প্লাঞ্চেটের ভয়ংকর রাত
মল্লিকা রায়
"আপনি বরং কোন স্পেশ্যাল সাইক্রিয়াটিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করুন এ সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে _ ঘাড় থেকে টেথেসস্কোপটা টেবিলে রেখে উত্তর দিলেন ড : মৈত্র "। এস আর মৈত্র। কলকাতা এজরা স্ট্রীটের নামকরা সাইকো ফিজিসিয়ান।
"কেন ডক্টর! ওনার কি মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে" ভয় পেলাম।
"না না আমি তা বলছি না, মানে উনি কোন ব্যাপারে ভীষণ ভয় পেয়েছেন, ঘরে অথবা বাইরে - আপনারা ওনার ফ্যামিলিয়র এ বিষয়টা আশা করি আপনাদেরই ভাল জানা উচিত"
পাশেই ছিলাম আমি। তখনও বাবার উদ্বেগ,উৎকন্ঠা কাটেনি চোখে মুখে কেমন একটা ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
"আচ্ছা আঙ্কেল, আমিও ওনার কয়েকটা সিম্পটম লক্ষ্য করছি সেগুলি টোট্যালি চাইল্ডহুড,আই মিন -
"ওহ্ ইয়েস"
"মানে উনি বেশিরভাগ সময়ে পাজামা ভিজিয়ে ফেলছেন - যেটা কিছুদিন আগেও আমরা দেখিনি"
"মে বি এ্যা সিম্পটম, আমি একজনকে সাজেস্ট করতে পারি ড: কান্ট, স্পেশ্যাল ফিজিসিয়ান ফ্রম ইউ এস এ ধর্মতলায় ওনার চেম্বার মাসে একদিন আসেন, আমি এট লিস্ট ফোন নম্বরটা দিতে পারি বাকিটা আপনাদের হাতে, ওকে "।
আসলে আমরা সকলেই ভীষণ চিন্তিত ছিলাম হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল বাবা হঠাৎ করেই কেমন বিষন্ন ও মনমরা হয়ে গেলেন। কিভাবে ওনাকে আগের মত মূল স্রোতে ফেরানো যায় চেষ্টা করছিলাম তারই।
"ঠিক আছে স্যার, আমরাই যোগাযোগ করে নেব" নমস্কার জানিয়ে বেড়িয়ে এসে টো টো ধরলাম,ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে বাবা ইদানিং যোগ হয়েছে বেশ কিছু উপসর্গ। ভার্সিটির সামনে দাঁড় করিয়ে ড্রাইভারকে ভাড়া ও মাকে ঠিকঠাক নির্দেশ দিয়ে আমি নেমে গেলাম।
ক্যাম্পাসেই ওয়েট করছিল ওদের গোটা টিমটা আমায় ঘিরে চলল জিজ্ঞাসাবাদ,কোন এক্সস্ট্রিম কিনা এ নিয়ে,গতকাল আসা হয়নি আগের দিন ডিটেলে আলোচনা করেছি ওদের সঙ্গে এটা তারই কৌতূহল। "তুই কিন্তু দেরী করে ফেলছিস রীতা আজই সেখানে এপয়েন্ট করে আসা উচিত ছিল তোর, জানিসইতো ওনার ডিমান্ড " উদ্বিগ্ন সৌনক।
"তুই ঠিকই বলেছিস,আমাদের মধ্যে ধর্মতলায় স্পেশ্যাল সাইকো ফিজিসিয়ান ড: কান্টের সঙ্গে পরিচয় আছে কারো আই মিন যোগাযোগ তাহলে এপয়েন্টের একটু সুবিধা হত"। আসলে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। চিরকাল দেখে এসেছি বাবা আমাদের গার্ডিয়ান ছোটাছুটি করেন মা,আমার জন্য। বুঝে ওঠার আগেই হুট্ করে এভাবে এতটা দায়িত্ব মাথায় চেপে বসবে ঠাহর করতে পারিনি।
"হুম্, একটু দাঁড়া ওই যে থার্ড রোয়ের কর্নারের দিকের মোটা মেয়েটা- প্রসঙ্গক্রমে একদিন বলছিল ড: কান্টের কথা মোট কথা তুই একটু জিজ্ঞাসা কর-"
সঙ্গে ওদের গোটা দল, মেয়েটির নাম পৌষালি মুখার্জী বাড়ি কলেজস্ট্রীটের কোথাও ওর কোন এক রিলেটিভের নার্ভের সমস্যার কারণে বারোমাস নিতে হয় ওই ডক্টরের প্রেশক্রিপশন। নাম্বার থাকলেও দিনে ফোন রিসিভ করেন না উনি। রাত দশটার পর তাও এমার্জেন্সি কল ছাড়া। অবশেষে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা ভাবনা চিন্তা করে স্থির হল এমার্জেন্সিতেই কল করা হবে ওনাকে আজ রাত দশটার পর।
আমাকে দেখেই মা শিশুর মত কেঁদে ফেলে। পাশে অসহায় বাবা ইদানিং কেমন রুক্ষ শুষ্ক লাগে। "ওহ্ মা তুমিও যদি এমন কর,আমি পারব কি করে বল,
কোথায় তুমি বাবাকে উৎসাহ দেবে তা নয়,কি যে কর আজকাল যেন অবুঝ হয়ে উঠছ দিনকে দিন"
"না মা তুই একদম চিন্তা করবি না আমার কি হয়েছে হ্যাঁ কিচ্ছু হয়নি,তোরা অযথা আমায় নিয়ে বাড়াবাড়ি - "
"বেশ আজ রাতে কিন্তু আলো জ্বেলে শোওয়া বন্ধ এভাবে চার পাঁচদিন যদি তুমি ভয় না পাও বুঝবো তুমি ট্যোট্যালি ফিট্ ওকে এন্ড দ্যাটস ফাইন্যাল মনে থাকে যেন -"
গরম রুটি আর সবজি টেবিলে রাখে মা সঙ্গে চাটনি অথবা আচার এই ব্যঞ্জনটা সাঙ্ঘাতিক প্রিয় আমার। মা জানে। কষ্ট হয় ওর জন্য,বেচারি! হাত খরচ চাইলে ওয়ার্ডরোব খুলে যখন আধ ময়লা খরচ বাচানো টাকাটা হাতে তুলে দিয়ে একগাল হাসেন, বেসরকারি সংস্থার মালিক ইউনিয়নের ষড়যন্ত্রে অসময়ে বসিয়ে দেওয়া সামান্য কর্মীর এর বেশি আর কিই বা কাম্য।
সংসার পূজা আচ্চা পাবন উপোস সংসার সন্তানের মঙ্গলকামনা করেই পেরিয়ে গেল তিনভাগ সময়টা যে সময়টা আমোদ আহ্লাদ করবে বলে বহু জল্পনা কল্পনা করেছিল হঠাৎ করেই বজ্রপাতে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সবকিছু। তথাপি বাবার ওই মা' সম্মোধনটা সব কষ্ট দু:খ ভুলিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখায় যেন। এই কিছুদিন আগেও ভাত খুব গরম বলে না খেয়ে বেড়োতে গেলে নিজ হাতে মেখে খাইয়ে দিয়েছিলেন। সে কি ঝগড়া মায়ের সঙ্গে - কেন ভাতটা দু ' ঘন্টা আগে রান্না করেনা মা, ভাত চড়িয়ে বাবা গোটা বাজার ঘুরে আসতে পারলে কেনই বা মা পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, হো হো করে আমার সে কি দমকা হাসি। গোত্তা মেরে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে মা ঢোকে রান্নাঘরে আর "বোল্ড আউট, হেহ্ হেহ্ করে ছোট ছেলের মত হাত পা ছুড়ে সেকি ছেলেমানুষী বাবারও। কোথায় সেসব দিন আজ,যদিও জানি চাকরিটা নেই বেড়িয়ে পরেছে সংসারের জরা জীর্ণ দশা। হলেও। প্রাণী বলতে তো মাত্র তিনজন। হৈ হৈ করে কাটিয়ে দিতে ক্ষতি কি। তার ওপরে আবার যোগ হয়েছে নতুন উপসর্গ। মা কাঁদবে ছাড়া করবে কি।
দুই
"হ্যালো স্যার,ড: কান্ট বলছেন,আইম রীতা ফ্রম ক্যলকাট্টা "
" ওকে ইয়েস "
"স্যার একটা এপয়েন্টমেন্ট, ভেরি আর্জেন্ট স্যার "
"নেক্সট মান্থ! নো স্যার পেসেন্টজ্ মাই ফাদার প্লিজ ডু সামথিং"
"নেক্সট উইক! ওকে থ্যঙ্কয়্যু ভেরিমচ"
ওঘরে বাবা মা ঘুমে আচ্ছন্ন। টয়লেট যাবার পথে কনফার্ম হয়ে নিলাম, নাহ্ হালকা আলোয় সব ঠিকঠাক আছে। গত সপ্তাহের প্রফেসর পার্থ'র থিসিসের নোটসগুলোর কিছুটা বাকি আছে শেষ করে তবে উঠতে হবে। এই মুহূর্তে একরাশ কাগজ আর এই ফোকাস ল্যাম্পটা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আর আছে চতুর্দিকের এই থমথমে পরিবেশে এই কাগজপত্র গুলোর সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় সখ্যতা, অন্তরঙ্গতা তা না হলে কি আর এমনি এমনি কারেন্ট থিসিসের দামী নোটস উনি প্রথম আমায় দিতেন আসলে আগেকার নোটসগুলো দেখে উনি যথেষ্ট ইমপ্রেসড। এখন রাত বারোটা বাবা বেশ কাশছেন আর মায়ের একটা হাত ওনার বুকের উপর থাবা দিতে ব্যস্ত যেমন বিষম খেলে আমায় করে। এখন আমি ফিলসফির ওয়েস্টার্ন পর্বে মুখ থুবরে পরে আছি খাতার ওপর, হাতে কলম সঙ্গে স্যারের নোটস্।
মাথার উপর সদা চক্ররত ত্রিচক্রটি ঘ্যাঁচর শব্দ করে থেমে গেল হঠাৎ, লোড শেডিং। নিত্যকার একঘেয়ে যন্ত্রণা। মবটর্চ জ্বেলে খুঁজে পেলাম ম্যাচ্, শব্দটি বিলুপ্ত হতে চলেছে। ইদানিং লাইটার,গ্যাসলাইট এসব পেয়ে আমরা ভুলতে বসেছি একে। তবে অসময়ে কাজে লাগে বটে। ড্রয়ার খুঁজে বের করলাম তাকে অনিন্দ্য সুন্দর হলুদ বস্তুতে তৈরি প্রাকৃতিক আলো। ওঘরে ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছেন বাবা। মায়ের হাত পাখার দোর্দন্ডপ্রতাপ চালনায় মর্মাহত বেচারা পওন দেবও, বোধয় এতক্ষণে যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে গেছে অন্তত পাখা চালনার আওয়াজে তা স্পষ্ট। ব্যাস্ ইতি টানো আজকের মত হে টেবিল,ওঠ তৈরি হও নিস্তরঙ্গ সমস্যার বৈতরনী বইবার।
এখন আমি নান্। ঠিক দেওয়ালের ছবিটার মত একহাতে দন্ডটিকে বয়ে নিয়ে চলেছি ওঘর আলো করতে,আমার মুখের হাইলাইট হচ্ছে শুধু। নাকটা মোটা মত,চোখের বা কর্নারের তিলটা বেশ মানানসই তবে কপালটা বড্ড চওড়া। ভ্রূ বেশ পাতলা প্লাগ্ করা মনে হয়। চোখটা ছোট হলেও সাইট বেশ স্বচ্ছ। দেওয়ালে ঐ বিশাল দেহের ছবিটা কার! ছ্যাৎ্ করে উঠল বুকের ভেতর। যাহ্ আমিই তো। রিফ্লেকশনে আমি। আমি আবার বাবা হয়ে যাচ্ছি না তো!
বিছানায় উঠে বসেছেন মা,পেছনে গুটিসুটি মেরে মায়ের আঁচল ধরে বসে মশার গান শুনছেন বাবা। " জানি তো তোমার আবার ভয় করবে,তাই নিয়ে এলাম "।
গরমে খুলে ফেলেছেন মশারির একাংশ, শরীরের বস্ত্রও বেজায় অবাধ্য। আমি আবার কাকে বলি নিজেই তো হাফ্ প্যান্টালুন আর শর্ট গেঞ্জিতে সম্ভ্রমের বালাই উড়িয়ে দিয়েছি স্বয়ং। ওসব মাজা ঘষা দিনের আলোয় দেখা যাবেখন। পাখা বেচারা আমার হাতে এসে একেবারেই দমবন্ধ অবস্থা ওইটুক ছোট্ট খেলনার বেয়াদপি দেখ,আমাদের প্রয়োজনকে অবজ্ঞা। তাও প্রায় মধ্যরাতে। দেখাচ্ছি মজা। ক্ষুদ্র স্ট্যাটাসের আবার বাহাদুরি! লেকট্রিকের সঙ্গে পাল্লা। খাটে টেনে কয়েক ঘা মারতেই গমগম করে দুলে উঠল পাখা জ্বলে উঠল আলো।
"বুঝলে বাবা এই হল নিম্নমানের স্ট্যাটাস,যোগ্যতা থাক বা না থাক পাল্লা দেবেই দেবে "।
যাক্ সমস্যা মিটল এরাতের মতন। তা-ই বা বলি কি করে ভোর তো প্রায় হয়েই এসেছে উঠে পরেছে কাক ওরা নাকি আর্লি রাইজার।
মায়ের নৈমিত্তিক অষ্টোত্তর শতনাম কানে আসছে,গোপালকে জাগাচ্ছেন হয়তো। বিছানা পাট করা,ফুল তোলা, ঘরে ঝাড়ু দেওয়া আর বাবাকে নিয়ে সামনের রাস্তায় মিনিট ত্রিশের পায়চারী।আমায় ডাকেন না জানেন বেশ রাত করে ঘুমোতে যাই। হাই উঠছে। ওঘরে ঢুকে লেপটে দিলাম নিজেকে।
তিন
বাস স্টপ থেকে কিছুটা পায়ে হেঁটে বিশাল ফিফ্থ্ ফ্লোর আ্যাপার্টমেন্টের সেকেন্ড ফ্লোরের ফ্রন্ট রুমেই ড: কান্টের চেম্বার। দরজার পাশে ইয়া বড় কালো নেমপ্লেটে বড় বড় সোনালী অক্ষরে খোদাই করা ওনার ডেজিগনেশন্। কলকাতার এই রাস্তার টী বোর্ডের পাশ দিয়ে সোজা শিয়ালদহ, একমাত্র বাস,হাতে টানা রিক্স এবং টোটো ছাড়া হলুদ ট্যাক্সির রমরমা । ফুতপাথ ধরে হেঁটে আসতে অবশ্য মিনিট দশেক লাগল। খিদেয় ঢু মারছে পেটে ফুটস্টলের পরোটা তরকা ছাড়া বসে খাবার মত রেস্তেরাঁ নেই। দু' একটা মিষ্টির দোকানী অবশ্য বসে আছেন মিষ্টান্নের পদ আলো করে। এসবে অবশ্য আমার তেমন ইন্টারেষ্ট নেই কোনকালে একমাত্র মিষ্টি দই ও ছানার জিলাপি ছাড়া,অবশ্য এসময় রুচি নেই তাতেও প্রাত:রাশের মায়ের হাতের গরমা গরম হাতে গড়া রুটি সবজির গুরুত্বই আলাদা সঙ্গে ধোঁওয়া ওঠা চা। পেট চাবকিয়ে অগত্যা বসতে হল ওয়েটিং রুমে। যদি টার্ম এসে যায়।
বহুবাজার স্ট্রীটে থাকে বলে কৃপা করে সৌনকই অগত্যা লাইনে দাঁড়িয়ে এপয়েন্টমেন্ট - টা ধরিয়ে দিয়েছিল ভাগ্যিস নইলে কি যে হত। ভোরবেলা কোনরকমে মুখ হাত ধুয়েই বেড়িয়ে পরতে হয়েছে,আট দশজন পেসেন্ট থাকায় সিট্ পেতে অসুবিধা হয়নি বাবা, মায়ের। বেলা গড়াতেই তিল ধারণের জায়গা রইল না। বারো নম্বরে নাম সময় বেশি না লাগলেও,গেল আজকের দিনটাও। ইম্পর্ট্যান্ট দিনগুলো এভাবেই মিস হয় আমার,আজ জরুরি সেমিনার ছিল ব্যাচমেটদের সাথে সপ্তাহান্তে এই একদিন করে, প্রিন্সিপালের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেরাই তৈরী করেছি আমরা ক্লাশের একাংশ মিলে। সাইড ব্যাগে অবশ্য পার্থ স্যারের নোটসগুলো নিয়ে নিয়েছি,যদি তারাতারি কমপ্লিট্ হয়ে যায় এই ভেবে। দশটা আটান্ন, আজ আর চান্স নেই ফোনে সৌনকের তিনটে মিসড্ কল।আসছি বলে বাইরে এসে রিং করলাম।
"সেমিনারটা একটু সামলে নিস্ প্লিজ,কিংশুক,তিয়াসার সাথে কথা বলে নিস বারোটার আগে কমপ্লিট করতে পারলে আমি এসে যাব, নোটসগুলো ফলো করে আমায় দিস কিন্তু "
নাম ডাকতেই বাবাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম "আরয়্যু দ্যটস আরজেন্টস - "
" ইয়েস স্যার হিজ মাই ড্যড্,দ্য পেসেন্ট"
মাথা ভরতি লাল সাদা চুলে এলোমেলো বোধহয় সময় পাননি চিরুনি বসানোর। তবে যতটা ইয়ং মনে হয়েছিল কথা বলে, ততটা তরুণ নন বেশ হাসিখুশি ধবধবে সাদা উচ্ছল ইয়া লম্বা মাঝবয়সী সু - দর্শন মধ্য বয়সী আ্যংলো। বাঙালি পাড়ায় এই একদিনই আসেন বেশিরভাগ পেসেন্ট বাঙালি হওয়ায় কথা বলেন ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে। তবে বলেন বেশ ঝরঝরে ভাষায়। আমি বাবাকে নিয়ে পর্দা সরিয়ে ইনডোরে ঢুকলাম একটা সাধারণ চেয়ার আর সমুখে বেশ বড় মাপের একটা স্ট্যান্ড লাইট সরাসরি মুখে ফোকাসের জন্য। তেমন হাইফাই কিছুই নয় নরম্যাল রেঞ্জমেন্ট।
বাবাকে বসানো হল চেয়ারটায়,প্রায়ান্ধকার ছোট্ট ঘরটিতে জ্বলে উঠল একশো ওয়াট আলো,ছটকে চোখ বন্ধ করলেন বাবা। বললাম "ভয় নেই ড্যড্"।
"রাইটট" আমার কথা শুনে হাসেন ডক্টর -
"হোয়াটজ ইওর নেম স্যর, মানে আফনার নাম কি আছে " প্রশ্ন করলেন বাবাকে।
"কৃষ্ণকান্ত মৈত্র" আমি আগ বাড়িয়ে বলতে গেলে বাধা দিলেন।
" নো নো উনাকে বুলথে হবে " হেসে ফললাম।
" আচ্ছা আফনি কোথায় কাজ করতেন মনে কোরতে পারেন কি আই মিন জব,আপনার ফ্রেন্ডসদের নাম আই মিন কোন সেকসনে - "
" হ্যাঁ হ্যাঁ ওই তো " ডোমজুর লয়্যালটি সেক্টরে, একাউন্ট সেকশনের দেবরাজ, ফাইল সেকশনের অম্লান, আর ট্রেইজারার মি: শতপথী। আমি ছিলাম হেড ক্লার্ক বাসুদেব স্যারের এসিস্টেন্ট, ওহ্ সেইসব দিন আহা কত আড্ডা ইয়ার্কির " একনাগারে বলে থামলেন বাবা। হয়তো ডক্টরকে উনি সন্তোষ জেঠু ভেবেছিলেন।
"আফনি তো সোব বোলতে পারছেন, গুড! আফনার কেইস হিস্ট্রি আমি পড়িলাম কেয়ারলি সবসময় আফনি ভয়ে ভয়ে ঠাকেন, কেন,কিসের ভয় পান বলুন তো -"
"না মানে,আমি ঠিক জানি না কিছুই মনে করতে পারছি না" কান্না ভেজা সুরে জানান ফাদার।
"মনে করবার চেষ্টা করুন, কখনো কোনদিন আপনি কি ভয়ের কিছু দেখিয়েছেন,আই মিন ফ্রাইটেন্ড ফ্রম এনি সিকোন্স"
" মাথা নাড়েন বাবা "
" ট্রাই ঠ্যু রিমাইন্ড প্লিজ্,আগে,দুই,পাঁচ,সাত বছর আগে,বাড়িতে, আউটডোরে, রাতে - একসাথে বসে কোন ঘটনা থেকে - "
"ইয়েস! ইয়েস ডক্টর মনে পড়েছে এইবার,বছর দুয়েক আগেই হবে কারণ বাবা মারা গেলেন গত বছরের ঠিক এই মাসের থার্ড উইকের ফ্রাইডেতে।
দিনটা ছিল ভাদ্র মাসের ঘোর অমাবস্যার মঙ্গলবার, সন্ধ্যা সাতটা। আমার বাবা দীপ্তেন্দু প্রসাদ মৈত্র হঠাৎ স্বপ্ন দেখে মন ভারাক্রান্ত হওয়ায় মনস্থ করলেন,আট বছর আগে দুর্ঘটনায় মৃত মায়ের প্ল্যানচেট করবেন। বলার সাথে সাথেই কাজ। সঙ্গী সাথী তিন চারজন ও মিডিয়া অর্থাৎ প্রধান ব্যাক্তির জোগাড় যন্ত্র আলোচনা করে তবে নির্দিষ্ট হল দিনক্ষণ। আগামী মঙ্গলবার অমাবস্যার শুভ যোগ। অত:পর ডাক পরল সেই টিমের। মিডলম্যান সহ অর্থাৎ যার উপর ভর করবে সেই মৃত ব্যাক্তির আত্মা দলটিকে নিয়ে গুছিয়ে বসলেন ভদ্রলোক ওপরের ফাঁকা ঘরের মধ্যিখানে। আগে থেকেই ধোঁওয়া মোছা পরিস্কার করা ঘরে ধূপ ধূণা প্রদীপ জ্বেলে ওই মিডিয়ার চারপাশে ঘিরে বসল সকলে, ওদের সঙ্গে আমিও। সন্ধ্যে সাতটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার করে দেওয়া হল ঘর এমনকি নিভিয়ে দেওয়া হল জ্বলন্ত প্রদীপও। আমাকে বলা হল সাদা খাতার ওপর কলম ছুঁয়ে বসে থাকতে। গাঢ় অমাবস্যার অন্ধকার আবার ভুত প্রেতের আগমন শুনে আমার তো আগে থেকেই বুক কাঁপতে শুরু করেছে। মধ্যিখানের মিডিয়া বারংবার সতর্কবানী উচ্চারণ করে চলেছেন -" এখনও সময় আছে ভয় পেলে যে কেউ উঠে যেতে পারেন "
আমি চোখ বুঁজে বসে রইলাম গেড়ে। ঘর কাঁপিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে প্রেত মন্ত্র,আমাদের বলা হয়েছে তার সাথে মনে মনে উচ্চারণ করতে। খটমট উচ্চারণ সব। ঘন্টাখানেক মন্ত্রোচ্চারণের পর কোথাও কিচ্ছু নেই তথাপি ঘরের ভেতর সোঁ সোঁ ঠিক প্রবল ঝড়ের বেগের আঁওয়াজ শোনা গেল নড়ে উঠল আমার হাতের আঙুল এমনিই, বেশ বুঝতে পারছি ভয়ে দাঁতে দাঁত চেপে শুধু রাম নাম স্মরণ করছি। "
"তিনি হাজির,আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন " গম্ভীর স্বরে জানান দিলেন মিডিয়া।
"তুমি এখন কোথায় আছো " আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলেন বাবা। " এই তো এখানে,তোমার পাশে"
মিডিয়া অর্ধচেতন হলে মুখে অদ্ভুত কন্ঠস্বরের উত্তর শোনা গেল।
"কেমন আছো তুমি "
"ভালো নেই,তুমি তো মুক্তি দিলে না"
এরপর আর মনে নেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম আমিও তবে শেষ মুহূর্তে বেশ কিছু প্রশ্ন করার পর। কাগজেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে স্পষ্ট তারই হাতের লেখা নাম,ঠিকানাসহ স্বীকার করেছিলেন বাবা নিজেই।
ঘন্টা তিনেক প্রেতলোকের অবসান ঘটিয়ে জ্বলে উঠল আলো। জ্ঞান ফিরল মিডিয়ার,ওরা চলে যাবার বেশ খানিকটা পরে জ্ঞান ফিরেছিল আমার। কিন্তু মাঝরাত্রে টয়লেট যাবার সময় অন্ধকারে খোলা জানালার বাইরের কলাগাছের পাশে মনে হল বাবা দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন, জ্বর এল কাঁপুনি দিয়ে সঙ্গে প্রবল ভয়। পরদিন সকালে বিছানায় নয় আমাকে পাওয়া গিয়েছিল বারান্দায় এক পাশে অচৈতন্য অবস্থায়,এবং প্রায় দিনেই এমন হতে থাকল মধ্য রাত্রে ঠিক ঐ টয়লেট যাবার সময়"।
"এন্ড দ্যসট দ্য পয়েন্ট মাই ফ্রেন্ড" পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে এলেন ডক্টর।
"ইসস্! এই ইম্পর্ট্যান্ট ইভেন্টটা আমার মনে পড়ল না, হাসপাতাল,ডাক্তার - ওষুধে, যমে সেকি টানাটানি।
যাক্ প্রেসকিপশন মোতাবেক একরাশ ওষুধ কিনে বাড়ি ফেরা হল বেলা তিনটেয় খিদে ফিদে মরে গেছে তখন। মাকে বললাম রুটি সবজি দিতে সঙ্গে চাটনি। টেবিলে বাবা বেশ সপ্রতিভ। দ্বি প্রাহরিক পঞ্চ ব্যাঞ্জনে সজ্জিত ভূরিভোজ না পেয়ে আহ্লাদে টেবিল বাজাতে লাগলেন। আহা! ক্ষুধা মানুষকে কত্ত মহান করে তোলে। এটা যেন বায়া তবলা অবশ্য একসময় বাজাতেন ভালো। যাক্ চিকিৎসায় কাজ হতে শুরু করেছে তাহলে। নিশ্চিন্ত হলাম।
পড়ার টেবিলে মন বসছিল না। ঘেটে গেছে পরিপাটি সময়টা আবার শুরু করতে হবে নতুন করে বাবার ওষুধগুলোয় টাইমটেবল লিখে আবারো ঝুঁকলাম পাশ্চাত্ত্যের পাঁচশো পচানব্বইয়ের দুয়ের তিন কলামে -
"ভোরবেলা ঝড়ঝড়ে মেজাজ দেখে বুঝলাম রাতে ওষুধের গুণে একঘুমে ভোর হয়েছিল বাবার, জানিস _"
আমার পাশে ততক্ষনে ওরা সকলে কেমন থম্ মেরে আছে।
************************************************************************************************
স্কুল ম্যাগাজিন থেকেই লেখালেখি শুরু। পরে বিবিধ পত্র পত্রিকায় ছোট গল্প,কবিতা এবং শুকতারায় লেখা প্রকাশিত হয়। পরে সাহিত্যের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। দুটি কবিতা সংকলন "ভালোবাসা ও কবিতা সংকলন" এবং তিনটি উপন্যাস সহ "একের ভেতর তিন " অনলাইন শপিজেন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় 2021 সালে। অনলাইনে লেখালেখিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বাংলা কবিতা আসরে 2000 কবিতা আছে। প্রতিলিপি সাইটে গল্প উপন্যাসসহ বহু লেখালেখি সংরক্ষিত রয়েছে। আর্থিক পরিস্থিতি উন্নত না হলে খরচ বহন করা সম্ভব নয়।




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন