রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

প্রবন্ধ * পারমিতা ভৌমিক




রবীন্দ্র-গানের দুকূলপ্লাবী জ্যোৎস্না 

পারমিতা ভৌমিক


রবীন্দ্রনাথ এমন এক মহৎ প্রতিভার অধিকারী যে আজও তাঁর প্রতিভার প্রসঙ্গ নিতান্তই প্রাসঙ্গিক বলে বিশ্বাস করতেই হয়।  প্রাতিভাকে আমি দুটি ভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারি। একটি তার সৌন্দর্যের দিক(aesthetics) অন্যটি দর্শনের দিক(philosophy)।

     রবীন্দ্রনাথ এক আধারেই কবি ও দার্শনিক কাজেই তাঁর মধ্যে এই দুইয়ের স্থিতাবস্থাই অনিবার্য ছিল।        

    সৌন্দর্য বা Aesthetics হল ক্রিয়েশনের এমন একটা দিক যা ব্যক্তিক ধারণার ওপরে গড়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই সেটা  হয়ে ওঠে আপেক্ষিক । যার যেমন বোধ তার তেমন সৌন্দর্যচেতনা সম্পর্কে ধারণা তৈরী হয়। অপরপক্ষে দর্শনের সত্য অনেক বেশি স্থায়ী ও প্রসারিত ও আপেক্ষিকতা বর্জিত। Aestheticsএর পিছনে ব‍্যক্তিক অনুভূতি পাল্টায় আর সেটাই কবিতাক্ষেত্রে গড়ে তোলে একজন মহৎ ও জনপ্রিয় কবিকে।

     সৃষ্টির আদিতে কবিও "দেখেন" দার্শনিকও "দেখেন"। কবি সুন্দর ও সত্যকে দেখেন, দার্শনিক আগে বিস্তৃত সত্যকে দেখেন পরে তাকে সুন্দরতা দান করেন। তাই দর্শনের সুন্দরতা এবং কবির  সুন্দরতা একটু স্বতন্ত্র।

     দর্শন বা philosophy অনেক বেশী স্থায়ী , কিন্তু কবির Aesthetics  রূপান্তরের বস্তু।

    রবীন্দ্রনাথের একটি অবিসম্বাদিত কবিসত্তা আছে । কবিতা তারই প্রকাশ। কিন্তু তাও কি সর্বৈবভাবে আপেক্ষিকতার বাইরে ? না। তা নয়। তাও তো যুগচৈতন‍্য ও সরিবেশচৈতন‍্য অনুযায়ী রূপান্তরিত হয়েছে । তবুও রবীন্দ্রনাথের নিজস্বতার শিল্প বনিয়াদ অনেক বেশি শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছিল। আর ঠিক এই কারণেই একসময় বাংলা কাব্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রবলয় মুক্তির কল্লোলীয় ভাঙচুর শুরু হয়েছিল ।

     আমরা জানি, খুব স্বাভাবিকভাবেই  কবিতার নিজস্ব ক্ষেত্র স্টাইল অবয়ব গঠন, সব পাল্টায়। যুগ যুগ ধরে তাইই হয়ে আসছে।তাহলে ব‍্যাপারটি নতুন করে চিন্তা করতে হয়। 

       ফিলসফি যদি সাহিত্য শাখার সঙ্গে যুক্ত করে নেওয়া যায় তার স্থায়িত্ব অনেক বেশি প্রসারিত হতে পারে, এমন একটা ধারণা আমরা রবীন্দ্রসাহিত্যে বিশেষত গানের ক্ষেত্রে করতেই পারি।গানে একই সঙ্গে থাকছে বাণী ও সুর। 

       গানে যে সুর থাকে তারই নাম সৌন্দর্য বা Aesthetics আর গানের বাণীতে থাকে দর্শন যা নাকি ঐ দর্শনের চাইতে অনেক বেশি জঙ্গম, এবং তাইই বাণীকে অনেক দূর পর্যন্ত উড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।

     আসলে সুরই হলো শক্তি । ফিলসফি হলো সত্য, এবং তা অনেকাংশে স্থবির। স্থিতির প্রশ্নে,কাল্টের একটা দীর্ঘযাত্রায় স্বাভাবিকভাবেই এই দুই-এর সামঞ্জস্য অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথ এর চূড়াচুম্বী intuitive mind তা বুঝে নিয়েছিল।

      আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সুরের ভাঙ্গা-গড়া এবং তাকে গ্রহণ-বর্জনের মাধ‍্যমে  নিজের মতো করে  আত্তীকরণ করায় রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বিরল প্রতিভা। 

      তিনি বুঝেছিলেন বাণী যত philosophical হবে ততই তা বহন করবে  ঊর্ধ্বমুখী এক ব্যপ্তি।  কিন্তু এর একটা  horizontal ব্যপ্তির দিকও তো আছে , তার জন্য তো আবার  সুরটিও দরকারি। বস্তুতঃ এই উল্লম্বতা ও আনুভূমিকতার মধ‍্যে একটা archway দরকার। একটা স্বর্গমর্তের মেলবন্ধন দরকার। এর বিজ্ঞান সূত্রই হল সংগীত।

    রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ভেবেছিলেন, তাহলে বরং সুরকে রৈবিকতা দেয়াই ভালো এবং এই দেয়াতে তাঁর মহৎ ইগোও মুক্তি পেতে পারে।

     এমন ভাবনা ভেতরে ভেতরে যত রূপ নিতে শুরু করল ততই রবীন্দ্রনাথের মধ‍্যে একটা পূর্ণ transformationঘটে যেতে লাগল। বলাবাহুল্য রবীন্দ্র সাহিত্যে এই রূপান্তরের পরিণমনটি হয়ে উঠল অলৌকিক। এ এক এমন রসায়ণ ঘটাচ্ছিল যা বাইরে থেকে খুব সহজে বোধে আনা যায় না। এ এক সামগ্রিক রূপান্তর। এখানে রবীন্দ্রমানস, রবীন্দ্রচিন্তা রবীন্দ্রযাপন ও রবীন্দ্র রঞ্জনতত্ত্ব (আইডিয়ালিজম) এক হয়ে গেছে তাঁর aesthetic বোধের সঙ্গে।

     খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর গানগুলিও তাই হয়ে উঠেছে সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের সাম্যরস‍্যে আরো স্থায়ী সুন্দর। এটা রবীন্দ্রনাথ সুসংহত ভাবে করতে পেরেছেন। তাঁর গান ঠিক তখনই হয়ে উঠেছে একটা উড়ন্ত কাঠামো( structure) ।

     সবচেয়ে বড়ো কথা এই যে, কোনও দ্বান্দ্বিকতার উগ্রতার মধ্য দিয়ে এই পরিণত রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাইনি । একটা স্বতঃস্ফূর্ত লগ্নতায় তাঁর গান হয়ে উঠেছে তাঁর  পারাণির কড়ি।কিন্তু গান তাঁর শেষ পারানির কড়ি নয় ।জনান্তিকে বলে রাখি,  তাঁর শেষ পারানির কড়ি হল তাঁর আঁকা‌। 

     কবিতা অন্তঃস্থ লিরিকই , কবি রবীন্দ্রনাথের স্থায়ীভাব ছিল। ঈশ্বরমগ্নতা তাঁর সেই ভাবকে তীর্ণ করে দিয়েছিল অতীন্দ্রিয়তায়।

    স্বীকার করতেই ভালো লাগে যে ঈশ্বরমগ্নতা একটা অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা । যেসব কবিদের সত্তার সমর্পণ সম্পূর্ণ হয় পরমের কাছে, তাঁদের কাব্য সীমানাটি চিহ্নিত ও স্থিরীকৃত হয়ে যায় সেখানেই । এই বোধে কবি হয়তো তাঁর জীবনকে গুছিয়ে নিতে পারেন। তবু  কিন্তু বলতে বাধা নেই যে মুক্ত আত্মার অন্তিম অভিজ্ঞতা এর পরেও তাঁর কাছে অনায়াত্তই থেকে যায়।

         আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর শেষ পারানির কড়ি যদিও হয়ে থাকে  তবুও কিন্তু একইসঙ্গে একথাও সত্য যে এই আত্মিক সাধনায় কিন্তু  তিনি কোন অন্তিম ঠিকানায় পৌঁছাতে পারেননি।

      তাই তাঁর সামগ্রিক জীবনের  রূপান্তরটাই বড় সত্য বলে মনে হয়েছে। আর সেই রূপান্তরটিই ঘটছিল রবীন্দ্রনাথের সমগ্র আন্তরচেতনায়--- প্রথম থেকেই। 

      একদিকে ঊর্ধ্বমুখী টান ছিল অন‍্যদিকে নীচে, শেকড়ের আদর ছিল ― বস্ততঃ এই দুই টান মিলে কবিসত্তায় ঘটে যাচ্ছিলো অনন্ত রূপান্তর। সে এক মহৎকবির মহার্ঘসাধনা যা আগামী হাজার বছরেও আর হবে কিনা সন্দেহ।

      রবীন্দ্রসত্তায় রয়েছে, কবিত্ব ও অন্তর সন্ন্যাসের একটা অদ্ভুত যৌগ। তিনি আগে কবি নাকি আগে যোগী তা কিন্তু অসংশয়ে  বলা যায় না। আসলে তো মানবজীবনের বৈষম্যই মানুষকে দ্বিখন্তিত করেছে । আর এই দুই খণ্ডকে একত্র করাই মানুষের অন্তিম সাধনার লক্ষ্য হতেই হবে।

      রবীন্দ্রনাথের মধ‍্যেও এমনটাই ঘটতে দেখি। গান তাঁকে রচনা করতেই হতো কেননা এটি ছিল তাঁর ঊর্ধ্বের সাধনা আর কবিতা লেখা ছিল তাঁর কাছে পৃথিবীর মধুময় স্বীকৃতি। সৌন্দর্য ও নন্দনের পথ। কাজেই গান না লিখলে কি হতো ? কি হতে পারত? অথবা কী হলো ?-----এইসব প্রশ্ন অবান্তর কেননা সমগ্র রবীন্দ্রচেতনাই একটা অনিন্দ্যসুন্দর সমীকরণ।

      রবীন্দ্রনাথ ভাবতেন জড়ের বন্ধনই আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে, অসামঞ্জস্যকে, বড় করে তোলে এবং কেবলমাত্র সঙ্গীতই তা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে । এ তাঁর আত্মগত ভাবনা। এ ছিল তাঁর বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করতেন সংগীতই আপন বিস্তীর্ণতার মধ্যে আমাদের ছোট ছোট গণ্ডীগুলোকে ভেঙে দিতে পারে। তিনি অনুভব করতেন, অনন্ত যখন আলোর রাখি বাঁধতে আসে তখন তার ভাষিক প্রকাশই হয়ে ওঠে  সঙ্গীত। বস্তুতঃ সঙ্গীতধর্মেই কম্পমান পক্ষের আঘাতবেগেই খুলে যায় "অতি চৈতন্যলোকের সিংহদ্বার"।

এই বোধেই তো কবি তাঁর গান বেঁধে নিতে চেয়েছিলেন। গীতবিতানের পূজা-পর্যায়ের প্রথম বত্রিশটি গান থেকেই বোঝা যাবে সেই অনির্বচনীয়ের টান তাঁকে কিভাবে আকুল করে রেখেছিল-----

"নিত্যকালের গোপন কথা বিশ্বপ্রাণের ব্যাকুলতা,

আমার বাঁশি দেয় এনে আমার কানে"।

   একটা অপূর্ণতার বেদনা তাঁর ছিল। অনন্তের সঙ্গে তাঁর প্রাণ এক-সুরে মেলেনি সব সময়ে। এই alienation এর  বেদনা মুছে গেছে তখনই যখন যেখানে তাঁর সঙ্গে পরমের মিলন পূর্ণ হয়েছে। ঠিক তখনই গান স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে আপন বেগে চলেছে। এইটাই তাঁর প্রার্থিত ছিল। 

     বলাবাহুল্য মানব চিন্তার খণ্ড খণ্ড এলাকা ছেড়ে কবি-চেতনার গোপন গুহাহিত অভীপ্সা ও  অভিজ্ঞতাগুলোই এক একটি সম্পূর্ণ গান হয়ে উঠতো। তখনই একথা সত্য হয়ে, সংগীত হয়ে, বেজে উঠত-----"আপন গানের কাছেতে  আপনি হারি"। এই হেরে যেতে যেতে যত দিন যাচ্ছিল ততই রবীন্দ্রনাথ সংগীতময় হয়ে উঠছিলেন।

     যতদিন কবি হিসেবে তিনি তাঁর কবি-স্বভাবোচিত ভাবছবি এবং বাকপ্রতিমা রচনা করে আত্মিক আগ্রহকে রূপ দিতে চেয়েছেন ততদিন পর্যন্ত সুর (lyric) ছিল কেবলমাত্র তাঁর ভাবনার বাহন। সেই আগ্রহই একদিন আত্মিক অভিজ্ঞতার স্তরে এসে পৌঁছেছে। তবে তাতে সময় লেগেছিল অনেক। 

   চেতনার রূপান্তর ঘটতে সময় তো  লাগেই। সেই রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে গানই ক্রমশঃ হয়ে উঠেছিল তাঁর অন্তিম সাধনা।         

তবুও কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন কবি । তাঁর বিশ্বাসের জগৎটা ছিল বিস্ময়কর। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ জগৎ ও জগদাতীত ---উভয় রাজ‍্যেরই বাসিন্দা। আর এই দুই জগতের মধ্যে যোগাযোগের অনিবার্য সেতু হয়ে উঠেছিল তাঁর গান ।

    এই গানের সত্য ও সুন্দরের সঙ্গে তাঁর নান্দনিকতা ও আত্মিকতা অভিন্ন হয়ে গেছে। একটা   অমর্ত্য আলোক ধ্বনিকে যেন তিনি মাটিতে বাসা বুনে দিয়েছেন -----

     "সেথায় তরু তৃণ যত

     মাটির বাঁশি হতে ওঠে গানের মত

     আলোক যেথা দেয় গো আনি

     আকাশের আনন্দ বাণী

     হৃদয় মাঝে বেড়ায় ঘুরে গানের সুরে"-----

     বস্তুতঃ রবিকবির উপলব্ধিতে  সত্য যত ভাস্বর হয়েছে ,যত সুদুরপ্রসারী হয়ে উঠেছে, তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্যও মহত্ব-ও তত গভীর হয়েছে।

     কবি উপলব্ধি করেছেন যে, ধুলোমাটির পৃথিবীকে একান্ত ভাবে আঁকড়ে রেখে দেয় যে মন সেই মনই আবার বিশেষ অনির্বচনীয় মুহূর্তে সুদূরের স্পর্শের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে।

    এই দু'মুখো টানে যে মন দিশাহীন তার একান্ত আশ্রয় যেন হয়ে উঠতে পারে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) গান। 


    রবীন্দ্রনাথ জগৎসীমার রূপ কল্পগুলির আড়ালে বারে বারে ছুঁয়ে গেছেন আমাদের এবং একইসঙ্গে ছুঁইয়ে দিয়েছেন অসীম স্পন্দনের জীবন্ত জাদুকাঠির স্পর্শ‌। যে স্পন্দন কখনো আলোছায়াময়, কখনোবা স্বচ্ছ‌। তা সে যেমনই হোক , সেখানেই ধরা পড়েছে আকাশ ও মাটি---সুরে ছন্দে , বড় আপনার হয়ে-------"যে গান তোমার সুরের ধারায় /জগত জাগায় তারায় তারায়/মোর আঙিনায় বাজল সে সুর/আমার প্রাণের তালে তালে"।

       বারবার বলতেই হয় যে রবীন্দ্রনাথের কাব্য সৃষ্টির মূল কথা হল সৌন্দর্য তা সে বহিঃ-প্রকৃতি-রাজ্যের হোক বা অন্তর-প্রকৃতি- রাজ্যেরই হোক। কায়ায় হোক আর মনেই হোক বা বাক্যেই হোক, সবখান থেকেই তিল তিল করে সৌন্দর্য চয়ন করে তিনি গড়েছেন কাব্যের তিলোত্তমা মূর্তি।

    তাঁর ভাষা, তাঁর শব্দলালিত্য, তাঁর ছন্দের লাস্য তাঁতেই পরাকাষ্ঠা লাভ করেছে।

   রবীন্দ্রনাথের ভাব সুন্দর, তাঁঁর চিন্তার বৈদগ্ধ সুন্দর,  তাঁর অনুভবের সৌকুমার্য ও তার বিচিত্রতাও মনোহারী। এমনকি তাঁর আখ্যানের বিষয়বস্তু নির্বাচনটিও  সুন্দর। 

    শুধু তাই নয় শব্দের অলংকারে, অর্থের অলংকারে এবং মন্ডনের উপর মন্ডন সাজিয়ে দিয়ে তাকে আবার অধিকতর অলংকারে অলংকৃত ও সুন্দর করে মেলে ধরেছেন তিনি।

      রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আসল মানুষটি হলেন একজন ঐন্দ্রজালিক রূপকার। রূপ সৃষ্টি তাঁর অন্তর পুরুষের ধর্ম। তাতেই তাঁর স্বভাবের নিত্যসিদ্ধি। জ্ঞান ও শক্তির দিক দিয়ে তিনি যতখানি উপরে উঠেছেন তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি সৌন্দর্যের দিক দিয়ে। তাঁঁর অন্তরপুরুষটি যেন এসেছেন গন্ধর্বলোক থেকে।

     রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য এই যে তাঁঁর অন্তরস্থ কবিপুরুষই তাঁঁর সমস্ত সত্তাকেই ছেয়ে আছে। তিনি কাব্য যদি কিছু নাও লিখতেন তবু তাঁঁর জীবনখানি একখানি সুন্দরের জীবন্ত কাব্য হয়ে থাকতো। তিনি সুদর্শন । তাঁঁর  ব্যবহার সুন্দর তাঁঁর কর্ম সুন্দর , তাঁঁর ধর্ম সুন্দর। তিনি সুন্দরকেই সৃষ্টি করতে করতে চলেছেন---- এ  যেন সৌন্দর্য থেকে যাত্রা করে সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে সৌন্দর্যের অভিমুখে চলে যাওয়া। আসলে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্পুরুষ  রূপকৃৎ। এইরূপ, আকার-সৌষ্ঠবে ধরা দিয়েছে তাঁর ছন্দের স্পন্দনে। একেই তিনি আঁকড়ে ধরেছেন সুর বলে। চেয়েছেন বাণীতে সুরযোজনা করতে। কেননা কেবলমাত্র সৌন্দর্যের গঠন নয়  গতিতেও তাঁঁর সৃষ্টি সাবলীল‌ হোক এ ছিল তাঁর সাধনলক্ষ‍্য। তিনি ভালো করেই জানতেন ফিলসফি পৌঁছে যাবে সর্বজনের মধ‍্যে। তার ভাষা (philosophy) তাই হয়ে উঠলো সর্বজনবোধ‍্য সহজ সরল। 

        অর্থের আড়ালে যে ব্যঞ্জনা আছে স্থূলবাক্যের অন্তরে যে অশরীরী ভাব আছে তাকেই কবি সহজ রূপ দিতে চাইলেন গানে-----

     "আমি দেখি নাই তার মুখ আমি/ শুনি নাই তার বাণী।"/কেবল শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার/পায়ের ধ্বনি খানি।"

"মন দিয়ে যার নাগাল নাহি পাই

গান দিয়ে সেই চরণ ছুঁয়ে যাই

সুরের ঘোরে আপনাকে যাই ভুলে"----এই সহজতাই তাঁর গানকে তাঁর প্রতিভার অনিবার্য পরিণতি দান করল। ফিলসফিকে এভাবে মুক্তি দিতে কজন পেরেছেন? এভাবে ফিলসফিকে চলৎশক্তি কজন দিতে পেরেছেন এত জনপ্রিয়ভাবে ? এ ছিল তাঁর অবলীল ও শেষ পূর্ণতার স্বাক্ষর। এমনটাই তো হবার ছিল।

    রবীন্দ্রনাথের  গানই হল রূপের চলমূর্তি। রূপকে তিনি স্থির সমাধির বিষয়ে করে রাখেন নি।

     তবে একথাও একেবারে অস্বীকার করা যাবে না যে কবির এই শব্দময়ী চলিষ্ণু প্রেরণা, স্তব্ধতাকে ভেঙে বেশিদূর যেতে পারেনি । হয়তো তা তাঁর প্রার্থিতও ছিল না।

   এই চলোধর্মের বাঁকে বাঁকে কি একটা ভাবের ঘোর, একটা সুরের লয় থেকে থেকে এমন মীড় টেনে নিয়েছে যে মনে হয় তারা যেন সব ফিরতিপথে একটা শান্তির ও স্তব্ধতার  তটে গিয়ে মিশেছে। কবির মুখরতা যেন অন্তর পুরুষের নিবিড় মৌনতার সঙ্গেই কোলাকুলি করে আছে।

         ভাবলে বিস্ময় জাগে, স্থূল শব্দের হূলস্থূলের  জগৎ নিয়ে খেলতে খেলতে , সেসব ফেলে কখন যেন কবি ভাবে ও ভঙ্গিতে তাকে ছেড়ে উঠে গেছেন একটা শুচিতা,স্বচ্ছতা , লঘুতা, লালিত‍্য ও লাবণ্যের রাজপাটে।

      মনে হয় কীটসের মত রবীন্দ্রনাথের হৃদয়বাণীতেও উচ্চারিত হয়েছে সুর----"Heard melodies are sweet but those unheard/ are sweeter".....

    রবীন্দ্রনাথেও শুনি-----"যে গান কানে যায় না শোনা/সে গান যেথায় নিত‍্য বাজে/প্রাণের বীণা নিয়ে যাব/সেই অতলের সভা মাঝে।"

      রবীন্দ্রনাথ আসলে সত‌্য ও মঙ্গলের সাধনা করেছেন সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গানই তাঁর কবিসত্তার সৌন্দর্যময় সত‍্যযাত্রা যা মঙ্গলের দিকে অভিমুখ স্থিরবদ্ধ করেছে।

    রবীন্দ্রনাথের গান আরোগ‍্য নিকেতন। আমাদের বিশ্লিষ্ট সত্তার উপশম ও পথ‍্য। 

আবার বলি রবীন্দ্রনাথের গান কোনো বিক্ষিপ্ত প্রকাশ নয়, সমগ্র রবীন্দ্রনাথের সুষ্ঠ পরিণাম যা অনিবার্য ছিল।












********************************************************************************



পারমিতা ভৌমিক

বাংলা কবিতার আলোচনার জগতে পারমিতা ভৌমিক একটি অতি পরিচিত নাম। কবিতার রহস্যময় দুর্ভেদ্য মায়াটান তাঁর আলোচনার প্রসাদগুণে প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। কবিতাপাঠের অনাস্বাদিত আনন্দে ভরে ওঠে পাঠকমন। স্বরবর্ণের বর্তমান সংখ্যায় আমরা পড়ছি রবীন্দ্রনাথ-এ কবিমানসের উপর তাঁর মননঋদ্ধ আলোচনা।

  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন