
ঠকে যাওয়া মানুষ
পার্থ প্রতিম গোস্বামী
সাংসারিক জীবনে প্রশংসা অতি বিরল বস্তু। আর নিজস্ব সহধর্মিণীর কাছ থেকে তা পাওয়া, তাও বিয়ের সতেরো বছর পরে, নিঃসন্দেহে কোনো অতিজাগতিক ঘটনার সমতুল্য। তবে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হলেও, এমনটা সত্যিই ঘটেছিল অরবিন্দবাবুর ছাপোষা জীবনে।
অরবিন্দবাবু, মানে অরবিন্দ ভট্টাচার্য্য, একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক।এই মানুষটিকে এককথায় বর্ণনা করা অসম্ভব। তবে তাঁর পরিচিত অধিকাংশই তাকে ভালোমানুষ হিসেবে চেনে। ভালো মানে নির্বিবাদী। নিজের কাজ নিয়ে থাকেন। দায়িত্ব সচেতন। পরশ্রীকাতর নন। আর একটু কবিতার ব্যারাম আছে। পারেন না তেমন, তবে আফিমের ঘোরের মতো মেতে থাকেন সে নেশায়। অবশ্য ক্লাসে পড়ানোর সময়টুকু ছাড়া।
সুতরাং তাঁর দ্বারা সংসার কেমন হয় তা অনুমান করা শক্ত নয়। দোকানে গেলে সব জিনিস আনতে ভুলে যান । বাজারে গেলেও তাই। যে সব্জি আনতে বারণ করা হয়, তাই নিয়ে চলে আসেন বেশি করে । শাকওলার জোরাজুরিতে দুই রকমের শাক চার আঁটি করে এনে বাড়িতে পচান। বাড়িতে বকুনি খান, তবু তাঁর আক্কেল হয় না। তো সেদিন সকাল থেকেই অরবিন্দবাবুর মনটা বেজায় খারাপ। মোবাইলের যে ফাইলে তাঁর অপ্রকাশিত অমর কাব্যগুলি সযত্নে গচ্ছিত ছিল, তা ভুলবশত ডিলিট হয়ে গেছে। কত বিনিদ্র রজনীর গর্ভ যন্ত্রণার, কত জ্বালাময়ী মর্মভেদী গঞ্জনার ফসল সেগুলি! গোলাভরা ধানের মতো জ্বলে পুড়ে চোখের নিমেষে খাক । স্কুলেও ঠিক করে ক্লাস নিতে পারলেন না সেই কারণে। তাঁর অন্যমনস্কতার সুযোগে ছেলেমেয়েরাও এত গোলমাল করেছে যে হেডমাস্টার মশাইয়ের কাছে ঈষৎ বকুনিও জুটলো উপরি পাওনা হিসেবে। কিন্তু কাউকেই কিছু বলেন নি মুখচোরা অরবিন্দবাবু।
বাড়িতে এসে জলখাবারের পর বিষন্ন মনে চা খেতে খেতে স্মৃতি চেলে কিছু উদ্ধার করা যায় নাকি, সে ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছেন। গৃহিণী সম্ভবত কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ফরমায়েশ বা ছেলেদের পড়াশোনার প্রতি পিতার বিন্দুমাত্র মনোযোগের অভাব এবং আরও অন্যান্য গুরুতর অভিযোগ নিয়ে লঘু স্বরে একমনে বকে চলেছিলেন। হঠাৎই একটি কথা, হয়তো বক্তার ধৈর্য্যচ্যুতির কারণেই, স্বাভাবিক স্বরগ্রাম থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে সরাসরি অরবিন্দবাবুর মর্মে প্রবেশ করল- "তোমাকে তো বাজারে সবাই ঠকানোর জন্যই বসে থাকে । "
আহা! কী মনোমুগ্ধকর কথা! এ কী প্রশংসা বাণী! অরবিন্দবাবুর রাগ হল না এতটুকু। বরং তাঁর চিন্তাক্লিষ্ট মুখটি শিশুর মতো অনাবিল হাসিতে ঝলমলিয়ে ওঠে। সত্যিই তো। তিনি তো বাজারে গিয়ে কখনও দরদাম করেন না। নিজে না বেছে, সব্জিওলাকেই বলেন ঠিক করে বেছে দিতে। যার তেমন বিক্রি হয় না, খুঁজে খুঁজে তার কাছেই হাজির হন। প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই নিয়ে নেন। কারণ এই ক্ষতি সামলানোর ক্ষমতা তাঁর আছে। কিন্তু ঐ রোদে পোড়া, বলিরেখায় ভরা তামাটে মুখের শরীরটিকেও তো পরের দিন নতুন সব্জি সাজিয়ে বাজারে বসতে হবে। সেই ক্ষমতার জোগান দেবে কে? বাজারে গেলেই যে সেই মুখগুলোর হাসি চওড়া হয়, এই অনুভূতি তো কবিতা লেখার চেয়ে কম আনন্দদায়ক নয়।
স্ত্রীকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেন না অরবিন্দবাবু। তবে তাঁর সারাদিনের ব্যর্থতার গ্লানি এক নিমেষে উধাও করে দেওয়ার জন্য মনে মনে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি গিন্নীর সারা জীবনের সমস্ত নিন্দেমন্দ অবলীলায় মাফ করে দেন। অসম্ভব ফুরফুরে লাগে তাঁর। এদ্দিন তিনি নিজেও ঠিক বোঝেন নি নিজেকে, তাই হঠাৎ এই উপলব্ধিতে খুব আহ্লাদিত হলেন অরবিন্দবাবু। তিনি ঠিক করে নিলেন, আরও বেশি বেশি এমনটা করবেন, তা ঘরে যতই অশান্তি হোক। ঠকে যাওয়াতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। কারণ , তিনি ঠকে যাচ্ছেন, তার মানে তো এটাও, তিনি ঠিক এই নিয়ত পাল্টে যাওয়া সময়ের সাথে নিজেকে পাল্টে ফেলতে পারেন নি। তিনি রয়ে যাচ্ছেন এই পৃথিবী নামক গ্রহটির মতো, তার মধ্যে থাকা গাছ, পাহাড়, নদী, ঝরণা, পশু,পাখি, প্রজাপতি, পোকামাকড়ের মতোই, বোকা, আর ভালো, যারা ঠকে গিয়েও স্বধর্ম থেকে পিছু হঠতে পারে না।
আর সবচেয়ে বড় কথা অন্যকে বিশ্বাস করে বেশ স্বস্তি পান, নিশ্চিন্ত বোধ করেন তিনি। কেউ কেউ সেই আস্থার মূল্য সুদে আসলে ফেরত দেয়। তবে সকলেই তো আর সমান নয়। কেউ কেউ এই সুযোগে যে ঠকিয়ে নেয়, তা ভালোই জানেন অরবিন্দবাবু। তবু তিনি রেগে যান না। তাঁর হাসি পায়, দুঃখও হয় বৈকি, যখন তিনি দেখেন, তাকে ঠকাতে গিয়ে, স্বধর্ম হারিয়ে নিজেই নিজের কাছে কী ভীষণ ঠকে যাচ্ছে হেরে যাওয়া মানুষটি।
*************************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন