বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বিশেষ রচনা * তপন পাত্র



পুরুলিয়ার গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ির ১৭ দিনের দুর্গাপূজা

তপন পাত্র


"শক্তির রূপ ভারতে ও মধ্য এশিয়ায়"গ্রন্থে ডক্টর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছেন , "পূর্ব ভারতে দুর্গাপূজা প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে । " দ্বাদশ শতাব্দীতে সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর "রামচরিত মানস"গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন "শরৎকালে কখনো কখনো উমার পূজা উপলক্ষে উৎসব উদযাপিত হয় ।" আমাদের এবঙ্গের অলংকার 'কীর্তিবাস কবি' কৃত্তিবাস শরৎকে "অকালবোধন" আর বসন্তকে "শুদ্ধিময়" বলে উল্লেখ করেছেন । "মার্কেন্ডেয় পুরাণ"- এ দেবীর বাৎসরিক পূজা বসন্তকাল বলেই উল্লেখ আছে। ষোড়শ শতাব্দীতে কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তীর "অভয়া মঙ্গল" বা "অম্বিকা মঙ্গল" কাব্যে পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে দশভূজা চণ্ডীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপের বর্ণনা আছে , এসময়ই দুর্গা পূজার প্রচলন হয়েছিল বলে মনে হয় ।

তবে সঠিক কবে (?) থেকে এদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রচলন , তা নিশ্চিতভাবে বলা খুব মুশকিল । পূর্ববঙ্গের রাজা হরিবর্মা দেবের প্রধানমন্ত্রী ভবদেব ভট্ট একাদশ শতাব্দীতে দুর্গাপূজার পদ্ধতি রচনা করেছিলেন । দ্বাদশ শতাব্দীতে দুর্গাপূজা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন জীমূতবাহন এবং শূলপাণি । চতুর্দশ , পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত "দুর্গা পূজা বিধান" বিষয়ক নানা পুঁথি পাওয়া যায় । চতুর্দশ শতকে বিদ্যাপতি "দুর্গা ভক্তি তরঙ্গিণী" রচনা করেন ।  তাছাড়া বাচস্পতি মিশ্রের "বাসন্তী পূজা প্রকরণ" রঘুনন্দনের "দুর্গোৎসব তত্ত্ব প্রকরণ" ইত্যাদি গ্রন্থে দুর্গাপূজার বিবরণ আছে ।

তাহলে যতদূর আন্দাজ করা যায় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক থেকে এদেশে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয় । কিন্তু শরৎকালের যে শারদ উৎসব তার প্রচলন ষোড়শ শতাব্দীতে। 

জানা যায় উত্তরবঙ্গের তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ আধুনিক রীতিতে তৎকালীন নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রতিমায় দুর্গাপূজা করেছিলেন । 

১৫১০ সালে বাংলার কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কোচবিহারে দুর্গাপূজা সূচনা করেন ।  ১৬১০ সালে দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিল কলকাতার বারিশার 

রায়চৌধুরী পরিবার । এতোসব প্রসঙ্গের অবতারণার মূল কারণটি হল আমাদের আলোচ্য রাজবাড়ীর অর্থাৎ পুরুলিয়া জেলার মানবাজারের গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ীর শারদীয়া দুর্গাপূজা ; আলোচ্য রাজবাড়ির দুর্গা পূজাও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের শারদ উৎসবের সূচনাকালের সমসাময়িক ।


     গড় পাথরমহড়া রাজপরিবারের প্রথম পুরুষ রাজা শ্রীশ্রী পরিমল সিংহ দেব ঠাকুর দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজস্থানের মোহব্বায় গড় নির্মাণ করেন। মান বংশের রাজপুরুষেরা গড় মোহাব্বা থেকে বর্ধমান জেলার কোটা-মানকর   -এ কিছুকাল অবস্থান করেন । তারপর ক্রোশজুড়ি হয়ে  বুধপুর এবং পরে মানবাজার পাথরমহড়ায় আসেন। রাজা অনন্ত মানের গড় ছিল কংসাবতীর তীরে বুধপুরে। মানবাজারের শেষ রাজা পঞ্চম হরিনারায়ণ দেব    চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা ছিলেন । চুয়াড় বিদ্রোহ সংঘটিত হয় ১৭৬৭-৬৮ সাল থেকে ১৭৯৭-৯৮ সাল পর্যন্ত দুটি পর্যায়ে । দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনের  শেষ ভাগে ফার্গুসন সাহেবের অতর্কিত আক্রমণে মানবাজারের পুরাতন রাজবাড়ী ধ্বংস হয়ে যায় । বন্দী অবস্থায় হরিনারায়ণ মেদিনীপুর জেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । হরি নারায়ণের পুত্র মানাবনিনাথ রাজা শ্রীশ্রী মুকুন্দ নারায়ন দেব ১৭০০ শকাব্দে পাথর মহড়ায় গড় নির্মাণপূর্বক দুর্গা মন্দির সহ অন্যান্য দেবতাদের মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন ।

রাণী কালি কুমারী পট্ট মহাদেবী পাথরমহড়ার মন্দির চত্বরটি শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা কে অর্পণ করেন।

রাণী রাজবালা দেব্যা , রাণী মেনকা সুন্দরী দেব্যা ,  রাণী চারুবালা দেব্যা পাথরমহড়া মৌজায় ২৬ শতক জমি ও রাণী লাবণ্যপ্রভা দেব্যা মধুপুর মৌজায় বড়পুকুর পুষ্করিণী শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা কে অর্পণ করেন। দুর্গা পূজার জন্য এক হাজার চুরাশি টাকা পুরুলিয়া কম্পেন্সেশন অফিস থেকে 'perpetual annuity' পাওয়া যায় ।

গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ির দুর্গাপূজার পূর্ব ইতিহাস প্রায় চার শ বছরের পুরানো ।


"কালিকাপুরাণ" মতে নবম্যাদি কল্পারম্ভবিধায় মানরাজবংশের শারদীয়া দুর্গাপূজা ১৭ দিনের। মান রাজবংশের বিধান অনুসারে দেবীপক্ষের শুক্লা চতুর্থী তিথিতে মানচতুর্থী ব্রত পালিত হয়। দেবীপক্ষের তৃতীয়াতে মানচতুর্থীর অধিবাস ও বিল্ববরণ । মান পাতা ,  বেল , ডালিম  , ধান ---এই চারটি দ্রব্য দিয়ে চতুর্থ পত্রিকা বাঁধা হয় । শুক্লা চতুর্থীতে শোভাযাত্রা সহকারে দোলা নিয়ে যাওয়া হয় মানবাজার মাঝপাড়ার বলরাম সায়েরে ; যা বর্তমানে বল্লাম্ সায়ের বা বল্লাম পুকুর নামে পরিচিত ।

মন্দিরে চতুর্থ পত্রিকা আনার পর ষোড়শোপচারে পূজা , আখ বলি , নতুন মাটির ঘৃত প্রদীপ প্রজ্বলন ও প্রসাদ বিতরণ হয়  । প্রদীপটি জ্বলে দেবীর বিসর্জন পর্যন্ত । পরের দিন পঞ্চমীতে আরতি ও এই দেবীর বিসর্জন হয়। এতদঞ্চলের লোক এই দেবীকে "মেজ ঠাকরুণ" বলে থাকেন ।


পাথরমহড়া রাজবাড়ির দুর্গাপূজায় প্রতিমা হয় না । নবপত্রিকায় পূজা হয় । সপ্তমীর দিন নবপত্রিকার আগমনী অনুষ্ঠান মহাসমারোহে উদ্ যাপিত হয় । নবপত্রিকা  দশদুর্গার প্রতীক । একে "ছোট ঠাকরুণ" বলে ।

প্রতিবছরই শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রাকলগ্নে মানবাজারের পন্ডিতমন্ডলী ও মেলা কর্তৃপক্ষ একসঙ্গে বসে শারদীয়া দুর্গা পূজার নির্ঘণ্ট  তৈরি করেন । বিশেষ করে দোলা তোলা এবং দোলা বিসর্জনের সময় স্থির করা হয় ।

জিতাষ্টমী থেকেই শুরু হয়ে যায় পূজার নানা কর্মকাণ্ড ।   জিতা অষ্টমীর রাত্রিতে মন্দির সংস্কার , হোম ও বোধনের অধিবাস হয় । পিতৃপক্ষের নবমীতে বোধন পূজা ,  বোধনের ঘট ভরিয়ে আনা হয় বলরাম সায়ের থেকে । এই বোধন কে বলা হয় "বড় ঠাকুরুণ"। 

মূল পূজায় রাজলক্ষ্মীর ঘট আসে রাজবাড়ী থেকে । গঙ্গা দেবীর ঘট ও একটি তলোয়ার আসে রাজবাড়ীর বলরাম জিউয়ের মন্দির থেকে ।  একটি নিরবচ্ছিন্ন ঘৃত প্রদীপ এই দিন থেকে জ্বলে বিজয়া দশমী পর্যন্ত । দেবীপক্ষের সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত পৃথকভাবে আরও দু'টি ঘৃত প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং সন্ধিপূজার সময় জ্বালানো হয় ১০৮ টি ঘৃতপ্রদীপ । কৃষ্ণানবমী থেকে বিজয়াদশমী পর্যন্ত প্রত্যহ পূজা ,  ভোগারতি , চণ্ডীপাঠ ও হরিনাম সংকীর্তন চলতে থাকে । সপ্তমী , অষ্টমী ,  নবমীতে প্রথানুসারে আঁখ ,  কুমড়া ও ছাগ বলি হয় ।


সপ্তমী ও বিজয়ার দিন রাজবাড়ী থেকে মানবাজারের অন্যান্য পারিবারিক ও গোষ্ঠীবদ্ধ সাতটি পূজার একসাথে দোলা তোলার অনুষ্ঠান হয়ে আসছে । রাজবাড়ীর সংকেত ধ্বনি শুনে সন্ধিপূজায় বলিদান মানবাজারের শারদীয়া পূজার চিরন্তন ঐতিহ্য ।  আগমনী ও বিসর্জন অনুষ্ঠান দেখার জন্য মানবাজার নামোপাড়ার গোপাল সায়েরে অগণিত মানুষের ভিড় হয় । রাজপুরোহিত আগমনীর দিন আগমনীর আর বিসর্জনের দিন বিসর্জনের মন্ত্র পাঠ করেন । এই পবিত্র মুহূর্তের রূপবৈচিত্র্য মানুষকে আজও আকর্ষণ করে । সারা মানবাজারে বেজে ওঠে সংহতি , মিলন ও ঐক্যের সুর । শারদ-উৎসব অনেকাংশে একটি প্রসিদ্ধ লোক-উৎসবের রূপ পেয়ে যায় ।

বিজয়া দশমীর দিন দুর্গা মন্দিরে অপরাজিতা পূজা , শুভ পুণ্যাহ , রাজলক্ষ্মীর রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন , বিকালে দিক্ বিঁধা অর্থাৎ  দ্বিগবিজয় , শ্রী শ্রী তালবাসিনিদেবীর বিশেষ পূজা ,  বলিদান এবং রাত্রিতে দুর্গা মন্দিরে রায় মহাশয় পাতর (পাত্র) সরকার আত্মীয় কুটুম্বদিগকে  খিলিপান বিতরণ করা হয় । অধিক রাত্রিতে খেটুয়া‌ বোধনে ঘট দু'টি বিসর্জন দেন এবং ১৭ দিনের শারদীয়া দুর্গা পূজার পরিসমাপ্তি ঘটে।

      


বি:দ্র:  রচনাটি নির্মাণের ক্ষেত্রে আমি গড় পাথরমহড়া রাজবাড়ির বর্তমান রাজা দেবাশীষ নারায়ণ দেবের কাছে কৃতজ্ঞ।।

*****************************************************************************************************



তপন পাত্র 

পুরুলিয়ার সুপ্রাচীন লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক ফুটে ওঠে পেশায় অধ্যাপক তপন পাত্রর কলমেগদ্য ও কবিতা উভয় শাখাতেই তিনি সাবলীল । তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই ---কাব্যগ্রন্থ : মাটিও কালে ঢেউ  --(১৯৯৪) * অচেনা রং --(১৯৯৮) * স্বাতী নক্ষত্রের জল  ঝিনুকের বুকে --(২০০০) *  ঝড় সওয়া কলাপাতার গান --(২০০৩) * রচিত কবিতা --(২০১৮ ) বিভাবরী --(২০১৮) * সেই পলাশ্যার তিন পাত --( (মানভূঁইয়া কবিতা) (২০১৯) * সুদূর মাঠের প্রস্তাব -- (২০২০) * কোভিড নাইনটিন্ --(২০২০) * বসন খসে পড়ে --(২০২১) ছড়া---দিলাম ছড়া ছড়িয়ে --(১৯৯২) *  হুল  --(২০১৩)


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন