প্রসঙ্গ:নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও আমাদের সমকাল
পারমিতা ভৌমিক
আমার সামনাসামনি দেখা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও আমার পড়া তাঁর কবিতা,মানবতা ও সমকাল নিয়ে লিখতে বসে ভাবছি কোথা থেকে শুরু করি, কোথায়বা শেষ করি।
নীরেন্দ্রনাথ এর কবিতা পড়তে পড়তে শিখেছি, মানুষ যখন স্বীয় সীমাকে নিঃসীম ভাবে অতিক্রম করে যায় তখনই জন্ম হয় সার্থক কবিতার।
একটু বিশদ করে বলি---স্বীয় সীমা কে ছাড়িয়ে যাওয়া মানে কবিতার চলনের দ্বিধা বিস্তার চাই ।একদিকে তা হবে হরাইজেন্টাল বিস্তৃতি, অন্যদিকে তাকে হতেই হবে ভার্টিকাল বিস্তারে ততখানিই প্রসারিত। স্বাভাবিকভাবেই কবিকে দুই স্তরের মধ্যে তৈরি করতে হবে একটা আর্ক ওয়ে।কবির একদিকে থাকবে ঐতিহ্যের সঙ্গে শিকড়গত নৈকট্য ও বন্ধন, অন্যদিকে থাকবে সমকালের সঙ্গে লক্ষ্য ও সাযুজ্য ।শুধু তাই নয় কাব্য প্রবাহমানতার ধারায় তা এগোতে থাকবে ভবিষ্যতের দিকে। এরমধ্যে তৈরি হতে থাকবে কবিতার ভাব ও ভাষার ভাঙা-গড়ার ইতিবৃত্ত।
হরাইজেন্টাল চলায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা মানবতাবাদী ।সমকালের যন্ত্রণা, বিচ্ছিন্নতা,ক্ষোভ এসব তাঁর অভিজ্ঞতার ফসল এবং এগুলো তিনি আত্মগত করেছেন আপন প্রজ্ঞার আলোয় । তাঁর কবিতা মানব জীবন কেন্দ্রিক বলেই কবির ভাষা হয়েছে সহজ ,সরল গদ্য ধর্মী। জটিল জীবন এবং তার জটিলতাকে সমাজের চিত্রে এঁকে পাঠকের অন্তর্গহনে তাকে প্রবেশ করার সহজ পদ্ধতি করে দিয়েছেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতাকে তিনি এমন একটা ডাইমেনশন দিতে পেরেছেন যেখানে তা সংকেতের রহস্যময়' ব্যঞ্জনায় হয়ে উঠেছে জনমানসের মনের সগোত্রীয় ।সে সব সংকেতের রহস্যময় ব্যঞ্জনাই কোমল আনন্দ-বেদনার ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়। নতুন ভাবে, নতুন দৃষ্টি দিয়ে তিনি বাস্তব জীবন বোধের নকশা আঁকলেন _এ কারণেই সম্ভবতঃ তাঁর কবিতার মধ্যে সমকাল ও মানবতাবাদের হৃদয় স্পর্শের চেতনাটি ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতার মধ্যে পাঠক পেয়ে যায় কবির সংবেদনশীল মনের গভীর পরিচয় ।এভাবেই ,এ পথেই নিয়ত পরিবর্তনশীল জীবনবোধের উন্মোচন ঘটেছে।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কে সমকালের কবি বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি কেননা দেশ বিভাজনের মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতা- সুখ দুঃখ ,বেদনা যন্ত্রণায় কবির মন ছিন্নভিন্ন হয়েছে। সেই সময় সংকটকেই তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন চিত্রিত ভঙ্গিতে।
এত ব্যথা যন্ত্রণার ক্ষত নিয়েও কিন্তু নীরেন্দ্রনাথের মনের ক্ষোভ ।কখন ও শব্দের বারুদ হয়ে ফেটে পড়েনি। তিনি নিপুণ কৌশলে ঐ ধূমায়িত ক্ষোভকে অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ছোঁয়ায় পৌঁছে দিতে পেরেছেন পাঠকের দরবারে।
চিত্রের পর চিত্র সাজিয়ে কবি তাঁর আরব্ধ কাজটি করে গেছেন।"নীরক্ত করবী"কাব্যগ্ৰন্থ ঐরকম ব্যথাময় একটি চিত্র তিনি পাঠককে দিয়েছেন-----
"যখন প্রত্যেকে আজ দ্বিতীয় স্বদেশে
চলেছে ,তখন ও আর দেখি আয়নার ভিতরে জলধারা
নেমেছে রক্তের মতো। যাবতীয় পুরানো দৃশ্যের
ললাটে রক্তের ধারা বয়ে যায়।আমি
পুরানো আয়নার কাঁচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
নিজের রক্তাক্ত মুখ কত আর দেখব জাদুঘর?"
"দ্বিতীয় স্বদেশ" শব্দটির মধ্যেই খেলা করে চলেছে নী রক্তকরবীর রক্তাক্ত বেদনা।সেই বেদনা সন্তর্পণে স্পর্শ করে যাচ্ছে পাঠক হৃদয় ।(কবিতার নাম- বৃষ্টিতে নিজের মুখ)।
এই কাল চেতনা ,বিশেষতঃ সমকালের যন্ত্রণা লব্ধ চেতন নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় অন্যত্র আরো প্রখর ভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে । নিজস্ব উপলব্ধিজাত বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার আলোকে তার চেতনাবোধ, বিশেষভাবে যোগ করেছে তাঁর ব্যক্তির আন্তরিকতা। বোধকরি এই আশ্চর্য আন্তরিকতা থেকেই কবি অনায়াসে রচনা করেছেন "উলঙ্গ রাজা "কবিতা টি। (উলঙ্গ রাজা কাব্যগ্রন্থ)।
কবিতাটিতে দেখি লক্ষণা ধর্মকে ফেলে এক গভীর ব্যঞ্জনার জগতে প্রবেশ করেছেন কবি। কবিতার শেষ কিছু পংক্তিতে ফুটে উঠেছে যুগ সংকটের ছবি ।সেখানে মূল সুর ।এছাড়া" রাজা"র প্রতীকী ব্যঞ্জনায় শক্তিমদমত্তার অহম সর্বস্ব নেতাদের নির্লজ্জ নগ্নতার ছবি এঁকেছেন ।বিদ্রূপের কশাঘাত পরিহাস প্রিয়তায় উচ্চশ্রেণীর একsocial satire উপহার দিয়েছে পাঠক কে-----" রাজা তোর কাপড় কোথায়" এ-প্রশ্নের চাবুক এসে পড়েছে চলমান নগ্ন একটি সিস্টেমের উপর। এই ধাক্কাতেই কবি চাটুকারদের মুখটাকে অনাবৃত করেছেন। কবি জানাচ্ছেন-----"নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়/আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু/জমে উঠছে স্তাবকবৃন্দের ভিড়"।
আবার শব্দটি ব্যবহার করে কবি একটি নগ্ন সিস্টেমের পূর্বাপর কন্টিনিউয়েশনটি দেখিয়ে দিয়েছেন।
কবির শুদ্ধচিত্ত শুধু খুঁজছে সেই শিশুকে যে প্রশ্ন করার সাহস রাখে ,যে বলতে পারে সত্যটাকে "রাজা তোর কাপড় কোথায়"? মূলত এ কবিসত্তারই প্রতিবাদ ।যন্ত্রণাক্ষুব্ধ সরল নির্ভীক সত্তার চিরন্তন প্রতিবাদ। একেই অন্বেষণ করেছেন কবি সমগ্র নির্লজ্জ আপাদমস্তক ধান্দাবাজদের ভিড়ে।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর" কলকাতার যীশু" কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত "কলকাতার যীশু" কবিতাটিতে প্রতিফলিত হয়েছে কবি মনের সমকালের বাস্তব চেতনার ফোকাস।নগর সভ্যতার অসারতায় ক্ষুব্ধ ব্যথিত কবি ।কবি লক্ষ্য করেছেন, উপলব্ধি করেছেন গভীর অপ্রেম জাত একটি শূন্যতা গ্রাস করছে মানুষের মন ও জীবনকে ।কালের বাধাহীন গতি অবিশ্রান্ত চলেছে নেতি পরিণতির দিকে ঋতচলন ক্রমশঃ হয়ে উঠেছে গতিহীন ।ফলে অনিবার্য হয়ে উঠেছে সংগ্রাম ,প্রতিবাদ, পরিবর্তন। যুগসংকটের বন্দি করে ফেলেছে মানুষের শুভবোধকে। কলকাতার যীশু এক ভিখারি মায়ের শিশু। টলমল করে নগর কলকাতার অতিব্যস্ত রাস্তা হেঁটে পার হচ্ছে নিজের মনে ।এদৃশ্য চমকে ওঠেন কবি, আমরাও এই চিত্রকল্পে আপ্লুত। এরইমধ্যে কবির সঙ্গে পাঠককেও খুঁজে পায় অন্তরাত্মাস্থিত ঐশ্বরিক মুক্ত প্রেমও আনন্দধারা।যন্ত্র সভ্যতার ধারাকে স্তব্ধ করে দিয়ে ভিখারি শিশুর স্পর্ধা, তার স্বাভাবিক ভয়হীন এগিয়ে চলার মধ্যে দিয়েই কবি দেখেছেন পরিব্যাপ্ত জীবনবোধের মুক্তির ছবি ।কবিকণ্ঠ শুনেছি _"লালবাতির নিষেধ ছিল না ,তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর অতর্কিতে থেমে গেল"।
এই শিশুটিকে কবি নষ্ট জীবনের উদ্ধারে একমাত্র সিম্বল করেছেন ।এই শিশুটিকেই কবি উলঙ্গ রাজায় খুঁজেছেন_সহজ-সরল সত্যবাদী।এই শিশুই সর্বমানবের অন্তরস্থিত সচল মূল্যবোধের প্রতীক।
ক্রমাগত দাসবৃত্তি খোশামুদি ,স্বার্থপর স্থবিরত্ব তার গতানুগতিকতা থেকে শৃঙ্খলিত মানবাত্মাকে মুক্তি দিতে পারে ওই শিশু সত্তাই। মনে হয় প্রচলিত ধারা থেকে নিজেও মুক্তি চেয়েছেন কবি আর তাই এমন কবিতা লেখা সম্ভব হয়েছে তাঁর পক্ষে। সরলতা ও মানবতার কথা নীরেন্দ্রনাথ এর কবিতায় বারবার এসেছে। এর থেকে মুক্তি পেতে তিনি চেয়েছেন মানুষে মানুষে প্রেম বন্ধন ।সমকালের ক্ষয়িষ্ণু পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কবি অনুভব করেছেন
একাকীত্ব_Alienation ,,,,, সমগ্র মানব সত্তা থেকে বিচ্যুত হওয়া বেদনা।মহৎ কবি বলেই এই বেদনা বোধ আর তাঁর একার থাকেনি এই নিঃসঙ্গতা হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক।
কবির" কলঘরে চিলের কান্না "(উলঙ্গ রাজা কাব্যগ্রন্থ )কবিতায় সমকালের কান্না, তার ব্যথিত চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে কবিমনের দীর্ঘশ্বাস। দূর আকাশের উড়ন্ত এক চিল হঠাৎই কবির ছাদে এসে পড়েছিল ।কবি কাকে দের গ্রাস থেকে তাকে বাঁচাতে রেখে দান কলঘরে। সেই বন্দীত্ব বোধহয় মৃত্যুর চেয়ে বেশি যন্ত্রনাময় ছিল ,তাই কল ঘরে বন্দিচিল সারারাত কেঁদেছিল।
এ যেন সমারসেট মম কিম্বা বনফুলের ছোট গল্পের মতোই ।মনে পড়ে যায় প্রাসঙ্গিকভাবেই বনফুলের আত্মপর গল্পটি।
চিলের গভীর কান্না, অন্তরশায়িত ব্যথা কবির কলমকে নিষ্কৃতি দেয়নি---
"এখনো তোমার সেই ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাই
এখনো তোমার সেই দারুন বিলাপ
কানে বাজে"।
এই কান্না বাইরের কান্না। এই কান্না বাল্মীকির ক্রৌঞ্চের শোক। এ কান্না ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রইল না। বিশ্ব গত হয়ে তৈরি করল নতুন রসায়ণ। এ কে বলি করুণরস। শেষের পঙতিতে ধরা পড়েছে কবির মর্মবেদনা _"অমন ধারালো, শুকনো, বুকফাটা আর্তনাদ আমি কখনো শুনিনি, মনে হয়েছিল যেন পাখি নয়, বিশ্বচরাচর
আজ রাত্রে ওই
কল ঘরে অন্ধকারে বন্দী হয়ে চিৎকার করছে"।
এই বিশ্ববোধই নীরেন্দ্রনাথের কবিতার মূল সুর কবি অনেক চেষ্টা করেও চিলটিকে শেষপর্যন্ত মুক্তি দিতে পারেননি ।পরদিন সকালে দেখেছেন চিলটি মৃত।কবির মনে হয়েছে তুমি পাখি নও, তুমি অফুরন্ত আকাশের প্রাণ মূর্তি যেন।"
অদ্ভুত এক বিশ্ববোধ এ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন কবি-
"সমস্ত আকাশ আজ
নিতান্ত ছাপোষা এক গৃহস্থের
কল ঘরের ক্লিন্ন অন্ধকারে
মরে পড়ে আছে"।
চিল নয় সমস্ত আকাশ চিল নয় সমগ্র উড়ান বন্ধ হয়ে গেছে মধ্যবিত্তের ক্লিন্ন যন্ত্রণার গুহা ঘরে। সত্তার মৃত্যু হয়েছে জীবনের অন্ধ দাবিতে। অন্ধকারের মৃত্যু তাকে গ্রাস করেছে। সমাজ-ভাবনা ও এভাবে ব্যক্তি ও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে গেছে নীরেন্দ্রনাথ এর কবিতায়।
প্রতীক ব্যবহারে কবি খাঁটি আধুনিক। এক আকাশ মুক্তিকে ধরেছেন একটি চিলের প্রতীকে। একটি চিলের কান্না ধরেছেন সমগ্র মানবসত্তার মুমূর্ষু মৃত্যুকে। একটি চিলের মৃত্যুতে দেখেছেন জনমানসের অন্ধকার কলঘরের পরিবেশ। বর্তমান জীবনের স্থবিরত্বকে আঘাত করেছেন কবি। কাক ওচিলের প্রতীকে এঁকেছেন রাজশক্তির আকাশছোঁয়া ক্ষমতা ও কাকের লোভের শিকার একটি চিল হয়েছে সাধারণ মানুষ যার অন্ধকারে ভয়ে গুমড়ে কাঁদতে কাঁদতে মরে যাওয়াই নির্ধারিত নিয়তি। এমনই অবস্থাতেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে এর শেষ কোথায়? শুধু কাল সচেতনাই নয় গভীর দার্শনিক জীবনবোধ ও একবিতার ঋজু পাঠ।
"দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে"(কলকাতার যীশু) কবিতাটিতে যুগ চেতনা ও প্রতিবাদ আরো প্রখর আরো মুখর। কবির কাছে দেশের অন্য মানে। শুধু পাঠ্যপুস্তকে লেখা ইতিহাস তাঁর দেশ নয় ,ফুল, পাখি নদী ,আকাশ বাতাস মানুষ নিয়ে কবির দেশ। শুধু লিখিত সত্যের চারুপাঠ এ উঠে আসবে না দেশের প্রতি ভালোবাসা। ইতিহাসের নিচে জমে থাকবে চাপা পড়া ভূগোলের অন্ধকার। নদীকে মাঠকে শস্যকে প্রকৃত বলে চিনতে হবে। এখানেই পড়েছে কবির সন্ধানী দৃষ্টির আলো।
সত্তর দশকের অস্থির রাজনীতি বাংলা তথা বাঙালির জনজীবনে যে অন্ধকার এনেছিল, এ কবিতা তারই প্রতিফলন ।কবির বিদ্রুপাত্মক যন্ত্রনার দলিল দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে ।এর সঙ্গেই নগ্ন হয়ে আছে একটি চাওয়া,_দেশকে দেখাও উন্মুক্ত আলোয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ,নকশালবাড়ি আন্দোলন উদ্বেলিত হৃদয় কবি নতুন করে দেশকে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেন।
স্বাধীনতা-উত্তর যুগের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর কবিতায় দেশের রূপ স্বতন্ত্র ।শুধু তা মাতৃরূপের ভাব সৌন্দর্য বা কল্পনা মাত্র নয়। কবি জানিয়েছেন জীবন যখন সার্বিকভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন তখন সেই অন্ধকার এ দেশকে স্পষ্ট করে দেখা যায় না ,চেনা তো দূরের কথা ।শুধু পাহাড়, মরুভূমি, নদী, অরণ্য নয় শহরে ক্ষেত-খামারে ,কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে যে প্রাণ তার মধ্যে রয়েছে দেশের প্রকৃত রূপ ।কবি তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনা থেকে এমন জীবন সত্য পৌঁছেছেন ।গুরুমশাই মানচিত্রে কবিকে দেশ দেখিয়েছেন, চিনিয়েছেন কিন্তু কবির কাছে তা বাঞ্ছিত নয় এই ব্যক্তি ঘটনাটি তাকে এক সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে।
বক্তৃতা নির্ভর শিক্ষা দান তার কাছে অর্থহীন । এছাড়াও শহর গঞ্জ ক্ষেত খামারে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষরা যখন পরিশ্রমক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তখন তাদের রাতের অন্ধকারে দেশের চারপাশের ফসলকে কি চিনিয়ে দেওয়া সম্ভব? অর্থহীন ও বটে ।অথচ কবি জানেন শ্রমজীবী মানুষকে বাদ দিয়ে ও কোন কিছু সম্ভব নয় ।নৈশ বিদ্যালয়ে পাঠদান পদ্ধতিকে এড়িয়ে জলের কাছে এসে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে দেশকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন কবি ।কবি তাঁর ব্যক্তিগত বোধ থেকে বলেছেন _"কিন্তু আমরা দেশ দেখি না অন্ধকারে/নৈশ বিদ্যালয়ের থেকে চুপিচুপি /পালিয়ে আসি জলের ধারে"।
যে দেশমাতার স্বপ্ন কবির মনে তা পড়ার বই ধারাবিবরণী বা মানচিত্রে নেই ,তা ছড়িয়ে আছে মায়াবী প্রকৃতির চিরন্তন রম্য তার মধ্যে, তা আছে মানব চেতনার মধ্যে ।মানুষ আর নিসর্গ দুই প্রকৃতি মিলেই দেশ। কবি তাই তার বিশ্বাসকেই আলোময় করে দেখেছেন_" অন্ধকারে কে দেখবে মানচিত্র খানা?/ মাথার মধ্যে দৃশ্য নানা /স্মৃতির মধ্যে অজস্র ফুল/ তার সুবাসকেই দেশকে পাচ্ছি বুকের কাছে"।
সংবেদনশীল নীরেন্দ্রনাথের একটু স্বতন্ত্র পরিচয় লিপিত হয়েছে তাঁর বাতাসি কবিতাতে।( নক্ষত্র জয়ের জন্য)
এখানেও সমকাল এসেছে পূর্বাপর তৎপরতায়। সমকালের চিত্রে চিত্রে পরিস্ফুট হয়েছে একটা গভীর বিস্ময়বোধ। কবিতাটি পড়ে নিতে পারি_
[02/05, 21:48] পূজা হোএপ: বাতাসি!বাতাসি!_লোকটা ভয়ঙ্কর চেঁচাতে চেঁচাতে
গুমটির পিছন দিকে ছুটে গেল
ধাবিত ট্রেনের থেকে এই দৃশ্য চকিতে দেখলুম"।
বলাবাহুল্য টুকরো টুকরো দেখা, ঝাঁকি দর্শন ,কবির মহ্ৎ সৃষ্টির অনুকূল ছিল।কলকাতার যীশুতেও তাই দেখেছি ।বাস্তবতার পরিসর অতি অল্প কিন্তু তা থেকে তৈরি আচ্ছন্ন করে রাখে তাঁর কবিতার চারপাশ। আগেই আলোচনায় এসেছে কবির সংবেদনের কথা, সংবেদনে সাড়া দেওয়ার কথা। চলমান ট্রেনের কামরা থেকে কবি লক্ষ্য করলেন এক ঝলকে একটুকরো ঘটনা ।একজন কেউ আকুল হয়ে ডাকছে বাতাসি !বাতাসি। এখান থেকেই কবি মনে হতে থাকে সামান্যীকরণের ক্রিয়াটি।কবি ক্রমশ উপলব্ধি করতে থাকেন এর পেছনে সমস্যাময় সাধারণের জীবনপ্রবাহকে। প্রবাহিত মানব জীবনের সঙ্গে কবি যত ই নিবিড় হতে থাকেন ততই তাঁর উপলব্ধিতে ধরা দেয় সেই সমকালের ই যন্ত্রণা দুঃখ বেদনা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চিহ্ন গুলো। কবির মনে হয় _
"টুকরো টুকরো কথাগুলি ইদানিং যেন বড় বেশি
গোঁয়ার মাছির মত
জ্বালাচ্ছে"।
ঘটনার সাধারণ অনিবার্য প্রবাহ ও ধাবমান সমস্যা প্রবাহের দ্বৈরথ সংশয়াকুল ও যন্ত্রণাকাতর করে রেখেছিল কবি সত্তাকে ।চলমান জীবনে সমস্যা ও যাপন নিয়েই কালচক্রের চাকা ঘুরবে।প্রতিনিয়ত জন্ম নেবে সমস্যা। এক সময়ে কবির ও মনে হয়েছে এ সমস্যার সূত্র খোঁজা বৃথা। তাঁর কলম থেকে তাই উঠে এসেছে_
শুধু এখানে ওখানে
জনারণ্যে বাসের ভিতরে,হাটে-মাঠে
অথবা ফুটপাতে, কিংবা ট্রেনের জানালায়
টুকরো টুকরো কথা শুনবো ।শুধু শুনে যাব ।আর,"
এই টুকরো কথার গ্রস্থতা কবিকে পেয়ে বসেছে। টুকরোগুলো দিয়েই একের সন্ধান করেছেন কবি তবুও এ সম্বন্ধে তিনি আশাবাদী নন। হঠাৎই তার আবার মনে হয়েছে-"হঠাৎ কখনো কোন ভুতুড়ে দুপুরে
কানে বাজবে,বাতাসি !বাতাসি!"।
এই ভূতুরে দুপুর ই কবির কাছে অনৈসর্গিক সময়ের প্রেক্ষিত।এখান থেকে কবি কিছুতেই দূরে থাকতে পারেননি। সাধারন একটা মানুষে
পূজা হোএপ: এও টুকরোগুলো দিয়েই একের সন্ধান করেছেন কবি তবুও এ সম্বন্ধে তিনি আশাবাদী নন। হঠাৎই তার আবার মনে হয়েছে-"হঠাৎ কখনো কোন ভুতুড়ে দুপুরে
কানে বাজবে,বাতাসি !বাতাসি!"।
এই ভূতুরে দুপুর ই কবির কাছে অনৈসর্গিক সময়ের প্রেক্ষিত।এখান থেকে কবি কিছুতেই দূরে থাকতে পারেননি। সাধারন একটা মানুষের বাতাসি বলে চিৎকার কবির মনোলোকে খুলে দিয়েছে তীব্র উৎকণ্ঠার দুয়ার।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সর্বোপরি সমকালের কবি। মানুষের কবি। ভালোবাসার কবি। তাঁর প্রতি বিমুগ্ধ শ্রদ্ধায় আনত হই।
*************************************************************************************************
****************************************************************************************************



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন