শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

উপন্যাস * দীপংকর রায়



[ 'স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]


কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ৭   

দীপংকর রায়


সে অত্যন্ত সৌখিন মানুষ। জানি না এতদিন তার চোখে পড়েনি কেন এসব । ইদানিং কিছুদিন দেখছি নতুন গোরু লালি আসার পর থেকেই তাঁর নজরটা ঘুরে গেছে । কোথায় তাদের খাবারদাবার সস্তায় পাইকারি দামে পাওয়া যায় , খড়-বিচালীরই বা কোথায় দাম কম ; পন্ডিতের দোকান ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় কি কমে মেলে ------ সে সেইসবের খোঁজই জানায় এসে । বলে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে দেখতে ।

             খোঁজখবর নিই এখান সেখান থেকে। এবং খোঁজ পাওয়ার পরে শঙ্কর, ফোচন, ওদের সঙ্গে করে ঘুরে আসি , দাম-দস্তুর যাচাই করে।  

            সব সামলেও শরৎ রচনাবলীর প্রথম খণ্ড শেষ করে ফেলেছি। দ্বিতীয় খন্ডও এসে গেছে । অবসর মতো নয় , একেবারে নিয়ম করে , গোরু-বাছুর পরিচর্যা পর্ব সকালে মিটে গেলে কাজের দিদির সঙ্গে, একেবারে স্নান-টান করে নিয়ে দুপুর বেলায় খাওয়ার আগে পর্যন্ত যেন পাঠ্যবই-এর পড়াশোনা চলছে এরকম একটা ভাব নিয়ে শুরু হয়ে যায় পড়াশোনা । 

            বন্ধুবান্ধবেরাও এই সময়টায় আজকাল আর এদিকে ঘেঁষে না । আসে শুধু ফোচনের ঠাকুমা । সে আর কাজের দিদি বারান্দায় লুডুর কোট বসায় । তার ভাজা মশলা দিয়ে পান চিবানোর গন্ধ আসে । কেন জানি না তার কাছে শুনি , ও ঠাকুমা , এই মশলা তুমি কনে পাও ?

            সে বলে , ও বানায়ে নি রে ভাই , নানা ঝক্কি রইছে , নানা কসরৎ রইছে এতি , বছ্ছ কি না , অনেক সময় যায়, বুড়ায় তো বকবক করে মাথা খারাপ করে দেয় .... কি আর করি তাই কও ;  কোক গে  ,  ও দিদি , নেও দান চালো দেহি , এই ছক্কা ..... 

            কোথা দিয়ে সময় পার হয়ে যায়।

            আস্তে আস্তে কীভাবে কখন যেন পাকা গোয়ালা হয়ে উঠছি । ভগ্নিপতি ডেয়ারি ফার্মের স্বপ্ন মাথার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে । তারা শাখাপ্রশাখা মেলে ধরছে । দরমার দোকান খুঁজে পেতে অর্ডার দিয়ে দিলাম । 

             সে বললো , পিঠের বেড়ার কথা বলেছিস তো ? দেখিস বুখোর বেড়া যেন না দেয় ।


             মনে মনে ভাবি, কিছু বলি না তাকে । ভাবি , এসব পিঠ বুখো , এইসব এই মানুষটি চিনলো কী করে রে বাবা ! একেবারে কলকাতার হাড়-পাজরার ভেতরে জন্মে এই মানুষটি এসব কী করে জানতে পারে ! ভাবি , একদিন জিজ্ঞাসা করবো সে কথা । 

            একদিন ছুটির দিনে এসে সে দেখে গেল ফলস্ সিলিং লেগে গেছে । জিজ্ঞাসা করলো , মিস্ত্রি কতো কি নিলো রে ?

            বললাম , মোট সাতশো আশি । লেখা আছে খাতায় ।

             সে বললো , বাকি আছে কিছু ? এই নে চারশো । বাকিটা মাস পড়লে দিয়ে দিবি । আমি দিয়ে দেব পরের দিন এসে না হয় । আচ্ছা থাক গে , বাকি রেখে দরকার নেই ...... আচ্ছা শোন , ইটের দাম হাজার কতো নেয় এখানে শুনিস তো । কয়েক হাজার ইট কিনে গোরুর ঘরের সোলিংটা আর বাথরুমটা ঠিক করা যায় কিনা দেখা যাক । একেবারে পাকা একটা এস্টিমেট নিয়ে নিবি । বলবি মিস্ত্রিকেও, এর পরে একটাকাও বেশি লাগলে দিতে পারবো না কিন্তু ।

            ডাকপিয়োন এখানে আসার পরে আজই প্রথম আমাদের বাড়িতে এলো ছাই-সুড়কি বিছানো পথ পেড়িয়ে দুপুর বেলায় চিঠি পৌঁছিয়ে দিতে । খামের উপরে ঠিকানায় হাতের লেখা দেখেই বুঝতে পেরেছি , হ্যাঁ ---- এ তো সঞ্চয়েরই হাতের লেখা ! 

             দিদিমার চিঠি এসেছে সঞ্চয়ের হাতের লেখায় --- ওই লিখে দিয়েছে তাকে । দিদিমা লিখেছে দেখছি ---- স্নেহের মা অঞ্জলী , তোমার বড় ছেলে এখান থেকে যাওয়ার পরে আর কোনো যোগাযোগ তোমাদের সঙ্গে আমার হয়নি । শুধু মাত্র কাইলের মুখ দিয়ে যেটুকু জানতে পেরেছি তোমাদের কুশল । তারপরে তোমার ছোটো ছেলে তার সঙ্গে এসে উপস্থিত হলো । তাও তোমাদের তরফ থেকে কোনো খোঁজ খবর নেবার প্রয়োজন অনুভব করলে না তোমরা ! 

             এবার সে তো এলো ; কয়েকটা দিন ভালোই ছিল । কিন্তু এখন সে যা শুরু করেছে , তাতে আমার এখানে টেকা দায় । প্রতিমুহূর্তে তার আবদারের সীমা পরিসীমা নেই । এখন নতুন আর একটা উপসর্গ শুরু হয়েছে ----  যেটা নিয়ে আমার হাত-পা গুটিয়ে আসার উপক্রম , খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি । পাড়ার ছেলেপেলেদের সঙ্গে করে , সেদিন বাবুদের ভাঙা দালানে খোন্তা কোদাল নিয়ে গিয়ে গর্ত খোঁড়া আরম্ভ করে দিয়েছে । কে নাকি তাদের বুঝিয়েছে ওখানে গুপ্তধন আছে । 

           এসব কী আর বলবো বলো !

           যাই হোক , সেসব যা হচ্ছে হোক । এখন মা , তুমি এসে অতি সত্তর এই সব আতঙ্কের হাত থেকে আমায় রক্ষা করো । এই চিঠি পাওয়া মাত্র যত তাড়াতাড়ি পারো ওকে তুমি তোমার দেশে নিয়ে যাও। এখানের মানুষজন আমাকে দায়ী করছে ওর সঙ্গতে নাকি তাদের ছেলেপেলে খারাপ হয়ে যাচ্ছে ।

তারা বলছে ডেকে , ' ও পিসিমা, সে তো ছিল একরকম , তাই তার সঙ্গে আপনি চেঁচামেচি করতেন ।আর এ কি , এ যে একেবারে লাগামছাড়া ! ' নারান বললো এই সব কথা । এতে মুখ থাকে কোথায় একবার বলো আমায় ? 

     

           যদিও জানি তোমার একটু অসুবিধা হবে এতে ।এই রকমভাবে হঠাৎ করে রওনা  হতে । সেসব যেভাবেই হোক একটু সামলে-সুমলে নিয়ে অতি সত্তর এখানে চলে এসো । ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও।এরপরে কোথায় কি অঘটন বাধিয়ে বসে তখন আমি পড়বো একেবারে বেকায়দায় । শেষে আমার হাজত বাস না করতে হয় ।

            আশাকরি তোমারা সর্বাঙ্গিন কুশল । আশির্বাদ জানিয়ে আজ রাখছি । ইতি তোমার মা -----  

                                                                সুরাজ 

    

           বেশ কিছুক্ষণ চিঠিটি খুলে পড়ার পর চুপ করে বসেছিলাম । ভাবছিলাম, এ কাজ কি ওর একার মস্তিষ্কপ্রসুত ? এ ধরনের কাজকম্মে আর কার ইশারা থাকতে পারে ? টের পেলাম । বুঝতে পারলাম ওকে হুজুগে পেয়ে কাজে লাগিয়েছে, এগিয়ে দিয়েছে । এছাড়া ওর যা যোগাযোগ এ সবের খোঁজ খবর ও পাবে কী করে ? 

           কাজের দিদি বার কয়েক প্রশ্ন করে তারপরে উত্তর পেলো , এটা দিদিমার চিঠি যে । এবং তাকে খানিকটা খুলেই বললাম সব কিছু । এখন কী করা ? 

            সে বললো , মারে আসতি দেও । এখন তুমি এ নিয়ে ভাইবে কীই বা করবা ! 

             চিঠি আসার পর আমার মুখ চোখের ভাব যে পল্টে গেছে তা তো তার চোখেও ধরা পড়েছে । আর সেই কারণেই তার এত জিজ্ঞাসাবাদ --- কী হলো কি ভাই , আমারে এটটু খুলে কও দেখিনি ; আমারে কলি তুমি এটটু হালকা হতি পারবানে যে !

              এই ভাবে আমি খানিকটা , সে খানিকটা, এই করে ঘরের ভেতরের সিলিং, গোরুর ঘরের সোলিং ও বাথরূম এবং ঘরের মেঝের কাজটা শেষ হলো একরকমভাবে । বাকি থাকলো উত্তরের দিকের জানলার পাল্লাটা । সেটাও হলো অবশ্য একদিন একটা ঝড়ের মুখে পড়ে ।

              যাই হোক একটু আগেই বলছিলাম না , আমি এবং সে দুজনে মিলে , এই কথাটির এই আমি ---- গোরুর খাওয়া, গোয়ালার‌ মাহিনা , বাকি সব খরচ-খরচা বাদ দিয়ে লভ্যাংশ যে টুকুন থাকে , সেগুলির যাবতীয় হিসাব পত্রের দেখাশোনা রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব ইদানিং মা আমার হাতেই তুলে দিয়েছে ; আর তার থেকেই বেরিয়ে এলো ওই ( আমি ) কথাটা ।

             এদিকে এই ( আমি ) কথাটা বলার পর থেকেই ভাবতে শুরু করেছি তাহলে কি এই গো-পরিচর্যা করা দিয়েই আমার কর্মজীবন শুরু হয়ে গেল ? 

             ভেতরে ভেতরে সংসারের এই অনটনের শূন্যস্থানটি নিয়ে এই যে আমার উপলব্ধি --- হয়তো সেইখান দিয়েই পথ পেয়ে গেল এই গো-পরিচর্যার বিষয়টি ---- কিন্তু সব কিছুই চলছে যেভাবে ---- আমিও আবৃত হচ্ছি তার দুদিকের দুটি পথের টানেই একটু একটু করে । কাউকেই ছোটো করে সরিয়ে রাখতে পারি না । ওদিকে যে দিকটা তাকালে , কেন জানি না মনের ভেতরটা আবার পেছন দিকে চায় ফিরে । যে যে অনুসঙ্গগুলি সেদিকে ফেরায় বেশি করে , তার মধ্যে ওই ঝাউবন ছাড়াও আর একটি জায়গা রয়েছে, সে হলো আমাদের ঘরের পেছনের বাঁশ - জঙ্গলের মাঝখানে যে ডোবাটি রয়েছে । সেখানে সন্ধ্যা নেমে আসে ডাহুকের ডাকে। দুপুর বেলাগুলিরও স্তব্ধতা ভেঙে দেয় ওই ডাহুকগুলি । এ কোনা ও কোনা সে কোনা থেকে তারা যেন কেবলই মনে করাতে চায় আমার সেই ফেলে আসা সময়গুলি ।

              দুপুরবেলাগুলিতে বাঁশের ঝাড়ের মধ্যে দুপুরের আলো পড়ে দোল খায় দেখি । তখন কেন জানি ভেতরটা ভার হয়ে ওঠে । কিসের এই ভার হওয়া তা কি সবটা ধরতে পারি ! সন্ধ্যাবেলায় ডাহুকগুলি ডাকতে থাকলে , কেন জানি না মনটা ফিরে যায় সেই ওদেশের ইটখোলার ডোবাটার ভেতরেই । নিমেষে আমাকে নিয়ে চলে যায় এই দুপুরের রোদ হাওয়া ----- এই সন্ধ্যা লাগো লাগো ডোবার জল সেই ইটখোলার ডোবাটির কাছেই । আমি চাটুজ্জে মশাইয়ের বাগানের নিচের ডোবাটির ভেতর। সেখানকার বাঁশ জঙ্গলের ঝুপ্সি অন্ধকার আমাকে ডাকে যেন দুহাত দিয়ে । কী জানি কেন, কিসের মায়ায় আজও সেই পেছনের টান ---- আমাকে চুপ করে এনে দাঁড় করায় এই জানলার ধারে ; যেখানে আমার এই মনটা দুদিকেই ছুটে মরে অদ্ভুত এক মুগ্ধতায় ।

              কাজের দিদি সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালতে জ্বালতে বলে , ও দাদাভাই পেছন দিকের জানলাটা এবারে দিয়ে দেও‌ , তা না হলি বড় বড় মশায় ভরে যাবে ! বাগানের মশা তো ভালো না ভাই ।

              আজও তেমনই কিছু চিন্তা ভাবনা নিয়ে দুপুরের রোদের আলোয় সবে যখন এইসব নিয়ে ভাবনা চিন্তায় মগ্ন হয়ে ভাঙাগড়া করে সাজিয়ে নিচ্ছিলাম একাকী ঘুরে ঘুরে এদিক ওদিকটায়, ঠিক সে সময়ই দিদিমার চিঠি এলো । চিঠিটি পড়বার পরেই ভেতরটা কিরকম যেন ভার হয়ে উঠলো । দু'প্রান্তে ভাগ হয়ে গেলাম পুনরায় । ওদিকের জন্যে কত ভাবনা যেন এদিকের সব পরিকল্পনার উপরে অন্য আর একটা ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে গেল । আমি ভাগ হয়ে গেলাম নানা ভাবনায় ।

             দুপুর বেলাটায় অন্যান্য দিন হলে ও বাড়ির ফচনের ঠাকুমা এসে লুডুর কোট বসায় এই সময় । মাঝে মাঝে শিবানী, মলি, কাবেরি, ওরাও এক এক দিন অংশ নেয় এসে ---- আমাকে কখনো পিড়াপিড়ি করলে বাধ্য হই বসতে । আর তা যদি না বসি তাহলে গোরুগুলির পরিচর্যায় এদিক ওদিক করি আর ভাবি কিভাবে কি উপায়ে এই বাড়িটার চারপাশ আর একটু গুছিয়ে তুলতে পারি । কিন্তু অন্তরায় তো অর্থ ! ইতিমধ্যে এদিক ওদিক থেকে ছাই সুড়কি যা পেয়েছি তাই দিয়েই রাস্তাটা উঁচু করে দিয়েছি চলাচলের সুবিধার জন্যে । আর ফুলের বাগান তো কালো গোরুটি একরকম সাবাড় করেই দিয়েছে । তারপরও গাঁদা  ফুলের চারাগুলি আর রজনীগন্ধার গোড়া এনে পুঁতে দেওয়াতে কল বেরিয়েছে তাতে । গাঁদার চারাগুলি বেশ লকলকে হয়ে উঠেছে । ডালিয়ার চরাগুলি আর হবে না । নতুন করে আবার বসালেও সেগুলি বসানোর সময় পেরিয়ে গেছিল যে তা তাদের বেড়ে ওঠার ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে , ভালো হওয়ার নেই আর ।

              সামনের ডোবাটা বুজিয়ে দেওয়া হবে । একেবারে কলতলা ঘেঁষে ওদিকে ডোবার দিকটার সীমানা ঘেঁষে একেবারে লম্বা করে ঘর ওঠাতে হবে । যাতে গোরু-বাছুরগুলিকে বাড়ির ভিতরে না আসতে হয় , ওপাশ দিয়েই মাঠ রাস্তা পেয়ে ওদিক দিয়েই যাতায়াত করে । এইসবের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যাতে একটু বড় করে অনেকগুলি গোরু-বাছুর থাকতে পারে । আর তার সঙ্গে সঙ্গে সীমানার প্রাচিরটাও ।

              এসব পুজো মিটলেই শুরু হয়ে যাবে । তাই মনে মনে পুরো বিষয়টার নকশা তৈরিতেই মনোনিবেশ। যদিও এসবের আর্থিক জোগান আমার কাছে কোথায় ! সবই অশোকদার উৎসাহ । এ বাড়িতে তার আগমন ঘটলেই দুজনের মধ্যে চলতে থাকে নানা আলোচনা। তারও একটা বাড়তি কারণ আছে ,গত দুমাসের এক্ষেত্রের উপার্জনের হিসাব পেয়ে সে আরো নড়েচড়ে বসেছে । ফলাফল যখন ভালো তাহলে বিষয়টাকে আর একটু বানিজ্যিক ভাবে ভাবা যাবে না কেন ?


কেন জানি না, আমার ভেতরেও একটা বাড়তি উৎসাহ কেন তৈরি হয়ে উঠছে যে, সেটাই ভাবছি । ভাবছি এ কাজে যেটুকু সময় ব্যায় হয় ,  সেইটুকু করেও আমি আমার মূল লক্ষ্যে মনোনিবেশ করতে বিশেষ একটা অসুবিধা তো হচ্ছে না , তাহলে এটা করতে অসুবিধে কোথায় ?

              ছুটিছাটার দিনে ওয়ারলেসের বাসায় তাদের ওখানে গেলেও আমাদের দুজনের আলোচনার বিষয় তো ওই একটাই । তাছাড়া এটা যদি দাঁড়িয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যতে আরো অন্যভাবে বড় জায়গাটায়গা নিয়ে জায়গাজমি কিনে আরো অন্যরকমভাবে ভাবা হবে, কিছু করা যায় কি না ।

               তাঁর ঠোঁটে সিগারেট পুড়তে থাকে , আর আমার চোখে সেই পোড়া সিগারেটের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে নানা স্বপ্ন কল্পনা দানা বাঁধতে থাকে ।

আর আজ যা শুনলাম দিদিমার চিঠিতে , সেটা হলো চাটুজ্জে মশাই-এর ভিটের পাশে গলির শেষ মাথায় ঝোঁপ - জঙ্গলে ঘেরা যে ভাঙা দালানটি দাঁড়িয়ে আছে , সেখানে নাকি মাটির নিচে নেমে যাবার মতোন একটি সিঁড়ি আছে এবং ওখানে নাকি একসময় এক রাত্তিরে রক্ষাকালী পুজো হতো । পুজো শেষে বলির মোষ নিয়ে নবগঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসতো এ বাড়ির গৃহস্থেরা । একদিন নাকি কি কারণে পুজোয় কি একটা ত্রুটি হয় , এবং তারই কারণে তারা নাকি নির্বংশ হয়ে যায় ।

          সে গল্প শুনে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যাদের কাছ থেকে এই গল্প শুনেছিলাম , একেবারে এক রাত্তিরির মধ্যি সকলেই মরে গ্যালো, এ আবার হয় নাকি?

          তা শুনে পরিমল বলতো , হ্যাঁরে ----- কান পাতলি এহোনো নাকি শোনা যায় নিচির দিকের থে ঝাঁঝ-কাঁশোর-ঘন্টা আরো কত কিছুর আওয়াজ । 

         বিষ্ময় নিয়ে বলতাম  , তাই নাকি ! তাহলি একদিন তো কান পাইতে দেখলি পারি আমরা , কি কোস ?

            যদিও কোনোদিন কোনো আওয়াজ পাইনি । আশপাশ দিয়ে ঘুরেছি অনেক সময়ই একা একা ,কত সকাল দুপুরবেলায় , ভাবতে চেয়েছি , আচ্ছা , সত্যি সত্যিই কি মানুষ বসবাস করতো এখানে ? যদি পুজোপাঠই হতো তাহলে এখনো যেটুকু দালানের অবশিষ্ট আছে তার গায়ে তো পোড়ামাটির নানা ধরণের নৃত্যরত নর্তক নর্তকীদের ভাষ্কর্য , আর মাটির নিচে যে সিঁড়ির কথা ওরা সকলেই বলে , সেটা ঠিকই , সিঁড়ির কয়েকটি ধাপ দেখা যায় মাটির নিচে নেমে গেছে । এবং বাকিটা মাটিতে ঢেকে গেছে অব্যাবহারে হয়তো । তবে তা কত দূর নেমে গেছে , তা কেউই কোনোদিন দেখেনি ।

              এই সব গালগপ্পে তাকে যে আলোড়িত করতো , সে কথা জানতাম । কিন্তু এই রহস্যের ফাঁদে সে ভাইকে কিভাবে উৎসাহিত করে ফেললো ? আমি না হয় গল্পের রহস্যে মাতি  এবং তার জন্যেই হয়তো তার সঙ্গে ঘোরাঘুরিও করেছি , কিন্তু ভাই-এর তো তেমন এই সব নিয়ে খুব একটা উৎসাহ আছে বলে দেখিনি কখনো ; তাহলে সে কেন মাতলো তার কথায় ? সেটাই ভাবছি বসে বসে ।

              এমন কতদিন গেছে যখন মাছ ধরতে যেয়ে বাবুদের গর্তের ভেতর টিপেটিপে বৃষ্টির মধ্যে ওই দিকটায় চেয়ে থেকে দেখেছি , কী একটা ছমছমে ভাব লাগতো যেন ; মন্টু মামাকে জিজ্ঞাসা করেছি কখনো কখনো , যখন সে আমার সঙ্গে তাদের ছাতরানে আম গাছের শেকড়ের উপরে আমাকে নিয়ে বসেছে মাছ ধরতে , তখন কত কথাই না তার সঙ্গে আলোচনা করেছি এই ভাঙা দালানখানি নিয়ে ! কিন্তু তার মুখেও যা শুনেছি তাতেও কিছুই পরিষ্কার নয় , যার একটু এদিক ওদিক করে আগের শোনা কথারই মতোন তার মুখের কথাতেও একই রকম সব --- সেও যেন একই গল্প একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে যেত । 

             এ ছাড়া এর আগে এই জঙ্গলের পাশেই যখন সকাল বেলার প্রাতঃকৃত্য সারবার জায়গা ছিলো প্রায় মানুষের এখানের , তখন তো কত কথাই ভাবতাম ! কত সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছি । কত ভাবেই না কত কিছু ভাবতে ভাবতে কত কল্পলোকে ভেসে গেছি  আপন মনে একাকী ; কিন্তু তাতো শুধুই ভাঙা দালান নিয়েই নয় , তাকে ছাড়িয়ে তপ্ত গ্রীষ্মের রোদ পড়ে যে কচি বেতের ডগাগুলি হাওয়া বাতাসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে স্তম্ভিত করে রাখতো , তাদের সেই সব মায়াজাল ভেঙে আমিও কি বেরিয়ে আসতে পারতাম খুব সহজে ? সেই সব নিস্তব্ধতার স্বরূপে যে জড়িয়েছে , সে আহ্লাদিত হয়েছে যেমন, তেমন ভয়ও পেয়েছে যে এ কথাও তো কম বড় সত্য নয় ! একমাত্র সেই জানে তাঁর কত কথা থাকে চারপাশ জুড়ে দশ হাত মেলিয়ে দিয়ে...

            এক্ষেত্রে ভাই-এর কথা তো তা না , সে তো এসব কিছুই গিয়েই ভাবতে পারেনি বা ভাবার মতোন কোনো ভাবও তার থাকার কথা না । তাহলে সে কেন এ সবে জড়িয়ে গেল ? এইসব রহস্যের ছলনায় যে একবার ধরা খেয়েছে তার যে কোথাও নিস্তার নেই ।

          আচ্ছা ছলনা বলছি কেন ?

         ছলনা বলার কারণ তো আর কিছু না , সত্যিই তো ছলনাই ! তাঁর প্রকৃত সত্য কি সকলের চোখে প্রকৃত সত্যই ------  যার টানে সবাই বাঁধা পড়বে ? আমি না হয় এই ঘোরে পড়েছিলাম , তাই বলে কি মন্টু মামার চোখে এই ঘোরের কোনো অস্তিত্ব আছে নাকি ? সে তো মাঠকে মাঠই দেখে , নদী না কখনোও ; বেত বনকে  বেত বনই দেখে । আমি না হয় সেই গ্রীষ্মের রাত-ভোর ভাঙা চাঁদের আলোয় ঘুরে ঘুরে আম কুড়োতে বেরিয়েও পরে মামার সঙ্গে কত কিছুই না উপলব্ধি করেছি ----  কিন্তু তাও তো আমার একার । তাদের তো কিছুই না !

তারা তো আমাকে , রাত ভোরের চাঁদকে , একই রকম ভাবে তাদের অভ্যাসের সঙ্গে আলোআঁধারিতে দেখেছে , কিন্তু আমি যে দেখেছি কত ভাবেই না তার উপস্থিতি , অদ্ভুৎ এক স্বপ্নঘোরে ; সে তো ঘাস কাটতে গিয়ে পাটের বনের ভেতর থেকে উঁকি মেরেও দেখেছি তাঁকে ; দেখেছি কুয়াশা আবৃত হয়ে সে আমাকে শীতের সন্ধ্যাবেলাগুলিতেও কীভাবে ঘরে ফিরে যাবার জন্যে তাড়িয়ে দিত মাঠ থেকে । যেভাবে আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে কেউ কাউকে ইঙ্গিতে নির্দেশ দেয় ! 

          তাই , সে সব সব ই আমার । 

          এ সবের ঘোরে এই অল্প কদিনের মধ্যে সে পড়বে কীভাবে ?

           কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না সেটাই আমি , নানা রকমভাবে এলোমেলো ভাসতে থাকলাম এই দুপুর বেলার বারান্দার কোণটিতে বসে বসে । বারবার মনে পড়ছিল ফেলে আসা সেই সব দিনগুলির কথা । কত সন্ধ্যা কত দুপুর কত রাত , কত দিন জমিতে মই দেওয়া সকাল বেলাগুলির কথা মনে পড়ছিল । যাকে এরা বলে ভূঁইতে চোঙো দেওয়া । সেই মই-এর উপরে চড়ে দুটি গোরুর লাগাম-এর দড়ি হাতের মুঠোর ভেতরে নিয়ে এই হ্যাট্ ......হ্যাট্ .....সেই..... হেই...... হেই.... ঢি ..রি..... ঢি... রি ..... ঢি ......রি.... চল দেহি ইবার , হেই ..... হে-- ই ..... হে - ই ...... 

            সেই সব চোঙো ( মই ) দেবার দিনগুলির কথা : বিশেষ করে চাষি ঘরের মধ্যেই এই সব শব্দের ব্যবহার । চোঙো দেবার অর্থ হলো মাটিকে লাঙল দেওয়ার পর ভালো করে গুঁড়িয়ে সমতল করে দেওয়া। চোঙো দিয়ে মাটি সমান করার পরে প্রোয়জন বুঝে আবার চোঙো দেওয়া হয়। বীজ ছড়ানোর আগে বা পরে।

             তাহলে কি এই ক'দিনের মধ্যে আমার ভাইটিও পল্লী জীবনের এই সব প্রতিদিনকার অভ্যাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেল ?

           তা যদি হয় তাহলে তো সেসব আরো বেশি চিন্তার বিষয় , তখন কি আর এখানকার সেই সাহেবী স্কুলে পড়ার পর মিশনারী স্কুলে ফিটফাট হয়ে যাবার অভ্যাসের ভেতরে ফিরতে পারবে সহজে ?

     ভাবছি , আচ্ছা আমার এই সব সংশয়ের কথাগুলো আমি কিভাবে এদের সকলকেই বা বুঝিয়ে বলতে পারবো ? কেউ কি বুঝবে আমার কথা ! না সমর্থন করবে, বুঝিয়ে বলতে পারলেও ঠিকঠাক !

           হয়তো ঠাকুমা বুঝতে পারে কিছুটা । মা তাঁর কথা ফেলতে পারবে না । তাহলে তাঁকেই চেষ্টা করে আসি আগে , তারপরে না হয়, সেই মাকে একটা সিদ্ধান্ত দিক , এখুনি ওদেশে গিয়ে ভাইকে নিয়ে আসার বিষয়ে।

           মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে পৌছোনো গেছে । সব কিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে দুই এক দিনের মধ্যেই মা ওদেশে রওনা দেবে । পাসপোর্ট অবশ্য আমার এবং মায়ের দুজনের এক সঙ্গেই তৈরি হলো । ভিসা মা একাই করে আনবে । কারণ এবারে দু 'জন একসঙ্গে যাওয়া সম্ভব না ।  মা ঘুরে এলে আমাকে পাঠাবে কারো সঙ্গে । এখন কাজের দিদি আর আমি বাড়িতে থাকবো। 

           কথা মতো  মা ক'দিনের মধ্যেই রওনা হয়ে গেল।কথা হলো বনগাঁ লোকাল ধরবে শিয়ালদাহ থেকে । এরপর ওখানে পৌঁছে যে ব্যাবস্থা আছে তার উপরে নির্ভর । হরিদাসপুর পেরিয়ে বেনাপোল পৌছোনো তো যাক আগে ।

      এখানে নির্বাচনের নতুন হৈ চৈ পড়েছে , শোনা যাচ্ছে এবারে নাকি ফ্রন্টই জিতবে । সকলেই ফ্রন্ট ফ্রন্ট করছে ,আমার সেটা বুঝতে বেশ সময় লাগলো । ফ্রন্ট আবার কী ! পরে অনেক কষ্টে বোঝা গেল বাম ফ্রন্ট । সমাজতন্ত্রীয়দের জোট ।

           শরৎ রচনাবলীর দ্বিতীয় খন্ড এসে গেছে । ব্রজদা বলে সেই ব্যাক্তিটি মাকে বই এনে দিয়ে জানালো , তার ওদেশে যাবার আগে আরো একখন্ড দিয়ে দেবে । মা তাঁকে বলেছে , সে কি ব্রজদা , আমি আপনাকে মাসে মাসে একটু একটু করে টাকা দিই ,তাতে আগের টাকা আগে পরিশোধ তো হবে , তা না , তার আগেই  আবার ধার বাড়লে ,  আমার তো একটা মানসিক চাপ বাড়ে বলুন ?

            তাতে সে বলেছে , ঠিক আছে , ছেলে 

বই পড়ছে যখন, তখন আমি তাকে বই দেবো না , সেটা কি কথা ! টাকা পয়সা নিয়ে আপনার এত চিন্তা কীসের ? সে আপনি যে মাসে যেমন পারবেন তেমনই দেবেন । হ্যাঁ, ওর কাছে জিজ্ঞেস করবেন আর কি লাগবে , অন্য আর কোনো কিছু লাগবে কিনা ? যদি অন্য কোনো কিছু লাগে তো আমাকে জানায় যেন সেটা।

             এ কথা শুনে আমি আনন্দ পাইনি যে তা না , খুবই বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি খানিকটা যেন ;  মনে মনে একটা কথাই ভাবছি , আচ্ছা এই মানুষটি থাকেন কোথায় ? সে কি উত্তরের দিকেই থাকে নাকি ? না , বিরাটি উল্টোডাঙা ব্যারাকপুর , নাকি অন্য কোনো স্টেশন সংলগ্ন কোথাও তাঁর বাড়ি ! 

            এভাবে কেন ভাবছি ? তার সঠিক কোনো উত্তর জানা নেই । ভাবছি । কিন্তু কেন তা জানি না । সামনাসামনি যেদিন তাঁকে পাবো সেদিন এই কথাটা জিজ্ঞাসা করবো আগেই । কিন্তু কেন ? ব্রজদার আমাকে বই এনে দেবার সঙ্গে তাঁর অবস্থানগত পরিচয়ের কী যে সূত্র তা কোনোদিনও আমার কাছে ধরা দেয় নি ।

           কিন্তু আমার ভেতরে যে এবারে আরো অন্য এক অভাবের বাজনা বাজছে , তার কি হবে ? 

           পুজো শেষ হয়ে গেল । সাহা বাড়িতে বেশ ধুমধাম করে পুজো হতে দেখলাম । শিবানী মলি অলোক ওরা পুজোয় প্রতিদিন একটি করে নতুন পোশাক পরেছে দেখেছি। শঙ্কর ফোচনও দুই সেট করে । পাড়ার অন্যান্য ছেলে মেয়েরাও একই রকম প্রায় । নতুন টেরিকটের জামা প্যান্ট বেলবটম কাটিং  এবারে , সকলেই একই ডিজাইন । জামার কলারটা কুকুরের জিভের মতোন লম্বা যেন । প্যান্টের ঘের কিছুটা যেন সায়ার মতোন । পরে হাঁটতে গেলে দুপাশে লতপত করে বাড়ি খাচ্ছে । সকলেই প্রায় সেটাই বানিয়ে নিয়ে তাতে সেন্ট লাগিয়ে হই হই করে পুজোর আনন্দ নিচ্ছে দেখতে পেলাম । 

            আমিও একসেট পেয়েছি । তাও দিদি আর মায়ের যৌথ প্রচেষ্টায়। তবে তা নিয়ে আমার অবশ্য বিশেষ কোনো হেলদোল নেই । আর বেলবটমের ধারেকাছেও যাই নি । কেন আমার একসেট, এ নিয়ে ভেতরে কোনো বিষণ্ণতাও জাগেনি ।

           রাত একটু বাড়লে সে সবের বালাই থাকে না আর । এদিকটার সব হইচইই মিইয়ে যায় যেন । পথ পড়ে থাকে তখন পথের মতন । পরনে তার যতোই সাজগোজের বাহার থাকুক না কেন , সে যেন ঘোরনো-ঘারানোর পরের অবস্থার নতুন বউ-এর সাজপোশাকের মতো ; 

          হইচই থাকে দেখেছি, একদিন শঙ্কর ফোচন ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ভবানীপুর পর্যন্ত গিয়ে বুঝতে পেরেছি । সে যেন আমার হাঁসফাঁস অবস্থা। মাঝপথেই তাই পালিয়েছি একটা ডবলডেকার ছনম্বর বাস পেয়েই ।

          এর পরে আরো একদিন ওদের সঙ্গে পঞ্চম না দশম দূর্গা পূজা দেখতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটাই । সে পুজো না দেখলে নাকি বন্ধুবান্ধব মহলে মান থাকে না । কিন্তু মানুষের হইহট্টগোল গাদাগাদি ঠাসাঠাসি ঘাম পারফিউমে মিলেমিশে সে যে গা গুলোনো একটা ব্যাপার তা আমার যৌবনের প্রথম ঢেউলাগানো মনে কোথাও কোনো আশক্তির জন্ম দিল না । কতক্ষণে ঘরে ফিরবো সেটার টানেই উসখুস করতে লাগলাম।

           কোনোদিনই এসবের কোনো প্রভাব পড়েনি। কেবলই মনে হয়েছে , মন বলেওছে শুনেছি যেন, ওই যে বাড়ির এক কোণে মোড়াটি পেতে বসে থাকা চুপ করে , না হলে নতুন বই-এর ভেতরে মনোনিবেশ করে বুঁদ হয়ে থাকা সেই যেন বড় প্রশান্তির জিনিস। এইসব হইহই হট্টগোল লাইট মাইক সাজগোজ এসবের মধ্যে গিয়ে পড়লে কীসের যেন এক মনখারাপের বার্তাই বহন করে সব কিছু মিলিয়ে।

          তাও যাই , যাই না যে তা না । এই তো এখন যেমন গেলাম । কিন্তু কেন যেন মনে হয় উৎসবের আনন্দ উপভোগ করবার মতোন মন আমার নেই । তবে ছিল না যে তাও না, ছিলো , তবে সে আনন্দ যেন কেউ নিয়ে চলে গেছে সবটা । আমি কোথাও যেন তাকে হারিয়ে ফেলেছি । অথচ বাস্তবে তা তো না । তবু কেন যে আমার অবচেতনে তার অভাবই আমাকে কখনোই অধিক আনন্দে মাততে দেয় না । কেবলই যেন কিসের এক শূন্যতা তৈরি করে । আমি তাকে নির্জনে খুঁজে পাবো বলেই আড়ালে ঢুকে পড়ি একান্তে ! 

          যদিও তার কোনো অস্তিত্বই এ পর্যন্ত কোনোদিনই ধরা দিল না । অথচ তাকেই খুঁজে চলেছি যেন সকল মুহূর্তে ---- ।

          যেটা হয়েছে সেটা হলো এত আলোর ঝলকানি , সমস্ত রাস্তাঘাট একেবারে টুনি লাইট দিয়ে মালার মতোন জালি বুনে দেওয়া যেন , হাঁটতে গেলে মনে হয় পথকে যেন বেঁধেছেঁদে গাছ ও  লাইটপোষ্টের সঙ্গে টাইট করে রাখা হয়েছে । 

           অলোকদের বাড়ির সামনেও বড় বড় সার্চলাইট লাগানো। ওদের প্রবেশ পথটির বর্ণ পাল্টে গেছে । তার ওপাশে বারোয়ারি পুজো মন্ডবেও একই অবস্থা। মাইক লাইট আলোর ঝলকানিতে কান একেবারে ঝালাপালা।

            এইসব পরিস্থিতি বেশিই ঘটে দেখেছি এমন সব উৎসবের দিনেই। তাছাড়া হয়তো উৎসব নয় শুধুই , সে তো ওদেশে থাকতেও একই অবস্থা দেখেছি। যাত্রা গান শুনতে গিয়েও একই অবস্থা ঘটেছে। কালীপুজোর ভাসানের নৌকোয় উঠেও, বিসর্জনের নৌকোয় চড়ে যখন শত্রুজিৎপুরের মেলায় যেতাম ; জোড়োনের নৌকোর মাথায় পাটাতনের উপর চুপচাপ বসে থাকতাম । জোড়নের নৌকোয় মেলায় যেতে যেতে ঘাটে ঘাটে নৌকো লাগানো হতো মহিলাদের সিঁদুর দান, ধান দুর্বা মিষ্টি দেবার জন্যে প্রতিমাকে যখন --- সেই সব পর্বের ভেতরেই আমার মনের ভেতরটা কেবলই যেন ভার হয়ে উঠতো । এই যে ভার হওয়া শুরু হতো , সেটাকেই বহন করতাম সারাক্ষণ । তারপর নৌকা মেলায় পৌঁছলে সকলে হই হই করে নেমে যেত নিচে , আমি নৌকোতেই বসে থাকতাম চুপচাপ ।

           ওদেশে গিয়ে প্রথম যেবার পুজোর জামা-কাপড় কিনতে নারান মামার সঙ্গে দিদিমা আমাকে মাগুরায় পাঠাল, কথা ছিল বাড়ির থেকে সাইকেলে চড়ে শত্রুজিৎপুর যাবো, তারপর শত্রুজিৎপুরে সাইকেল রেখে নারান মামা আমাকে বাসে করে মাগুরায় নিয়ে যাবে । অথচ অন্য সকলের কী যে আনন্দ, তারা 

হই হই করে মেলায় চলে গিয়ে পাঁপড় ভাজা , বাদাম , মিষ্টি , কটকটি খেলনা কিনে নিয়ে এসে নৌকোয় সকলের সঙ্গে হই হই করে আনন্দ করতো । এসব সবই আমি চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখতাম , তাদের সঙ্গে সঙ্গ দিতে পারতাম না । পোড়া মাটির তৈরি সেই কটকটি খেলনা আমার কানের সামনেই বাজাতো এরা সকলে । পোড়া মাটির সেই বাটির মতো দেখতে ; বাটি উল্টোলে যেমনটা হয় তার পেছনটা ঠিক সেরকম । তার সঙ্গে দুটি কাঠি লাগানো থাকতো ,ঠিক যেন ঢাকের কাঠির মতো ; সেই বাটির মতো বস্তুটির গোড়ার দিকটায় চাপ দিলে টং টং করে বাজতে থাকতো । ওদিকে কাঠিতে লাগানো পটকাবাজীর আওয়াজ, এদিকে এই খেলনা ঢাকের বাদ্দি , মানুষ জনের হইহল্লা , বড়দের ঢাকের বাজনা , মাইকের আওয়াজ, নানা ঘোষনা ,ধুপধুনোর ধোঁয়া ---- সবে মিলে আমার জন্যে সে যে কি দুঃসহ যন্ত্রনা যেন ; মনে হতো কতক্ষণে এখান থেকে রেহাই পাবো ! অথচ আমার একার ইচ্ছা অনিচ্ছার সঙ্গে তো এই জগৎ সংসারের কিছুই চলে না ! এদের সকলের এই যে সমস্ত বছরের একটি দুটি দিনের অপেক্ষা , তা কি তারা ছেড়ে দিয়ে আমার ভালোলাগা মন্দলাগার উপর নির্ভর করে বন্ধ করে দেবে সবটা ?

            এই যে এই দিনটার জন্যে কি আমার ভেতরে কোনো অপেক্ষা থাকতো না ! অবশ্যই থাকতো । তবুও এই দুরত্ব তৈরি হয়ে যেত । কেন , সে কথার কোনো অর্থ ধরা দিত না । বুঝতে চাইতাম কি ? হয়তো চাইতাম , হয়তো চাইতাম না কিছুই। মনের যেটাতে ভালোলাগা তাতেই ভালো মন্দের সায় দিতে বাধ্য হতাম তখন। মনে হতো যেন এই আনন্দের , হুল্লোড়ের পেছনেই আছে হয়তো বড় কোনো ভালো না লাগা ; যা হয়তো এখুনি ঘটতে পারে !

          এই সংশয়-দীর্ণ মন কেন জানি না বরাবরই আমাকে সকল উল্লাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে চিরকাল। কোনোদিন তার কোনো আনন্দ-হুল্লোড়ের অংশিদার হতে দিল না কেন যে , তা জানতে পারলাম না আজও ।

           বাড়ি থেকে যাওয়াটা হলো, কিন্তু গোল বাঁধলো শত্রুজিৎপুর পৌঁছে । নারান মামা শত্রুজিৎপুর পৌঁছে এক কলুবাড়িতে ঘাইন ঘরে আমাকে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল কোথাও একটা কাজে । সাইকেল খানি থাকলো ঘাইন ঘরের দেয়ালে হেলান দেওয়া । নারান মামা বললো , বস এখানে , আমি একটু কাজ সেরে আসছি এখুনি ।

            আমার কেন জানি মনে হলো, আচ্ছা , সব সময় নারান মামা মন্টু মামারা আমাকে সাইকেলে চাপিয়ে ঘোরায়, এখন তো খানিকটা সময় পাওয়া গেছে , দেখি না কেন, পারি কি না আমি একবার , তাহলে তো একা একাই এদিকে ওদিকে যেতে পারবো ।

           সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে সাইকেলের ভার সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল তা পায়ের উপর । পা কাটল । রক্তারক্তি একেবারে । নারান মামা ফিরে এসে বললো, কী কাণ্ড ঘটালি তাই ক তো , এহোনে আমি কি করি ? পিসিমা তো আমারে খাবরোয়ে রাখপেনানে !

           সেদিন হাটবার ছিলো । সুনীল ডাক্তারের চেম্বারে দেখিয়ে ওষুধ পত্র ইনজেকশন দেওয়া হলো । সুনীল বাবু বললেন , ও কিছু না , নতুন নতুন সাইকেল চড়া শিখতি গেলি অমন একটু হয় ; আমারও হইছিলো । দুই একদিন একটু ব্যাথা থাকপেনে তারপর ঠিক হয়ে যাবেনে সব ।

            যদিও বাস্তবে সেটা হলো না । পা ফুলে গেল । পেকে গেল কাটা জায়গাটা । পুজো দেখার আনন্দ মাটি হলো । ভাসান দেখতে যাবো বলে টাবুরে নৌকো ভাড়া করা হলো । জোর-জবরদস্তিতে অগত্যা নৌকোর ছোই-এর ভেতর শুয়ে শুয়ে চললাম রসিকদাদু, দিদিমা ও ওদের বাড়ির অন্যান্য সকলের সঙ্গে বিসর্জনের মেলা দেখতে । গায়ে জ্বর যদিও যাচ্ছে না । ব্যাথার তো কোনো বর্ণনা হয় না ! সে যে কি অসহনীয় অবস্থা , পায়ের সেই দাগটার দিকে তাকালে সে কথা মনে পড়ে আজও । সাইকেল চড়া এ জীবনে আর হলো না !

*********************************************************************************

আগামী পর্বে    



***********************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন