শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

স্মরণ * জাঁ লুক গোদার * কিন্নর রায়



[ অতি সম্প্রতি না-ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন কিংবদন্তী চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ লুক গোদার । তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক কিন্নর রায়।]


জাঁ লুক গোদার - আমাদের বর্ণবিমোহনের তীরন্দাজ 

কিন্নর রায়


জাঁ লুক গোদারের সিনেমা আসলে সান্নিপাতিক জ্বর যেমন, সেভাবেই ঘুরে ঘুরে আসে, অথবা এও তো বলা যায়, জীবনানন্দ দাশ যেমন তাঁর আহত মননে জলের মূর্চ্ছনাকে ঘুরে ঘুরে আসতে দেখেন ও দেখান, 'সুতীর্থ' নামের আখ্যানে রাজনৈতিক নেতারা হয়ে ওঠেন গাধার টুপি পরা ভাঁড়, গোদারের তীব্র বিষাদ ও ইউরোপিয় এলিয়েনেশন, যা ভারতীয় বিষাদ - বিযুক্তি থেকে স্বতন্ত্র, এই বিষাদ -  বিযুক্তিই হল ভারতীয় এলিয়েনেশন, যা মহাভারতের কর্ণ ও ভীষ্মকে আচ্ছন্ন করে রাখে, হয়ত বা যুধিষ্ঠিরকেও তা খন্ড গ্রাসে রাখে মহাপ্রস্থানের পথে, তো সে যাই হোক, গোদার তাঁর সিনেমা - যাত্রাপথে দশ হাতা বিষাদের সঙ্গে চিপটেনি কাটা, ছুরি হেন খুব গভীরে রাখা প্রায় আন্ডারগ্রাউন্ড স্যাটায়ার তিন হাতা মিশিয়ে দেন । প্রেম, যৌনতা, না - যৌনতা--  সবই জাঁ লুক গোদারের কাছে সিদ্ধিগঞ্জের মোকামবিহীন যাত্রা।


জাঁ লুক গোদার আমাদের যাবতীয় গুরুগম্ভীরপনা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, পুঁজিবাদী হ্যাংওভারকে অনায়াসে 'আউট' বলে  সঙ্গীত ও নারীর প্রেমে উদাসীন এক বাঁশিওয়ালা হয়ে বুনেছেন নিষ্ঠুরতার রূপকথা। এক পরম্পরা হীন আপাত বিশৃঙ্খলার মধ্যে তিনি আসলে পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শেকল ছেঁড়ার কথাই বলেছেন ক্যামেরাকে রাইফেলের ভূমিকায় এনে।


গোদার  নাকী সেলুলয়েড যাপনে কখনও কোনো গল্প বলেন নি অথবা বলতে চাননি গল্প। কিন্তু পুঁজিবাদ যখন তার দাঁত - নখ নিয়ে বাজার খুঁজতে বেরিয়ে হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, তৈরি করে বা করতে চায় নতুন নতুন উপনিবেশ,  --- জাঁ লুক গোদার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্যামেরা হাতে দাঁড়ান। মৃণালদা -- মৃণাল সেনের 'কোরাস' -এর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, গোদারিয় ঘরানার সিনেমা বলে। এর সঙ্গে মৃণালদার আরও দুটি ছবির কথা  উল্লেখ করা যায় অনায়াসে -- 'চালচিত্র', 'পরশুরাম'।


আমাদের কারও কারও সিনেমা মন্ত্রে, সিনে উচ্চারণে ফেলিনি, বার্গম্যান, ত্রুফো, লুই বুনুয়েল, আকিরা কুরোশাওয়া, ঋত্বিক কুমার ঘটক এবং অবশ্যই জাঁ লুক গোদার। মৃণালদা --  মৃণাল সেন প্রভাবিত ছিলেন গোদারে, বিশেষ করে তাঁর 'কোরাস' দেখলে তো তেমনই মনে হয়েছে আমাদের কারও কারও। ফেলিনির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন হিচকক, সেটি পরে গ্রন্থ হয়। ভাবি, এইভাবে গোদারকে চুলচেরা বিশ্লেষণ যদি করতেন তেমন কোনো চিত্রপরিচালক !


আমাদের কারও কারও সেলুলয়েড স্বপ্নপথ ছিলেন জাঁ লুক গোদার। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের কথাও তিনি বলেছিলেন তাঁর ফ্রেমে , পুঁজিবাদ বিরোধী উচ্চারণ ছিল তাঁর লেন্সে। আ দিউ গোদার। আ দিউ ।

জাঁ লুক গোদার -- পথে পথে সিনেমা যাপনে,  পুঁজিবাদ বিরোধিতায়, ক্যামেরাই যখন মেশিনগান। বিদায় সিনেমা ক্রান্তিক। আমাদের  অনেকেরই জীবন  চারণে সকালবেলার আলো, বিদ্যুতের ঝলক, সাংস্কৃতিক  তরঙ্গ, নব তরঙ্গের নিয়ত বাদন  জাঁ লুক গোদার, ৯১ বছরের জীবন মহিমায়  বিউগিলে বেজে  উঠল লাস্টপোস্ট। দাস ভিদানিয়া গোদার।


 ****************************************************************************************************


****************************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন