সিদ্ধার্থ সিংহ
প্রত্যেকটি গান রেকর্ড করার শেষে যিনি বলতেন, 'মাই নেম ইস গওহর জান'। ঠিক সেভাবে আর কোনও শিল্পীকে... না, উদ্ধত্য নয়, নিজের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের নাম বলতে শোনা যায়নি। তিনি যে কত বড় তারকা ছিলেন এবং কত টাকা উপার্জন করতেন‚ আবার সেই টাকা জলের মতো খরচও করতেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই৷ শোনা যায়‚ পোষা বিড়ালের বিয়েতে বিশ শতকের গোড়ায় তিনি খরচ করেছিলেন বারোশো টাকা৷ সেই মেনি যখন মা হল‚ সেই আনন্দে গওহর যে পার্টি দিয়েছিলেন তাতে খরচ করেছিলেন দু’হাজার টাকা৷
যখন সাধারণ লোকদের ঘোড়ায় টানা গাড়ি ব্যবহার করা ছিল নিষিদ্ধ। সেই সময় চার ঘোড়ায় টানা বুগি গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি এবং সে জন্য প্রত্যেক দিন ভাইসরয়কে জরিমান বাবদ এক হাজার টাকা করে দিতেন।
তিনি তা হাসিমুখেই দিতেন। কারণ মেহফিলে তাঁর নজরানা ছিল এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা৷ রেকর্ডিং পিছু নিতেন তিন হাজার টাকা৷
কত টাকা? যখন এক তোলা সোনার দাম খুব বেশি হলে ২৮ বা ২৯ টাকা, মনে রাখতে হবে এক তোলা সোনা মানে কিন্তু এখনকার ১০ গ্রাম নয়, তার থেকে কিঞ্চিৎ বেশি। মানে ১১.৬৬৩৮০৩৮ গ্রাম। এই সোনার দাম অনুযায়ী গওহর একটি গান রেকর্ডিং করার জন্য পেতেন এখনকার হিসেবে প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা।
নিয়মিত বাজিও ধরতেন রেসের মাঠে৷ একবার অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সময় তাঁর আবদারে ভাড়া করতে হয়েছিল আস্ত একটা ট্রেন৷ সেই ট্রেনে বাজনদার ছাড়াও গওহর নিয়ে গিয়েছিলেন নিজস্ব রাঁধুনি‚ রাঁধুনির সহকারী‚ হাকিম‚ ধোপা‚ নাপিত এবং খাস চাকর৷
১৮৭৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের এক ইহুদি পরিবারে তাঁর জন্ম। জন্মসূত্রে গওহরের নাম ছিল এইলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড। তাঁর দাদু ছিলেন ব্রিটিশ৷ দিদিমা ভারতীয়৷ বাবা রবার্ট ইয়ার্ড ছিলেন স্থানীয় বরফকলের ইঞ্জিনিয়ার এবং মা ভিক্টোরিয়া হেমিংস ব্রিটিশ পরিবারভুক্ত হলেও আদতে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তিনি ছোট থেকেই নাচগানে পারদর্শী ছিলেন।
অ্যাঞ্জেলিনার বয়স যখন মাত্র ছ'বছর, তখনই তাঁর বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেই বিচ্ছেদের পরে দীর্ঘদিনের প্রেমিক খুরশেদ আলমকে বিয়ে করে গওহরের মা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন তাঁর নতুন নামকরণ হয় মালকা জান। আর মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনার নাম হয় গওহর... গওহর জান।
সেই খুরশেদের থেকেও আঘাত পেয়ে আরও বেশি করে নাচগানের জগতে নিজেকে সঁপে দেন মা মালকা জান। কত্থক শিখলেন। ঠুমরি শিখলেন। স্বয়ং উস্তাদ ইমদাদ খানের তত্ত্বাবধানে সারেঙ্গির সুরে মজলিস আলো করে গান গাইতেন মালকা আর মায়ের পাশে বসে তাল মেলাতেন বালিকা গওহর।
মেয়ের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান মালকা জান। জমানো টাকা দিয়ে চিৎপুরে কেনেন একটি বিশাল বাড়ি। সেই 'গওহর বিল্ডিং' মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই কলকাতার বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান হয়ে ওঠে। সেই বাড়িতেই গওহরের পড়াশোনা, গান ও নাচের তালিম চলতে থাকে বেনারস ঘরানার বিরাট বিরাট শিল্পীদের কাছে। পেশায় গায়িকা মালকা জানের জায়গা হয় নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দরবারে। সেখানে নবাবের ব্যক্তিগত অনুরাগিণী ও নর্তকী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।
মেয়েকে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। সে সময় নবাবের দরবারে আনাগোনা ছিল ভারতবর্ষের অনেক নামজাদা সংগীতজ্ঞের। তাঁদের সান্নিধ্যেও সংগীতচর্চা শুরু করেন গওহর। কিংবদন্তি কত্থকশিল্পী বৃন্দদিন মহারাজ, ধ্রুপদ শ্রীজনবাঈ, চরণ দাসের কাছে বাংলা কীর্তনের তালিম নেন এবং অচিরেই নৃত্য ও সঙ্গীত পটিয়সী হয়ে ওঠেন তিনি। শিখতে শুরু করেন রবীন্দ্রসংগীতও। সংগীতের আরও নানা ধরন--- ধ্রুপদ, টপ্পা, খেয়াল, ঠুমরি, ভজন, দাদরা, চৈতি, গজল, ধামার, বিষ্ণুপুরী এবং কাজরি গানেও পারদর্শী হতে শুরু করেন গওহর।
মা এবং পণ্ডিতদের সান্নিধ্যে গান ও নাচের পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষাও রপ্ত করা শুরু করেন তিনি।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে গানের আসরে অভিষেক ঘটে তাঁর। তাঁর প্রথম পরিবেশনাতেই বিহারের দারভাঙ্গা দরবারের কর্তারা এত মুগ্ধ হন যে, ক'দিন পর দরবারের প্রধান সংগীত ও নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে।
ধীরে ধীরে রাজা এবং জমিদারদের মেহফিলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন গওহর। বিশেষ করে ঠুমরি গাইতে গাইতে তাঁর নাচ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৮৯৬ সালে কলকাতার অনুষ্ঠানে 'ফার্স্ট ড্যানসিং গার্ল' হিসাবে পরিচিতি পান তিনি। এর আগে যেহেতু এই ধরনের উপস্থাপনার চল ছিল না, ফলে এ ক্ষেত্রে তাঁকে 'রকস্টার'-এর প্রবর্তক বলা যেতেই পারে। এরপর দেশের বিভিন্ন শহরে মেহফিল করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
একটা-দুটো নয়, বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠা, তামিল, আরবি,পার্সি, পাশতুন, ফরাসি এবং ইংরাজি মিলিয়ে প্রায় দশ-বারোটি ভাষায় অনায়াস গাইতে পারতেন তিনি। তাঁর লেখা উর্দু ও হিন্দি নজম গান রূপে সুরারোপিত হয়েছে বহুবার, প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় সংগীত পত্রিকায়।
এ ছাড়া ভারতবর্ষের স্টেট রাজসভাগুলো থেকেও একের পর এক ডাক পেতে শুরু করেন তিনি। এমনকী রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক উৎসবেও দিল্লি থেকে বিশেষ আমন্ত্রণ পান গওহর।
এ দিকে রাজ-উজির ও বাবুদের কাছ থেকে দামি উপহার পেতে পেতে তাঁর সম্পদের পরিমাণও পাহাড় প্রমাণ হয়ে ওঠে।
১৯০২ সালে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে স্থানীয় কার্যালয় খুলতে ভারতবর্ষে আসেন গ্রামোফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেডের রেকর্ডিং প্রকৌশলী উইলিয়াম ফ্রেডরিক গেইসবার্গ। গ্রামোফোন কোম্পানির পক্ষ থেকে স্থানীয় শিল্পীদের গান রেকর্ড করতে আসা গেইসবার্গ আমন্ত্রণ পান এক বাঙালি বাবুর নৈশভোজে।
সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী গওহর জান। তাঁর গান শুনে, রেকর্ড করার জন্য আগে অনেকের গান শুনলেও, সেই নৈশভোজেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন প্রথম শিল্পী হিসেবে গওহর জানের গানই তিনি রেকর্ড করবেন।
তবে কলকাতার তৎকালীন 'হার্টথ্রব' এত সহজে রাজি হননি। রেকর্ডিংয়ের প্রতি সেশনের জন্য তিনি দাবি করেন তিন হাজার টাকা। যেটা সেই সময়ে কল্পনাই করা যেত না। তবু তাতেই রাজি হয়ে যান গেইসবার্গ।
ফলে ১৯০২ সালের ১১ নভেম্বর ভারতবর্ষের প্রথম রেকর্ডিং আর্টিস্ট হিসেবে ইতিহাস গড়ে ফেলেন গওহর জান।
এর পরেই এ দেশে গওহর জানের পাশাপাশি বিখ্যাত হয়ে ওঠে গ্রামোফোন কোম্পানি৷ সেই শুরু৷ ১৯০২ থেকে ১৯২০ অবধি নিজের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে মোট ১০টি ভাষায় প্রায় ৬০০টি গান রেকর্ড করেছেন গওহর। তাঁর গানের ভাণ্ডার যেমন সুবিশাল, তেমনি বৈচিত্র্যময়। 'খেয়াল'-এর মতো ভারী উচ্চাঙ্গ সংগীত যেমন রেকর্ড করেছেন, তেমনি রেকর্ড করেছেন ঠুমরী, দাদরা, কাজরি, হোরি, চৈতি ও ভজনের মতো হালকা ঘরানার হিন্দুস্তানি গানগুলিও।
ছোটবেলা থেকে রাজবাড়িতে বড় হওয়া গওহরের বেশভূষা ও আচার-আচরণও ছিল ভীষণ রাজকীয়। সব সময় এমব্রয়ডারি শাড়ি এবং ভারী গয়না পরা এই শিল্পীর সাজগোজ কোনও রাজরানির চেয়ে কম ছিল না।
কর্মজীবনে যশ-খ্যাতির শিখরে পৌঁছনো গওহরের ব্যক্তিগত জীবন কিন্তু মোটেও সুখের ছিল না। বেনারসের ছাগন রাই এবং নিমাই সেনের মতো বাবুদের সঙ্গে পর্দার আড়ালে প্রণয় হলেও কেউ তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেননি।
এমন সময়ে জীবনে এলেন গুজরাটের বিখ্যাত অভিনেতা অমৃত কেশব নায়ক৷ মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণার শোক ভুলতে অমৃতের আশ্রয় খুঁজছিলেন গওহর৷ সে সময় তাঁর সঙ্গে সত্যিকারের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও ১৯০৭ সালে অমৃতর অকাল মৃত্যুতে সমাপ্তি ঘটে তারও।
একসময় ব্যক্তিগত সহকর্মী ও তবলচি সৈয়দ আব্বাসকে বিয়ে করেন গওহর। আর এই একটা ভুল পদক্ষেপই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের পতন ঘটায়। গওহরের চেয়ে বয়সে বেশ ছোট আব্বাস এই সম্পর্কের অপব্যবহার করেন ভয়ানকভাবে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া থেকে স্ত্রীর সম্পত্তি দু'হাতে ওড়ানোর ফলে তাঁদের সম্পর্কে ভাঙন ধরে। আর সেই সম্পর্ক থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কোর্টকাছারি, মামলা-মোকদ্দমা চালাতে গিয়ে ভুল লোকের পাল্লায় পড়ে শেষ পর্যন্ত গওহরকে প্রায় সমস্ত সম্পত্তি হারাতে হয়। এমনকী তাঁর বড় সাধের চিৎপুরের 'গওহর বিল্ডিং' পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়। হাত বদল হতে হতে তার নাম এখন 'সেলিম মঞ্জিল'।
সে সময় মহীশুরের মহারাজা নলভাদি কৃষ্ণরাজা ওয়াদেয়ার তাঁর রাজদরবারে সংগীতশিল্পী হিসেবে গওহরকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তত দিনে লড়াই করার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে বসেছেন তিনি।
১৯৩০ সালের ১৭ জানুয়ারি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মহীশুরের কে আর হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন গওহর। মৃত্যুকালে এই নিঃসঙ্গ শিল্পীর বিছানার পাশেও কেউ ছিল না।
যে দু'জন শিল্পী, মানে মা মালকা আর মেয়ে গওহরের গান শুনে আর এক কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী বেগম আখতার এতটাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেছিলেন তিনি। সেই গওহরের পরিণতি যে এমন হবে গহরের জীবদ্দশায় তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
*******************************************************************************
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন