আশি এবং অন্তর্বর্তী পাঠ
সব্যসাচী মজুমদার
১.

বিশদে বলি। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের তখন বহু আন্দোলনের পর বাম জোট সরকারে। বাঙালি তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে,এই পথেই মুক্তি। আবার উল্টো দিকে তখন প্রথম বিশ্বে তখন বামপন্হা অনেকটা কোনঠাসা। এমনকি আসন্ন সোভিয়েত পতনের ব্লু প্রিন্টও এই দশকেই তৈরি হতে শুরু করলো।আমি কোনও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা বলছি না।বলতে চাইছি, চিন্তার, অর্থনৈতিক ধারণার বিবর্তনটাকে।এই বিবর্তন আবার তখন এই বাংলায় কিন্তু অন্যদিকে। বরং কোনঠাসা সেই ধারণাকেই জাপ্টে বাঙালি মেধা স্বপ্ন দেখছে যৌথ খামারের।দুটো ভিন্ন সময়, ভিন্ন প্যাটার্ন একই সমান্তরালে,বলা ভালো একটার মধ্যে আরেকটা অদ্ভুত ভাবে জায়মান।ফলত এই সময়ে যাঁরা বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে এলেন, নিঃসন্দেহে দুটো ভিন্ন সময়ের সংঘর্ষের উত্তেজনাকে প্রশমন করেই তাঁদের লিখতে হলো বৈকি। বিজয় সিংহের কবিতা ঠিক সেই মুহূর্তের দ্বন্দ্বগুলিকে তুলে ধরেছে বারবার।ইতিপূর্বেও, বর্তমান পাঠ 'মায়া চতুর্দশ '-এও।
বিজয় বাবুর কবিকৃতি সম্পর্কে পাঠকের কাছে কিছু বলতে যাওয়াটাই অতিরেক।চার দশকেরও বেশি সময় ধরে জায়মানের গভীরতম সঙ্গোপনে বিজয় সিংহের দর্শন। নান্দনিক বিবিধ প্রক্ষেপে অবিরল তাঁর কাব্যে উপস্থিত। বিজয় সিংহ আশির ক্রান্তি আর উত্তর পর্বের আপোস -দ্বন্দ্বের কথক,
"চতুর্দশপদী যদি দু -পায়ে ঘুঙুর চোখে গীত
তুমি কি সন্ধের হয়ে জাদুকরী দেখাবে চুমায়
নেশা ছড়াবে বানজারা মুদ্রা নিয়ে যাবে দেশাতীত
রাষ্ট্র যদি অসম্মত তুমিই পুষ্প ভূমিতে ভূমায়
আমার স্বরাজ্য নেই দেশ অর্থ দেওয়াল ও জুঁই
আমার জুঁইয়ের গন্ধ পারাপার করে স্বপ্নলোক
স্বপ্নলোকে - ফোয়ারা জল-শীর্ষাসনে আমি শুই
হেজিমনি বিদ্যুতের বিদ্যুতের পুত্রকন্যা হোক
চতুর্দশপদী তুমি বিদ্যুতের কারুমুদ্রা নিও
আগুন-জলেরর দেশে ছায়া থাক তোমার দু-পায়ে
পংক্তি জুড়ে আলো থাক স্তবকের পাশে কালফনীও
মিথ হয়ে হাওয়া যাক এ বাংলার এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে
চতুর্দশপদী যদি শ্রীচরণে রক্ত জবা রাখি
দেখাও বিম্বন মায়া বিষাকাশে ওড়ে ভস্মপাখি"
(যদি চতুর্দশপদী)
এই কবিতাটি পাঠের মাধ্যমে আপনি প্রবেশাধিকার পাবেন এই ছাপান্নটি সনেটে তৈরি গ্রন্হে।এবং একই সঙ্গে আপনি লক্ষ্য করছেন -বানজারা,কারুমুদ্রা,হেজিমনি ,মিথ,কালফনী,বিম্বন,ভস্মপাখি-কী নির্বিকার শব্দ ব্যবহার! অনায়াস সাবলীলতায় কবি বস্তত একটা ক্রম বিবর্তিত,আপোসে নিবেদিত অথচ আপোসকামী নয়, তীব্রভাবে স্বাতন্ত্র্য উদগ্রীব একটা বেঁচে থাকার জটিল ও মনস্তাত্ত্বিক বয়ান তুলে ধরেছেন। ফলত ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন হয়েছে, একটার পর একটা বিপর্যস্ত সময়ভূমাকে সাজিয়ে দেওয়ার কাজটা করে গেছেন নিবিড়ভাবে।আর প্রত্যক্ষে ক্রুদ্ধ হাহাকার রোল নির্মাণ করে বিজয় সিংহের কাব্যবিশ্বের পরিচিত উপস্থাপন,
"আমার সন্ন্যাস তুমি এত যে স্বীকার করো দেবী
সেজন্য বিস্তৃতি তাঁর তোমার কপালে সুর্যোদয়
দিয়ে থাকে সকালে যে-কোনো রাত্রি-পাখির সংশয়
তোমার নাভিতে এসে শ্বাস নিয়ে ওড়ে বেহিসেবি।
আমার বিভিন্নে এসে যতকিছু নাগরিক তার
বিভঙ্গে ছড়িয়ে গেলে তুমি তাকে যত্নে জোড়া দাও
স্বয়ং শহর ফলে নিত্য ঘাসের বিশুদ্ধতায়
সায় দেয় ট্রাক থামে চারুস্থান নিয়েছে কুঠার
আমি যেই জড়ো করা বাতাসের আসনে বসাই
অন্তর্বর্তী মণিপুর আজ্ঞাচক্র তাহার সংজ্ঞাই বদলে
দেয় পুরুষের সব বর্ণ রতিচিহ্ন হয়
প্রারব্ধের যতকিছু অপমান রাধে সাহা বীর "
কবিতাটির প্রতিটা শব্দই যেন প্রতিনিধিত্ব করে সমসাময়িক ডিসটোপিয়ার।আর সম্পূর্ণাবয়বে সে প্রতিস্পর্ধা স্হাপন করে তার জায়মানতার বিরুদ্ধে।তবে জায়মানতার কিন্তু ঠিক সেইটুকুও যৌথখামারে গৃহীত হয়,যতটুকু মানুষের জন্য 'চারুস্বাদ'। তারও মাত্রা ঠিক করে দেন কবি ব্যাক্তি যাপনে নিহিত স্হবিরকের আদেশে।অবিরল ধ্যান মুদ্রা তৈরি হতে থাকে সনেটগুলিতে।সে মুদ্রায় চিহ্নিত হয় আয়লান কুর্দি থেকে কৃষক মৃত্যু, চিহ্নিত হয় হত্যা,হনন অস্ত্র আর হানাদারও। তীব্রভাবে রাজনৈতিক হয়েও নিরবচ্ছিন্ন অক্ষরবৃত্তে লিখে রাখলেন যাপিত পৃথিবীর একটি বই প্রতিনির্মাণ,
"বস্তুপুঞ্জ দিয়ে ঘেরা সমস্ত নির্মিত স্বপ্ন বিষ
মহাপয়ারের মধু নিয়ে বাংলার পিঁপড়েরা সব
অলৌকিক কাটাকুটি খেলে ও নদীর খোলা শবে
আরূঢ় পাথর ভাবে পুরুষ প্রকৃত সহিস
বাদাম পাহাড়ে চটি হারিয়েছিলেন কবি ত্রাসে..."
খুব সচেতনভাবে এই 'প্রতিনির্মাণ'শব্দটিকে ব্যবহার করলাম। তীব্রভাবে সমসময়ের প্রত্যেকটা নিত্যবৃত্তে লগ্ন হয়ে আরেকটা চিন্তা বিশ্ব তৈরি করাই অভিপ্রায় হয়ে উঠেছে প্রতিটা ছত্রে। মানে এভাবেও বলা যায় যে, আশির দশকের মানসিক রেম্পারামেন্ট আর বিকল্প বিশ্বের অনুসন্ধানই নিরবিচ্ছিন্ন চলে কবিতাগুলোর অন্তর্জাগতিক চেতনায়।
এই সময়ে অর্থাৎ একটা আরবান জনসঙস্কৃতি জাগরণের জোয়ারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না,বিজয় সিংহের কবিতা একটি অবধারিত টেক্সট। এবং তা সর্বার্থেই।যাপনের ঘনিষ্ঠতম হৃদবিকার ,তার হাহাকার আর উত্তীর্ণ অমিতাভ একত্রিত আলংকারিক নিপুণতায়,সনেটের আট -দশ ফর্মে।পাঠক আপনার গোচরে আসবেই ,একই সঙ্গে, সনেটের সবরকমের গঠনকেই ব্যবহার করেছেন গ্রন্হের প্রতিবেশে। শব্দ এবং অক্ষরবৃত্ত নিতান্তই অনুগত না হলে এই ব্যাপক বিন্যাস নির্মাণ প্রায় অসম্ভব কাজ।সনেট রসিকের সংগ্রহের একটি মূল্যবান অংশ এই গ্রন্থ। সচেতন ডায়ালগ যেখানে জাদুভরা দৃশ্য হয়ে যায়,
"পাঠ
মাংস জানে গুহ্যতত্ত্বে চাবুকের দাগ কতভাবে
চামড়ার অতলে গিয়ে নুনের আস্বাদ পেয়ে থাকে
লহুচিহ্নে নখ কত নন্দন বিস্তার দেয় আঁকে জানে
সন্ধ্যা ইহাদেরই বিষয়-আশয়ে কিংখাবে
মুদ্রিত দেবীর হলোগ্রাম তাহার অন্তরকারু
পাঠে নিই পাঠে আসে পোড়া তার অগ্নিজল ধূমে
ওড়া রক্তগন্ধ ফলে পালিয়েছি ব্যভিচার জমে
ভরন্ত আঁধার হল বহুদুরে জোছনার চারু
চতুর্ভুজ নদী খেলে সর্পশিশু নিয়ে শব্দাচারে
মণিপদ্ম যোনিপদ্মে ওষধি ঔজার মহীপাল কুহক
মায়ায় ঘেরা সেসব অস্তিম থেকে ত্রাণ চাইছে আয়ু
নিখিলেরও ভোর জানে নীল সিন্ধুপারে রৌদ্রমাংস
খেতে গিয়ে পাখিরাও ভুলে গেছে গান
বিষকুম্ভ পিঠে হাঁটছে ভুসুক ঢেন্ডন কুক্কুরীপা"
মোট দশটি দীর্ঘ কবিতাকে একত্রে 'সামাজিক দায় 'কে উৎসর্গ করেছেন অরুনাংশু ভট্টাচার্য।সদ্য প্রকাশিত 'গতিবিধি সন্দেহজনক 'নামক কাব্যে। শেষ প্রচ্ছদে জানা যাচ্ছে ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে রচিত কবিতাগুলো। লক্ষ্য করবার বিষয় এই সময়টা।অরুনাংশু ভট্টাচার্য মূলতঃ আশির দশক থেকেই লেখালিখি শুরু করেন। বস্তুত এই সেই পূর্বোল্লিখিত সংক্রান্তি কাল।একটা অতিস্পষ্ট বিবর্তন ফুটে উঠছিল সে সময়ের গায়ে।আর তারপর এই দুই হাজার দশ থেকে কুড়ির অন্তর্বর্তী সময় পর্বটিও।এই সময়েও কেবল অর্থনৈতিক নয় মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনটিও সমানভাবে সক্রিয়। ক্রমশঃ সংক্ষিপ্তকরণের সময়ে বিস্তারের ওপর নির্ভরতা এক অর্থে বিকল্প ধারারই ইঙ্গিতবাহী।সেই সংবাহনের সন্ধানে।
লক্ষ্য করার বিষয় কাব্যটিতে দশটি গদ্য কবিতা ব্যবহৃত হয়েছে আলাদা আলাদা ফরম্যাটে। বিভিন্ন সময়ের লেখা হলেও, নিজের তৈরি বিন্যাসের মোহে কবি প্রায়শই আক্রান্ত হন। নিজেকে ভাঙা এবং অবিরল বিপন্নতা থেকে লিখে ফেলা," ধর্ষণচরিত
নাম ধাম জানার আগেই একেবারে
উপমা-টুপমাশুদ্ধ মাঠে নেমে পড়লে
পলুপোকা, আমি আর অধিক কী কবো।
দেখো, এই যে একটু রণক্ষেত্র,একটু
জলীয় বাষ্প আর একটু মোমবাতির
মিছিলেই যদি বাণতলা থেকে বদায়ুন।
পর্যন্ত স্বভাব-রহস্যের প্রকৃতি তৈরি হয়ে
যেত, তাহলে পক্ষী সকলের আর কী
দোষ?" বিস্ময়ে লক্ষ্য করি এ রচনার কালীক বিস্তার সম্পন্ন হয় বাইনতলা থেকে বদায়ুনের ব্যাপকতায়।আর অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই ভাষাটিও ব্যবহৃত হলো প্রতিবেশের সম্যক চরিতার্থে।আপাত তৎসমগন্ধী এ ভাষা ধীর বিস্তারে সময়ের অতীত থেকে আগতে ঢুকে পড়তে চেয়েছে। ঠিক এই জাদু খেলাটিই করেছেন অরুনাংশু।ভাষার বিবিধ সজ্জায় বিচিত্রগামী দশটি অভিমুখ।যেমন পাঁচালী নান্দীমুখ হয়,গদ্য নির্মাণ করে ভাবনা বিশ্বের শরীর। আবার অক্ষরবৃত্তের সুর বিন্যস্ত হয়ে যায় কবিতার শরীরে।আলাপ থেকে ঝালা অবধি,"
প্রশাসনিক নিয়ম নীতি পরিচ্ছন্ন বটে। যখন
তোমার রচনা করছে ফাটল এবং ভূত যখন
একটি খারাপ দৃশ্য বিরক্তিতে ভরা।
অবলীলায় ঘটছে যা যা রাতের শেষপ্রহরে।
কৌতুক সব সাজিয়ে রাখা চক্রাকারে আর
সঙ্গে যেন সিনেম্যাটিক হুইস্কি ভরা গ্লাস-
ভাবছ এটা সাজানো নাকি, আসলে আমি
এই"
জাদু আর জায়মান উভয়তই এ কাব্যে একই সঙ্গে মিথোষ্ক্রিয়া করে,আর উপযুক্ত বাহন হয়ে যায় মুক্তক -মিলে নির্মীত শ্লেষ ও আত্মনির্মাণ ও প্রি-নির্মাণ।উৎসের স্বভাব বশতঃ আশির দশকে লিখতে শুরু করা এই কবির কাব্যেও সংযুক্ত হয়ে বিকল্পের সমূহ নির্মাণ।অনিশ্চিত জেনেও উদ্দাম। ঠিক যেন,'হটতে হটতে হটেনটট'
"অস্ত্র বোঝো— ভূমি থেকে ভূমি? এই অবিমৃষ্যকারিতা এই ধারা, এই অবনতি পিঠে ঠেকে তোমারও দেয়াল ? এসো তবে আমার সংহতি
ওই দ্যাখো প্রতিবাদী যারা তোমাদের মতে নির্বাসিত তাদের রচিত বৃন্দগান যাহাদের ভেবেছিলে মৃত: তারা নিচ্ছে ইতিহাস থেকে নির্বাচিত শিক্ষা আর পাঠ তাদের তুলিতে বিচিত্রিত পৃথিবীর আশ্চর্য মলাট। তাহারা কী বলে আজ, শোনো শোনো ওহে ভ্রান্ত আধুনিক তারা নয় তোমার মতন ওই দ্যাখো হাসে পূর্বদিক। এই সেই প্রতিবাদ-ভাষা এই সেই মায়া, জাদুকরী এই সেই যক্ষের ঠিকানা গান গেয়ে যেথা আসে তরী। পারলে তুমিও এসো সখা এ-বরষা এই লেবুবন; প্রসারিত আমাদের হাত তমসা সরাও বন্ধুগণ। মহাজাগতিক রশ্মি আর শস্যে ঘেরা প্রযুক্তির পথ যক্ষ ঘোরে তারায় তারায়; নোটে ঘূর্ণমান ভবিষ্যত।"
একটা মহাকাব্যিক প্যাটার্ন তৈরি করেছেন।ঐ আঙ্গিকটুকুই, তীব্রভাবে উত্তর দু 'হাজার পর্বের যাবতীয় বিবর্তনবোধকে যাপন করেছেন কবি তাঁর এই সাম্প্রতিক কাব্যে। বস্তুতঃ যখন পিডিএফমুখী পাঠরুচি, তুলনামূলক দ্রুতি চাইছে,সে সময় এ হেন মার্গীয় সংগীত রীতির মতো দীর্ঘ কাব্যিক বিস্তার ও রাজনৈতিক সচেতনতা একপ্রকার উল্টো দিকে ঘুরতে চাওয়ার মতনই যেন। গুমড়ে উঠে ফের গর্ভে ঢোকার মতোই। কাব্যটি বাঙালির পাঠরুচির সঙ্গী হোক।
বিজয় সিংহ:মায়া চতুর্দশ: ধানসিঁড়ি:১২০টাকা:প্রচ্ছদ: সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
গতিবিধি সন্দেহজনক:অরুণাংশু ভট্টাচার্য:লুব্ধক:১৬০টাকা:প্রচ্ছদ:দেবাশিস সাহা
***********************************************************************************************************
********************************************************************************************************




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন