারিন্দোছে জিনকো ঘর নেহি হোতে।”
(সন্ধ্যার অন্ধকার কতটা ভয়ঙ্কর, তা সেই পাখিকে জিজ্ঞাসা করো; যার কোনো ঘর নেই।)
১৩).
“কাবা কিস মুহসে যাওগে গালিব,
শরম তোমকো মাগার নেহি আতি।”
(কোন দিক ঘুরে তুমি কাবায় যাবে গালিব; যখন তুমি লজ্জিত আর অনুতপ্ত নও?)
১৪).
“উমর ভার গালিব ওহি গালতি করতা রাহা
ধুল চেহরে পর থি ওর আয়না সাফ করতা রাহা।”
(জীবনটা ভরে গালিব একই ভুল করে গেছে। ধুলো ছিলো মুখে আর সে বারবার পরিষ্কার করেছে আয়না।)
১৫).
“না থা কুচ তো খোদা থা, কুচ না হোতা তো খোদা হোতা
ডুবায় মুজকো হুনে নে, না হোতা ম্যায় তো কিয়া হোতা?”
(যখন কিছুই ছিলো না, খোদা ছিলেন। যদি কিছু নাও হতো, খোদা থাকতেন; আমার অস্তিত্বই আমাকে ডুবিয়েছে, আমি না থাকলে কি এমন হতো?)
১৬)
“ভালোবাসা লুকিয়ে রাখতে, কলঙ্ক থেকে বাঁচতে
হায়, তোমার ধুলার ঘোমটা পরার ব্যাপারটা বড়ই বাড়াবাড়ি নয় কি!”
১৭).
“হিন্দুস্তানে দু'টি আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে; একটি পবিত্র বেদ এবং অন্যটি দিওয়ানে গালিব”।
১৮).
কাব্য যদি হয় ইমান, তবে গালিবের অনুসারী না হওয়ার অর্থ হচ্ছে কাফের হওয়া”। (জান-এ- গালিব, পৃষ্ঠা- ১৫)
** মির্জা গালিব সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো ---
১) মীর্জা গালিব, শ্রী গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি, ১৯৬৬
২) জান-এ- গালিব, ইনামউল্লা খাঁ নাসির, অনুবাদ- জাভেদ হুসেন, ঐতিহ্য, ফেব্রুয়ারি-২০১৭
৩) মুহব্বত কি শায়েরী, বহ্নিশিখা ভট্টাচার্য, উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির, কলকাতা।
***********************************************************************************************
জন্ম - কোলকাতা ( ২রা মার্চ ১৯৫১.) শিক্ষাগত যোগ্যতা - বানিজ্যে স্নাতক জীবিকা - বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা (প্রধান-শিক্ষক,বর্তমানে - অবসর প্রাপ্ত)। কবিতা চর্চা -১৯৭০ সালের শুরু থেকে -সান্নিধ্য লাভ - অন্নদা শংকর রায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অমিতাভ চৌধুরী, সমরেশ বসু, নারায়ণ গাঙ্গুলী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চ্যাটার্জী, পবিত্র মুখার্জী, দিব্যেন্দু পালিত পবিত্র সরকার প্রমুখ।প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ -১). তোমাকে যে দুঃখ দেয় ২).স্মৃতি তুমি আমাকে ফেরাও ৩).যাব বলে এখানে আসিনি ৪).আবার বছর কুড়ি পরে
এ'ছাড়াও আরও দশটি 'ই-বুক' প্রকাশিত হয়েছে। এই ওয়েব লিঙ্কে সব বইগুলি পাবেন পড়ার জন্য।https://sites.google.com/view/sblekhalikhi/home প্রকাশিত কবিতা শ'পাঁচেক-এর চেয়েও বেশী। প্রায় শতাধিক পত্রিকার লেখক। 'দৈনিক বাংলা স্টেটসম্যান', পুরশ্রী, 'প্রসাদ', 'ঘরোয়া' 'বিকল্প বার্তা (শারদীয়া সংখ্যা - ১৪২৮) এ'ছাড়া রয়েছে -( সমরেশ বসু সম্পাদিত - মহানগর, শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত - জ্ঞিসাসা, কিরণ শংকর সেনগুপ্ত সম্পাদিত - সাহিত্য চিন্তা, পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত - কবিপত্র প্রভৃতি)। বহু পুরস্কারে ভূষিত। 'সারা বাংলা কবি সন্মেলন'( ১৯৭৮ সালে) সালে তরুণদের মধ্যে প্রথম পুরস্কার। 'সময়ানুগ' (১৯৭৯ সালে) প্রথম পুরস্কার। ' যুব উৎসব (১৯৮০ সালে)-এ পুরস্কৃত ও অন্যান্য আরও পুরস্কারে ভূষিত।



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন