রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

প্রবন্ধ * দেবাশিস সাহা

 



শ্রীচৈতন্যের দেহকান্তি, অরূপের রূপ

দেবাশিস সাহা 


শ্রীচৈতন্য বাঙালির আবহমান আবেগ। ভক্তের চোখে তিনি ভগবান। শ্রীকৃষ্ণের অবতার। বৈষ্ণব পদাবলীর মূল রসের দিক দিয়ে বিচার করলে তিনি রাধা-কৃষ্ণের মিলিত অবতার। 'শিক্ষাষ্টকম্' নামে আটটি সংস্কৃত শ্লোক ছাড়া তিনি নিজে আর বিশেষ কিছুই লেখেননি। অথচ, বিগত পাঁচ শতকেরও বেশি সময় ধরে তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র পুথি, গবেষণা ও আলোচনা-গ্রন্থ। অধ্যাপক-গবেষক বিমানবিহারী মজুমদার লিখেছেন, 'ভারতবর্ষে শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করিয়া যত গ্রন্থ রচিত হইয়াছে এত আর অন্য কোন ব্যক্তির সম্বন্ধে লিখিত হয় নাই। শ্রীচৈতন্যের জীবনকাল হইতে আরম্ভ করিয়া আজ পর্যন্ত তাঁহার যত জীবনী বা জীবনের কোন ঘটনা লইয়া স্তব পদ বা কাহিনী রচিত হইয়াছে সেগুলি একত্র সংগ্রহ করিলে বেশ একটি লাইব্রেরী হইতে পারে।' বাস্তবিক, বাঙালির চৈতন্য-জিজ্ঞাসা কিছুতেই ফুরোয় না। তার কারণ বোধহয় এই, তিনি বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের নন, বিশ্বমানবের। রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, 'চৈতন্যদেব শাক্তও নহেন, বৈষ্ণবও নহেন, সন্ন্যাসীরও নহেন--- তিনি সকলেরই।' অকাতরে তিনি প্রেমভক্তি বিলিয়েছেন জাত- পাত, স্পৃশ্য- অস্পৃশ্য ভেদাভেদ ভুলে, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন পরিসরে (১৪৮৬ -- ১৫৩৩ খ্রি:)।


     তো প্রশ্ন, সকলেরই প্রিয় প্রেমের এই অবতারপুরুষটি দেখতে কেমন ছিলেন? কেমন ছিল তাঁর দেহকান্তি? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজব, তার আগে স্মরণ করি, মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের বিশারদ, বিদগ্ধ সমালোচক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফের একটি উক্তি, 'বাংলাদেশে দুইবার এক দেহে অসামান্য রূপগুণের সমাবেশ ঘটেছিল একবার চৈতন্যদেহে অন্যবার রবীন্দ্র শরীরে।'


     এ নিবন্ধের বিষয় চৈতন্য শরীর। সন্ন্যাস গ্রহণের আগে চৈতন্য গোরা, গৌরাঙ্গ, বিশ্বম্ভর, নিমাই নামে পরিচিত ছিলেন। এই সব নামের মধ্যেই তাঁর গায়ের রঙের আভাস পাওয়া যায়। চৈতন্য জীবনীকাররাও তাঁর চেহারার মাধুর্য বর্ণনা করেছেন। 'গোবিন্দ দাসের কড়চা'য় এর একটি উজ্জ্বল চিত্র পাওয়া যায়। গোবিন্দ দাস কর্মকার ছিলেন চৈতন্যের ছায়াসঙ্গী। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বা বৃন্দাবন দাস তাঁর জীবনী রচনা করেছেন অনেক পরে। ষোড়শ শতকে। তাঁরা কেউ-ই শ্রীচৈতন্যকে দেখেননি। গোবিন্দ দাস সম্পর্কে দীনেশ চন্দ্র সেন জানাচ্ছেন, '১৫০৮ খ্রিস্টাব্দ হইতে সম্ভবত চৈতন্যপ্রভুর তিরোধান পর্যন্ত গোবিন্দ তাঁহার অনুগামী ছিলেন।' অতএব, শ্রীচৈতন্যকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল গোবিন্দ দাস-এর। যেমন হয়েছিল মুরারি গুপ্ত-র। মুরারি এবং নিমাই ছিলেন গঙ্গাদাস পন্ডিতের টোলের ছাত্র। বলা যায় সহাধ্যায়ী। যদিও বয়সে  মুরারি নিমাই-এর চেয়ে অনেকটাই বড়। পরবর্তীকালে, মুরারি চৈতন্যের জীবনী রচনা করেছেন, যা 'মুরারি গুপ্তের কড়চা' নামে প্রসিদ্ধ। সংস্কৃতে লেখা কড়চার প্রথম সর্গেই মুরারি গৌরসুন্দরের জয় গেয়েছেন----

'স জয়ত্যতিশুদ্ধবিক্রমঃ কনকাভঃ কমলায়তেক্ষণঃ।

বরজানুবিলম্বিসম্ভুজো বহুধা ভক্তিবয়াভিনর্ত্তকঃ।।

অর্থাৎ অতি শুদ্ধ বিক্রম- শৌর্য্যাতিশয় যুক্ত, স্বর্ণবর্ণ পদ্মপলাশলোচন, আজানুবিলম্বিতভুজ এবং ভক্তিরসে বহু প্রকারে নর্তন-পরায়ণ সেই গৌর সুন্দরের জয় হোক।'


     ফিরি গোবিন্দ দাস-এর বর্ণনায় । গোবিন্দ দাস তাঁর কড়চার শুরুতেই কবুল করেছেনঃ স্ত্রী শশিমুখীর সঙ্গে ঝগড়ার পরিণামে ঘর ছেড়েছেন তিনি। নিজের গ্রাম কাঞ্চননগর ছেড়ে কাটোয়া হয়ে পৌঁছেছেন নদিয়ায়। গঙ্গার ঘাটে। 'লোকে বলে শচী গৃহে ঈশ্বর আইলা।' বাতাসে জোর গুঞ্জন। উতলা গোবিন্দ দাস। 'তাই দরশনে চিত্ত আকুল হইলা।।' ঘাটে বসে নানা কথা ভাবছেন। 'হেন কালে শ্রীচৈতন্য আইলেন স্নানে/ কটিতে গামছা বাঁধা আশ্চর্য্য গঠন'। স্নানে একা আসেননি চৈতন্য। সঙ্গে আছেন নিত্যানন্দ, শ্রীবাস ঠাকুর, দামোদর, সিদ্ধ হরিদাস, গদাধর। একটু পরে এলেন অদ্বৈত গোঁসাই। সাঁতার কেটে নানা কায়দায় জল কেলি করে সকলে স্নানের আনন্দ নিচ্ছেন। হরিনামে আকাশ বিদীর্ণ করছেন অদ্বৈত---' হরিধ্বনি সহ বুড়া করহে চীৎকার'। স্নান সেরে ডাঙায় উঠলেন গোরা চাঁদ। বিস্ময় বিমুগ্ধ গোবিন্দ দাস---'আশ্চর্য প্রভুর রূপ হেরিতে লাগিনু। রূপের ছটায় মুহি মোহিত হইনু।।' কী সেই রূপ? জানাচ্ছেন গোবিন্দ দাস---- 'শুদ্ধ সুবর্ণের ন্যায় অঙ্গের বরণ। /নীলপদ্ম দল সম সুদীর্ঘ নয়ন।' শুধু কী তাই? 'প্রেমময় তনুখানি মুখে হরিবোল। / যারে পান দয়া করে তারে দেন কোল।।/ হরি বলি অশ্রুপাত করে মোর গোরা।/ পিচকারী ধারা সম বহে অশ্রুধারা।।'


      'চৈতন্য ভাগবত'-এ বৃন্দাবন দাস ঠাকুরও শ্রীচৈতন্যের চেহারার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। চৈতন্য তখনও সন্ন্যাস নেননি। তখনও তিনি নিমাই পণ্ডিত। বাবার পিণ্ডদান করে সদ্য গয়া থেকে ফিরেছেন। মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেছেন ঈশ্বরপুরীর। মনেপ্রাণে অপূর্ব ভাব । আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে তাঁর জীবনে। উধাও পাণ্ডিত্যের অহঙ্কার। প্রথম যৌবনের চপলতা। সারা ক্ষণ বিভোর কীর্তনানন্দে। নয়তো নগর সংকীর্তনে। টোল সামলাতে পারছেন না আগের মতো। ছাত্ররা ফিরে যাচ্ছে। খোল -করতাল- মৃদঙ্গ- পাখোয়াজের বোলে দুহাত তুলে নবদ্বীপ নৃত্যরত।


      এ দিকে নগরে 'হরিনাম' কীর্তন বন্ধের আদেশ জারি করেছেন চাঁদ কাজি, নবদ্বীপের প্রশাসক। শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে সেই আদেশ অমান্য করল নবদ্বীপবাসী। রুখে দাঁড়ালেন চৈতন্য। এই সময়কার বর্ণনা দিচ্ছেন বৃন্দাবন দাস---- 'দুই মহাভুজ হেন কনকের স্তম্ভ।/ পুলকে শোভয়ে যেন কনক-কদম্ব।।.. গজেন্দ্র জিনিয়া স্কন্ধ, হৃদয় সুপীন। তহিঁ শোভে শুক্ল যজ্ঞ সূত্র অতি ক্ষীণ।।' জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে অজস্র মানুষ প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন । এমন গাদাগাদি ঠাসাঠাসি ভিড় যে সরষে ফেললেও তা মাটিতে পড়বে না --'সরিষপ পড়িলেও তল নাহি হয়'। তাই বহু দূর থেকেও সবাই তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন। কারণ, তিনি এতটাই লম্বা ছিলেন ---'উন্নত নাসিকা সিংহ গ্রীব মনোহর। / সবা' হৈতে  সুপীত সুদীর্ঘ কলেবর।।'


      সন্ন্যাস গ্রহণের পরের একটি ঘটনা। সেবার শ্রীচৈতন্য এসেছেন রামকেলি নামে একটি গ্রামে। গ্রামটি গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের রাজধানীর কাছে। সেখানে তিনি রূপ- সনাতনের সঙ্গে দেখা করবেন। গোপনে। রূপ ও সনাতন দুই ভাই। তাঁরা ছিলেন হসেন শাহেরই দুই মন্ত্রী। সনাতন 'সাকর মল্লিক' অর্থাৎ রাজস্বমন্ত্রী। আর রূপ 'দবির খাস' অর্থাৎ ব্যক্তিগত সচিব। তাঁরা শ্রীচৈতন্যের কৃপাপ্রার্থী। তাই গোপনীয়তা। এ দিকে শ্রীচৈতন্য যে কৃষ্ণের অবতার এই বার্তা নবদ্বীপ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতেও। প্রচুর মানুষ দেখতে এসেছেন তাঁকে । ফলে খবর আর গোপন রইল না। কোটাল গিয়ে রাজাকে জানাল--- 'এক ন্যাসী আসিয়াছে রামকেলি গ্রামে।/ নিরবধি করয়ে ভূতের সংকীর্ত্তন।' হুসেন শাহ জানতে চাইলেন--- 'কহ কহ সন্ন্যাসী কেমন।/ কি খায়, কি নাম, কৈছে দেহের গঠন।।' কোটাল জানাচ্ছে--- ' শুন শুনহ গোসাঞি।/ এমত অদ্ভুত কভু দেখি শুনি নাই।।... জিনিয়া কনক কান্তি, প্রকাণ্ড শরীর।/ আজানুলম্বিত ভুজ, নাভি সুগভীর।।/ সিংহ -গ্রীব, গজ- স্কন্ধ, কমল নয়ান।/ কোটিচন্দ্র সে মুখের না করি সমান।।' আরও বিস্তর বিবরণ দেওয়ার পরেও কোটাল থামছে না --- 'ক্ষণে ক্ষণে সন্ন্যাসীর হেন কম্প হয়।/ সহস্র জনেও ধরিবারে শক্তি নয়।।/ দুই লোচনের জল অদ্ভুত দেখিতে। / কত নদী বহে হেন না পারি কহিতে।।'


      কৃষ্ণদাস কবিরাজ 'চৈতন্যচরিতামৃত'-এ লিখেছেন শ্রীচৈতন্যের শরীর ছিল 'প্রকাণ্ড 'এবং তিনি তার নিজের হাতের মাপের চারগুন লম্বা ছিলেন--- 'তপ্ত হেমসম কান্তি প্রকাণ্ড শরীর।/নবমেঘ জিনি কণ্ঠধ্বনি যে গম্ভীর।। /দৈর্ঘ্য বিস্তারে যেই আপনার হাত।/ চারি হস্ত হয় মহাপুরুষ বিখ্যাত।।' সাধারণত, মানুষ তার নিজের হাতের সাড়ে তিনগুন লম্বা হয়।


      যুধিষ্ঠির জানা-র 'শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য' বই-এ  একটি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ আছে, যে ঘটনা  থেকে চৈতন্যের শারীরিক শক্তির একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ঘটনাটি এরকম: চৈতন্যদেব পুরীতে এসেছেন। একদিন তিনি ভাবাবেশে জগন্নাথদেবকে দর্শন করার জন্য অগ্রসর হচ্ছেন। সামনেই মূল মণ্ডপ। সিংহাসন। দেববিগ্রহ। প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে প্রহরী। বিশালাকার বলিষ্ঠ শরীর অনন্ত গচ্ছিকার। অনন্ত তাঁকে সিংহাসনের দিকে অগ্রসর হতে নিষেধ করলেন। চৈতন্য ভাবাবেগে অনন্তকে হাত দিয়ে সরিয়ে সোজা এগোতে লাগলেন। তাতেই বিপত্তি। অনন্ত ছিটকে পড়ল পূজাপীঠ অনসরপিণ্ডি-তে। এই খবর তড়ি়ৎগতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল এবং রাজা প্রতাপরুদ্রও বিস্মিত হলেন এই ভেবে যে, এই মহাশক্তিধর বীর কি সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে বাইরের কোনও শত্রু?


      সচরাচর চৈতন্যের যে ছবি আমরা দেখতে অভ্যস্ত, এই বর্ণনার সঙ্গে তার মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। তাঁর বেশিরভাগ ছবিতে, নারীসুলভ কমনীয়তা ফুটিয়ে তোলা হয়। সেটা বোধহয় তাঁর দেহে শ্রীকৃষ্ণের সখীভাব স্পষ্টরূপে ফুটিয়ে তোলার জন্য। কিন্তু, এই বর্ণনা স্পষ্টতই একজন সুঠাম দীর্ঘদেহী সুপুরষ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে, যাঁর মধ্যে নারীসুলভ কোনও লক্ষ্মণ নেই। অথচ, যাঁর দেহকান্তির ভিতরে ছিল, অরূপের রূপ...যার আকর্ষণে ছুটে আসত ধনী- নির্ধন, উঁচু- নিচু হাজার হাজার মানুষ ।




*********************************************************************************************


গ্রন্থ ও তথ্যঋণ:

গোবিন্দদাসের কড়চা

মুরারি গুপ্তের কড়চা 

শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত: কৃষ্ণদাস কবিরাজ

শ্রীচৈতন্য ভাগবত: বৃন্দাবন দাস ঠাকুর 

শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধ্যন রহস্য: যুধিষ্টির জানা 

শ্রীচৈতন্যচরিতের উপাদানঃ ড.বিমানবিহারী মজুমদার

আন্তর্জাল: মিলনসাগর   


**********************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন