[ শোভা সেনের জন্মশতবর্ষের শুরুতে 'বিপ্লবের বাঁশি' নিবন্ধটি লিখে এই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানালেন স্বনামধন্য লেখক সম্রাট মুখোপাধ্যায়।]
বিপ্লবের বাঁশি
সম্রাট মুখোপাধ্যায়
বুঝেছি হেলেনা ভাইগেলের দীপ্তি কী ছিল!
আমি প্রভা দেবীকে মঞ্চে দেখি নি।কিন্তু শোভা সেনকে মঞ্চে দেখেছি।'কল্লোল'এ বিদ্রোহ আর বিষাদকে পাশাপাশি নিয়ে,'একলা চলো রে'তে আশ্রয়ের ডালপালা হয়ে।
বুঝেছি তাঁর প্রভা-মা কী দীপ্যমান ছিলেন!
শোভা সেন। আমার দেখা বঙ্গরঙ্গমঞ্চের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। যিনি কথা বললে তেজে সহস্র সূর্য জেগে উঠত।
এক অদ্ভূত ভঙ্গিমা কথা বলার।যেন অভিনয় নয়,স্বগতভাবে ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছেন!তার মাঝে মাঝে ছেদ-যতি-শ্বাসের অদ্ভূত কিছু emphasis...যা আর কখনও কারো মুখে শুনি নি। একদম signature style সংলাপক্ষেপনের।
এই তো প্রকৃত ব্রেখটিয় নৈরাত্মরীতির অভিনয়।চরিত্র হয়ে উঠেছেন।অথচ চরিত্র সম্পর্কে সারাক্ষণ মন্তব্যও করে চলেছেন!
শোভা সেন পরবর্তী যুগের সমস্ত অভিনয় শিল্পীদের জন্য এক খোলা পাঠশালা।
যদিও জানি শোভা সেন একবারই জন্মান।তাঁকে অনুসরণ করা সম্ভব নয়।
'টিনের তলোয়ার'এ কাপ্তেনবাবুর সেই অমোঘ সংলাপ মনে হয়,"একমাত্র ঐ আঙুর ক'রে অভিনয়,আর তোমরা সব জলে দাগ কাটো।"
প্রায় পৌনে এক শতক আগে বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের এক নারী তাঁর অগ্রবর্তী চেতনায় প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহের চেয়ে পবিত্র মনে করেছিলেন হৃদয়ের ডাককে,ভালোবাসাকে।এমন প্রথাভাঙা ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়া...তারপর তাকে নিঙড়ে শিল্পের ফুল বানানো ক'জন পেরেছে অবরোধের অন্দর কাটিয়ে এই বাঙালি জীবনে?
তাঁর আত্মজীবনীর নামে কাব্য নেই।আছে 'নবান্ন থেকে লালদূর্গ' এই উপশিরোনাম।তাতে আছে ইতিহাসের অমিত্রাক্ষর কবিতা।বাঙালির বিকল্প সংস্কৃতির জ্বলন্ত ইতিহাস।আর কোন বাঙালি নিজের জীবনকে উপশিরোনাম থেকেই এমন ইতিহাসের পেরেকে ঝুলিয়ে দিতে পেরেছে?
শোভা সেনের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা বাড়ি বন্ধকের টাকা দিয়েই সাথী উৎপল মিনার্ভা মঞ্চ ভাড়া নিয়েছেন,তবে তৈরি হয়েছে 'অঙ্গার','কল্লোল','মানুষের অধিকার'এর মতো সব কুতুব-মিনার।তিনি শুধু জানতেন বিপ্লব জায়মান।উৎপল গ্রেপ্তার হয়েছেন,বহু সাথী ভীত,তিনি নির্বিকার থেকেছেন শিশুকন্যাসহ।তিনি শুধু জানতেন গলন্ত লাভা ধরা আছে তাঁর দু'হাতে,তাকে চেহারা দিতে হবে।সেই তাঁকে ও উৎপলকে দল একসময় কার্যত বিতাড়ন করেছে,কুৎসিত অপমান ও কল্পিত অপবাদসহ...অপমানকারিদের সেই দলে থেকেছে এমনকি তারাও,যাদের তিনি ও উৎপল গড়ে উঠতে সাহায্য করেছেন!তবু তিনি মনোবল হারান নি।লিজের টাকার ঋণের প্রতিটি কপর্দক মিটিয়ে দিতে কমরেড উৎপলের পাশে থেকেছেন।তাঁর কি চোখের জল ছিল না?ছিল।কিন্তু জানতেন তাকে জীবনের গ্রিনরুমে ফেলে আসতে হবে।তিনি শুধু জানতেন তাঁকে হয়ে উঠতে হবে একজন সার্থক 'পিপলস আর্টিস্ট'।তাই আবার নতুন দল গড়েছেন। আবার তাকে সাফল্য এনে দিয়েছেন।তিনি শুধু জানতেন সাচ্চা কমিউনিস্টদের 'ফিনিক্স' পাখির রূপকথা হতে হয়।
এক ইস্পাতে গড়া নারী তিনি।যেন প্রাচীন রুশ উপকথার পাতা থেকে উঠে আসা!
আজ শোভা সেনের জন্মদিন।আজ শোভা সেনের জন্মশতবর্ষের শুরু।আজ অন্য দেবীপক্ষ।
উৎপল দত্ত প্রথম দেখায় প্রণাম করতে দেন নি মনে আছে।হাতটা দু'হাতের মধ্যে ধরে ফেলেছিলেন।হেসে উঠেছিলেন 'লাল সেলাম','লাল সেলাম' বলে।শোভা সেন প্রণাম নিয়েছিলেন।অন্য আর এক দিন।
আজ তাঁকে আর একবার প্রণাম।বিপ্লবী অভিনন্দন মিশিয়ে।
************************************************************************************************
***************************************************************************************************





কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন