ফারসি কবিতার তিন নারী

ভাষান্তর: রূপায়ণ ঘোষ
জমিলা ইস্ফাহনি [ ১৫৭১ - ? ]

১.
সময়ের আশ্চর্য রসুইয়ে
আমারও নিমন্ত্রণ ছিল প্রেমের ভোজসভায়
এমন উল্লাস মনের দ্বিধা সরিয়ে দেয়;
আমিই শেষ অতিথি যে ফেলে এসেছি খাদ্যের সমস্ত প্রমত্ততা-
এখন আমি বৃদ্ধা হয়েছি,
পান করে নিচ্ছি জীবনের শেষ সুরা
কত তিক্ত দৃষ্টি সাজিয়ে ফিরি পুরোনো দৃশ্যদের কাছে
দেখি, আমার অতীত চিত্রগুলি থেকে অশ্রুর মাদকতা ঝরে পড়ে...
২.
আমার ভাগ্যের বাগানে
কেবল দুঃখের রূঢ় কাঁটা বেড়ে গেছে,
যত দীর্ঘ হয়েছে সেগুলি-
হৃদয়কে বিদ্ধ করেছে অবিরত,
বিদ্ধ করেছে রোজ, আমার বেদনার স্বগোক্তি প্রলাপও।
৩.
আমি এখন দুঃখে ও উন্মাদনায় ঘুমোতে পারব না
আমার হৃদয় শোবে না দুঃখে আচ্ছন্ন হয়ে-
তোমার বিপুল জাগ্রত চোখ
আমার ঘুম নিঙড়ে নেয়,
হে সুতীব্র ঈশ্বর, তোমার খাদিম্ ঘুমোতে পারে না এখনও
এমনকী তার কবরেও জেগে থাকে অনিদ্রিত মৃত্যু।
নূরজাহান [ ১৫৭৭- ১৬৪৫ খ্রি: ]
নূরজাহান মধ্যযুগের ভারতের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম মেহেরুন্নেসা। তাঁর জন্ম ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের কান্দাহারে। পরবর্তীকালে ভাগ্যান্বেষণে তিনি পরিবারসহ ভারতবর্ষে এসে উপস্থিত হন। অপরূপ সুন্দরী মেহেরুন্নেসার ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহ হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মুঘল দরবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তাঁর ক্ষমতা খর্ব হতে থাকে। এই সময়পর্বে একাকিত্ব দূরীকরণের পন্থা হিসাবে কাব্যরচনার কাজে তিনি হাত দেন। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে লাহোরে (বর্তমান পাকিস্তান) নূরজাহানের মৃত্যু হয়।৪.
আকাশের রং গাঢ় হলে
আমাদের বেদনা প্রগাঢ় হয়,
দুঃখের বিষয় যে চিনা আয়না ভেঙে গেছে
অথচ সমস্ত দুঃখ উন্মীলিত নয়।
কাচ টুকরো হলে জেনো
নিজেকে দেখার একটি সহজ উপায় চলে গেছে,
এখন আর তুমি নিজেও নিজের অধিকারী নও!
৫.
আমার সমাধি এখানে অপরিচিত,
কোনো প্রদীপ অথবা গোলাপ নেই
শুধু অন্ধকারে কিছু নির্লিপ্ত আলো জ্বলে যায়
কোনো পথভ্রষ্ট প্রজাপতি
এ সমাধির উপর দিয়ে ওড়েনি কখনো
এখানে প্রশান্ত ঘুমের বসত রেখে
পৃথিবীতে আমার ঠিকানা বদলে গেছে...
৬.
ঈশ্বর, এই নির্বোধ কবিদের সাহায্য করো
তাদের উপমার ভিতর দখলের উল্লাস ফেটে পড়ে।
আমি সেই বৃক্ষের দিকে ছুটে যাই
দখলসম্ভব সবকিছু থেকে দূরে
যে অপেক্ষারত-
আমি লোভনীয় উপমার উপর দাঁড়িয়ে
নির্লিপ্ত আকাশ ছোঁব বলে
এই অনন্ত বৃক্ষের কাছে এসে থেমে যাই।
যিব্-অল্-নিসা-মখ্ফি [ ১৬৩৮ - ১৭০১ খ্রি: ]
যিব্-অল্-নিসা-মখ্ফির জন্ম হয় ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আগ্রায়। তাঁর পিতা মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। শৈশব থেকে প্রবল মেধার অধিকারী মখ্ফি নানাবিধ পঠন-পাঠনে অভ্যস্ত ছিলেন। দারাশুকোর পুত্রের সঙ্গে তাঁর প্রণয় সম্পর্কের কথা জানতে পেরে ঔরঙ্গজেব নিজ কন্যাকে দিল্লির সেলিমগড় দুর্গে দীর্ঘ কুড়ি বৎসর গৃহবন্দি করে রাখেন এবং ভ্রাতৃপুত্রকে হত্যা করেন। প্রেমের বিচ্ছেদ ও প্রেমিকের মৃত্যু সংবাদ মখ্ফিকে শোকে পাথর করে তোলে। বন্দি অবস্থায় ফারসি ভাষায় তিনি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন, অধিকাংশই নষ্ট করে ফেলা হলেও কয়েকটি রয়ে যায়। এগুলিই নূরহূন সিদ্দিকী তাঁর গ্রন্থে সংকলিত করেন।৭.
প্রেমের মিনার থেকে নেমে আসি
আমার ফসলের সম্পদ খড়ের মতো বিলিয়ে দেওয়া হয়,
আমার অব্যক্ত সুখ এখানে বন্দি হতে হতে
অর্ধেক জীবন কী আশ্চর্য শূন্যতায় কেটে যায়!
এই উন্মাদ হৃদয়, স্তব্ধ আত্মা-
জানালার গরাদ ভেঙে বেরোতে পারে না
প্রতিটি রাত্রি এত অন্ধকার নিয়ে আসে
মানুষের নিজস্ব আলোর মোহর হারিয়ে যায়;
কত কত বিশ্বে কিনব বলে অপেক্ষা করি
অথচ গরাদহীন একখানি জানালা কিনতে পারি না আজও...
৮.
প্রেম আসে অতর্কিতে, আসে আর
একজন ব্যক্তির চেতনা চুরি করে।
এ এক অনন্ত পারম্পর্যময় খেলা,
দৃষ্টির বাইরে থাকবে বলে
চোরেরা প্রথমে অপরিমেয় আলো ঢেলে রাখে-
একজন অন্ধ মানুষ নিজেকে আঘাত করে না
যেমন আমি করেছি,
আমি এক সাজানো উজ্জ্বল ঘরে আছি
অথচ কোথাও তার মালিকের আলো খুঁজে পাচ্ছি না।
৯.
হে জলপ্রপাত, তুমি অবিরাম হাহাকার করো কেন?
কে তোমার কপালে এঁকেছে যন্ত্রণার ভ্রুকুটি?
কী বিপুল বেদনার জলরাশি জমে যায়
তুমি প্রতিনিয়ত পাথরে মাথা রেখে কাঁদো, প্রহার করো-
নিজেকে ধ্বংসের প্রমত্ততা
ধীরে ধীরে একদিন সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙে দেয়
খুলে দেয় প্রমগ্ন প্রবাহের পথ...
১০.
আমি, অপর সকল বৃত্ত থেকে পালিয়ে যাই
যে আয়নার কাছে একাকী ধরা দেবো বলে বেঁচে আছি
তার সম্মুখে আমার চোখ বন্ধ থাকে,
পৃথিবীতে এত এত আয়না আছে
তবু আমার সুরম্য ঘরে একা জেগে থাকি
উল্লাস করার মতো কোনও ছায়া
আজও জমাতে পারিনি এখানে!
*************************************************************************************************
************************************************************************************************************
রূপায়ণ ঘোষের জন্ম অগস্ট ১৯৯৩ সালে, লালমাটির বীরভূমে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রত্নবিদ্যা' বিষয়ে স্নাতকোত্তর। অনুবাদের পাশাপাশি রূপায়ণ মৌলিক কবিতা ও প্রবন্ধচর্চাও করে থাকেন। তাঁর এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে দু'টি কবিতার বই ও একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। বর্তমানে হিন্দি, মরাঠি, পালি ও রোমানিয়ান সাহিত্যের অনুবাদক হিসেবেও তিনি কাজ করছেন।





কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন