রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল




[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * আট

বিশ্বনাথ পাল

 বারো 

আশীষদা বলল, “ওপি খান্নার  জিকে বই মিসসেলেনিয়াস ও ক্লার্কশিপের জন্য খুব কার্যকরী। ইংরেজিতে লেখা, দিল্লির কোনও পাবলিকেশনের বই।”

বললাম, “কলেজস্ট্রিটে পাওয়া যাবে?” 

“মনে হয় পাওয়া যাবে। একবার চ্যাটার্জীতে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো।”

বেহালায় অরিন্দমদার বাড়িতে এসেছি। আমি, পারমিতাদি এবং অরিন্দমদার বন্ধু আশীষদা। কোনও উপলক্ষ্য ছাড়াই অরিন্দমদা আমাদের ডেকেছে। বিকেল চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা এসেছি। এদের মধ্যে আশীষদার সঙ্গে আমার আজই আলাপ হয়েছে। এর আগে আশীষদার সম্পর্কে শুনেছি পারমিতাদির কাছে। বলেছে, “আমাদের ইউনিভার্সিটির বন্ধু আশীষ রাইটার্সে চাকরি পেয়েছে পিএসসি দিয়ে।”

শুনে আশীষদাকে একটু দেখার ইচ্ছা হয়েছিল। সেই সাধ আজ পূর্ণ হল। যারা সরকারি চাকরি পায়, তারা দেখবারই বটে। তাদের থেকে নেওয়া টিপস কাজে লাগতে পারে।

আশীষদা আরও বলল, “ওপি খান্না পড়লে প্রিলির অন্তত এইটটি পার্সেন্ট কমন পাওয়া যায়। ট্রাডিশনাল জিকের ক্ষেত্রে অবশ্য।” 

আমি বললাম, “আমার টাটা ম্যাগ্রোহিলের বইটা আছে।”

“ওটা তো বিশাল মোটা বই, কভার করা খুব টাফ। বিসিএসের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু ক্লার্কশিক, মিসসেলেনিয়াসের জন্য ওপি খান্না ইস দ্য বেস্ট অ্যাস পার মাই ওপিনিওন।” 

কথাপ্রসঙ্গে আশীষদা আরও বলল, “তোমার কথা আমি বলতে পারব না, কারণ তোমার সঙ্গে তো আজই আলাপ, কিন্তু অরিন্দমের যা বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, ও যদি আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করে— তবে ও সরকারি চাকরি পাবে।”

শুনে ভালই লাগল। যাক, সরকারি চাকরি পেতে তার মানে অরণ্যদেব হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার কথায় আশীষদার খারাপ লাগতে পারে না ভেবেই এবার একটা বেমক্কা প্রশ্ন করে বসলাম, “অনেকে যে বলে সরকারি চাকরি পেতে গেলে ঘুষ দিতে হয়— এসব কি সত্যি?”

“আমার চাকরি পেতে কাউকে দশ পয়সাও ঘুষ দিতে হয়নি।”

খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর আশীষদা আবার বলল, “তবে আমাকে দিতে হয়নি বলে পৃথিবীর কেউই যে ঘুষ দিয়ে সরকারি চাকরি বাগাচ্ছে না, তা তো নয়। তবে সেসব মাথায় না আনাই ভাল। একটা সিস্টেম তো পুরোটাই কোরাপ্ট হতে পারে না। তোমাকে মনে রাখতে হবে যে ফিফটি পার্সেন্টও যদি ফেয়ার কম্পিটিশন হয় তবে তারমধ্যেই ক্লিক করতে হবে। কারচুপির কথা মাথায় রাখলে বিশ্বাস টলে যাবে, পড়ায় মন বসবে না।”

এরপর একদিন কলেজস্ট্রিটে গিয়ে ওপি খান্নার বইটা কিনি। সেদিন আশীষদার কথা শুনে মনে বেশ বল পেলাম। আমারও কোথাও কোনও মামা, কাকা, দাদা নেই। যা করতে হবে নিজের চেষ্টায়। কোনও টাকা-পয়সা বা প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে নয়, মেধার জোরে একটা চাকরি ছিনিয়ে নিতে হবে। চাকরির প্রস্তুতির পড়াশোনাকে একটা প্রকল্প হিসাবে ভাবা শুরু করলাম। নাম দিলাম মিশন এভারেস্ট। মাথায় আসা এই সব হাবিজাবি চিন্তা ডায়রিতে লিখে রাখতাম। একদিন ২৯ মে এভারেস্ট দিবসের দিন লিখি—আগামী বছর ২৯মে-র মধ্যে অন্তত একটা চাকরি পেতে চলেছি এই আত্মবিশ্বাস যেন আমার মধ্যে গড়ে ওঠে। যেন রামকৃষ্ণের সেই ‘ঠং’ আওয়াজ শুনে বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে মাটির নীচে মোহর আছে। 


মাঝেমধ্যে কিছুই ভাল লাগত না। ইতিমধ্যে খেয়াল করে দেখি মৌমিতার বিয়ের পর থেকে বছর দুই-তিন আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। বিবাহিত বান্ধবীকে ফোন করতে অস্বস্তি হয়ে থাকবে হয়তো। কিংবা ওদের সুখের সংসারে আমার  স্ফুলিঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা যাতে না দেখা দেয় তাই এই ব্যবস্থা। আবার একথাও হয়তো সত্যি যে আমি পায়ের তলায় মাটি খুঁজছিলাম, মৌমিতা আমাকে খাদের কিনারে নিয়ে যেতে পারত। তাই দূরত্বই কাঙ্ক্ষিত ছিল।

একদিন দোলের দিন সকালে কী মনে করে মৌমিতার বাপের বাড়ির ল্যাণ্ড লাইনে ফোন করে বুঝি ফোনটা মৌমিতাই ধরেছে। বলি, “কে বলছি বল তো?”

জবাব আসে, “সোমনাথ।” 

আমার ফোনে কালেভাদ্রে মৌমিতার গলায় উষ্ণতার ঢেউ টের পেতাম। তখন গলাটা কেমন হাস্কি হয়ে যেত। অধিকাংশ সময়ই তো বরফের শীতলতা। আমিই ফোন করতাম, ও খুব দরকার ছাড়া ফোন করেছে মনে পড়ে না। আর ফোন করার জন্য অন্তত তিন মাসের অপেক্ষা বা দীর্ঘ বিরতি নিতাম যদি উষ্ণতার ঢেউ খেলে। নিরন্তর যোগাযোগের মানুষকে কি কেউ মিস করে? তো এবারও যেন সেই হাস্কি গলার স্বর টের পেলাম।

বলল, “আমি এখন বাপের বাড়িতে আছি। তুই এক্ষুনি চলে আয় সাইকেল নিয়ে।”

“কেন?”

“আয়, রং খেলব।”

“না রে এখন যাব না।”

“আচ্ছা তাহলে একদিন আসিস। কথা আছে।” 

‘কথা আছে’ আমার মনে একই সঙ্গে আশা ও উৎকণ্ঠার সঞ্চার করল। এতদিন তো ভাবতাম, এক পাক্ষিক প্রেমের বদলে শুধু এক পাক্ষিক বন্ধুত্বকে বয়ে বেরাচ্ছি। ও পক্ষের সাড়া নিতান্ত দায়সারা গোছের। তো, সেই আমার আমি-র সঙ্গে এতদিনে কথা থাকার মতো গুরুত্বে উন্নয়ন। সুন্দরীদের কাছে গুরুত্ব পাওয়াটাও বেশ কলার তোলার মতো ব্যাপার। ইউনিভার্সিটির কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে তাপস বলে একটি ছেলের সঙ্গে আমার মোটামুটি সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাপসের সঙ্গে আবার সুমনার খুব ভাব। এতটাই যে আমরা যাদের মেয়েদের বন্ধুত্ব জুটত না বা কোনও মেয়ের সঙ্গে অমন অন্তরঙ্গ ভাবের কথা কষ্ট কল্পনা, তাদের দীর্ঘশ্বাস পড়ত। তো, তাপসের মাধ্যমে একদিন জানি, সুমনার এক প্রেমিক জুটেছে—হীরক। হীরকের কথাও সুমনা তাপসের সঙ্গে শেয়ার করত। একদিন তাপসকে জিজ্ঞেস করি, “আচ্ছা, এই যে সুমনার সঙ্গে তোর এত অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব আর এখন সুমনা অন্য একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে, তোর মন খারাপ বা ঈর্ষা হয় না?” 

তাপস বলল, “না, হয় না। হয় না, কারণ সুমনার কাছে আমার ইমপর্টেন্স আছে। যদি না থাকত, তাহলে হয়তো হত।”

সাইকেল চালিয়ে একদিন বিকেলে গেলাম। মৌমিতাদের দোতলা বাড়িটা বেশ বড়। নীচের তলাটা ভাড়া দেওয়া। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ির প্রবেশপথের গ্রিলের গেট পেরিয়ে বাঁধানো রাস্তা, যার দু-পাশে ফুলের গাছ। একদিকে কালী মন্দির। সেখানে নিত্য পুজো হয়। সিঁড়ির ঘরের মুখে ওদের দোতলায় ওঠার দরজা। দরজার ডান দিকে কলিং বেল টিপলে মাথার কিছু উপরে জানলায় মুখ রেখে বলে, “কে?” তারপর আগন্তুককে দেখে বলে, “দাঁড়া, আসছি।”

নীচে এসে দরজা খুলে দিলে পর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ওদের বসার ঘরে গিয়ে  সোফায় বসি। এবার মৌমিতার কথায় যেন খানিক আন্তরিকতার ছোঁয়া পাই।

মৌমিতার কাছে যা জানলাম তা হল বিয়ে করে মেয়েটি সুখী হয়নি। যে মানুষটিকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, বিয়ের পর তার চরিত্রের ত্রুটিগুলি ওর চোখে প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে।  প্রথম ত্রুটি তার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। বাবা-মা স্কুলে চাকরি করতেন, পেনসন পান। আর ভদ্রলোক মাসে মাত্র চার-পাঁচ হাজার টাকার কাজ করেই সন্তুষ্ট। উন্নতির চেষ্টাও নেই। দ্বিতীয়ত মৌমিতাদের দাম্পত্যে কোনও শিশুর কলকাকলি নেই। সন্তান না জন্মানোতেও ওরা অসুখী। 

এইসব শোনার ফাঁকে আমার প্রশ্ন ছিল, “সমস্যাটা কার?”

বলল, “আমার নয়।”

বললাম, “একটা বাচ্চা দত্তক নে। আজকাল তো কতই নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক নিয়ে মানুষ করছে।”

“সেই প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও রাজি না।” 


দুই বিপরীত অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। একটি বিষন্নতার। আমাকে পাত্তা দেয়নি বলে ওর কোনও অনিষ্ট কামনা তো করিনি, তাই ওর সুখহীনতায় বিষন্নতা। আর অন্যটি স্নিগ্ধ আনন্দের। কারণ ওর আন্তরিক ব্যবহার। আমাকে বন্ধুর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে যে কুণ্ঠা লক্ষ্য করতাম, তা অন্তর্হিত। 


তেরো 


এক দিন স্টাফরুমে বসে একটা দুঃসংবাদ পেলাম।খবরের কাগজে বেরিয়েছে সর্বশিক্ষা মিশনে নিযুক্ত প্যারা টিচারদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল। প্যারাটিচারদের নিয়োগ সংক্রান্ত কোনওএকটা বিষয় তখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। এরই মধ্যে খবরের কাগজে এই সংবাদ, যা হেড স্যারের চোখে পড়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে, মাসের মাঝামাঝি গ্রীষ্মের ছুটি পড়বে। অর্থাৎ আমাদের কাজের মেয়াদ উত্তীর্ণ।  হেড স্যার তাঁর ঘরে ডেকে বললেন, “গরমের ছুটি পড়া অবধি তোরা আয়।” মানে ছুটির পরে স্কুল খুললে আর আসার দরকার নেই। 

মনে হতাশার ঝড় বয়ে গেলেও কিছুই করার নেই। স্কুলে পড়ানোর সূত্রে বেশ কিছু নতুন টিউশনি জুটেছিল। তার মধ্যে অন্যতম উচ্চ মাধ্যমিকের ইকনমিক্সের বেশ কয়েকটা ব্যাচ। স্কুলে পড়ানো বন্ধ হয়ে গেলে সেসবও হয়তো পরের বার বিলীন হয়ে যাবে। তৃপ্তির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। হয়তো আমার থেকেও ওর অবস্থা খারাপ। স্বামী একটা জামা-কাপড় ইস্ত্রি করার দোকান চালায়। একদিন বলেছে। যাইহোক, এইসব সাতপাঁচ ভাবছি যখন, ইতিহাসের শিক্ষক মনোরঞ্জনবাবু  স্টাফরুমে ঢুকে আমাদের উদ্দেশে বেশ জোর গলায় বললেন, “তোরা যেমন স্কুলে পড়াতে আসছিস, তেমনই আসবি। খবরের কাগজ পড়ে কি আমরা চলব? তোদের কাজ সমাপ্তির কোনও কাগজপত্র ডিআই অফিস থেকে আসেনি।” 

মনোরঞ্জনবাবু স্কুলে স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি। তাঁর কথার ওজন আলাদা। বামপন্থী  রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত। তাঁর কথার বিরুদ্ধে যাওয়া হেড স্যারের পক্ষেও এক রকম অসম্ভব। ফলে আমাদের ধরে প্রাণ এল। গরমের ছুটির পরেও দেখা গেল আমাদের কাজ চলে যায়নি। খবরটি ভুয়ো ছিল।

কিন্তু সমস্যা আরেকটা ছিল। স্কুলে পড়িয়ে আমরা প্রতি মাসে বেতন পেতাম না। কারণ প্যারাটিচারদের ছ’মাসের বেতন জেলার সরকারি দফতর থেকে একবারে আসত। ফলে ছ’মাস পড়িয়ে ছ’মাসের টাকা একবারে হাতে পেতাম। তারপর আবার পড়িয়ে যেতে হত অপেক্ষার প্রহর গুণে গুণে। 

আমার তাও বেশ কিছু টিউশনি ছিল বলে অথৈ জলে পড়তাম না। কিন্তু তৃপ্তির খুবই সমস্যা হত। স্বামীর ইস্ত্রির দোকান সেভাবে চলত না। ওর গলায় আক্ষেপ শুনতাম, “অনেক স্কুলে প্যারাটিচারদের টাকাটা স্কুল ফান্ড  থেকে মিটিয়ে দেয়, পরে সর্বশিক্ষা মিশনের টাকা এলে কেটে নেয়, বৈকুণ্ঠপুরেও এই ব্যবস্থা চালু হলে ভাল হত।”

বৈকুণ্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনে আমার মুখ ছাত্র হিসাবে মনে রেখেছেন এমন একজন মাষ্টারমশাই হলেন অখিলেশবাবু। অখিলেশ রায়। বায়োলজির শিক্ষক। আমাকে মনে রাখার কারণ হয়তো স্কুলে আমি অয়নের সঙ্গে থাকতাম। অয়নের সূত্রে রজতাভর সঙ্গেও বন্ধুত্ব। রজতাভ ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আবার ওর যাতায়াত ছিল অয়নদের বাড়ি— ওর বাবার কাছে কেমিস্ট্রি পড়ার জন্য। অখিলেশবাবুও অয়নকে পড়াতে যেতেন ওদের বাড়ি। আমার সঙ্গে সেখানেও একবার দু’বার দেখা হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে বায়োলজির প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষায় চল্লিশে আটত্রিশ পেয়েছিলাম। পরীক্ষক ছিলেন অখিলেশবাবু। ফার্স্ট বয় রজতাভর সঙ্গে এই একটি ক্ষেত্রে আমার নম্বর সমান—দুজনেই আটত্রিশ।প্র্যাক্টিকালের পরীক্ষা নেওয়ার ভার স্কুলের ছিল। ফলে এই স্যারের প্রতি আমার মনে কৃতজ্ঞতা ছিল। হালকা চাপদাড়ি, চোখে চশমা, মাঝারি উচ্চতার অখিলেশবাবু ছিলেন বেশ বাকপটু এবং বই পড়তে উৎসাহী। তো, এই স্যারকে পেলাম সহকর্মী হিসাবে। প্রথম দিকে স্যারের সঙ্গে আমারও আড্ডা জমে উঠত। স্যারকে এটা-সেটা বই পড়তে দিতাম। আমদের আকাশ গ্রুপের লিটল ম্যাগাজিন স্যার কিনতেন। স্যারও তাঁর প্রিয় লেখক নারায়ণ স্যানালের অনেক বই আমাকে পড়াতেন।

অখিলেশস্যার একদিন আমাকে বললেন, “স্টাফরুমে বসে আড্ডা মেরে সময় নষ্ট না করে অফ পিরিয়ডের সময়টা তো কাজে লাগাতে পারিস?”

বললাম, “কীভাবে?”

“কেন অমলেন্দুদার ঘরের পাশে ফাঁকা জায়গাটায় বস না চেয়ার নিয়ে। ওখানে তুই তোর চাকরির পরীক্ষার প্রিপারেশন নে।”

কথাটা আমারও মনে ধরল। অমলেন্দুবাবু অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার। তাঁর চেম্বারের পাশে খানিকটা জায়গায় লম্বা টেবিল পাতা। সেখানে পরীক্ষার খাতাপত্র রাখা হয়। চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিব্যি পড়ার কাজ করা যায়। ফলে অমলেন্দুবাবুর কাছে ওখানে বসার অনুমতি চাইতে গেলাম। প্রস্তাব পেশ করতেই স্যার রাজি হয়ে গেলেন। আমার এক সঙ্গীও জুটে গেল—চন্দনদা।

দু-চার দিনের মধ্যেই আমি আর চন্দনদা দু’জনে চাঁদা দিয়ে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার কিনলাম। ওখানে বসে আমাদের কর্মযজ্ঞ শুরু হল। আমি প্রতিযোগিতা-মূলক পরীক্ষার ম্যাগাজিন পড়াতাম। আর চন্দনদা গল্পের কপি করত। স্টাফরুমে বসা আমরা ছেড়ে দিলাম। 

এইভাবে স্কুলে স্টাফরুমের মূলস্রোত থেকে আমরা ছিটকে গেলাম বটে, কিন্তু আমার আর চন্দনদার মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠল। দু’একজন শিক্ষক মাঝেমধ্যে  আমাদের কাছে এসে আলাপ করে যেতেন। কী করছি, কেন করছি এইসব।

অমেলেন্দুবাবু আমাকে একটু-আধটু স্নেহ করতেন। একবার বছরের শুরুতে দুটো ডায়রি পেয়েছেন। আমাকে আর তৃপ্তিকে ডেকে দিলেন। বললেন, “ভাবলাম, বাচ্চা ছেলে-মেয়েদুটো পাক। আর একটা পেলে তপনকে দেব।” তপন স্কুলের চুক্তিভিত্তিক কম্পিউটার শিক্ষক।

তিনি মাঝেমধ্যে আমার পরীক্ষার প্রস্তুতিরও খোঁজ নিতেন। তবে একদিন তাঁর মুখে শোনা একটি কথা আমায় ব্যথিত করল। স্যারের চেম্বারে স্যার ও মনোরঞ্জনবাবু বসে ছিলেন। খুব নীচু গলায় কথা চলছিল তাঁদের। আমি ও চন্দনদা যথারীতি টেবিলে মাথাগুঁজে আমাদের কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ শুনলাম মনোরঞ্জনবাবুর প্রশ্ন, “আমলা হবে বিসিএস দিয়ে?”

অমলেন্দুবাবু বললেন, “হ্যাঁ, ইচ্ছে আছে। কিন্তু হবে না।”

আমার শোনার কথা ছিল না হয়তো এত নীচু গলার কথা। কিন্তু কী জানি মন একাগ্র হলে হয়তো প্রায় অশ্রুত কথাও শোনা যায়। অর্থাৎ ডবলুবিসিএস দিয়ে আমলা হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আমি তা হতে পারব না। আমার সে যোগ্যতা নেই। অমলেন্দুবাবুর অভিজ্ঞ দৃষ্টি আমার ভবিষ্যৎ পড়ে ফেলেছে।

শোনার পর কষ্ট হলেও মনে মনে কোনও প্রতিজ্ঞা করিনি যে আমাকে আমলা হতেই হবে সিভিল সার্ভিস পাশ করে। আমি চেষ্টা করতে পারি, ফলাফল তো আমার হাতে ছিল না। তবে মনে হত সরকারি অফিসের একটি কেরানির চাকরি পেলেও বেঁচে থাকা নিশ্চিত হবে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব। মাকে খুব ভালবাসতাম। আমার একটা চাকরি মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের মেঘভার লাঘব হবে। কিন্তু ব্যথা পেয়েছিলাম আড়ালের কথায়।


ভূগোলের শিক্ষিকা অনুপমাদির কথাবার্তায়ও স্নেহ ফুটে উঠত। একদিন তিনি  ডেকে আমাকে বললেন, “সোমনাথ, আমার হাজব্যান্ডের অফিসে একটি পোস্ট ভ্যাকেন্ট আছে। তুমি কি কাজটা করবে?”

শুনেই ধন্যবাদ জানিয়ে ‘না’ করে দিলাম। দিয়ে বেশ গর্ব হল আমার। স্বনির্ভরতা অর্জনের কোনও সহজ রাস্তা পছন্দ ছিল না আমার।  আমার রামকৃষ্ণকথামৃতে পড়া একটি গল্প মনে পড়ল। সংসারী মানুষ কোনও কিছুতেই মন ধরে রাখতে পারে না। একবার ভাবে এখানে বুঝি গুপ্তধন আছে। ফলে কোদাল চালায়। কিছুক্ষণ পরেই ভাবে এখানে নয়, অন্যত্র। কোনও কিছুতেই তাদের স্থিরতা নেই। কিন্তু যারা তত সংসারী নয়, হৃদয়ে খানিক বৈরাগ্য আছে, তারা একই জায়গায় খনন করে চলে। বিশ্বাস স্থির রেখে। একদিন ঠং করে আওয়াজ শোনে। কোদাল গিয়ে লাগে ঘড়ায়। তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। আরও খননের পর উঠে আসে ঘড়া-ভর্তি মোহর। নিজেকে এই দ্বিতীয় দলের ভাবতাম। সেই সঙ্গে বিবেকানন্দের অনেক বাণী আমার মুখস্ত। কেউ যদি কোনও কিছু পাওয়ার ঠিক ঠিক উপযুক্ত হয়, তবে জগতের কোনও শক্তি নেই তাকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে। সুতরাং আমার এই লড়াইয়ের কোনও সহজ সমাধান চাইনি, সেটা আমার পক্ষে সম্মানজনকও হত না। দেখাই যাক। এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে কোনও আলোকস্তম্ভ আছে কিনা। অনুপমাদির প্রস্তাব ফিরিয়ে নিজেকে সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র অরুণ মুখোপাধ্যায় মনে হল। রাতে একটা কবিতা লিখে ফেললাম—


অনুপমাদি, আপনার হাজব্যান্ডের অফিসে  

আমাকে চাকরি দিতে চেয়েছেন বলে 

আপনাকে লাখো সেলাম

সবিনয়ে ফিরিয়ে দিতে পেরে

নিজেকেও মনে হল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র

অরুণ মুখোপাধ্যায়, যিনি ছবি বিশ্বাসের

অফার ফিরিয়ে দিচ্ছেন, 

বিরক্ত ছবিবাবু বলছেন,

‘...তোমার চাকরির দরকার নেই?’


‘আছে।’


‘হাউ ডু ইউ এক্সপেক্ট টু গেট ওয়ান?...হাউ?’


‘নিজের চেষ্টায়।’


যদিও হিমালয়ান প্রেক্ষাপট নেই

তবু হিমালয়ান ভূত আমার মাথায়


অনুপমাদি, কবিতা লিখে আমেরিকা যাওয়া যায়

আমি কি কোথাও পৌঁছাব?


পিএসসি বত্রিশ

এসএসসি সাইত্রিশ হলেও

অতদিন টেনাসিটি থাকবে তো!


এভাবেই কিছু একটা

হলে ভাল, না হলেও...

আমার তো কাউকে কথা দেওয়া নেই!


সেসময় আমাদের আকাশ গ্রুপের এক বন্ধু কবিতা লিখে বেশ নাম করেছে। আমেরিকাতে গিয়েছে কবিতার কর্মশালায়। এই খবর কানে এসেছিল। কীজানি কোনও গোপন আত্মবিশ্বাস কাজ করেছিল কিনা। সে সময় তিনটি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দেওয়া ছিল—ডবলুবিসিএস, মিসসেলেনিয়াস এবং ক্লার্কশিপ। রজতাভর বিয়েতে শিলিগুড়ি থেকে আসার পর এই পরীক্ষাগুলোয় বসা। খুব খারাপ হয়নি। সেবক কালীবাড়ির ফুল পেনসিল বক্সে করে নিয়ে গিয়েছি পরীক্ষা হলে। মনের অবচেতনে পাশের সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে থাকবে।




***********************************************

আগামী পর্বে 

***********************************************



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন