কবিতাগুচ্ছ * পরানসখা ব্রজবাসী
আদিবাস উত্তর কুরু
" আমি সূত, স্বর্গের ঠিকানা আমার জানা আছে । ভারতের উত্তরে হিমালয় ৷হিমালয়ের উত্তরে হেমকূট, তার দক্ষিণে কিম্পুরুষবর্ষ ৷হেমকূটের উত্তরে হরিবর্ষ ৷হরিবর্ষের উত্তর সীমা নিষধ পর্বত।নিষধের উত্তরে ইলাবৃতবর্ষ | ইলাবৃতের উত্তরসীমা নীলাচল।" ইলাবৃতবর্ষ'কে স্বর্গ এবং নীলাচল'কে বিষ্ণুলোক বলেছ শাম্ব-কাহিনিতে|
অথচ,যা-কিছু বলোনি তুমি ...
উৎসর্গ : কালকূট
১
যদি ভাব দূর ... উত্তরে হিমালয়
আরও উত্তর হেমকূট, হরিবর্ষ,
নিষধগিরিমালা ,ইলাবৃতবর্ষ,নীলাচল আরও
আরও দূর ...
আসলে দূর নয়, অন্তরে ভেবে দ্যাখ,আছি কি না
আজও দ্রোহে এবং মোহে তোমা অন্তঃপুর৷
২
জান তো, ধুন্ধু এসে ডোবালো দেশ -- কচ্ছ রান --
ডুবে গেল দ্বারাবতী পশ্চিম সাগরজলে ; আরও
বুঝি দৃশ্য চাও তুমি -- খুঁজে দ্যাখ, জলতল
থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় রৈবতক --
আমাকে মানিবে না তুমি? গঙ্গার বুক থেকে
হস্তিনানগর উঠে এলে?
৩
বন্ধ হলে দেবযানপথ, আছে নক্ষত্রবিথি --
ধর যদি মেঘবেশ্ব-বায়ুঅশ্বযান -- নিকটেই
চন্দ্রদেশ ; কানু নেই; এমনকী আরও দূর শূন্য --
খগচরে বগচরে কাসপিয়ান সাগরকূলে কোথা
ব্রক্ষ্মলোক !
আপন আলোকে দেখ অন্তর্লোকে অন্তরিক্ষ রয়,
নীলাচলে নীল ।
৪
হাওয়ামাঝে যে আমি নিরাকার, জলদেহ নিয়ে
বরফে আকার ধরি-- অগ্নিদেশে আনতপ্রবাহে
নড়ে উঠি, ধরি নদীনাম...
তেমনই সত্তা জেনো দেহের আড়াল -- আমাতে
আমার মাঝে ধরি বিশ্বরূপ ৷
৫
তুমি কি দেখিতে পাও তোমাকে তুমি! হৃদিমাঝে
অসুখ এলে পাঁজরে পাঁজরে নাগ -- সহিংস
দংশনে যে-ব্যথা, ফোঁসগর্জনে যে-বায়ু বিষাদিত
নীল,কথা-যা মন্ত্রপূত ওষধিবায়ুর শ্বাস -- তুমি কি
দেখিতে পেলে?
দেখিবে না এই বায়ুনীল দংশনে বিষ ; দেখিবে না
আলো ; দেখিবে না অন্ধকার ,পদশব্দ তাঁহার --
নিকটে ঈশ্বর এলে৷
৬
শ্রীচরণে ফুল নয়, আলো রেখে দ্যাখ, নন্দিত
কেশর কেমন অর্ঘ্যের মতো সাদা ৷ বায়ুমেঘে
আঁধার ডুবে গেলে যে-আলোর খেলা --
যে-অশ্বনীলে ডুবে যায় যবনিকা -- সেখানেই
মনোগত প্রাণ পেয়ে যায় পথ ...
তুমিও সেই অনিঃশেষ জেনো ; যাকে তুমি মৃত্যু
জানো , সে শুধু খণ্ডযবনিকা ... আত্মার আড়াল
আত্মা -- শোক ভুলে থাকা ।
৭
আলোতে অশ্রু রেখে দ্যাখ শিখিপাখার জন্ম হল
কি না :
এই বায়ুমনোরঞ্জিত দেশ -- বায়ু দিলে
জীবননদীতে ওঠে গান -- বায়ু দাও, আলো দাও --
জনম যখন জটিল সংসারে ;
রৌদ্রে এসে বসে গেছে শিক্ষার্থী বালক-এক
নির্বোধআকার --সেও জেনো সূর্যমুখী ফুলের
শোভায় আলো ধরতে জানে ৷
৮
মনোমুগ্ধ অতল , তোমাতেই মুক্তি মেলে --
আলোয় রাঙানো মানুষ পলকেই ডুবে গেলে
আর উঠে আসে না, রয়ে যায় আবছায়া প্রান্তর --
সমুদ্রনীল , আকাশে বাসুকিতরঙ্গ ...
৯
পাখি-ডাকা মাটির দরবেশে এলেন তিনি,
ঋষি বাল্মীকি আর ব্যাসদেব মুনি ; সেই থেকেই তৃতীয়
ভুবন ... তারও আগে মহাপ্রলয়শেষে ডুবে গেল
লিপিমস্যাধার -- এলো পাথরের দেহ ভেঙে কথাবলাযুগ,
মুখে নিয়ে আদিম শ্রুতি ; মুনিদেহে উঠে এলো
বল্কল, মরাপশুর ছাল ... তারও আগে ছিল
উত্তাল নররক্ষপুর -- দীর্ঘ চঞ্চুর ডগায়
রক্ত দেখে গুহার আড়ালে লুকালো শিকারি মানুষ ...
এভাবেই শুরু হল মহানাম : মহাভয়ে ধর্মবদল
কর, রক্ত থেকে মাংস কেটে নিয়ে আজও কার
নৈবেদ্য সাজিয়ে চল ?
১০
আলো আমাকে প্রত্যাখ্যান করে -- অথচ,
ইঙ্গিতে তুমি ছিলে পলাশের বন, আমি ছিলাম
দারুব্রহ্মবাঁশি ; অথচ, আলোর ভিতরে হাসি,
ধুলোর ভিতরে প্রেম -- যে- আমি পাণ্ডাহত -- কথা
বলব না আর ; অশ্রুকে রোপণ কোরো মাটিতে --
কিছু জ্যোৎস্নাভরতি গাছের জন্ম হলে,
কথা দিচ্ছি, ফিরে আসব আবার ৷
১১
দহনে মিশে-থাকা আমি, নির্বাপণেও আমি ...
পরাক্রান্ত আমি জন্মরূপ : অমর ও অক্ষয়
আলোর বিষ্ণুরূপ ধরি, ধরি আঁধারকৃষ্ণ ...
ত্রেতায় রাম যদি দ্বাপরে পতি-সত্যভামা ; চেতনায়
চৈতন্য কলিতে, বহু পথে বহু মতে ঋষিরামকৃষ্ণ
আমার শোভা ।
১২
বলিমন্ত্র নয়, খাঁচা থেকে উড়িয়ে দাও চিত্রগ্রীব --
তুমি উড়িয়ে দিলে :
দেখলে, নভসঙ্গমে উড়ে গেল পাখি -- ডালে বসে
ডেকে উঠল --
হরে কৃষ্ণ রাধা :
সেইথেকেই তুমি গ্রহণ করলে ভাগবতের আলো ;
তুমি অনুরাগী হলে :
সখী ও সখাসঙ্গ নিয়ে এ বৈকুণ্ঠপুরে বেড়াতে
এলে।
১৩
পঞ্চভূতে আকাশ নেই ? তবে এই আকাশ থাক
আমার দখলে --
এই পৃথিবী থাক মাইথোলজির গল্পবলা দেশ ;
হিংসায় নীল হয়ে যাওয়া
অন্ধধর্ম দেখুক, আলিঙ্গন মধুর হলে জন্ম হয়
বাউলফকিরের ৷
ওগো বাউল ওগো গেরুয়া ফকির, অগ্নিকুণ্ডের
ভিতর দাঁড়িয়ে
তুমি গান গাইলে জেগে ওঠে লালনের দেশ
চৈতন্যের দেশ ...
আহারে নমনমজাতি, এই দাবদাহদিনে সূর্য থেকে
আশীর্বাদ ঝরে পড়ুক
তোমার মাথায় --
এই মাটির দেশ তোমার না তোমার না ; হে ব্রহ্ম,
হে নদীপুত্রব্রহ্ম ...
ডিঙিমাঝে ভেসে যায় যে-মানুষ রোহিঙ্গা নামে
পরিচয় -- তাকে তুমি দেশ দেবে না ?
১৪
....১৪৫৮ খ্রিস্টপূর্ব;
অথবা, আরও অতীত -- যার কালবিন্দু নেই,
সেই আদিবিন্দু
ছুঁয়ে দ্যাখ, আমিই আদিরূপ -- অরূপ রূপের
ঠাঁই ;
আমি প্রবাহ ... সর্গে প্রতিসর্গে ; মনু ও মন্বন্তরে
অনন্ত আমার নাম ;
তোমরা নরপতি ডাকো -- দ্যাখো, মায়াটানে নদী
হেঁটে যায় সাগরে
ঘোড়া এসে আস্তাবলে দাঁড়ায়,
দর্পিত পা ফেলে ফেলে উঠোনের দেবী আসে
ঘরের মন্দিরে ...
এইসব ছাতিমের ঝোঁপঝাড় -- বাঁশঝাড়ের ছায়া --
নানুরের পুকুরধার
থেলো হুঁকোর ভুড়ুক ভাড়ুকেও মিশে আছি
আমি ; দ্যাখ,
দেহভাণ্ডে বিশ্ব কী রূপ -- আঠারো মোকামে খেলে
দ্বাদশ আদিত্য ;
কী করে শুনবে তুমি হৃদিকথা -- হৃদি থেকে দূরে
সরে গেলে ৷
****************************************************************************************************
********************************************************************************************************
প্রকাশিত কাব্য: বধূ শ্যামলিমা, সম্পাদিত পত্রিকা: অরুন্ধতী
সম্মাননা: অর্ণব সাহিত্য সম্মান ,অকাদেমি অফ বেঙ্গলি পোয়েন্ট্রি'র সারস্বত সম্মান ,সৈকত সাহিত্য অকাদেমি'র শিশির চক্রবর্তী স্মৃতি সম্মান,অনন্যে অভিধা সৃজনী আকাদেমী'র ঋষি বঙ্কিম স্মারক সম্মান ।




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন