রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

লেখা আহ্বান

 




স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর

স্বরবর্ণ * ২৩


##########################################

পঞ্চম বর্ষ * প্রথম সংখ্যা আগামী বৈশাখে আত্মপ্রকাশ করবে। এই সংখ্যার জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ২০ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত। কী ধরণের লেখা, লেখা পাঠানোর ঠিকানা এবং অন্যান্য জরুরি তথ্য উপরের লিংকে পাওয়া যাবে । মনোনয়ন সাপেক্ষে নির্বাচিত লেখক তালিকা ২০ তারিখের পর সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। 

##########################################


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন -----

১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ২০ মার্চ, ০২৫-এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮.  লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা





প্রিয় কবি প্রিয় কবিতা * নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

 




উলঙ্গ রাজা

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।

গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।

নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।

শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?


**************************************************************************************************************

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল




[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * আট

বিশ্বনাথ পাল

 বারো 

আশীষদা বলল, “ওপি খান্নার  জিকে বই মিসসেলেনিয়াস ও ক্লার্কশিপের জন্য খুব কার্যকরী। ইংরেজিতে লেখা, দিল্লির কোনও পাবলিকেশনের বই।”

বললাম, “কলেজস্ট্রিটে পাওয়া যাবে?” 

“মনে হয় পাওয়া যাবে। একবার চ্যাটার্জীতে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো।”

বেহালায় অরিন্দমদার বাড়িতে এসেছি। আমি, পারমিতাদি এবং অরিন্দমদার বন্ধু আশীষদা। কোনও উপলক্ষ্য ছাড়াই অরিন্দমদা আমাদের ডেকেছে। বিকেল চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা এসেছি। এদের মধ্যে আশীষদার সঙ্গে আমার আজই আলাপ হয়েছে। এর আগে আশীষদার সম্পর্কে শুনেছি পারমিতাদির কাছে। বলেছে, “আমাদের ইউনিভার্সিটির বন্ধু আশীষ রাইটার্সে চাকরি পেয়েছে পিএসসি দিয়ে।”

শুনে আশীষদাকে একটু দেখার ইচ্ছা হয়েছিল। সেই সাধ আজ পূর্ণ হল। যারা সরকারি চাকরি পায়, তারা দেখবারই বটে। তাদের থেকে নেওয়া টিপস কাজে লাগতে পারে।

আশীষদা আরও বলল, “ওপি খান্না পড়লে প্রিলির অন্তত এইটটি পার্সেন্ট কমন পাওয়া যায়। ট্রাডিশনাল জিকের ক্ষেত্রে অবশ্য।” 

আমি বললাম, “আমার টাটা ম্যাগ্রোহিলের বইটা আছে।”

“ওটা তো বিশাল মোটা বই, কভার করা খুব টাফ। বিসিএসের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু ক্লার্কশিক, মিসসেলেনিয়াসের জন্য ওপি খান্না ইস দ্য বেস্ট অ্যাস পার মাই ওপিনিওন।” 

কথাপ্রসঙ্গে আশীষদা আরও বলল, “তোমার কথা আমি বলতে পারব না, কারণ তোমার সঙ্গে তো আজই আলাপ, কিন্তু অরিন্দমের যা বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, ও যদি আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করে— তবে ও সরকারি চাকরি পাবে।”

শুনে ভালই লাগল। যাক, সরকারি চাকরি পেতে তার মানে অরণ্যদেব হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার কথায় আশীষদার খারাপ লাগতে পারে না ভেবেই এবার একটা বেমক্কা প্রশ্ন করে বসলাম, “অনেকে যে বলে সরকারি চাকরি পেতে গেলে ঘুষ দিতে হয়— এসব কি সত্যি?”

“আমার চাকরি পেতে কাউকে দশ পয়সাও ঘুষ দিতে হয়নি।”

খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর আশীষদা আবার বলল, “তবে আমাকে দিতে হয়নি বলে পৃথিবীর কেউই যে ঘুষ দিয়ে সরকারি চাকরি বাগাচ্ছে না, তা তো নয়। তবে সেসব মাথায় না আনাই ভাল। একটা সিস্টেম তো পুরোটাই কোরাপ্ট হতে পারে না। তোমাকে মনে রাখতে হবে যে ফিফটি পার্সেন্টও যদি ফেয়ার কম্পিটিশন হয় তবে তারমধ্যেই ক্লিক করতে হবে। কারচুপির কথা মাথায় রাখলে বিশ্বাস টলে যাবে, পড়ায় মন বসবে না।”

এরপর একদিন কলেজস্ট্রিটে গিয়ে ওপি খান্নার বইটা কিনি। সেদিন আশীষদার কথা শুনে মনে বেশ বল পেলাম। আমারও কোথাও কোনও মামা, কাকা, দাদা নেই। যা করতে হবে নিজের চেষ্টায়। কোনও টাকা-পয়সা বা প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে নয়, মেধার জোরে একটা চাকরি ছিনিয়ে নিতে হবে। চাকরির প্রস্তুতির পড়াশোনাকে একটা প্রকল্প হিসাবে ভাবা শুরু করলাম। নাম দিলাম মিশন এভারেস্ট। মাথায় আসা এই সব হাবিজাবি চিন্তা ডায়রিতে লিখে রাখতাম। একদিন ২৯ মে এভারেস্ট দিবসের দিন লিখি—আগামী বছর ২৯মে-র মধ্যে অন্তত একটা চাকরি পেতে চলেছি এই আত্মবিশ্বাস যেন আমার মধ্যে গড়ে ওঠে। যেন রামকৃষ্ণের সেই ‘ঠং’ আওয়াজ শুনে বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে মাটির নীচে মোহর আছে। 


মাঝেমধ্যে কিছুই ভাল লাগত না। ইতিমধ্যে খেয়াল করে দেখি মৌমিতার বিয়ের পর থেকে বছর দুই-তিন আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। বিবাহিত বান্ধবীকে ফোন করতে অস্বস্তি হয়ে থাকবে হয়তো। কিংবা ওদের সুখের সংসারে আমার  স্ফুলিঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা যাতে না দেখা দেয় তাই এই ব্যবস্থা। আবার একথাও হয়তো সত্যি যে আমি পায়ের তলায় মাটি খুঁজছিলাম, মৌমিতা আমাকে খাদের কিনারে নিয়ে যেতে পারত। তাই দূরত্বই কাঙ্ক্ষিত ছিল।

একদিন দোলের দিন সকালে কী মনে করে মৌমিতার বাপের বাড়ির ল্যাণ্ড লাইনে ফোন করে বুঝি ফোনটা মৌমিতাই ধরেছে। বলি, “কে বলছি বল তো?”

জবাব আসে, “সোমনাথ।” 

আমার ফোনে কালেভাদ্রে মৌমিতার গলায় উষ্ণতার ঢেউ টের পেতাম। তখন গলাটা কেমন হাস্কি হয়ে যেত। অধিকাংশ সময়ই তো বরফের শীতলতা। আমিই ফোন করতাম, ও খুব দরকার ছাড়া ফোন করেছে মনে পড়ে না। আর ফোন করার জন্য অন্তত তিন মাসের অপেক্ষা বা দীর্ঘ বিরতি নিতাম যদি উষ্ণতার ঢেউ খেলে। নিরন্তর যোগাযোগের মানুষকে কি কেউ মিস করে? তো এবারও যেন সেই হাস্কি গলার স্বর টের পেলাম।

বলল, “আমি এখন বাপের বাড়িতে আছি। তুই এক্ষুনি চলে আয় সাইকেল নিয়ে।”

“কেন?”

“আয়, রং খেলব।”

“না রে এখন যাব না।”

“আচ্ছা তাহলে একদিন আসিস। কথা আছে।” 

‘কথা আছে’ আমার মনে একই সঙ্গে আশা ও উৎকণ্ঠার সঞ্চার করল। এতদিন তো ভাবতাম, এক পাক্ষিক প্রেমের বদলে শুধু এক পাক্ষিক বন্ধুত্বকে বয়ে বেরাচ্ছি। ও পক্ষের সাড়া নিতান্ত দায়সারা গোছের। তো, সেই আমার আমি-র সঙ্গে এতদিনে কথা থাকার মতো গুরুত্বে উন্নয়ন। সুন্দরীদের কাছে গুরুত্ব পাওয়াটাও বেশ কলার তোলার মতো ব্যাপার। ইউনিভার্সিটির কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে তাপস বলে একটি ছেলের সঙ্গে আমার মোটামুটি সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাপসের সঙ্গে আবার সুমনার খুব ভাব। এতটাই যে আমরা যাদের মেয়েদের বন্ধুত্ব জুটত না বা কোনও মেয়ের সঙ্গে অমন অন্তরঙ্গ ভাবের কথা কষ্ট কল্পনা, তাদের দীর্ঘশ্বাস পড়ত। তো, তাপসের মাধ্যমে একদিন জানি, সুমনার এক প্রেমিক জুটেছে—হীরক। হীরকের কথাও সুমনা তাপসের সঙ্গে শেয়ার করত। একদিন তাপসকে জিজ্ঞেস করি, “আচ্ছা, এই যে সুমনার সঙ্গে তোর এত অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব আর এখন সুমনা অন্য একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে, তোর মন খারাপ বা ঈর্ষা হয় না?” 

তাপস বলল, “না, হয় না। হয় না, কারণ সুমনার কাছে আমার ইমপর্টেন্স আছে। যদি না থাকত, তাহলে হয়তো হত।”

সাইকেল চালিয়ে একদিন বিকেলে গেলাম। মৌমিতাদের দোতলা বাড়িটা বেশ বড়। নীচের তলাটা ভাড়া দেওয়া। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ির প্রবেশপথের গ্রিলের গেট পেরিয়ে বাঁধানো রাস্তা, যার দু-পাশে ফুলের গাছ। একদিকে কালী মন্দির। সেখানে নিত্য পুজো হয়। সিঁড়ির ঘরের মুখে ওদের দোতলায় ওঠার দরজা। দরজার ডান দিকে কলিং বেল টিপলে মাথার কিছু উপরে জানলায় মুখ রেখে বলে, “কে?” তারপর আগন্তুককে দেখে বলে, “দাঁড়া, আসছি।”

নীচে এসে দরজা খুলে দিলে পর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ওদের বসার ঘরে গিয়ে  সোফায় বসি। এবার মৌমিতার কথায় যেন খানিক আন্তরিকতার ছোঁয়া পাই।

মৌমিতার কাছে যা জানলাম তা হল বিয়ে করে মেয়েটি সুখী হয়নি। যে মানুষটিকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, বিয়ের পর তার চরিত্রের ত্রুটিগুলি ওর চোখে প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে।  প্রথম ত্রুটি তার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। বাবা-মা স্কুলে চাকরি করতেন, পেনসন পান। আর ভদ্রলোক মাসে মাত্র চার-পাঁচ হাজার টাকার কাজ করেই সন্তুষ্ট। উন্নতির চেষ্টাও নেই। দ্বিতীয়ত মৌমিতাদের দাম্পত্যে কোনও শিশুর কলকাকলি নেই। সন্তান না জন্মানোতেও ওরা অসুখী। 

এইসব শোনার ফাঁকে আমার প্রশ্ন ছিল, “সমস্যাটা কার?”

বলল, “আমার নয়।”

বললাম, “একটা বাচ্চা দত্তক নে। আজকাল তো কতই নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক নিয়ে মানুষ করছে।”

“সেই প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও রাজি না।” 


দুই বিপরীত অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। একটি বিষন্নতার। আমাকে পাত্তা দেয়নি বলে ওর কোনও অনিষ্ট কামনা তো করিনি, তাই ওর সুখহীনতায় বিষন্নতা। আর অন্যটি স্নিগ্ধ আনন্দের। কারণ ওর আন্তরিক ব্যবহার। আমাকে বন্ধুর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে যে কুণ্ঠা লক্ষ্য করতাম, তা অন্তর্হিত। 


তেরো 


এক দিন স্টাফরুমে বসে একটা দুঃসংবাদ পেলাম।খবরের কাগজে বেরিয়েছে সর্বশিক্ষা মিশনে নিযুক্ত প্যারা টিচারদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল। প্যারাটিচারদের নিয়োগ সংক্রান্ত কোনওএকটা বিষয় তখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। এরই মধ্যে খবরের কাগজে এই সংবাদ, যা হেড স্যারের চোখে পড়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে, মাসের মাঝামাঝি গ্রীষ্মের ছুটি পড়বে। অর্থাৎ আমাদের কাজের মেয়াদ উত্তীর্ণ।  হেড স্যার তাঁর ঘরে ডেকে বললেন, “গরমের ছুটি পড়া অবধি তোরা আয়।” মানে ছুটির পরে স্কুল খুললে আর আসার দরকার নেই। 

মনে হতাশার ঝড় বয়ে গেলেও কিছুই করার নেই। স্কুলে পড়ানোর সূত্রে বেশ কিছু নতুন টিউশনি জুটেছিল। তার মধ্যে অন্যতম উচ্চ মাধ্যমিকের ইকনমিক্সের বেশ কয়েকটা ব্যাচ। স্কুলে পড়ানো বন্ধ হয়ে গেলে সেসবও হয়তো পরের বার বিলীন হয়ে যাবে। তৃপ্তির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। হয়তো আমার থেকেও ওর অবস্থা খারাপ। স্বামী একটা জামা-কাপড় ইস্ত্রি করার দোকান চালায়। একদিন বলেছে। যাইহোক, এইসব সাতপাঁচ ভাবছি যখন, ইতিহাসের শিক্ষক মনোরঞ্জনবাবু  স্টাফরুমে ঢুকে আমাদের উদ্দেশে বেশ জোর গলায় বললেন, “তোরা যেমন স্কুলে পড়াতে আসছিস, তেমনই আসবি। খবরের কাগজ পড়ে কি আমরা চলব? তোদের কাজ সমাপ্তির কোনও কাগজপত্র ডিআই অফিস থেকে আসেনি।” 

মনোরঞ্জনবাবু স্কুলে স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি। তাঁর কথার ওজন আলাদা। বামপন্থী  রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত। তাঁর কথার বিরুদ্ধে যাওয়া হেড স্যারের পক্ষেও এক রকম অসম্ভব। ফলে আমাদের ধরে প্রাণ এল। গরমের ছুটির পরেও দেখা গেল আমাদের কাজ চলে যায়নি। খবরটি ভুয়ো ছিল।

কিন্তু সমস্যা আরেকটা ছিল। স্কুলে পড়িয়ে আমরা প্রতি মাসে বেতন পেতাম না। কারণ প্যারাটিচারদের ছ’মাসের বেতন জেলার সরকারি দফতর থেকে একবারে আসত। ফলে ছ’মাস পড়িয়ে ছ’মাসের টাকা একবারে হাতে পেতাম। তারপর আবার পড়িয়ে যেতে হত অপেক্ষার প্রহর গুণে গুণে। 

আমার তাও বেশ কিছু টিউশনি ছিল বলে অথৈ জলে পড়তাম না। কিন্তু তৃপ্তির খুবই সমস্যা হত। স্বামীর ইস্ত্রির দোকান সেভাবে চলত না। ওর গলায় আক্ষেপ শুনতাম, “অনেক স্কুলে প্যারাটিচারদের টাকাটা স্কুল ফান্ড  থেকে মিটিয়ে দেয়, পরে সর্বশিক্ষা মিশনের টাকা এলে কেটে নেয়, বৈকুণ্ঠপুরেও এই ব্যবস্থা চালু হলে ভাল হত।”

বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনে আমার মুখ ছাত্র হিসাবে মনে রেখেছেন এমন একজন মাষ্টারমশাই হলেন অখিলেশবাবু। অখিলেশ রায়। বায়োলজির শিক্ষক। আমাকে মনে রাখার কারণ হয়তো স্কুলে আমি অয়নের সঙ্গে থাকতাম। অয়নের সূত্রে রজতাভর সঙ্গেও বন্ধুত্ব। রজতাভ ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আবার ওর যাতায়াত ছিল অয়নদের বাড়ি— ওর বাবার কাছে কেমিস্ট্রি পড়ার জন্য। অখিলেশবাবুও অয়নকে পড়াতে যেতেন ওদের বাড়ি। আমার সঙ্গে সেখানেও একবার দু’বার দেখা হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে বায়োলজির প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষায় চল্লিশে আটত্রিশ পেয়েছিলাম। পরীক্ষক ছিলেন অখিলেশবাবু। ফার্স্ট বয় রজতাভর সঙ্গে এই একটি ক্ষেত্রে আমার নম্বর সমান—দুজনেই আটত্রিশ।প্র্যাক্টিকালের পরীক্ষা নেওয়ার ভার স্কুলের ছিল। ফলে এই স্যারের প্রতি আমার মনে কৃতজ্ঞতা ছিল। হালকা চাপদাড়ি, চোখে চশমা, মাঝারি উচ্চতার অখিলেশবাবু ছিলেন বেশ বাকপটু এবং বই পড়তে উৎসাহী। তো, এই স্যারকে পেলাম সহকর্মী হিসাবে। প্রথম দিকে স্যারের সঙ্গে আমারও আড্ডা জমে উঠত। স্যারকে এটা-সেটা বই পড়তে দিতাম। আমদের আকাশ গ্রুপের লিটল ম্যাগাজিন স্যার কিনতেন। স্যারও তাঁর প্রিয় লেখক নারায়ণ স্যানালের অনেক বই আমাকে পড়াতেন।

অখিলেশস্যার একদিন আমাকে বললেন, “স্টাফরুমে বসে আড্ডা মেরে সময় নষ্ট না করে অফ পিরিয়ডের সময়টা তো কাজে লাগাতে পারিস?”

বললাম, “কীভাবে?”

“কেন অমলেন্দুদার ঘরের পাশে ফাঁকা জায়গাটায় বস না চেয়ার নিয়ে। ওখানে তুই তোর চাকরির পরীক্ষার প্রিপারেশন নে।”

কথাটা আমারও মনে ধরল। অমলেন্দুবাবু অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার। তাঁর চেম্বারের পাশে খানিকটা জায়গায় লম্বা টেবিল পাতা। সেখানে পরীক্ষার খাতাপত্র রাখা হয়। চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিব্যি পড়ার কাজ করা যায়। ফলে অমলেন্দুবাবুর কাছে ওখানে বসার অনুমতি চাইতে গেলাম। প্রস্তাব পেশ করতেই স্যার রাজি হয়ে গেলেন। আমার এক সঙ্গীও জুটে গেল—চন্দনদা।

দু-চার দিনের মধ্যেই আমি আর চন্দনদা দু’জনে চাঁদা দিয়ে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার কিনলাম। ওখানে বসে আমাদের কর্মযজ্ঞ শুরু হল। আমি প্রতিযোগিতা-মূলক পরীক্ষার ম্যাগাজিন পড়াতাম। আর চন্দনদা গল্পের কপি করত। স্টাফরুমে বসা আমরা ছেড়ে দিলাম। 

এইভাবে স্কুলে স্টাফরুমের মূলস্রোত থেকে আমরা ছিটকে গেলাম বটে, কিন্তু আমার আর চন্দনদার মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠল। দু’একজন শিক্ষক মাঝেমধ্যে  আমাদের কাছে এসে আলাপ করে যেতেন। কী করছি, কেন করছি এইসব।

অমেলেন্দুবাবু আমাকে একটু-আধটু স্নেহ করতেন। একবার বছরের শুরুতে দুটো ডায়রি পেয়েছেন। আমাকে আর তৃপ্তিকে ডেকে দিলেন। বললেন, “ভাবলাম, বাচ্চা ছেলে-মেয়েদুটো পাক। আর একটা পেলে তপনকে দেব।” তপন স্কুলের চুক্তিভিত্তিক কম্পিউটার শিক্ষক।

তিনি মাঝেমধ্যে আমার পরীক্ষার প্রস্তুতিরও খোঁজ নিতেন। তবে একদিন তাঁর মুখে শোনা একটি কথা আমায় ব্যথিত করল। স্যারের চেম্বারে স্যার ও মনোরঞ্জনবাবু বসে ছিলেন। খুব নীচু গলায় কথা চলছিল তাঁদের। আমি ও চন্দনদা যথারীতি টেবিলে মাথাগুঁজে আমাদের কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ শুনলাম মনোরঞ্জনবাবুর প্রশ্ন, “আমলা হবে বিসিএস দিয়ে?”

অমলেন্দুবাবু বললেন, “হ্যাঁ, ইচ্ছে আছে। কিন্তু হবে না।”

আমার শোনার কথা ছিল না হয়তো এত নীচু গলার কথা। কিন্তু কী জানি মন একাগ্র হলে হয়তো প্রায় অশ্রুত কথাও শোনা যায়। অর্থাৎ ডবলুবিসিএস দিয়ে আমলা হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আমি তা হতে পারব না। আমার সে যোগ্যতা নেই। অমলেন্দুবাবুর অভিজ্ঞ দৃষ্টি আমার ভবিষ্যৎ পড়ে ফেলেছে।

শোনার পর কষ্ট হলেও মনে মনে কোনও প্রতিজ্ঞা করিনি যে আমাকে আমলা হতেই হবে সিভিল সার্ভিস পাশ করে। আমি চেষ্টা করতে পারি, ফলাফল তো আমার হাতে ছিল না। তবে মনে হত সরকারি অফিসের একটি কেরানির চাকরি পেলেও বেঁচে থাকা নিশ্চিত হবে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব। মাকে খুব ভালবাসতাম। আমার একটা চাকরি মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের মেঘভার লাঘব হবে। কিন্তু ব্যথা পেয়েছিলাম আড়ালের কথায়।


ভূগোলের শিক্ষিকা অনুপমাদির কথাবার্তায়ও স্নেহ ফুটে উঠত। একদিন তিনি  ডেকে আমাকে বললেন, “সোমনাথ, আমার হাজব্যান্ডের অফিসে একটি পোস্ট ভ্যাকেন্ট আছে। তুমি কি কাজটা করবে?”

শুনেই ধন্যবাদ জানিয়ে ‘না’ করে দিলাম। দিয়ে বেশ গর্ব হল আমার। স্বনির্ভরতা অর্জনের কোনও সহজ রাস্তা পছন্দ ছিল না আমার।  আমার রামকৃষ্ণকথামৃতে পড়া একটি গল্প মনে পড়ল। সংসারী মানুষ কোনও কিছুতেই মন ধরে রাখতে পারে না। একবার ভাবে এখানে বুঝি গুপ্তধন আছে। ফলে কোদাল চালায়। কিছুক্ষণ পরেই ভাবে এখানে নয়, অন্যত্র। কোনও কিছুতেই তাদের স্থিরতা নেই। কিন্তু যারা তত সংসারী নয়, হৃদয়ে খানিক বৈরাগ্য আছে, তারা একই জায়গায় খনন করে চলে। বিশ্বাস স্থির রেখে। একদিন ঠং করে আওয়াজ শোনে। কোদাল গিয়ে লাগে ঘড়ায়। তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। আরও খননের পর উঠে আসে ঘড়া-ভর্তি মোহর। নিজেকে এই দ্বিতীয় দলের ভাবতাম। সেই সঙ্গে বিবেকানন্দের অনেক বাণী আমার মুখস্ত। কেউ যদি কোনও কিছু পাওয়ার ঠিক ঠিক উপযুক্ত হয়, তবে জগতের কোনও শক্তি নেই তাকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে। সুতরাং আমার এই লড়াইয়ের কোনও সহজ সমাধান চাইনি, সেটা আমার পক্ষে সম্মানজনকও হত না। দেখাই যাক। এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে কোনও আলোকস্তম্ভ আছে কিনা। অনুপমাদির প্রস্তাব ফিরিয়ে নিজেকে সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র অরুণ মুখোপাধ্যায় মনে হল। রাতে একটা কবিতা লিখে ফেললাম—


অনুপমাদি, আপনার হাজব্যান্ডের অফিসে  

আমাকে চাকরি দিতে চেয়েছেন বলে 

আপনাকে লাখো সেলাম

সবিনয়ে ফিরিয়ে দিতে পেরে

নিজেকেও মনে হল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র

অরুণ মুখোপাধ্যায়, যিনি ছবি বিশ্বাসের

অফার ফিরিয়ে দিচ্ছেন, 

বিরক্ত ছবিবাবু বলছেন,

‘...তোমার চাকরির দরকার নেই?’


‘আছে।’


‘হাউ ডু ইউ এক্সপেক্ট টু গেট ওয়ান?...হাউ?’


‘নিজের চেষ্টায়।’


যদিও হিমালয়ান প্রেক্ষাপট নেই

তবু হিমালয়ান ভূত আমার মাথায়


অনুপমাদি, কবিতা লিখে আমেরিকা যাওয়া যায়

আমি কি কোথাও পৌঁছাব?


পিএসসি বত্রিশ

এসএসসি সাইত্রিশ হলেও

অতদিন টেনাসিটি থাকবে তো!


এভাবেই কিছু একটা

হলে ভাল, না হলেও...

আমার তো কাউকে কথা দেওয়া নেই!


সেসময় আমাদের আকাশ গ্রুপের এক বন্ধু কবিতা লিখে বেশ নাম করেছে। আমেরিকাতে গিয়েছে কবিতার কর্মশালায়। এই খবর কানে এসেছিল। কীজানি কোনও গোপন আত্মবিশ্বাস কাজ করেছিল কিনা। সে সময় তিনটি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দেওয়া ছিল—ডবলুবিসিএস, মিসসেলেনিয়াস এবং ক্লার্কশিপ। রজতাভর বিয়েতে শিলিগুড়ি থেকে আসার পর এই পরীক্ষাগুলোয় বসা। খুব খারাপ হয়নি। সেবক কালীবাড়ির ফুল পেনসিল বক্সে করে নিয়ে গিয়েছি পরীক্ষা হলে। মনের অবচেতনে পাশের সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে থাকবে।




***********************************************

আগামী পর্বে 

***********************************************



উপন্যাস * দীপংকর রায়


  



['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৫ 

দীপংকর রায়



সে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থেকে এবারে এই কথাটিই বললো শুধু দেখলাম —- আমি তোমার সব কথা ঠিক ভাবে বুঝতেই পারলাম না ভাই । তাই বলে তোমার কথা ফেলেও দিচ্ছিনে , আবার খুব পরিষ্কার ভাবে গ্রহণও করতে পারছি না , তবে তোমাকে অনুরোধ করবো আমি যাদের কথা বললাম তোমাকে তাঁদের লেখা পত্র একটু পড়ে দেখো আগে আমাদের ক্লাবে আমরা একটি ছোট্ট লাইব্রেরী করেছি, তুমি ইচ্ছে করলে, তার সদস্য হয়ে যাও ।

        জিজ্ঞাসা করলাম , সদস্য চাঁদা কতো ?

        সে বললো , মাসে পাঁচ টাকা করে । 

        আচ্ছা , তাহলে এই মুহূর্তে আমার হাতের বইগুলি আগে শেষ করে নিয়ে দেখি , তারপরে আপনাদের সদস্য হওয়া যায় কি না ।

       সে তাতে বলে , হাতের বই কি তোমার শেষ হবে কোনোদিন ! যে হারে তুমি বই কিনে চলেছো ; কজন আর এইভাবে পারে ?  সব কিনে  কিনে কি সবার পড়া হয়ে ওঠে , তাই বলো ? 

       বিষয়টা কি জানেন , আমি একটু নিজস্বতায় ভুগি তো‌ , তাই , তারপরে আবার ঘর কুনো চরিত্রের ; এ বাদে আমার সমস্ত দিনের কাজকর্মও তো দেখছেন , গোরু-বাছুর এই সব নিয়ে একেবারে নাজেহাল দশা । তাঁদের পরিচর্যাতেই তো  কেটে যায় দিনের সবটা একরকম , তাই এখানে ওখানে যাই কখন ?

     সে বলে তাতে , সমস্যাটা তো সেখানেই । কিন্তু একটু ভেবে দেখো এই বিষয়টা নিয়ে , কারণ বই কিনে কিনে তুমি কত পড়বে ? তাছাড়া মানুষের সঙ্গে মিশতেও তো হবে ভাই, চায়ের আড্ডায় কখনো যাও কি ? দেখিনি তো তোমায় কোথাও !

      বললাম , না না , সেটা ঠিক হয়ে ওঠেনি । ঠিক চায়ের আড্ডা যেভাবে হয় , সেভাবে ঠিক হয়ে ওঠেনিই এখনো বলতে পারেন ; আসলে কথাটা কি জানেন , আমাকে আমার অভিভাবকেরা ছোটোবেলা থেকে একটু নিয়মের মধ্যেই বেড়ে উঠিয়েছেন । তাঁরা সেটাই চেয়েছিলেন । তারপরে এখানে এসেও যাঁদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু হলো এখানে , তারাও বলতে পারেন সব একরকমের একটা গন্ডিবদ্ধ অবস্থা থেকে উঠে এসেছে তো , তাই।

     —- বুঝেছি বুঝেছি , ঐ মনিন্দ্র কর্মকারের ছেলেটিকেই তো দেখি তোমার সঙ্গে বেশি ;  তা , ও এরকম কেন ? ওর বাবা তো যথেষ্ট লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করে , কিন্তু তার ছেলেটি দেখেছি তোমাদের মতো এই কয়েকজনের সঙ্গেই ; এখন সে  হয়েছে যখন তোমার ও বন্ধু ,  তখন এরকম একটা মানসিক গঠন তো হবেই , আসলে এরা সব মিশনারী ইস্কুলে পড়া ছেলেপেলে তো , এদের একটা আলাদা আলাদা মানসিকতা তৈরি হবেই , সেটাই দেখেছি আজ পর্যন্ত — যদিও এতে তো এদের সবটা দোষ একার নয় , যতোটা পরিবারের —- 

        —-- না না ,  সে ঠিক একা তো না , আরো অনেকেই আছে । কিছু বাইরের ছেলে-পেলেও আছে তো ; —- তবে তারা ঠিক রকে বসে বসে আড্ডা মারা ছেলে-পেলে না । তাই আমারও সৌভাগ্য হয়নি হয়তো সেভাবে কোথাও বলতে পারেন ।

       আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপরেই হঠাৎ বেশ একটু গলাটা চড়িয়েই বলে উঠলো সে , —- কিন্তু একটা কথা কেন তুমি বুঝতে পারছো না , ওঁরা কিন্তু একটি প্রথাবদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে লেখাপড়া শিখে ভালো একটা চাকরি বাকরি জুটিয়ে নিয়ে সুন্দর সাজুগুজু করা একটা জীবন কাটাবে । কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ কি , ওদের সঙ্গে তোমার জীবনের কি কোনো  মিল আছে ?  মিল তো থাকার কথাও না ! তুমি তো গোরু বাছুর লালন-পালন করে , তার ভেতর দিয়ে জীবন তৈরি করতে নেমেছো! অথচ ঠিক গোরু বাছুরের মধ্যেও তুমি তো থাকো না ; তোমার লক্ষ্য তো  অন্য দিকে । তাই আমি বলি কি , ঘরে বসে বসে শুধু বই পড়ে , এইসব ছেলেপেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করে , একটা ছোট্ট গন্ডির- ই মধ্যে ঘোরাফেরা করে বেড়াবে শুধু !  বৃহত্তর দুনিয়ার মানুষ জনের খোঁজ খবর না পেলে , তুমি লিখবে টা কি ? তাঁদের জীবনের গতিবিধি দেখ । চা ওয়ালার জীবন , মাতালের জীবন , গাঁজা খোর , লম্পট , দালাল , বাউন্ডুলে‌ ,  ঠগ- জোচ্চোর ,এই সব সকলের জীবনের কাছে যেতে না পারলে ;  তাদের ভেতরে যেয়ে একেবারে বুঝতে হবে তোমাকে , তা না হলে তুমি তাদের মনের কথা মুখের ভাষা এ সব জানতে পারবে কীভাবে ! তুমি কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের কথা জানো কিছু ? সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা হয়তো লোক মুখে খানিকটা শুনেছ ; তুমি যে শরৎচন্দ্র পড়ছো , তাঁর জীবনের কথা জানো ? চরিত্রহীন পড়েছো তো , কার কথা ওখানে বর্ণিত করেছেন শরৎ বাবু ? ভালো করে পড়ো , দেখ লেখকের জীবনচরিত ; তবেই না , তা না হলে কীভাবে তুমি না জেনে অনুপ্রানিত হতে পারবে ?

     তাঁর সঙ্গে এই সব কথাবার্তা ভাইএর যখন পড়াশোনা হয়ে যায়‌ , কাজের দিদি যখন তাকে চা বিস্কুট দেয় ,  তখনি সে আমার সঙ্গে এই সব গল্প আরম্ভ করে । 

      আর আমিও জানি না কেন যেন সমস্ত কাজের শেষে সন্ধ্যে‌বেলাটায় একটুখানি ফাঁক খুঁজে রেখে দিই তাঁর সঙ্গে এই সব নিয়ে বকবক করার জন্যেই বুঝি !

        যদিও ঠিক বকবক করা বা নিতান্ত আড্ডাও না , যত দিন যাচ্ছে ততোই তাঁর সঙ্গে আমার বোঝাবুঝির মাত্রাটি যেন বেড়েই চলেছে । সে তাঁর মত বলে‌ ,হয়তো  তাঁর মতো‌ন করেই , আর আমিও বলি আমার মতো । তারপরে একজায়গায়‌ যেয়ে‌ শেষ হয় । সে হয়তো‌ তাঁকে এগিয়ে দিতে যেয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়েই এক দুই ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম তার‌ সঙ্গে আলাচোনায় । 

     এই তো , আজই তো সে আমাকে রাশিয়ান সাহিত্যের একটা খোঁজ দিলো । বললো , রাশিয়ান গদ্য‌ সাহিত্যটা পড়ে দেখ আগে একবার‌ । একটা জিনিস দেখতে পাবে , কত‌ মিল আমাদের সঙ্গে যেন খানিকটা , আবার মনে হবে নাতো  ! 

       সেই আমাকে ম্যাক্সিম গোর্কি, তলস্তয় , পুশকিন , আরো কত সব নামের লেখকদের কথা বললো ।

        সেই বললো , লেলিনের জীবন জানো ? রাশিয়ান বিপ্লবের কথা , জারের শাসন , এ সব তুমি জানো কি ?  কার্ল মার্ক্স পড়ে দেখতে হবে। দাশ ক্যাপিটাল ।  যা না পড়লে তোমার অনেক কিছুই বাকি থেকে যাবে । মার্ক্সের কথা জানতে হবেই । সে এই গোটা দুনিয়াটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছিল একদিন । সর্বহারার জীবন কথা আমরা যেমন রাশিয়ান দার্শনিক লেখকদের কাছ থেকে জানতে পারি , সেরকম ভাবে আর কারো কাছ থেকে জানতে পাই না ।

          সব কিরকম তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । ওরে বাবা ! কত কিছুই না জানতে হবে আমায় ! এত কিছু কীভাবেই বা জেনে উঠতে পারবো রে বাবা ? এত তাড়াতাড়ি কি এত কিছু জেনে বুঝে উঠতে পারবো !  আর এত কিছু জেনে নিজের কথা জেনে , নিজের কথা বলার শক্তি কি সঞ্চয় করে উঠতে পারবো ? এ আবার কীরকম বিভ্রাটে পড়লাম রে বাবা ! বিশ্বসাহিত্যের সম্ভার কি কম ? তার কতটুকুই বা জেনে ওঠা সম্ভব ? এত কিছু জানতে জানতেই তো সময় ফুরিয়ে যাবে একদিন , তাহলে লিখবো কখন ? বলবোই বা কী এমন নতুন করে ? এঁরা কত কিছু জেনেছে ইতিমধ্যেই ! আচ্ছা , এত কিছু জেনে এরা কিছু লেখবার সাহস পায় না কেন ? আর আমি প্রতিদিনই তো আমার ডাইরির পাতা ভরিয়ে ফেলছি কত কিছু লিখে লিখে ! তাহলে সেগুলো কি সবই হাবিজাবি ? সে গুলি কি আদেও কিছু হচ্ছে নাকি , কিছুই হচ্ছে না ?

         একদিকে শঙ্কর বলছে ভারতীয় দর্শনের কথা । বেদ । উপনিষদ । পুরানের কথা । ওদিকে আবার পাশ্চাত্য সাহিত্য শিল্পের কথা । পাশ্চাত্য দর্শন , কতো কিছু ! আমি কার কথা শুনে এগোই ? এত কিছু জানতে জানতেই তো একদিন জীবন ফুরিয়ে যাবে ! তাহলে লিখবো কবে ? আবার ভাবি , ধুস্ …. এগুলি কি সব তাহলে জলে ফেলে দেবো ! না , ফেলেই বা দেবো কেন ? নিতাই দাকে খানিকটা বলবো ভাবলাম একদিন  । যদিও এত কিছু শোনার  পর , সেই হক কি আছে আমার ? সত্যি সত্যিই তো , এইসবের নাম আমি শুনিনি তো আগে !  তাহলে এত কথা বলা কি উচিৎ হবে 

আদেও ? আমি কি সব ঠিকঠাক বললাম তাহলে ? 

     কোনো সমাধানে যেন নিজের মধ্যে নিজেই আসতে পারি না । ভীষণ লজ্জা হতে লাগলো নিজেরই বলা কথা গুলি নিয়েই যেন । 

      মনে মনে বলি , সত্যিই তো আমি নিজে কিছুই জানি না । তাহলে,  ওরকম গরগর করে কী সব বকে গেলাম ? না জেনে , না বুঝে , সেদিন কেন তাহলে ওরকম ক্রুদ্ধ হয়ে বকে গেলাম ! নিজের এখনো কত ত্রুটিই না রয়ে গেছে , তার অন্যের চিন্তাভাবনার ভুল ধরিয়ে দিতে গেছি !

       নিজেই নিজের কাছে স্বীকার করে নিই । নিতাই দাকে আর কিছুই বলি না । 

        আসলে বিষয়টি হলো আমি নিজের কাছে নিজেইতো ঠিক করে পরিষ্কার নয় । তাই , সব সময়  নিজের কাছে নিজেই নানা অসহায়তায় ভুগি ।

     তবু একটা মন আমার এই বলে যাওয়ার পক্ষেই সায় দেয় ।

       যাইহোক যে পাপবোধ জন্ম নিতে যাচ্ছিল তার থেকে নিজেই সরে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছি যে , এটাই নিজের কাছে নিজের শান্তনা ।

       এইভাবেই নিজেকে শান্তনা দিই নিজেই । মনে মনে ভাবি , যা কিছুই জানি বা বুঝি , তার থেকে প্রকৃত অর্জন বাড়ছে কি আমার নিজের মধ্যে নিজেরই একটুও ? তবে প্রকাশ্যে এভাবে সব কিছু বলা যাবে না আর । অর্থাৎ বলবো না সরাসরি এভাবে আর। একটু আড়াল তৈরি করে বলতে পারাটা চেষ্টা করবো । নিজের মধ্যে নিজে টলবো না একটুও । আমার জানা এবং নাজানার ভাষা এক জায়গাতেই দাঁড় করাতে হবে , তা না হলে এত জানার ভিড়ে আমার অন্তরের জানা পথ আর  পথ খুঁজে পাবে না কোথাও । যদিও তারপরেও ভুলটা তো ভুলই —- আর ঠিক টা তো ঠিকই ?

     এই দুইয়ের প্রকার ভেদ নিজের কাছে নিজে একবার পরিষ্কার করে নেবো না , সেটা কি করে হয় !

      এখানে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত কালিদাস মামার কোনো খোঁজ  নিইনি যেমন , তেমন , সেও এ মুখো হয়নি কখনো । সে যেন কোথায় হারিয়ে গেছে ! কিন্তু কেন ? 

        সে অনেক কথা । ইতিমধ্যে সে যা যা ঘটিয়েছে , এদেশে শুধু না , এখানেই , এই অঞ্চলেই – কোথাও রয়েছে যে এটাই জানি শুধু । এবং খুব বেশি দূরেও নেই যে তাও জানতাম । কিন্তু সঠিক কোথায় থাকে তা যেন আজই জানতে পারলাম ।  

        তার কথা বলতে গেলে একটুখানি পেছন থেকে না বললে বলাটা ঠিক হবে না । 

          দেশ স্বাধীন হলে সেই যে‌ সে আমাদের সঙ্গেই ফিরে গেল ওদেশে , তারপর আবার মাগুরাতে তার মামা কৃষ্ণপদ ভৌমিকের ( কেষ্ট দাদু ) ওখান থেকেই আই এস সি  পাশ করলো রিলিফের সুযোগে । যেবার কাইলে মামা শিবু দা-রা সব হোই হোই করে ম্যাট্রিক পাশ করলো রিলিফের সুযোগে , সেইবার । আমরাও যেমন যুদ্ধের কারণে এক ক্লাস এগিয়ে পরের ক্লাসে উঠে গেলাম । শুনু মামা তার ভূবন দাকে বললো , “ ও ভূবন দা , তুমিও পরীক্ষে দিলি অক্লাসে ম্যাট্রিকটা এবারে  পাশ করে যাতি পারতে কিন্তু কলাম , হে … হে … ও ভূবন দা , তালি দ্যাখপা নাহি একবার চিষ্টা করে কী হতি পারে , আরে দেহোই না ….. এত মানুষ দেচ্ছে…. তুমিও দিয়ে দিলি মন্দ হয় না , …. উ … হু … হা… হা.. হা…..” 

      এসব সব তো ইতিমধ্যেই আবার কত পেছনে চলে গেছে ! এই তো দেখতে দেখতে সেও হয়ে গেল প্রায় দেড় দশক ! 

          কালীদাস মামার সেবারে রেজাল্ট বেরোনোর পরে , বড় দাদুর একান্ত ইচ্ছেতেই , সে আবার এদেশে চলে এলো । তবে সে ক্ষেত্রে তারও যে একেবারে ইচ্ছে ছিল না তা না । ফিরে এসে সে এই নিতাই দা দেরই একটি বাড়ি পরের বাড়িতে ভাড়া থাকা শুরু করলো । যেখানে একাত্তরের গন্ডগোলের সময় তাদের পরিবারকে যেখানে ভাড়া বাড়ি করে রাখা হয়েছিল । এবারে সেখানেই সে তার মাসতুত এক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে‌ থাকা শুরু করে দিল । 

       দীলিপদার কথা পূর্বেও এসেছে । তার সঙ্গে অনেক কথা আগে হয়েছে যে , সে কথা মনে আছে সব ই ।

       কালীদাস মামা বাড়ি বাড়ি টিউশন পড়ায় । এই বিষয়ে শুনি তার নাকি ইদানীং একটা সুনাম ও হয়ে গেছে এই অঞ্চলে । এবং আর একটি কাজ সে এই সুযোগে এখানে এসে করে নিয়েছে , সেটা হলো নেতাজি নগরের নৈশ বিভাগ থেকে বি এ পাশটিও করে নিয়েছে । এদিক ওদিক চাকরির দরখাস্ত ও করেছে । কিন্তু ঐ যা হয় , তাইই হয়েছে । শেষ পর্যন্ত আর সেই যুদ্ধে লেগে না থাকতে পেরে টিউশন পড়ানোই তার জীবিকার মাধ্যম বা উপার্জনের মাধ্যম বলেই ধরে নেয় সে  ।

       ইতিমধ্যে যে বাড়িতে সে ভাড়া থাকে সেই বাড়িরই বড় মেয়েটির সঙ্গে পরে বিবাহের সম্পর্কে জড়িয়ে পরে । 

        তার পছন্দের এই সিদ্ধান্ত আমাদের পরিবারের কারোরই নাকি সম্মতি মেলেনি  । তার বিবাহের অনুষ্ঠানে আমাদের বাড়ির কারোরই উপস্থিতি ছিল না । 

     এবং এই না থাকাকে কেন্দ্র করেই হয়তো এই দূরত্ব । এবং এমনই সেটা , এত কাছে থেকেও , সে যত দিন তার শ্বশুরালয়ের এখানে ছিলো , ততোদিন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ সেও করেনি যেমন তেমন আমাদের বাড়ির তরফ থেকেও সেটাই ঘটেছে । ইতিমধ্যে সে শ্বশুর বাড়ির ভাড়ার ঘর ছেড়েছে এবং বর্তমানে কোথায় আছে সেটাও আমাদের জানা ছিল না । তবে এই অঞ্চলেই রয়েছে যে তার আভাস তো পাই এদিক ওদিক থেকে ঠিকই ।


       ওদেশ থেকে চলে আসবার আগে বড় দাদু আমার চলে আসবার খবর জানতে পেরে আমাকে অনুরোধ করেছিল কয়েকটি কথা বলে এই ভাবে , ভাইডি , তুমি তো শুনতিছি যাবা চলে , তা যাবাই যহনে ,  তহনে তোমারে এটটা কথা কই , তারে এটটু বুঝোয়ে কোয়ো , সে যেন একটিবারের জন্যি এই দ্যাশটায়  আইসে ঘুরে যায় । আমাগের কথা না হয়ে ছাইড়েই দিলাম , তার ও তো ইডা নিজির দ্যাশ ? জন্মভূমি । তারেও কি সে ভুলে গ্যালো ? পারলো কী কোইরে ! ওরে কি এই শিক্ষা দিছিলাম ! যাক গে , যাক গে , সব ই ভুল ; সবই আমাগের কপালের ভাইডি , সবই আমাগের কপালের দোষ , তা না হলি এমনডা হবে ক্যান ? তুমিও যাতি চাচ্ছো যাও , কিন্তু কথা ডা তোমারে মনে করালাম শুধু ,  আর কিছু না । এই আর কি ……

        কথা দিয়েছিলাম বললে ভুল হবে , তবে বলেছিলাম —- ঠিক আছে দাদু , সে যদি আমাগের বাড়ির দিকি আসে , তালি আমি তারে অবশ্যিই কবার চিষ্টা করবানে  । তবে শুনিছি , মা অনেক দুঃখ করে লিখিছিল একবার তার কথা অনেক কিছু , শুনিছি সে নাকি আমাগের বাড়ি মুখোটি হয় না‌ একেবারেই । তার বিয়ের পরে এমন উন্নতির কথা বলে মা অনেক দুঃখির কথা লিখিছিল একবার । আর সে সব সব তো আপনারও জানার কথা না , তাও  তো না ! আর তারপরেও আরেক কথা , আমি যদি যাতি পারি ওদ্যাশে তবেই তো ! না হলি আর কার কথা কারে কিডা কচ্ছে , তাই কন ?

       এই সব কথপোকথনের মধ্যে এমনই এক বাস্তব রূপ অনেক কাল অবধি এমন ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি , যে‌ কথা মূল বেদনার সুরটি যে কত দূর যেয়ে ধাক্কা খাচ্ছে , সে কথা আর কাকে বুঝিয়ে বলি !

        তাছাড়া কালীদাস মামার ক্ষেত্রে সেটা এমন রূপ নেবে যে , সেটা ভাবতে গেলেও কষ্ট হয় বড় । কারণ সেই একাত্তরের দিনগুলি , তার আগে এবং পরে , তার সঙ্গে আমার যে দিনগুলি কেটেছে , নানা অনুভব গুলি দেওয়া নেওয়া হতো যেভাবে সে সময় তার সঙ্গে যে যে ভাবে , সেই দিনগুলির সঙ্গে তাকে আমি এভাবে ভাবতে গেলে আমাদের জীবনের সব মূল্যবোধ গুলি ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যায় যে ! 

        তাই আমার জীবনে তাকে পরবর্তীতে দেখে , বা তার কথা শুনে যে বড়সড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম , এমন ধাক্কা যেন তার আগে কেউ আমার অনুভবে এই ভাবে  দিতে পারেনি !

      তাই তার সংবাদ যেটুকু জানি , তাতে সেটাই যেন বাঞ্ছনীয় ছিলো আমাদের সকলের কাছেই । 

       তবুও তাকে নিয়ে এখনো আমার ভেতরটার একটা হু হুঁ করা ভাব যে তৈরি হয় সে কথাও স্বীকার করি । আর সেটাকে আমি এড়িয়ে চলতে পারি না একেবারেই । 

        তার শ্বশুরবাড়ির সামনে দিয়েই আমাদের সকলের হাঁটা পথ । সে মায়ের দু-বেলার অফিস যাওয়াও যেমন , তেমন আমার ও তো দানাভুসি আনতে যাওয়ার জন্যেই বলো , আর সদর কলকাতার দিকে কাজেকর্মে যাওয়ার জন্যেই বলো , পথ তো সেই একটাই আমাদের সকলের ।

       কালীদাস মামার বিবাহের পরে দীলিপ দাও কেন জানি না এই অঞ্চল থেকে একেবারে মিলিয়ে গেল। অথচ সেই মানুষটির কাছের থেকেই আমার প্রথম সমাজ সচেততার প্রথম পাঠ নেওয়া । যার কাছের থেকেই জানতে পেরেছি এই ভূমণ্ডলে এমন একটি দেশ আছে যার নাম ভিয়েতনাম । যেখানের মানুষেরা দীর্ঘকাল ধরে স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছে একটি শক্তিশালী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে । একটি শক্তিশালী ক্ষমতার বিরূদ্ধে । 

          সেই দীলিপদা মানুষটি যে কোথায় হারিয়ে গেল , তাও জানতে পারলাম না , বা বুঝতেও পারলাম না একবারটিও !

          দীলিপ দার সঙ্গে তাদের দুই মাসতুতো ভাইএর একে অন্যের কী নিয়ে বিবাদ হয়ে ছাড়াছাড়ি হলো সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র  জানতে পারিনি অনেক কাল অবধি । 

      আজ সেই কালীদাস মামাকে বহুকাল পরে একেবারে মুখোমুখি হলাম গাছতলায় একটি পান সিগারেটের দোকানের সামনে । প্রথমটায় খানিকটা অবাক হবার পালা তাকে ধুমপান করতে দেখে । এ যেন আর একটি চমক ! যাইহোক কত চমকই তো ঘটে মানুষের নানা পরিবর্তন দেখে । সে কি কম দেখতে পাচ্ছি যত দিন যাচ্ছে সর্বক্ষেত্রেই তো বিস্ময়ের এই হতবাক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায় । তাই এ আর এমনকি ! তবুও তো একটু চমকে যাওয়া থাকেই । 

         আজ সে আমাকে দেখতে পেয়ে নিজেই ডেকে দাঁড় করালো । যদিও তার আগেই তাকে আমি দেখেছি । কিন্তু কি করবো ভাবার আগেই সে আমাকে ডেকে নিলো । 

       কী একটা কারণে যে ব্যাস্ত ছিলাম সেটা মনে নেই । সে বেশ একটি মস্ত টান দিয়ে সিগারেটে বললো , কোথায় যাচ্ছিলি ? 

           বললাম , এই একটা কাজে বেরোইছিলাম … ।

            সে বললো , জানি , আমি সব-ই জানি , তুই যে এহেনে আইছিস সে কথা জানি , কিন্তু তোগের কোনো খোঁজ নিতি পারিনি নানা কারণে ।

            আমি খানিকটা সে কথায় গুরুত্ব না দিয়েই বললাম তাকে ,  জিজ্ঞাসা করলাম , আপনি এই বস্তুটি কবে ধরলেন ? 

               — সে বেশ কিছুকাল , মুখি খুব গন্ধ হোত তো তাই , ডাক্তারবাবুই ধরাইছেন ; তিনিই 

কোইছিলেন , আপনি পড়ানোর আগে পড়ে একটা দুটো খাবেন ।

                —- তাহলি তো এই ডাক্তার বাবু বেশ অন্যরকমের কতি হবে মামা ! ডাক্তার রা তো আগেই ধুপপান করে কিনা রুগী সেই কথা জিজ্ঞাসা করেন , এবং এই বিষয়টিতে একেবারেই তাদের ‘ না’  আগেই , আর আপনাকে কোলো কিনা ধুমপান করেন !

              —  না না , তার সঙ্গে আরো কিছু কারণ ছিল , একেবারে ঘুমোতি পারতাম না । ঘুম আসতোই না । রাত্তিরে জাইগে বসে থাকতাম সারারাত্তির একা একা । তাইতি । তা তুই কি ধরিছিস নাকি ? নে , নে না নে , ধর ….

               —- খাই না যে একেবারে সে কথা কলি মিথ্যে বলা হবেনে , মাঝে মধ্যে খাই , তবে নিয়মিত না । 

              —-- তালি আর কি আছে , নে , ধর একটা । সংকোচ করবার কী আছে ? ও কিছু না , এহনে বড় হোইছিস , এতে দোষের কিছু নেই । এহনে সবাই সমান । 

            সংকোচ যে হয়নি তাও না , আবার ইচ্ছেও যে হয়নি তাও না । ভাবলাম , আচ্ছা , এই সূত্রে যদি তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে মনের এই দূরত্বটুকু খানিকটাও কাটিয়ে ওঠা যায় , তাহলে মন্দ কি !

            সেও তারপরে দেখলাম বেশ খানিকটা মন খুলেই যেন বলতে লাগলো , জানিস তো তোর সঙ্গে মনে হয় ভগবান আজ দেখা করাইছেন । তা না হলি আমার তো এখনে এখেনে দাঁড়ানোর কথাই না ! এটটা টিউশন বাদ গ্যালো বলেই‌ তো এহেনে দাঁড়াই ছিলাম এটটা সিগারেট ধরানোর জন্যি । যদিও আজ কদিন কেন জানি নে তোর কথা ভাবতিছিলাম ; কথায় কয় না , কেউ কারো কথা ভাবলি ঈশ্বর তারে তার সংবাদটা অন্তরাল থাইকেই সেই ব্যাক্তির কাছে পৌঁছোয়ে দেন মনে‌ হয়‌ , তা না হলি এই ক্ষেত্রে সেইটা  হোল কী করে !

         কালীদাস মামার মুখের ভাষায় দু-দিককারই টান । দু-প্রান্তের মিশ্রণ-ই ঘটে চলেছে… । তবে এই মিশ্রণ তার অন্তরে কতটুকু আজও ওদেশের জন্যে অনুভবে আছে , তা সেই জানে । তবে কিছুক্ষণ কথা বলার মধ্যে একটা কথাই মনে হচ্ছে সে যেন কিছু বলতে চায় , অথচ বলতে চেয়েও থেমে যাচ্ছে ! হয়তো ভাবছে কিছু । তবে আমি তার কথাবার্তার মধ্যে বেশ বুঝতে পারছি  বারবার সে বলতে চাচ্ছে যেন কিছু , অথচ বলতে পারছে না । বারবারই প্রসঙ্গ তুলছে , কেন তার এতকাল  আমাদের কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতে না পারার কারণের কথা । যেন এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে , এমন কিছু উল্লেখ সে করছে । আবার থেমে যাচ্ছে এই বলে , জানিস না তো তোরা কিছুই , আমি এহনে কেমন রইছি যে …. ;



















****************************************************************

আগামী পর্বে 

****************************************************************

অনুবাদ কবিতা * জয়িতা ভট্টাচার্য

 



অনুবাদ কবিতা স্বরবর্ণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এই বিভাগে ইতিপূর্বে আমরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহু কবির কবিতা পড়েছি, এ সময়ের  কবিদের অনুবাদে বর্তমান সংখ্যায় আমরা  সিলভিয়া প্লাথ, মায়া এঞ্জেলু, আনা আখমাতোভা, এবং আডা লিমন -এর  একটি করে কয়েকটি কবিতা পড়ছি কবি জয়িতা ভট্টাচার্যের অনুবাদে



সিলভিয়া প্লাথ

স্বীকারোক্তি মূলক বা কনফেশনাল কবিতার ক্ষেত্রে বিশ্বে উল্লেখযোগ্য কবি সিলভিয়া প্লাথ, আমেরিকা নিবাসী কবি জন্ম ২৭ অক্টোবর ১৯৩২।কবিতার জন্য পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার। বিখ্যাত কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ড্যাডি,লেডি ল্যাজেরাস,টিউলিপ প্রভৃতি। অবসাদ জনিত মনোবেদনায় মৃত্যু বেছে নেন সিলভিয়া প্লাথ ১১ফেব্রুয়ারি,১৯৬৩।


Edge

By Sylvia Plath


Share

The woman is perfected.   

Her dead


Body wears the smile of accomplishment,   

The illusion of a Greek necessity


Flows in the scrolls of her toga,   

Her bare


Feet seem to be saying:

We have come so far, it is over.


Each dead child coiled, a white serpent,   

One at each little


Pitcher of milk, now empty.   

She has folded


Them back into her body as petals   

Of a rose close when the garden


Stiffens and odors bleed

From the sweet, deep throats of the night flower.


The moon has nothing to be sad about,   

Staring from her hood of bone.


She is used to this sort of thing.

Her blacks crackle and drag.



প্রান্তদেশ 

সিলভিয়া প্লাথ


মেয়েটি পূর্ণ হলো মৃত্যুতে।

সারা শরীরে জড়িয়ে আছে অভিজাত হাসি।

আলগা গাউনের ফাঁক দিয়ে শোভা পাচ্ছে 

গ্রীক ভাস্কর্য লীলার মতোই নগ্নতা।

ঠাণ্ডা পা দুটি যেন বলছে

"দীর্ঘ যাত্রা শেষ হয়েছে এবার "

প্রতিটি মৃত শিশু শ্বেত সর্পের মতো গুটিয়ে ছিল দুধের কলস; 

এখন,সবই ফাঁকা।

ঠিক যেমন বাগান নিরন্ন হলে গোলাপ-পাপড়ি ভাঁজে ভাঁজে 

ফিরে যায়,যেমন রাত ফুলের গভীর কন্ঠ থেকে 

ঝরে পড়ে রক্তের মিষ্টি গন্ধ!তেমন।

ঢালের আড়ালে বিষণ্ণ হয় না আর চাঁদ,

এসব অভ্যাস হয়ে গেছে।

মেয়েটি ভয় ভেঙে এগিয়ে যাবে পা টেনে টেনে,আবার।



         

মায়া এ্যাঞ্জেলু 

মায়া এ্যঞ্জেলু আমেরিকার জনপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ কবি ,গায়িকা ও সমাজকর্মী ।এ্যাফ্রো আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ২৮ মে ২০১৪ সনে পরলোকগমন করেন।


Phenomenal Woman

By Maya Angelou


Share

Pretty women wonder where my secret lies.

I’m not cute or built to suit a fashion model’s size   

But when I start to tell them,

They think I’m telling lies.

I say,

It’s in the reach of my arms,

The span of my hips,   

The stride of my step,   

The curl of my lips.   

I’m a woman

Phenomenally.

Phenomenal woman,   

That’s me.


I walk into a room

Just as cool as you please,   

And to a man,

The fellows stand or

Fall down on their knees.   

Then they swarm around me,

A hive of honey bees.   

I say,

It’s the fire in my eyes,   

And the flash of my teeth,   

The swing in my waist,   

And the joy in my feet.   

I’m a woman

Phenomenally.


Phenomenal woman,

That’s me.


Men themselves have wondered   

What they see in me.

They try so much

But they can’t touch

My inner mystery.

When I try to show them,   

They say they still can’t see.   

I say,

It’s in the arch of my back,   

The sun of my smile,

The ride of my breasts,

The grace of my style.

I’m a woman

Phenomenally.

Phenomenal woman,

That’s me.


Now you understand

Just why my head’s not bowed.   

I don’t shout or jump about

Or have to talk real loud.   

When you see me passing,

It ought to make you proud.

I say,

It’s in the click of my heels,   

The bend of my hair,   

the palm of my hand,   

The need for my care.   

’Cause I’m a woman

Phenomenally.

Phenomenal woman,

That’s me.



অদ্বিতীয়া

মায়া এঞ্জেলু


আমার গোপনকথা 

অনুসন্ধান অপরূপ মেয়েরা।

বিজ্ঞাপনের মডেলের মাপে আমি সুন্দরী নই

অথচ একথা বিশ্বাস করে না ওরা।

হাতের তালুর মত এই যে কোমর,চলার বিভঙ্গ,অথবা

ঠোঁটের ভাঁজ...

আমি এভাবেই 

অসামান্যা হয়ে উঠি।


পরিপূর্ণ সজীবতা নিয়ে 

আমি ঘরে আসি ঠিক যেমন 

পুরুষ স্বপ্ন দেখে।

তাই ওরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় এবং আনত হয় 

আমার হাঁটুর কাছে বসে।

মৌমাছির মতো গুঞ্জন করে  আমায় ঘিরে ঘিরে।

আমি বলি

সে আমার চোখের আগুন 

সে আমার শুভ্র দাঁতের ঝলক।

আমার কোমরের লচক,

আর প্রতি পদক্ষেপে আমার উল্লাস ঝরে পড়ে,

এমনই অসামান্য নারী

আমি।


আমার মধ্যে ওরা কী এমন দেখেছে!

ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে ভাবে কেবল।

এত চেষ্টা করেও তবু 

আমায় ছুঁতে পারে না তাহারা,

আমার গুপ্ত রহস্যের তল পায় না কেউ। 

আমি উন্মোচিত হই

তবু ওরা দেখতে পায় না,এমনটাই বলে।

আমার বাঁকানো পিঠ

আমার হাসিতে রোদের ঝলক, বুকের দোলন,আর

আমার চলনশৈলী,

সবকিছু নিয়ে

আমি নারী

আশ্চর্যজনক এক

অসামান্যা নারী।


কেন আমি মাথা হেঁট করি না  

এবার বুঝলে তো? 

আমি চেঁচাই না।লম্ফ-ঝম্পও করি না।

আমায় চিৎকার করতে হয় না।

আমি যখন হেঁটে যাই 

সেই ভঙ্গী তোমায় নিঃসন্দেহে

গর্বিত করে।

আমি অতঃপর বলি,

আমার গুল্ফের টংকার,আর কেশ গুচ্ছ,আমার হাতের তালু, 

যত্ন দাবি করে,

কারন আমি 

এক অনন্য নারী,

অদ্বীতীয়া।


আনা আখমাতোভা

রাশিয়ার কবি আনা আখমাতোভার আসল নাম আন্দ্রে ইয়েভনা গোরেংকা।জন্ম ২৩ জুন ১৮৮৯ ও মৃত্যু ৫ মার্চ ১৯৬৬ ।দু বার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে তার কবিতা।শ্রেষ্ঠ কবিতা পোয়েমা বেজ গেরোইয়া বা যে কবিতার নায়ক নেই একটি জটিল ও দীর্ঘ কবিতা।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে  ৯০০ দিন ধরে লেখা কবিতাটি ৭৪৪ লাইনের,এখানে একটি অংশ মাত্র অনূদিত হয়েছে।১৯৪০ থেকে ১৯৬৫ অবধি অসংখ্যবার সম্পাদনা হয় এটি কবির দ্বারা।


'Poem Without a Hero' 

Anna Akhmatova


I have lit my treasured candles,

one by one, to hallow this night.

With you, who do not come,

I wait the birth of the year.

Dear God!

the flame has drowned in crystal,

and the wine, like poison, burns

Old malice bites the air,

old ravings rave again,

though the hour has not yet struck.


Dread. Bottomless dread…

I am that shadow on the threshold

defending my remnant peace.


Let the gossip roll!

What to me are Hamlet’s garters,

or the whirlwind of Salome’s dance,

or the tread of the Man in the Iron Mask?

I am more iron than they.


Prince Charming, prince of the mockers —

compared with him the foulest of sinners

is grace incarnate…


That woman I once was,

in a black agate necklace,

I do not wish to meet again

till the Day of Judgement.


Are the last days near, perhaps?

I have forgotten your lessons,

prattlers and false prophets,

but you haven’t forgotten me.

As the future ripens in the past,

so the past rots in the future —

a terrible festival of dead leaves.


All the mirrors on the wall

show a man not yet appeared

who could not enter this white hall.

He is no better and no worse,

but he is free of Lethe’s curse:

his warm hand makes a human pledge.

Strayed from the future, can it be

that he will really come to me,

turning left from the bridge?


From childhood I have been afraid

of mummers. It always seemed

an extra shadow

without face or name

had slipped among them…


You…

you are as old as the Mamre oak,

ancient interrogator of the moon,

whose feigned groans cannot take us in.

You write laws of iron.


Creature of special tastes,

you do not wait for gout and fame

to elevate you

to a luxurious jubilee chair,

but bear your triumph

over the flowering heather,

over wildernesses.

And you are guilty of nothing: neither of this,

that, nor anything..


Besides

what have poets, in any case, to do with sin?

They must dance before the Ark of the Covenant

or die! But what am I trying to say?


In the black sky no star is seen,

somewhere in ambush lurks the Angel of Death,

but the spiced tongues of the masqueraders

are loose and shameless

A shout:

“Make way for the hero!”

Ah yes. Displacing the tall one,

he will step forth now without fail

and sing to us about holy vengeance…


There is no death, each of us knows —

it’s banal to say.

I’ll leave it to others to explain.


Is this the visitor from the wrong side

of the mirror? Or the shape

that suddenly flitted past my window?

Is it the new moon playing tricks,

or is someone really standing there again

between the stove and the cupboard?


This means that gravestones are fragile

and granite is softer than wax.

Absurd, absurd, absurd! From such absurdity

I shall soon turn gray

or change into another person.

why do you beckon me with your hand?

For one moment of peace

I would give the peace of the tomb.



যে কবিতায় নায়ক নেই 

আনা আখতামোভা


মূল্যবান সব মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছি

রাতের কোটরে।একে একে।

পাশে নেই তবু তার সঙ্গেই অপেক্ষা করি

একটি নতুন বছরের।

হে মহান!স্ফটিকে ভেসে গেছে আগুন

আর সোনালি মদ বিষাক্ত হয়ে গেছে,

প্রাচীন ঈর্ষা দংশন করছে বাতাস.

পুনরায়।

উপহাস করছে এখন নির্বোধরা।

সময় হয়নি ।


ভয়! অথৈ ভয় 

ছায়া হয়ে বসে আছি চৌকাঠে

আর ছেঁড়া ছেঁড়া শান্তির পাহারা 

দিচ্ছি আমি।


চলুক জল্পনা!

কোন মহামতির সূত্র,

শান্তিকামী দেবীর নাচন,

কিম্বা লৌহ মুখোশ বীর পুরুষের কদম,

ওদের চেয়ে কঠিন আমি।


প্রিন্স চার্মিং, যুবরাজ বিদুষক 

নোংরা অপরাধীর মতো সেজে আছে উজ্জ্বল অবতার...


কালো রত্ন খচিত নেকলেস 

পরে সেই যে নারী ছিলাম আমি 

তার মুখোমুখি আর হবো না

ন্যায়দণ্ডের আগে।

শেষের সেদিন কি আসন্ন?

তোমার শেখানো অসত্য এবং অতিকথন

কিছু মনে নেই 

কিন্তু তোমরা আমাকে ভুলতে পারোনি।

যেভাবে অতীতের গর্ভে বেড়ে ওঠে ভবিষ্যত 

তেমন ভবিষ্যতে পচে যায় অতীত 

যেন এ পচা পাতার বিভৎস উৎসব।


দেওয়াল-আয়নায় দেখি, আসেনি কেউ 

ওই সাদা দেওয়ালের ভেতর দিয়

কেউ খুব খারাপ অথবা খুব ভাল নয়।

কিন্তু বিস্মরণের অভিশাপ মুক্ত 

ওর করতল এখনও অবধি উষ্ণ!

সাঁকো থেকে নেমে ফের বাম ঘুরে

সে কি আগামীর থেকে নেমে আসবে 

বাস্তবে আমার কাছে ?


শৈশব থেকে আমি ভয় পাই 

গুঞ্জন,

সর্বদা মনে হয় ওরা নামহীন অবয়বহীন 

পিছল এক বাড়তি অস্পষ্টতা।


তুমি,

তুমি ওই বুড়ো অশত্থের শাখা

প্রশ্ন করবে চাঁদকে 

গভীর আর্তনাদের ওই ছলনায়

ভুলব না আর।

তুমি লেখো কঠিন বিচার।


বিশিষ্ট স্বাদের রচয়িতা,

তুমি সেই অপেক্ষায় নেই কখন 

ব্যথা ও খ্যতি তোমায় সাফল্যের 

স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দেবে,

আর কেবল সহ্য করবে জয়

মাধবীলতার ওপর কিম্বা 

উপবনে।

অথচ তুমি নির্দোষ 

এসব কোনোটাই না,কিছু নয়।


তাছাড়া

অন্যায় হলে কবিরগণ কী করতে পারে!

নয় সিংহাসনের সামনে নাচবে,

নয়ত মরবে!

তবে আমি কী বলতে চাই?


কালো আকাশ জুড়ে আজ নেই

 কোনও তারা।

ওৎ পেতে বসে থাকা মৃত্যুদূত

তাদের মশলাদার জিভে নির্লজ্জ 

চিৎকার করছে,

" সাবধান,রাজা আসছে!"

আর হ্যাঁ,অগ্রজকে সরিয়ে দিয়ে

সামনে এসে পড়বে তুমি, 

আর আমাদের

সেই ধর্মীয় প্রতিশোধের সঙ্গীত শোনাবে...

কোনো মৃত্যু নেই ,আমরাও জানি

কিন্তু বলা বারন 

আমি চলে গেলে অন্য কেউ 

বুঝিয়ে দিক সেকথা।


আয়নায় উল্টো দিক থেকে এসেছে সে?

অবয়ব আঁটে না জানলায় 

অমাবস্যার চাঁদের খেলা কি এইসব?

নাকি স্টোভ আর মিটসেফের মাঝে 

সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে কেউ ?


তার মানে কবরের পাথরগুলো ভঙ্গুর

এবং গ্রানাইট মোমের চেয়ে আজ নরম।

অদ্ভুত, অদ্ভুত, অদ্ভুত 

এই কিম্ভুতকিমাকার থেকে আমি 

দ্রুত ধূসর হয়ে যাব

অন্য এক মানুষ হয়ে যাব।

কেন আমায় ডাকো 

হাতছানি দিয়ে,

এক মুহূর্তের শান্তির জন্য আমি এক

ইমারত শান্তি দিতে পারি।



আডা লিমন 

আডা লিমন একজন আমেরিকান কবি ,জন্ম ২৪ মার্চ ১৯৭৬,তাঁর কবিতার  মুখ্য উপজীব্য প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবযাপনের গভীর সম্পর্ক। কংগ্রেস গ্রন্থাগারিক দ্বারা তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪ তম কবি বিজয়ী নির্বাচিত হন। এটি তাঁকে প্রথম ল্যাটিনা করে তুলেছে।"দ্য হার্টিং কাইণ্ড"কবিতা সংকলনের জন্য PEN জোসেফাইন মাইলস পুরস্কার পেয়েছেন।নাসা র মহাকাশযান ইউরোপায় লিমনের লেখা কবিতা ইন প্রেজ অব মিস্ট্রি:এ পোয়েম ফর ইয়ুরোপা কবিতাটি ট্যানটেলাম ধাতব প্লেটের অভ্যন্তরে তাঁর সাক্ষর সহ  লেখা  মহাকাশযানে বসানো মাইক্রোচিপ এ বসানো রয়েছে এবং এটা যুগান্তর ধরে মহাবিশ্বে অণ্বেষণে রত ।


Triumph Like a Girl

Ada Limon


I like the lady horses best,

how they make it all look easy,

like running 40 miles per hour

is as fun as taking a nap, or grass.

I like their lady horse swagger,

after winning. Ears up, girls, ears up!

But mainly, let’s be honest, I like

that they’re ladies. As if this big

dangerous animal is also a part of me,

that somewhere inside the delicate

skin of my body, there pumps

an 8-pound female horse heart,

giant with power, heavy with blood.

Don’t you want to believe it?

Don’t you want to lift my shirt and see

the huge beating genius machine

that thinks, no, it knows,

it’s going to come in first.



মেয়েদের মতো জয়

আডা লিমন 


মেয়ে ঘোড়া ভীষণ ভাল লাগে আমার।

ঘন্টায় চল্লিশ মাইল ছুটে যাওয়া,

যেন তাদের কাছে ঘাসের ওপর সুখের দিবানিদ্রা।

মেয়ে ঘোড়ার এই অহংকার দারুন লাগে।

জিতে যাওয়ার পরে কান খাড়া!

সব মেয়েদের কান সোজা হয়ে থাকে!

কিন্তু সত্যি বলতে কি ওরা মেয়ে,

শুধু এই কারনে ওদের ভালোবাসি।

যেন এই বিরাট প্রাণী আমার অংশ।

যেন আমার ত্বকের নিচে একটি আট পাউণ্ড ধুকপুক করে,

দানবের মতো ক্ষমতাসীন আর ভারী রক্ত ওদের।

তুমি কি বিশ্বাস করো না একথা?

তুমি কি পোষাক তুলে দেখবে না এই 

মেধাবি যন্ত্রের স্পন্দন?

সে ভাবে, না,সে জানে একথা

 প্রথম স্থানে সে-ই আসবে।












************************************************************************************************* 




জয়িতা ভট্টাচার্য 

কলকাতা নিবাসী সাহিত্যিক জয়িতা ভট্টাচার্য পেশায় শিক্ষক। অল্প বয়স থেকে লেখালিখি। প্রধানত মানবাধিকার বিষয়ক বুলেটিন ও খবরের কাগজে লিখতেন। প্রথম প্রেম কবিতা। এযাবৎ চারটি কবিতার বই,একটি গল্পের বই ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত। লিখেছেন অসংখ্য সংকলনে। এছাড়াও নিয়মিত    প্রবন্ধ, ও অনুবাদ কবিতা লেখেন বৈদ্যুতিন ও মুদ্রিত পত্রিকায়। পেয়েছেন সরকারি ও সাহিত্য গোষ্ঠীর নানা সম্মান।


প্রবন্ধ * দেবাশিস সাহা

 



শ্রীচৈতন্যের দেহকান্তি, অরূপের রূপ

দেবাশিস সাহা 


শ্রীচৈতন্য বাঙালির আবহমান আবেগ। ভক্তের চোখে তিনি ভগবান। শ্রীকৃষ্ণের অবতার। বৈষ্ণব পদাবলীর মূল রসের দিক দিয়ে বিচার করলে তিনি রাধা-কৃষ্ণের মিলিত অবতার। 'শিক্ষাষ্টকম্' নামে আটটি সংস্কৃত শ্লোক ছাড়া তিনি নিজে আর বিশেষ কিছুই লেখেননি। অথচ, বিগত পাঁচ শতকেরও বেশি সময় ধরে তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র পুথি, গবেষণা ও আলোচনা-গ্রন্থ। অধ্যাপক-গবেষক বিমানবিহারী মজুমদার লিখেছেন, 'ভারতবর্ষে শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করিয়া যত গ্রন্থ রচিত হইয়াছে এত আর অন্য কোন ব্যক্তির সম্বন্ধে লিখিত হয় নাই। শ্রীচৈতন্যের জীবনকাল হইতে আরম্ভ করিয়া আজ পর্যন্ত তাঁহার যত জীবনী বা জীবনের কোন ঘটনা লইয়া স্তব পদ বা কাহিনী রচিত হইয়াছে সেগুলি একত্র সংগ্রহ করিলে বেশ একটি লাইব্রেরী হইতে পারে।' বাস্তবিক, বাঙালির চৈতন্য-জিজ্ঞাসা কিছুতেই ফুরোয় না। তার কারণ বোধহয় এই, তিনি বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের নন, বিশ্বমানবের। রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, 'চৈতন্যদেব শাক্তও নহেন, বৈষ্ণবও নহেন, সন্ন্যাসীরও নহেন--- তিনি সকলেরই।' অকাতরে তিনি প্রেমভক্তি বিলিয়েছেন জাত- পাত, স্পৃশ্য- অস্পৃশ্য ভেদাভেদ ভুলে, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন পরিসরে (১৪৮৬ -- ১৫৩৩ খ্রি:)।


     তো প্রশ্ন, সকলেরই প্রিয় প্রেমের এই অবতারপুরুষটি দেখতে কেমন ছিলেন? কেমন ছিল তাঁর দেহকান্তি? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব, তার আগে স্মরণ করি, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের বিশারদ, বিদগ্ধ সমালোচক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফের একটি উক্তি, 'বাংলাদেশে দুইবার এক দেহে অসামান্য রূপগুণের সমাবেশ ঘটেছিল একবার চৈতন্যদেহে অন্যবার রবীন্দ্র শরীরে।'


     এ নিবন্ধের বিষয় চৈতন্য শরীর। সন্ন্যাস গ্রহণের আগে চৈতন্য গোরা, গৌরাঙ্গ, বিশ্বম্ভর, নিমাই নামে পরিচিত ছিলেন। এই সব নামের মধ্যেই তাঁর গায়ের রঙের আভাস পাওয়া যায়। চৈতন্য জীবনীকাররাও তাঁর চেহারার মাধুর্য বর্ণনা করেছেন। 'গোবিন্দ দাসের কড়চা'য় এর একটি উজ্জ্বল চিত্র পাওয়া যায়। গোবিন্দ দাস কর্মকার ছিলেন চৈতন্যের ছায়াসঙ্গী। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বা বৃন্দাবন দাস তাঁর জীবনী রচনা করেছেন অনেক পরে। ষোড়শ শতকে। তাঁরা কেউ-ই শ্রীচৈতন্যকে দেখেননি। গোবিন্দ দাস সম্পর্কে দীনেশ চন্দ্র সেন জানাচ্ছেন, '১৫০৮ খ্রিস্টাব্দ হইতে সম্ভবত চৈতন্যপ্রভুর তিরোধান পর্যন্ত গোবিন্দ তাঁহার অনুগামী ছিলেন।' অতএব, শ্রীচৈতন্যকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল গোবিন্দ দাস-এর। যেমন হয়েছিল মুরারি গুপ্ত-র। মুরারি এবং নিমাই ছিলেন গঙ্গাদাস পন্ডিতের টোলের ছাত্র। বলা যায় সহাধ্যায়ী। যদিও বয়সে  মুরারি নিমাই-এর চেয়ে অনেকটাই বড়। পরবর্তীকালে, মুরারি চৈতন্যের জীবনী রচনা করেছেন, যা 'মুরারি গুপ্তের কড়চা' নামে প্রসিদ্ধ। সংস্কৃতে লেখা কড়চার প্রথম সর্গেই মুরারি গৌরসুন্দরের জয় গেয়েছেন----

'স জয়ত্যতিশুদ্ধবিক্রমঃ কনকাভঃ কমলায়তেক্ষণঃ।

বরজানুবিলম্বিসম্ভুজো বহুধা ভক্তিবয়াভিনর্ত্তকঃ।।

অর্থাৎ অতি শুদ্ধ বিক্রম- শৌর্য্যাতিশয় যুক্ত, স্বর্ণবর্ণ পদ্মপলাশলোচন, আজানুবিলম্বিতভুজ এবং ভক্তিরসে বহু প্রকারে নর্তন-পরায়ণ সেই গৌর সুন্দরের জয় হোক।'


     ফিরি গোবিন্দ দাস-এর বর্ণনায় । গোবিন্দ দাস তাঁর কড়চার শুরুতেই কবুল করেছেনঃ স্ত্রী শশিমুখীর সঙ্গে ঝগড়ার পরিণামে ঘর ছেড়েছেন তিনি। নিজের গ্রাম কাঞ্চননগর ছেড়ে কাটোয়া হয়ে পৌঁছেছেন নদিয়ায়। গঙ্গার ঘাটে। 'লোকে বলে শচী গৃহে ঈশ্বর আইলা।' বাতাসে জোর গুঞ্জন। উতলা গোবিন্দ দাস। 'তাই দরশনে চিত্ত আকুল হইলা।।' ঘাটে বসে নানা কথা ভাবছেন। 'হেন কালে শ্রীচৈতন্য আইলেন স্নানে/ কটিতে গামছা বাঁধা আশ্চর্য্য গঠন'। স্নানে একা আসেননি চৈতন্য। সঙ্গে আছেন নিত্যানন্দ, শ্রীবাস ঠাকুর, দামোদর, সিদ্ধ হরিদাস, গদাধর। একটু পরে এলেন অদ্বৈত গোঁসাই। সাঁতার কেটে নানা কায়দায় জল কেলি করে সকলে স্নানের আনন্দ নিচ্ছেন। হরিনামে আকাশ বিদীর্ণ করছেন অদ্বৈত---' হরিধ্বনি সহ বুড়া করহে চীৎকার'। স্নান সেরে ডাঙায় উঠলেন গোরা চাঁদ। বিস্ময় বিমুগ্ধ গোবিন্দ দাস---'আশ্চর্য প্রভুর রূপ হেরিতে লাগিনু। রূপের ছটায় মুহি মোহিত হইনু।।' কী সেই রূপ? জানাচ্ছেন গোবিন্দ দাস---- 'শুদ্ধ সুবর্ণের ন্যায় অঙ্গের বরণ। /নীলপদ্ম দল সম সুদীর্ঘ নয়ন।' শুধু কী তাই? 'প্রেমময় তনুখানি মুখে হরিবোল। / যারে পান দয়া করে তারে দেন কোল।।/ হরি বলি অশ্রুপাত করে মোর গোরা।/ পিচকারী ধারা সম বহে অশ্রুধারা।।'


      'চৈতন্য ভাগবত'-এ বৃন্দাবন দাস ঠাকুরও শ্রীচৈতন্যের চেহারার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। চৈতন্য তখনও সন্ন্যাস নেননি। তখনও তিনি নিমাই পণ্ডিত। বাবার পিণ্ডদান করে সদ্য গয়া থেকে ফিরেছেন। মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেছেন ঈশ্বরপুরীর। মনেপ্রাণে অপূর্ব ভাব । আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে তাঁর জীবনে। উধাও পাণ্ডিত্যের অহঙ্কার। প্রথম যৌবনের চপলতা। সারা ক্ষণ বিভোর কীর্তনানন্দে। নয়তো নগর সংকীর্তনে। টোল সামলাতে পারছেন না আগের মতো। ছাত্ররা ফিরে যাচ্ছে। খোল -করতাল- মৃদঙ্গ- পাখোয়াজের বোলে দুহাত তুলে নবদ্বীপ নৃত্যরত।


      এ দিকে নগরে 'হরিনাম' কীর্তন বন্ধের আদেশ জারি করেছেন চাঁদ কাজি, নবদ্বীপের প্রশাসক। শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে সেই আদেশ অমান্য করল নবদ্বীপবাসী। রুখে দাঁড়ালেন চৈতন্য। এই সময়কার বর্ণনা দিচ্ছেন বৃন্দাবন দাস---- 'দুই মহাভুজ হেন কনকের স্তম্ভ।/ পুলকে শোভয়ে যেন কনক-কদম্ব।।.. গজেন্দ্র জিনিয়া স্কন্ধ, হৃদয় সুপীন। তহিঁ শোভে শুক্ল যজ্ঞ সূত্র অতি ক্ষীণ।।' জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে অজস্র মানুষ প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন । এমন গাদাগাদি ঠাসাঠাসি ভিড় যে সরষে ফেললেও তা মাটিতে পড়বে না --'সরিষপ পড়িলেও তল নাহি হয়'। তাই বহু দূর থেকেও সবাই তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন। কারণ, তিনি এতটাই লম্বা ছিলেন ---'উন্নত নাসিকা সিংহ গ্রীব মনোহর। / সবা' হৈতে  সুপীত সুদীর্ঘ কলেবর।।'


      সন্ন্যাস গ্রহণের পরের একটি ঘটনা। সেবার শ্রীচৈতন্য এসেছেন রামকেলি নামে একটি গ্রামে। গ্রামটি গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের রাজধানীর কাছে। সেখানে তিনি রূপ- সনাতনের সঙ্গে দেখা করবেন। গোপনে। রূপ ও সনাতন দুই ভাই। তাঁরা ছিলেন হসেন শাহেরই দুই মন্ত্রী। সনাতন 'সাকর মল্লিক' অর্থাৎ রাজস্বমন্ত্রী। আর রূপ 'দবির খাস' অর্থাৎ ব্যক্তিগত সচিব। তাঁরা শ্রীচৈতন্যের কৃপাপ্রার্থী। তাই গোপনীয়তা। এ দিকে শ্রীচৈতন্য যে কৃষ্ণের অবতার এই বার্তা নবদ্বীপ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতেও। প্রচুর মানুষ দেখতে এসেছেন তাঁকে । ফলে খবর আর গোপন রইল না। কোটাল গিয়ে রাজাকে জানাল--- 'এক ন্যাসী আসিয়াছে রামকেলি গ্রামে।/ নিরবধি করয়ে ভূতের সংকীর্ত্তন।' হুসেন শাহ জানতে চাইলেন--- 'কহ কহ সন্ন্যাসী কেমন।/ কি খায়, কি নাম, কৈছে দেহের গঠন।।' কোটাল জানাচ্ছে--- ' শুন শুনহ গোসাঞি।/ এমত অদ্ভুত কভু দেখি শুনি নাই।।... জিনিয়া কনক কান্তি, প্রকাণ্ড শরীর।/ আজানুলম্বিত ভুজ, নাভি সুগভীর।।/ সিংহ -গ্রীব, গজ- স্কন্ধ, কমল নয়ান।/ কোটিচন্দ্র সে মুখের না করি সমান।।' আরও বিস্তর বিবরণ দেওয়ার পরেও কোটাল থামছে না --- 'ক্ষণে ক্ষণে সন্ন্যাসীর হেন কম্প হয়।/ সহস্র জনেও ধরিবারে শক্তি নয়।।/ দুই লোচনের জল অদ্ভুত দেখিতে। / কত নদী বহে হেন না পারি কহিতে।।'


      কৃষ্ণদাস কবিরাজ 'চৈতন্যচরিতামৃত'-এ লিখেছেন শ্রীচৈতন্যের শরীর ছিল 'প্রকাণ্ড 'এবং তিনি তার নিজের হাতের মাপের চারগুন লম্বা ছিলেন--- 'তপ্ত হেমসম কান্তি প্রকাণ্ড শরীর।/নবমেঘ জিনি কণ্ঠধ্বনি যে গম্ভীর।। /দৈর্ঘ্য বিস্তারে যেই আপনার হাত।/ চারি হস্ত হয় মহাপুরুষ বিখ্যাত।।' সাধারণত, মানুষ তার নিজের হাতের সাড়ে তিনগুন লম্বা হয়।


      যুধিষ্ঠির জানা-র 'শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য' বই-এ  একটি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ আছে, যে ঘটনা  থেকে চৈতন্যের শারীরিক শক্তির একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ঘটনাটি এরকম: চৈতন্যদেব পুরীতে এসেছেন। একদিন তিনি ভাবাবেশে জগন্নাথদেবকে দর্শন করার জন্য অগ্রসর হচ্ছেন। সামনেই মূল মণ্ডপ। সিংহাসন। দেববিগ্রহ। প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে প্রহরী। বিশালাকার বলিষ্ঠ শরীর অনন্ত গচ্ছিকার। অনন্ত তাঁকে সিংহাসনের দিকে অগ্রসর হতে নিষেধ করলেন। চৈতন্য ভাবাবেগে অনন্তকে হাত দিয়ে সরিয়ে সোজা এগোতে লাগলেন। তাতেই বিপত্তি। অনন্ত ছিটকে পড়ল পূজাপীঠ অনসরপিণ্ডি-তে। এই খবর তড়ি়ৎগতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল এবং রাজা প্রতাপরুদ্রও বিস্মিত হলেন এই ভেবে যে, এই মহাশক্তিধর বীর কি সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে বাইরের কোনও শত্রু?


      সচরাচর চৈতন্যের যে ছবি আমরা দেখতে অভ্যস্ত, এই বর্ণনার সঙ্গে তার মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। তাঁর বেশিরভাগ ছবিতে, নারীসুলভ কমনীয়তা ফুটিয়ে তোলা হয়। সেটা বোধহয় তাঁর দেহে শ্রীকৃষ্ণের সখীভাব স্পষ্টরূপে ফুটিয়ে তোলার জন্য। কিন্তু, এই বর্ণনা স্পষ্টতই একজন সুঠাম দীর্ঘদেহী সুপুরষ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে, যাঁর মধ্যে নারীসুলভ কোনও লক্ষ্মণ নেই। অথচ, যাঁর দেহকান্তির ভিতরে ছিল, অরূপের রূপ...যার আকর্ষণে ছুটে আসত ধনী- নির্ধন, উঁচু- নিচু হাজার হাজার মানুষ ।




*********************************************************************************************


গ্রন্থ ও তথ্যঋণ:

গোবিন্দদাসের কড়চা

মুরারি গুপ্তের কড়চা 

শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: কৃষ্ণদাস কবিরাজ

শ্রীচৈতন্য ভাগবত: বৃন্দাবন দাস ঠাকুর 

শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধ্যন রহস্য: যুধিষ্টির জানা 

শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদানঃ ড.বিমানবিহারী মজুমদার

আন্তর্জাল: মিলনসাগর   


**********************************************************************************************

প্রবন্ধ * সিদ্ধার্থ সিংহ




তাঁর আবদারে ভাড়া করতে হয়েছিল আস্ত একটা ট্রেন


সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রত্যেকটি গান রেকর্ড করার শেষে যিনি বলতেন, 'মাই নেম ইস গওহর জান'। ঠিক সেভাবে আর কোনও শিল্পীকে... না, উদ্ধত্য নয়, নিজের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের নাম বলতে শোনা যায়নি। তিনি যে কত বড় তারকা ছিলেন এবং কত টাকা উপার্জন করতেন‚ আবার সেই টাকা  জলের মতো খরচও করতেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই৷ শোনা যায়‚ পোষা বিড়ালের বিয়েতে বিশ শতকের গোড়ায় তিনি খরচ করেছিলেন বারোশো টাকা৷ সেই মেনি যখন মা হল‚ সেই আনন্দে গওহর যে পার্টি দিয়েছিলেন তাতে খরচ করেছিলেন দু’হাজার টাকা৷ 
যখন সাধারণ লোকদের ঘোড়ায় টানা গাড়ি ব্যবহার করা ছিল নিষিদ্ধ। সেই সময় চার ঘোড়ায় টানা বুগি গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি এবং সে জন্য প্রত্যেক দিন ভাইসরয়কে জরিমান বাবদ এক হাজার টাকা করে দিতেন।
তিনি তা হাসিমুখেই দিতেন। ‌কারণ মেহফিলে তাঁর নজরানা ছিল এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা৷ রেকর্ডিং পিছু নিতেন তিন হাজার টাকা৷
কত টাকা? যখন এক তোলা সোনার দাম খুব  বেশি হলে ২৮ বা ২৯ টাকা, মনে রাখতে হবে এক তোলা সোনা মানে কিন্তু এখনকার ১০ গ্রাম নয়, তার থেকে কিঞ্চিৎ বেশি। মানে ১১.৬৬৩৮০৩৮ গ্রাম। এই সোনার দাম অনুযায়ী গওহর একটি গান রেকর্ডিং করার জন্য পেতেন এখনকার হিসেবে প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা।
নিয়মিত বাজিও ধরতেন রেসের মাঠে৷ একবার অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সময় তাঁর আবদারে ভাড়া করতে হয়েছিল আস্ত একটা ট্রেন৷ সেই ট্রেনে বাজনদার ছাড়াও গওহর নিয়ে গিয়েছিলেন নিজস্ব রাঁধুনি‚ রাঁধুনির সহকারী‚ হাকিম‚ ধোপা‚ নাপিত এবং খাস চাকর৷
১৮৭৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের এক ইহুদি পরিবারে তাঁর জন্ম। জন্মসূত্রে গওহরের নাম ছিল এইলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড। তাঁর দাদু ছিলেন ব্রিটিশ৷ দিদিমা ভারতীয়৷ বাবা রবার্ট ইয়ার্ড ছিলেন স্থানীয় বরফকলের ইঞ্জিনিয়ার এবং মা ভিক্টোরিয়া হেমিংস ব্রিটিশ পরিবারভুক্ত হলেও আদতে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তিনি ছোট থেকেই নাচগানে পারদর্শী ছিলেন।
অ্যাঞ্জেলিনার বয়স যখন মাত্র ছ'বছর, তখনই তাঁর বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেই বিচ্ছেদের পরে দীর্ঘদিনের প্রেমিক খুরশেদ আলমকে বিয়ে করে গওহরের মা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর নতুন নামকরণ হয় মালকা জান। আর মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনার নাম হয় গওহর... গওহর জান।
সেই খুরশেদের থেকেও আঘাত পেয়ে আরও বেশি করে নাচগানের জগতে নিজেকে সঁপে দেন মা মালকা জান। কত্থক শিখলেন। ঠুমরি শিখলেন। স্বয়ং উস্তাদ ইমদাদ খানের তত্ত্বাবধানে সারেঙ্গির সুরে মজলিস আলো করে গান গাইতেন মালকা আর মায়ের পাশে বসে তাল মেলাতেন বালিকা গওহর।
মেয়ের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান মালকা জান। জমানো টাকা দিয়ে চিৎপুরে কেনেন একটি বিশাল বাড়ি। সেই 'গওহর বিল্ডিং' মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই কলকাতার বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান হয়ে ওঠে। সেই বাড়িতেই গওহরের পড়াশোনা, গান ও নাচের তালিম চলতে থাকে বেনারস ঘরানার বিরাট বিরাট শিল্পীদের কাছে। পেশায় গায়িকা মালকা জানের জায়গা হয় নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দরবারে। সেখানে নবাবের ব্যক্তিগত অনুরাগিণী ও নর্তকী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।
মেয়েকে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। সে সময় নবাবের দরবারে আনাগোনা ছিল ভারতবর্ষের অনেক নামজাদা সংগীতজ্ঞের। তাঁদের সান্নিধ্যেও সংগীতচর্চা শুরু করেন গওহর। কিংবদন্তি কত্থকশিল্পী বৃন্দদিন মহারাজ, ধ্রুপদ শ্রীজনবাঈ, চরণ দাসের কাছে বাংলা কীর্তনের তালিম নেন এবং অচিরেই নৃত্য ও সঙ্গীত পটিয়সী হয়ে ওঠেন তিনি। শিখতে শুরু করেন রবীন্দ্রসংগীতও। সংগীতের আরও নানা ধরন--- ধ্রুপদ, টপ্পা, খেয়াল, ঠুমরি, ভজন, দাদরা, চৈতি, গজল, ধামার, বিষ্ণুপুরী এবং কাজরি গানেও পারদর্শী হতে শুরু করেন গওহর।
মা এবং পণ্ডিতদের সান্নিধ্যে গান ও নাচের পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষাও রপ্ত করা শুরু করেন তিনি।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে গানের আসরে অভিষেক ঘটে তাঁর। তাঁর প্রথম পরিবেশনাতেই বিহারের দারভাঙ্গা দরবারের কর্তারা এত মুগ্ধ হন যে, ক'দিন পর দরবারের প্রধান সংগীত ও নৃত্যশিল্পী  হিসেবে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে।
ধীরে ধীরে রাজা এবং জমিদারদের মেহফিলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন গওহর। বিশেষ করে ঠুমরি গাইতে গাইতে তাঁর নাচ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 
১৮৯৬ সালে কলকাতার অনুষ্ঠানে 'ফার্স্ট ড্যানসিং গার্ল' হিসাবে পরিচিতি পান তিনি। এর আগে যেহেতু এই ধরনের উপস্থাপনার চল ছিল না, ফলে এ ক্ষেত্রে তাঁকে 'রকস্টার'-এর প্রবর্তক বলা যেতেই পারে। এরপর দেশের বিভিন্ন শহরে মেহফিল করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
একটা-দুটো নয়, বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠা, তামিল, আরবি,পার্সি, পাশতুন, ফরাসি এবং ইংরাজি‌ মিলিয়ে প্রায় দশ-বারোটি ভাষায় অনায়াস গাইতে পারতেন তিনি। তাঁর লেখা উর্দু ও হিন্দি নজম গান রূপে সুরারোপিত হয়েছে বহুবার, প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় সংগীত পত্রিকায়। 
এ ছাড়া ভারতবর্ষের স্টেট রাজসভাগুলো থেকেও একের পর এক ডাক পেতে শুরু করেন তিনি। এমনকী রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক উৎসবেও দিল্লি থেকে বিশেষ আমন্ত্রণ পান গওহর।
এ দিকে রাজ-উজির ও বাবুদের কাছ থেকে দামি উপহার পেতে পেতে তাঁর সম্পদের পরিমাণও পাহাড় প্রমাণ হয়ে ওঠে।
১৯০২ সালে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে স্থানীয় কার্যালয় খুলতে ভারতবর্ষে আসেন গ্রামোফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেডের রেকর্ডিং প্রকৌশলী উইলিয়াম ফ্রেডরিক গেইসবার্গ। গ্রামোফোন কোম্পানির পক্ষ থেকে স্থানীয় শিল্পীদের গান রেকর্ড করতে আসা গেইসবার্গ আমন্ত্রণ পান এক বাঙালি বাবুর নৈশভোজে। 
সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী গওহর জান। তাঁর গান শুনে, রেকর্ড করার জন্য আগে অনেকের গান শুনলেও, সেই নৈশভোজেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন প্রথম শিল্পী হিসেবে গওহর জানের গানই তিনি রেকর্ড করবেন।
তবে কলকাতার তৎকালীন 'হার্টথ্রব' এত সহজে রাজি হননি। রেকর্ডিংয়ের প্রতি সেশনের জন্য তিনি দাবি করেন তিন হাজার টাকা। যেটা সেই সময়ে কল্পনাই করা যেত না। তবু তাতেই রাজি হয়ে যান গেইসবার্গ। 
ফলে ১৯০২ সালের ১১ নভেম্বর ভারতবর্ষের প্রথম রেকর্ডিং আর্টিস্ট হিসেবে ইতিহাস গড়ে ফেলেন গওহর জান। 
এর পরেই এ দেশে গওহর জানের পাশাপাশি বিখ্যাত হয়ে ওঠে গ্রামোফোন কোম্পানি৷ সেই শুরু৷ ১৯০২ থেকে ১৯২০ অবধি নিজের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে মোট ১০টি ভাষায় প্রায় ৬০০টি গান রেকর্ড করেছেন গওহর। তাঁর গানের ভাণ্ডার যেমন সুবিশাল, তেমনি বৈচিত্র্যময়। 'খেয়াল'-এর মতো ভারী উচ্চাঙ্গ সংগীত যেমন রেকর্ড করেছেন, তেমনি রেকর্ড করেছেন ঠুমরী, দাদরা, কাজরি, হোরি, চৈতি ও ভজনের মতো হালকা ঘরানার হিন্দুস্তানি গানগুলিও।  
ছোটবেলা থেকে রাজবাড়িতে বড় হওয়া গওহরের বেশভূষা ও আচার-আচরণও ছিল ভীষণ রাজকীয়। সব সময় এমব্রয়ডারি শাড়ি এবং ভারী গয়না পরা এই শিল্পীর সাজগোজ কোনও রাজরানির চেয়ে কম ছিল না। 
কর্মজীবনে যশ-খ্যাতির শিখরে পৌঁছনো গওহরের ব্যক্তিগত জীবন কিন্তু মোটেও সুখের ছিল না। বেনারসের ছাগন রাই এবং নিমাই সেনের মতো বাবুদের সঙ্গে পর্দার আড়ালে প্রণয় হলেও কেউ তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেননি। 
এমন সময়ে জীবনে এলেন গুজরাটের বিখ্যাত অভিনেতা অমৃত কেশব নায়ক৷ মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণার শোক ভুলতে অমৃতের আশ্রয় খুঁজছিলেন গওহর৷ সে সময় তাঁর সঙ্গে সত্যিকারের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও ১৯০৭ সালে অমৃতর অকাল মৃত্যুতে সমাপ্তি ঘটে তারও।
একসময় ব্যক্তিগত সহকর্মী ও তবলচি সৈয়দ আব্বাসকে বিয়ে করেন গওহর। আর এই একটা ভুল পদক্ষেপই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের পতন ঘটায়। গওহরের চেয়ে বয়সে বেশ ছোট আব্বাস এই সম্পর্কের অপব্যবহার করেন ভয়ানকভাবে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া থেকে স্ত্রীর সম্পত্তি দু'হাতে ওড়ানোর ফলে তাঁদের সম্পর্কে ভাঙন ধরে। আর সেই সম্পর্ক থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কোর্টকাছারি, মামলা-মোকদ্দমা চালাতে গিয়ে ভুল লোকের পাল্লায় পড়ে শেষ পর্যন্ত গওহরকে প্রায় সমস্ত সম্পত্তি হারাতে হয়। এমনকী তাঁর বড় সাধের চিৎপুরের 'গওহর বিল্ডিং' পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়। হাত বদল হতে হতে তার নাম এখন 'সেলিম মঞ্জিল'। 
সে সময় মহীশুরের মহারাজা নলভাদি কৃষ্ণরাজা ওয়াদেয়ার তাঁর রাজদরবারে সংগীতশিল্পী হিসেবে গওহরকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তত দিনে লড়াই করার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে বসেছেন তিনি।
১৯৩০ সালের ১৭ জানুয়ারি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মহীশুরের কে আর হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন গওহর। মৃত্যুকালে এই নিঃসঙ্গ শিল্পীর বিছানার পাশেও কেউ ছিল না।
যে দু'জন শিল্পী, মানে মা মালকা আর মেয়ে গওহরের গান শুনে আর এক কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী বেগম আখতার এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেছিলেন তিনি। সেই গওহরের পরিণতি যে এমন হবে গহরের জীবদ্দশায় তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।





















*******************************************************************************



প্রবন্ধ * পারমিতা ভৌমিক




রবীন্দ্র-গানের দুকূলপ্লাবী জ্যোৎস্না 

পারমিতা ভৌমিক


রবীন্দ্রনাথ এমন এক মহৎ প্রতিভার অধিকারী যে আজও তাঁর প্রতিভার প্রসঙ্গ নিতান্তই প্রাসঙ্গিক বলে বিশ্বাস করতেই হয়।  প্রাতিভাকে আমি দুটি ভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারি। একটি তার সৌন্দর্যের দিক(aesthetics) অন্যটি দর্শনের দিক(philosophy)।

     রবীন্দ্রনাথ এক আধারেই কবি ও দার্শনিক কাজেই তাঁর মধ্যে এই দুইয়ের স্থিতাবস্থাই অনিবার্য ছিল।        

    সৌন্দর্য বা Aesthetics হল ক্রিয়েশনের এমন একটা দিক যা ব্যক্তিক ধারণার ওপরে গড়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই সেটা  হয়ে ওঠে আপেক্ষিক । যার যেমন বোধ তার তেমন সৌন্দর্যচেতনা সম্পর্কে ধারণা তৈরী হয়। অপরপক্ষে দর্শনের সত্য অনেক বেশি স্থায়ী ও প্রসারিত ও আপেক্ষিকতা বর্জিত। Aestheticsএর পিছনে ব‍্যক্তিক অনুভূতি পাল্টায় আর সেটাই কবিতাক্ষেত্রে গড়ে তোলে একজন মহৎ ও জনপ্রিয় কবিকে।

     সৃষ্টির আদিতে কবিও "দেখেন" দার্শনিকও "দেখেন"। কবি সুন্দর ও সত্যকে দেখেন, দার্শনিক আগে বিস্তৃত সত্যকে দেখেন পরে তাকে সুন্দরতা দান করেন। তাই দর্শনের সুন্দরতা এবং কবির  সুন্দরতা একটু স্বতন্ত্র।

     দর্শন বা philosophy অনেক বেশী স্থায়ী , কিন্তু কবির Aesthetics  রূপান্তরের বস্তু।

    রবীন্দ্রনাথের একটি অবিসম্বাদিত কবিসত্তা আছে । কবিতা তারই প্রকাশ। কিন্তু তাও কি সর্বৈবভাবে আপেক্ষিকতার বাইরে ? না। তা নয়। তাও তো যুগচৈতন‍্য ও সরিবেশচৈতন‍্য অনুযায়ী রূপান্তরিত হয়েছে । তবুও রবীন্দ্রনাথের নিজস্বতার শিল্প বনিয়াদ অনেক বেশি শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছিল। আর ঠিক এই কারণেই একসময় বাংলা কাব্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রবলয় মুক্তির কল্লোলীয় ভাঙচুর শুরু হয়েছিল ।

     আমরা জানি, খুব স্বাভাবিকভাবেই  কবিতার নিজস্ব ক্ষেত্র স্টাইল অবয়ব গঠন, সব পাল্টায়। যুগ যুগ ধরে তাইই হয়ে আসছে।তাহলে ব‍্যাপারটি নতুন করে চিন্তা করতে হয়। 

       ফিলসফি যদি সাহিত্য শাখার সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়া যায় তার স্থায়িত্ব অনেক বেশি প্রসারিত হতে পারে, এমন একটা ধারণা আমরা রবীন্দ্রসাহিত্যে বিশেষত গানের ক্ষেত্রে করতেই পারি।গানে একই সঙ্গে থাকছে বাণী ও সুর। 

       গানে যে সুর থাকে তারই নাম সৌন্দর্য বা Aesthetics আর গানের বাণীতে থাকে দর্শন যা নাকি ঐ দর্শনের চাইতে অনেক বেশি জঙ্গম, এবং তাইই বাণীকে অনেক দূর পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।

     আসলে সুরই হলো শক্তি । ফিলসফি হলো সত্য, এবং তা অনেকাংশে স্থবির। স্থিতির প্রশ্নে,কাল্টের একটা দীর্ঘযাত্রায় স্বাভাবিকভাবেই এই দুই-এর সামঞ্জস্য অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথ এর চূড়াচুম্বী intuitive mind তা বুঝে নিয়েছিল।

      আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সুরের ভাঙ্গা-গড়া এবং তাকে গ্রহণ-বর্জনের মাধ‍্যমে  নিজের মতো করে  আত্তীকরণ করায় রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বিরল প্রতিভা। 

      তিনি বুঝেছিলেন বাণী যত philosophical হবে ততই তা বহন করবে  ঊর্ধ্বমুখী এক ব্যপ্তি।  কিন্তু এর একটা  horizontal ব্যপ্তির দিকও তো আছে , তার জন্য তো আবার  সুরটিও দরকারি। বস্তুতঃ এই উল্লম্বতা ও আনুভূমিকতার মধ‍্যে একটা archway দরকার। একটা স্বর্গমর্তের মেলবন্ধন দরকার। এর বিজ্ঞান সূত্রই হল সংগীত।

    রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ভেবেছিলেন, তাহলে বরং সুরকে রৈবিকতা দেয়াই ভালো এবং এই দেয়াতে তাঁর মহৎ ইগোও মুক্তি পেতে পারে।

     এমন ভাবনা ভেতরে ভেতরে যত রূপ নিতে শুরু করল ততই রবীন্দ্রনাথের মধ‍্যে একটা পূর্ণ transformationঘটে যেতে লাগল। বলাবাহুল্য রবীন্দ্র সাহিত্যে এই রূপান্তরের পরিণমনটি হয়ে উঠল অলৌকিক। এ এক এমন রসায়ণ ঘটাচ্ছিল যা বাইরে থেকে খুব সহজে বোধে আনা যায় না। এ এক সামগ্রিক রূপান্তর। এখানে রবীন্দ্রমানস, রবীন্দ্রচিন্তা রবীন্দ্রযাপন ও রবীন্দ্র রঞ্জনতত্ত্ব (আইডিয়ালিজম) এক হয়ে গেছে তাঁর aesthetic বোধের সঙ্গে।

     খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর গানগুলিও তাই হয়ে উঠেছে সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের সাম্যরস‍্যে আরো স্থায়ী সুন্দর। এটা রবীন্দ্রনাথ সুসংহত ভাবে করতে পেরেছেন। তাঁর গান ঠিক তখনই হয়ে উঠেছে একটা উড়ন্ত কাঠামো( structure) ।

     সবচেয়ে বড়ো কথা এই যে, কোনও দ্বান্দ্বিকতার উগ্রতার মধ্য দিয়ে এই পরিণত রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাইনি । একটা স্বতঃস্ফূর্ত লগ্নতায় তাঁর গান হয়ে উঠেছে তাঁর  পারাণির কড়ি।কিন্তু গান তাঁর শেষ পারানির কড়ি নয় ।জনান্তিকে বলে রাখি,  তাঁর শেষ পারানির কড়ি হল তাঁর আঁকা‌। 

     কবিতা অন্তঃস্থ লিরিকই , কবি রবীন্দ্রনাথের স্থায়ীভাব ছিল। ঈশ্বরমগ্নতা তাঁর সেই ভাবকে তীর্ণ করে দিয়েছিল অতীন্দ্রিয়তায়।

    স্বীকার করতেই ভালো লাগে যে ঈশ্বরমগ্নতা একটা অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা । যেসব কবিদের সত্তার সমর্পণ সম্পূর্ণ হয় পরমের কাছে, তাঁদের কাব্য সীমানাটি চিহ্নিত ও স্থিরীকৃত হয়ে যায় সেখানেই । এই বোধে কবি হয়তো তাঁর জীবনকে গুছিয়ে নিতে পারেন। তবু  কিন্তু বলতে বাধা নেই যে মুক্ত আত্মার অন্তিম অভিজ্ঞতা এর পরেও তাঁর কাছে অনায়াত্তই থেকে যায়।

         আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর শেষ পারানির কড়ি যদিও হয়ে থাকে  তবুও কিন্তু একইসঙ্গে একথাও সত্য যে এই আত্মিক সাধনায় কিন্তু  তিনি কোন অন্তিম ঠিকানায় পৌঁছাতে পারেননি।

      তাই তাঁর সামগ্রিক জীবনের  রূপান্তরটাই বড় সত্য বলে মনে হয়েছে। আর সেই রূপান্তরটিই ঘটছিল রবীন্দ্রনাথের সমগ্র আন্তরচেতনায়--- প্রথম থেকেই। 

      একদিকে ঊর্ধ্বমুখী টান ছিল অন‍্যদিকে নীচে, শেকড়ের আদর ছিল ― বস্ততঃ এই দুই টান মিলে কবিসত্তায় ঘটে যাচ্ছিলো অনন্ত রূপান্তর। সে এক মহৎকবির মহার্ঘসাধনা যা আগামী হাজার বছরেও আর হবে কিনা সন্দেহ।

      রবীন্দ্রসত্তায় রয়েছে, কবিত্ব ও অন্তর সন্ন্যাসের একটা অদ্ভুত যৌগ। তিনি আগে কবি নাকি আগে যোগী তা কিন্তু অসংশয়ে  বলা যায় না। আসলে তো মানবজীবনের বৈষম্যই মানুষকে দ্বিখন্তিত করেছে । আর এই দুই খণ্ডকে একত্র করাই মানুষের অন্তিম সাধনার লক্ষ্য হতেই হবে।

      রবীন্দ্রনাথের মধ‍্যেও এমনটাই ঘটতে দেখি। গান তাঁকে রচনা করতেই হতো কেননা এটি ছিল তাঁর ঊর্ধ্বের সাধনা আর কবিতা লেখা ছিল তাঁর কাছে পৃথিবীর মধুময় স্বীকৃতি। সৌন্দর্য ও নন্দনের পথ। কাজেই গান না লিখলে কি হতো ? কি হতে পারত? অথবা কী হলো ?-----এইসব প্রশ্ন অবান্তর কেননা সমগ্র রবীন্দ্রচেতনাই একটা অনিন্দ্যসুন্দর সমীকরণ।

      রবীন্দ্রনাথ ভাবতেন জড়ের বন্ধনই আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে, অসামঞ্জস্যকে, বড় করে তোলে এবং কেবলমাত্র সঙ্গীতই তা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে । এ তাঁর আত্মগত ভাবনা। এ ছিল তাঁর বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করতেন সংগীতই আপন বিস্তীর্ণতার মধ্যে আমাদের ছোট ছোট গণ্ডীগুলোকে ভেঙে দিতে পারে। তিনি অনুভব করতেন, অনন্ত যখন আলোর রাখি বাঁধতে আসে তখন তার ভাষিক প্রকাশই হয়ে ওঠে  সঙ্গীত। বস্তুতঃ সঙ্গীতধর্মেই কম্পমান পক্ষের আঘাতবেগেই খুলে যায় "অতি চৈতন্যলোকের সিংহদ্বার"।

এই বোধেই তো কবি তাঁর গান বেঁধে নিতে চেয়েছিলেন। গীতবিতানের পূজা-পর্যায়ের প্রথম বত্রিশটি গান থেকেই বোঝা যাবে সেই অনির্বচনীয়ের টান তাঁকে কিভাবে আকুল করে রেখেছিল-----

"নিত্যকালের গোপন কথা বিশ্বপ্রাণের ব্যাকুলতা,

আমার বাঁশি দেয় এনে আমার কানে"।

   একটা অপূর্ণতার বেদনা তাঁর ছিল। অনন্তের সঙ্গে তাঁর প্রাণ এক-সুরে মেলেনি সব সময়ে। এই alienation এর  বেদনা মুছে গেছে তখনই যখন যেখানে তাঁর সঙ্গে পরমের মিলন পূর্ণ হয়েছে। ঠিক তখনই গান স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে আপন বেগে চলেছে। এইটাই তাঁর প্রার্থিত ছিল। 

     বলাবাহুল্য মানব চিন্তার খণ্ড খণ্ড এলাকা ছেড়ে কবি-চেতনার গোপন গুহাহিত অভীপ্সা ও  অভিজ্ঞতাগুলোই এক একটি সম্পূর্ণ গান হয়ে উঠতো। তখনই একথা সত্য হয়ে, সংগীত হয়ে, বেজে উঠত-----"আপন গানের কাছেতে  আপনি হারি"। এই হেরে যেতে যেতে যত দিন যাচ্ছিল ততই রবীন্দ্রনাথ সংগীতময় হয়ে উঠছিলেন।

     যতদিন কবি হিসেবে তিনি তাঁর কবি-স্বভাবোচিত ভাবছবি এবং বাকপ্রতিমা রচনা করে আত্মিক আগ্রহকে রূপ দিতে চেয়েছেন ততদিন পর্যন্ত সুর (lyric) ছিল কেবলমাত্র তাঁর ভাবনার বাহন। সেই আগ্রহই একদিন আত্মিক অভিজ্ঞতার স্তরে এসে পৌঁছেছে। তবে তাতে সময় লেগেছিল অনেক। 

   চেতনার রূপান্তর ঘটতে সময় তো  লাগেই। সেই রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে গানই ক্রমশঃ হয়ে উঠেছিল তাঁর অন্তিম সাধনা।         

তবুও কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন কবি । তাঁর বিশ্বাসের জগৎটা ছিল বিস্ময়কর। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ জগৎ ও জগদাতীত ---উভয় রাজ‍্যেরই বাসিন্দা। আর এই দুই জগতের মধ্যে যোগাযোগের অনিবার্য সেতু হয়ে উঠেছিল তাঁর গান ।

    এই গানের সত্য ও সুন্দরের সঙ্গে তাঁর নান্দনিকতা ও আত্মিকতা অভিন্ন হয়ে গেছে। একটা   অমর্ত্য আলোক ধ্বনিকে যেন তিনি মাটিতে বাসা বুনে দিয়েছেন -----

     "সেথায় তরু তৃণ যত

     মাটির বাঁশি হতে ওঠে গানের মত

     আলোক যেথা দেয় গো আনি

     আকাশের আনন্দ বাণী

     হৃদয় মাঝে বেড়ায় ঘুরে গানের সুরে"-----

     বস্তুতঃ রবিকবির উপলব্ধিতে  সত্য যত ভাস্বর হয়েছে ,যত সুদুরপ্রসারী হয়ে উঠেছে, তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্যও মহত্ব-ও তত গভীর হয়েছে।

     কবি উপলব্ধি করেছেন যে, ধুলোমাটির পৃথিবীকে একান্ত ভাবে আঁকড়ে রেখে দেয় যে মন সেই মনই আবার বিশেষ অনির্বচনীয় মুহূর্তে সুদূরের স্পর্শের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে।

    এই দু'মুখো টানে যে মন দিশাহীন তার একান্ত আশ্রয় যেন হয়ে উঠতে পারে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) গান। 


    রবীন্দ্রনাথ জগৎসীমার রূপ কল্পগুলির আড়ালে বারে বারে ছুঁয়ে গেছেন আমাদের এবং একইসঙ্গে ছুঁইয়ে দিয়েছেন অসীম স্পন্দনের জীবন্ত জাদুকাঠির স্পর্শ‌। যে স্পন্দন কখনো আলোছায়াময়, কখনোবা স্বচ্ছ‌। তা সে যেমনই হোক , সেখানেই ধরা পড়েছে আকাশ ও মাটি---সুরে ছন্দে , বড় আপনার হয়ে-------"যে গান তোমার সুরের ধারায় /জগত জাগায় তারায় তারায়/মোর আঙিনায় বাজল সে সুর/আমার প্রাণের তালে তালে"।

       বারবার বলতেই হয় যে রবীন্দ্রনাথের কাব্য সৃষ্টির মূল কথা হল সৌন্দর্য তা সে বহিঃ-প্রকৃতি-রাজ্যের হোক বা অন্তর-প্রকৃতি- রাজ্যেরই হোক। কায়ায় হোক আর মনেই হোক বা বাক্যেই হোক, সবখান থেকেই তিল তিল করে সৌন্দর্য চয়ন করে তিনি গড়েছেন কাব্যের তিলোত্তমা মূর্তি।

    তাঁর ভাষা, তাঁর শব্দলালিত্য, তাঁর ছন্দের লাস্য তাঁতেই পরাকাষ্ঠা লাভ করেছে।

   রবীন্দ্রনাথের ভাব সুন্দর, তাঁঁর চিন্তার বৈদগ্ধ সুন্দর,  তাঁর অনুভবের সৌকুমার্য ও তার বিচিত্রতাও মনোহারী। এমনকি তাঁর আখ্যানের বিষয়বস্তু নির্বাচনটিও  সুন্দর। 

    শুধু তাই নয় শব্দের অলংকারে, অর্থের অলংকারে এবং মন্ডনের উপর মন্ডন সাজিয়ে দিয়ে তাকে আবার অধিকতর অলংকারে অলংকৃত ও সুন্দর করে মেলে ধরেছেন তিনি।

      রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আসল মানুষটি হলেন একজন ঐন্দ্রজালিক রূপকার। রূপ সৃষ্টি তাঁর অন্তর পুরুষের ধর্ম। তাতেই তাঁর স্বভাবের নিত্যসিদ্ধি। জ্ঞান ও শক্তির দিক দিয়ে তিনি যতখানি উপরে উঠেছেন তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি সৌন্দর্যের দিক দিয়ে। তাঁঁর অন্তরপুরুষটি যেন এসেছেন গন্ধর্বলোক থেকে।

     রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য এই যে তাঁঁর অন্তরস্থ কবিপুরুষই তাঁঁর সমস্ত সত্তাকেই ছেয়ে আছে। তিনি কাব্য যদি কিছু নাও লিখতেন তবু তাঁঁর জীবনখানি একখানি সুন্দরের জীবন্ত কাব্য হয়ে থাকতো। তিনি সুদর্শন । তাঁঁর  ব্যবহার সুন্দর তাঁঁর কর্ম সুন্দর , তাঁঁর ধর্ম সুন্দর। তিনি সুন্দরকেই সৃষ্টি করতে করতে চলেছেন---- এ  যেন সৌন্দর্য থেকে যাত্রা করে সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে সৌন্দর্যের অভিমুখে চলে যাওয়া। আসলে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্পুরুষ  রূপকৃৎ। এইরূপ, আকার-সৌষ্ঠবে ধরা দিয়েছে তাঁর ছন্দের স্পন্দনে। একেই তিনি আঁকড়ে ধরেছেন সুর বলে। চেয়েছেন বাণীতে সুরযোজনা করতে। কেননা কেবলমাত্র সৌন্দর্যের গঠন নয়  গতিতেও তাঁঁর সৃষ্টি সাবলীল‌ হোক এ ছিল তাঁর সাধনলক্ষ‍্য। তিনি ভালো করেই জানতেন ফিলসফি পৌঁছে যাবে সর্বজনের মধ‍্যে। তার ভাষা (philosophy) তাই হয়ে উঠলো সর্বজনবোধ‍্য সহজ সরল। 

        অর্থের আড়ালে যে ব্যঞ্জনা আছে স্থূলবাক্যের অন্তরে যে অশরীরী ভাব আছে তাকেই কবি সহজ রূপ দিতে চাইলেন গানে-----

     "আমি দেখি নাই তার মুখ আমি/ শুনি নাই তার বাণী।"/কেবল শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার/পায়ের ধ্বনি খানি।"

"মন দিয়ে যার নাগাল নাহি পাই

গান দিয়ে সেই চরণ ছুঁয়ে যাই

সুরের ঘোরে আপনাকে যাই ভুলে"----এই সহজতাই তাঁর গানকে তাঁর প্রতিভার অনিবার্য পরিণতি দান করল। ফিলসফিকে এভাবে মুক্তি দিতে কজন পেরেছেন? এভাবে ফিলসফিকে চলৎশক্তি কজন দিতে পেরেছেন এত জনপ্রিয়ভাবে ? এ ছিল তাঁর অবলীল ও শেষ পূর্ণতার স্বাক্ষর। এমনটাই তো হবার ছিল।

    রবীন্দ্রনাথের  গানই হল রূপের চলমূর্তি। রূপকে তিনি স্থির সমাধির বিষয়ে করে রাখেন নি।

     তবে একথাও একেবারে অস্বীকার করা যাবে না যে কবির এই শব্দময়ী চলিষ্ণু প্রেরণা, স্তব্ধতাকে ভেঙে বেশিদূর যেতে পারেনি । হয়তো তা তাঁর প্রার্থিতও ছিল না।

   এই চলোধর্মের বাঁকে বাঁকে কি একটা ভাবের ঘোর, একটা সুরের লয় থেকে থেকে এমন মীড় টেনে নিয়েছে যে মনে হয় তারা যেন সব ফিরতিপথে একটা শান্তির ও স্তব্ধতার  তটে গিয়ে মিশেছে। কবির মুখরতা যেন অন্তর পুরুষের নিবিড় মৌনতার সঙ্গেই কোলাকুলি করে আছে।

         ভাবলে বিস্ময় জাগে, স্থূল শব্দের হূলস্থূলের  জগৎ নিয়ে খেলতে খেলতে , সেসব ফেলে কখন যেন কবি ভাবে ও ভঙ্গিতে তাকে ছেড়ে উঠে গেছেন একটা শুচিতা,স্বচ্ছতা , লঘুতা, লালিত‍্য ও লাবণ্যের রাজপাটে।

      মনে হয় কীটসের মত রবীন্দ্রনাথের হৃদয়বাণীতেও উচ্চারিত হয়েছে সুর----"Heard melodies are sweet but those unheard/ are sweeter".....

    রবীন্দ্রনাথেও শুনি-----"যে গান কানে যায় না শোনা/সে গান যেথায় নিত‍্য বাজে/প্রাণের বীণা নিয়ে যাব/সেই অতলের সভা মাঝে।"

      রবীন্দ্রনাথ আসলে সত‌্য ও মঙ্গলের সাধনা করেছেন সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গানই তাঁর কবিসত্তার সৌন্দর্যময় সত‍্যযাত্রা যা মঙ্গলের দিকে অভিমুখ স্থিরবদ্ধ করেছে।

    রবীন্দ্রনাথের গান আরোগ‍্য নিকেতন। আমাদের বিশ্লিষ্ট সত্তার উপশম ও পথ‍্য। 

আবার বলি রবীন্দ্রনাথের গান কোনো বিক্ষিপ্ত প্রকাশ নয়, সমগ্র রবীন্দ্রনাথের সুষ্ঠ পরিণাম যা অনিবার্য ছিল।












********************************************************************************



পারমিতা ভৌমিক

বাংলা কবিতার আলোচনার জগতে পারমিতা ভৌমিক একটি অতি পরিচিত নাম। কবিতার রহস্যময় দুর্ভেদ্য মায়াটান তাঁর আলোচনার প্রসাদগুণে প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। কবিতাপাঠের অনাস্বাদিত আনন্দে ভরে ওঠে পাঠকমন। স্বরবর্ণের বর্তমান সংখ্যায় আমরা পড়ছি রবীন্দ্রনাথ-এ কবিমানসের উপর তাঁর মননঋদ্ধ আলোচনা।