লীলা
শতদল মিত্র
দোলে গ্রামে এসেছে অশোক। অনেকদিন পর। বসন্তের মধুর সকাল। কীর্তন শুনছে মোহিত সে। শুনছে স্মৃতি। কুঞ্জলীলা। রাধা পরম আদরে কৃষ্ণের ঘুম ভাঙাচ্ছে। আর ঘোর ভেঙে অশোক দেখে একটি শিশু, শিবনেত্র, আটচালায় ওঠার চেষ্টা করছে। তার লক্ষ্য খোল। কৌতুহলী হয় অশোক। দু'বছর আগে কার্তিকের যে মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল শিশুটি তারই সন্তান। গাঁয়ের দিকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি সত্ত্বেও মেয়েদের আজও অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যায়। এই মেয়েটি বছর না ঘুরতেই মাতৃ-সাধে বাচ্চাটির জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। মায়া জাগে। কথায় কথা টানে। শোনে অশোক গত আষাঢ়ে ছোটনের যে মেয়েটির উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে হয় সাত তাড়াতাড়িই, সে শ্বশুরঘর যায় না। তার শাশুড়ি আর বড় ননদ মিলে নাকি তাকে কলকাতায় পাচার করতে চাইছিল। মায়া ঘন হয়। সে মায়ায় সর সর শব্দে এক পশলা বাতাস বয়ে যায় তখনই পাশের বাঁশঝাড়ে। শুকনো পাতা সাত পাক ঘুরে নামে। নামতেই থাকে। ওদিকে জীবনের মেয়েটির অবস্থা আরও করুণ। তার বর মদ খেয়ে মারে তাকে। মেয়েটি পালিয়ে আসে বাপের ঘরে। গরিব বাবা বুঝিয়ে আবার পাঠায় তাকে সোয়ামির ঘর। মেয়েটি পারে না, আবার ফিরে আসে। আসা-যাওয়ার টানাপড়েনের মাঝেই এমন অপ্রেমেও জান্তব কারণে মা হয় মেয়েটি। এখন কী করবে সে? জানে না মেয়েটি! এ ভাবনায় দীর্ঘশ্বাস থাকায় ঝলাস বয় হঠাৎই। মধুর সকাল ভেঙে যায়। চৈত্রবেলা ঘনিয়ে ওঠে। ততক্ষণে সুর-ঘন আসরও। অশোকও কীর্তনে থিতু হওয়ার চেষ্টা করে। যেখানে ঘুম ভেঙে শৃঙ্গার-শান্ত কিশোরকৃষ্ণ দু-হাতে রাধার মুখ তুলে ধরে অপলক চেয়ে থাকে। সুন্দর পান করে। আহা! কালো যমুনার কোলে পূর্ণ চাঁদের মায়া জাগে দিনমানেই! এ অরূপে স্তব্ধতা ছায় যেন বা জগৎজুড়ে। সে স্তব্ধতাকে গাঢ করে দূরে কোথায় একলা এক কোকিল ডেকে উঠলে কাঁচ-কাঁচ বেদনা ঝরে পড়ে একলা পুরুষ অশোকের মনে নিঃশব্দে। আর তখনই আবারও শেষ বসন্তের তপ্ত বাতাস ঘূর্ণি তুলে নেচে যায় এখানে, ওখানে। অশোক উদাস চোখ মেলে দেয় সে দৃশ্যে। যদিও তার চোখ ছিল আয়নাবিহীন, কেননা তার মন দেখেছিল অন্য কিছু! সে লীলায় যুবক কৃষ্ণ, নিষ্ঠুর কৃষ্ণ চলে যাচ্ছে তার প্রাণাধিক রাধিকাকে ছেড়ে কর্তব্যের টানে! এ ভাষ্যেও তো পাঁজর নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস থাকে। ফলে চৈত্রের ঝলাস আবারও বয় দিনমান চিরে। দূরে মরীচিকা ঝিরঝির ডাকে। আকাশ উপুড় হয় মাটিতে। লবণ মায়া ফোটে রক্তরাঙা রাঢ় ভূমিকে ফাটিয়ে আচরাচর। এ সজল দহন আভাং ভিজিয়ে দেয় অশোককে সময় মুছিয়ে। নিঃস্ব সে পুরুষ রুখু দু-হাতে অপলক তুলে ধরে তার আনজন্ম, স্বপ্নের আলোমুখ। ডুকরে ওঠে-- হে... !
***********************************************************************************************



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন