আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়ায় রঞ্জিত কাব্যানুসন্ধান
পার্থসারথি মহাপাত্র
আগের বছর নভেম্বর মাসে প্রকাশিত তপনের ''পারাপার এপার ওপার'' কাব্যগ্রন্থটি ৬৯টি কবিতার সংকলন । আলাদা করে কবিতাগুলির নাম নেই, শিরোনামের জায়গায় সংখ্যা বসিয়ে লেখা । এই গ্রন্থে কবির জীবন উপলব্ধি গতানুগতিকতা থেকে এক অনন্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে । জীবন উপলব্ধিতে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া লেগেছে । উপলব্ধির এই স্তরে পৌঁছে যাওয়ার নেপথ্যে কি জীবনযন্ত্রণা ? সেই জীবন যন্ত্রণা কি কবির ব্যক্তিগত নাকি সমকালের অধিকাংশ মানুষেরই জীবন যন্ত্রণা? এরকম কয়েকটি প্রশ্ন মনের মধ্যে দানা বাঁধে , প্রত্যেক পাঠকের মনে দানা বাঁধবেই । কারণ হিসেবে কবিতায় ব্যবহৃত কয়েকটি চরণ উদ্ধার করি । তিনি লিখছেন,
"সাপের মুখে ব্যাঙের মতোই
মানব জীবন
গিললেও মরণ
উগরে দিলেও...."
আবার বলেছেন ''ভাজা লুচির মতো জীবন আমার''। তাঁর কাছে ''জীবন একটি দ্বিতীয় অংকের নাটক''। তবুও কী অপরূপ উপমায় জীবনে অমলিন থাকার উপায় বলেছেন,
''শতদল জন্মসূত্রে পঙ্কজ হলেও
কর্মসূত্রে পদ্ম
কারণ তার মুখ ঊর্ধ্বমুখী
তার পাতায়
মলিন জল দাঁড়াতে পারে না ।"
কিন্তু জীবনযন্ত্রণার মাঝে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখী হওয়া তো সহজ কথা নয় । উর্ধ্বমুখী হতে গেলে নিজের মনটিকে বাঁধতে হয় আগে । পাগলা বিস্রস্ত মনকে না বাঁধতে পারলে ঊর্ধলোকের সোপান বেয়ে উচ্চে ওঠা যায় না। তিনি বলছেন --
'' ঊর্ধ্বমুখী হতে গেলে আহার দরকার''
আবার আহার নিয়ে বলছেন --
"আহারে নিরামিষ আমিষ নেই
সবকিছু জমে আছে আহার গ্রহণে
শঙ্খচূড়ার মতো শুভ্র স্তনে
জেগে থাকে সন্তানের প্রাণ ,
আর কামুকের কামও।"
প্রকৃত জীবন পথে এগিয়ে যেতে হলে সেই পথের উপযুক্ত করে মনকে তৈরি করার পর ক্ষণকালের পার্থিব সমস্ত আনন্দ উল্লাসকে পিছনে ফেলে ধীর পদক্ষেপে অথচ অবিচল গতিতে সেই পরম লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে হয়। এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এইভাবে,--
"এইসব ক্ষণকালের উন্মাদনা আনন্দ-উল্লাস
মুহূর্তে ধুয়ে মুছে যায়......
এইসব আনন্দ অনিত্য
নিয়ত ভঙ্গুর
নিত্যানন্দ পেতে হলে
ধীরে ধীরে অবিচল
এগোতে হবে
ভূমানন্দের অন্বেষণে" ।
আসলে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন কোন এক ঐশ্বরিক শক্তি বা প্রকৃতি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে,
"হয়তো নিরানব্বই বছরের লিজে দিয়ে
সে অলক্ষ্যেই নজর রেখেছে''
আবার বলছেন,
''সুখের উৎস তুমি
এবং
দুঃখেরও ।"
আমরা এরকম কোন শক্তির সান্নিধ্যে এলে কিছু পাওয়ার মানৎ করি কিন্তু সেই শক্তির কাছে এই কবি নিবেদন করছেন,
" তুমি কিছু দিও না
দিও না
আমার ভার বহনের শক্তি নেই
বরং আমার সমস্ত ভার-ই
তোমার দু'টি পদ্মের নিচে
জমা করে রেখো ।"
---আমার মনে হয় কবি সেই অদৃশ্য শক্তির কাছে জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছেন । তিনি লিখেছেন,
" আমাকে গ্রহণ করো
আমি তোমার মাঝে হারিয়ে যেতে চাই,
তোমার অমন উদার বুকে
বুক রেখে আমি লীন হতে চাই ।"
আসলে তিনি হয়তো দেখেছেন বৃত্তের পর বৃত্ত আঁকতে আঁকতে ''ব্যাসার্ধ বেড়েই চলেছে'', আবার দেখছেন --
''সকালবেলায় শূন্য থেকে শুরু হয়েছিল
সন্ধ্যাতেও ...শূন্য''।
যে যতই ধন, সম্পদ, ঐশ্বর্যের বড়াই করি না কেন শেষে সব শূন্য । তাই তিনি চেয়েছেন,
''সকল অহং ভেসে যাক
হড়পা বানের তোড়ে ।"
অবশেষে লিখছেন, "আমি নাম শুনছি
আমি তো জপ জানি না
নাম বুঝি না
যুবতি জবালা হয়ে উঠছে টগর বোষ্টমি
গুরুদেব নাকি বলেছেন
নাম শুনতে শুনতে কাম পদপিষ্ট হয় । "
কবির তাই উপলব্ধি হয়েছে,
''তুমি আমার অগতির গতি
তুমি বিনে এপার ওপার নেই
পারাপার নেই''।
----তপন পাত্র সম্বন্ধে সর্বোপরি একটা কথা বলতে পারি, তাঁর মনে সৃষ্ট অনুভূতি যখন মননের অক্ষর দ্বারা ছন্দোবদ্ধ হয়ে লিপিমালায় প্রকাশিত হয় তখন সাধারণ একটা বিষয়ও অসাধারণ কবিতা হয়ে ওঠে।
আমার তো মনে হয় নিত্যনৈমিত্তিক ঈশ্বর সাধনা ছাড়া কোন ব্যক্তির পক্ষে এই উপলব্ধিতে পৌঁছানো সম্ভব নয় যে উপলব্ধির কথা তিনি আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের ৩৮ সংখ্যক কবিতায় লিখলেন --
"প্রতিমাতে তিনি আছেন
প্রতি মা -তে তিনি আছেন
প্রতিমাতে তিনি নেই
প্রতি মা-তেও তিনি নেই
তিনি আছেন
তৃতীয় নয়নে
অজ্ঞানতার অবসানে
জ্ঞানের আলোকে ।"
এই জ্ঞানাণ্বেষণই ভারতীয় দর্শনের মূল কথা । তবে কি কবি ধীরে ধীরে সাধন পথে এগিয়ে চলেছেন ? তাঁর মানব প্রেম , উদার চিত্তে ছোট বড় জ্ঞানী অজ্ঞানি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে ঈশ্বর প্রেমের রূপান্তরিত হোক । কবিতা রচনার এই ধারাটি সহ তাঁর নানা ধরনের কবিতার অপেক্ষায় রইলাম।
"পারাপার এপার ওপার " তপন পাত্র
প্রকাশক--- মানভূম সংবাদ পাবলিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড
পুরুলিয়া, মূল্য- ১০০টাকা
************************************************************************************************
**************************************************************************************************




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন