বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

গুচ্ছ কবিতা * পরানসখা ব্রজবাসী

 

কবিতাগুচ্ছ * পরানসখা ব্রজবাসী


আদিবাস উত্তর কুরু

" আমি সূত, স্বর্গের ঠিকানা আমার জানা আছে । ভারতের উত্তরে হিমালয় ৷হিমালয়ের উত্তরে হেমকূট, তার দক্ষিণে কিম্পুরুষবর্ষ ৷হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ ৷হরিবর্ষের উত্তর সীমা নিষধ পর্বত।নিষধের উত্তরে ইলাবৃতবর্ষ | ইলাবৃতের উত্তরসীমা নীলাচল।"   ইলাবৃতবর্ষ'কে স্বর্গ এবং নীলাচল'কে বিষ্ণুলোক বলেছ শাম্ব-কাহিনিতে|    

                                     

                                        অথচ,যা-কিছু বলোনি তুমি ...

                                         উৎসর্গ : কালকূট


যদি ভাব দূর ... উত্তরে হিমালয় 

আরও উত্তর হেমকূট, হরিবর্ষ, 

নিষধগিরিমালা ,ইলাবৃতবর্ষ,নীলাচল আরও 

আরও দূর ... 

আসলে দূর নয়, অন্তরে ভেবে দ্যাখ,আছি কি না 

আজও দ্রোহে এবং মোহে তোমা অন্তঃপুর৷


জান তো, ধুন্ধু এসে ডোবালো দেশ -- কচ্ছ রান -- 

ডুবে গেল দ্বারাবতী পশ্চিম সাগরজলে ; আরও 

বুঝি দৃশ্য চাও তুমি -- খুঁজে দ্যাখ, জলতল 

থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় রৈবতক -- 

আমাকে মানিবে না তুমি? গঙ্গার বুক থেকে  

হস্তিনানগর উঠে এলে?


বন্ধ হলে দেবযানপথ, আছে নক্ষত্রবিথি -- 

ধর যদি মেঘবেশ্ব-বায়ুঅশ্বযান -- নিকটেই 

চন্দ্রদেশ ; কানু নেই; এমনকী আরও দূর শূন্য -- 

খগচরে বগচরে কাসপিয়ান সাগরকূলে কোথা 

ব্রক্ষ্মলোক !


আপন আলোকে দেখ অন্তর্লোকে অন্তরিক্ষ রয়, 

নীলাচলে নীল ।


হাওয়ামাঝে যে আমি নিরাকার, জলদেহ নিয়ে 

বরফে আকার ধরি-- অগ্নিদেশে আনতপ্রবাহে 

নড়ে উঠি, ধরি নদীনাম...

তেমনই সত্তা জেনো দেহের আড়াল -- আমাতে 

আমার মাঝে ধরি বিশ্বরূপ ৷


তুমি কি দেখিতে পাও তোমাকে তুমি! হৃদিমাঝে 

অসুখ এলে পাঁজরে পাঁজরে নাগ -- সহিংস 

দংশনে যে-ব্যথা, ফোঁসগর্জনে যে-বায়ু বিষাদিত 

নীল,কথা-যা মন্ত্রপূত ওষধিবায়ুর শ্বাস -- তুমি কি 

দেখিতে পেলে?

দেখিবে না এই বায়ুনীল দংশনে বিষ ; দেখিবে না 

আলো ; দেখিবে না অন্ধকার ,পদশব্দ তাঁহার -- 

নিকটে ঈশ্বর এলে৷


শ্রীচরণে ফুল নয়, আলো রেখে দ্যাখ, নন্দিত 

কেশর কেমন অর্ঘ্যের মতো সাদা ৷ বায়ুমেঘে 

আঁধার ডুবে গেলে যে-আলোর খেলা -- 

যে-অশ্বনীলে ডুবে যায় যবনিকা -- সেখানেই 

মনোগত প্রাণ পেয়ে যায় পথ ...

তুমিও সেই অনিঃশেষ জেনো ; যাকে তুমি মৃত্যু 

জানো , সে শুধু খণ্ডযবনিকা ... আত্মার আড়াল 

আত্মা -- শোক ভুলে থাকা ।


আলোতে অশ্রু রেখে দ্যাখ শিখিপাখার জন্ম হল 

কি না :

এই বায়ুমনোরঞ্জিত দেশ -- বায়ু দিলে 

জীবননদীতে ওঠে গান -- বায়ু দাও, আলো দাও --  

জনম যখন জটিল সংসারে ;

রৌদ্রে এসে বসে গেছে শিক্ষার্থী বালক-এক 

নির্বোধআকার --সেও জেনো সূর্যমুখী ফুলের 

শোভায় আলো ধরতে জানে ৷


মনোমুগ্ধ অতল , তোমাতেই মুক্তি মেলে -- 

আলোয় রাঙানো মানুষ পলকেই ডুবে গেলে 

আর উঠে আসে না, রয়ে যায় আবছায়া প্রান্তর -- 

সমুদ্রনীল , আকাশে বাসুকিতরঙ্গ ...


পাখি-ডাকা মাটির দরবেশে এলেন তিনি, 

ঋষি বাল্মীকি আর ব্যাসদেব মুনি ; সেই থেকেই তৃতীয় 

ভুবন ... তারও আগে মহাপ্রলয়শেষে ডুবে গেল 

লিপিমস্যাধার -- এলো পাথরের দেহ ভেঙে কথাবলাযুগ, 

মুখে নিয়ে আদিম শ্রুতি ; মুনিদেহে উঠে এলো 

বল্কল, মরাপশুর ছাল ...    তারও আগে ছিল 

উত্তাল নররক্ষপুর -- দীর্ঘ চঞ্চুর ডগায় 

রক্ত দেখে গুহার আড়ালে লুকালো শিকারি মানুষ ...


এভাবেই শুরু হল মহানাম : মহাভয়ে ধর্মবদল 

কর, রক্ত থেকে মাংস কেটে নিয়ে আজও কার 

নৈবেদ্য সাজিয়ে চল ?


১০

আলো আমাকে প্রত্যাখ্যান করে -- অথচ, 

ইঙ্গিতে তুমি ছিলে পলাশের বন, আমি ছিলাম 

দারুব্রহ্মবাঁশি ; অথচ, আলোর ভিতরে হাসি, 

ধুলোর ভিতরে প্রেম -- যে- আমি পাণ্ডাহত -- কথা 

বলব না আর ; অশ্রুকে রোপণ কোরো মাটিতে --  

কিছু  জ্যোৎস্নাভরতি গাছের জন্ম হলে, 

কথা দিচ্ছি, ফিরে আসব আবার ৷


১১

দহনে মিশে-থাকা আমি, নির্বাপণেও আমি ...       

পরাক্রান্ত  আমি জন্মরূপ : অমর ও অক্ষয় 

আলোর বিষ্ণুরূপ ধরি, ধরি আঁধারকৃষ্ণ ...      

ত্রেতায় রাম যদি দ্বাপরে পতি-সত্যভামা ; চেতনায় 

চৈতন্য কলিতে, বহু পথে বহু মতে ঋষিরামকৃষ্ণ 

আমার শোভা ।


১২

বলিমন্ত্র নয়, খাঁচা থেকে উড়িয়ে দাও চিত্রগ্রীব -- 

তুমি উড়িয়ে দিলে :


দেখলে, নভসঙ্গমে উড়ে গেল পাখি -- ডালে বসে 

ডেকে উঠল --

হরে কৃষ্ণ রাধা :


সেইথেকেই তুমি গ্রহণ করলে ভাগবতের আলো ; 

তুমি অনুরাগী হলে :


সখী ও সখাসঙ্গ নিয়ে এ বৈকুণ্ঠপুরে বেড়াতে 

এলে।


১৩

পঞ্চভূতে আকাশ নেই ? তবে এই আকাশ থাক 

আমার দখলে --

এই পৃথিবী থাক মাইথোলজির গল্পবলা দেশ ; 

হিংসায় নীল হয়ে যাওয়া

অন্ধধর্ম দেখুক, আলিঙ্গন মধুর হলে জন্ম হয় 

বাউলফকিরের ৷


ওগো বাউল ওগো গেরুয়া ফকির, অগ্নিকুণ্ডের 

ভিতর দাঁড়িয়ে

তুমি গান গাইলে জেগে ওঠে লালনের দেশ 

চৈতন্যের দেশ ...


আহারে নমনমজাতি, এই দাবদাহদিনে সূর্য থেকে 

আশীর্বাদ ঝরে পড়ুক 

তোমার মাথায় --

এই মাটির দেশ তোমার না তোমার না ; হে ব্রহ্ম, 

হে নদীপুত্রব্রহ্ম ...

ডিঙিমাঝে ভেসে যায়      যে-মানুষ রোহিঙ্গা নামে 

পরিচয় -- তাকে তুমি দেশ দেবে না ?


১৪


                                                    ....১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্ব;


অথবা, আরও অতীত -- যার কালবিন্দু নেই, 

সেই আদিবিন্দু 

ছুঁয়ে দ্যাখ, আমিই আদিরূপ -- অরূপ রূপের 

ঠাঁই ;

আমি প্রবাহ ... সর্গে প্রতিসর্গে ; মনু ও মন্বন্তরে 

অনন্ত আমার নাম ;

তোমরা নরপতি ডাকো --  দ্যাখো, মায়াটানে নদী 

হেঁটে যায় সাগরে

ঘোড়া এসে আস্তাবলে দাঁড়ায়,

দর্পিত পা ফেলে ফেলে উঠোনের দেবী আসে 

ঘরের মন্দিরে ...


এইসব ছাতিমের ঝোঁপঝাড় -- বাঁশঝাড়ের ছায়া -- 

নানুরের পুকুরধার

থেলো হুঁকোর ভুড়ুক ভাড়ুকেও মিশে আছি 

আমি ; দ্যাখ,

দেহভাণ্ডে বিশ্ব কী রূপ -- আঠারো মোকামে খেলে 

দ্বাদশ আদিত্য ;

কী করে শুনবে তুমি  হৃদিকথা -- হৃদি থেকে দূরে 

সরে গেলে ৷


****************************************************************************************************







********************************************************************************************************



পরান মণ্ডল

জন্ম: ২৬ অক্টোবর , ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ | বর্ধমান জেলার গলসিতে  এরপর চার-বৎসর বয়সে সপরিবারে বোলপুরে৷অদ্যাবধি সেখানকারই বাসিন্দা । বাবা কৃষক| মা গৃহকর্মিণী । ১৮ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু প্রথম কবিতা 'মরু সাহারার বেদনা' শব্দের ঝংকার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়  এরপর শতাধিক লিটল ম্যাগাজিন-এ লেখালখি শুরু  দরিদ্রতার জন্য মাঝেমধ্যে কবিতা লেখায় এবং পত্রিকা সম্পাদনায় বিরতি এবং দিবারাত্র পরিশ্রম  ২সেপ্টেম্বর ১০১২ `দেশ' পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ । পুনরায় অবর্ণনীয় দরিদ্রতার জন্য পত্রিকা-প্রকাশ এবং কবিতাচর্চা একেবারে বন্ধ  ভগ্নস্বাস্থ্য , ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, অ্যাঞ্জিয়প্লাস্টি এবং দরিদ্রতা নিত্যসহযোগী ...জানুয়ারি ২০১৮ থেকে পুনরায় কবিতার জগতে প্রবেশ । দু'মুঠো অন্ন সংস্থানের নিশ্চয়তা থাকলেও  ভগ্নস্বাস্থ্য এবং টিন্নিটাস চিরসঙ্গী।খ্যাতির প্রত্যাশা নয়, যন্ত্রণাকে শিল্পে রূপান্তর ঘটাতেই এখন কবিতা লেখেন  তিনি বিশ্বাস করেন, প্রভুনাম শতবার লেখার সাথে সাথেই লেখা হোক শতকবির নামও । ভাগবতের পাশাপাশি পড়া হোক মরমীকবির কথা এবং তাদের অনশ্বর পঙক্তিসমুহ ।

               প্রকাশিত কাব্য: বধূ শ্যামলিমা, সম্পাদিত পত্রিকা: অরুন্ধতী

সম্মাননা: অর্ণব সাহিত্য সম্মান ,অকাদেমি অফ বেঙ্গলি পোয়েন্ট্রি'র সারস্বত সম্মান ,সৈকত সাহিত্য অকাদেমি'র শিশির চক্রবর্তী স্মৃতি সম্মান,অনন্যে অভিধা সৃজনী আকাদেমী'র ঋষি বঙ্কিম স্মারক সম্মান ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন